শ্রীরামপুরের ভৌগোলিক অবস্থান ২২.৭৫° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৩৪° পূর্ব দ্রাঘিমায়। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। শ্রীরামপুরের পূর্বে হুগলী নদীর ওপারে ব্যারাকপুর শহর[১২], পশ্চিমে আরামবাগ শহর[১৩], উত্তরে চন্দননগর শহর[১৪] ও দক্ষিণে হাওড়া শহর[১৫]
শ্রীরামপুরে পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে জি টি রোড ও পশ্চিমে যাওয়ার জন্য জি টি রোড-এর ওপর “শহিদ গোপীনাথ সাহা উড়ালপুল” রয়েছে।[১৬] কলকাতা-দিল্লি রোড এই শহরের পশ্চিমপ্রান্তে উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর বিস্তৃত। এই দিল্লি রোড এবং শ্রীরামপুর টাউন রেল স্টেশন ও শ্রীরামপুর কোর্ট(আদালত) থেকে বিভিন্ন রুটের বাস আছে।[১৭][১৮][১৯] পশ্চিম শ্রীরামপুরের মল্লিকপাড়ায় জিটি রোডের ধারে ৫ বিঘা জায়গা জুড়ে রয়েছে ‘শ্রীরামপুর মহকুমা বাস-মিনিবাস ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি বাস টার্মিনাস; এতে প্রায় ৩০ টি রুটের ২৫০ টি বাস দাঁড়াতে পারে। এছাড়াও শহরের ভিতরে বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন রুটে অটো এবং টোটোর ব্যবস্থা রয়েছে।[২০]
১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট পূর্ব ভারতে রেল চলাচল শুরু হলে প্রথম দফাযর সেই রেলের যাত্রাপথ ছিল হাওড়া থেকে হুগলী এবং মধ্যপথে তা থেমেছিল বালি, শ্রীরামপুর আর চন্দননগরে।[২১] বর্তমানে শ্রীরামপুর শহরে দুটি রেল স্টেশন - শ্রীরামপুর টাউন এবং শেওড়াফুলি; এরা হাওড়া-বর্ধমান (মেন) শাখার খুবই গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশন। এই দুটি রেলস্টেশনে প্রতিদিন লোকাল ও দুরপাল্লার ট্রেন মিলিয়ে মোট ২৭২টি (শ্রীরামপুর টাউন) এবং ২৭০টি (শেওড়াফুলি স্টেশন) ট্রেন আসে[২২][২৩] ও প্রতিদিন হাজারেরও বেশি মানুষ যাতায়াত করেন।[২৪]
লাল বিহারী দে, এম.টান্সডেন্ড, নারায়ণ চট্টরাজ গুণানিধি, কালিদাস মৈত্র, জন রবিনসন এবং অন্যরা তাদের সাহিত্য চর্চার খুব সক্রিয় ছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ শ্রীরামপুরে চাতরায় জন্মগ্রহণ করেন তাঁর মামার বাড়িতে।[৪৯]মহান লেখক, দীনবন্ধু মিত্র পোস্টমাস্টার ছিলেন শ্রীরামপুর প্রধান ডাকঘর-এর (৭১২২০১)। বিখ্যাত সাহিত্যিক, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় শ্রীরামপুরের চাতরায় তাঁর ছেলেবেলা কাটিয়েছেন। অমিয় চক্রবর্তী, হরপ্রসাদ মিত্র-এর মত কবি এখানে জন্মগ্রহণ করেন।[৫০] স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক তথা লেখক অশ্বিনীকুমার দত্তচাতরা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ছিলেন।[৫১]
এই শহর কয়েক শতাব্দী পুরনো এবং উভয় বৃদ্ধি এবং সামন্ততন্ত্র, একটি সাংস্কৃতিক রেনেসাঁস ( বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত) ব্রিটিশ দ্বারা প্রবর্তিত পূর্ব ভারতীয় নির্মাণের নিম্নলিখিত দিনেমারদের এবং তাদের উপনিবেশ আসার এবং তারপর পতন প্রত্যক্ষ করেছে রেলওয়ে, পরবর্তী শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে বরাবর।
মাহেশ জগন্নাথ মন্দির ১৩৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা হয়। বাংলার ১৫ শতকে শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণবধর্মের নেতৃত্বে এখানে এলে, এসব স্থানে একটি হিন্দু তীর্থ কেন্দ্র হিসেবে অগ্রগণ্য ওঠে।
রাজা মনোহর রায় উত্তর শ্রীরামপুরের শেওড়াফুলি এর জমিদা্র ১৭৫৩ সালে শ্রীপুর রাম-সীতার মন্দির তৈরী করলেন আর তার ছেলে রামচন্দ্র রায় পরে দেবতার সেবা দেবোত্তর ভূমি হিসাবে শ্রীপুর, গোপীনাথপুর ও মনোহরপুর গ্রামের নিবেদন করেন। পরবর্তীকালে রাজা নির্মল চন্দ্র ঘোষ এবং শেওড়াফুলি রাজ দেবোত্তর এস্টেট, শ্রীরামপুর -এর দ্বারা মন্দির যত্ন নেয়া হয়। বর্তমান কালে, মন্দির ও তার প্রাঙ্গন শেওড়াফুলি রাজবাড়ী নজরদারির আওতায়।
এটা সম্ভব যে শ্রীরামপুর নামটি সম্ভূত পারে শ্রীপুর, শ্রী রাম বা উভয় থেকে, অথবা এটি সীতারামপুর থেকে উদ্ভূত পারে সেখানে একটি খুব বিখ্যাত 'রাম-সীতা' মন্দির ছিল। শ্রীপুরে কিছু সম্ভ্রান্ত পল্লী যথা গোস্বামীপাড়া, লাহিড়ীপাড়া, মুখার্জীপাড়া, ভট্টাচার্যপাড়া, চক্রবর্তীপাড়া, বেণিয়াপাড়া ইত্যাদি, যার অধিবাসীরা বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণির ব্রাহ্মণ এসেছে। ১৮ এর শতকে মাহেশ, বল্লভপুর, আকনা, শ্রীপুর, গোপীনাথপুর, মনোহরপুর, চাতরা, রাজ্যধরপুর, নওগাঁ, শেওড়াফুলি, সিমলা-সাতঘড়া-এই সমস্ত গ্রামগুলিকে নিয়ে তৈরি হয় এই শ্রীরামপুর শহর।
সেখানে শ্রীরামপুরের নগরায়ন প্রক্রিয়ায় তিনটি প্রধান পর্যায়ক্রমে ছিল :
১।প্রাক-নগরায়ণকাল ( ১৭৫৫ এর আগে পর্যন্ত )
২।নগরায়ন পর্যায় (১৭৫৫ থেকে ১৮৫৪ পর্যন্ত)
৩।শিল্পায়ন পর্যায় (১৮৫৪ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত)
মুঘল যুগের আগে, সরস্বতী ও হুগলী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে একটি সমৃদ্ধিশালী স্থানীয় সম্প্রদায় ছিল।
এরপর সেবা বর্গ যারা প্রতিবেশী গ্রামগুলো থেকে এসে মঞ্জুর জমির উপর বসতি স্থাপন সহ স্থানীয় কাজকর্মের জন্য প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল এই পথ। এই ধরনের পটুয়াপাড়া,কুমোরপাড়া, ঢুলিপাড়া, গোয়ালাপাড়া, দত্তবাগান ,খাসবাগান যেমন উপনিবেশগুলির গঠন করা হয়েছে। সত্য যে শেওড়াফুলি স্থানীয় বাজারজাত হুগলির বিভিন্ন প্রান্তে উৎপাদিত পণ্যের জন্য একটি ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট ছিল , অনেক পরিবার প্রবর্তিত বরাবর এই - বারুজীবি, দত্ত, দাস ইত্যাদি - বসতি স্থাপন ও চাষ করে। আগে এখানে বসতি স্থাপন করতে আসা সদগোপপাড়া, মান্নাপাড়া, লঙ্কাবাগানপাড়া-র মত জায়গাগুলোতে . জেলে - কৈবর্ত এবং সানি - মুচি , ইতিমধ্যে প্রথম থেকেই এলাকায় ছিল এবং তাদের নিজস্ব এলাকায় ছিল। স্থানীয় সুন্নি মুসলমান, মোগল সৈন্যরা , ব্যবসায়ী ও কারিগর বংশধর মল্লিকপাড়া , মুসলমান পাড়ায় বাস করতেন এবং এখানে একটি মসজিদ আজও তাদের সাক্ষ্য বহন করে।
মুঘল আমলে আকনা ( আজকের আকড়াবা্টী লেন ) এবং মাহেশ ঘন জনবসতি ছিল। এলাকার উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ু বস্ত্রবয়ন শিল্পের উপযুক্ত ও স্থানীয় ভূমি ভাল তার সুতি ও রেশমি বয়ন জন্য পরিচিত ছিল। হিন্দু তাঁতি জরিমানা তুলো টুকরা তৈয়ার করতে ব্যবহৃত, যখন মুসলিম তাঁতিরা রেশম উৎপাদনে একচেটিয়া। উর্বর জমি ,ধান ,পাট ও পান পাতাওয়ালা এ প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। কৈবর্ত মাছ ধরার জন্য অনূপদেশ ব্যবহার করত।
প্রাক নগরায়ন যুগে যোগাযোগ প্রধানত নদী দ্বারা ছিল। এ ছাড়া ,সেখানে বাদশাহী সড়ক বা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ছিল।[৫৮] দিনেমারদের আসার আগে এই অঞ্চলে শেওড়াফুলি হাট প্রধান অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল এবং বরিশাল, খুলনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) অন্যান্য জেলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সংযোগ ছিল। ১৪ ও ১৮ শতাব্দীর মধ্যে, যেমন ফরাসি, পর্তুগিজ ও ডাচ হিসাবে অনেক বিদেশী বণিকদের এখানে ট্রেডিং ফাঁড়ি স্থাপন বা " কুঠি " এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত ছিল। মুসলিম আমলে হুগলি ও সরস্বতী নদীর তীরে গ্রামবাসী শেওড়াফুলির জমিদারির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সামন্ত প্রভুদের না শুধুমাত্র ভাড়া সংগ্রহ বরং ন্যায় প্রয়োগও করা হয়।
