দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাস
১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ জাপানীদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাস শুরু হয়। এমনটা নয় যে, দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর কোরিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন দেশ, বরং সেখানে একই জনগণ রয়েছে এবং তাঁরা একই উপদ্বীপে আছে।
পটভূমি
[সম্পাদনা]দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে ১৯৪৫ সালে কোরিয়া প্রশাসনিকভাবে ভাগ করা হয়েছিলো। যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে কোরিয়া ছিলো জাপানী শাসনের কর্তৃত্বে, তাই জাপানী অঞ্চলের প্রভাবে কোরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিলো। জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ কোরিয়া বিভাজন করে দুটি পেশা অঞ্চল গঠনে চালিত করে (জার্মানির চারটি অঞ্চলের মত), যেখানে, উপদ্বীপটির দক্ষিণ অর্ধাংশ শাসন করতো যুক্তরাষ্ট্র এবং ৩৮তম সমান্তরালের এলাকা সোভিয়েত ইউনিয়ন শাসন করতো। এই বিভাজন মনে করা হয়েছিলো ক্ষণস্থায়ী হবে (যেমনটা জার্মানিতে হয়েছিলো) এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন সমস্ত উপদ্বীপটিকে একক সরকার গঠন করার ব্যবস্থা করে তাঁদের জনগণের কাছে সমন্বিত কোরিয়া ফিরিয়ে দেবে, প্রথমে এমনই প্রবণতা ছিলো।
কিন্তু কোরিয়ার ওপর যৌথ ট্রাস্টিশীপ বাস্তবায়নে দুইটি দল সমঝোতা করতে ব্যর্থ হয়, কারণ দুইরকম মতামতের কারণে। এটি ১৯৪৮ সালে দুটি পৃথক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চালিত করে দুটি বিপরীতধর্মী মতাদর্শের কারণে, কমুনিস্ট-জোটবদ্ধ ডেমোক্রাটিক পিপলস রিপাবলিক অফ কোরিয়া (ডিপিআরকে) এবং পশ্চিমা জোটবদ্ধ ফার্স্ট রিপাবলিক অফ কোরিয়া - উভয়ই কোরিয়ার বৈধ সরকার গঠন করার দাবি করছিলো। সালের জুনের ২৫ তারিখ কোরিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়। অনেক ধ্বংসযজ্ঞের পরে, ১৯৫৩ সালে ২৭ শে জুলাই যুদ্ধ শেষ হয়। ১৯৪৮ সালের স্থিরাবস্থা পুনরুদ্ধার হয়, ডিআরপিকে কিংবা ফার্স্ট রিপাবলিক কোনটিই ব অন্য বিভক্ত অংশ জয় করতে সফলতা পায়না। কোরিয়ার নিরস্ত্রীকৃত অঞ্চল কর্তৃক উপদ্বীপটিকে ভাগ করা হয়, এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের নিকট দক্ষিণ ও উত্তর কোরিয়া নামে দুটি পৃথক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার পরবর্তী ইতিহাস পর্যায়ক্রমিক গণতান্ত্রিক শাসনামল এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসন হিসেবে চিহ্নিত। বেসামরিক সরকার প্রচলতিভাবেই হয়েছে সিন্গমান রিহ এর প্রথম প্রজাতন্ত্র হতে সমসাময়িক ষষ্ট প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত। প্রথম প্রজাতন্ত্র, তর্কযোগ্যভাবে সূচনালগ্নে গণতান্ত্রিক ছিলো (যদিও বড় ধরনের কমুনিস্ট-বিরোধী ও সোসিয়ালিস্ট-বিরোধী নির্মূলকার্য চালনা হয়েছিলো), ১৯৬০ সালে পতন না হওয়া পর্যন্ত ক্রমশ স্বৈরতান্ত্রিক হচ্ছিলো। দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র খুবই কড়া গণতান্ত্রিক ছিলো, তারপরও এক বছরের কম সময়ের মধ্যে তাঁকে উৎখাত করা হয় এবং আরেকজনকে বসানো হয় স্বৈরাচারী সামরিক শাসন কর্তৃক। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজাতন্ত্র নামেমাত্র গণতান্ত্রিক ছিলো, কিন্তু ব্যপকভাবে মনে করা হতো চলমান সামরিক শাসনই চলছে।[১] ষষ্ট প্রজাতন্ত্রের মাধ্যমে দেশটি ক্রমশ উদার গণতন্ত্রে পাকাপোক্ত হয়।
সূচনালগ্ন হতে, দক্ষিণ কোরিয়া শিক্ষা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে যথেষ্ট উন্নয়ন দেখিয়েছে। ১৯৬০ এর দশক হতে, এশিয়ার দরিদ্রতম দেশ হতে উন্নয়ন করে এখন পৃথিবীর অন্যতম ধনী রাষ্ট্র হয়েছে। শিক্ষা, বিশেষ করে তৃতীয় পর্যায়ে, নাটকীয়ভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও হং কং এর সাথে দক্ষিণ কোরিয়াকে এশিয়ার গর্জে ওঠা "চার বাঘ" বলা হয়ে থাকে।[২] [৩]
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শাসন (১৯৪৫-১৯৪৮)
[সম্পাদনা]কোরিয়ায় সরকার
ইয়েও উন-হায়ুঙ (যতদূর সঠিক) যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত যৌথ কমিশনে (১৯৪৭)
