চীনের ইতিহাস
চীনের ইতিহাস | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
প্রাচীন যুগ | |||||||
নব্যপ্রস্তর যুগ আনু. খ্রিস্টপূর্ব ৮৫০০ - ২০৭০ অব্দ | |||||||
সিয়া সাম্রাজ্য আনু. খ্রিস্টপূর্ব ২০৭০ - ১৬০০ অব্দ | |||||||
শাং সাম্রাজ্য আনু. খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ - ১০৪৬ অব্দ | |||||||
চৌ রাজবংশ আনু. খ্রিস্টপূর্ব ১০৪৬ - ২৫৬ অব্দ | |||||||
পশ্চিম চৌ | |||||||
পূর্ব চৌ | |||||||
শরৎ বসন্ত কাল | |||||||
যুদ্ধরত রাজ্য কাল | |||||||
সামন্ততান্ত্রিক যুগ | |||||||
কিন সাম্রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব ২২১ - ২০৬ অব্দ | |||||||
হান সাম্রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ অব্দ - ২২০ খ্রিস্টাব্দ | |||||||
পশ্চিম হান | |||||||
সিন সাম্রাজ্য ৯ - ২৩ খ্রিস্টাব্দ | |||||||
পূর্ব হান | |||||||
তিন রাজ্য ২২০ - ২৮০ খ্রিস্টাব্দ | |||||||
চাও ওয়েই, শু হান ও পূর্ব য়ু | |||||||
চিন সাম্রাজ্য ২৬৫ - ৪২০ খ্রিস্টাব্দ | |||||||
পশ্চিম চিন | |||||||
পূর্ব চিন | ষোল রাজ্য | ||||||
উত্তর ও দক্ষিণ রাজবংশ ৪২০ - ৫৮৯ খ্রিস্টাব্দ | |||||||
সুই সাম্রাজ্য ৫৮১ – ৬১৮ খ্রিস্টাব্দ | |||||||
তাং রাজবংশ ৬১৮ – ৯০৭ খ্রিস্টাব্দ | |||||||
(দ্বিতীয় চৌ রাজবংশ ৬৯০–৭০৫ খ্রিস্টাব্দ) | |||||||
পাঁচ সাম্রাজ্য ও দশ রাজ্য ৯০৭ – ৯৬০ খ্রিস্টাব্দ |
লিয়াও রাজবংশ ৯০৭ – ১১২৫ খ্রিস্টাব্দ | ||||||
সং রাজবংশ ৯৬০ – ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ |
|||||||
উত্তর সং | পশ্চিম সিয়া | ||||||
দক্ষিণ সং | চিন | ||||||
ইউয়ান রাজবংশ ১২৭১ – ১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দ | |||||||
মিং রাজবংশ ১৩৬৮ – ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ | |||||||
চিং রাজবংশ ১৬৪৪ – ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ | |||||||
আধুনিক যুগ | |||||||
গণতান্ত্রিক চীন ১৯১২ – ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ | |||||||
গণচীন ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ – বর্তমান |
গণচীন (তাইওয়ান) ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ – বর্তমান | ||||||
হুয়াংহো নদীকে চৈনিক সভ্যতার সুতিকাগার বলা হয়। হাজার হাজার বছর ধরে হুয়াংহো ও ইয়াংসিকিয়াং নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা অনেক আঞ্চলিক সংস্কৃতি চীনের সভ্যতাকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করেছে। কয়েক হাজার বছরের ধারাবাহিক ইতিহাসে চৈনিক সভ্যতা পৃথিবীর আদিম সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম।[১] এই কারণে চৈনিক সভ্যতাকে মানব সভ্যতার অন্যতম সুতিকাগার বলা হয়।[২] খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সাল থেকে চীনের শাং সাম্রাজ্যের (১৬০০ থেকে ১০৪৬ খ্রিস্টপূর্ব) [৩] আমলে লিখিত ও গ্রহণযোগ্য ইতিহাস পাওয়া যায়।[৪][৫] প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ যেমন ‘রেকর্ড অব গ্রান্ড হিস্টোরিয়ান’ (১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) এবং ‘বাম্বু এ্যানালস’ এ সিয়া সাম্রাজ্য এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন থেকে শাং সাম্রাজ্যের আমল পর্যন্ত লিখিত কোন দলিল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার কোন উপায় চীনাদের জানা ছিল না।[৩][৬]
ঝউ রাজবংশের (১০৪৬ থেকে ২৫৬ খ্রিস্টপূর্ব) আমলে চীনের সংস্কৃতি, সাহিত্য ও দর্শনের প্রভূত উন্নতি হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দী থেকে ঝউ শাসকরা নানা রকম অভ্যন্তরিন ও বাইরের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে শুরু করে এবং এক সময় বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা ‘শরৎ’ ও ‘বসন্ত‘ পর্ব (Spring and Autumn period) থেকে শুরু হয় এবং ‘আন্তঃরাজ্য যুদ্ধাবস্থা’ (Warring States period) এর সময়ে পূর্নরূপ লাভ করে। এই সময়কালটি ছিল চীনের ইতিহাসের অন্যতম ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রীয় শাসনামল’। এই ব্যর্থ রাষ্ট্রীয় শাসনামলের সর্বশেষ সময়টি ছিল ১৯২৭ সালে চীনের গৃহযুদ্ধের সময়।
বহু রাজ্য ও যুদ্ধবাজ নেতাদের শাসনামলে চৈনিক রাজবংশগুলো বর্তমান চীনের অংশবিশেষ শাসন করত। যার সীমানা বর্তমান জিংজিয়ান এবং তিব্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কিন শি হুয়াং বিভিন্ন যুদ্ধরত রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে কীন বংশের একটি ক্ষুদ্র “সাম্রাজ্য” (হুয়াংডি) প্রতিষ্ঠা করে, চৈনিক সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সূচনা করেন। পরবর্তী রাজবংশগুলো শাসনব্যবস্থায় একটি জনপ্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল যা ক্রমে তৎকালিন চীনের বিশাল এলাকায় চৈনিক সম্রাটের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ভূমিকা রাখে। চীনের সর্বশেষ সাম্রাজ্য ছিল কিং সাম্রাজ্য (১৬৪৪ থেকে ১৯১২), যার উচ্ছেদের পর ১৯১২ সালে রিপাবলিক অব চায়না, এবং ১৯৪৯ সালে গনপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রচলিত চৈনিক ইতিহাসে পর্যায়ক্রমে রাজনৈতিক ঐক্য এবং অনৈক্যের চিত্র দেখা যায়, আরও দেখা যায় যে স্তেপ জাতি দ্বারা চীন শাসিত হবার ইতিহাস। পরবর্তীকালে যারা চৈনিক হান জাতির জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব, অভিবাসন, বৈদেশিক বাণিজ্য ও চুক্তি ইত্যাদি আধুনিক চীনের সংস্কৃতি গঠনে ভূমিকা পালন করেছে;চিনে প্রথম বারুদের ব্যবহার হয়েছিল।
পৌরাণিক চীন
[সম্পাদনা]প্রাচীন চৈনিক লোকগাঁথা থেকে জানা যায়, পৃথিবী সৃষ্টির আগে সবকিছু ছিল খুব বিশৃঙ্খল। এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে ‘ইয়াং’ ও ‘ইন’ নামের দুইটি শক্তির জন্ম হয়। এই শক্তিদুটি কালো ও সাদা রঙের একটি বৃত্তের মধ্যে চক্রাকারে ঘুড়তে থাকে। বৃত্তের কালো অংশ থেকে সৃষ্টি হয় নারী সত্ত্বা ও সাদা অংশ থেকে সৃষ্টি হয় পুরুষ সত্ত্বা। এদের থেকে জন্ম হয় ‘পানকু’ নামের এক বিরাট আকারের মানুষ। এই পানকু আসলে পৃথিবীর একটি রূপ। এই পানকুকে খুশি করার জন্য চন্দ্র, সূর্য আর তারা সৃষ্টি করা হয়। পানকুর মাথা থেকে পর্বত সৃষ্টি হয়। নিঃশ্বাস থেকে মেঘের সৃষ্টি হয়। শিরা উপশিরা থেকে নদী আর গায়ের পশম থেকে গাছপালার জন্ম হয়। বিশাল পানকুর গায়ে যে সব পোকামাকড় ছিল সেগুলো কালক্রমে হয়ে যায় মানুষ আর অন্যান্য পশুপাখি। ফিনিক্স পাখি, বিশাল কালো কচ্ছপ আর ড্রাগন ছিল পানকুর সহকারী। একসময় ড্রাগনকে চীন ও পার্শবর্তি দেশগুলোতে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে বিশ্বাস করা হত।[৭]
