ফজলে হাসান আবেদ
ফজলে হাসান আবেদ কেসিএমজি | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ২০ ডিসেম্বর ২০১৯ অ্যাপোলো হাসপাতাল, ঢাকা | (বয়স ৮৩)
জাতীয়তা | বাংলাদেশি |
শিক্ষা | নৌ স্থাপত্য |
মাতৃশিক্ষায়তন | ঢাকা কলেজ গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় |
পেশা | চেয়ার এমেরিটাস, ব্র্যাক |
পরিচিতির কারণ | ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান |
আত্মীয় | নাজমুল হাসান জাহেদ (ভাই) |
স্যার ফজলে হাসান আবেদ, কেসিএমজি (২৭ এপ্রিল ১৯৩৬ - ২০ ডিসেম্বর ২০১৯) ছিলেন একজন বাংলাদেশি সমাজকর্মী এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা।[১] সামাজিক উন্নয়নে তাঁর অসামান্য ভূমিকার জন্য তিনি র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, স্প্যানিশ অর্ডার অব সিভিল মেরিট, লিও তলস্তয় আন্তর্জাতিক স্বর্ণ পদক, জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার মাহবুবুল হক পুরস্কার এবং গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ্ব স্বাস্থ্য পুরস্কার এবং শিক্ষা ক্ষেত্রের নোবেল বলে খ্যাত ইয়াইদান পুরস্কার লাভ করেছেন। [২]
২০১৪ ও ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিনের "বিশ্বের ৫০ সেরা নেতার তালিকা"য় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। অশোকা তাঁকে বৈশ্বিক সেরাদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। তিনি স্বনামধন্য গ্লোবাল অ্যাকাডেমি ফর সোশ্যাল অন্ট্রপ্রনোরশিপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।[৩] বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দারিদ্র বিমোচন এবং দরিদ্রের ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে সবচেয়ে সম্মানিত অর্ডার অব সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড সেন্ট জর্জের নাইট কমান্ডার উপাধিতে ভূষিত করে।[৪] ২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডের রাজা তাঁকে নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত করেন।
তিনি অসংখ্য সম্মানসূচক ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছেন, তন্মধ্যে রয়েছে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব হিউমেন লেটার্স (২০০৭), কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব লজ (২০০৮), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব লেটার্স (২০০৯) ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব লজ (২০১৪)।[৩]
প্রারম্ভিক জীবন
[সম্পাদনা]ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন একজন ভূস্বামী। তার মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন ঐ অঞ্চলের জমিদার। আবেদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে দেশভাগের ঠিক আগে তার বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে চলে আসেন কুমিল্লা জিলা স্কুলে। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। এরপর চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হওয়ায় তিনিও চাচার সাথে পাবনায় চলে যান এবং পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। তিনি ১৯৫২ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচার বিষয়ে পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন। দুবছর লেখাপড়া করে কোর্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৮ সালে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে পরবর্তী কালে তিনি ১৯৬২ সালে লন্ডনের চাটার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টসে চার বছরের পেশাদার কোর্স সম্পন্ন করেন।[৫] এছাড়া তিনি ১৯৯৪ সালে কানাডার কুইনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'ডক্টর অব ল' এবং ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'ডক্টর অব এডুকেশন' ডিগ্রি লাভ করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
প্রারম্ভিক কর্মজীবন