লায়ুহ উন-হায়ুঙ (যতদূর সঠিক) ১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত যৌথ কমিশনে
১৯৪৫ সালের ১৫ ই আগস্ট মিত্রশক্তির কাছে সম্রাট হিরোহিতো জাপা সম্রাজ্যের আত্মসমর্পণ ঘোষনা করেন। জাপানের আত্মসমর্পণের (যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চীফ অফ স্টাফ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এবং ১৯৪৫ এর ১৭ আগস্টে অনুমোদিত) সাধারণ আদেশ জাপানী বাহিনীর জন্য কোরিয়ার উত্তর ও দক্ষিণে ৩৮ তম সমান্তরাল পৃথক আত্মসমর্পণ পদ্ধতি নির্ধারণ করে। মিত্রশক্তির কাছে জাপানের আত্মসমর্পণের পর (১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকতা হয়), ৩৮ তম সমান্তরাল বিভাজনে উত্তর ও দক্ষিণ অংশে যথাক্রমে সোভিয়েত ও যুক্তরাষ্ট্রের দখলাদারিত্বের শুরু চিহ্নিত হয়। এই বিভাজন সাময়িক সময়ের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিলো, এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনা প্রজাতন্ত্র কোরিয়ার স্বাধীনতার জন্য একটি ট্রাস্টিশীপ গঠন করার কথা ছিলো। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইয়াল্টা কনফারেন্সে ট্রাস্টিশীপ বিষয়ে আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী ১৯৪৫ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর লাচনে অবতরণ করে এবং পরে একটি সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে। তাঁদের সেনাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জন আর. হডজ সরকারের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। জনসাধারণের ব্যাপক অসন্তোষের কারণে, ১৯৪৫ এর অক্টোবরে হডজ কোরিয়ার উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে। চীন হতে পরিচালিত, প্রজাতন্ত্রী কোরিয়ার অস্থায়ী সরকার, হডজের কাছে তিন সদস্যের একটি দোভাষী প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে, কিন্তু সে তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জানায়। নতুন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া ও এর জন কমিটি চিনতে হডজ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে এবং ১২ ডিসেম্বর এটিকে বেআইনি ঘোষনা করে। এক বছর পরে, একটি অন্তর্বর্তী আইনসভা ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়, যেখানে কিম কিউ-শিক ও সিন্গমান রিহ কে যথাক্রমে প্রধান করা হয়। রাজনৈতক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা - বিভিন্ন ক্ষেত্র হতে বেড়ে ওঠে - যা এই সময়কালে সারা দেশকে জর্জরিত করে তোলে। জাপানি শোষণের পরবর্তী-প্রভাব দক্ষিণের মত উত্তরেও থেকে যায়। যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী কোরিয়া শাসন মোকাবেলার জন্য সম্পূর্ণভাবে অপ্রস্তুত ছিলো, যেখানে তাঁদের কোরিয়ার ভাষা, সংস্কৃতি অথবা রাজনেতিক অবস্থা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ছিলো না। একারণে যুক্তরাষ্ট্রে অধিকাংশ নীতি অনিচ্ছাকৃত হলেও অস্থিতিশীল প্রভাব ফেলে। উত্তর কোরিয়া ও বাইরে হতে উদ্বাস্তুদের ঢেউয়ের আরো অশান্তি বেড়ে যায়।
১৯৪৫ সালে ডিসেম্বরে কোরিয়ার ভবিষ্যতের ব্যাপের আলোচনা করতে মস্কোতে একটি বৈঠক আহবান করা হয়। একটি পঞ্চ-বার্ষিক ট্রাস্টিশীপ আলোচনা করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত যৌথ কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কমিশন অন্তর্বর্তী সময়ে সিউলে সাক্ষাৎ করে কিন্তু একটি জাতীয় সরকার গঠনের ইস্যুতে অচলাবস্থা তৈরি হয়। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে, কোনো সমাধান না হওয়াতে, যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়ান সমস্যার কথা ইউএন জেনারেল এসেম্বলিতে তোলে।
এই সমাধানকল্পে ইউএন জেনারেল এসেম্বলি যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে কোরিয়ায় একটি সাধারণ নির্বাচনের ডাক দেয়, কিন্তু উত্তর অংশ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তাই শুধু দক্ষিণ অংশে একটি সাংবিধানিক পরিষদের জন্য একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের মে মাসে। একটি সংবিধান গৃহীত হয়, সরকারের জন্য চার বাৎসরিক রাষ্ট্রপতি ঠিক করে এবং রাষ্ট্রপতিত্বের জন্য চার বছর মেয়াদ নির্দিষ্ট করে। সংবিধানের বিধান অনুসারে, জুলাই মাসে একটি পরোক্ষ রাষ্ট্রপতির নির্বাচন আয়োজিত হয়। নতুন এসেম্বলির প্রধান রিহ সিন্গমান রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন এবং প্রজাতন্ত্রী কোরিয়া (দক্ষিণ কোরিয়া) ঘোষনা করেন ১৯৪৮ সালে আগস্টের ১৫ তারিখে।
