খারুয়া মেলা
| খারুয়া মেলা ছোট সন্ন্যাসী মেলা, খাউড়া মেলা | |
|---|---|
| অবস্থা | প্রতিবছর একবার বসে |
| ঘটনাস্থল | খারুয়া দহ |
| অবস্থান (সমূহ) | খারুয়া দহ, জালশুকা, শাজাহানপুর উপজেলা, বগুড়া জেলা |
| দেশ | |
| প্রবর্তিত | ১৮শ শতাব্দীতে |
| অতি সাম্প্রতিক | ২০২৪ |
| উপস্থিতি | ±১০০,০০০ (আনুমানিক) |
খারুয়া মেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি প্রাচীন লোকজ মেলা। বগুড়া শহর হতে ১৩ কিলোমিটার পূর্বদিকে খারুয়া দহ নামক স্থানে প্রতি বছর যে মেলা বসে তাই খারুয়া মেলা নামে পরিচিত। একে ছোট সন্ন্যাসী মেলা বলেও ডাকা হয়।[১] বাংলাদেশে গ্রামীণ মেলাসেমূহের মধ্যে বগুড়ার খারুয়া মেলা অন্যতম। মেলাটি প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়।[১]
মেলার ইতিহাস
[সম্পাদনা]একাধিক সূত্র হতে জানা যায়, প্রায় চার শত বছর পূর্বে পোড়াদহ সংলগ্ন মরা বাঙালী (মতান্তরে মহিষাবান নদী) নদীতে প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবারে অলৌকিকভাবে বড় একটি কাতলা মাছ (মতান্তরে অজ্ঞাত মাছ) সোনার চালুনি পিঠে নিয়ে ভেসে উঠত। মাঘের শেষ বুধবারের এ অলৌকিক ঘটনা দেখার জন্য প্রচুর লোকজন জড়ো হত। পরে স্থানীয় একজন সন্ন্যাসী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে অলৌকিক এ মাছের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদনের জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। সন্ন্যাসীর আহবানে সাড়া দিয়ে পোড়াদহ বটতলায় মাঘের শেষ বুধবারে অলৌকিক মাছের উদ্দেশ্যে স্থানীয় লোকজন অর্ঘ্য নিবেদন শুরু করেন। কালক্রমে এটি সন্ন্যাসী পূজা নাম পরিগ্রহ করে। পূজা উপলক্ষে লোক সমাগম বাড়তে থাকে ও বৃহদাকৃতির মাছ ক্রয়-বিক্রয়ের প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। তো এই জালশুকার হিন্দুরাও ঐ সন্ন্যাসী পুজোয় অর্ঘ্য নিবেদন করতে যেতো এবং উক্ত সন্ন্যাসী যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তাকে ঐ খানে তাকে পুড়িয়ে ফেলা হয় । কিন্তু সন্ন্যাসীর পোড়া দেহের কিছু অংশ জালশুকার চর ও বালুপাড়া চরের মোহনায় ভেসে উঠলে এখানকার হিন্দুরা তা দেখে এবং মনে করে সন্ন্যাসীর পুনরাগমণ ঘটেছে বা পুনজীর্বিত হয়েছে। পুনজীর্বিত এই সন্ন্যাসীকে তারা ছোট সন্ন্যাসী হিসাবে আখ্যায়িত করে । তাই, তার সম্মানে ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার পুজোর আয়োজন করে এবং এই পুজো উপলক্ষে মেলার আয়োজন করে। যা ছোট সন্ন্যাসী মেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ।[২]
নামকরণের ইতিহাস
[সম্পাদনা]যেখানে ছোট সন্ন্যাসী পুজো অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে খারুয়াজান নামে এক পাগলির অকস্মাৎ আগমন ঘটে এবং ঐ পাগলি পুজোর স্থানে বটগাছের নিচে ছোট একটি ঘরে বসত করতে শুরু করে,পাগলির সন্ন্যাসীভক্ত এমন আচরণে স্থানীয় হিন্দুরা তার প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁকে ধর্মগুরু বা ধর্মযাজক হিসেবে মানতে শুরু করে। এই খারুয়াজান পাগলি মারা যাবার পর তৎকালিন হিন্দুরা উক্ত পুজোর স্থানকে খারুয়াজানের তীর্থস্থান হিসেবে আখ্যায়িত করে। যা ঐ সময়েই ব্যাপকভাবে আলোড়িত হয় এবং জালশুকা চরের অববাহিকায় যে নদী প্রবাহমান সেটা খারুয়া নদী হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে এই খারুয়াজানের সম্মানে উক্ত ছোট সন্ন্যাসীর মেলাকে তৎকালিন হিন্দুরা খারুয়া মেলা হিসেবে উৎস্বর্গ করে। যা আজ অবধি খারুয়া মেলা নামে পরিচিত।[২]
