বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধিত) আইন, ১৯৭৪

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধিত) আইন, ১৯৭৪ বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পরবর্তী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত প্রথম আইন।[১] ১৯৭৩ সালের ২৭ মার্চ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের আদেশক্রমে "বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আদেশ, ১৯৭৩" জারি করা হয়। আদেশটি প্রেসিডেন্ট আদেশ ২৩ নামে পরিচিত। এটি ১৭ জুলাই প্রথম দফায় সংশোধন করা হয়। প্রেসিডেন্ট আদেশ ২৩ এরপর একই বছর আগস্ট মাসে জাতীয় সংসদে যায়। পরের বছর ১৯৭৪ সালে আদেশটি দ্বিতীয় দফা সংশোধিত হয় এবং বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধিত) আইন, ১৯৭৪ হিসেবে অনুমোদিত হয়।[২] মূল আইনটি ইংরেজি ভাষায় রচিত।

বিবরণ[সম্পাদনা]

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধিত) আইনে মোট ৪৮টি বিধি (Article) এবং ৪৯টি ধারা (Clause) আর বহু উপধারা (Sub-clause) রয়েছে। এসব বিধির বলে বাংলাদেশে বসবাস ছিল বা আছে এমন সব বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আইন অমান্য করলে ৫০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা জরিমানা এবং সর্বোচ্চ ছয় মাস থেকে দুই বছর কারাগারে অবস্থান করার বিধান রাখা হয়েছে।[২] দেশীয় বেশিরভাগ বন্যপ্রাণী ধরা, মারা, শিকার বা আহত করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আইনে এমন বিধান রয়েছে যাতে বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছে করলে যে কোন সরকারি ও বেসরকারী অঞ্চল "বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য" (Wildlife Sanctuary), "জাতীয় উদ্যান" (National Park), "সংরক্ষিত এলাকা" (Game Reserve) এবং "চিত্তবিনোদন উদ্যান" (Recreation Park) হিসেবে ঘোষণা করতে পারে।

বন্যপ্রাণী আইনের আওতায় একটি "বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা পরিষদ" গঠনের জন্য বিধি রয়েছে। এই আইনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল তিনটি তফসিলে বর্ণিত বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর নাম। কোন তফসিলে বর্ণিত কোন প্রাণীকে হত্যা করা যাবে বা যাবে না তার উল্লেখ রয়েছে। এটি বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী সংরক্ষণের জন্য একটি বলিষ্ঠ অধ্যায়।

সংরক্ষণ তফসিল[সম্পাদনা]

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধিত) আইন, ১৯৭৪ এ মোট তিনটি তফসিল রয়েছে। এসব তফসিলে বর্ণিত রয়েছে কোন প্রজাতি শিকারযোগ্য এবং কোনটি শিকারযোগ্য নয়।

প্রথম তফসিল[সম্পাদনা]

প্রথম তফসিলটি মোট দুইটি খণ্ডে বিভক্ত।

প্রথম খণ্ড[সম্পাদনা]
বেয়ারের ভুতিহাঁস, মহাবিপন্ন প্রজাতি হলেও এই আইনে প্রজাতিটিকে লাইসেন্সের মাধ্যমে শিকার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

প্রথম খণ্ডে কিছু কিছু দেশীয় প্রজাতির পাখি, সরীসৃপস্তন্যপায়ী প্রাণীর তালিকা রয়েছে যেগুলো শিকারের যোগ্য। এসব প্রজাতি সাধারণ গেম হান্টিং লাইসেন্সের আওতায় শিকার করা যাবে। এই তফসিলে হাঁসজাতীয় পাখিদের মধ্যে রয়েছে মেটে রাজহাঁস, দাগি রাজহাঁস, পাতি সরালি, চখাচখি, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, পিয়াং হাঁস, লালশির, বেয়ারের ভুঁতিহাস, পাতি ভুতিহাঁস, রাঙ্গামুড়ি সহ আরও অনেক প্রজাতি। বক গোত্রের পাখিদের মধ্যে রয়েছে দেশি কানিবক, গো বকছোট বগা। ডুবুরি গোত্রের মধ্যে ছোট ডুবুরিকালোমাথা কাস্তেচরা গোত্রের মধ্যে ইউরেশীয় চামচঠুঁটি এই খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। আরও রয়েছে কয়েক প্রজাতির চাপাখি, বাটান ও চ্যাগা এই খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে খেঁকশিয়াল, কালোগ্রীব খরগোশ (Lepus nigricollis), মাউস হেয়ার (Ochotona roylei) এবং বন্য শূকরও