প্রথম প্রজাতন্ত্র (১৯৪৮-১৯৬০)
[সম্পাদনা]সিন্গমান রিহ, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি
১৯৪৮ সালের ১৫ই আগস্ট সিন্গমান রিহ কে প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রজাতন্ত্রী কোরিয়া আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। রিহ'র সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নতুন সরকারের আইনগত সার্বভৌমত্বও পাস হয়। ১৯৪৮ সালে ৯ই সেপ্টেম্বর কিম-ই-সাঙ এর নেতৃত্বে একটি সাম্যবাদী দল, ডেমোক্রাটিক পিপলস রিপাবলিক অফ কোরিয়া (উত্তর কোরিয়া) ঘোষনা করা হয়। যাইহোক, ১৯৪৮ সালের ১২ ডিসেম্বরে, তৃতীয় অধিবেশনে এর রেজোলিউশন ১৯৫ অনুসারে, জাতিসংঘ প্রজাতন্ত্রী সরকারকে কোরিয়ার একমাত্র আইনসিদ্ধ সরকার হিসেবে চিহ্নিত করে।
১৯৪৬ সালে, উত্তর কোরিয়া ভূমি সংস্কার আইন বাস্তবায়ন করে, বিশেষত জাপানি এবং জাপানপন্থী মালিকানায় থাকা সুযোগ, কারখানাসমূহ ও ব্যাক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিবর্তন করে। দক্ষিণে ভূসি সংস্কারের দাবি আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, এবং ১৯৪৯ সালে এই আইন পাস হয়। কোরিয়ায় বিশাল জমিজমা অধিকৃতকারীরা তাঁদের অধিকাংশ জমি বর্জন করতে বাধ্য হয়ে পড়েছিলো। মোট খামার পরিবারের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ অল্প জমির মালিক হয়ে যায়। যাইহোক, স্বাধীনতার পূর্বে জমির মালিকদের সংস্পর্শে যারা ছিলো তাঁদের ক্ষেত্রে জমি ক্রয়ের অগ্রাধিকার দেয়া হয়, একারণে বহু জাপানপন্থী দল সম্পত্তি লাভ করে বা ধরে রাখে।
দেশ ভাগ হওয়ার পর এখন, সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে দুই কোরিয়ার মাঝে সম্পর্কও শত্রুতা পূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালে সোভিয়েতের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের পর, দক্ষিণ কোরিয়া হতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা বহিষ্কারের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর উত্তর কোরিয়া চাপ প্রয়োগ করে, কিন্তু রিহ তার সরকার আমেরিকার সাথে থাকার কথা ব্যক্ত করে এবং উত্তর কোরিয়া ও জাপান উভয়ের বিপক্ষে চলে যায়। যদিও জাপানের সাথে সম্পর্ক শিথিল করতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তবু তাঁরা সামান্যই অর্জন করে। ইতিমধ্যে, সরকার আমেরিকা হতে বিশাল অঙ্কের সাহায্য লাভ করে, যা পরিমানে সরকারের মোট জাতীয় বাজেটের কাছাকাছি। ১৯৪৮ সালে জাতীয়বাদী এ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সামরিক চর্চাও অব্যাহত রাখে, রিহ'র সরকার জেজু, সানচন ও ইয়েওসুতে অনেক সামরিক বিদ্রোহ দমন করে। বিদ্রোহ উত্থান ও এর দমনকালে ১৪,০০০ হতে ৬০,০০০ এর মত লোক হত্যা করা হয়েছিলো সমস্ত যুদ্ধে। রাষ্ট্রপতি রিহ'র শাসন প্রতিপক্ষদের জন্য অসহনীয় হয়ে যায়। একটি বিখ্যাত সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছিলো যে, ১৯৪৮ সালে সাম্যবাদী ষড়যন্ত্রে জন্য ভবিষ্যত রাষ্ট্রপতি পার্ক চুঙ-হি কে আটক ও আসামী করা হয়।
১৯৪৮ সালের ১৫ই আগস্টে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম প্রজাতন্ত্রী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন
কোরিয়ার প্রথম প্রজাতন্ত্রী সরকারের প্রধান নীতি ছিলো সাম্যবাদ-বিরোধী চেতনা এবং " উত্তরদিকে প্রসারিত হয়ে কোরিয়াকে একীকরণ। দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী যথেষ্ট সজ্জিত বা প্রস্তুত ছিলো না, তারপরও রিহ'র প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় কোরিয়াকে পুনরায় এক করার কাজে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলো। যাইহোক, ১৯৫০ সালের ৩০ মে দ্বিতীয় সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, অধিকাংশ আসন স্বতন্ত্র হয়ে যায় এবং তাঁদের অবস্থান অনুমোদন করে না, যা সমর্থনের অভাব ও রাষ্ট্রের ভঙ্গুর অবস্থা নিশ্চিত করে।
