জগন্নাথ মন্দির, পুরী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
জগন্নাথ মন্দির (পুরী)
The Jagannath Temple at Puri
Shri Jagannatha Temple.jpg
জগন্নাথ মন্দির, পুরী
ধর্ম
অন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্ম
জেলাপুরী
অবস্থান
অবস্থানগ্র্যান্ড রোড, পুরী
রাজ্যওড়িশা
দেশ India
স্থাপত্য
ধরনকলিঙ্গ স্থাপত্য
সৃষ্টিকারীমালব রাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন ও রানীগুন্ডিচা (খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চমশতাব্দী নাগাদ)
ওয়েবসাইট
http://jagannath.nic.in/

পুরীর জগন্নাথ মন্দির (ওড়িয়া: ଶ୍ରୀ ଜଗନ୍ନାଥ ମନ୍ଦିର) একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দির। এই মন্দিরটি ওড়িশার পুরী পূর্ব সমুদ্র সৈকতে অবস্থিত।

পুরীর জগন্নাথ মন্দির

এই মন্দিরটি একটি বিখ্যাত হিন্দু তীর্থক্ষেত্র বিশেষ করে বিষ্ণুকৃষ্ণ উপাসকদের নিকট। এটি চারধামের অন্যতম যেখানে সকল ধার্মিক হিন্দুদের জীবনে অন্তত একবার যেতে চান। [১]

পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা

ইতিহাস[সম্পাদনা]

মন্দিরটি পূর্ব গঙ্গা রাজবংশের তৃতীয় ত্রিকলিঙ্গ রাজা অনন্তবর্মণ চোদাগঙ্গা 12 শতকে খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন, যেমনটি তাঁর বংশধর নরসিংহদেব দ্বিতীয়ের কেন্দুপাটনা তাম্র-ফলকের শিলালিপি দ্বারা প্রস্তাবিত। অনন্তবর্মণ মূলত একজন শৈব ছিলেন এবং 1112 খ্রিস্টাব্দে উৎকল অঞ্চল (যেখানে মন্দিরটি অবস্থিত) জয় করার পর তিনি বৈষ্ণব হয়েছিলেন । 1134-1135 খ্রিস্টাব্দের একটি শিলালিপি মন্দিরে তাঁর দানকে লিপিবদ্ধ করে। অতএব, মন্দির নির্মাণ অবশ্যই 1112 খ্রিস্টাব্দের পরে শুরু হয়েছিল।

মন্দিরের ইতিহাসের একটি গল্প অনুসারে, এটি দ্বিতীয় অনঙ্গভীম দেব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল : বিভিন্ন ইতিহাসে বিভিন্নভাবে 1196, 1197, 1205, 1216, বা 1226 হিসাবে নির্মাণের বছর উল্লেখ করা হয়েছে। এটি থেকে বোঝা যায় যে মন্দিরের নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল বা মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছিল অনন্তবর্মণের পুত্র অনঙ্গভীমার রাজত্বকালে । পূর্ব গঙ্গা রাজবংশ এবং সূর্যবংশী (গজপতি) রাজবংশ সহ পরবর্তী রাজাদের শাসনামলে মন্দির কমপ্লেক্সটি আরও বিকশিত হয়েছিল ।

আক্রমণ ও লুণ্ঠন[সম্পাদনা]

মন্দিরের বিবরণ, মাদালা পাঞ্জি রেকর্ড করে যে পুরীর জগন্নাথ মন্দির আঠারো বার আক্রমণ ও লুণ্ঠন করা হয়েছে।  

১৫৬৮ সালে বাংলার কররানী রাজা সুলায়মান খান কররানীর সেনাপতি কালাপাহাড় পুরীর জগন্নাথ মন্দির আক্রমণ করেন। সেই সময় ১৫৬৮ থেকে ১৫৭৭ সাল পর্যন্ত মোট ৯ বছর বন্ধ ছিল রথযাত্রা।

১৬০১ সালে তত্‍কালীন বাংলার নবাবের কম্যান্ডার মিরজা খুররাম হামলা চালায় পুরীর মন্দিরে। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি রক্ষা করতে মূর্তিগুলিকে পুরী থেকে ১৩-১৪ কিলোমিটার দূরে কপিলেশ্বরের পঞ্চমুখী গোসানি মন্দিরে সরিয়ে নিয়ে যান। সেই বছর রথযাত্রা বন্ধ থাকে।