প্রাক ইতিহাস
[সম্পাদনা]পুরাতন প্রস্তরযুগ
[সম্পাদনা]দশ লাখ বছর পূর্বে প্রাগৈতিহাসিক কালে, হোমো ইরেক্টাস নামে মানুষের একটি প্রজাতি চীনের ভূখণ্ডে বসবাস করত। [৮] অধুনা গবেষণায় দেখা যায় যে, জিয়াওচাংলিয়ানে প্রাপ্ত পাথরের হাতিয়ার ১.৩৬ মিলিয়ন বছর পুরাতন। [৯] সাংঝি প্রদেশের Xihoudu এর প্রত্নস্থানটিতে হোমো ইরাক্টাসদের আগুন ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা ১.২৭ মিলিয়ন বছর পুরাতন।[৮] Yuanmou এর প্রত্নস্থান খননের পর সেখানে প্রাচীন মানুষের আবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে ১৯২৩-২৭ সালে প্রাপ্ত হোমো ইরেক্টাস জাতির প্রাচীন মানুষের কঙ্কালটি সবচেয়ে পরিচিত যা তথাকথিত ‘পিকিং’ মানুষ হিসাবে পরিচিত। Hunan প্রদেশের Fuyan গুহা এবং Dao কাউন্টিতে প্রাপ্ত হোমো সেপিয়েন্সের প্রাপ্ত ফসিলীকৃত দাঁতের বয়স ১,২৫,০০০ থেকে ৮০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।[১০]
নবপ্রস্তরযুগ
[সম্পাদনা]খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ বছর আগের সময়কালকে নবপ্রস্তর যুগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।[১১] সবচেয়ে পুরাতন প্রাক-চৈনিক যুগের কৃষিকাজ হিসাবে মিলেট চাষের যে নিদর্শন পাওয়া যায় তার কার্বন ডেটিং অনুসারে উৎপাদিত হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ সালে।[১২] একই ভাবে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, Yangtze নদীর তীরে রোপন করা ধান ৮,০০০ বছর পুরাতন।[১৩] তৎকালিন জিহাউ সংস্কৃতি ছিল কৃষিভিত্তিক (৭০০০ থেকে ৫৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)।
ব্রোঞ্জ যুগ
[সম্পাদনা]Majiayao সংস্কৃতির প্রত্নস্থানে খ্রিঃপূঃ ৩১০০ থেকে ২৭০০ এর মধ্যবর্তী সময়ের পুরাকীর্তি পাওয়া গেছে,[১৪][১৫] চীনের সর্ব উত্তরের অঞ্চলে নিম্ন Xiajiadian সংস্কৃতিতেও ব্রোঞ্জ যুগের আরও নিদর্শন পাওয়া গেছে।[১৬])।
মহাপ্রাচীর, রেশম ও কাগজ
[সম্পাদনা]মহাপ্রাচীর
[সম্পাদনা]খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী থেকে ১৬শ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষার জন্য এই প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। প্রথম চীন সম্রাট শি হুয়াং দি এই প্রাচীর নির্মাণ শুরু করেন। এই প্রাচীরের মোট দৈর্ঘ্য ২১,১৯৬ কিমি। উচ্চতা ৫ থেকে ৮ ফুট। প্রাচীন চীনের উত্তর সীমান্তে কিছু ছোট রাজ্যে যাযাবর জাতীর মানুষ বাস করত। তারা প্রায়ই চীনের ভূখণ্ডে হামলা চালাত। তাদের এই অনুপ্রবেশে বাধা দানের জন্য বিভিন্ন সময়ে চীন সম্রাটরা প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। মহাপ্রাচীরটি সাংহাই পাস থেকে লোপনুর পর্যন্ত অবস্থিত।
রেশম
[সম্পাদনা]প্রাচীনকাল সর্বপ্রথম চীনে রেশমগুটির চাষের প্রচলন হয়।[১৭] সম্ভবত খ্রিস্টের জন্মের ৩,৫০০ আগে থেকেই চীনারা রেশমের ব্যবহার করত।[১৮] প্রাচীন চীনে রাজপরিবার ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই কেবল রেশমের কাপড় ব্যবহার করত। কোন কিছু লেখার জন্য রেশম ব্যবহার করা হত। চীন থেকে ক্রমান্বয়ে জাপান, কোরিয়া ও ভারতে এর চাষ ছড়িয়ে পরে।
প্রাচীন চীন
[সম্পাদনা]সিয়া সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ থেকে ১৬০০ অব্দ)
[সম্পাদনা]প্রাচীন চৈনিক শাসকদের মধ্যে সিয়া সাম্রাজ্যের (খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ থেকে ১৬০০ অব্দ) প্রামান্য ইতিহাস সবচেয়ে পুরান। এর প্রমাণ সিমা কিয়ান এর “রেকর্ডস অব গ্রান্ড হিস্টোরিয়ান” ও ”ব্যাম্বু এনালস“ এ পাওয়া যায়।[৩][৬] যদিও প্রকৃতই এই রাজবংশের অস্তিত্ব ছিল কিনা সে বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে এই রাজবংশের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সিমা কিয়ান লিখেছিলেন যে সিয়া সাম্রাজ্য আনুমানিক ২২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীন শাসন করে ছিল। যদিও এই তথ্য সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়নি। অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক সিয়া রাজবংশকে এর লি থৌ এবং Henan এর সাথে সম্পর্কৃত মনে করেন।[১৯] যেখান থেকে মাটি খনন করে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে নির্মিত একটি ব্রোঞ্জ গলানোর যন্ত্র পাওয়া গেছে।[২০] প্রাপ্ত কিছু মৃৎপাত্রে কিছু প্রাচীন প্রতীক দেখা যায় যা আধুনিক চৈনিক অক্ষরের আদি রূপ বলে মনে করা হয়।[২০]
ইয়ু দ্য গ্রেট এ বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক। তিনি খাল খননের মাধ্যমে মহাপ্লাবন মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। [২১][২২] পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, এই রাজবংশ প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ অব্দে মিঙতিয়াও যুদ্ধে বিলুপ্ত হয়।
শাং সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১০৪০ অব্দ)
[সম্পাদনা]প্রাপ্ত প্রত্নতাত্মিক নিদর্শনসমূহ নির্দেশ করে যে শাং সাম্রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১০৪৬ পর্যন্ত চীন শাসন করে। সাং শাসনকালের প্রমাণসমুহ দুইটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগটি, Erligang, Zhengzhou, এবং Shangcheng উৎস থেকে এসেছে।
চৌ রাজবংশ (খ্রিস্টপূর্ব ১০৪৬ থেকে ২৫৬ অব্দ)