এ সময় জুন মাসে সাম্যবাদী দল উত্তর থেকে আক্রমণ করে, দক্ষিণ কোরিয়ার সন্দেহভাজন সাম্যবাদী বা তাদের অনুসারী দলকে পশ্চাদ্ধাবন করে, যারা কারাগারে বা পুনঃ শিক্ষা আন্দোলন চালনা করছিলো তাঁদেরকেও, যা বদো লীগ ম্যাসাকর নামে পরিচিত।
১৯৫০ সালের জুন মাসে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়াকে আক্রমণ করে। যুক্তরাষ্ট্র চালিত ১৬-দলীয় জোট দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে প্রথম সংগঠিত অ্যাকশন নেয়, যা ইউনাইটেড নেশনশ কমান্ড (ইউএনসি) এর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। দোদুল্যমান যুদ্ধ পরিস্থিতি ব্যাপক নাগরিক সমস্যার সৃষ্টি করে এবং বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ১৯৫০ এর শেষের দিকে উত্তর কোরিয়ার পক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রবেশ করলে, সীমারেখার মূল রেখার কাছাকাছি যুদ্ধ কিছুটা শিথিল হয়। ১৯৫১ সালের জুলাই মাসের শুরুতে যুদ্ধরীতি আলোচনা শুরু হয়, এবং ১৯৫৩ সালের ২৭শে জুলাই চূড়ান্তভাবে শেষ হয় প্যানমুনজম নামের স্থানে, এখন পরিচিত নিরস্ত্রীকৃত এলাকা নামে (ডিমিলিটারিজাইড জোন - ডিএমজেড)। যুদ্ধরীতি অনুসারে, দক্ষিণ কোরিয়ান সরকার সিওলে ফিরে আসে তাৎপর্যপূর্ণ তারিখে ১৯৫৩ এর ১৫ই আগস্টে।
যুদ্ধবিরতির পরে, সিন্গমান রিহ'র কিছু বছর স্বৈরাচারী নেতৃত্বে দক্ষিণ কোরিয়া রাজনৈতিক গোলযোগের অভিজ্ঞতা পেতে থাকে, যা ১৯৬০ সালে একটি ছাত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে। রিহ'র শাসন জুড়ে অতিরিক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চেয়েছিলো সরকারের প্রতি তাঁর নিয়ন্ত্রন মজবুত করতে। ১৯৫২ সালেই এসব শুরু করে যখন সরকার বুসান ভিত্তিক চালিত হতো চলমান যুদ্ধের কারণে। ঐ বছরের মে মাসে রিহ সংবিধান সংশোধন করে যা রাষ্ট্রপতির পদকে সরাসরি-নির্বাচনের অবস্থানে দাড় করায়। এসব করতে, সে সামরিক শাসন জারি করে, সংসদের প্রতিপক্ষ সদস্য৷ বিক্ষোভকারী ও সরকার-বিরোধী দলকে আটক করে। রিহ পরবর্তীতে ব্যাপক ভোটে বিজয়ী হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে রিহ সংসদের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনরায় লাভ করে, এবং আট-বছর মেয়াদে শাসন চালানোর পর নিজেকে অব্যাহতি দেয়ার একটা আইন সংশোধন করে। ১৯৫৬ সালে সে আবারো একবার নির্বাচিত হয়। এরপরপরই, রিহ'র প্রশাসন প্রতিপক্ষ দলের সদস্যদের আটক করে, এবং প্রতিপক্ষ দলের নেতাকে উত্তর কোরিয়ান গুপ্তচর নামে অভিহবত করে।
এই প্রশাসনে ক্রমশ রাজনৈতিক অঙ্গন আয়ত্ব করতে দমন-পীড়ন বাড়াতে থাকে, এবং ১৯৫৮ সালে এটি জাতীয় নিরাপত্তা আইন সংশোধন করে সকল ধাপের শাসনের (স্থানীয় শাসন সহ) ওপর কর্তৃত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করে। এই পদক্ষেপ সমূহ জনগণের ওপর অত্যাচার আরো বাড়িয়ে তোলে, কিন্তু জনগণের হৈচৈ সত্ত্বেও, রিহ'র প্রশাসন ১৯৬০ এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কারচুপি করে এবং নির্বাচনে জয়লাভ করে।
নির্বাচনের দিন, মাসান শহরে নির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে ছাত্র ও সাধারণ নাগরিকরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। শুরুতে প্রতিবাদকারীদের স্থানীয় পুলিশ বাহিনী দ্বারা প্রশমিত করা হয়, কিন্তু মাসানের পোতাশ্রয়ে এক ছাত্রের দেহ ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেলে, সারাদেশ ফুসে ওঠে এবং রাষ্ট্রজুড়ে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। এপ্রিলের ১৯ তারিখ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সিওলের রাস্তায় সমাবেশ ও মিছিল করে প্রতিবাদ করে, এটাকে এপ্রিল বিপ্লব বলা হয়ে থাকে। সরকার সামরিক শাসন ঘোষনা করে, সেনাবাহিনীকে তলব করে এবং জনগণের ওপর গুলিবর্ষণের মাধ্যমে নির্যাতন চালায়। পরবর্তীতে দেশব্যাপী প্রতিবাদ সরকারকে নাড়িয়ে দেয়, এবং ২৫শে এপ্রিল রাস্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকমন্ডলী নিয়ে এক বর্ধিত প্রতিবাদ হয়, রিহ ২৬শে এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করে এবং নির্বাসনে পালিয়ে যায়।
দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র (১৯৬০-১৯৬৩)
