প্রস্বেদন
প্রস্বেদন (ইংরেজি: Transpiration) হচ্ছে একটি শারীরতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে উদ্ভিদের পাতা ও অন্যান্য বায়বীয় অঙ্গ হতে জল বাষ্পাকারে বের হয়ে যায়। মূল এবং ফুলের মাধ্যমেও প্রস্বেদন বা বাষ্পমোচন হতে পারে। উদ্ভিদ তার মূল দিয়ে জল শোষণ করে থাকে এবং পত্ররন্ধ্রের রক্ষীকোষ দুটোর-স্ফীতি ও শিথিল অবস্থা পত্ররন্ধ্র খোলা ও বন্ধ হওয়া নিয়ন্ত্রণ করে। পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে বেশিরভাগ প্রস্বেদন সম্পন্ন হয়।
বাষ্পমোচনের ফলে মেসোফিল কলায় যে ব্যাপন চাপ ঘাটতি (Diffusion pressure deficit) দেখা যায় তা জাইলেম বাহিকায় যে বিশেষ চোষণ চাপ (suction pressure) সৃষ্টি করে মূল থেকে খনিজ লবণ মিশ্রিত জলকে ঊর্ধ্বমুখে পরিবাহিত করে, তাকে বাষ্পমোচন টান বা প্রস্বেদন টান বলে। এই টানের ফলেই রসের উৎস্রোত (Ascent of sap) ঘটে।
সক্রিয় শোষণঃ যে শোষণ প্রক্রিয়ায় বিপাকীয় শক্তির প্রয়োজন হয় তাকে সক্রিয় শোষণ প্রক্রিয়া বলে।
- নিষ্ক্রিয় শোষণঃ যে শোষণ প্রক্রিয়া কোনো বিপাকীয় শক্তির প্রত্যক্ষ প্রয়োজন পড়ে না তাকে নিষ্ক্রিয় শোষণ বলে।
পত্ররন্ধ্রীর প্রস্বেদন
[সম্পাদনা]পাতায় , কচিকাণ্ডে , ফুলের বৃতি ও পাপড়িতে দুটি রক্ষীকোষ ( Guard cell ) বেষ্টিত এক ধরনের রন্ধ্র থাকে । এদেরকে পত্ররন্দ্র ( একবচন stoma , বহুবচন stomata ) বলে । কোনো উদ্ভিদের মোট প্রস্বেদনের 90-95 % হয় পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে ।
প্রস্বেদনের গুরুত্ব
[সম্পাদনা]উদ্ভিদের জীবনে প্রস্বেদনের গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রস্বেদনের গুরুত্বে উপকারী এবং অপকারী দুটি দিকই রয়েছে। নিচে দুটি দিকই আলোচনা করা হলো।
- প্রস্বেদনের উপকারিতা
প্রস্বেদনের ফলে উদ্ভিদের বাহিকা নালীতে জলের যে টান পড়ে, মূলরোম কর্তৃক জল শোষণে তা সাহায্য করে থাকে। প্রস্বেদন উদ্ভিদ দেহের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যরস উপরে ওঠায়। প্রস্বেদনের ফলে বাহিকা নালীতে জলের যে টান পড়ে, তার সঙ্গে খনিজ লবণ তথা সামগ্রিক খাদ্যরস উপরে উঠে আসে। এই প্রক্রিয়া উদ্ভিদদেহে জল সরবরাহ করতে সাহায্য করে। প্রস্বেদনের ফলে উদ্ভিদের সারাদেহে জল সরবরাহ সহজতর হয়। এই পদ্ধতি উদ্ভিদদেহকে শীতল করতে কাজে লাগে প্রস্বেদনের সময় জল কে বাষ্পাকারে পরিণত করতে উদ্ভিদদেহের কিছু তাপ ব্যয় হয়। ফলে উদ্ভিদদেহ অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা হয়। এই প্রক্রিয়া অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় সহায়তা দান করে। প্রস্বেদনের ফলে কোষরসের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। কোষরসের ঘনত্ব বৃদ্ধি অভিস্রবণ প্রক্রিয়ার জন্য সাহায্যকারী হয়।
এছাড়াও প্রস্বেদন সালোক-সংশ্লেষণ ও শ্বসনে সহায়তা দান করে। প্রস্বেদনের সময় পত্ররন্ধ্রের খোলা ও বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াটি সালোক-সংশ্লেষণ ও শ্বসন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এই প্রক্রিয়া উদ্ভিদকে খাদ্য পরিবহনে সহায়তা দান করে। প্রস্বেদন প্রক্রিয়া উদ্ভিদদেহের বিভিন্ন অংশে খাদ্য পরিবহনে সহায়তা করে। এই পদ্ধতি উদ্ভিদের কোষ বিভাজন ও দৈহিক বৃদ্ধি করে। প্রস্বেদন প্রক্রিয়া পরোক্ষভাবে অভিস্রবণ প্রক্রিয়া চালু রাখে এবং সব কোষকে স্ফীত অবস্থায় রাখে। এর ফলে কোষ বিভাজন ও অঙ্গের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।