[সম্পাদনা]চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়াকালীন ১৯৫৮ সালে ফজলে হাসান আবেদের মায়ের মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে তিনি লন্ডনে চাকরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন চাকরি করার পর চলে যান কানাডা। সেখানেও একটি চাকরিতে যোগ দেন। পরে চলে যান আমেরিকা। ১৯৬৮ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে তিনি শেল অয়েল কোম্পানিতে যোগদান করেন এবং পদোন্নতি লাভ করে ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।[৬] এখানে চাকরিকালীন ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। এ সময়ে তিনি 'হেলপ' সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে মনপুরা দ্বীপে গিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেন।[৫] ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের লক্ষ্যে অ্যাকশন বাংলাদেশ এবং হেলপ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন।[৫][৭]
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
[সম্পাদনা]১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের সময় তিনি চট্টগ্রামে অবস্থান করেন। এপ্রিলের দিকে তিনি ঢাকায় আসেন।[৮] এ সময় শেল কোম্পানির তৎকালীন চেয়ারম্যান জেনারেল আবদুর রহিম ঢাকায় আবেদের অবস্থানের কথা জানতে পেরে তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি মিটিং ডাকেন। সেখানে তিনি বলেন, চলমান যুদ্ধে শেল পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ করবে। টিক্কা খানের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তেল কোম্পানিগুলো থেকে একজন লিয়াজোঁ অফিসার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যিনি সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষা করবেন। আবেদই হবেন সেই লিয়াজোঁ অফিসার। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিপদ হতে পারে উপলব্ধি করে তিনি বিষয়টি মেনে নেন এবং পরের কয়েক দিন নিবিষ্ট মনে কাজ করেন। এপ্রিলের শেষ দিকে জানতে পারেন পাকিস্তানের প্রতি আমেরিকার সমর্থন বন্ধ করার জন্য আমেরিকায় তাঁর বন্ধুরা তদবির করছেন। ইতিমধ্যে তাঁর ঘনিষ্ঠ অনেকেই ভারত অথবা অন্য কোনো দেশে চলে গেছেন। তিনি ভাবেন, তহবিল সংগ্রহ কিংবা জনমত গঠন—যা–ই হোক লন্ডনে গেলে তিনি ভালোভাবে দেশের জন্য কাজ করতে পারবেন। তখন তিনি লন্ডনে যাওয়ার জন্য মনস্থির করেন। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে লন্ডনে যাওয়া ছিল দুঃসাহসিক কাজ। লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে নিয়োগের পর তাঁকে একটি বাঘ মার্কা পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। এই ‘ফ্রি মুভমেন্ট পাস’-এর মাধ্যমে কারফিউ জারি থাকলেও তিনি নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারতেন। ঢাকা-লন্ডন সরাসরি ফ্লাইট না থাকায় তখন তিনি প্রথমে করাচিতে যান। সেখানে শেলের এক সহকর্মীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তিনি কোম্পানির চেয়ারম্যানকে আবেদের ঢাকা ত্যাগের বিষয়টি জানিয়ে দেন। তখন শেলের চেয়ারম্যান পাকিস্তান ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) কাছে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করেন এবং আবেদকে গ্রেপ্তারের অনুরোধ করেন। এর পরপরই আইএসআইয়ের কর্মীরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেন এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শেলের ইসলামাবাদ অফিসে নিয়ে যান। গ্রেপ্তারের বিষয়টি পাকিস্তানে অবস্থানরত আবেদের বন্ধু আসাফউদ্দৌলাহ জানতে পারেন। তখন তিনি ব্রিটিশ হাইকমিশনকে জানান, তাদের এক নাগরিককে আইএসআই আটকে রেখে হয়রানি করছে। উল্লেখ্য, আবেদের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ছিল। ব্রিটিশ হাইকমিশনের মধ্যস্থতায় দুই দিন পর আবেদ ছাড়া পান এবং তাঁর পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হয়। এরপর আসাফউদ্দৌলাহ তাঁকে খাইবার গিরিপথ দিয়ে আফগানিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরদিন খুব ভোরে আবেদ ইসলামাবাদ থেকে ট্যাক্সিতে আফগান বর্ডার থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে পেশোয়ারের উদ্দেশে রওনা দেন। সেখান থেকে পরদিন সকালে খাইবার পাস হয়ে আফগানিস্তানে পৌঁছান। এরপর চলে যান জালালাবাদ এবং সেখান থেকে কাবুল। এ সময় আবেদ লন্ডনে অবস্থানরত তাঁর পুরোনো বন্ধু ম্যারিয়েটাকে টেলিগ্রাম করে লন্ডনে যাওয়ার জন্য একটি বিমান টিকিটের ব্যবস্থা করে দিতে বলেন। অভিজাত পরিবারে জন্ম নেওয়া ম্যারিয়েটা ছিলেন ফিনল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কন্যা। তিনি দ্রুতই টিকিটের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন। দুই