[সম্পাদনা]ছাত্রবিপ্লবের পর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিয়ো জিয়োঙ্গ এর নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের কাছে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ১৯৬০ সালের ২৯ শে জুলাই একটি নতুন সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম প্রজাতন্ত্রের সময়কার বিপক্ষ দল থাকা ডেমোক্রেটিক পার্টি নির্বাচনে সহজে জয়লাভ করে, তাঁরা ক্ষমতা লাভ করে এবং দ্বতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সংশোধিত সংবিধান দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রকে সংসদীয় মন্ত্রীসভা পদ্ধতিতে এই নির্দেশ করে যে, যেখানে রাষ্ট্রপতি নাম মাত্র ভূমিকায় থাকবে। দক্ষিণ কোরিয়াকে রাষ্ট্রপতির শাসনের পরিবর্তে সংসদীয় মন্ত্রীসভা পদ্ধতিতে চালিত করার এটিই প্রথম এবং একমাত্র দৃষ্টান্ত। ১৯৬০ সালের আগস্টে ইয়ুন পো-সান কে গণপরিষদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করে এবং চাঙ মায়োন কে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করে।
দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের সময় রাজনৈতিক দলের বিস্তর সক্রিয়তা দেখা যায় যা রিহ'র শাসনামলে দমন করা হতো। রাজনৈতিক কার্যকলাপের বেশিরভাগ হতো বামপন্থী দল ও ছাত্রদল থেকে, যা কিনা প্রথম প্রজাতন্ত্রে অস্ত্রের মাধ্যমে উৎখাত করা হতো। ১৯৬০ এর শেষের মাসগুলোতে ইউনিয়নের সদস্যতা ও তাঁর কার্যকলাপ দারুণভাবে বেড়ে যায়, সাথে সাথে শিক্ষক জোট, সাংবাদিক জোট এবং কোরিয়ান বাণিজ্য সংঘ জোটেও কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রথম আট মাসেই প্রায় ২,০০০ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
বামপন্থী হতে চাপ আসায়, চাঙ্গ সরকার সেনাবাহিনী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েক দফা সংশোধন করে যারা কিনা গণতন্ত্র-বিরোধী কার্যাবলী ও দূর্নীতিতে জড়িত ছিলো। এই কার্যে ১৯৬০ এর ৩১শে অক্টোবরে একটি বিশেষ আইন পাস করা হয়। ৪০,০০০ লোকের ওপর তদন্ত চালনা করা হয়, এদের মধ্যে, ২,২০০ এর বেশি ছিলো সরকারি কর্মকর্তা এবং ৪,০০০ পুলিশ কর্মকর্তাদের সংশোধন করা হয়। অধিকন্তু, সরকার সেনাবাহিনীকে ১,০০,০০০ কমিয়ে আনার বিবেচনা করে, যদিও এ পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়।
অর্থনৈতিক ব্যাপারে, সরকার বিশাল অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হয়। সরকার পঞ্চ-বার্ষিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, যদিও নির্দিষ্ট সময়ে এটা অর্জন করা সম্ভব ছিলো এবং স্থগিত করা হয়েছিলো। দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রে, ১৯৬০ হতে ১৯৬১ সালের বসন্ত পর্যন্ত এর মুদ্রামান অর্ধেক হ্রাস পায় ডলারের তুলনায়।
যদিও সরকার জনগণের সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তারপরও সরকার কার্যকরী সংষ্কার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় যা সীমাহীন সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক গোলযোগ এবং শেষ পর্যন্ত ১৬ই মে অভ্যুণ্থান বয়ে আনে।
সামরিক শাসন (১৯৬১-১৯৬৩)
১৬ই মে অভ্যুত্থান চলাকালে মেজর জেনারেল পার্ক চুঙ-হি (মাঝখানে)
১৬ই মে ১৯৬১ সালে মেজর জেনারেল পার্ক চুঙ-হি চালিত গণঅভ্যুণ্থান দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের সমাপ্ত করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। পার্ক ছিলেন সামরিক বাহিনীর অন্যতম নেতা যিনি সেনাবাহিনীকে রাজনীতিমুক্ত করতে চেষ্টা করছিলো। দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের নেওয়া সংশোধনী কর্মকান্ডে অসন্তুষ্ট হন এবং ভেবেছিলেন চলমান দিশেহারা রাষ্ট্র সাম্যবাদে পতিত হবে, একারণে তাঁরা নিজহাতে ব্যবস্থা গ্রহণের পথ অবলম্বন করে।
জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেয়া হয়,
