দক্ষিণাকালী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
দক্ষিণা কালী
সময়, সৃষ্টি , স্থিতি , লয়, ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষের দেবী
দশমহাবিদ্যা গোষ্ঠীর সদস্য
দক্ষিণা কালী
অন্তর্ভুক্তিপার্বতীকালীদুর্গা
মহাবিদ্যাদেবী,মহাদেবী
আবাসশ্মশানভূমি , মণিদ্বীপ , মন্দির , গৃহ
অস্ত্রখড়্গ , নরমুণ্ড , বর ও অভয়মুদ্রা
বাহনশবরূপী মহাদেব বা সদাশিব
সঙ্গীমহাকাল


দক্ষিণা কালী হিন্দু দেবী কালীর সবচেয়ে জনপ্রিয় রূপ এবং জন্ম, স্থিতি, শক্তির দেবী ও প্রসিদ্ধ মূর্তি। তাঁকে শিবের সঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দক্ষিণা কালীর রূপ মহাকালী (মৃত্যু এবং সময়ের দেবী ) এবং শ্মশানকালীর ( ​​শ্মশানে পূজিতা দেবী ) থেকে কিছু ভিন্ন। তাঁকে দিব্যমাতৃকা হিসাবে ভারতে পূজা করা হয়।

নাম-ব্যুৎপত্তি[সম্পাদনা]

দক্ষিণা কালীর ডান পা শিবের বক্ষস্থলে। সেই কারণে কালীর এই রূপের নাম দক্ষিণাকালী।"দক্ষিণা কালী" এই নাম প্রসঙ্গে মহানির্বাণ তন্ত্রের দশম পটলে বলা হয়েছে
" দক্ষিণস্যাং দিশি স্থানে সংস্থিতশ্চ রবে সুতঃ।
কালীনাম্না পলায়েত ভীতিযুক্তঃ সমস্ততঃ।।
অতঃ সা দক্ষিণা কালী ত্রিষু লোকেষু গীয়তে।
পুরুষো দক্ষিণঃ প্রোক্তো বামা শক্তির্নিগদ্যতে।।
বাময়া দক্ষিণং জিত্বা মহামোক্ষপ্রদায়িনী।
অতঃ সা দক্ষিণা নাম্না ত্রিষু লোকেষু গীয়তে।।
নির্গুণঃ পুরুষঃ কাল্যা সৃজ্যতে লুপ্যতে যতঃ।
অতঃ সা দক্ষিণা নাম্না ত্রিষু লোকেষু গীয়তে।।"

এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী,দক্ষিণা কালীর এইরূপ নামের তিনটি স্বতন্ত্র কারণ রয়েছে। দক্ষিণদিকের অধিপতি সূর্য্যনন্দন যম কালীর নামে ভীত হয়ে দিগ্বিদিকে পলায়ন করেন, সেজন্য দেবীর দক্ষিণা কালিকা নাম। দ্বিতীয়তঃ,দক্ষিণাখ্য পুরুষকে জয় করে বামাখ্যা পরাপ্রকৃতি কালী মহামোক্ষ প্রদান করেন, তাই তিনি দক্ষিণাকালী নামে পরিচিতা হন। আবার কালী যেহেতু নির্গুণ পুরুষকে সৃষ্টি ও ধ্বংস করেন, সেই জন্য তিনি দক্ষিণা কালিকা নামে ত্রিজগতে আখ্যায়িতা।

দক্ষিণা কালী পূজার সূত্রপাত[সম্পাদনা]

কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রতিষ্ঠিত আগমেশ্বরী মাতা,নবদ্বীপ

রামপ্রসাদ সেনের গুরু কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বপ্নে আদেশ পান কালীর প্রসন্ন ভাবমূর্তি রচনা করার। স্বপ্নে দেবী তাকে জানান পরবর্তী ভোরে যে নারীকে তিনি সর্বপ্রথম দেখবেন তার রূপ অনুযায়ী কালীর এক প্রসন্ন প্রতিমূর্তি তৈরী করতে। পরবর্তী ভোরে যে নারীকে প্রথম সে দেখেন তিনি কৃষ্ণবর্ণা, তার ডান পা সামনে, উন্মুক্ত কালো কেশ এবং বাম হাত উত্তোলনের দ্বারা দেয়ালে গোবর স্থাপন করছেন। আকস্মিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে সামনে দেখে সেই মহিলা খুব লজ্জা পেলেন এবং তার জিহ্বা বার করে দাঁত দিয়ে চাপলেন। সেই নারীর রূপ অনুসরণ করে আগমবাগীশ মহাশয় কালীতন্ত্রের মূর্তিতত্ত্ব অনুযায়ী দক্ষিণা কালীর মূর্তি রচনা করেছিলেন। এর আগে কালী যন্ত্রে কালীপূজা হতো।[১][২]

মূর্তিতত্ত্ব[সম্পাদনা]

দক্ষিণা কালীর ডান পা শিবের বুকে। তিনি কালীর অন্যান্য রূপ থেকে ভিন্ন এবং তাঁকে গৃহে, মন্দিরে পূজা করা হয়।