[সম্পাদনা]চৌ রাজবংশ চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশ। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে হলুদ নদী অববাহিকায় সাং বংশের অধিকৃত এলাকার উপর চৌ রাজবংশের উত্থান শুরু হয়। আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার আদলে চৌ শাসন শুরু হয়েছিল। চৌরা সাংদের পশ্চিমে বাস করত। চৌ সেনাপতিদেরকে পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। Muye এর যুদ্ধে চৌ শাসক রাজা উইউ, তার ভ্রাতা চৌএর জমিদারের সম্মিলিত বাহিনীর সাহায্য নিয়ে সাং বাহিনীকে পরাজিত করে। চৌ রাজা এই সময়ে তার ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে ‘স্বর্গাদেশ’ ধারনার প্রচার করেন। এই ধারনাটি তখনকার আমলে অধিকাংশ সম্রাটকে শাসক হিসাবে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল। সাংডি মতে, স্বর্গ (tian) সকল দেবতাদের সেরা এবং তিনিই নির্দেশ দেন কে পরবর্তী শাসক হবেন। জনমনে বিশ্বাস ছিল যে যদি ঘন ঘন প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা দেয় তাহলে ধরে নিতে হবে সম্রাট তার স্বর্গাদেশ হারিয়েছেন। ফলস্রুতিতে শাসককে উৎখাত করা হত, এবং স্বর্গাদেশ প্রাপ্ত অন্য কাউকে শাসনভার দেয়া হত।
শরৎ-বসন্ত যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ থেকে ৪৭৬ অব্দ)
[সম্পাদনা]খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীতে, শরৎ ও বসন্তকালে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। এ যুগের নামকরণ করা হয় তৎকালিন প্রভাবশালী শরৎ বসন্ত ইতিবৃত্ত এর নামে। এই সময়ে, আঞ্চলিক সামরিক প্রধানরা চৌ সম্রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষমতা লাভ করার জন্য পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। পরিস্থিতির আরও অবনতি হয় যখন উত্তর পশ্চিম অঞ্চল থেকে কিছু বহিরাগতরা (যেমন কিন জাতি) আক্রমণ শুরু করলে চৌরা তাদের রাজধানী আরও পূর্বে সরিয়ে নেয়। এভাবে চৌ রাজবংশের দ্বিতীয় ধারা: পূর্ব চৌ এর জন্ম হয়। শরৎ-বসন্ত যুগ ছিল অবিভক্ত চৌ সম্রাজ্যের বিভক্ত হওয়ার কাল। এ সময়ে কয়েক শত ছোট ছোট রাজ্যের উত্থান হয়। এই রাজ্যগুলো নামে মাত্র চৌ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রকৃত অর্থে তারা স্বাধীনভাবে শাসন করত। কিছু রাজ্যের শাসকগন রাজকীয় পদবীও গ্রহণ করেছিলেন। তখনকার চীন ছিল এসব ছোট ছোট রাজ্যের সমষ্টি। যাদের মধ্যে কিছু কিছু রাজ্যের আয়তন একটি গ্রাম এবং একটি কেল্লার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এই সময়ে অনেক দার্শনিক মতবাদের জন্ম হয়। এসব মতবাদ বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের জন্ম দেয়। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, কনফুসীয় ধর্ম, তাও ধর্ম, লিগালিজম এবং মহিজম। তৎকালিন রাজনৈতিক ক্রমধারা ও ঘটনাপ্রবাহ আংশিকভাবে এসকল মতবাদের পিছনে কাজ করেছিল।
আন্তঃরাজ্য যুদ্ধাবস্থা (খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৬ থেকে ২২১ অব্দ)
[সম্পাদনা]রাজনৈতিকভাবে একিভূত হবার পর, খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর শেষে সাতটি প্রভাবশালী বৃহৎ রাজ্য স্বাধীনভাবে টিকে ছিল। বেশ কিছু বছর এই সাতটি রাজ্য পরস্পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এই সময়টিকে বলা হয় আন্তঃরাজ্য যুদ্ধাবস্থার যুগ বা Warring States period। খ্রিস্টপূর্ব ২৫৬ পর্যন্ত স্থায়ী হলেও চৌ রাজবংশ মূলতঃ আলংকরিক রাজা ছিলেন। প্রকৃত ক্ষমতা তাদের হাতে ছিল না।
এই যুগের চূড়ান্ত সম্প্রসারণ শুরু হয় কীন রাজা ইং জেং এর শাসনকালে। তিনি অন্য ছয়টি শক্তিশালী রাজ্যকে একত্রিত করেন। খ্রিস্টপূর্ব ২১৪ সালে তিনি পার্শ্ববর্তী আরও এলাকা আধুনিক চীনের Zhejiang, Fujian, Guangdong এবং Guangxi তার রাজ্যের সাথে যোগ করেন। তার সম্রাজ্যের আকার বৃদ্ধি পায় এবং তিনি নিজেকে চীনের সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করেন। চীনের ইতিহাসে তিনিই ছিলেন প্রথম সম্রাট (কিন শি হুয়াং)।
চীন সাম্রাজ্য
[সম্পাদনা]ছিন সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ২২১ থেকে ২০৬ অব্দ)
[সম্পাদনা]চীন তখন হান, ওয়েই, চাও, ছি, ছু এবং ইয়ান এই ছয়টি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। রাজা ছিন শি হুয়াং এই ছয়টি রাজ্যকে একত্রিত করে ছিন সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন। ইতিহাসে তিনি প্রথম চৈনিক সম্রাট (始皇帝) হিসেবে পরিচিত। দুর্ধর্ষ তাতার জাতির (মঙ্গোল জাতি) হাত থেকে চীনকে রক্ষা করার জন্য তিনি সমগ্র চীনের উত্তর সীমান্ত জুড়ে প্রাচীর নির্মাণের উদ্যোগ নেন। যা চীনের মহাপ্রাচীর নামে পরিচিত। যদিও বর্তমানে সেই প্রাচীরের সামান্য কিছু অংশের অস্তিত্ব আছে। ছিন সি হুয়াং তার প্রধানমন্ত্রী লী সিংকে সাথে নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার করন।[২৩] এছাড়া শি হুয়াং এর অবদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা, একক আইন ও ধারা প্রনয়ন, লেখ্য ভাষার প্রবর্তন, এবং মুদ্রার প্রচলন।
পশ্চিম হান
[সম্পাদনা]লিউ বাং হান বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। একগৃহযুদ্ধে স্বল্পস্থায়ী কিন বংশের পতন হয়। হান শাসনামল ছিল চীনের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। হান শাসকরা রাজনৈতিক স্থায়ীত্ব ও উন্নতির পাশাপাশি পরবর্তি দুই সহস্রাব্দের জন্য চৈনিক সম্রাজ্যকে একটি কঠিন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পান। এই শাসনামলে চৈনিক সম্রাজ্য ’মূল চীন’ (China proper বা চীনের ১৮ প্রদেশ) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পশ্চিমের ভূখণ্ডও চৈনিক সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কনফুশিয় মতবাদ সরকারিভাবে মৌলভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মতবাদ চৈনিক সভ্যতার সঠিক রূপায়নে অবদান রাখে। এই শাসনামলে কলা, সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। হান সম্রাজ্যের গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের কারণে সমগ্র চীন জাতির মানুষ একসময় ‘‘হান” হিসাবে পরিচত ছিল। এই হান জাতি বর্তমান চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠী।
সিন সাম্রাজ্য
[সম্পাদনা]৯ম খ্রীস্টাব্দে, দখলদার ওয়াং মাং দাবী করেন যে হান বংশের উপর স্বর্গাদেশ আর বলবৎ নেই। তিনি হান শাসনামলের সমাপ্তি ও স্বল্পস্থায়ী ‘সিন’ (নতুন) বংশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ওয়াং মাং ভূমি ও অর্থনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি দাস প্রথা রোহিতকরন এবং ভূমি জাতীয়করণ পুনর্বণ্টন সহ বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সাধারন কৃষকদের স্বার্থে গৃহীত এ সকল প্রকল্প ভূমির মালিক ধনাঢ্য ব্যক্তি ও পরিবারের সমর্থন পায়নি। ক্ষমতার অস্থিরতা বিশৃঙ্খলা, বিদ্রোহের জন্ম দেয় সেই সাথে অনেক অঞ্চল সম্রাটের হাতছাড়া হয়ে যায়। হলুদ নদীর আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়; বন্যা ও পলিমাটির আস্তরন বিশাল এলাকায় কৃষক জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করে। ২৩ খ্রিষ্টাব্দে একদল ক্রদ্ধ কৃষক, ওয়াং মাংকে তার Weiyang প্রাসাদে হত্যা করে।