সামরিক কর্মকর্তাদের বেসামরিক পদে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৬১ এর মে মাসে, "বিপ্লবের অঙ্গীকার" ঘোষণা করে জুন্টা: সাম্যবাদবিরোধীতা; যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বর্ধিত সম্পর্ক; "সজীব ও পরিচ্ছন্ন নৈতিকতা" নামে সরকারি দূর্নীতি সমাপ্ত; একটি আত্মনির্ভর অর্থনীতি; পুনর্মিলনের মাধ্যমে কাজ; এবং দুই বছরের মধ্যে গণতান্ত্রিক বেসামরিক সরকার। প্রতিপক্ষদের ওপর নজরদারি রাখতে, ১৯৬১ সালের জুনে সামরিক কর্তৃপক্ষ কোরিয়ান সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (কেসিআইএ) গঠন করে, এর প্রথম পরিচালক করা হয় কিম জঙ-পিল কে, যিনি পার্কের আত্মীয় ছিলেন। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসন ফিরিয়ে আনতে ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে একটি গণভোট আয়োজিত হয়, যেখানে অভিযোগসহ ৭৮% সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হয়। পার্ক এবং অন্যান্য সামরিক নেতারা পরবর্তী নির্বাচনে অফিসে না যাওয়ার অঙ্গীকার করে। যাইহোক, নতুন ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক পার্টি (ডিআরপি) এর পক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হন, যে দল মূলত কেসিআইএ এর কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ছিলো, রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ১৯৬৩ সালের নির্বাচনে সূক্ষ ব্যবধানে জয়লাভ করে।
তৃতীয় প্রজাতন্ত্র (১৯৬৩-১৯৭২)
[সম্পাদনা]রাষ্ট্রপতি পার্ক চুঙ-হি, যিনি ১৯৬১ হতে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়া শাসন করতেন, পার্ক প্রশাসন পঞ্চ-বার্ষিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ঘোষনার মাধ্যমে তৃতীয় প্রজাতন্ত্র শুরু করে। সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয় অর্থনীতিতে আত্ম-নির্ভরশীল এবং আধুনিকায়নতার ওপর; "প্রথমে উন্নয়ন, পরে পুনর্মিলন" ঐ সময়ের স্লোগান হয় এবং বাণিজ্য ক্ষেত্রে অর্থনীতি দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়; বিশেষকরে ছোট এবং ভারী রাসায়নিক শিল্পে। রাজধানীতে এমন ধরনের উন্নয়ন প্রয়োজন, একারণে পার্কের শাসনামল রপ্তানি বাণিজ্যে ঋণ সরবরাহ করতে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র হতে বৈদেশিক সাহায্যের অন্তঃ প্রবাহ ব্যবহার করে, স্বল্প-সুদে ব্যাংক ঋণ ও কর সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা করা হয়। সরকারের সহযোগিতায়, পরবর্তীতে এসব ব্যবসা চ্যায়েবল হয়ে ওঠে।
১৯৬৫ সালের জুনে কোরিয়া-জাপান চুক্তি অনুমোদনের মাধ্যমে জাপানের সাথে সম্পর্ক শিথিল হয়। এসব চুক্তির মাধ্যমে জাপানি তহবিলগুলো ঔপনিবেশিক আমলে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য ঋণ ও ক্ষতিপূরণ আনয়ন করে, যদিও জাপান সরকারিভাবে অনুতাপ প্রকাশ করে না। এতে রাষ্ট্রজুড়ে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ বাড়তে থাকে।
সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে, এবং যুক্তরাষ্ট্র হতে বিশাল অঙ্কের সাহায্য পাওয়া অব্যাহত থাকে। ১৯৬৬ সালে সেনাবাহিনী চুক্তি সমাপ্ত হয়, যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর সেখানে নিযুক্ত থাকা আইনি অবস্থা স্পষ্টীকরণ করে। কিছুকাল পরে, কোরিয়া ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগদান করে, যুক্তরাষ্ট্র সেনাদল ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীর সাথে ১৯৬৪ হতে ১৯৭৩ পর্যন্ত কোরিয়া মোট ৩,০০,০০০ সৈনিক প্রেরণ করে।
অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তির প্রগতি তখনকার সাধারণ মানুষের জীবনেও উন্নয়ন আনে, এসব শিক্ষাক্ষেত্রে সুযোগসুবিধা প্রসারিত করে। উচ্চ শিক্ষিত কর্মীরা দ্রুত শিল্প-বাণিজ্য প্রসার, ব্যবসায়িক ক্ষেত্র ও শহরে জনসংখ্যার ঢেউয়ে নিমগ্ন থাকে। জায়োন্গবু মহাসড়ক নির্মাণ করা হয় এবং সিউলের সাথে রাষ্ট্রের দক্ষিণতম অংশ এবং বন্দর নগরী লাচন ও বুসানের সংযোগ স্থাপিত হয়। ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা সত্ত্বেও শহুরে সাধারণ শ্রমিকদের জীবনমান তখনো খুবই নিন্মমানের ছিলো। শ্রমিকদের স্বল্প মজুরীতে কাজ করতে হচ্ছিল রপ্তানি-মুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রপ্তানিতে দাম বৃদ্ধির জন্য, এবং সরকারের দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রনের কারণে কৃষকদের হতদরিদ্র অবস্থা হয়েছিলো। গ্রামীণ অর্থনীতি ক্রমশ ঐতিহ্য হারায় এবং কৃষকদের মাঝে মতবিরোধ সৃষ্টি করে, যাইহোক ১৯৭১ সালে সরকার ফার্ম উৎপাদনশীলতা ও আয়-রোজগার বাড়াতে কিছু ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যে ব্যবস্থাটি ছিলো সায়েমল আন্দোলন ("নতুন গ্রাম আন্দোলন")। আন্তোলনের লক্ষ্য ছিলো গ্রামীণ জীবনমান উন্নয়ন করা, গ্রামীণ ও শহুরে উভয় সমাজ আধুনিকায়ন করা এবং তাঁদের আয়ের মাঝে আয়ের ফারাক কমানো।