নগরায়ন ফেজের প্রথম দিকে ১৮ শতকের মধ্যে দিনেমারদের দ্বারা এলাকায় জমি অধিগ্রহণ শুরু হয় ডেনিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে।[৫৯] ১৭৫৫ সালে ডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব তার
অফিস থেকে একটি প্রতিনিধি পাঠান। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পরওয়ানা (জেলা অধিক্ষেত্র) তাদের বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া। তারা নবাব আলীবর্দী খানকে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা পরিশোধ করে পরওয়ানা প্রাপ্ত, অনেক উপহার সহ জমির তিন বিঘা একটি নতুন কারখানা আকনা-এ এবং বন্দর নির্মাণের এবং তারপর অন্য সা্তান্ন বিঘা শ্রীপুরে অর্জন, যা দিনেমারদের পরিচালিত।পরবর্তীকালে দিনেমারেরা শেওড়াফুলি জমিদারকে (ট্যাক্স কৃষক) ১৬০১ টাকা বার্ষিক খাজনা পরিশোধ করে শ্রীপুর, আকনা ও পিয়ারাপুর মহাল অর্জন করে। ১৭৭০ এ ডেনিশ বণিকদের দ্বারা বাণিজ্য ও এলাকায় বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করতে শুরু করেছিল। ডেনিশ কর্নেল ওলেবাই থেকে, যারা ১৭৭৬ সালে শ্রীরামপুর-এর প্রথম ক্রাউন শাসক নিযুক্ত হন, সক্ষম প্রশাসনিক কর্মক্ষমতা সহায়তা করেন।
ডেনিশ সমাধিক্ষেত্র
দিনেমারদের প্রতিষ্ঠিত ক্রাউন বাজার (বর্তমান টিনবাজার) ও বেসরকারি গুদামে দেওয়া বা গুদাম রক্ষণাবেক্ষণ করায় ধীরে ধীরে শহর উন্নত এবং মার্জিত এবং সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। উভয় বিদেশী এবং দেশীয় বণিকেরা পৌছান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।[৬০]
ডেনিশ সমাধিক্ষেত্র
প্রাথমিকভাবে দিনেমারদের পণ্যদ্রব্য ( প্রাথমিকভাবে সিল্ক এবং তুলো কাপড় ) প্রাপ্তির জন্য তাদের কারণের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু তারা পরে প্রযোজক থেকে সরাসরি পণ্যদ্রব্য সংগ্রহে জড়িয়ে পড়েন এবং উচ্চ মানের পণ্য তৈরীর জন্য দেওয়া সতংকার আকারে কারিগরদের প্রণোদনা। এছাড়াও তারা এজেন্টদের মধ্যে লেনদেনের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের একটি শ্রেণী গড়ে তুলেছি্ল। শোভারাম বসাক ও আনন্দরাম বসু স্থানীয় দুই টেক্সটাইল ব্যবসায়ীরা দিনেমারদের প্রথম জন্য কারণের হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। নন্দলাল চক্রবর্তী ছিলেন প্রথম এজেন্ট ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি দেওয়ান পদে উন্নীত হন। পতিত পাবন রায় বাঁকুড়া জেলার কোতলপুর থেকে এসেছেন এবং রাম দে-কে শোরা সরবরাহের জন্য এজেন্ট নিয়োগ করা হয়। রঘুরাম গোস্বামী এবং তার ভাই তাদের ভাগ চাওয়া্র জন্য পাটুলীতে তাদের বাড়িতে গ্রাম থেকে শ্রীরামপু্রে আসে। রঘুরাম ডেনিশ গভর্নর সৈন্যবাহিনীকে খাদ্যসরবরাহের ভারপ্রাপ্ত এ চাকরি পেয়েছিলেন যখন তার ভাই কারখানার সরকারি মহাজন হয়ে ওঠে। তারা একটি বিশাল ভাগ সুবিশাল জমি জড় এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে পশ্চিম শ্রীরামপুরের একটি অভিজাত উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত করে। তাদের বংশধরদের আজও শ্রীরামপুরে বাস।
আকনা ও মোহনপুর গ্রামের তাঁতিদের একটি রুটির টুকরো হিসেবে দিনেমারদের উভয় তুলো এবং জরিমানা সিল্ক পণ্যের জন্য অগ্রিম দিয়েছিলেন। সোমালিয়ার তাদের নিজস্ব কারখানা স্থাপন জরিমানা কাপড়ের উৎপাদন। তারা জোগাড় করল 'হাতুড়ি' এবং জাহাজের জন্য 'দড়াদড়ি' দড়ি এবং কৃষিজ পণ্যের বিভিন্ন অন্যান্য ধরণের সংগ্রহ। তা ছাড়াও নীল চা্ষ, ধান থেকে পিয়ারাপুররের চাষীদের অনুপ্রাণিত। মিস্টার প্রিন্সেপ ছিলেন নীলের এজেন্ট।
তাদের আয়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উৎস হুন্ডি ব্যবসা ছিল। কর্নেল ওলে'বি-ও শ্রীরামপুরকে একটি কমনীয়, মার্জিত, আকর্ষণীয় পর্যটন রিসোর্ট তৈরি করতে আগ্রহী ছিলেন। এটা একটি ভাল সুরক্ষিত শহর এবং আইন ও শৃঙ্খলা ভাল উন্নত ছিল। পৌর প্রশাসন ও বিচার কাজ সহজতর করার জন্য, একটি নতুন কোর্ট হাউস নির্মিত হয়েছিল এবং একটি পাকা রাস্তা নদী তীরে স্থাপন করা হয়েছিল এবং মহৎ প্রাসাদোপম ভবন দাঁড় করানো হয়েছিল, যা আজও সেখনে রয়েছে। স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন, তবে একটি পুরসভা 'ভিলেজ কমিটি', তার গভর্নর হিসেবে ওলে'বি এর সঙ্গে হিসাবে পরিচিত একটি প্রোটোটাইপ দ্বারা বাহিত হয় আউট। ডেনিশ বহির্বাণিজ্যের সুবাসিত দিন মূলত কারখানা প্রধান হিসেবে ওলেবাই থেকে সেবার সঙ্গে মিলে, মাত্র কয়েক বাধা ১৭৭৬ থেকে ১৮০৫।
শ্রীরামপুর ত্রয়ীর আগমন (উইলিয়াম কেরী, জোশুয়া মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড) ও মিশন প্রেসের প্রতিষ্ঠা[সম্পাদনা]
শ্রীরামপুরের প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে কমবেশি অনেকেই অবগত আছেন। এখন মনে করা যাক আমরা ২০০ বছরেরও আগে ডেনিশ অধিকৃত ফ্রেডেরিক্সনগরে চলে গেছি। কলকাতা থেকে প্রায় ৩৫ কিমি উজানে গঙ্গা নদীর পশ্চিম উপকূলে মনোরম পরিবেশে সুদৃশ্য শ্রীরামপুর(ফ্রেডেরিক্সনগর) শহর। ১৭৫৫ সাল থেকে এই ফ্রেডেরিক্সনগরে দিনেমারদের(ডেনিশদের) উপনিবেশ ক্রমশ বাণিজ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে।[৬১] গঙ্গার ঠিক অপর দিকে ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট আর এক মাইল উপকূল জুড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির গভর্নরসহ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারিদের অবসর বিনোদনের পরিসর। এপারে ডেনিশ পতাকা গাড়া নিশান ঘাটে উঠেই ডানদিকে ডেনিশ ট্যাভার্ণ অ্যান্ড হোটেল(১৭৮৬) আর বামদিকে গভর্মেন্ট গোডাউন রয়েছে। তাদের মাঝখানের পথ ধরে সোজা এগোলে ঘেরা ১৭ বিঘা ফুলগাছে সাজানো বাগানের চওড়া গেটের ভেতরদিকে রাজকীয় গভর্মেন্ট হাউস(১৭৭১) দেখা যাচ্ছে। গেটের পাশে ওয়াচ হাউস(১৭৭১) তখনও ২তলা হয়নি। গঙ্গার ধারে ক্যাথেলিক চার্চ(১৭৬১) তৈরি হলেও লিউদেরিয়ান চার্চ সেন্ট ওলাফ কিন্তু হয়নি। এমনকি গভর্মেন্ট হাউস এর পিছনের দিকে ৬বিঘা জমিতে ক্রাউন বাজার(বর্তমানে টিনবাজার) ও তার মধ্যে বিশাল বিশাল স্টোর হাউস বা কাছেই জেলখানার অস্তিত্ব নেই। তবে যুগল-আড্ডি ঘাটে দু ঘরের বারান্দাসমেত বাড়িটা অসুস্থ মরণাপন্নদের গঙ্গাযাত্রী নিবাস (১৭৫৭) তৈরি হয়েছে। আর কিছু দূরে প্রায় ৯০০০ ফুটের পেয়ারাপুর ক্যানেল(১৭৮১ ডিসেম্বর) ডেনিশরা কেটে ঐ অঞ্চলে চাষের প্রয়োজনীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। এই বন্দরনগরীর একপাশে ছোটবড় পালতোলা নৌকার আনাগোনায় স্রোতস্মিনী মা গঙ্গা কল্লোল মুখর হয়ে থাকে দিনের আলোয়। রাত্রি নিশিথে শান্ত হয়ে আসে পরিমন্ডল। এমন সময় একদিন অতি প্রত্যুষে দুটো নৌক এসে নোঙর করে নিশান ঘাটে। চার মিশনারি পরিবারের সদস্যেরা নৌক থেকে ডাঙায় অবতরণ করে ১৭৯৯ সালের ১৩ অক্টোবর। তাঁরা হলেন উইলিয়াম ওয়ার্ড ও স্ত্রী সন্তানাদিসহ জশুয়া মার্শম্যান, তাঁর বন্ধু জন গ্র্যান্ট ও ইমানুয়েল ব্রান্সডন। সঙ্গে আনেন লন্ডন ডেনিশ কনসুলেটের লিখিত ছাড়পত্র। প্রথমে তাঁরা সকলে 'মায়ার্স' হোটেলে ওঠেন। পরে ডেনিশ গভর্ণর কর্নেল ওলি বি-র শরণাপন্ন হলে তাঁর বদান্যতায় শ্রীরামপুরে নিরাপদ আশ্রয় লাভের আশ্বাস পেয়ে, একটা বড় বাড়ি ভাড়া করে উঠে যান সেখানে। কর্নেলের পরামর্শ মতো ওয়ার্ড উত্তর বঙ্গে অবস্থানরত ১৭৯৩ সালের শেষদিকে বাংলায় আগত উইলিয়াম কেরীর সাথে যোগাযোগ করেন। তাঁদের মধ্যে আলোচনার পর ঠিক হয় শ্রীরামপুরেই মিশন গঠন যুক্তিযুক্ত। উডনী সাহেবের উপহার একটা কাঠের মুদ্রণযন্ত্র সমেত কেরী পরিবারসহ ১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি ওয়ার্ডের সাথে শ্রীরামপুর চলে আসেন।