পূর্ব হান
[সম্পাদনা]সম্রাট গুয়াংউ জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের সাহায্যে হান বংশকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। পুরাতন রাজধানী জি’য়ানের কিছু পূর্বে নতুন হান রাজধানী স্থাপন করার জন্য এই নতুন হান সম্রাজ্যের নামকরণ করা হয় পূর্ব হান বংশ। সম্রাট মিং ও জাং, আরও অধিক কর্মক্ষম প্রশাসনযন্ত্রের সাহায্যে হানদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। পাশাপাশি সামরিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও প্রচুর উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। হানদের হাতে জিয়ংজু সম্রাজ্যের পতন ঘটে। রাষ্ট্রদূত ও সেনাপতি বান চাও পামীর পর্বতের মধ্য দিয়ে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত সম্রাজ্যের সীমানা বিস্তার করেন।[২৪] সিল্ক রুটের সূচনা হয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের পথ সুগম হয় সেই সাথে চীনে বৌদ্ধ মতবাদের আগমন হয়।
পূর্ব হান শাসনামল ছিল প্রাচীন চিনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতির কাল। বিশেষ করে কাই লুনের কাগজের আবিষ্কার এবং বহুবিদ জ্যাং হেংএর অগণিত অবদান।
রাজ্যত্রয় (২২০ থেকে ২৮০ খ্রিস্টাব্দ)
[সম্পাদনা]খ্রীস্টিয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভূমি দখল, বহিঃশত্রুর আক্রমণ এবং বিভিন্ন গোত্র ও খোজাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিবাদের কারণে চৈনিক সম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। ১৮৪ সালে ‘হলুদ পাগড়ি বিদ্রোহ’ দেখা দেয়, সেই সাথে সূচনা হয় যুদ্ধবাজ নেতাদের যুগ। এসব হাঙ্গামার সময়, তিনটি সম্রাজ্য তাদের আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট ছিল। এই সময়টি চৈনিক ইতিহাসে রাজ্যত্রয় (Three Kingdoms) হিসাবে পরিচিত। ‘রোমান্স অব দ্যা থ্রি কিংডমস’ সাহিত্যকর্মে এসময়কার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
চাও কাও ২০৮ সালে চীনের উত্তর অংশ পুনঃএকত্রিকরন করেন। পরবর্তীতে তার পুত্র ২২০ সালে উই বংশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। উই এর প্রতিদ্বন্দ্বি শু এবং উ বংশ তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ফলস্রুতিতে চীন তিনটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে কিন ও হান শাসনামলের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ভেঙে পরে। এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা কিছু বৃহৎ পরিবারের হাতে চলে আসে।
২৬৫ সালে জিন বংশ উইদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে এবং ২৮০ সালে তারা চীনকে ঐক্যবদ্ধ করে। তবে এই ঐক্য ক্ষনস্থায়ী ছিল।
জিন সাম্রাজ্য (২৬৫ থেকে ৪২০ খ্রিস্টাব্দ)
[সম্পাদনা]অ-হান অভিবাসিদের বিদ্রোহের পর উত্তর চীন হাতছাড়া হয়ে যায়। বিদ্রোহীরা Luoyang এবং Chang’an দখল করে নেয়। এছাড়া রাজপুত্রদের মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত জিন শাসনকে ক্রমেই দূর্বল করে ফেলে। ৩১৭ সালে, একজন জিন রাজকুমার, নানজিং সম্রাট হন। ইতিহাসে এই নতুন সম্রাজ্য পূর্ব জিন সম্রাজ্য নামে পরিচিত। এই সম্রাজ্য পরবর্তী এক শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল।
উত্তর চীন কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এসব রাজ্যের বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল Xiongnu, Xianbei, Jie, Di এবং Qiang শাসকদের দ্বারা। এসব শাসকরা হান জাতিভূক্ত ছিল না। তারা ছিল তূর্কী, মঙ্গল এবং তিব্বতীয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষ।
উত্তর ও দক্ষিণের রাজবংশ সমূহ (৪২০ থেকে ৫৮৯ খ্রিস্টাব্দ)
[সম্পাদনা]পঞ্চম শতাব্দীর শুরুতে চীন নতুন একটি যুগে প্রবেশ করে যা উত্তর ও দক্ষিণের রাজবংশ (Northern and Southern dynasties) নামে পরিচিত। এ সময় উত্তর ও দক্ষিণ চীনে সমান্তরাল কিন্তু পৃথক শাসনক্ষমতা বিরাজমান ছিল।
সুই সাম্রাজ্য (৫৮৯ থেকে ৬১৮ খ্রিস্টাব্দ)
[সম্পাদনা]সুই রাজবংশ মাত্র ২৯ বছর টিকে ছিল। কিন্তু স্বল্পকালের শাসন চীনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সুইরা চীনকে পুনরায় একত্রিক করে। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিল যেগুলো পরবর্তী শাসকরা পরিগ্রহণ করেছিলেন। এ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, তিনটি বিভাগ বিভক্ত সরকার ব্যবস্থা, ছয়টি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, মুদ্রাব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি, মহাপ্রাচীরের সম্প্রসারণ, এবং বৌদ্ধ ধর্মকে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা দান। কিনদের মতো সুই সম্রাটরাও প্রাপ্ত সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার শুরু করেন যার ফলে তাদের পতন ত্বরান্বিত হয়।
তাং সাম্রাজ্য (৬১৮ থেকে ৯০৭ খ্রিস্টাব্দ)
[সম্পাদনা]৬১৮ সালের ১৮ই জুন সম্রাট গাউজু তাং রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এ শাসনামল ছিল কলা, সাহিত্য, বিশেষ করে কাব্য সাহিত্য এবং কারিগরী উৎকর্ষের স্বর্ণ যুগ। এ শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্ম সাধারণ মানুষের ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। তাং সম্রাজ্যের রাজধনী Chang'an ছিল তৎকালিন বিশ্বের সর্ববৃহৎ নগরী।
