হযরত মখদুম আল্লামা শাহ কেয়ামুদ্দিন ফারুকি আল মাদানি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
হযরত মখদুম আল্লামা শাহ কেয়ামুদ্দিন ফারুকি আল মাদানি
হযরত মখদুম আল্লামা শাহ কেয়ামুদ্দিন ফারুকি আল মাদানি এর সমাধি
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম১১ হিজরী
মৃত্যু১১৫২ মঘি ১৩ই ফাল্গুন ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দ
সমাধিস্থলজামগাছতল, দক্ষিণ সোনাই পাহাড়, মাস্তাননগর, মীরসরাই, চট্রগ্রাম
ধর্মইসলাম
জাতীয়তাআরব জাতি
পিতামাতা
অঞ্চলচট্রগ্রাম
আখ্যাসুন্নি
ব্যবহারশাস্ত্রহানাফী
প্রধান আগ্রহফিকহ, সুফিবাদ, তাফসির, হাদীস
তরিকাচিশতিয়া, মাদারিয়া, সাবেরিয়া
দর্শনসুফিবাদ
মুসলিম নেতা


হযরত মখদুম আল্লামা শাহ কেয়ামুদ্দিন ফারুকি আল মাদানি ছিলেন চট্টগ্রামের বিখ্যাত দরবেশ শাহ আমানত এর খলিফা। তিনি সুদূর মদীনা হতে বিহার হয়ে চট্টগ্রামের এর মীরসরাই এ আসেন। তিনি তাফসির, হাদিসে, ও ফিকহে হানাফির বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। তিনি আঠারো শতকের শ্রেষ্ঠ কবি জ্ঞানসাগর এর রচয়িতা শাহ আলী রজা এর পীর[১] হযরত মখদুম আল্লামা শাহ কেয়ামুদ্দিন ফারুকি আল মাদানি বিখ্যাত পুস্তিকা রাসূলনোমা এর রচয়িতা যে পুস্তিকায় রাসূল (দ.) এর অবয়ব বর্ণনা করা আছে।[২]


জীবন[সম্পাদনা]

হযরত মখদুম কেয়ামুদ্দিন ফারুকি আল মাদানি ১১ হিজরির কোন এক সময় মদিনা হতে ৬/৭ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে খলিফাতুর রাসুল (দঃ) ফারুকে আজম (রাঃ) এর বংশে হযরত আমিরুল এর বংশধর হযরত আলিমুদ্দিন খাঁ এর ঘরে কনিষ্ঠ পুত্র হিসাবে ভূমিষ্ঠ হন। [৩]

প্রাথমিক শিক্ষা পিতার থেকে গ্রহণ করে মদিনায় মসজিদে নববীতেই হাদিসেরতাফসিরের দরসে যোগ দান করে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন। মক্কাতুল মুকাররমায় ফিকহি দরস হতে হানাফি মাশায়েখদের সনদ অর্জন করেন। তিনি পরবর্তীতে মদিনায় যান এবং সেখানে গিয়ে বিবাহ করেন। তাঁর ৬ মেয়ে ৩ ছেলে ছিলো। [৪]

বিবাহের পর তিনি তাফসির, হাদিসে, ও ফিকহে হানাফির দরস শুরু করেন। এই সময় ইরাক, ইরান, জর্দান ফিলিস্তানের পথে দ্বীনি তাবলিগ ও দরসের জন্য ভ্রমণ করেন।

দ্বীন প্রচার ও তাসাউফ চর্চার উদ্দেশ্যে বিহার হয়ে বাঙলায় গমন[সম্পাদনা]

মদিনায় তিঁনি ৫ মেয়ে ৩ ছেলে রেখে ৬ষ্ঠ মেয়ে রোকাইয়া ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের দিকে তাবলিগ (দ্বীন প্রচার) ও তাসাউফ চর্চার উদ্দেশ্যে নিয়ে হিজরত করেন। বিহারে হযরত শাহ সূফি আমানত নুয়াইম আল আরবী হাতে চিশতিয়ামুজাদ্দিদিয়া তরিকায় বায়াত গ্রহণ করেন। এবং অল্প দিনেই খেলাফত ও আমানত অর্জন করেন। মুরশিদের নির্দেশে ঝাড়খান্ড এর সোন নদীর পাড়ে খানকাহ স্থাপন করে দ্বিনি তাবলিগ ও রেয়াজতে মাশগুল হন। তিঁনি আরবি উর্দ্দূ, ফার্সির ভাষাভাষী হওয়ার কারণে দ্বীনি দাওয়াতি কাজে অগ্রগতি না হলে পীরের নির্দেশে মধুরামী ও দেবনাগরী অক্ষরে বাংলা, সাংস্কৃতি ও হিন্দি ভাষা শিক্ষা অর্জন করেন। তার নম্রতা, কেরামত, মিষ্টি ভাষায় দাওয়াতি আহবানে অসংখ্য লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। চারিদিকে তাঁর নাম প্রচার প্রসার হয়ে যায়। সোনপুর খানকাহ্ শরীফ এক দ্বীনি বাগানে পরিণত হয়ে উঠে।[৫]