[৬২] অভিজ্ঞ কেরীর নেতৃত্বে সেইদিনই বাংলার প্রথম ব্যাপটিস্ট মিশন সংগঠিত হয়। আর মিশন প্রেস থেকে সুদক্ষ ওয়ার্ডের তত্ত্বাবধানে ছাপার কাজ শুরু হওয়ায় শ্রীরামপুরের ইতিহাসের ধারা নতুন পথে বইতে থাকে। শ্রীরামপুরে কেরীর নেতৃত্বে মিশনের কর্মযজ্ঞের বিস্তারির বিবরণ না দিয়ে কেবলমাত্র উল্লেখযোগ্য প্রধান কয়েকটা বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করাটাই সমীচীন বোধ হয়। প্রথমত ডেনিশ নগরীতে ইংল্যান্ডীয় মিশনারিদের স্থানীয় গভর্ণরের বদান্যতায় নিরাপদ আশ্রয় লাভ হওয়ার, প্রাচ্যে খ্রিস্টধর্মতত্ত্ব শিক্ষার ব্যাপক প্রসারলাভ করার জন্যেই শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা সার্থক পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য বাইবেলের নানা ভাষায় অনুবাদ মুদ্রণের মাধ্যমে এদেশে ধর্মপ্রচার পঞ্চানন-মনোহরের মিশনে যোগদানে নানা ভাষার হরফ ঢালাই, কালি ও কাগজ তৈরি, সাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের মানসে শিক্ষাব্যবস্থার নীতি নির্ধারণ ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তাশীলতার মধ্যে মিশনের শতাধিক বিদ্যালয় ও কলেজে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, প্রাচ্যের সাহিত্য ও দর্শনের সাথে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান সংবলিত পাঠ্যক্রম প্রণয়ন, কোনো রকম সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতার উর্দ্ধে থাকা প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মিশনের কর্মৎপরতা আরও প্রাণ পায় যখন ১৮০১ সালে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে নবাগত সিভিলিয়ানদের দেশীয় ভাষা শেখানোর কাজে কেরীর যোগদান, আর সেই সুযোগে বিভিন্ন ভষা পন্ডিতদের সহায়তায় আরও প্রাচ্য ভাষা শেখা ও ধর্মপুস্তকের অনুবাদ মুদ্রণ করে প্রকাশিত হয়। তার সঙ্গে নিজের পাঠ্যপুস্তক রচনা, ৭ টা ভাষায় ব্যাকরণ ও ৩ টে ভাষার অভিধান প্রণয়ন, আরও অন্যান্য পন্ডিতদের পুস্তক প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করায় বিশেষভাবে বাংলা গদ্যসাহিত্যের সূচনা হয়। কেরীর বাংলা ভাষায় কথোপকথন ও ইতিহাসমালা প্রকাশ পাঠ্যপুস্তকের অভাব মেটানো ও বাংলা কথ্যগদ্য সাহিত্যের প্রচলনে তাঁর বিবেচনা ও বিচক্ষনতার পরিচয় দেয়।[৬৩]রামায়ণ মহাভারতের মতো সুপ্রাচীন মহাকাব্যের প্রচার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ এবং মূল সংস্কৃত ভাষাসহ ইংরাজীতে রামায়ণের অনুবাদ প্রকাশ করে ভারতীয় দর্শন ও সাহিত্যের প্রতি স্বদেশীয় পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা সত্যই প্রণিধানযোগ্য।
মার্ডকের ক্যাটালগ থেকে জানা যায়, মিশন প্রেস থেকে ‘হরকরা’, ‘জ্ঞানোদয়’, ‘লাশকারদের প্রতি’ ও বিভিন্ন খণ্ড বাইবেল ছাড়া নিম্নোক্ত পুস্তকাদি ছাপা হয়েছিল :
The Missionaries Address to Hindoos– উইলিয়ম ওয়ার্ড
The Sure Refuge (কবিতা)—পীতাম্বর সিংহ
মঙ্গল সমাচার , শ্রীরামপুর মিশন প্রেস-এ প্রকাশিত পুস্তকA Short Summary of the Gospel– উইলিয়ম কেরি
Address to the Hindoos– মার্শম্যান
The Difference : or Krishna & Christ Compared– মার্শম্যান
অন্যতম জনপ্রিয় অধ্যাপকরূপে কেরীর ৩০ বছর ধরে যুক্ত থেকে কলকাতারফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মর্যাদা ও গৌরববৃদ্ধি করার কৃতিত্ব অপরিসীম। মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত ৪৫ টি প্রাচ্যভাষায় বাইবেলের অনুবাদ ছেপে প্রকাশের মধ্যে কেরীর ৩৫ টা গ্রন্থ তাঁকে সে যুগে বিশিষ্ট বিরল ভাষাবিদের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৮১২ সালে মিশন ছাপাখানার প্রভূত দ্রব্যাদি অগ্নিকাণ্ড ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও দেশ-বিদেশের আর্থিক সাহায্যে প্রেসের পণ্ডিত শিল্পীদের সহযোগিতায় তার পুণর্গঠন করে বহুগুণ উৎসাহে হরফ, কালি, কাগজসহ ছাপাশিল্পের উন্নতিসাধন কেরীর দৃঢ়চেতনা মনের পরিচয় দেয়। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ভাষা শিক্ষণ আর শ্রীরামপুর কলেজে ধর্মতত্ত্বের সাথে উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা, কৃষিবিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষকতায় উইলিয়াম কেরি বেশ সুনাম অর্জন করেন। উদ্ভিদ ও কৃষি বিজ্ঞানের প্রতি গভীর অনুরাগী কেরী শ্রীরামপুরে বহু বিচিত্র বৃক্ষলতাদি পূর্ণ ৫ একর জমিতে বোটানিক্যাল গার্ডেন রচনা করে এই বিষয়ে গবেষণার পথ প্রশস্ত করেন। হাওড়া শহরের শিবপুরে কোম্পানি-উদ্যানের প্রধান রক্সবার্গ, ওয়ালিচ প্রমুখ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বীজ ও চারাগাছ বিনিময়ের মাধ্যমে উদ্ভিদবিদ্যা চর্চার সুযোগ তৈরি করেন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য কেরী তাঁর বক্তৃতা ও প্রতিষ্ঠানের পত্রিকায় শোচনীয় কৃষিব্যবস্থার উন্নয়নপন্থার আলোচনা প্রকাশ, আর কলকাতার এগ্রিহর্টিকালচারাল সোসাইটি সংগঠনের মাধ্যমে দরিদ্র কৃষকেরা দুঃখ দুর্দশা দূর করার চেষ্টা করেন।
সে যুগে হিন্দুসমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের মধ্যে উল্লেখ্য সাগরে শিশু বিসর্জন, সতীদাহ প্রথা, কুষ্ঠরোগী হত্যা, গঙ্গাজলি, বাণবিদ্ধ অবস্থায় চড়কে ঘোরা,রথের চাকায় প্রাণদান প্রভৃতি কুপ্রথা প্রতিরোধের জন্য বিরামহীন সংগ্রাম চালান কেরী। হিন্দুসমাজ উন্নয়নে শ্রীরামপুর মিশনের ভূমিকায় গ্রামের দরিদ্র, পীড়িতদের মধ্যে ওষুধ বিতরণ, কেরীর রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০২ সালে আইন করে সাগরে শিশু বিসর্জন নিষিদ্ধ করেন এবং ১৮২৯ সালে রামমোহন রায় এবং উইলিয়াম কেরির সহযোগিতায় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন। কেরীরই উদ্যোগে কলকাতায় কুষ্ঠরোগীদের হাসপাতাল স্থাপন হয়। ১৮১৯ সালে শ্রীরামপুর সঞ্চয় ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা, শ্রীরামপুরে সাধারণ হাসপাতাল স্থাপনের প্রচেষ্টা প্রভৃতি জনহিতকর কর্মে কেরীর নেতৃত্ব তুলনাহীন।
তবে এই মিশনারিরা যদি ডেনিশ শ্রীরামপুরে আশ্রয় না পেতেন ও ধর্মপ্রচারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতেন, যদি পঞ্চানন কর্মকার সদলবল মিশনের সাথে যোগ না দিতেন, যদি কেরী কলকাতারফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগ না দিতেন, রামরাম বসুর সাথে যদি দেখা না হতো, ভাষাশেখা, মুদ্রণ, অনুবাদ, বাংলাসাহিত্যের বিকাশ, এমনকি সমাজসংস্কারমূলক কাজও ব্যাপকভাবে ব্যাহত হত। তাহলে আঞ্চলিক ইতিহাস যে কেমন হত তা সহজেই অনুমান করা যায়।
মিশনারি কার্যকলাপের জন্য শ্রীরামপুরত্রয়ীডেনিশ রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডেরিক্সের কাছ থেকে স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। ১৮০৭ সালে ধর্মপুস্তকের প্রাচ্য ভাষায় অনুবাদক হিসাবে কেরী আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডক্টর অফ ডিভিনিটি উপাধি পান। ইংল্যান্ডের লিনিয়র সোসাইটি, জিওলজিক্যাল সোসাইটি, হর্টিকালচারাল সোসাইটি কেরীকে ফেলো নির্বাচন করে সম্মানিত করেন।
কেরীর নেতৃত্বে শ্রীরামপুর মিশনের যেসব কাজ সম্পন্ন হয় তার মধ্যে শ্রীরামপুর মিশন, মিশন চার্চ, হান্নার বাড়িতে মিশন গার্লস স্কুল, জননগর চার্চ, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি আর এগ্রিহর্টিকালচারাল সোসাইটি প্রভৃতি শ্রীরামপুর কলেজের সাথে আজও সেগুলোর স্মৃতিরক্ষা করে চলেছে।