মেলার সময়কাল
[সম্পাদনা]প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার শাজাহানপুরের জালশুকা গ্রামের খারুয়া দহে অনুষ্ঠিত এ মেলা। মেলাটি এ এলাকার প্রায় ৩শ’ বছরের ঐতিহ্য।[৩]
মেলার দিন দূর-দূরান্তের মানুষ মেলায় আসে। তবে একদিনের মেলা হলেও স্থানীয়ভাবে সপ্তাহব্যাপী উৎসব লেগে থাকে। মেলা উপলক্ষে প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরা এসে জড়ো হয়। চারিদিকে উৎসব মুখর অবস্থা বিরাজ করে। মেলায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের ব্যাপক সমাগম আর শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে উপজেলার জালশুকা, চান্দাই, নারিল্যা, খোট্টাপাড়া, বলদিপালান, চাঁচাইতারাসহ আশ পাশের এলাকা।[৩] মূল মেলার পরদিন বৃহস্পতিবার একই স্থানে এবং আশেপাশের গ্রামে গ্রামে চলে ছোট আকারের বউ মেলা। বউ মেলার একটি বিশেষত্ব হলো এখানে বিবাহিত (নিজ নিজ স্বামীর সঙ্গে) এবং অবিবাহিত নারীরা প্রবেশ করতে এবং কেনাকাটা করতে পারেন।
মেলার স্থান
[সম্পাদনা]বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার জালশুকা গ্রামের খারুয়া দহে মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
যাতায়াত
[সম্পাদনা]বগুড়া বনানী বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি সিএনজি অটোরিকশা করে মেলায় যাওয়া যায়।
মাছ-মাংস
[সম্পাদনা]- মাছ: খাউড়া মেলার প্রধান আকর্ষণ মাছ। মেলায় পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রজাতির বড় মাছ। মাছগুলো প্রথমে ভোর বেলায় মেলায় স্থাপিত অস্থায়ী আড়ৎগুলোতে এসে জমা হয়। সেখান থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা মাছগুলো কিনে মেলার নিজ নিজ দোকানে নিয়ে যায়। দোকানগুলোতে দিনভর কেনাকাটা চলতে থাকে। মেলায় আসা বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রুই, কাতলা, মৃগেল, বোয়াল, সিলভার কার্প, কালবাউশ, পাঙ্গাস মাছ ইত্যাদি। মেলায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় 'বাঘা আইড়' মাছ স্থানীয় ভাবে যাকে 'বাগাইড়' মাছ বলা হয়। মেলায় দুই মণ থেকে আড়াই মণ ওজনের বাঘা আইড় পাওয়া যায়। তবে, সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে 'মহাবিপন্ন' প্রজাতি হিসেবে ঘোষিত 'বাঘা আইড়' মাছের কেনাবেচা মেলায় বন্ধ রয়েছে। তবুও কখন-কখন মেলায় বাঘাইর মাছ উঠতে দেখা যায়। এছাড়া পনের থেকে বিশ কেজি ওজনের রুই, কাতলা, পাঙ্গাস মাছ পাওয়া যায়।[৪]
- মাংস: মেলা উপলক্ষ্যে বিক্রি উদ্দেশ্যে অনেকগুলো গরু, মহিষ, ছাগল জবাই করা হয়। পাশাপাশি মুরগিও বিক্রি করা হয়।
আসবাবপত্র
[সম্পাদনা]মেলায় কাঠের, স্টিল ও লোহার বিভিন্ন ডিজাইনের আসববাপত্র যেগুলো অনেক সূলভ মূল্যে পাওয়া যায়।[৫]
কসমেটিক ও খেলনা সামগ্রী
[সম্পাদনা]মেলায় বিভন্ন জেলা হতে আসা লোকজন উন্নতমানের কসমেটিকস, খেলনা, গিফট সামগ্রী-এর দোকান দেন। সাধারণত শিশু এবং মহিলাদের ভিড় লেগে থাকে। আছে চুড়ি, কানের দুল, মালা, কাজল, মেকাপ বক্স-সহ সকল সাজার জিনিস।[৬] খেলনার মধ্যে থাকে ব্যাট, বল ইত্যাদি। এছাড়াও কাঠের তৈরি ঘোড়ার গাড়ি, টমটম, গ্যাস বেলুন ইত্যাদি পাওয়া যায়।