দক্ষিণাকালী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তাঁর বামকরযুগলে সদ্য ছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ; দক্ষিণকরযুগলে বর ও অভয় মুদ্রা। তাঁর গাত্রবর্ণ মহামেঘের ন্যায় (কখনোও বা অঞ্জনপর্বতের ন্যায়) ঘোর শ্যাম, কর্পূরাদি স্তোত্রে "ধ্বান্তধারাধররুচি"। সকল রং যেমন কালোতে মিশে যায়, লয় পায়; তেমনি জীবাত্মা- পরমাত্মা সনাতনী পরমাপ্রকৃতি সত্যস্বরূপিনী দক্ষিণাকালীতেই বিলীন হয়।এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় মহানির্বাণ তন্ত্রের ১৩শ উল্লাসে "শ্বেতপীতাদিকোবর্ণো যথা কৃষ্ণে বিলীয়তে।
প্রবিশন্তি তথা কাল্যাং সর্ব্বভূতানি শৈলজে।।
অতস্তস্যাঃ কালশক্তের্নির্গুণায়া নিরাকৃতেঃ।
হিতায়াঃ প্রাপ্তযোগানাং বর্ণঃ কৃষ্ণো নিরূপিতঃ।।"
- হে শৈলসুতে। কৃষ্ণবর্ণে যেমন শ্বেত, পীত প্রভৃতি সকল বর্ণ লয় পায়, তেমনি নিখিল চরাচর কালীতে অন্তর্হিত হয়। সেই নির্গুণা, নিরাকারা পরব্রহ্মময়ী কালশক্তির বর্ণ তাই কালো।

তিনি দিগম্বরী - নিখিলব্রহ্মাণ্ডই তাঁর অঙ্গের আবরণ। (নজরুলের কথায় " বিশ্বে মায়ের রূপ ধরে না তাই তো মা মোর দিগ্বসন"।)

তিনি শ্যামা- শীতে উষ্ণস্পর্শা, গ্রীষ্মে শীতলস্পর্শা , তপ্তকাঞ্চনের ন্যায় উজ্জ্বলপ্রভাবিশিষ্টা। তাঁর গলায় সদ্যকর্তিত পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা - মুণ্ডগুলি পরস্পরের কেশের দ্বারা গ্রথিত; কর্ণে দুই শিশুশব ও বাণ বা শকুন্তপক্ষের কুণ্ডল; কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। তিনি দন্তুরা - তাঁর উঁচু দন্তপঙক্তি উজ্জ্বল শ্বেতবর্ণ; তাঁর স্তনযুগল উন্নত - জরা-মরণাদি ত্রিদশার অতীত  ; তিনি ত্রিনয়নী এবং শবাকার শিবের বুকে আলীঢ়পদে আসীন । তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিণী । তাঁর দীর্ঘ এবং কালো চুল সভ্যতা থেকে প্রকৃতির স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করে। দক্ষিণা কালীর তিনটি নয়ন সূর্য, চন্দ্র এবং অগ্নির প্রতীক এবং এটি প্রকৃতির চালিকা শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।[৩]

তাঁর লোলজিহ্বা রজোগুণ এবং শুভ্র দন্তপঙক্তি সত্ত্বগুণের প্রতীক। তাঁর জিহ্বা তিনি দন্তপঙক্তিতে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছেন। এটি সত্ত্বগুণের রজোগুণের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন দ্যোতনা করে। তাঁর গলায় মুণ্ডমালা প্রজ্ঞার দ্যোতক এবং তা ৫০ টি সদ্যকর্তিত নরমুণ্ডে গ্রথিত । সংস্কৃত বর্ণমালায় অ থেকে ক্ষ অবধি ৫০ টি বর্ণ (১৪ স্বর ও ৩৬ ব্যঞ্জনবর্ণ) রয়েছে, বিদ্যারাজ্ঞী বা অনিরুদ্ধ সরস্বতী দেবী দক্ষিণাকালী এই নরমুণ্ডের মালা বর্ণ বা অক্ষমালা হিসাবে কন্ঠে ধারণ করেন ।

তাঁর উপরের বাম হাতে খড়্গ জ্ঞানশক্তির প্রতীক এবং নিচের বাম হাতে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড জীবত্ব ও অহং এর প্রতীক। কালী জ্ঞানখড়্গের দ্বারা মানুষের অহং ছিন্ন করে তার জীবত্ব নাশ করেন ও পরমাত্মার সঙ্গে যোগ ঘটান। দক্ষিণা কালী দক্ষিণকরযুগলে নিত্য চতুর্বর্গের বর ও জাগতিক বিবিধ ভয় হতে অভয় দান করে চলেছেন। তাঁর কটিতট বা কোমরে বদ্ধ ছিন্নহাতের কাঞ্চী জীবের কর্ম অন্তিমলগ্নে যে তাঁর মধ্যেই লয় পায়, তাঁতেই যে মিশে যায়, সেকথাই প্রকাশ করে ।

ভগিনী নিবেদিতা তাঁর মাতৃরূপা কালী বইতে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী (জগদীশ্বরী) কালীর কথা আলোচনা করেছেন। দক্ষিণেশ্বরের কালী দক্ষিণা কালী। তাঁর পূজা করলে ত্রিবর্গ (ধর্ম, অর্থ,কাম) তো বটেই, এমনকি মোক্ষও ফলস্বরূপ পাওয়া যায়।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

পাদটীকা[সম্পাদনা]

  1. "কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, স্বপ্নে আদেশ ও দক্ষিণা কালীর মূর্তি রচনা"। ২০১৬-০৮-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৮-০১ 
  2. নবদ্বীপের হেরিটেজ (পিডিএফ)। ১৬ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ আগস্ট ২০১৬ 
  3. দক্ষিণাকালীর ধ্যান, স্তবকবচমালা ও ধ্যানমালা, পণ্ডিত বামদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত, অক্ষয় লাইব্রেরি, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২৮৮