মৃত্যুর কয়েকদিন আগে উইলিয়াম কেরি তাঁর অভীষ্ট সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে মনে করে নির্দ্বিধায় ঈশ্বরের কোলে ৯ জুন, ১৮৩৪ সালে আত্মসমর্পণ করে শান্তিলাভ করেন।[৬৫]
বাংলা তথা ভারতের ঐতিহ্যঃ শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং তার ইতিহাস[সম্পাদনা]
১৮১৮ সালে ১৫ আগষ্ট ভারতের কল্যাণে বিশ্বের প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞানদানের উদ্দেশ্যে এশিয় খ্রিস্টানসহ অন্যান্য যুবকদের প্রাচ্যের সাহিত্য-দর্শন ও পাশ্চাত্যের আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসাবে মিশনারিদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ছাত্রের জন্য শ্রীরামপুর কলেজের দ্বার উন্মুক্ত ছিল। মাত্র ৩৭ জন ছাত্র নিয়ে কলেজের ক্লাস শুরু হয় গঙ্গার (হুগলী নদীর) ধারে অলড্রিন হাউসে। ডেনিশ গভর্মেন্ট প্রদত্ত ১০ একরের মতো জমিতে ১৮২১ সালে কলেজ ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। গভর্ণরের সহকর্মী মেজর উইকেডির প্রাসাদোপম ভবনটির তৈরি নক্সায় কোম্পানির গভর্ণর হেস্টিংস প্রবেশদ্বারের সম্মুখাংস সামান্য পরিবর্তনসহ অনুমোদন করেন। ১৮২২ সালের প্রথমে এই ভবনে কলেজের ক্লাস স্থানান্তরিত করা হয়। মিশনের গ্রন্থাগার এই ভবনে কলেজের গ্রন্থাগারে রূপান্তরিত হয়। ভবনের সুদৃশ্য সিঁড়ি ও ঢালাই লোহার মেন গেট ডেনমার্কের রাজার উপহার। লর্ড হেস্টিংস ও শ্রীরামপুরের ডেনিশ গভর্ণর জেকব ক্রেফটিং কলেজের পৃষ্টপোষকতার আন্তরিক সম্মতি জ্ঞাপন করেন। কেরী কলেজের চিরস্থায়িত্বের বিষয় চিন্তা করে ১৮২৬ সালে মার্শম্যানকে ডেনমার্কের রাজার কাছে পাঠান। ১৮২৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ডেনমার্কের রাজা 'ষষ্ঠ ফ্রেডেরিক্স' প্রদত্ত রাজকীয় সনদবলে শ্রীরামপুর কলেজকে ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য এশিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় -এর সম্মানদান করা হয়। ১৮৩৩ সালে উইলিয়াম কেরীর রচিত কলেজের সংবিধান চালু হওয়ায় ১২ জুন থেকে কেরীকে কলেজ কাউন্সিলের প্রথম মাস্টার বা সভাপতি নির্বাচন করে কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ কেরীর স্থলাভিষিক্ত করা হয় জশুয়া মার্শম্যানকে অধ্যক্ষপদে। ১৮৩৪ সালের ৯ জুন ভারতে ফাদার অফ দ্যা ব্যাপটিস্ট মিশন, ডঃ উইলিয়াম কেরীর মৃত্যুর পর ১৮৩৭ সালের ৫ ডিসেম্বর ডঃ জশুয়া মার্শম্যান দেহত্যাগ করায় শ্রীরামপুর মিশনারিত্রয়ীর নিজস্ব কর্মসাধনের অবসান হয়। জন ম্যাক অধ্যক্ষ হন, জন ক্লার্ক মার্শম্যান কলেজ কাউন্সিলের একমাত্র জীবিত স্থানীয় সদস্য হয়ে থাকেন। ১৮৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল জন ম্যাক মারা যান। ডেনহাম কলেজের অধ্যক্ষ হন। জন ক্লার্ক মার্শম্যান লন্ডনের ব্যাপটিস্ট মিশনারি সোসাইটির ওপর কলেজ পরিচালনের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দেন ১৮৫৫ সালে। কেবলমাত্র ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া[৬৬] পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা বজায় রেখে শ্রীরামপুর তথা ভারত ত্যাগ করেন। জন মার্শম্যান এই পত্রিকার স্বত্ব ইংরেজি পত্রিকা স্টেটস ম্যান- এর প্রবর্তক রবার্ট নাইটের কাছে বিক্রি করে দেন ১৮৭৫ সালে মাত্র ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে। জন ক্লার্কের ১৮৭৭ সালের ৮ জুলাই স্বদেশে দেহবসানে শ্রীরামপুর মিশনের প্রাথমিক সদস্যদের শেষ প্রতিনিধির শ্রীরামপুর কলেজের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়।
১৮৫৭ সালে ভারতের কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ শহরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় শ্রীরামপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তনের ৩০ বছর পরে স্থাপিত হয়। শ্রীরামপুর কলেজের সাহিত্য-বিজ্ঞান বিভাগ তখনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৫৮ সালে ডোনহামের মৃত্যুর পর জন ট্রাফোর্ড(১৮৫৮-৭৯), রেঃ উইলিয়ামস(১৮৭৯-৮৩), কলেজের অধ্যক্ষ পদ গ্রহন করেন। এরপর রেঃ সামর্স অধ্যক্ষ হয়ে সাহিত্য-বিজ্ঞান বিভাগ ছাত্র ও অর্থের অভাবে ১৮৮৩ সালে সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে কেবলমাত্র খ্রিস্টান ছাত্রদের ধর্মতত্ত্বের পঠনপাঠন চালাতে থাকেন। ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড থেকে জর্জ হাওয়েলস উড়িষ্যার মিশনের কাজে এসে ১৯০০ সালে শ্রীরামপুর কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের আদর্শে কলেজের রাজকীয় সনদকে পুনরুজ্জীবিত করার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালান। বিভিন্ন খ্রিস্টান বিত্তবান পদস্থ ব্যক্তির সহায়তায় ডঃ হাওয়েলস এই প্রচেষ্টায় সফলতা পান। ১৯০৬ সালে রেঃ সামর্সের অবসর গ্রহণের পর ডঃ জর্জ হাওয়েলস অধ্যক্ষ হয়ে শ্রীরামপুর কলেজে উচ্চস্তর পর্যন্ত ধর্মতত্ত্বের প্রশিক্ষণ শুরু করেন ১৯১০ সালে। সাহিত্য-বিজ্ঞান বিভাগ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরের বছর। রাজকীয় সনদবলে থিওলজি বিভাগের ছাত্রদের প্রথম ব্যাচেলার অফ ডিভিনিটি ডিগ্রি দেওয়া হয় ১৯১৫ সালে শ্রীরামপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।[৬৭] বর্তমানে ভারতের এই একমাত্র ধর্মতত্ত্বের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার অধিনস্ত পঞ্চাশোর্ধ কলেজ ছাত্রদের স্নাতক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন ডিগ্রি প্রদান প্রচলিত আছে। একই সীমানায় ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি সাহিত্য-বিজ্ঞান-বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও দুটি বিষয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করছে - এই দৃষ্টান্ত এদেশে বিরল। ১৯১৮ সালে জর্জ হাওয়েলসের সময়ে কলেজের জন্মশতবার্ষিকি পালন করার সময় ডেনিশ রাজার প্রদত্ত সনদের, ১৮৪৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী Treaty of Purchase অনুসারে শ্রীরামপুর নগরী দিনেমারদের হাত থেকে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে আসার সময়, যেমন সর্বাধিক অধিকার ও শর্ত বজায় ছিল, ঠিক তেমনই রয়্যাল চার্টার সমেত ১২ জুন ১৮৩৩ সালে কেরীর তৈরি শ্রীরামপুর কলেজের সংবিধান ও নিয়মাবলী সমস্ত শর্তাধিকার ১৯১৮ সালে শ্রীরামপুর কলেজ অ্যাক্ট নামে বেঙ্গল অ্যাক্ট নং IV হিসাবে সরকারি অনুমোদন লাভ করে। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার এই বিধান ১৯৫১ সালে ভারত সরকারের আইন সংহিতায় লিপিবদ্ধ হয়। বস্তুতপক্ষে রেঃ ডঃ জর্জ হাওয়েলসের তৎপরতায় উইলিয়াম কেরী প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজের আদর্শকে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পুণর্জীবন দেওয়ার জনয় তাঁকে কলেজের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গণ্য করা হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে অদ্যাবধি শ্রীরামপুর কলেজের উইলিয়াম কেরীর মহান আদর্শ অনুসরণ করে উত্তরোত্তর উন্নতির ইতিহাস অনেকেরই জানা আছে। তাই এই প্রবন্ধকে দীর্ঘায়িত করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