সপ্তাহ পর কাবুল থেকে ইস্তাম্বুল হয়ে আবেদ লন্ডনে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে প্রথমে শেলের হেড কোয়ার্টারে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। সে সময় তাঁর বন্ধু আইনজীবী ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীও সেখানে অবস্থান করছিলেন। লন্ডনে ইতিমধ্যে বিদেশিরা বাংলাদেশের সপক্ষে একটি আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। পল কনেট ও অ্যালেন কনেট নামের আরও দুই প্রবীণ অ্যাকটিভিস্টের সঙ্গে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলতে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিলেন ম্যারিয়েটা। আবেদ তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।[৯][১০]
১৯৭১ সালের জুলাই মাসে আবেদ ভিয়েতনামের পক্ষে ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে কাজ করা একটি গ্রুপের কাছ থেকে রহস্যময় ফোনকল পান। ওই গ্রুপ আবেদ ও ভিকারুলের সঙ্গে দেখা করে। তাঁদের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, গ্রুপটি তাঁদের পক্ষ হয়ে পাকিস্তানের ভেতরে ‘নাশকতামূলক তৎপরতা’ চালাবে। এ কাজের জন্য তাদের সঙ্গে ১৬ হাজার ৮০০ পাউন্ডের চুক্তিও হয়। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের আগে আবেদ ও ভিকারুল কলকাতায় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি খুলে বলেন। সবকিছু শোনার পর তাজউদ্দীন এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে এত অর্থ ব্যয় করা ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন। তিনি এ–ও বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা আর্থিক সংকটে রয়েছে। আবেদ ও ভিকারুল তখন বুঝতে পারেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি সহায়তা করার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। লন্ডনে ফিরে এসে নানা সূত্র থেকে প্রাপ্ত অর্থসহায়তার একটি অংশ তাঁরা কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। সেই অর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে ব্যয় করা হয়। লন্ডনে হেল্প বাংলাদেশ অফিসের এক পাশে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের লক্ষ্যে অর্থসংগ্রহ শুরু করেন। অন্যদিকে অ্যাকশন বাংলাদেশ ও হেল্প বাংলাদেশ যৌথভাবে লন্ডনে মার্কিন দূতাবাসের সামনে পথনাটক প্রদর্শনের আয়োজন করে। কীভাবে পাকিস্তানি সেনারা নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করছে, নাটকে সেটি তুলে ধরা হয়। ব্রিটিশ টেলিভিশন নাটকটি সম্প্রচার করে। ডিসেম্বরের ৬ তারিখ ফজলে হাসান আবেদ তখন একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে অংশ নিতে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ছিলেন। তিনি ডেনমার্কসহ অন্য দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ডেনমার্কসহ ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, আইসল্যান্ড ও ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।[১১][১২]
ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা
[সম্পাদনা]বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাধীন বাংলাদেশের দরিদ্র, অসহায়, সবহারানো মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কল্পে 'Bangladesh Rehabilitation Assistance Committee' বা সংক্ষেপে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন। যুদ্ধের পর সিলেটের শাল্লায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসবাসরত লোকজনকে দেখতে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি শাল্লায় উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন।[৭]
১৯৭৩ সালে সাময়িক ত্রাণকার্যক্রমের গণ্ডি পেরিয়ে ব্র্যাক যখন উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করে, তখন 'BRAC'-এই শব্দসংক্ষেপটির যে ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়, সেটি হল 'Bangladesh Rural Advancement Committee'। বর্তমানে ব্যাখ্যামূলক কোনো শব্দসমষ্টির অপেক্ষা না রেখে এই সংস্থা শুধুই 'BRAC' নামে পরিচিত। কবি বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কাজী ফজলুর রহমান, আকবর কবীর, ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, এস আর হোসেন এবং ফজলে হাসান আবেদ, এই সাতজনকে নিয়ে ১৯৭২ সালে ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ড গঠিত হল। বোর্ড ফজলে হাসান আবেদকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারম্যান। তিনি ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন,[১৩] এবং আবেদ ২০০১ সাল পর্যন্ত সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে ৬৫ বছর বয়সে নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর ব্র্যাকের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ তাকে চেয়ারপারসন নির্বাচিত করে। পরবর্তীতে তিনি ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধায়ক পর্ষদেরও চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।[১৪]
প্রভাব, উদ্ভাবনশীলতা, টেকসই সমাধান এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের নিরিখে জেনেভা ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংস্থা এনজিও অ্যাডভাইজার ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর ব্র্যাককে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এনজিও হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।[৭] ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক বাংলাদেশ ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপারসন পদ থেকে অব্যহতি নেন এবং চেয়ার এমেরিটাস পদ গ্রহণ করেন।[১৫]
মৃত্যু
[সম্পাদনা]শ্বাসকষ্ট ও শারীরিক দুর্বলতাজনিত কারণে ২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হন। ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত অবস্থায় ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার রাত ৮ টা ২৮ মিনিটে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।[১৬][১৭]
পুরস্কার
[সম্পাদনা]- র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, সামাজিক নেতৃত্বের জন্য (১৯৮০)।[১৮]
- ইউনেস্কো নোমা পুরস্কার (১৯৮৫)
- এ্যালান শন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার (১৯৯০)
- ইউনিসেফ মরিস পেট পুরস্কার (১৯৯২)
- সুইডেনের ওলফ পাম পুরস্কার (২০০১)। "দারিদ্র বিমোচন ও দরিদ্র মহিলাদের ক্ষমতায়নের জন্য।" [১৯]
- শোয়াব ফাউন্ডেশন "সামাজিক উদ্যোক্তা" পুরস্কার (২০০২)
- গ্লেইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৩)
- জাতীয় আইসিএবি (২০০৪)
- জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার মাহবুব-উল-হক পুরস্কার (২০০৪), সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকার জন্য।[২০]
- গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ্ব স্বাস্থ্য পুরস্কার (২০০৪)
- হেনরি আর. ক্রাভিস পুরস্কার (২০০৭)
- প্রথম ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেন পুরস্কার (২০০৭) [২১]
- পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন আজীবন সম্মাননা পুরস্কার (২০০৭)
- ডেভিড রকফেলার পুরস্কার (২০০৮)
- দারিদ্র বিমোচনে বিশেষ ভূমিকার জন্য ব্রিটেন কর্তৃক ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে "নাইটহুডে" ভূষিত।[২২]
- এন্ট্রাপ্রেনিওর ফর দ্য ওয়ার্ল্ড পুরস্কার (২০০৯)[২৩]
- ওয়াইজ পুরস্কার (২০১১)[২৪]
- সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি ওপেন সোসাইটি পুরস্কার (২০১৩)
- লিও তলস্তয় আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক (২০১৪)
- বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার (২০১৫)
- ইয়াইদান পুরস্কার ( নেদারল্যান্ড, ২০১৯)
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "স্যার ফজলে হাসান আবেদ আর নেই"। দৈনিক কালের কণ্ঠ। ২০ ডিসেম্বর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২০ ডিসেম্বর ২০১৯।
- ↑ "ফজলে হাসান আবেদ এক আলোকবর্তিকা"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-২০।
- ↑ ক খ "Remembering Sir Fazle Hasan Abed KCMG"। ব্র্যাক (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০ ডিসেম্বর ২০১৯।
- ↑ "Knight Commander of the Most Distinguished Order of St Michael and St George" (KCMG)
- ↑ ক খ গ "স্যার ফজলে হাসান আবেদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত"। দৈনিক প্রথম আলো। ২৭ এপ্রিল ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০ ডিসেম্বর ২০১৯।
- ↑ THE STARS OF ASIA -- FINANCIERS: Fazle Hasan Abed, BusinessWeek, July 8, 2002.
