ইউক্লিড

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ইউক্লিড
ইউক্লিড
জন্মখ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি
মৃত্যুখ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীর মাঝামাঝি
পরিচিতির কারণইউক্লিডীয় জ্যামিতি
ইউক্লিড’স এলিমেন্টস
ইউক্লিডীয় এলগরিদম
ইউক্লিডের নামে নামকরণ করা জিনিসগুলির তালিকা
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রগণিত

ইউক্লিড (জন্ম: অজানা - মৃত্যু: ৩০০ খ্রি. পূ.) বিখ্যাত গ্রিক গণিতজ্ঞ। তার লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে মাত্র তিনটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এগুলো হলো : ডাটা, অপটিক্সএলিমেন্টস। এলিমেন্টস বইটি মোট ১৩ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। পাটিগণিতের মূল নিয়মাবলী, জ্যামিতি, গাণি[১]তিক রাশি ও গাণিতিক সংকেত, সংখ্যাতত্ত্বসহ গণিতের বিভিন্ন শাখায় তার অবদান রয়েছে। অমূলদ রাশির আবিষ্কার গ্রিক গণিতকে যে সংকটে ফেলেছিল তা থেকে উদ্ধার পেতে পাটিগণিত জ্যামিতির দিকে ঝুঁকে পড়েছিল আর ইউক্লিডের গণিতেরও অনেকটাকেই বলা যেতে পারে জ্যামিতিক বীজগণিত। তার প্রধান বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ ইউক্লিড’স এলিমেন্টস। এতে আলোচনা আছে তলমিতি ও ঘ্নমিতি এবং সংখ্যাতত্ত্বের বিভিন্ন সমস্যা যেমন অ্যালগরিদম নিয়ে।[২]

ইউক্লিডের জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধ প্রণালী নিম্নোক্ত কয়েকটি মৌলিক প্রতীকির উপর নির্ভরশীল। সেগুলো হচ্ছে : বিন্দু, রেখা, তল, গতি এবং এই দুটি সম্পর্ক_"কোনো বিন্দু একটি তলের অন্তর্গত একটি রেখার উপর অবস্থিত" ও "যে কোনো বিন্দুর অবস্থান অন্য আর দুটি বিন্দুর মধ্যে"। আধুনিক পর্যালোচনা অনুসারে, ইউক্লিডের জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধগুলো এই পাঁচটি ভাগে বিভক্ত : আপত্ন, ক্রম, গতি, সন্ততি এবং সমান্তরাল স্বতঃসিদ্ধ। এই জ্যামিতি অসীম স্তরের উপাদানের কথাও বিবেচনা করেছে। এই প্রসঙ্গে ইউক্লিডিয়ান স্পেস ও ইউক্লিডিয়ান রিং-এর কথা উল্লেখ করা যায়।[২]


সেই আদি যুগ থেকে শুরু করে ইউক্লিডের যুগ পর্যন্ত জ্যামিতিশাস্ত্রের একটি সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়।

কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করতেন এই জ্যামিতিগ্রন্থ সংকলন ও সম্পাদনা করার জন্য মহাজ্ঞানী অ্যারিস্টটল তাঁকে নির্দেশ এবং অনুপ্রেরণা দান করেছিলেন। তাঁর আদেশেই ইউক্লিড এই জটিল কাজে হাত দেন এবং তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন। কিন্তু আধুনিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, কারো আদেশে নয়, ইউক্লিড তাঁর নিজের মনের অনুপ্রেরণাতেই বেছে নিয়েছিলেন এই বিশাল কর্মটি।

আজ এই গ্রন্থ বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রচারিত হয়েছে বিশ্বের প্রতিটি দেশে। পরবর্তীকালে বিশ্বের জ্ঞানী এবং পণ্ডিত ব্যক্তিরাও ইউক্লিডের জ্যামিতির সূত্র অবলম্বনেই তাঁদের গবেষণা করেছেন আবিষ্কার করেছেন অনেক বড় বড় বৈজ্ঞানিক সূত্র। ইউক্লিডের উপর গবেষণা করতে করতেই বিখ্যাত জার্মান অঙ্কশাস্ত্রবিদ রেইম্যান (Rieman) আবিষ্কার করেন ইউক্লিডিয়ান জিওমেট্রি (Euclidian Geometry)।

মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনও ইউক্লিডের জ্যামিতির সূত্রের সাহায্যেই আবিষ্কার করেছেন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্ব (Relativity)। এ ছাড়াও আইনস্টাইন ছিলেন ইউক্লিডের একান্ত ভক্ত এবং তাঁর ভাবশিষ্য। তিনি ইউক্লিডের উপর অনেক প্রবন্ধ রচনা করেছেন এবং গবেষণাও করেছেন। মহাজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতে ইউক্লিড ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অঙ্কশাস্ত্রবিদ। তিনিই জ্যামিতিশাস্ত্রের সত্যিকার সূত্র আবিষ্কার করে গেছেন।