কেবলমাত্র শ্রীরামপুর মিশনারিদের দেশবিদেশ থেকে সংগৃহীত পুঁথি ও পুস্তকাদি এই কলেজ প্রতিষ্ঠার পর কলেজ ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। সেই শ্রীরামপুর কলেজ গ্রন্থাগারের মিশনারিদের সংগ্রহের সাথে প্রায় দেড়শতাধিক বছরে পরবর্তীকালের পুস্তকাদির সংযোগ ক্রমশ গ্রন্থভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। বর্তমানে সেইসব সামগ্রী ধর্মতত্ব ও সাহিত্য-জ্ঞান-বিজ্ঞান-বাণিজ্য বিভাগের সঙ্গে কেরী লাইব্রেরীতে মোট তিনটি গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আচে। তার মধ্যে প্রায় সমগ্র প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ১০১ টা বিভিন্ন ভাষায় দশসহস্রাধিক পুরাতন বই এখন কেরী লাইব্রেরী ও রিসার্চ সেন্টারের আর্কাইভে স্থান পেয়েছে। উপরন্তু শ্রীরামপুর মিশনের প্রায় ৪০ টি প্রাচ্য ভাষায় ও ৪৩ টি ভাষায় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রকাশিত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বাইবেলসহ মিশনের প্রাকাশিত পুস্তক, অভিধান, ব্যাকরণ, সংস্কৃত ভাষায় সংগৃহীত পুঁথি, বেদ-পুরানাদি উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া, ক্যালকাটা রিভিউ, এশিয়াটিক রিসার্চ, পিরিয়ডিকাল একাউন্টস, এডিনবার্গ রিভিউ প্রমুখ জার্নালের সংগ্রহ অনেক গ্রন্থাগারে পাওয়া যায় না। কেরী লাইব্রেরীর এই অমূল্য সম্পদ গত দু'শতকের ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার জন্য দেশ-বিদেশের বহু কৌতূহলী স্কলারকে এই শ্রীরামপুর কলেজ আজও আকর্ষণ করে। তাঁদের সাহায্য করার জন্য এই কলেজের কেরী মিউজিয়াম সামগ্রীও অনেক তথ্য ও তত্বের সন্ধান দেয়। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে বর্তমানে শ্রীরামপুর কলেজ পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত। এশিয়াটিক সোসাইটি, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সান্নিধ্য প্রত্যক্ষভাবে কেরীকে সমৃদ্ধ করার সঙ্গে পরোক্ষভাবে শ্রীরামপুর কলেজকেও গৌরবান্বিত করেছে।
বর্তমানে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও হিন্দু কলেজ উঠেগেছে। ডেনিশরা শ্রীরামপুর নগরী-কে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়ে ভারতত্যাগ করেছে, কেরীর উদ্ভিদ উদ্যান ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর প্রায় ৫ একর জমি ইণ্ডিয়া জুটমিলের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে, ভারত স্বাধীনতা লাভের পর নানারকম পরিবর্তন হয়ে চলেছে। তবুও কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি, এগ্রিহর্টিকালচারাল সোসাইটি এবং শ্রীরামপুরের মিশন চার্চ, সেন্ট ওলাভ'স চার্চ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মতো শ্রীরামপুর কলেজেরও নাম মহাত্মা রেঃ ডঃ জর্জ হাওয়েলসের এবং উইলিয়াম কেরি তথা শ্রীরামপুর ত্রয়ীর সাথে সমহিমায় বিড়জিত থাকবে।
শ্রীরামপুর নগরী হুগলী জেলার একটি মহকুমায় পরিণত হয়েছিল ১৮৪৫ সালে।[৬৮] শ্রীরামপুর পুরসভা ১৮৬৫ সালে শ্রীরামপুরে আলাদাভাবে স্থাপন করা হয়।[৬৯] এর আশপাশের এলাকায় শিক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিল। সংস্কৃত পাঠশালাগুলি জনপ্রিয় টোল নামে পরিচিত।
এখান থেকে প্রকাশিত হত বিভিন্ন পত্রিকা যেমনঃ
গয়নারোনুদয় (১৮৫২)
সত্য প্রদীপ (১৮৪৩)
ধর্ম প্রচারক (১৮৪৩)[[চিত্|thumb|রাজা মমোহন রায়- ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ, উত্তর শ্রীরামপুরের চাতরায় জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর মামার বাড়ি- দেশগুরু ভট্টাচার্য্য বাড়িতে]]
অরুণোদয় (১৮৫৬)
সর্বাথ সংগ্রহ (১৮৭৩) ,
আখবার শ্রীরামপুর ( ১৮২৬)
বিবিধ বার্তা প্রকাশিকা (১৮৭৫)
প্রকৃতি রঞ্জন (১৮৭৮)
বঙ্গ-বন্ধু (১৮৮২)
সাহিত্য সবসময় শ্রীরামপুরে জ্বলজ্বলে ছিল।
১১ অক্টোবর ১৮৪৫-এ ব্রিটেনকে বিক্রি করা হয় এই নগরী। ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত হয়ে যায় এটি এবং আবার তার বাংলা নাম ফিরে পায়। শহরের দখল নেওয়ার পর, ব্রিটিশরা তার নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দেখাশোনা করতে লাগল এবং তার আগে ভিলেজ কমিটি ১৮৬৫ সালে শ্রীরামপুর পুরসভা-য় রূপান্তরিত হয়। শ্রীরামপুর নগরীর নিকটবর্তী অঞ্চল রিষড়া এবং কোন্নগরও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
যে সময়ে, শ্রীরামপুর জনসংখ্যার সমৃদ্ধিশালী উচ্চবর্ণ অধ্যায় কোন আধুনিকতার চিহ্ন প্রদর্শিত না এবং তারা একটি শহুরে তত্ত্ব সাবস্ক্রাইব হয়নি। সময়কালে ভারতের অর্থনীতি একটি তীব্র মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সেখানে শহুরে কেন্দ্রে গ্রামীণ জনগণের ক্রমাগত অভিপ্রয়াণ ছিল। ভূমিহীন শ্রমিকেরা উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার এবং ওড়িশা থেকে কর্মসংস্থানের সন্ধানে শ্রীরামপুর এসেছিলেন। ভারতের দ্বিতীয় জুট মিল শ্রীরামপুরে ১৮৬৬ সালে উদ্বোধন করা হয় যখন শহর শিল্পনগরী-তে পরিণত হতে শুরু করে। জুট মিলের বরাবর, অনেক অন্যান্য সহায়ক কারখানার মধ্যে বা শহরের প্রত্যন্তে পূর্বকালীন গ্রামাঞ্চলে উঠে এসেছে। সুতরাং, ব্রিটিশদের পুঁজি বিনিয়োগের সঙ্গে শ্রীরামপুর বাণিজ্যিক শহরের সাথে সাথে একটি শিল্পনগরীতে রূপান্তরিত হয়। প্রক্রিয়া পিছনে মীমাংসাকারী বল ১৮৫৪ সালে ১৫ অগস্ট হাওড়া থেকে হুগলী পর্যন্ত রেল চলাচল করলে শহরের সামাজিক অনুপাতের একটা বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৮৬৬ এবং ১৯১৫ সালের মধ্যে আরো ছয়টি পাটকল শ্রীরামপুর ও চন্দননগর- এ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থানীয় ভূস্বামী, ঠিকাদারদের এবং কল - মালিকদের কারখানায় প্রায় শ্রমিকদের বসবাসের ব্যবস্থা করেন। এমনিভাবে মাহেশ, আকনা ও তারাপুকুর মৌজা গঙ্গা সংলগ্ন শ্রমিকদের মত উপনিবেশগুলির এ বস্তি- গয়াপাড়া বস্তি, ছাপরা বস্তি, এবং তেলঙ্গী বস্তি, পাড়া বস্তি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অভিবাসী শ্রমিকদের আগমনের কারণে শ্রীরামপুরের লোকসংখ্যা ১৮৭২ থেকে ১৯০১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ২০.০০০ থেকে ৪৪,৪৫১ হয়। শ্রমিকরা লোকালয়ে অস্বাস্থ্যকর, জনাকীর্ণ বস্তিতে ছিল . তাদের বাড়ী- নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে এমনকি ন্যূনতমরূপে জন্য কোন বিধান ছিল না।
১৯১৪ সালে, একটি ব্যবস্থা পৌরসভা থেকে পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহ করা হয়। টাউন হল কিশোরী লাল গোস্বামী স্মরণে ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারি উদ্যোগে ১৯০৮ সালে উইভিং স্কুল প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং পরে তা একটি টেক্সটাইল কলেজে উন্নীত করা হয়। পৌরসভা ১৯৩৮ সালে বিদ্যুৎ প্রদান শুরু করে। ব্রিটিশ দখল পঞ্চাশ বছর পর শ্রীরামপুরেবাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বঙ্গীয় রেনেসাঁ -এর ঢেউ এসে পড়ে। জাতীয়তাবাদী চেতনায় মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে অনেক অল্পবয়সি প্রভাবিত হতে থাকেন। এটা বিদেশী বিনিয়োগ শিল্পে পতনের ফলে, কিন্তু সেখানে আদিবাসী বিনিয়োগ বৃদ্ধি ছিল। বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল স্বদেশী উদ্দমের বাইরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০ শতাব্দীর প্রথম থেকেই অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শ্রীরামপুর-এ স্থাপন করা হয়েছে। পুরোনো বনেদি পরিবারের কিছু বংশধর হিতৈষী উদ্দেশ্যের জন্য তাদের আবাসিক ভবন দান করেন.