১৬০৭ সালে ওডিশার মুঘল সুবেদার কাসিম খান জুইনি হামলা চালান জগন্নাথ মন্দিরে। মূর্তিগুলিকে বাঁচাতে লুকিয়ে খুড়গার গোপালা জিউ মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই বছরও রথযাত্রা হয় না।

১৬১১ সালেও বন্ধ থাকে রথযাত্রা। আকবরের সভাষদ টোডর মলের ছেলে কল্যান মল ওডিশার সুবেদার হয়ে এসে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে হামলা চালান। আক্রমণের খবর আগেই পেয়ে মূর্তিগুলি চিল্কা হৃদের মাহিসানসিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৬১৭ সালে আবার জগন্নাথ মন্দিরের হামলা চালায় কল্যান মল। তবে তার আসার আগেই তিনটি মূর্তি চিল্কা হৃদের গুরুবাইগড়ে সরিয়ে ফেলা হয়।

১৬২১ এবং ১৬২২ এই দুই বছর বন্ধ থাকে রথযাত্রা। মুসলিম সুবেদার আহমেদ বেগ মন্দিরে হামলা করায় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি বানাপুরের আন্ধারিয়াগড়ে সরিয়ে ফেলা হয়।

1692 সালে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মন্দিরটি বন্ধ করার নির্দেশ দেন যতক্ষণ না তিনি এটি পুনরায় খুলতে চান অন্যথায় এটি ভেঙ্গে ফেলা হবে, স্থানীয় মুঘল কর্মকর্তারা যারা কাজটি সম্পাদন করতে এসেছিলেন তাদের স্থানীয়দের দ্বারা অনুরোধ করা হয়েছিল এবং মন্দিরটি কেবল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ওডিশার মুঘল কম্যান্ডার একরাম খান মন্দিরে হামলা পরিকল্পনা করেন। হামলার খবর আগে থেকে পেয়ে পুরোহিতরা খুড়দার বিমলা মন্দিরে লুকিয়ে রাখেন। সেখান থেকে মূর্তিগুলি চিলিকা হৃদের কাছে গাডাকোকালা গ্রামে সরিয়ে ফেলা হয়। সেখান থেকে আবার বানাপুরের বড়া হনতুয়াদা গ্রামে সরানো হয় মূর্তিগুলি। এই কারণে ১৩ বছর সেবার রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। 1707 সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এটি পুনরায় চালু করা হয়।

১৭৩১ সালে মাসুলিপত্তনমের নবাব মহম্মদ তাকি খান মন্দিরে হামলা চালান। চিলিকা হৃদের কঙ্কনাশেখারি কুড়ায় সেবার লুকিয়ে রাখা হয় মূর্তিগুলি। সেখান থেকে মূর্তিগুলি নিয়ে যাওয়া হয় খুড়দার হরিশ্বর মণ্ডপে। সেখান থেকে আবার গঞ্জাম জেলার চিকিলি গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় মূর্তিগুলি। সেই বছরও অনুষ্ঠিত হয়নি পুরীর রথযাত্রা।

স্থাপত্য[সম্পাদনা]

মন্দিরটি বেলেপাথরের তৈরি, ১১৬১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পুরীর জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই নিয়ে ঐতিহাসিকদের বিস্তর দ্বন্দ্ব আছে। মন্দিরের চারটি দ্বার-- উত্তর দ্বার,দক্ষিণ দ্বার,পূর্ব দ্বার ও পশ্চিম দ্বার।উত্তর দিকের দরজাটি হস্তীদ্বার। দক্ষিণ দিকের দরজা অশ্বদ্বার। পূর্ব দিকের দরজা সিংহদ্বার এবং পশ্চিম দিকের দরজা ব্যাঘ্র দ্বার।

রত্নভাণ্ডার[সম্পাদনা]