১৭৭১ ইংরেজী সালে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বারংবার বিদ্রোহের ধারাবাকিতা শুরু করে। তখন কিছু হিন্দু কট্টরপন্থি সন্ত্রাসবাদির ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সংখ্যালগু মুসলমানদের উপর নির্যাতন আরম্ভ করে। ঝাড়খণ্ড আদিবাসী নওমসলিম ও আদি মুসলিমদের কাছে এই কট্টরপন্থি হিন্দু সম্প্রদায় প্রস্তাব দেয় যদি এই মুসলিম দরবেশ এখান হতে চলে যায় তাহলে তোমরা নিরাপদে থাকতে পারবে। মুসলিমগণ এই প্রস্তাব প্রত্যাক্ষান করে । অবশেষে হিন্দু কট্টরপন্থিগণ এই মহান আউলিয়া কে শহীদ (হত্যা) করার পরিকল্পনা করে।[৬]

একদিন হযরত মাখদুম কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া তাঁর পীর শাহ আমানত আল আরবীরাসুলুল্লাহ্ (দ.) কে স্বপ্নে দেখেন। রাসুলুল্লাহ্ (দ.) শাহ্ কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া কে বলছেন, বাবা কেয়ামুদ্দীন! "আপনার আবস্থা আমি জানতে পেরেছি। আপনি পূর্ব বাংলায় গমণ করেন সেখানে গিয়ে আমার ও আপনার পীরের দেয়া আমানত তথা স্থানে পৌছাইয়া দেন। আজ রাতই হিজরত করুন"। হযরত কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া ঐ রাতেই ১১৭৮ বাংলা ১৭৭১ ইংরেজী সোন নদীতে গিয়ে পাথরে আরোহন করে ফেনী নদীর মোহনায় আসেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো হযরতের সাথে তার বিবি চলে আসেন। পরবর্তীতে কোন এক বুর্জুগের সাহায্যে। হযরতের মেয়ে রোকাইয়াও এই স্থানে চলে আসেন। তৎকালীন ফেনীর দক্ষিণে হাজিগাঁও বর্তমান দুর্গাপুর ইউনিয়ন মীরসরাই এর হাজীশ্বরাই গ্রামে তিনি বসতি স্থাপন করেন।[৭]

হযরত শাহ্ সুফি কালু শাহ্ , হযরত কালা শাহ, হযরত চিন কি শাহ্ প্রমুখ এখানেই যরত মখদুম আল্লামা শাহ কেয়ামুদ্দিন ফারুকি আল মাদানি এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। তাঁর বিশিষ্ট খলিফাগণ হলোঃ হযরত শাহ্ সুফি কালু শাহ্, হযরত কালা মুস্তান শাহ্, হযরত কেয়ামুদ্দীন কালা, হযরত চিনকি শাহ্ , হযরত লালা শাহ্ এবং হযরত শাহ্ সুফি আলী রজা কানু শাহ্ প্রমুখ। এইখানে তিনি পূর্বের ন্যায় দাওয়াতি ও তাসাউফ এর কর্ম শুরু করেন। নবাবগণের জরিপ কালে তাঁর কর্মকান্ডে খুশি হয়ে তাকে কিছু ভূসম্পত্তি দিতে চাহিলে, তিনি নিজের জন্য গ্রহণে আপত্তি প্রকাশ করেন। তখন হযরতের বিশেষ সহচর হযরত কালা মুস্তান শাহ্ এর নামে জরিপ হয়। যা কালার তানুক নামে এখানো পরিচিত। হযরত কালা মুস্তানের নামেই বর্তমান এই মীরসরাই এর মুস্তাননগর । হযরত শাহ্ সুফি কালা মুস্তান কে হযরত কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া তরিকার দায়িত্ব অর্পন করে দেন এবং তার মেয়ে রোকাইয়া কে তাঁরই খলিফা চিনকি শাহ্ এর নিকট বিবাহ দেন। সেই বৎসর তাঁর স্ত্রী ইন্তেকাল করেন। এরপর ্তিনি পীরের থেকে প্রাপ্ত ও রাসুলুল্লাহ্ (দ.) এর থেকে রুহানীভাবে প্রাপ্ত কাজে মনোনিবেশ করেন এবং বর্তমান চট্টগ্রামের পরৈকোড়া আসেন। এই হিসেবে বলা যায় তিনি ১১৩৪ মঘি ১১৭৯ বাংলা ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দের শুরুতে কোন এক সময় শাহ্ কালাকে খেলাফত দেন এবং মেয়ের বিবাহ দেন।[৮]