১৯৪৭ সাল থেকে শ্রীরামপুরে নগরায়ন ও পরিবর্তনের যেমন তার প্রক্রিয়া হিসেবে এখনো অসম্পূর্ণ। এখন শ্রীরামপুর হুগলী জেলার সবচেয়ে উন্নত নগর। যত দিন যাচ্ছে ততই এই নগরের প্রতিটি পল্লীতে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রায় বলতে গেলে প্রতিদিনই নতুন নতুন নামী সংস্থা শহরে এসে বিভিন্ন স্থানে শপিং মল ইত্যাদি নির্মাণ করে চলেছে। যেমনঃ ট্রেন্ড সেটার, 'এম' বাজার, রিলায়েন্স ট্রেন্ডস, ডোমিনোজ, মোর, বিগবাজার, কলকাতা ফ্যাশন বাজার ইত্যাদি আরও অনেক, যা বলে শেষ করা যাবেনা।[৭০][৭১][৭২][৭৩] আবার অনেক নামীদামী অলংকারের শোরুমও স্থাপন করা হয়েছে, যেমনঃ
ভারতের ২০১১ সালের আদম শুমারি অনুসারে শ্রীরামপুর শহরের জনসংখ্যা হল ৫৯৭,৯৫৫ জন।[৭৯] এর মধ্যে পুরুষ ৫৩%, এবং নারী ৪৭%।
এখানে সাক্ষরতার হার ৮৮%, । পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৮১%, এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৭৩%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৫৯.৫%, তার চাইতে শ্রীরামপুর এর সাক্ষরতার হার বেশি।
এই শহরের জনসংখ্যার ৮% হল ৬ বছর বা তার কম বয়সী।
শিক্ষা (উচ্চমানের বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়)[সম্পাদনা]
মাহেশের রথযাত্রা ও জগন্নাথবাটী, (স্থানঃ মাহেশ)- স্থাপিত- ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ[সম্পাদনা]
মাহেশের জগন্নাথ মন্দির
মাহেশের রথযাত্রা ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম (পুরীর রথযাত্রার পরেই) এবং বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা উৎসব। এই উৎসব ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এটি পশ্চিমবঙ্গের এই শহরের মাহেশে হয়। রথযাত্রার সময় মাহেশে একমাস ধরে মেলা চলে।[১০৫] মাহেশের জগন্নাথদেবের মূল মন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দির অবধি (১ কিমি) জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিশাল রথটি টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। উল্টোরথের দিন আবার রথটিকে জগন্নাথ মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।
মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রা উৎসবের পিছনে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। সেটি হল: চতুর্দশ শতকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল যে তিনি জগন্নাথদেবকে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন। কিন্তু পুরীর মন্দিরের পাণ্ডারা বাধ সাধায় তিনি তা করতে পারলেন না। তখন দুঃখিত হয়ে তিনি আমরণ অনশনে বসলেন। তিন দিন পরে জগন্নাথদেব তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন, "ধ্রুবানন্দ, বঙ্গদেশে ফিরে যাও। সেখানে ভাগীরথী নদীর তীরে মাহেশ বলে এক জায়গা আছে। সেখানে যাও। আমি সেখানে একটি বিরাট দারুব্রহ্ম (নিম গাছের কাণ্ড) পাঠিয়ে দেবো। সেই কাঠে বলরাম, সুভদ্রা আর আমার মূর্তি গড়ে পূজা করো। আমি তোমার হাতে ভোগ খাওয়ার জন্য উদগ্রীব।" এই স্বপ্ন দেখে ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে সাধনা শুরু করলেন। তারপর এক বর্ষার দিনে সেখানে একটি নিমকাঠ ভেসে এল। তিনি জল থেকে সেই কাঠ তুলে তিন দেবতার মূর্তি বানিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন।[১০৬]
পরবর্তীকালে ১৭৫৫-এ কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিক মাহেশে জগন্নাথ দেবের মন্দির তৈরি করেছিলেন যা আজও রয়েছে। বর্তমান রথটি প্রায় ১২৯ বছরের পুরনো। সে যুগে ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে শ্যামবাজারের বসু পরিবারের সদস্য হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু রথটি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। রথটিতে রয়েছে মোট ১২টি লোহার চাকা এবং দু'টি তামার ঘোড়া। ইতিহাস বলে সাধক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী স্বপ্ন পেয়ে গঙ্গায় ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে দারুমূর্তি তৈরি করেন। প্রতি বছর রথের আগে বিগ্রহের অঙ্গরাগ হয়ে থাকে। রথের দিন জিটি রোড দিয়েই রথ টানা হয়। এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে আজও বসে মেলা। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর 'রাধারানি' উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছিল এই মাহেশের রথযাত্রা।[১০৭]
কমলাকার পিপলাই, ছিলেন যেমন আগেই উল্লেখ করা হয়, শ্রীচৈতন্য দ্বাদশ গোপালদের মধ্যে পঞ্চম। তিনি সুন্দরবনের খালিঝুলি-র জমিদারের পুত্র। তিনি যুক্তিবিজ্ঞান অধ্যয়ন করে নবদ্বীপের কাছে এলেন। পরে তিনি মহাপ্রভুর একটি প্রিয় শীষ্য হয়ে ওঠেন এবং তার মন্ত্রণালয় যোগদান করেন। তিনি ৬৪ মহন্তের প্রথম। মাহেশ জগন্নাথ মন্দিরে ভার গ্রহণ করার পর, তিনি থাকে এবং তিনিই বিখ্যাত রথ উৎসব অধিক ৬২০ বছর আগে শুরু করেন।
তাঁর উত্তরাধিকারী্রা এখনো সেবাইত বা মন্দির 'অধিকারী' হিসেবে মাহেশে বসবাস করেন।
শুধু এই উৎসব প্রাচীনতমি নয়, বাংলায় সর্ববৃহৎ রথযাত্রা এটি। প্রায় ২-৪ লাখ মানুষ মাসব্যাপী মেলা দেখতে আসে। প্রভু মাহেশ গুন্ডিচা বাটী (মাহেশ মাসীর বাড়ী) মন্দিরে যায় এবং হিসাবে এটি জনপ্রিয় বাংলায় পরিচিত রথ পুনযাত্রা বা উল্টোরথ পর্যন্ত সেখানে রয়ে যায়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- এর বিখ্যাত উপন্যাস 'রাধারাণী' মাহেশ রথযাত্রায় বিস্ময়কর বিবরণ নিয়ে গঠিত।[১০৯] রাধারানী, উপন্যাসের বীরাঙ্গনা মেলায় হারিয়ে এবং তারপর তার ভবিষ্যত
রথযাত্রার দিন মাহেশের প্রভু শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেব
প্রেমিকা দ্বারা পাওয়া গিয়েছে। বঙ্কিম এর বর্ণনা না শুধুমাত্র উৎসবের একটি প্রাণবন্ত ছবি দেয় কিন্তু এটা ন্যায্য একটি রোমান্টিক সাহিত্য কবজ দিলেন না। কথিত আছে যে, আজও এক ভগ্নান্তঃকরণ মেয়েটির দুঃখ বোধ করতে পারে।
আধুনিক মন্দির ১৭৫৫ সালে নির্মাণ করা হয়। কলকাতা নিবাসী নয়নচাঁদ মল্লিক এর খরচ দেন। সময়ের সঙ্গে সেই রথ জীর্ণ হয়ে পড়ে। কৃষ্ণরামের ছেলে গুরুপ্রসাদ ১৭৯৮ সালে নয় চূড়াবিশিষ্ট নতুন রথ বানিয়ে দেন। ১৮৮৪ সালে রথযাত্রার দিন বল্লভপুরে গুন্ডিচাবাটীতে সেই রথটি আগুনে পুড়ে যায়। তখন বসু পরিবারেরই কর্তা কৃষ্ণচন্দ্রবাবু বর্তমান লোহার রথটি তৈরি করিয়ে দেন। মার্টিন বার্ন কোম্পানি রথটি তৈরি করে। সেই সময়েই এর দাম পড়েছিল ২০ লক্ষ টাকা। ১৮৮৫ সাল থেকে ওই রথে টান শুরু হয়। সেই থেকে এক ভাবে ওই রথ চলছে।[১১০]
শ্রীরামপুরে চাতরা পল্লীতে মাতুলালয়ে বাস করতেন। তার মাতুলগৃহে গৌরাঙ্গদেবের প্রতিমূৰ্ত্তি ছিল। একদিন রুদ্ররামকে গৌরাঙ্গদেবের পূজা করতে দেখে তাহার মাতুল বলেন, “তোমার এখনও পুজায় অধিকার হয় নাই” বলে
বল্লভপুর রাধাবল্লভ মন্দির