আরো উপকারিতার মধ্যে রয়েছে প্রস্বেদন ফলমূলের মিষ্টতা বৃদ্ধি করে। প্রস্বেদনের ফলে উদ্ভিদদেহ থেকে প্রচুর পরিমাণে জল নির্গত হয় বলে শর্করা জাতীয় পদার্থের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। শর্করা জাতীয় পদার্থের ঘনত্ব বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন ফলমূল এবং অন্যান্য ভক্ষণযোগ্য অংশের মিষ্টতা বৃদ্ধি পায়। এই পদ্ধতি উদ্ভিদের পাতায় ছত্রাক আক্রমণ রোধ করে। প্রস্বেদনের ফলে পাতার পৃষ্ঠে কিছু জলগ্রাহী লবণ জমা হয়, যা ছত্রাক আক্রমণ থেকে পাতাকে রক্ষা করে। প্রস্বেদন পাতায় উপযুক্ত তাপ নিয়ন্ত্রণ ও শক্তি নির্গমন করে। পাতা সূর্য থেকে প্রতি মিনিটে প্রচুর শক্তি শোষণ করে। এর মাত্র এক ভাগ বিভিন্ন বিক্রিয়ার জন্য খরচ হয়, বাকি অধিকাংশ তাপশক্তি প্রস্বেদনের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। তা না হলে গাছ অধিক তাপে মারা যেত। প্রস্বেদন উদ্ভিদের পাতাকে আর্দ্র করে রাখে। প্রস্বেদনের ফলে কোনো কোনো পাতার উপরিভাগে স্বল্প পরিমাণ জলগ্রাহী লবণ পরিত্যক্ত হয়। এই লবণ বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচুর জল গ্রহণ করে পাতাকে আর্দ্র রাখে।
প্রস্বেদনের অপকারিতা
[সম্পাদনা]প্রস্বেদনের অপকারিতার মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদের ঢলে পড়া। উদ্ভিদে অধিক প্রস্বেদন ঘটলে বা মাটিতে পানির পরিমাণ কমে গেলে উদ্ভিদ কোষে পানিস্বল্পতা দেখা দেয়। অনেক সময় উদ্ভিদ ঢলে পড়ে ও মারা যায়। এছাড়া প্রস্বেদনের মাধ্যমে দেহ থেকে বাষ্পাকারে পানি বের করে দিতে উদ্ভিদের শক্তির অপচয় হয়। এছাড়া আর একটি অপকারিতা হচ্ছে প্রস্বেদনের কারণেই উদ্ভিদকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি মাটি থেকে শোষণ করতে হয়।
প্রস্বেদনের হার
[সম্পাদনা]পত্ররন্ধ্রের খোলা ও বন্ধ হওয়ার উপর নির্ভর করে প্রস্বেদনের হার। এছাড়া প্রস্বেদনের হার পাতার চারপাশের আবহাওয়া, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, বাতাস এবং সূর্যালোকের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। উদ্ভিদ কি পরিমাণ জল হারায় তা নির্ভর করে এর আকার এবং কি পরিমাণ জল মূলের মাধ্যমে শোষণ করা হয় তার উপর।
প্রস্বেদনের হারের উপর বিভিন্ন উপাদানের ভূমিকা নিচের টেবিলে তুলে ধরা হয়েছেঃ
উপাদান | কীভাবে তা প্রস্বেদনে প্রভাব ফেলে |
---|---|
পাতার সংখ্যা | পাতার সংখ্যা বেশি হলে বায়বীয় আদান-প্রদান সহজ হবে। এর ফলে প্রস্বেদনের মাধ্যমে বেরিয়ে যাওয়া জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। |
পত্ররন্ধ্রের সংখ্যা | পত্ররন্ধ্রের সংখ্যা বেশি হলে বায়ুকুঠুরী বেশি হবে, প্রস্বেদনের হারও বাড়বে। |
পাতার আকার | পাতার আকার বড় হলে প্রস্বেদন দ্রুত ঘটবে এবং ছোট হলে প্রস্বেদন ধীর হবে। |
আলোর উপস্থিতি | পত্ররন্ধ্রের সাথে প্রস্বেদনের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ, এবং এই ছোট ছোট বায়ুকুঠুরীর খুলে যায় সালোকসংশ্লেষণের সময়। ফলে সালোকসংশ্লেষণের সময় প্রস্বেদন সম্পন্ন হবে বেশি। |
তাপমাত্রা | তাপমাত্রা বাড়লে প্রস্বেদন ত্বরান্বিত হবে। |
আপেক্ষিক আর্দ্রতা | আবহাওয়া আর্দ্র হলে প্রস্বেদন কম হবে, আর কম আর্দ্র হলে প্রস্বেদন বেশি হবে। |
জল সরবরাহ | জল সরবরাহ কম হওয়ার অর্থ হচ্ছে কম জল প্রস্বেদনের মাধ্যমে ব্যয় হবে। |