মন্দিরের গোপন কক্ষে সাতটি ঘর আছে। সেই ঘরগুলিই হল রত্নভাণ্ডার। ৩৪ বছর আগে মাত্র তিনটি ঘরের তালা খুলতে সক্ষম হয়েছিলেন কর্মকর্তারা। বাকি ঘরগুলিতে কী আছে, তা আজও রহস্যই রয়ে গিয়েছে। শ্রীজগন্নাথের ‘ব্রহ্মবস্তু’র মতোই রত্নভাণ্ডারের রহস্য অধরাই রয়ে গিয়েছে। যে কক্ষগুলি খোলা সম্ভব হয়েছিল, সেখান থেকে উদ্ধার হয় ১৮০ রকমের মণিমুক্তো খচিত স্বর্ণ অলঙ্কার। যার মধ্যে আছে মুক্তো, প্রবালের মতো অত্যন্ত দামী পাথর। এছাড়া, ১৪৬ রকমের রৌপ্য অলঙ্কার। তবে, এই সবই ‘ভিতর রত্নভাণ্ডার’-এর কথা। ‘বাহার ভাণ্ডার’-এর চিত্র কিছুটা অন্যরকম। পুরী শ্রীজগন্নাথ মন্দির আইন, ১৯৫২ অনুযায়ী রেকর্ড জানার অধিকারে ১৯৭৮ সালে তালিকা তৈরি হয়। সেই তালিকা অনুযায়ী, বাহার ভাণ্ডারে ১৫০ রকমের স্বর্ণ অলঙ্কার আছে। যার মধ্যে তিনটি স্বর্ণহার আছে। যার এক একটির ওজন প্রায় দেড় কেজি। শ্রীজগন্নাথ এবং বলভদ্রের স্বর্ণ শ্রীভুজ ও শ্রীপায়রের ওজন যথাক্রমে সাড়ে ৯ কেজি এবং সাড়ে ৮ কেজি। জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার স্বর্ণ মুকুটের ওজন ৭ কেজি, ৫ কেজি এবং ৩ কেজি। ১৯৭৮ সালের ১৩ থেকে ২৩ মে’র মধ্যে পুরী মন্দির প্রশাসনের তৈরি হিসেব অনুযায়ী, মণিমুক্তো খচিত ১২০ কেজি ৮৩১ গ্রাম স্বর্ণ অলঙ্কার, ২২০ কেজি ১৫৩ গ্রাম রৌপ্য অলঙ্কার, রুপোর বাসনপত্র সহ বিভিন্ন দামী বস্তু রত্নভাণ্ডারে পাওয়া গিয়েছে। প্রতি বিজয়াদশমী, কার্তিক পূর্ণিমা, পৌষ পূর্ণিমা এবং মাঘী পূর্ণিমার দিন শ্রীক্ষেত্রে ভক্তদের সামনে রাজবেশে দর্শন দেন মহাপ্রভু। তার সেই সজ্জা দেখে ভক্তরা ধন্য ধন্য করেন। যে সব অলঙ্কারে জগন্নাথদেবকে সাজানো হয়, সেগুলি হল, শ্রীচরণে শ্রীপায়র, হাতে শ্রীভুজ, কর্ণে কীরিটি, ওড়না, সূর্যচন্দ্র, কানা, আড়াকানি, ঘাগরা, মালি, কদম্বমালি, তালিকচন্দ্রিকা, অলকাতিলকা, ঘোবা কণ্ঠী, স্বর্ণচন্দ্র, রৌপ্য শঙ্খ, হরিদা, সেবতী মালি। দাদা বলভদ্রের অঙ্গে থাকে শ্রীপায়র, শ্রীভুজ, শ্রীকীরিটি, অধ্যয়নী কুণ্ডর, সূর্যচন্দ্র, আড়াকানি, কদম্বমালি, তিলক চন্দ্রিকা, হল, মুষল, বহড়া মালি। সুভদ্রার অঙ্গে থাকে শ্রীপায়র, শ্রীভুজ, কীরিটি, ওড়না মালি, ঘাগরা মালি, কানা মালি, সূর্যচন্দ্র, আদাকানি, সেবতী মালি তড়াগি ইত্যাদি। [২]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে অফিসিয়াল ওয়েবসাইট

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৫ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ মে ২০১৫ 
  2. "শ্রীজগন্নাথ ধামের রত্নভাণ্ডারের রহস্য"। ২৪ নভেম্বর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ জুন ২০১৮ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]