অত্যন্ত তিরস্কার করেন। এতে রুদ্ররামের মনে অত্যন্ত ঘৃণা হয় ও বল্লভপুরের জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে তপস্যা আরম্ভ করেন । তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে রাধাবল্লভ স্বপ্ন দেন, ''গৌড়ের নবাববাটীর অন্তঃপুরস্থ গৃহদ্বারের উপরে একখানি কৃষ্ণবর্ণ প্রস্তর আছে। প্রস্তরখানি সৰ্ব্বদাই ঘামিয়া থাকে। তুমি ঐ প্রস্তর আনিয়া তোমার উপাস্ত দেবতার মুক্তি সংগঠন করিয়া উপাসনাদি কর-অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে।” রুদ্ররাম স্বপ্ন দেখে গৌড় নগরে প্রস্থান করেন এবং নবাবের মন্ত্রী অত্যন্ত হিন্দু ছিলেন–তাঁকে সবশেষে বলেন মন্ত্রী “যে পাথর ঘামে সে পাথর বাড়ীতে রাখিলে মহ অমঙ্গল ঘটে”—এই কথা নবাবকে বলায়, নবাব পাথরখানি খসে জলে ফেলে দেবার অনুমতি দেন। পাথর জলে ফেলে দেওয়ায় রুদ্ররাম পণ্ডিত প্রাপ্ত হলেন না, অত্যন্ত কাঁদতে লাগলেন। দৈববাণী হইল “তুমি মাহেশে যাও, তথাকার স্নানের ঘাটে ঐ পাথর প্রাপ্ত হইবে।” রুদ্ররাম পণ্ডিত তৎশ্রবণে মাহেশে এসে প্রস্তরখানি পেলেন । তিনি সুনিপুণ ভাস্কর ডাকিয়ে রাধাবল্লভ-মূৰ্ত্তি প্রস্তুত করালেন। এমন সুন্দর মূৰ্ত্তি এদেশে দ্বিতীয় নেই। ঐ প্রস্তরে তিনটী মূৰ্ত্তি প্রস্তুত হয়েছিল—শ্রীরামপুরেরবল্লভপুরের রাধাবল্লভ, খড়দহের শ্যামসুন্দর এবং সাইবনের নন্দদুলাল ।[১১১]
অবিলম্বে এই মর্মে অনুমতি দেওয়া হয় এবং রুদ্ররাম তার শুভেচ্ছা পরিতৃপ্তির সঙ্গে সুখী ছিল। নিতাই চাঁদ দীক্ষা দিলেন এবং তার উপগোপাল পরিবারে তাকে অন্তর্ভুক্ত এবং বারুথাপাগোপাল নামে পরিচিত করলেন।
মুরুসিদাবাদের নবাবের কোন হিন্দু কৰ্ম্মচারী আকনা ও মাহেশের মধ্যে থেকে কিয়দংশ ভূমি বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে রাধাবল্লভকে প্রদান করেন এবং ঠাকুরের নাম অনুসারে এই স্থানের নাম বল্লভপুর রাখেন। ঐ সময় ঐ স্থানের বার্ষিক রাজস্ব ১৮ ছিল। এর দেড়শত বৎসর পরে রাজা নবকৃষ্ণ গ্রামটকে ভারজাই তালুক করিয়া দেন। ১৫৯৯ সালে কলকাতার নয়ানচাদ মল্লিক রাধাবল্পভের মন্দির নিৰ্ম্মাণ করিয়া দেন।
মাইল অন্তর্দেশীয, অস্তিত্বে এসেছিল। এই নতুন মন্দির নির্মাণ কলকাতার মল্লিক পরিবার দ্বারা স্পন্সর করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয় এবং এটি এখনও রুদ্ররাম আসল মূর্তি ধারণ কর।পুরানো মন্দির পরিত্যক্ত , এবং প্রকৃতি দ্বারা উদ্ধারকৃত করা বাকি ছিল। বর্তমান দিনের ঠাকুরবাড়ী নির্মিত এবং বছর ১৮৮৬ সালে এবং রাধাবল্লভ জিউ ঠাকুর ও রাধারানী জিউ ঠাকুরানীও দেবতাদের উপস্থিত চত্বরে ১৮৮৭ সালে স্থাপন করা হয় হয়। সংলগ্ন এলাকায় ঘর ঘোষেদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, সব ঠাকুরবাড়ীর সঙ্গে একটি ব্যক্তিগত উত্তরণ মাধ্যমে সংযুক্ত যাতে মহিলা বাইরে যেতে না করেও অবাধে দেবদেবীর পরিদর্শন পারে।
ঠাকুরবাড়ী পূজার জন্য উন্মুক্ত ও অঞ্জলি উভয় সকালে ও সন্ধ্যায় দৈনিক সঞ্চালিত হয়।
বৈষ্ণব ঐতিহ্য অনুযায়ী ছয় প্রধান উৎসব সহ পালিত হয় :
ঝুলন যাত্রা
জন্মাষ্টমী
নন্দোৎসব
রাধাষ্টমী
রাসযাত্রা
দোল
কাশীশ্বর পীঠ (মহাপ্রভুবাটী) [স্থানঃ পূর্ব চাতরা]- স্থাপিত- ১৫২২ খ্রিস্টাব্দ[সম্পাদনা]
চাতরা কাশীশ্বর পীঠ (মহাপ্রভুবাটী)
শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুমাহেশের শ্রী শ্রী জগন্নাথদেব ও বল্লভপুরের শ্রী শ্রী রাধাবল্লভ জিউ এর পবিত্র মন্দির পরিদর্শন করতে শ্রীরামপুর-এ এসেছিলেন। বেশ কয়েকবার একবার তিনি নৌকায় করে চাতরার কাছে এসে নদী গঙ্গা এর গৌরাঙ্গ ঘাট এ সাথে চোখাচোখি হল। কোথায় ইতস্তত তিনি চাতরা কাশীশ্বর তরুমজ্জা বা দোলতলা মন্দির পরিদর্শন করেন এবং তিনি মাহেশের জগন্নাথ মন্দির যাওয়ার পথে এই স্থানে কাজকর্ম বন্ধ রাখলেন। কোথায় উপাসকমণ্ডলী ২০০ বছর আগে এই বর্তমান মন্দির তৈরি করেন।
পুরানো মন্দির আরো যে ৫০০ বছরের পুরনো। বর্তমান মন্দির শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গ ঠাকুর ও সমিতির দ্বারা পরিচালিত হয়। সারা বছর ধরে ঘটনা অনেকটা এখানে ঘটত যথাঃ রথযাত্রা, দোল রথযাত্রা, ঝুলন, রাশ পূর্ণিমা , রামকৃষ্ণ জন্মদিন, মা জন্মদিন।
শীতলাতলার শীতলা পূজো (স্থানঃ পশ্চিম চাতরা)[সম্পাদনা]
চাতরা শীতলাতলা। শ্রীরামপুর শহর পত্তন (১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দ) -এর অনেক আগেই চাতরা নামক এলাকার অস্তিত্ব ছিলো। শ্রীচৈতন্য নবদ্বীপ থেকে পদব্রজে নীলাচলে যাওয়ার সময়ে চাতরারচৌধুরী পাড়ায় তাঁর শিষ্য কাশীশ্বর পন্ডিত স্থাপিত দোলমন্দিরে এসেছিলেন। সেই মন্দির আজো আছে যা প্রায় ছ'শো বছরেরও বেশী প্রাচীন। এটুকু লিখলাম কেবল চাতরার প্রাচীনত্ব বোঝানোর জন্যে। (পরে বিশদ জানাবো)
এবার চাতরার খুব প্রাচীন এক লৌকিক উৎসব তথা পূজো। শীতলা মাতার পূজো। দোলের ঠিক আট দিন আগে শুরু হয়, চলে পাঁচদিন ধরে। বিশাল মেলা বসে। আর অসংখ্য মানুষ পূজা দিয়ে যান। এই পূজাও বহু প্রাচীন। অনুমান করা কঠিন। কারোর মতে ৪০০ বছরেরো বেশি, কারোর মতে ৬০০ বছরও হতে পারে।[১১২]
রাজা কিশোরীলাল-এর বাসভবন- শ্রীরামপুর রাজবাটী (চাতরা), শ্রীরামপুর
শ্রীরামপুরের গোস্বামীরা, পাঁচটি ব্রাহ্মণ পরিবার যাদের আদিসুর, গৌড়ের রাজা, ভূমি ও অর্থ উপহার দিয়ে বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করা, জ্ঞান প্রচারের জন্য নিমন্ত্রণ করেছিল এক বংশধরকে। তার বংশধরদের এক লক্ষ্মণ চক্রবর্তী ছিলেন। অচ্যুৎ গোস্বামী, অদবৈদাচার্য্য গোস্বামী, চৈতন্য মহাপ্রভুর জ্বলন্ত শিষ্য ছিলেন। লক্ষ্মণ শান্তিপুরে বসতি স্থাপন করে, অচ্যুৎ -এর পরিবারের সঙ্গে, এবং তাদের বিবাহ থেকে একটি ছেলে জন্ম নেয়- রামগোবিন্দ, যারা তার মায়ের কুমারী নাম, গোস্বামী গ্রহণ জন্মগ্রহণ করেন। এটা রামগোবিন্দ-এর ছেলে রাধাকান্ত, যারা শ্রীরামপুরে বসতি স্থাপন করেন। রঘুরাম গোস্বামী। গোস্বামীপাড়ায় তাঁর আদি সম্পত্তির পর্যন্ত অত্যধিক ফ্র্যাগমেন্টেশন ছিল রঘুরাম বা নিজে ও তার সন্তানদের জন্য একটি ঘর তৈরী করতে এবং এটা এইভাবে ছিল যে দৈত্য জমিদারের আজ যেমন "শ্রীরামপুর রাজবাড়ী" নামে স্থানীয়দের পরিচিত এসেছেন। একদা ১৮১৫ এবং ১৮২০ মধ্যে সময় বা খুব শীঘ্রই শ্রীরামপুর কলেজ নির্মাণের পর। এটা রাজবাড়ী বলা হয় যদিও, লেখক কানাইলাল গোস্বামী প্রশ্নে পরিবারের নিজে বলছে, যে এটি ঠাকুরবাড়ী বা ঠাকুরবাটী বললে সঠিক হবে যেহেতু এটি একটি অংশ সম্পত্তি দেবোত্তর তৈরি করা হয়েছিল।
বাড়িটী দুটি পৃথক ব্লক আছে. উত্তর এবং দক্ষিণ. দক্ষিণ অংশটি যে সম্ভবত মূলত হেমচন্দ্র গোস্বামীর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল। দোতলা -এ কাঠামো এখন একটি বাসভবন বিয়ের রিসেপশন হিসাবে ব্যবহার করা হয়, সেইসাথে অন্য সামাজিক কাজকর্মের জন্য বাইরে ভাড়া করা হচ্ছে।
আরও মহৎ এক অধ্যায় হয় উত্তরে, তার গাড়ীবারান্দা, আয়নের কলাম এবং ঢালাই লোহা ফটক দিয়ে। এই বাড়ির অংশ যে দেবোত্তর সম্পত্তি পরিণত হয়। এটা এখনও একটি আবাসিক সম্পত্তি আজকের হিসাবে ব্যবহার করা হয়। একটি বোর্ড ঘোষণা যে বাড়ির একটি অংশ একটি শিশু গাইডেন্স সেন্টার হিসেবে সরকার কর্তৃক ব্যবহৃত হয়।
ভিতরে, সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য, চাঁদনী বা নাটমন্দির, একটি আবৃত অঙ্গন ৩০ ফুট ১২০ ফুট পরিমাপের। এই অঞ্চল মূলত একটি পানির ট্যাংকের ন্যায়, যা থেকে গার্হস্থ্য খরচের জন্য টানা ছিল। রঘুরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র আত্মারাম যখন ট্যাংকে সাঁতার কাটছিল ৫ বছর বয়সে দুর্ভাগ্যবশত সে ডুবে যায়, কারণ, ট্যাংকটি ভরাট ছিল এবং চাঁদনি নির্মাণ করা হয়েছিল। চাঁদনি যেমন হোলি উল্লসিত অনুষ্ঠান, বিবাহ, এবং সামাজিক এবং এমনকি উপস্থাপনকারী নাটকের জন্য ব্যবহৃত হয়। তেমনই দুর্গাপূজা উপলক্ষেও চাঁদনি্তে একবারে ৫০০ মানুষ জড়ো হত। দীর্ঘ সারি উপবিষ্ট খাওয়ানোর জন্য স্থল ছিল।
