গীতাধ্যানম্‌

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ভগবদ্গীতা-র প্রেক্ষাপট: কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণঅর্জুন, অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর চিত্রকলা

গীতাধ্যানম্‌ (সংস্কৃত: गीता ध्यानम्) বা গীতাধ্যান হল ৯টি শ্লোকে বিভক্ত একটি সংস্কৃত কবিতা। এটি হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ ভগবদ্গীতা-র সঙ্গে যুক্ত।[১]:৩৯৫

গীতাধ্যান-এর নয়টি শ্লোকে ভগবদ্গীতা-র সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, চরিত্র ও দেবতার প্রতি প্রণাম জানানো হয়েছে এবং উপনিষদ্‌ শাস্ত্রের সঙ্গে ভগবদ্গীতা-র সম্পর্ক দর্শিত হয়েছে। এই ধ্যানটির উৎস নিয়ে গবেষকদের মতবিরোধ থাকলেও ভারতের একাধিক হিন্দু ধর্মগুরু এই এটি উদ্ধৃত করেছেন।

শ্লোকসমূহ[সম্পাদনা]

নির্বাচিত শ্লোক, অনুবাদ সহ

বাংলা অনুবাদ

৪. সকল উপনিষদ্‌ গাভীসমূহ, গোপালক-পুত্র কৃষ্ণ দোহনকারী, গোবৎস অর্জুন, মহাদুগ্ধ গীতারূপ অমৃত এবং সুবুদ্ধিসম্পন্নরাই এই দুগ্ধের পানকর্তা। [৪][১]:৩৯৫
৮. যাঁর কৃপায় বাকশক্তিহীনও বাচাল হয় এবং পঙ্গুও গিরি লঙ্ঘন করে, সে পরমানন্দরূপী কৃষ্ণকে আমি বন্দনা করি। [৮][১]:৩৯৯

মূল সংস্কৃত

৪.সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ।
পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ।। ৪ ।।
৮. মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্‌।
যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দমাধবম্‌।। ৮ ।।

গীতাধ্যানম্‌-এর প্রথম শ্লোকটিতে অনুধ্যান বা ধ্যান করার কথা বলা হয়েছে: হে জননী ভগবদ্গীতা! [তুমি] স্বয়ং ভগবান নারায়ণ কর্তৃক অর্জুনকে উপদিষ্ট এবং প্রাচীন ঋষি ব্যাস কর্তৃক মহাভারতের মধ্যে গ্রথিত। অদ্বৈততত্ত্বরূপ অমৃতবর্ষণকারিণী, সংসার-নাশিনী, অষ্টাদশ অধ্যায়ে বিভক্তা [হে] ভগবতী, [আমি] তোমার অনুধ্যান করি।[১]:৩৯৫[২] এই শ্লোকে ভগবদ্গীতা-কে মা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী শ্লোকে ব্যাসকে প্রণাম জানানো হয়েছে। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, ব্যাস মহাভারত-এর সংকলক তথা ভগবদ্গীতা-র কথক। এরপর কয়েকটি শ্লোকে কৃষ্ণকে (শ্লোকসংখ্যা ৩, ৫, 8) এবং পরমদেবতাকে (শ্লোকসংখ্যা ৯) প্রণাম জানানো হয়েছে।[৩]

সম্পূর্ণ গীতাধ্যানম্:[সম্পাদনা]

পার্থায় প্রতিবোধিতাং ভাবতাম নারায়ণেন স্বয়ং ব্যাসেন গ্ৰথিতাং পুরাণমুনিনা মধ্যেমহাভারতম্ ।

অদ্বৈতামৃতবর্ষিণীং ভগবতীমষ্টাদশাধ্যায়িনীমম্ব ত্বামনুসন্দধামি ভগবদ্গীতে ভবদ্বেষিণীম্॥১॥

নমঽস্তু তে ব্যাস বিশালবুদ্ধে ফুল্লারবিন্দায়তপত্রনেত্র। যেন ত্বয়া ভারততৈলপূর্ণঃ প্রজ্বালিতো জ্ঞানময়ঃ প্রদীপঃ॥২॥