ইউক্লিডের জ্যামিতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—কতকগুলো ব্যাপার বিনা প্রমাণে মেনে নিতে হবে। তাদের বলা হয় স্বতঃসিদ্ধ । অথাৎ এগুলো ধ্রুব সত্য। অঙ্ক দিয়ে এর কোনো প্রমাণ দেওয়া যাবে না, অর্থাৎ বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না। যেমন : ইউক্লিডের একটি সিদ্ধান্ত হলো---কোনো একটি সরল রেখার বহিঃস্থ কোনো বিন্দু থেকে একটিমাত্র সমান্তরাল সরলরেখা আঁকা যেতে পারে। ইউক্লিডে বলেন, z বিন্দুর ভেতর দিয়ে XY সরলরেখার সমান্তরাল একটিমাত্রই সরলরেখা আঁকা যায়। ইউক্লিড নিজেই এ ব্যাপারটির একটি যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ খাড়া করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি।

পরবর্তীকালে অন্যান্য গণিতজ্ঞেরাও অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাঁরাও ইউক্লিডের মতোই ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে ইউক্লিডের সেই ধ্রুব সত্যগুলো ধ্রুবই রয়ে গেছে।

অঙ্কশাস্ত্র বিষয়টি সত্যি খুব কাঠখোট্টা। কিন্তু এমন নীরস বিষয়ের প্রতিই প্রচণ্ড আগ্রহ ছিলো ইউক্লিডের। তিনি যখন জ্যামিতিশাস্ত্র নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় গ্রন্থ রচনা এবং গবেষণায় রত ছিলেন, তখন সারা দেশ জুড়ে তার ছিলো প্রচণ্ড খ্যাতি। এমনকি স্বয়ং সম্রাট টলেমিও ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ এবং অনুরাগী ভক্ত। তিনি নিজেও মাঝেমধ্যে ইউক্লিডের কাছে এই কাঠখোট্টা জ্যামিতি শিখতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু জ্যামিতির জটিল তত্ত্ব তাঁর মাথায় সহজে ঢুকতো না। তাই তিনি একদিন ইউক্লিডকে বলে ফেলেছিলেন, আচ্ছা, আপনার বইয়ে জ্যামিতির সূত্র যেভাবে লিখেছেন, এর চেয়ে সহজভাবে লিখবার বা বোঝবার কোনো পথ নেই? সম্রাটের প্রশ্ন শুনে মহাজ্ঞানী ইউক্লিড সবিনয়ে বলেছিলেন,-না, মহারাজ। রাজাদের জন্যও জ্যমিতিতে কোনো সহজ উপায় তৈরি হয়নি। জ্ঞানার্জনের জন্য রাজকীয় পথ বলে কিছু নেই (In Geometry there is no shortcut for kings. There is, Sir, no royal road to learning)

ইউক্লিডের এই কথাটি ইতিহাসের পাতায় আজো অমর হয়ে আছে।



এলিমেন্টস[সম্পাদনা]

রাফায়েলের অমর সৃষ্টি "স্কুওলা দি আতেনে" চিত্রকর্মে ইউক্লিড।

যদিও এলিমেন্টস এর বহু কাজই পূর্বতন গণিতবিদরা সম্পন্ন করেছেন, তবুও ইউক্লিডের বিশেষত্ব ছিল এই কাজগুলো একত্রীকরণে। তিনি বিচ্ছিন্ন কাজগুলোকে জড়ো করে একক গ্রন্থে প্রাসঙ্গিকভাবে সাজিয়ে দেয়ায় যেকোনো কাজের তথ্যসূত্র উদ্ধৃতিকরণ সহজ হয়ে যায়। ২৩ শতাব্দী পরও তাই গাণিতিক প্রমাণগুলো যথাযথভাবে গণিতের ভিত্তি হয়ে রয়েছে।

এলিমেন্টস এর প্রথম দিকের প্রতিলিপিগুলোয় ইউক্লিডের নাম আসেনি, বরং অধিকাংশ প্রতিলিপিতে বলা হয়েছে সেগুলো "থিওনের সংস্করণ থেকে" অথবা "থিওনের বক্তৃতামালা"। ভ্যাটিকানে সংরক্ষিত যে প্রতিলিপিটিকে প্রাথমিক সময়ের প্রতিলিপি বলে ধরা হয় সেটায় কোনো লেখকের নাম উল্লেখ নেই। ইউক্লিড এলিমেন্টসের রচয়িতা বলে একমাত্র যে তথ্যসূত্রটি পাওয়া যায় তার নাম প্রোক্লুস, যিনি তার কমেন্টারি অন দ্যা এলিমেন্টস বইতে ইউক্লিডকে এর লেখক হিসেবে আরোপ করেছেন।

যদিও এলিমেন্টস এর জ্যামিতির জন্য সর্বাধিক পরিচিত, সংখ্যাতত্ত্বও এর অন্তর্গত যেখানে পারফেক্ট নাম্বার ও মার্জেন প্রাইমের মধ্যকার সম্পর্ক এবং গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়ক বের করার ইউক্লিডীয় এলগরিদম বর্ণনা করা হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে এলিমেন্টস এ বর্ণিত জ্যামিতিই ছিল জ্যামিতি বলতে যা বোঝায় তার সবকিছু। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে অ-ইউক্লিডীয় বা ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির আবির্ভাব হলে এলিমেন্টস এর জ্যামিতিজ্ঞানকে ইউক্লিডীয় জ্যামিতি নামে আখ্যায়িত করা হয়।

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

Euclides, 1703

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "ইউক্লিড"উইকিপিডিয়া। ২০২৩-০৩-২৬। 
  2. ধীমান দাশগুপ্ত, বিজ্ঞানী চরিতাভিধান, ১ম খণ্ড, বাণীশিল্প, কলকাতা, জানুয়ারি ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৬৭-৬৮।