সুলায়মান খান কররানী
সুলায়মান খান কররানী (শাসনকাল ১৫৬৬-১৫৭২) ছিলেন বাংলার সুলতান। তার বড় ভাই তাজ খান কররানীর মৃত্যুর পর তিনি সুলতান হন।[১] রিয়াজুস সালাতিন অনুযায়ী তিনি গৌড় থেকে তান্ডায় রাজধানী সরিয়ে আনেন।[২]
সুলায়মান খান, তার ভাই তাজ খান কররানী ও সুলায়মান খানের দুই পুত্র বায়েজিদ খান কররানী ও দাউদ খান কররানী মোগলদের অনুগত একটি স্বল্পস্থায়ী রাজ্য শাসন করেন। আকবরের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনপূর্বক সুলায়মান খান অত্র এলাকায় কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। আফগানরা আকবরের কাছে পরাজিত হওয়ার তার পতাকার অধীনে অবস্থান করে।
আকবরের সাথে সম্পর্ক
[সম্পাদনা]সুলায়মান খান তার শাসনামলে নিজ নামে মুদ্রা চালু করেননি। এই কাজের মাধ্যমে মোগলদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হত।[১] মসজিদে আকবরের নামে জুমার খুতবা পাঠের মাধ্যমে তিনি আকবরকে বাংলার সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে মেনে নেন।[১] ইতিহাসবিদরা এই ঘটনাকে বাংলা ও মোগল সাম্রাজ্যের মধ্যকার কূটনৈতিক শান্তি স্থাপন হিসেবে দেখেন।[১]
উড়িষ্যা জয়
[সম্পাদনা]উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের অংশবিশেষ মুসলিম শাসকদের অধীনে ছিল। তবে উড়িষ্যা তখনও মুসলিম শাসনের অধীনে আসেনি। ১৫৬৮ সালে সুলায়মান খান তার পুত্র বায়েজিদ খান কররানী ও তার বিখ্যাত সেনাপতি কালাপাহাড়কে উড়িষ্যা আক্রমণের জন্য পাঠান। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের পর উড়িষ্যা সুলায়মান খানের আওতায় আসে। কালাপাহাড় জগন্নাথ মন্দির আক্রমণ করেন ও পুরীর নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। সুলায়মান কররানী লোদি খান ও কুতলু খানকে যথাক্রমে উড়িষ্যা ও পুরীর গভর্নর নিয়োগ করেন।[৩]
কুচবিহার জয়
[সম্পাদনা]সুলায়মান খান কররানী এরপর তার সেনাপতি কালাপাহাড়কে কামতা (পরবর্তীতে মোগলদের অধীনে কুচ বিহার) প্রেরণ করেন। কালাপাহাড় ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করেন এবং তেজপুর (বর্তমান দিনাজপুর জেলা) পর্যন্ত পৌছান। কালাপাহাড় কামতার সেনাপতি শুক্লধজকে পরাজিত ও বন্দী করেন।
কিংবদন্তি
[সম্পাদনা]চৈতন্য মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দ অপ্রকট হওয়ার পর বীরভদ্র দৈবাদেশ পান, মালদহের নবাবের রাজপ্রাসাদের তোরণে রয়েছে একটি কালো পাথর। বীরভদ্রের প্রতি দৈবাদেশ, সেই পাথর থেকে কৃষ্ণ বিগ্রহ তৈরি করিয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এই উদ্দেশ্যে বীরভদ্র সপার্ষদ নামসঙ্কীর্তন করতে করতে হাজির হলেন তখনকার মালদহে। গৌড়ের নবাব সোলেমান খাঁ। মালদহের নবাব সংবাদ পেয়ে বীরভদ্রকে বন্দি করলেন এবং ষড়যন্ত্র করলেন, গোমাংস খাইয়ে বীরভদ্রের জাত নষ্ট করা হবে। বীরভদ্রের এই অভিযানে আছে অলৌকিক দৈব মহিমার অনুষঙ্গ। রাজসভায় বীরভদ্রের সামনে ঢাকা দেওয়া একটি খাবারের থালা আনা হয়। ঢাকনা সরানো হলে দেখা গেল, গোমাংসের বদলে থালায় রয়েছে পুষ্পমাল্য। নবাব দমলেন না। সুরার পাত্র আনিয়ে বীরভদ্রকে পান করতে বললেন। এ বারেও দেখা যায়, সুরার বদলে পাত্রে রয়েছে দুধ। কাণ্ড দেখে নবাব ভয় পেলেন। তিনি বীরভদ্রের কাছে ক্ষমা চাইলেন। অনুরোধ করলেন, বীরভদ্র যদি তাঁর দৈব ক্ষমতার সাহায্যে নবাবের রুগ্ণ জামাইকে সুস্থ করে তোলেন। বীরভদ্র শর্ত দেন, জামাইয়ের সুস্থ শরীরের বিনিময়ে তিনি নিয়ে যাবেন রাজপ্রাসাদের তোরণে রক্ষিত বিশেষ কষ্টিপাথরটি। নবাব সম্মতি দিলেন। বীরভদ্রের নির্দেশে সুরার পাত্রের দুধটি জামাইকে পান করানো হয়। বীরভদ্রের অলৌকিক শক্তির জোরে নবাবের জামাই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। অপর দিকে আচমকাই আকাশ জুড়ে খেলে যায় তীব্র বিদ্যুতের ঝলক। সঙ্গে প্রচণ্ড বজ্রপাত। সবাই অবাক হয়ে দেখলেন, বজ্রের আঘাতে তোরণ থেকে খুলে পড়েছে বিরাট কষ্টিপাথরের খণ্ড।[৪]
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
[সম্পাদনা]সুলায়মান কররানী ৭ বছর শাসন করার পর ১৫৭২ সালের ১১ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তার পুত্র বায়েজিদ খান কররানী এরপর সুলতান হন।
ধর্ম
[সম্পাদনা]সুলায়মান খান কররানী একজন ধার্মিক মুসলিম ছিলেন। পুরনো মালদার সোনা মসজিদ তিনি নির্মাণ করেন।[৩]
ইতিহাসবিদ আবদুল কাদির বাদাউনি উল্লেখ করেছেন যে সুলায়মান খান প্রতিদিন সকালে ১৫০ জন আলেমের সাথে ধর্মীয় আলাপ করতেন। এরপরই তিনি অন্যান্য বৈষয়িক বিষয়ে মনোনিবেশ করতেন।[৫]
পূর্বসূরী তাজ খান কররানী |
কররানী রাজবংশ ১৫৬৬-১৫৭২ |
উত্তরসূরী বায়েজিদ খান কররানী |
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ ঘ Hasan, Perween; Grabar, Oleg (২০০৭)। Sultans and Mosques: The Early Muslim Architecture of Bangladesh। I. B.Tauris & Company, Limited। আইএসবিএন 978-1-84511-381-0।
- ↑ Eaton, Richard M. (১৯৯৩)। The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760। Berkeley: University of California Press। পৃষ্ঠা 140–2। আইএসবিএন 0-520-20507-3। line feed character in
|শিরোনাম=
at position 33 (সাহায্য) - ↑ ক খ "Sulaiman Khan Karrani in Banglapedia"। ৩০ নভেম্বর ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জুলাই ২০১৪।
- ↑ "নবাব প্রাসাদের পাথর থেকে শ্রীশ্যামসুন্দর"।
- ↑ Abul Fazl Allami (translated by H. Blochman) (১৮৭৩)। Ain i Akbari। Calcutta।