দ্বিতীয় তাং সম্রাট তেইজং, যাযাবর জাতির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। চীন সম্রাজ্যের সীমানা আরও বিস্তার লাভ করে। তিনি প্রতিবেশী ছোট ছোট রাজ্যগুলোকে ট্রিবিউটারি ব্যবস্থার অন্তর্গত করেন। তা’রিম অববাহিকার সামরিক অভিযান সিল্ক রুট খোলা রাখে এবং মধ্য এশিয়ার সাথে চীনের যোগাযোগের পথ সুগম করে। দক্ষিণে গুয়াংজু বন্দরের মতো লাভজনক বাণিজ্যিক সমুদ্রপথ চালু হয়। দূরবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্য চলতে থাকে, এবং অনেক বিদেশী বণিকদের চীন বসতি স্থাপন করে যা একটি কসমোপলিটন বিশ্বজনীন সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে। তাংদের সামাজিক ও সংস্কৃতিক ব্যবস্থা জাপানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো অনুকরন করতে শুরু করে। অভ্যন্তরীনভাবে গ্রান্ড ক্যানেলের সম্প্রসারণ, চীন সম্রাজ্যের রাজনৈতিক কেন্দ্র চ্যাংগা’নের সাথে কৃষি ও অর্থনীতির প্রানকেন্দ্র, চীনের পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশকে সংযু্ক্ত করে। তাং রাজবংশের সমৃদ্ধির পিছনে ছিল একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র। তিনটি বিভাগ ও ছয় মন্ত্রণালয়ে বিভক্ত প্রশাসনযন্ত্র একই সাথে রাজপরিবারের সদস্য ও মেধাবী কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হত। রাজকীয় পরীক্ষার মাধ্যমে এ সব কর্মকর্তাদের বাছাই করা হত। এসকল প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরবর্তী শাসকরাও বহাল রাখেন।
পঞ্চ বংশ ও দশ রাজ্য (৯০৭ থেকে ৯৭০ খ্রিস্টাব্দ)
[সম্পাদনা]৯০৭ থেকে ৯৭০ খ্রীস্টাব্দ পর্য়ন্ত চীনের ইতিহাসের রাজনৈতিক অনৈক্যকে বলা হয় ‘পঞ্চ বংশ ও দশ রাজ্যর শাসনামল’ (Five Dynasties and Ten Kingdoms period)। দীর্ঘ অর্ধশত বছর যাবত চীন ছিল একটি বহুরাজ্য শাসিত অঞ্চল। পাঁচটি রাজবংশ একের পর এক উত্তরাঞ্চলের সাবেক চীন সম্রাজ্যের কেন্দ্রসমূহের শাসন ক্ষমতা দখল করে। একই সময়ে দক্ষিণ ও পশ্চিম চীনে দশটি রাজ্যের শাসন অপেক্ষাকৃত স্থায়ী ছিল।
সং, লিয়াও, ঝিন এবং পশ্চিম সিয়া সাম্রাজ্য (৯৬০ থেকে ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দ)
[সম্পাদনা]৯৬০ সালে সং বংশ চীনের অধিকাংশ অঞ্জলের শাসন ক্ষমতা দখল করে এবং কাইফেং এ রাজধানী স্থাপন করে (পরবর্তীতে বিয়নজিং নামে পরিচিত)। এ সময় চীন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়। এ সময় কিতাল লিয়াও মাঞ্চুরিয়া, মঙ্গলিয়া এবং উত্তর চীনের কিছু অংশ শাসন করত।
ইউয়ান সাম্রাজ্য (১২৭১ থেকে ১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দ)
[সম্পাদনা]Jurchen ছিলেন ঝিন বংশের প্রতিষ্ঠাতা যিনি মঙ্গলদের দ্বারা পরাজিত হয়েছিলেন। এরপর মঙ্গলরা দক্ষিণ সং রাজ্যের দিকে অগ্রসর হয় এবং এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এটাই ছিল প্রথম যুদ্ধ যেখানে আগ্নেয়াস্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই যুদ্ধের পরবর্তী সময়কে বলা হয় Pax Mongolica, এ সময় মার্কো পোলো ও অন্যান্য ইউরোপীয় পরিব্রাজকরা চীন ভ্রমণ করেন এবং চীন সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য ইউরোপে পৌছায়। ইউয়ান শাসনামলে, মঙ্গলদেরকে দুইটি অংশে ভাগ করা হয়, একটি অংশ স্তেপে থেকে যায় এবং আর একটি অংশ চৈনিক রীতিনীতি গ্রহণ করে। চেঙ্গিস খানের পৌত্র কুবলাই খান ইউয়ান বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ইউয়ান শাসনামলে সর্ব প্রথম বেইজিং থেকে সমগ্র চীন সম্রাজ্য পরিচালিত হয়। এর আগে ঝিন সম্রাটদের রাজধানী ছিল বেইজিং। কিন্তু তারা সমগ্র চীনের শাসক ছিলেন না। মঙ্গলদের আগ্রাসনের পূর্বে চীনের জনসংখ্যা ছিল ১২০ মিলিয়ন। ১২৭৯ সালে যুদ্ধ শেষ হবার পর চীনের জনসংখ্যা ছিল ৬০ মিলিয়নের মত।[২৫] Frederick W. Mote এর মতে যুদ্ধ জনসংখ্যার এই ব্যাপক হ্রাসের একমাত্র কারণ ছিল না। পূর্বে জনসংখ্যার গণনা সঠিক ছিল না বলে তিনি মনে করেন।
১৪ শতাব্দীতে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে ২৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। যা ছিল তৎকালিন জনসংখ্যার ৩০%।[২৬]
মিং সাম্রাজ্য (১৩৬৮ থেকে ১৬৪৪ খ্রীস্টাব্দ)
[সম্পাদনা]ইউয়ান বংশ এক শতাব্দীরও কম সময়ে চীনের শাসন ক্ষমতায় ছিল। মঙ্গলদের শাসনের বিরুদ্ধে এ সময়ে চৈনিক জনগনের মনে অষোন্তষ তৈরী হয়েছিল। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দূর্যোগ আঘাত হানার পর এই অষোন্তোষ ১৩৪০ সালে ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহে রূপ নেয়। ১৩৪৮ সালে মিং বংশ ইউয়ান বংশকে উৎখাত করে। ব্যাপক নগরায়ন হতে থাকে। সেই সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। জটিল শ্রম বিভাজন প্রক্রিয়া শুরু হয়। নানজিং ও বেইজিং এর মতো নগর কেন্দ্রগুলো বেসরকারী শিল্পের প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে, কাগজ, সিল্ক, তুলা এবং পোর্সালিনকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্রাকার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। সমগ্র সম্রাজ্য জুড়ে ছোট ছোট নগর-বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
ভিনদেশী আতঙ্ক বা জেনোফোবিয়া অথবা নব্য-কনফুসিয়াসম ধারনার ব্যাপক প্রচলন সত্যেও মিং শাসিত চীন বহিঃবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। বৈদেশিক বাণিজ্য ও অন্যান্য যোগাযোগ বিশেষ করে জাপানের সাথে জোড়াল কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। চৈনিক বনিকরা ভারত মহাসাগরে অনুসন্ধান পরিচালনা করে, চৈনিক পর্যটক জেং হি পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে পৌছান।
মিং বংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট হংওউ বাণিজ্যের চেয়ে কৃষির উপর কর আরোপে বেশি উৎসাহি ছিলেন। সম্ভাব্য কারণ ছিল এই যে এ রাজবংশের পূর্বপুরুষরা কৃষক ছিলেন। পূর্বতন সং ও মঙ্গোলিয়ান শাসকদের মতো তাদের কর ব্যবস্থা বাণিজ্য নির্ভর ছিল না। মিং শাসকরা তাদের পূর্বসূরী সং ও মঙ্গলদের নব্য-সামান্ত ব্যবস্থার আমলের ভূ-স্বামীদের কাছ থেকে ভূমি বাজেয়াপ্ত করেন। সকল ভূমি এস্টেট গুলো জব্দ করা হয় এবং প্রকৃত কৃষকদেরকে লীজ প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত দাসপ্রথা রোহিত করা হয়। ফলশ্রুতিতে চীনে স্বাধীন কৃষকশ্রেণীর আবির্ভাব হয়। মিং শসকদের এসকল কর্মকান্ডের ফলে কৃষি নির্ভর চীন সমাজে ধীরে ধীরে দারিদ্র কমতে থাকে।
মিং শাসকরা একটি দৃঢ় এবং জটিল কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ক্রমেই মিং শাসকরা একচ্ছত্র স্বৈরশাসকে পরিনত হয়।
ছিং সাম্রাজ্য (১৬৪৪ থেকে ১৯১১)