তফসিলে বর্ণিত বন্যপ্রাণীর ইংরেজি ও বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে। কোন কোন প্রজাতির প্রচলিত বাংলা নাম বর্ণিত হয়েছে। কোথাও পরিবার বা বর্গের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এসব নামের বানানে অসংখ্য ভুল রয়েছে। এসব নাম সংযোজন করার ক্ষেত্রে কোন শ্রেণিবিন্যাস নীতিও অনুসরণ করা হয় নি। উপরন্তু এমন কিছু প্রজাতির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যাদের বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। মাউস হেয়ার (Ochotona roylei) কোন কালেই বাংলাদেশের সীমানায় ছিল না, তবুও তফসিলে প্রাণীটি অন্তর্ভুক্ত।[৩] এছাড়া কিছু কিছু প্রজাতিকে লাইসেন্সের মাধ্যমে শিকার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে যারা প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন কর্তৃক মহাবিপন্ন বলে ঘোষিত হয়েছে, যেমন- বেয়ারের ভুঁতিহাস

দ্বিতীয় খণ্ড[সম্পাদনা]

এই খণ্ডে বিশেষ কোন প্রাণীর নাম উল্লেখ না করে বাংলাদেশের সেই সব প্রাণীর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ হয়েছে যাদের মারার জন্য বিশেষ পরিস্থিতি ও অনুমতি লাগবে। যদি দেখা যায় যে কোন একটি প্রজাতির সংখ্যা কোন একটি অঞ্চলে এমনভাবে বেড়ে গেছে যে তা ঐ অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় অথবা জনজীবনের উপর হুমকি হয়ে দাঁড়ায় (যেমন মানুষখেকো বাঘ, পাগলা হাতি ইত্যাদি) তখন প্রধান বন্যপ্রাণী সংরক্ষক (চিফ ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন) সেসব প্রাণী শিকারের জন্য অনুমতি দেবেন। তিনি আরও বলে দেবেন কোন মৌসুমে ও কোন এলাকায় ঐসব প্রাণী শিকার করা যাবে।[৩]

দ্বিতীয় তফসিল[সম্পাদনা]

এই তফসিলটিতেও কোন সুনির্দিষ্ট তালিকা রাখা হয় নি। এতে আছে সেই সব প্রাণীর নাম ও বৈশিষ্ট্য যাদের বহন করা, অধীনে রাখা বা আমদানি করার জন্য আইনানুগ অনুমতিপত্র বা রসিদ থাকতে হবে। তাদের ট্রফি এবং মাংসের ক্ষেত্রেও একই আইন প্রযোজ্য হবে। তফসিলে চারটি বিষয়ে নজর রাখা হয়েছে:

  1. যে কোন জীবন্ত সংরক্ষিত প্রাণী বা গেম এনিম্যাল।
  2. সংরক্ষিত প্রাণী থেকে উদ্ভূত তাদের ট্রফি বা মাংস।
  3. হরিণ, সম্বর হরিণ, বাইসন, গয়াল, গৌর এবং হাতির শিং ও গজদন্ত
  4. ভাল্লুক, ভোঁদড়, বাঘ, চিতাবাঘ, বন বিড়াল, গুই সাপ, হরিণ, সম্বর হরিণ, বনরুই, কুমির এবং অজগরের চামড়া।

তৃতীয় তফসিল[সম্পাদনা]

এই তফসিলে ২২ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪৮৭ প্রজাতির পাখি এবং ৬৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর নাম সংযোজিত রয়েছে। এসব প্রজাতিকে "সংরক্ষিত প্রাণী" হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এসব প্রাণী শিকার করা, মারা বা ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়া তফসিলে আরও বলা হয়েছে:

  1. বিষধর সাপ, ইঁদুর, ফলাহারী বাদুড়, চামচিকা প্রভৃতি প্রাণী, অর্থাৎ যেগুলো মানুষের জীবনে হুমকিস্বরূপ, সেগুলো বাদে সকল অপ্রাপ্তবয়স্ক সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী শিকার করা, মারা বা ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
  2. সকল স্ত্রী সংরক্ষিত প্রাণী (ক) গর্ভবতী অবস্থায়, (খ) বাচ্চাকে দুধ পান বা খাবার পরিবেশনরত অবস্থায়, অথবা (গ) বাচ্চাসহ অবস্থায় শিকার করা, মারা বা ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
  3. মানুষখেকো বাঘিনী ও পাগলা হস্তিনী প্রথম তফসিলের দ্বিতীয় খণ্ডের সকল প্রাণী তৃতীয় তফসিলের অন্তর্ভুক্ত।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Acts, Regulations and Conventions relating to wildlife ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৪ জুন ২০১২ তারিখে, Wildlife, Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh.
  2. বন ও বন্য প্রাণী রক্ষায় কঠোর হচ্ছে আইন[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], বিপ্লব রহমান, দৈনিক কালের কণ্ঠ।
  3. ডাঃ মোঃ আলী রেজা খান, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী: তৃতীয় খণ্ড (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৮৭), পৃ. ১০৯।

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]