- ↑ ক খ গ "ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবনাবসান"। ব্র্যাক। ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ ডিসেম্বর ২০১৯।
- ↑ লেখা (২০২৩-১২-২০)। "ফজলে হাসান আবেদ: 'অ্যাকশন বাংলাদেশ' ও 'হেল্প বাংলাদেশ'র ভূমিকা"। Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০১-০৫।
- ↑ প্রতিবেদক, নিজস্ব (২০১৯-১২-২২)। "রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধে আবেদ"। Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০১-০৫।
- ↑ মোর্তোজা, গোলাম (২০২১-০৪-২৭)। "ফজলে হাসান আবেদের বাংলাদেশ"। The Daily Star Bangla (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০১-০৫।
- ↑ "মুক্তিযুদ্ধে স্যার ফজলে হাসান আবেদ"। মানবজমিন। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০১-০৫।
- ↑ মোর্তোজা, গোলাম (২০২১-০৪-২৭)। "ফজলে হাসান আবেদের বাংলাদেশ"। The Daily Star Bangla (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০১-০৫।
- ↑ "ব্র্যাক থেকে অবসরে ফজলে হাসান আবেদ নতুন চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান"। দৈনিক যুগান্তর। ৬ আগস্ট ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২০ ডিসেম্বর ২০১৯।
- ↑ "ব্র্যাক থেকে অবসর নিলেন ফজলে হাসান আবেদ"। ঢাকা ট্রিবিউন। ৬ আগস্ট ২০১৯। ২০ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ ডিসেম্বর ২০১৯।
- ↑ "ব্র্যাকের চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসরে ফজলে হাসান আবেদ"। দৈনিক ইত্তেফাক। ৭ আগস্ট ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২০ ডিসেম্বর ২০১৯।
- ↑ "ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ আর নেই"। Jugantor। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-২০।
- ↑ "স্যার আবেদকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা | জাতীয়"। ittefaq। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-২৩।
- ↑ 1980 Ramon Magsaysay Award for Community Leadership - Fazle Hasan Abed ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১২ মার্চ ২০০৭ তারিখে, Ramon Magsaysay Foundation.
- ↑ ওলফ পাম পুরস্কার ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে, ওলফ পাম সেন্টার. সুইডিয় ভাষার পুরস্কার সম্মাননায় বলা হয়েছে, Fazle Hasan Abed, Bangladesh, grundare av BRAC (Bangladesh Rural Advancement Committee). För hans arbete med att bekämpa fattigdom och stärka de fattigas, särskilt kvinnornas, makt över sina liv.
- ↑ Fazle Hasan Abed wins UNDP Award, The Daily Star, 18 October, 2004.
- ↑ 2007 President Clinton Honors Four Extraordinary Individuals at Inaugural Clinton Global Citizen Awards, Clinton Global Citizen Awards.
- ↑ Bangladesh NGO head gets UK award
- ↑ ওয়ার্ল্ড এন্ট্রাপ্রেনিওরশিপ পুরস্কার ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৮-০১-০৬ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো, ০১ ডিসেম্বর ২০১২
- ↑ দৈনিক সকালের খবর
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- ১৯৩৬-এ জন্ম
- ২০১৯-এ মৃত্যু
- বাংলাদেশী সমাজকর্মী
- রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার বিজয়ী
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- বাঙালি সমাজসেবক
- বাঙালি মুসলিম
- বাঙালি নাইট
- বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো
- হবিগঞ্জ জেলার ব্যক্তি
- ঢাকা কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- পাবনা জিলা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- বনানী কবরস্থানে সমাধিস্থ
- বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠাতা
- যুক্তরাজ্যের স্বাভাবিক নাগরিক
- ইংল্যান্ডে বাংলাদেশী অভিবাসী
- ওলফ পালমে পুরস্কার বিজয়ী
- ২১শ শতাব্দীর বাঙালি
- ২০শ শতাব্দীর বাঙালি
- গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী