মুহাম্মদ আবদুহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মুহাম্মদ আবদুহ
জন্ম১৮৪৮
মৃত্যু১১ জুলাই ১৯০৫(1905-07-11) (বয়স ৫৬)

মুহাম্মদ আবদুহ (আরবী محمد عبده ) (নীল বদ্বীপ অঞ্চল, ১৮৪৯-আলেক্সান্দ্রিয়া, জুলাই ১১, ১৯০৫) একজন মিশরীয় আইনজ্ঞ, ধর্মীয় পণ্ডিত এবং একজন সংস্কারক, যাকে 'ইসলামিক আধুনিকতা'র প্রবর্তক বিবেচনা করা হয়।

জীবনী[সম্পাদনা]

মুহাম্মদ আবদুহ ১৮৪৯ সালে মিশরের উত্তরাঞ্চলের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন তুর্কী এবং মাতা আরব বংশদ্ভূত। তিনি এক গৃহশিক্ষক ও ক্বারীর কাছে শিক্ষালাভ করেন। ১৩ বছর বয়সে তৎকালীন মিশরের অন্যতম বৃহত্তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আহমদি মসজিদে তাকে পাঠানো হয়। কিছুদিন পর তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান এবং বিয়ে করেন। ১৮৬৬ সালে তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।[১] আল-আযহারে তিনি যুক্তি, দর্শনসুফিবাদ নিয়ে পড়াশোনা করেন। আবদুহ ছিলেন দার্শনিকধর্মীয় সংস্কারক জামাল উদ্দিন আফগানির ছাত্র, যিনি ইউরোপীয় উপনিবেশবাদকে রুখতে প্যান ইসলামিজমে বিশ্বাসী ছিলেন।[২] আফগানির অনুপ্রেরণায় আবদুহ সাংবাদিকতা, রাজনীতিঅতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিকতাকে সমন্বয় করেন। তৎকালীন মিশর ও মুসলিম বিশ্বের সমস্যা এবং পাশ্চাত্যের প্রযুক্তিগত অর্জন বিষয়ে আফগানি কর্তৃক আবদুহ শিক্ষাপ্রাপ্ত হন।

১৮৭৭ সালে আবদুহ ডিগ্রি প্রাপ্ত হন এবং আল-আযহারে যুক্তি, ধর্মতত্ত্বনীতিশাস্ত্র বিষয়ে শিক্ষা দেয়া শুরু করেন। ১৮৭৮ সাল তাকে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কলেজ দার আল-উলুমে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। একই সাথে তিনি Khedivial School of Language এর আরবী শিক্ষাদানে নিযুক্ত হন।[১] রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র Al-Waqai al-MiSriyaa তে তিনি সম্পাদক ও প্রধান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। মিশরীয় সমাজের সকল অংশকে পুনর্গঠনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য শিক্ষাকে সবচেয়ে উত্তম মাধ্যমরূপে তিনি বিবেচনা করতেন। শিশুর নৈতিকতাকে শক্তিশালী করার জন্য ধর্মীয় শিক্ষা এবং চিন্তার উৎকর্ষতার জন্য বিজ্ঞান শিক্ষার পক্ষে ছিলেন তিনি। তার লেখায় তিনি দুর্নীতি, কুসংস্কার ও ধনীদের বিলাসী জীবনযাপনের তীব্র সমালোচনা করেন।[১]

উরাবি বিদ্রোহকে সমর্থন করার দায়ে ১৮৮২ সালে তাকে ছয় বছরের জন্য মিশর থেকে বহিষ্কার করা হয়। প্রত্যেক সমাজকে তাদের ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে উপযুক্ত সরকার ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দেয়া উচিত বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।[১] আবদুহ সাত বছর লেবাননে অবস্থান করেন এবং সেখানে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। ১৮৮৪ সালে তিনি ফ্রান্সের প্যারিস যান এবং আফগানির The Firmest Bond ( আল উরয়াহ আল ওয়াতকাহ ) নামক ইসলামী বিপ্লবী ধারার পত্রিকার প্রকাশনায় যুক্ত হন। এই পত্রিকাটি ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবকে প্রাধান্য দিত। তিনি ব্রিটেন যান এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে মিশরসুদান বিষয়ে আলোচনা করেন। ১৮৮৫ সালে তিনি বৈরুতে ফিরে আসেন বিভিন্ন ধর্মীয় মতাবলম্বী পণ্ডিতদের দ্বারা পরিববেষ্টিত হন। সেখানে অবস্থানকালে তিনি ইসলাম, খ্রিষ্টানইহুদী ধর্মের মধ্যে অধিকতর শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্ব স্থাপনে আত্মনিয়োগ করেন।[১]

১৮৮৮ সালে তিনি মিশরে ফিরে আসেন ও আইন পেশায় মনোনিবেশ করেন। তিনি স্থানীয় ট্রাইবুনালের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান এবং ১৮৯০ সালে তিনি আপিল আদালতের সদস্য হন। ১৮৯৯ সালে তিনি মিশরের মুফতি হন এবং আমৃত্যু এই পদে বহাল থাকেন। মিশরে থাকাকালীন সময়ে আবদুহ আরবদের বিজ্ঞানে উন্নয়নের জন্য একটি ধর্মীয় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন ও এর প্রেসিডেন্ট হন। আল-আযহারের পরীক্ষাপদ্ধতি, পাঠক্রম এবং অধ্যাপক ও ছাত্রদের কাজের পরিবেশ উন্নত করার ব্যাপারে প্রস্তাব রাখেন। তিনি অনেক অঞ্চল সফর করেন এবং ক্যামব্রিজঅক্সফোর্ডের পণ্ডিতদের সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি ফরাসি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ভিয়েনাবার্লিনের লাইব্রেরীতে ইউরোপীয় ও আরব রচনা পাঠ করেন। তার সফরের ফলে তিনি এই উপসংহারে আসেন যে মুসলিমরা নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও স্বৈরাচারী শাসকদের একচ্ছত্র ক্ষমতার জন্য নির্যাতিত হচ্ছে।[১]

মুহাম্মদ আবদুহ ১৯০৫ সালের ১১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষ তাদের সমবেদনা জানায়।

চিন্তাধারা[সম্পাদনা]

আমি পাশ্চাত্যে ইসলাম দেখেছি কিন্তু মুসলিম দেখিনি, প্রাচ্যে ফিরে এসে মুসলিম দেখেছি কিন্তু ইসলাম দেখিনি।

মুসলিমদের শুধুমাত্র মধ্যযুগীয় পণ্ডিতদের রচনার ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করা উচিত না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তার মতে মুসলিমদের পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য কার্যকারণকে ব্যবহার করা উচিত। তিনি বলেন যে ইসলামে মানুষকে লাগাম দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরী করা হয়নি বরং মানুষকে বুদ্ধিমত্তা দেয়া হয়েছে যাতে তারা জ্ঞানের মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারে। তার মতে শিক্ষকের ভূমিকা হল মানুষকে শিক্ষার দিকে চালিত করা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ইসলাম মানুষকে তাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্ব থেকে নিজেকে আলাদা করতে উৎসাহ দেয় এবং ইসলাম প্রচলিত প্রথার অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন যে মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং চিন্তা ও মতের স্বাধীনতা প্রদানের দ্বারা আশীর্বাদ করা হয়েছে এবং এই বিষয়গুলো ধর্মের সাথে সম্পর্কিত। এই দুটির মাধ্যমে সে সুখ অর্জন করতে সক্ষম। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ইউরোপের পাশ্চাত্য সভ্যতা এই দুটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।[৩]

তার মুসলিম প্রতিপক্ষরা তাকে ধর্মহীন হিসেবে প্রতিপন্ন করে; যদিও তার অনুসারীরা তাকে একজন জ্ঞানী, ধর্মের পুনর্জাগরণকারী এবং সংস্কারক নেতা হিসেবে সম্বোধন করে। তাকে 'আল-উস্তাদ আল-ইমাম' ও 'আল-শায়েখ আল-মুফতি' উপাধি দ্বারা সম্মানিত করা হয়। তিনি তার রচনায় ঈশ্বর মানবতাকে এর শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত এবং এরপর এর বয়ঃপ্রাপ্তিকালে শিক্ষা দিচ্ছেন এই মত ব্যক্ত করেন। তার মতে ইসলাম হল একমাত্র ধর্ম যার মূলনীতিগুলো কারণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রমাণ করা সম্ভব। আবদুহ ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রত্যাবর্তনের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি বহুবিবাহের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং একে একটি পুরোনো প্রথা হিসেবে দেখতেন। তিনি ইসলামের সেই রূপে বিশ্বাস করতেন যা মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেবে, সকল মানুষের জন্য সমান অধিকার প্রদান করবে, ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যায় ধর্মীয় পণ্ডিতদের একাধিপত্যকে খর্ব করবে এবং জাতিগত বৈষম্য ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাকে নির্মূল করবে।[১]

মুহাম্মদ আবদুহ সুন্নিশিয়াদের মধ্যে সম্প্রীতি উন্নয়নের জন্য অবদান রাখেন। তিনি ইসলামের সকল শাখার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রচার করেন। তবে সুফীবাদ থেকে উতসরিত কুসংস্কারকে তিনি তীব্র সমালোচনা করেন।[৪]

আবদুহ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্ধুত্বের ডাক দেন। যেহেতু খ্রিষ্টান ধর্ম মিশরে দ্বিতীয় বৃহত্তম ছিল তাই তিনি মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে বন্ধুত্ব বৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে নিবেদিত ছিলেন। তার অনেক খ্রিষ্টান বন্ধু ছিল এবং কপ্টিকদের সুরক্ষায় তিনি বহুবার কথা বলেন। উরাবি বিদ্রোহের সময় কিছু মুসলিম দুষ্কৃতকারী ইউরোপীয় উপনিবেশকারীদের প্রতি বিদ্বেষবশত বিভ্রান্তির কারণে কপ্টিকদের উপর আক্রমণ করে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Kügelgen, Anke von. "ʿAbduh, Muḥammad." Encyclopaedia of Islam, THREE. Edited by: Gudrun Krämer, Denis Matringe, John Nawas and Everett Rowson. Brill, 2009. Brill Online. Syracuse University. 23 April 2009 <http://www.brillonline.nl.libezproxy2.syr.edu/subscriber/entry?entry=ei3_COM-0103.>
  2. Kedourie, E. (1997). Afghani and 'Abduh: An Essay on Religious Unbelief and Political Activism in Modern Islam, London: Frank Cass. ISBN 071464355.
  3. Gelvin , J. L. (2008). The Modern Middle East (2nd ed., pp. 161-162). New York: Oxford university Press.
  4. Benzine, Rachid. Les nouveaux penseurs de l'islam, p. 43-44.

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]