১১৩৪ মঘি ১১৭৯ বাংলা ১লা কার্তিক ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দের শুরুতে তিনি শাহ্ সুফি আলী রজা কানু শাহ্ কে ১৩ বৎসর বয়সে বায়াত করান। [৯]হযরত মখদুম শাহ্ সুফি কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া, শাহ সুফি আলী রজা কে বায়াত করানোর পর তাকে হাদিসের,তাফসিরেরফিকহার বিষয়ে উচ্চ পড়াশুনা করান। এবং লালানগর বাজারের পশ্চিমে জমিদার বাড়িতে শিক্ষক হিসেবে চাকুরি নেন। দীর্ঘদিন এখানে চাকুরি করতেন আর শাহ্ আলী রজা কে জাহেরি বিদ্যায় পারদর্শি করে তুলেন। তাকে খেলাফত ও সাধনের জন্য বনবাসী হওয়ার এজাজত দিয়ে ১১৪৫ বা ১১৪৬ মঘি ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দের কোন এক সময় সেখান হতে পুনরায় মীরসরাই তে ফিরে যান। খানকাহ্ এর দায়িত্ব শাহ্ কালা মুস্তান কে অর্পন করে এবং আমানত সঠিক ভাবে আলী রজা এর নিকট পৌছিয়ে দিয়ে হযরত কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া একাগ্রচিত্তে এবাদত ও রেয়াজতে মশগুল হলেন।[১০]

ইন্তেকাল[সম্পাদনা]

হযরত মাখদুম কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া এর খেদমতে এবং তাঁর সুবিধায় হযরত কালা মুস্তান শাহ্ মস্তান নগরের পূর্ব দিকে পাহাড়ের নির্জন জনমানবহীন নীরব স্থানে একটি ছোট টিলায় হুজরা স্থাপন করে দেন। হযরত কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া এই হুজরায় বাকি জীবন কাটিয়ে দেন। এই স্থানের নাম সোনাই পাহাড়। এইখানেই বর্তমান মখদুম শাহ্ সুফি কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠিত। রাসূল (দ.) এর অবয়ব বর্ণনায় তার রচিত পুস্তিকা ‘রাসুলনোমা’র একটি কপি চট্টগ্রামের নূরিয়া বিষু দরবার শরীফে সংরক্ষিত আছে। এই মহান আল্লাহর অলী ১১৫২ মঘি ১৩ই ফাল্গুন ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। প্রতি বছর ১৩ই ফাল্গুন ২৫ শে ফেব্রুয়ারি মীরসরাই, মস্তান নগর, দক্ষিণ সোনাই পাহাড়, জামগাছতল তাঁর বাষিক ইছালে ছাওয়াব ফাতেহা শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে হযরত শাহ্ সুফি আলী রজা কানু শাহ্ এর নাতি দরবেশ শাহনুর একটি মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ করেন এবং মাজার শরীফ কে পূর্ণ সংস্কার করে দেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "আলী রজা"বাংলাপিডিয়া 
  2. মসিক আলোক ধারা/জুলাই-২০০৩/পৃঃ২৮
  3. [১]শাহ্সুফি কেয়ামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) সংক্ষিপ্ত জীবনী
  4. [২] হযরত মখদুম আল্লামা শাহ কেয়ামুদ্দিন ফারুকি আল মাদানি জীবনী
  5. মসিক আলোক ধারা/জুলাই-২০০৩/পৃঃ২৭
  6. মীরসরাই এর ওলামা ও আকাবির, পৃষ্ঠা:০৮।
  7. সিরাজুল কুলুব , রচয়িতাঃশাহ্ সুফি আলী রজা
  8. নাজমুছ্ ছাক্বিব রচয়িতাঃহযরত খাজা শাহনুর দরবেশ পৃষ্ঠাঃ১৭
  9. [৩] আল্লামা শাহ্‌ সূফী আলী রজা প্রকাশ কানু শাহ্‌ (রঃ) এর কর্ম জীবন
  10. নাজমুছ্ ছাক্বিব রচয়িতাঃহযরত খাজা শাহনুর দরবেশ পৃষ্ঠাঃ১৮