[সম্পাদনা]ছিং রাজবংশ চীনের ইতিহাসের সর্বশেষ রাজবংশ। মাঞ্চুসরা এই বংশ প্রতিষ্ঠা করে। অ-হান চৈনিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় রাজবংশ যারা সমগ্র চীন শাসন করেছিল। মাঞ্চুরা পূর্বে Jurchens নামে পরিচিত ছিল। যারা উত্তর পশ্চিম চীনে মিং শাসিত এলাকার বাইরে মহাপ্রাচীরের অপর প্রান্তে বসবাস করত। মিং বংশের শেষ শাসকদের নিকট তারা একসময় বড় রকম হুমকি ছিল। বিশেষ করে নুরচাই যথন সকল জুরচেন উপজাতিদেরকে সংঘবদ্ধ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। যদিও, শেষ মং সম্রাট চংজেন, এক কৃষক বিদ্রোহের ১৬৪৪ সালে সিংহাসনচ্যুত হবার পর আত্মহত্যা করেন। মাঞ্চুরা একজন প্রাক্তন মিং সেনাপতির সাথে সন্ধিবদ্ধ হয়ে চীন আক্রমণ করেন। প্রথমে বেইজিং দখল করে রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন। পরে ধীরে ধীরে দক্ষিণের এলাকাগুলো দখল করেন। মাঞ্চু শাসনামলে প্রচুর প্রানহানি ঘটে এবং চীনের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। সর্বমোট ২৫ মিলিয়ন মানুষ প্রান হারান।[২৭] যাইহোক, মাঞ্চুসরা ঐতিহ্যগত চীনা সরকারের কনফুশিয়ানর নিয়ম গ্রহণ করে। একারণে তাদের চীনা রাজবংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
মাঞ্চুরা ‘বেনী আদেশ’ বলে সকল হান-চৈনিকদের চুলে বেনী বাঁধতে বাধ্য করে। সকল সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঞ্চুদের প্রথাগত পোশাক পরিধান করার আদেশ দেয়া হয়। যদিও সাধারণ হান বংশদ্ভুত চীনারা তাদের পছন্দমতো পোশাক পরিধান করতে পারত।
কিয়ালং সম্রাটের শাসনামলে, ছিং সম্রাজ্য সমৃদ্ধির সর্ব্বোচ্চ শীখরে পৌছায়। চীন সম্রাট তখন পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জনগনকে শাসন করত। এবং একই সাথে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতি হিসাবে স্বীকৃত ছিল। ১৯ শতকে এসে চীন সম্রাজ্য ক্রমেই দূর্বল হয়ে পরে। এবং পশ্চিমা শক্তির দ্বারা নানা হুমকির সম্মুখিন হয়। ১৮৪০ সালে প্রথম আফিম যুদ্ধে চীন ব্রিটিশ সম্রাজ্যের কাছে পরাজিত হয়। ১৮৪২ সালে নানকিং চুক্তির মাধ্যমে হংকং তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
এসময়ে চীন তাইপিং বিদ্রোহ (১৮৫১-১৮৬৪) দেখা দেয়। আপাতদৃষ্টে একটি খ্রীস্টান ধর্মালম্বীদের বিদ্রোহ যারা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এক-তৃতীয়াংশ চৈনিক ভূমি শাসন করত। ১৮৬৪ সালে তৃতীয় নানকিং যুদ্ধে তারা পরাজিত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা বিবেচনায় এটি ছিল ১৯ শতকের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ২০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়।[২৮] এসময়ে বেশ কিছু ধারাবাহিক বেসামরিক অষোন্তষ দেখা যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, পুন্টি-হাক্কার যুদ্ধ, নিয়ান বিদ্রোহ, দুঙ্গা বিদ্রোহ (১৮৬২-১৮৭৭) এবং প্যান্থে বিদ্রোহ[২৯]।
এসব বিদ্রোহ সফলভাবে দমন করা হলেও, তার জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছিল। হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রচুর। এসব কারণে কেন্দ্রীয় রাজকীয় কর্তৃপক্ষ দূর্বল হয়ে পড়ে।
চীন প্রজাতন্ত্র চীন
[সম্পাদনা]চীন প্রজাতন্ত্র (১৯১২-১৯৪৯)
[সম্পাদনা]কিং রাজদরবারের দূর্বলতার কারণে তরুন রাজকীয় সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা এবং ছাত্রসমাজ সম্রাটকে উৎখাত করে একটি প্রজাতন্ত্র গঠন করতে প্রয়াসী হন। ১২ই মার্চ ১৯১২ সালে নানজিংএ একটি অন্তর্বর্তী কালিন সরকার গঠিত হয়। সমাপ্ত হয় চীনের ২০০০ বছরের রাজকীয় শাসনের। কিন্তু সান শীঘ্রই সম্রাটকে ক্ষমতাচ্যুত করায় সাহয্য করার বিনিময়ে (যে সিদ্ধান্তের জন্য পরবর্তীকালে তিনি অনুশোচনা করেন) চুক্তি অনুসারে, ইউয়ান সিকাই এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। ইউয়ান সিকাই ছিলেন নব গঠিত সেনাবাহিনী প্রধান এবং ভূতপূর্ব সম্রাটের প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তী পাঁচ বছরে, ইউয়ান জাতীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা ভেঙে দেন এবং ১৯১৫ সালে নিজেকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করেন। সম্রাট হবার উচ্চাভিলাস তার অধীনস্থ কর্মচারীরা মেনে নেননি। ১৯১৬ সালের মার্চ মাসে তাকে উৎখাত করা হয় এবং একই বছর জুন মাসে তিনি মারা যান। ইউয়ানের অপসারন ও মৃত্যু চীনের রাষ্ট্র ক্ষমতায় শূন্যতার সৃষ্টি হয়। প্রজাতান্ত্রিক সরকার ছিন্ন বিচ্ছন্ন হয়ে পরে। এ পরিস্থিতিতে কিছু যুদ্ধবাজ নেতার উত্থান হয়। তারা চীনের অনেক অঞ্চল এসকল নেতারা শাসন করতেন।
১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। এ চুক্তিতে চীনের উপর কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। মন্ত্রী পরিষদ এই চুক্তির স্বাক্ষরের বিপক্ষে মত দেয়। পশ্চিমা পুঁজিবাদী দর্শনের প্রতি অশ্রদ্ধা, চীনের বামপন্থী নেতাদের চিন্তাধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এছাড়া বলশেভিক বিপ্লবীরা ও মস্কো থেকে প্রেরিত রুশ বিপ্লবীদের প্রতিনিধিরাও এর পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯২০ সালে সান ইয়াত সেন দক্ষিণ চীনে একটি বিপ্লবী ভিত্তি গড়ে তোলেন, বিভক্ত চীনকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন। সোভিয়েত বিপ্লবীদের সাহায্য নিয়ে তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে মৈত্রী চুক্তি করেন। ১৯২৫ সালে তার মৃত্যুর পর চিয়াঙ কাই শেক কুওমিনটাঙ (চীনের রিপাবলিকান পার্টি) এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তিনি উত্তর অভিযান (১৯২৬-১৯২৭) নামের সামরিক অভিযানের মাধ্যমে মধ্য ও দক্ষিণ চীনে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণ ও মধ্য চীনের যুদ্ধবাজ নেতাদের দমন করে উত্তরের নেতাদের সাথে নামমাত্র মৈত্রী চুক্তি করেন। ১৯২৭ সালে, চিয়াং কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। পূর্ব ও দক্ষিণ চীনের কমিউনিস্ট সেনাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে তাদের উত্তর পশ্চিমের দুর্গম এলাকায় বিতাড়িত করেন। এ সময় কমিউনিস্টদের নতুন নেতা মাও সেতুং এর আবির্ভাব হয়।
১৪ বছর যাবত চীন-জাপান যুদ্ধের পর (১৯৩১-৪৫) রিপাবলিকান ও কমিউনিস্টদের মধ্যে এই তিক্ততা চলতেই থাকে। জাপানের সেনাবাহিনী চীনের বিভিন্ন অংশ আক্রমণ করে। দ্বিতীয় সিনো-জাপান যুদ্ধের সময় এই দুই চীনা রাজনৈতিক দল ১৯৩৭ সালে একটি মৈত্রী চুক্তি করে। এই যুদ্ধ পরবর্তীতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একটি অংশে পরিনত হয়। জাপানী সেনাবাহিনী নিরীহ বেসামরিক চীনাদের উপর নজিরবিহীন বীভৎস নৃশংসতা প্রদর্শন করে। জীবাণু অস্ত্রও ব্যবহার করা হয় (দেখুন Unit 731) এবং থ্রি অল পলিসি (Sankō Sakusen), থ্রি অল পলিসি বলতে বুঝান হত, “সবাইকে হত্যা কর, সবকিছু পুড়িয়ে দাও এবং সবকিছু লুট কর।”[৩০]