প্রপন্নপারিজাতায় তোত্ত্রবেত্রৈকপাণয়ে। জ্ঞানমুদ্রায় কৃষ্ণায় গীতামৃতদুহে নমঃ॥৩॥

সর্বোপনিষদো খাবো গোদ্ধা গোপালনন্দনঃ। পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ॥৪॥

বসুদেবসুতং দেবং কংসচাণূরমর্দনম্। দেবকীপরমানন্দং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্॥৫॥

ভীষ্মদ্রোণতটা জয়দ্রথজলা গান্ধারনীলোৎপলা শল্যগ্ৰাহবতী কৃপেণ বহনী করতেন বেলাকুলা।

অশ্বত্থামবিকর্ণঘোরমকরা দুর্যোধনাবর্তিনী সোত্তীর্ণা খলু পাণ্ডবৈ রণনদীকৈবতঃ কেশবঃ॥৬॥

পারাশর্যবচঃ সরোজমমলং গীতার্থগন্ধোৎটমং নানাখ্যানককেসরং হরিকথাসংবোধনাবোধিতম্।

লোকে সজ্জনষট্‌পদৈরহরহঃ পেপীয়মানং মুদা ভূয়াদ্ভারতপঙ্কজং কলিমলপ্রধ্বংসি নঃ শ্রেয়সে॥৭॥

মূকং করোতি বাচাল পঙ্গু লঙ্ঘয়তে গিরিম্। যৎকৃপা তমহং বন্দে পরানন্দমাধবম্ ॥৮॥

যং ব্রহ্মা বরুণেন্দ্ররুদ্রমরুতঃ স্তুত্বন্তি দিবৈঃ স্তবৈর্বেদৈঃ সাঙ্গপদক্রমোপনিষদৈর্গায়ন্তি যং সামগাঃ।

ধ্যানাবস্থিততদ্গতেন মনসা পশ্যন্তি যং যোগিনো যস্যান্তং ন বিদুঃ সুরাসুরগণা দেবায় তস্মৈ নমঃ॥৯॥

উৎস[সম্পাদনা]

সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন[৪]:১৩নটরাজ গুরু[৫]: লিখেছেন যে, গীতাধ্যানম্‌ বৈষ্ণবীয় তন্ত্রসার থেকে গৃহীত। স্বামী চিন্ময়ানন্দ লিখেছেন, গীতাধ্যানম্‌ মধুসূদন সরস্বতী কর্তৃক রচিত হয়েছিল।[৬]:২৭ স্বামী রঙ্গনাথানন্দ লিখেছেন, গীতাধ্যানম্‌-এর শ্লোকগুলি

সমগ্র ভারতে প্রচলিত। ইদানীং সেগুলি বহির্ভারতেও প্রলচন লাভ করেছে। আমরা জানি না এই শ্লোকগুলি কার রচনা। কেউ কেউ মনে করেন, এগুলি তিন বা চার শতাব্দী আগে ভগবদ্গীতাভাগবত পুরাণ-এর ভাষ্যকার শ্রীধর স্বামী কর্তৃক রচিত হয়েছিল।[৭]:১৫

প্রভাব[সম্পাদনা]

নটরাজ গুরু বলেছেন, গীতাধ্যানম্‌ "গীতার অধিকাংশ ভারতীয় সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে।"[৫]: স্বামী রঙ্গনাথানন্দ বলেছেন, ভগবদ্গীতা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে, "সাধারণত মূল গ্রন্থ অধ্যয়নের আগে আমরা গীতাধ্যানম্‌-এর নয়টি শ্লোক অধ্যয়ন করি।"[৭]:১৫

হিন্দু ধর্মগুরুরা গীতাধ্যানম্‌ উদ্ধৃত করেছেন। ১৮৯৩ সালে বিশ্বধর্ম মহাসভায় ভাষণ দেবার পর স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো থেকে লিখেছেন যে, , "আমি ঈশ্বরের কাজ করছি এবং তিনি যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন, আমি সেখানেই যাচ্ছি। মূকং করোতি বাচালং ইত্যাদি। যিনি মূককেও বাগ্মীতে পরিণত করেন এবং খঞ্জকেও গিরিলঙ্ঘন করান, তিনিই আমাকে সাহায্য করছেন।"[৮]:৭১

