বিষয়বস্তুতে চলুন

পলান সরকার

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
পলান সরকার
জন্ম১ আগস্ট ১৯২১
মৃত্যু১ মার্চ ২০১৯(2019-03-01) (বয়স ৯৭)
বাঘা, রাজশাহী, বাংলাদেশ
জাতীয়তাবাংলাদেশি
নাগরিকত্ব বাংলাদেশ
পেশাসমাজ সেবক
পরিচিতির কারণসমাজসেবা, সাদা মনের মানুষ,[] আলোর ফেরিওয়ালা

পলান সরকার (১ আগস্ট ১৯২১ - ১ মার্চ ২০১৯) একজন বাংলাদেশি সমাজকর্মী ছিলেন। ২০১১ সালে সমাজসেবায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক প্রদান করে।[][] পলান সরকার রাজশাহী জেলার ২০ টি গ্রামজুড়ে গড়ে তুলেছেন অভিনব শিক্ষা আন্দোলন। নিজের টাকায় বই কিনে তিনি পড়তে দেন পিছিয়ে পড়া গ্রামের মানুষকে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাঁধে ঝোলাভর্তি বই নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। মাইলের পর মাইল হেঁটে একেকদিন একেক গ্রামে যান। বাড়ি বাড়ি কড়া নেড়ে আগের সপ্তাহের বই ফেরত নিয়ে নতুন বই পড়তে দেন। এলাকাবাসীর কাছে তিনি পরিচিত ‘বইওয়ালা দাদুভাই’ হিসেবে।[][]

প্রারম্ভিক জীবন

[সম্পাদনা]

পলান সরকার ১৯২১ সালের ১ আগস্ট[] (বাংলা: ২৫ ভাদ্র, ১৩২৯) নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[] পলান সরকারের জন্ম নাম ছিল হারেজ উদ্দিন সরকার। তবে জন্মের পর থেকেই মা “পলান” নামে ডাকতেন।[] মাত্র পাঁচ মাস বয়সে তার বাবা হায়াত উল্লাহ সরকার মৃত্যুবরণ করেন। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর অর্থনৈতিক সংকটে লেখাপড়া বন্ধ করে দেন।[] এরপর তার নানা ময়েন উদ্দিন সরকার মা মইফুন নেসাসহ পলান সরকারকে রাজশাহীর বাঘার থানার বাউসা গ্রামে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে তিনি একটি স্কুলে ভর্তি হন যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণির পর লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে পলান সরকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন। কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেন।[]

কর্মজীবন

[সম্পাদনা]

পলান সরকারের নানা ময়েন উদ্দিন সরকার স্থানীয় ছোট জমিদার ছিলেন। প্রথমদিকে তিনি তার নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন। দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে ১৯৬২ সালে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারীর চাকরি পান। নানার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ৪০ বিঘা সম্পত্তির মালিক হন।[] ব্রিটিশ আমলেই তিনি যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন। তিনিই আবার যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতেন। অন্যদিকে মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দিতেন। এভাবেই বই পড়ার নেশা জাগ্রত হয়। দীর্ঘদিন ধরে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৬৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় ৫২ শতাংশ জমি দান করার পর পলান সরকার স্থানীয়দের অনুরোধেই চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। বাউসা বাজারে তার একটি চালকল রয়েছে।[]

বই বিতরণ

[সম্পাদনা]

১৯৯০ সাল থেকে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিবছর যারা মেধাতালিকায় প্রথম দশটি স্থান অর্জন করত তাদের বই উপহার দিতেন পলান সরকার। এরপর অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও তার কাছে বইয়ের আবদার করলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তাদেরও বই দিবেন তবে তা ফেরত দিতে হবে। এরপর গ্রামের মানুষও তার কাছে বই চাইতে শুরু করে। এভাবেই শুরু হয় বই পড়া আন্দোলনের ভিত। ১৯৯২ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায় পলান সরকারকে হাঁটার অভ্যাস করতে হয়। তখনই তার মাথায় এক অভিনব চিন্তা আসে।[]

তিনি স্কুলকেন্দ্রিক বই বিতরণের প্রথা ভেঙে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেয়া এবং ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি তিনি বইও উপহার দেন। এছাড়া যারা তার চালকলে দেনা পরিশোধ করে তাদেরও তিনি বই উপহার দেন। ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে।[][১০]

সম্মাননা

[সম্পাদনা]

প্রথমে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মানুষই জানত পলান সরকারের এই অসামান্য শিক্ষা আন্দোলনের গল্প। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিতে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে পলান সরকারকে আলোকিত মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়।[] পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিক প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ সাময়িকীতে তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়, যার নাম ছিলো ‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’। এরপর থেকে তিনি সারাদেশে পরিচিতি পান।[]

২০১১ সালে সামাজসেবায় অবদানের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার উপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।[][১১] তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে বিটিভির জন্য গোলাম সারোয়ার দোদুল নির্মাণ করেন ঈদের নাটক 'অবদান'। বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সকলের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টির করার জন্য ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে 'সাদা মনের মানুষ' খেতাবে ভূষিত করে।[][১২]

মৃত্যু

[সম্পাদনা]

পলান সরকার ২০১৯ সালের ১ মার্চ রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার বাউশার নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।[১৩]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "আবুল হায়াত এখন পলান সরকার"। বাংলানিউজ২৪.কম। 
  2. "নতুন পলান সরকার"দৈনিক প্রথম আলো। ২০১৮-১০-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১১-২৮ 
  3. "পলানের বইগুলো"দৈনিক আমাদের সময়। ১৯ মে ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ নভেম্বর ২০১৮ 
  4. "পলান সরকারকে বই ফেরত দিচ্ছেন না পাঠকরা"। জাগোনিউজ২৪.কম। 
  5. আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, আবুল কালাম মুহম্মদ (১ আগস্ট ২০২০)। "হেঁটে হেঁটে বই বিলি করা পলান সরকারের ১০০তম জন্মদিন"প্রথম আলো। প্রথম আলো। ২ আগস্ট ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ আগস্ট ২০২২ 
  6. "পলান সরকারের সঙ্গে কিছু সময়"। দৈনিক প্রথম আলো। 
  7. "পলান সরকারের দেখা বৈশাখের একাল-সেকাল"দৈনিক ইত্তেফাক, বগুড়া সংস্করণ। [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  8. "আলোর ফেরিওয়ালা"। দৈনিক প্রথম আলো। 
  9. "পলান সরকারের বই পড়ার আন্দোলন"amardeshonline.com। ৩১ জুলাই ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ মে ২০১৫ 
  10. "পলান সরকার পাঠাগার"bausaup.rajshahi.gov.bd। ৭ নভেম্বর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ নভেম্বর ২০১৮ 
  11. "বইপ্রেমী পলান সরকার"বাংলাদেশ প্রতিদিন 
  12. "পলান সরকারকে নিয়ে নাটক অবদান"দৈনিক জনকণ্ঠ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  13. "'আলোর ফেরিওয়ালা' পলান সরকার আর নেই"। Archived from the original on ১ মার্চ ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১ মার্চ ২০১৯