১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর চীনের দুই দলের মধ্যে যুদ্ধ পুনরায় শুরু হয়। যদিও বহুবার বিভিন্নভাবে সমোঝতার চেষ্টা করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের মধ্যে চীনের অধিকাংশ অঞ্চল কমিউনিস্ট পার্টির দখলে চলে যায়। চীনের গৃহযুদ্ধ চলাকালে রিপাবলিকান পার্টি এবং কমিউনিস্ট উভয় দলের কর্মী সমর্থকরা বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় নিহত হয়।[৩১] বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে ভর্তি এবং নানকিং হত্যাকাণ্ডে উভয় দলের অনেক কর্মী মারা যায়। [৩২] ১৯৪৯ সালে রিপাবলিকান পার্টি চীনের মূল ভূখণ্ডে পরাজিত হয়। বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী মূল ভূখণ্ড ছেড়ে তাইওয়ানে পালিয়ে যায়। তাদের ক্ষমতা তাইওয়ান ও তার আশেপাশের দ্বীপের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পরে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সমাপ্ত হবার পর জাপানের সেনাবাহিনী রিপাবলিকান পার্টি সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।[৩৩]
গনপ্রজাতন্ত্রী চীন (১৯৪৯ থেকে বর্তমান)
[সম্পাদনা]চীনের গৃহযুদ্ধের মূল যুদ্ধ ১৯৪৯ সালে সমাপ্ত হয়। রিপাবলিকানদের চীনের মূল ভূ-খন্ড থেকে তাইওয়ানে বিতাড়িত করা হয়। মূল চীনে কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের ১ লা অক্টোবর মাও সেতুং গনপ্রজাতান্ত্রিক চীন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।[৩৪] গনচীনের দুইটি জনপ্রিয় নাম ছিল “কমিউনিস্ট চীন” বা “লাল চীন”[৩৫]
রাজনৈতিক অভিযানের তালিকা এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে গনচীনের গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। অগ্রসরের মহালম্ফন বা Great Leap Forward এর কারণে ৪৫ মিলিয়ন মানুষকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।[৩৬] মাও সরকার অগণিত ভূস্বামীদের গনহারে মৃত্যদন্ড কার্যকর করে। মৃত্যদন্ড ও বাধ্যতামূলক শ্রমদানে বিপুল সংখ্যক প্রানহারি ঘটনা ঘটে। ১৯৬৬ সালে মাও এবং তার মিত্ররা সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে।, একদশক পরে মাও এর মৃত্যুর পরও এই আন্দোলন চলতে থাকে। দলের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা আর সোভিয়েত ইউনিয়নভীতি ছিল এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল প্রেষনা।
১৯৭৬ সালে মাও এর মৃত্যুর পর কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অতিরিক্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের চর্চার জন্য চার জনের দলকে বা Gang of Four কে গ্রেফাতার করা হয়। সেই সাথে রাজনৈতিক ডামাডোলের অবসান হয়। দেং জিয়াওপিং সুকৌশলে চেয়ারম্যান হুয়া গাওফেংএর স্থলাভিষিক্ত হন এবং পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির একচ্ছত্র নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন। দেং জিয়াওপিং ১৯৭৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত চীনের নেতা ছিলেন। যদিও তিনি কখনও পার্টি প্রধান কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন না। তথাপি কমিউনিস্ট পার্টিতে তার দৃঢ় প্রভাব ছিল। তার প্রভাবে চীনে অর্থনৈতিক সংস্কার সূচীত হয়। কমিউনিস্ট পার্টি ধীরে ধীরে জনগনের ব্যক্তিগত জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। প্রজাসভা বা কমিউনগুলো থেকে প্রচুর জমি বিযুক্ত করে কৃষকদের নিকট লীজ দেয়া হয়। এর ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এই পরিবর্তন চীনের অর্থনীতিকে পরিকল্পিত অর্থনীতি থেকে মিশ্র অর্থনীতির দিকে নিয়ে যায়।[৪০] কমিউনিস্ট পার্টির ভাষায় যাকে বলা হয় চৈনিক পদ্ধতির সমাজতন্ত্র।
১৯৮৯ সালে পার্টির প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল, হু ইয়াওব্যাং এর মৃত্যুর পর চীনে তিয়েনআনমেন স্কোয়ার আন্দোলনের সূচনা হয়। ছা্ত্র ও সাধারণ জনতা কয়েক মাস ব্যাপী এই আন্দোলনে বাক্স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার, রাজনৈতিক সংস্কার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ৪ জুন পিপলস লিবারেশন আর্মি তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে এই প্রতিবাদ সমাবেশ বলপূর্বক বন্ধ করে দেয়। এ সময়ে অনেকে হতাহত হন। এ'ঘটনা বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়।[৪১][৪২] ট্যাংক ম্যান নামের একটি ছায়াছবিতে তখনকার ঘটনা চিত্রিত হয়েছে।
তিয়েনমেন আন্দোলনের পর ৯০ এর দশকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি এবং গন চীনের প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন এবং প্রধানমন্ত্রী জু রংজি চীনের শাসন ক্ষমতায় আসেন। তারা দুজনেই সাংহাইয়ের মেয়র ছিলেন। তাদের ১০ বছরের শাসনামলে চীনের ১৫০ বিলিয়ন কৃষককে দারিদ্রসীমার উপরে নিয়ে আসা হয়। বাৎসরিক প্রবৃদ্ধি ১১.২ শতাংশে উন্নিত হয়।[৪৩][৪৪] দেশটি ২০০১ সালে ওয়ার্লড ট্রেড অর্গানাইজেশনে যোগদান করে।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "China country profile" (ইংরেজি ভাষায়)। BBC News। ১৮ অক্টোবর ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ৭ নভেম্বর ২০১০।
- ↑ Cradles of Civilization-China: Ancient Culture, Modern Land, Robert E. Murowchick, gen. ed. Norman: University of Oklahoma Press, 1994
- ↑ ক খ গ "Public Summary Request Of The People's Republic Of China To The Government Of The United States Of America Under Article 9 Of The 1970 Unesco Convention"। Bureau of Educational and Cultural Affairs, U.S. State Department। ১৫ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০০৮।[অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ William G. Boltz, Early Chinese Writing, World Archaeology, Vol. 17, No. 3, Early Writing Systems. (Feb., 1986), pp. 420–436 (436).