রঘুরামের ছেলে গোপীকৃষ্ণের পাঁচটি পুত্র ছিল। তাদের জ্যেষ্ঠ ভাই কৃষ্ণলাল তার বাবার ত্যাজ্যপুত্র ছিলেন। অবশিষ্ট চার ভাই এই বাড়িতে একটি যৌথ পরিবার হিসেবে বসবাস করতেন। নন্দলাল, কিশোরী্লাল, রাজেন্দ্রলাল এবং রাধিকালাল। ১৯০৮ সালে এই বাড়িতে একটি যৌথ পরিবার হিসেবে বাস করতে লাগলেন নন্দলাল মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত পরিবারের ঐক্য ছিল অটুট। কিশোরীলাল ১,৫০,০০০ টাকা ব্যয়ে হুগলী নদীর তীরে একটি প্রাসাদোপম বাসভবন নির্মাণ শুরু করেছিলেন। সম্পত্তি অধিকার নদীগর্ভ এটি একটি আকর্ষণীয় নদী সম্মূখভাগ থেকে একটি ভয়ংকর প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত হয় এবং একটি বড় বাগান স্থাপন করা হয়। এই বাড়িতে , তিনি ১৯১০ সালে পরিবারের তার শাখা সরান। এই ভবন এখনও স্থায়ী ব্যবহার এবং রঘুরাম মূল রাজবাড়ী চেয়ে ভাল আকৃতির হয়। বর্তমানে এই বাড়িটি সরকারি অফিসে পরিণত হয়েছে, যার ফলে এখনও এর অবস্থা ভাল।
বর্তমানে রাজবাটীর মূল ভবনটি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হয় এবং সিনেমার স্যুটিং-এও ভাড়া দেওয়া হয়েছে যেমনঃ ভূতের ভবিষ্যৎ সিনেমাটি খুবই জনপ্রিয়।[১১৩]
সেন্ট ওলাভ'স চার্চ (স্থানঃ শ্রীপুর)- স্থাপিত - ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দ[সম্পাদনা]
২৫০ বছর বয়সী সেন্ট ওলাভ'স চার্চ-এর শ্রীরামপুরে রেনেসাঁ। ১৮০০ সালে শ্রীরামপুরের গভর্ণর ওলে'বি সেন্ট ওলাভ'স চার্চের ইমারত প্রবর্তিত করেন। ওলে'বি ডেনমার্ক ও ভারত উভয়ের ভবন কার্যকলাপের জন্য সংগৃহীত তহবিল এবং এবং গির্জা শ্রীরামপুরের নতুন ল্যান্ডমার্ক হতে অভিপ্রেত ছিলেন। কিন্তু তিনি এটি সমাপ্ত অবস্থায় দেখে যেতে পারেননি। ১৮০৫-এ তিনি যখন মারা যান তখন চার্চের টাওয়ার ও সামনের অংশ সম্পুর্ণ হয়। ওলে'বি -এর উত্তরসূরি ক্যাপ্টেন ক্রেফটিং। তারপর ভবনের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সাহায্য করার জন্য ইংরেজদের জন চেম্বারস এবং রবার্ট আর্মস্ট্রং ভাড়া করা হয়। ১৮০৬ সালে গির্জা সমাপ্ত হয় এবং ১৮১৯ সালে একটি প্রাচীর গির্জা পরিক্ষেপ দুটি ছোট পাহারা ঘর, যা এক এখনও সংরক্ষিত হয় একসাথে দূর্গ ছিল।[১১৪]
গির্জার স্থাপত্য গুণগতভাবে ডেনিশ নয় কিন্তু ঘনিষ্ঠ সংযোগ শ্রীরামপুর ও কলকাতায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ছিল প্রতিফলিত - সেন্ট জনস সেন্ট অ্যান্ড্রু এর অনুরূপ চার্চ বাড়িতে। এই ধরনের গির্জার জন্য অনুপ্রেরণা দেন সেন্ট মার্টিন - ইন- ফিল্ডস লন্ডনে, যা বহু বছর ধরে ব্রিটিশ গির্জা ভবন জন্য আদর্শ রেফারেন্স ছিল থেকে ডালপালা। গির্জার ছাদ সমতল এবং সামনের ডবল কলাম সঙ্গে একটি খোলা বারান্দা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সামনে ভাঙা কার্নিশের খ্রিস্টীয় সপ্তম, যারা ডেনমার্কের রাজা ছিল যখন গির্জা আলাদা ছিল রাজকীয় যে নকশার কেয়েকটি জড়ানো অক্ষর খোদাই করা থাকে সঙ্গে সজ্জিত করা হয়। বারান্দা উপরে একটি বর্গক্ষেত্র ঘণ্টা টাওয়ার, যা একটি শহর ঘড়ি। ঘড়িটি নদীর ওপাড়ে ব্যারাকপুর শহর থেকেও দেখা যায়।[১১৫] গির্জাটি ১৪ হাজার বর্গফুট জমিতে অবস্থিত। ইউনেস্কোর সম্মান পেয়েছে এই সেন্ট ওলাভ'স চার্চ।[১১৬]
জননগর চার্চ-টি ১৮২২ সালে জন ক্লার্ক মার্শম্যান-এর উদ্দ্যোগেই এই চার্চটি নির্মাণ করা হয়। তাঁর নাম অনুসারেই এই এলাকা ও চার্চের নাম হয়। চার্চটি এখনও সক্রিয়ভাবে সচল। প্রতি রবিবার বিকেল ৪ঃ৩০-এ উপাসনা গৃহটি খোলা থাকে।
১৮২২ সালে জন ক্লার্ক মার্শম্যানমিশন প্রেস থেকে ২ মাইল দক্ষিণে মাহেশ অঞ্চলে বেশ কিছু পরিমাণ জমি কেনেন। ঐ বছরেই জুন মাসে স্বদেশী ভাষায় তথা মাতৃভাষায় প্রানের ঠাকুরকে প্রণতি জানাবার জন্য এই চার্চের ভিত-পাথর স্থাপিত হয়।
১৮২৬ সালে একটি পত্রিকায় জন ক্লার্ক মার্শম্যান উল্লেখ করেনঃ ''We have planted a new Christian village and built the houses and chapel.''
এই গির্জার এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হলঃ প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এই গৃহে প্রতি রবিবার বিকেলে বাংলাভাষায় উপাসনা করার পদ্ধতি চালু আছে। এটা একটা শান্তিপ্রদ উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। স্থানীয় জনগণ ভক্তিভরে মাতৃভাষায় আকুতি জ্ঞাপন করতে পারছেন এও কম কথা নয়।
শ্রীরামপুর নগরের প্রতিটি পল্লীতেই দুর্গাপূজো হয়। দুর্গাপূজোয় এই শহর সারা জেলায় প্রথম স্থানে। এই উৎসবে আশেপাশের জেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। খটির বাজার থেকে বউবাজার প্রতিটি অঞ্চল পুজোর ৫ দিন হাজার হাজার মানুষে ছেয়ে যায়। প্রাচীন শহর শ্রীরামপুরে আজও প্রথা মেনে রামমোহন রায়ের মামার বাড়ির ঠাকুর প্রথম নিরঞ্জন হয়। তার পরে অন্য পুজোর প্রতিমা নিরঞ্জন হয়।[১১৮] অনেক পুজোর উদ্যোক্তা ভট্টাচার্য বাড়ির অনুমতি নিয়ে তবে প্রতিমা বিসর্জন দেন। চারশো বছরের পুরনো প্রতিমার কাঠামো আজও আগলে রেখেছেন বংশধরেরা। রয়েছে প্রাচীন খাঁড়া। পুজোর প্রয়োজনীয় টুকিটাকি আরও নানা জিনিসপত্র। সে সবও বহু প্রাচীন। সেই বাড়িতেই চারশো বছরের বেশি সময়কাল ধরে হয়ে আসছে দুর্গাপুজো। শ্রীরামপুরে চাতরার দেশগুরু ভট্টাচার্যবাড়ির পুজো হিসেবেই এক ডাকে সবাই চেনে। শ্রীরামপুর রাজবাটীর বুড়িদুর্গা প্রায় ৫০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। সার্বজনীন দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে মাহেশ ও চাতরা-র পুজোগুলি খুবই প্রাচীন।
↑"Google মানচিত্র"। Google মানচিত্র। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৯-০৮।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑"Google মানচিত্র"। Google মানচিত্র। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৯-০৮।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑"Google"। www.google.co.in। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৯-০৭।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑"Google মানচিত্র"। Google মানচিত্র। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৯-০৮।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑জন্মগ্রহণ করেন উত্তর শ্রীরামপুরের চাতরায়, দেশগুরু ভট্টাচার্য্য বাড়িতে (তাঁর মামার বাড়ি)-"Census of India 2011: Serampore City Census 2011 data"। Census Commission of India। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-১১-০১।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑Ghosh, Kaushik K। "Welcome to Serampore College"। www.seramporecollege.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৯-০৮।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑"GCETTS"। www.gcetts.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৯-০৮।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)