মহাত্মা গান্ধী একটি অনাথ আশ্রমে এই ধ্যানটি সম্পর্কে বলেন, "এই বিদ্যালয়টি দেখে শ্রদ্ধায় আমা মাথা নত হয়েছে। ভাবছি, ভালবাসায় কী না হয়। ভালবাসা দিয়ে মূকও কথা বলতে পারে, খঞ্জও গিরি লঙ্ঘন করতে পারে।"[৯]

স্বামী রঙ্গনাথানন্দ অষ্টম শ্লোকটি সম্পর্কে লিখেছেন, "ভারতের বহু সন্ত ও ঋষিরা এই শ্লোকটি বারংবার উল্লেখ করেছেন কৃপার শক্তি বোঝাতে।"[৭]:২৩

অনুবাদ[সম্পাদনা]

স্বামী চিন্ময়ানন্দ গীতাধ্যানম্‌-এর একটি আক্ষরিক অনুবাদ ও বিস্তারিত টীকা প্রকাশ করেছিলেন।:

অন্যান্য ইংরেজি অনুবাদগুলি হল:

ইতালীয় ভাষাতেও এই ধ্যান অনুদিত হয়েছে:

পাদটীকা[সম্পাদনা]

  1. "Invocation to the Gita" (pp. 393-399) in: Easwaran, Eknath (১৯৭৫)। The Bhagavad Gita for daily living: Commentary, translation, and Sanskrit text। Berkeley, CA: Blue Mountain Center of Meditation। আইএসবিএন 0-915132-03-6  ওসিএলসি ১৩২২১৪১
  2. (italics added) The corresponding Sanskrit reads: "Om pārthāya pratibodhitāṃ bhagavatā nārāyaṇena svayaṃ... tvam anusandadhāmi bhagavad-gite" (See Easwaran, 1975, p. 394, or Chinmayananda, 1998, pp. 1-2).
  3. About verse 9, Chinmayananda (1998) comments that "The invocation of the Supreme-most is undertaken here through a peculiar literary trick. The extent of the Infinite cannot be comprehended by anyone and therefore, it can only be indicated by suggestive terms. Even the Creator and the Vedik Deities representing the phenomenal powers must be praying to and invoking their own glorious powers only at the altars of the Infinite and so it is said that we invoke Him, whom the deities of the Vedik period invoke by their Divine hymns" (p. 26).
  4. Radhakrishnan, S. (১৯৯৩)। The Bhagavadgita: With an introductory essay, Sanskrit text, English translation, and notes। New Delhi: HarperCollins। আইএসবিএন 81-7223-087-7 
  5. Guru, Nataraja (১৯৭৩)। The Bhagavad gita: A sublime hymn of dialectics composed by the antique sage-bard vyasa। Asia Publishing House। 
  6. Chinmayananda, Swami (১৯৯৮)। Shreemad Bhagawad Geeta chapter I & II: original Sanskrit text with Roman transliteration, word-for-word meaning, translation and commentary (revised সংস্করণ)। Mumbai, India: Central Chinmaya Mission Trust। আইএসবিএন 81-7597-084-7। ৭ জুলাই ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুন ২০১৪ 
  7. Ranganathananda, (Swami) (২০০০)। Universal message of the Bhagavad Gita: An exposition of the Gita in the light of modern thought and modern needs (Vol. 1)1। Calcutta: Advaita Ashrama। আইএসবিএন 81-7505-213-9 
  8. Vivekananda (১৯৬৪)। Letters of Swami Vivekananda। Calcutta, India: Advaita Ashrama।  (pp. 68-71). Letter to Dewanji Saheb, Chicago, 15 November 1894(3?) [sic]
  9. Gandhi (18 February 1932), Collected Works, vol. 55, p. 22.

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]