- ↑ David N. Keightley, "Art, Ancestors, and the Origins of Writing in China", Representations, No. 56, Special Issue: The New Erudition. (Autumn, 1996), pp.68–95 (68).
- ↑ ক খ "The Ancient Dynasties" (ইংরেজি ভাষায়)। University of Maryland। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০০৮।
- ↑ এ কে এম শাহনাওয়াজ এর প্রাচীন সভ্যতা সিরিজ ৫ চীন পৃষ্ঠা ১০ প্রথমা প্রকাশনী মার্চ ২০১৫ আইএসবিএন ৯৭৮৯৮৪৮৭৬৫১৭৩
- ↑ ক খ Rixiang Zhu, Zhisheng An, Richard Pott, Kenneth A. Hoffman (জুন ২০০৩)। "Magnetostratigraphic dating of early humans of in China" (পিডিএফ)। Earth Science Reviews (ইংরেজি ভাষায়)। 61 (3–4): 191–361। ২৪ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ এপ্রিল ২০১৬।
- ↑ "Earliest Presence of Humans in Northeast Asia" (ইংরেজি ভাষায়)। Smithsonian Institution। ১৩ আগস্ট ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ আগস্ট ২০০৭।
- ↑ "Fossil teeth place humans in Asia '20,000 years early'" (ইংরেজি ভাষায়)। BBC News। সংগ্রহের তারিখ ১৪ অক্টোবর ২০১৫।
- ↑ "Neolithic Period in China"। Timeline of Art History (ইংরেজি ভাষায়)। Metropolitan Museum of Art। অক্টোবর ২০০৪। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০৮।
- ↑ "Rice and Early Agriculture in China"। Legacy of Human Civilizations (ইংরেজি ভাষায়)। Mesa Community College। ২৭ আগস্ট ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০৮।
- ↑ [১]/Science
- ↑ Martini, I. Peter (২০১০)। Landscapes and Societies: Selected Cases (ইংরেজি ভাষায়)। Springer। পৃষ্ঠা 310। আইএসবিএন 90-481-9412-1।
- ↑ Higham, Charles (২০০৪)। Encyclopedia of ancient Asian civilizations (ইংরেজি ভাষায়)। Infobase Publishing। পৃষ্ঠা 200। আইএসবিএন 0-8160-4640-9।
- ↑ Leadership Strategies, Economic Activity, and Interregional Interaction: Social Complexity in Northeast China, pp. 89
- ↑ "Silk: History"। Columbia Encyclopedia Sixth Edition।
- ↑ "Textile Exhibition: Introduction"। Asian art।
- ↑ Bronze Age China at National Gallery of Art
- ↑ ক খ Scripts found on Erlitou pottery (written in Simplified Chinese)
- ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;Flood Myths
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি - ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;এনশিয়েন্ট অরিজিনস
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি - ↑ ISMB0495050539
- ↑ Ban Chao, Britannica Online Encyclopedia
- ↑ Ho, Ping-ti (১৯৭০)। "An Estimate of the Total Population of Sung-Chin China"। Études Song। 1 (1): 33–53।
- ↑ "Course: Plague"। ১৮ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।[অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ John M. Roberts (1997). A Short History of the World. Oxford University Press. p. 272. আইএসবিএন ০-১৯-৫১১৫০৪-X.
- ↑ White, Matthew। "Statistics of Wars, Oppressions and Atrocities of the Nineteenth Century"। সংগ্রহের তারিখ ১১ এপ্রিল ২০০৭।
- ↑ Harper, Damsan; Fallon, Steve; Gaskell, Katja; Grundvig, Julie; Heller, Carolyn; Huhti, Thomas; Maynew, Bradley; Pitts, Christopher (২০০৫)। Lonely Planet China (9 সংস্করণ)। আইএসবিএন 1-74059-687-0।
- ↑ Fairbank, J. K.; Goldman, M. (২০০৬)। China: A New History (2nd সংস্করণ)। Harvard University Press। পৃষ্ঠা 320। আইএসবিএন 9780674018280।
- ↑ Rummel, Rudolph (1994), Death by Government.
- ↑ Valentino, Benjamin A. Final solutions: mass killing and genocide in the twentieth century Cornell University Press. December 8, 2005. p88
- ↑ Surrender Order of the Imperial General Headquarters of Japan, 2 September 1945, "(a) The senior Japanese commanders and all ground, sea, air, and auxiliary forces within China (excluding Manchuria), Formosa, and French Indochina north of 16 degrees north latitude shall surrender to Generalissimo Chiang Kai-shek."
- ↑ The Chinese people have stood up ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে. UCLA Center for East Asian Studies. Retrieved 16 April 2006. isop.ucla.edu [ত্রুটি: আর্কাইভের ইউআরএল অজানা] আর্কাইভকৃত [তারিখ অনুপস্থিত] তারিখে
- ↑ Smith, Joseph; and Davis, Simon. [2005] (2005). The A to Z of the Cold War. Issue 28 of Historical dictionaries of war, revolution, and civil unrest. Volume 8 of A to Z guides. Scarecrow Press publisher. আইএসবিএন ০-৮১০৮-৫৩৮৪-১, আইএসবিএন ৯৭৮-০-৮১০৮-৫৩৮৪-৩.
- ↑ Akbar, Arifa (১৭ সেপ্টেম্বর ২০১০)। "Mao's Great Leap Forward 'killed 45 million in four years'"। London: The Independent। সংগ্রহের তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০১০।
- ↑ Witty, Patrick (জুন ৩, ২০০৯)। "Behind the Scenes: Tank Man of Tiananmen"। The New York Times।
- ↑ Floor Speech on Tiananmen Square Resolution. Nancy Pelosi, Speaker of the U.S. House of Representatives. June 3, 2009.
- ↑ Corless, Kieron (মে ২৪, ২০০৬)। "Time In – Plugged In – Tank Man"। Time Out।
- ↑ Hart-Landsberg, Martin; Burkett, Paul (মার্চ ২০১০)। "China and Socialism: Market Reforms and Class Struggle"। Monthly Review Press। আইএসবিএন 1-58367-123-4। সংগ্রহের তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০০৮।
- ↑ Youngs, R. The European Union and the Promotion of Democracy. Oxford University Press, 2002. আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৯-৯২৪৯৭৯-৪.
- ↑ Carroll, J. M. A Concise History of Hong Kong. Rowman & Littlefield, 2007. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৭৪২৫-৩৪২২-৩.
- ↑ "Nation bucks trend of global poverty"। China Daily। ১১ জুলাই ২০০৩।
- ↑ "China's Average Economic Growth in 90s Ranked 1st in World"। People's Daily। ১ মার্চ ২০০০।