১৯৭৩ সালের পহেলা অক্টোবর সামরিক কুচকাওয়াজ চলাকালে পারক চুঙ-হি এর একটি প্রতিকৃতি
১৯৬৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৫১.৪% শতাংশ ভোটে জিতে পার্ক আবারো সরকার গঠন করে। সেসময় সংবিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুইবার রাষ্ট্রপতি হওয়ার নিয়ম ছিলো, কিন্তু তিনি তৃতীয় মেয়াদে আবারো রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য ১৯৬৯ সালে জাতীয় সংসদে জোরপূর্বক সংবিধানে সংশোধন আনেন। সংবিধান সংশোধনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে বিরোধী দলনেতা কিম ডে-জুঙ তাঁর পক্ষে বিশাল সমর্থন লাভ করে। তারপরও ১৯৭১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পার্ক আবারো নির্বাচিত হয়।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরপরই সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে বিরোধী দল বেশি আসন পায়, এবং তাঁরা সংশোধিত সংবিধানের যাবতীয় ক্ষমতা লাভ করে। পার্ক ভীত হয়ে ১৯৭১ সালে ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে। দেশে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে, নিক্সন ডকট্রিন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উপদেষ্টাদের দুঃশ্চিন্তা সহজতর করে, যা সাম্যাবাদ-বিরোধী নীতি অনুসারে নিজের শাসনামলকে বৈধ ঘোষনা করা পার্ককে উভয়সংকটে ফেলে। এক আকস্মিক ইঙ্গিতে, ১৯৭২ সালে ৪ জুলাই উত্তর কোরিয়ার সাথে পুনর্মিলনের একটি যৌথ প্রজ্ঞাপন ঘোষণা করে এবঋ সিওল ও পায়োঙ্গইয়াঙ্গে রেড ক্রস টলকস আয়োজিত হয়। যাইহোক, পুনর্মিলনী বিবেচনায় সরকারী নীতিতে কোনো পরিবর্তন করা হয় না এবং ১৯৭২ সালে ১৭ অক্টোবর পার্ক সরকার সামরিক শাসন জারি করে, তিনি জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন এবং সংবিধান স্থগিত করেন।
চতুর্থ প্রজাতন্ত্র (১৯৭২-১৯৭৯)
[সম্পাদনা]১৯৭৬ সালে উলসানে হায়ুনডাই শিপইয়ার্ডে ভারী শিল্প
১৯৭২ সালের ১২ নভেমাবর ইউশিন সংবিধান গ্রহণের মধ্য দিয়ে চতুর্থ প্রজাতন্ত্র শুরু হয়। এই নতুন সংবিধান পার্ককে সংসদের ওপর নতুন কার্যকরী নিয়ন্ত্রন দেয়, এবং স্থায়ী রাষ্ট্রপতিত্বের সম্ভাবনা দেখায়। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরোক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের হতো এবং রাষ্ট্রপতির মেয়াদ বৃদ্ধি করে ছয় বছর করা হয়, যেখানে পুন নির্বাচনের প্রয়োজন ছিলো না। আইনসভানএবং বিচারসভা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো, এবং শিক্ষা সম্বন্ধীয় নির্দেশনা সরাসরি নজরদারিতে করা হতো। সরকারের নির্দেশনায় সামরিক সরকারের সমর্থনের পক্ষে পাঠ্যপুস্তক তৈরি হতো, শিক্ষামন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হতো।
সামাজিক ও রাজনৈতিক অশান্তি সত্ত্বেও, রপ্তানি-ভিত্তিক বাণিজ্য নীতির মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে উন্নয়ন অব্যাহত থাকে। প্রথমে নেয়া দুই বাৎসরিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় সফলতা আসে এবং তৃতীয় ও চতুর্থ পরিকল্পনায় জোর দেয়া হয় ভারী শিল্প ও রাসায়নিক শিল্প বৃদ্ধির ওপর, ইস্পাত উৎপাদন ও তেল পরিশোধনে সক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্ব দেয়। যাইহোক, বৃহৎ সমষ্টিবদ্ধ চ্যায়েবল ধারাবাহিকভাবে অগ্রাধিকার চুক্তি গ্রহণ করে এবং স্থানীয় বাজার দখল করতে আসে। বিদেশী রাজধানীরহতে বেশির ভাগ উন্নয়ন আসাতে, বেশিরভাগ লভ্যাংশ চলে যাচ্ছিলো ঋণ এবং সুদ পরিশোধ করতে।
ইউশিনের নিয়মতন্ত্র বিলুপ্ত করার প্রয়াসে ছাত্রছাত্রী এবং গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনকারীরা তাঁদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। পার্কের প্রশাসন ১৯৭৪ হতে ১৯৭৫ জরুরী ডিক্রি ঘোষণা করে। যা শত শত প্রতিপক্ষকে কারাগারে চালিত করে। প্রতিবাদ আরো বিশালাকার ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যেখানে রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় নেতারা, শ্রমিক ও কৃষক সর্বস্তরের লোকজন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে যোগদান করে। ১৯৭৮ সালে, আরো একটি পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে পার্ক আরো এক মেয়াদে নির্বাচিত হয়, এই ঘটনা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশকে আরো বেশি জোরালে করে তোলে। সরকার প্রতিপক্ষ দলের নেতা কিম ইয়োঙ্গ-সাম কে সংসদ হতে বের করে দিয়ে প্রতিহিংসার পথ অবলম্বন করে এবং উগ্রবাদী নাম দিয়ে আন্দোলনকারীদের নির্যাতন করা হয়। ১৯৭৯ সালে, রাষ্ট্রজুড়ে বিশালকারা সরকার-বিরোধী বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে, এই রাজনৈতিক গোলযোগের মধ্যেই, পার্ক চুঙ্গ-হি কে কেসিআইএ এর পরিচালকের হতে খুন হন, এভাবে ১৮ বছরের সামরিক শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
পঞ্চম প্রজাতন্ত্র (১৯৭৯-১৯৮৭)
[সম্পাদনা]ম্যাঙ্গল-ডঙ কবরস্থান (২০০৮)
ম্যাঙ্গল-ডঙ কবরস্থানে গোয়ানজু বিদ্রোহে নিহত ব্যক্তিদের সমাধিক্ষেত্র
পার্ক চুঙ্গ-হি কে হত্যার পর, প্রধানমন্ত্রী চয় কিউ-হাহ রাষ্ট্রপতির পদের দায়িত্ব নেয়, কিন্তু ৬ দিন পরে ১৯৭৯ সালের ১২ই ডিসেম্বর এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে চুন ডো-হান ক্ষমতা দখল করে নেয়। পরবর্তী বছরের মে মাসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শ্রমিক পরিষদ নিয়ে গঠিত সোচ্চার নাগরিক সমাজ স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ চালনা করে। ১৯৮০ সালের ১৭ মে চুন ডো-হান সামরিক শাসন জারি করে এবং প্রতিবাদ আরো বেড়ে যায়। প্রতিপক্ষের রাজনীতিবিদ কিম ডে-জুঙ্গ এবং কিম জঙ্গ-পিল কে আটক করা হয় কিম ইয়োঙ্গ-সাম কে গৃহবন্দী করা হয়।
১৯৮০ সালের ১৮ মে, গোয়ানজু শহরে ছোনাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রী ও সামরিক আইন নির্দেশনায় প্রেরিত সামরিক বাহিনীর মাঝে সংঘাত ঘটে। এই ঘটনা শহর ব্যাপী প্রতিবাদে রূপ নেয় এবং ২৭ মে পর্যন্ত নয় দিন ব্যাপী প্রতিবাদ চলে এবং শেষপর্যন্ত গোয়ানজুতে হত্যাকান্ডে রূপ নেয়। প্রাথমিক অনুমান করা হয় কয়েক ডজন হতে ২০০০ এর মতো নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে, পরবর্তীতে বেসামরিক সরকার কর্তৃক সম্পূর্ণ তদন্তে ২০০ হত্যাকান্ড ও ৮৫০ আহতের তথ্য পায়। ১৯৮০ সালের জুনে চুন জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে সে জাতীয় জরুরী প্রতিরক্ষা নীতি সমিতি (ন্যাশনাল ডিফেন্স ইমারজেন্সি পলিসু কমিটি) গঠন করে, এবং নিজেকে এর সদস্য করে নেয়। ১৭ জুলাইয়ে, সে কেসিআইএ এর পরিচালক পদ হতে পদত্যাগ করে এবং কমিটির একজন সদস্য হিসেবে থাকে। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে, রাষ্ট্রপতি চয় কিউ-হাহ কে রাষ্ট্রপতি পদ হতে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং নতুন সামরিক নেতা চুন ডো-হান কে পথ করে দেয়ার জন্য।
ঐ বছরের সেপ্টেম্বরে, পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে চুন নির্বাচিত হয় এবং ঐ বছরের মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের সূচনা ঘটে। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠা করা হয়; রাষ্ট্রপতীয় পদ্ধতিসমূহ বজায় রেখে ৭ বছর-মেয়াদে সীমাবদ্ধ করা হয়, জাতীয় সংসদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করা হয়, সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে বিচারবিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। যাইহোক, পরোক্ষ নির্বাচনের পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি চয়ন অব্যাহত থাকে এবং বহু সামরিক সদস্যকে উচ্চ স্তরের সামরিক পদে নিয়োগ করা হয়, ইউশিন আমলের বাকি নিয়ম অব্যাহত থাকে।
ষষ্ট প্রজাতন্ত্র (১৯৮৭-বর্তমান)
[সম্পাদনা]আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Polity IV Regime Trends: South Korea, 1948-2013"। www.systemicpeace.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১০-০৬।
- ↑ Eun Mee Kim (১৯৯৮)। The Four Asian Tigers: Economic Development and the Global Political Economy। San Diego: Academic Press। আইএসবিএন 978-0-12-407440-8।
- ↑ Will the four Asian tigers lead the way again in 2010, Times of Malta, 2010-02-01