মিষ্টি
[সম্পাদনা]খাউড়া মেলার অন্যতম আকর্ষণ মিষ্টি। রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলাপী, নিমকি, তিলের নাড়ু, খই, শুকনো মিষ্টি, মণ্ডা, বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী দই। আরও আকর্ষণীয় হল বড় বড় আকারের মিষ্টি। একেকটি মিষ্টি দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের হয়ে থাকে।[৭]
খাবারের দোকান
[সম্পাদনা]মেলায় লোকজনের খাওয়া দাওয়ার জন্য বসানো হয় অস্থায়ী হোটেল, আছে ফুচকা-চটপটি, ভাজা-পোড়া ও আইসক্রিমের দোকান। এছাড়াও মেলায় নানা প্রকার বড়ই পাওয়া যায়।
বিবিধ
[সম্পাদনা]মেলা উপলক্ষ্যে দৈনন্দিন জিনিসের বাজার বসে। মাংস, কাঁচাবাজার, মসলা, গৃহস্থালীর দৈনন্দিন জিনিস পত্র যেমন- ছুরি, দা, বটি এগুলোও পাওয়া যায়।
বিনোদন
[সম্পাদনা]মেলায় কেনাকাটার পাশাপাশি বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। ছোটোদের জন্য নাগড়দোলা, ঘোড়ার গাড়ি, সার্কাস ইত্যাদি ও বড়দের জন্য রয়েছে মোটরসাইকেল খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- 1 2 "বগুড়ায় ৩০০ বছরের পুরনো সন্ন্যাসী মেলা ঘিরে উৎসব"। Protidiner Bangladesh। সংগ্রহের তারিখ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫।
- 1 2 সরোয়ার, রুহুল (৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। "খারুয়া মেলার ইতিহাস"। খারুয়া মেলা আয়োজক কমিটি। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগষ্ট ২০২৪।
{{ওয়েব উদ্ধৃতি}}:|সংগ্রহের-তারিখ=এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: ইউআরএল-অবস্থা (লিঙ্ক) - 1 2 শাজাহানপুর, বগুড়া, প্রতিনিধি (১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। "বগুড়ার শাজাহানপুরে হয়ে গেলো ঐতিহ্যবাহী খাউড়া মেলা"। পুন্ড্রকথা। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগষ্ট ২০২৪।
{{সংবাদ উদ্ধৃতি}}:|সংগ্রহের-তারিখ=এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য) - ↑ নাজির, মোঃ নাজমুল হাসান (২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। "বগুড়ায় ঐতিহ্যবাহী খাউড়ার মেলা!"। দৈনিক আমাদের দর্পণ। ২২ আগস্ট ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগষ্ট ২০২৪।
{{সংবাদ উদ্ধৃতি}}:|সংগ্রহের-তারিখ=এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য) - ↑ শাজাহানপুর, বগুড়া, প্রতিনিধি (২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। "শাজাহানপুরের ঐতিহ্যবাহী খাউড়া মেলা বুধবার"। দৈনিক করতোয়া। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগষ্ট ২০২৪।
{{সংবাদ উদ্ধৃতি}}:|সংগ্রহের-তারিখ=এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য) - ↑ "বগুড়ায় ৩০০ বছরের পুরনো সন্ন্যাসী মেলা ঘিরে উৎসব"। প্রতিদিনের বাংলাদেশ। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগষ্ট ২০২৪।
{{সংবাদ উদ্ধৃতি}}:|সংগ্রহের-তারিখ=এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য) - ↑ ওমর, সাবিক (২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২)। "৩০০ বছরের "খারুয়া দহের খাউড়া মেলা""। ডিজিটাল বাংলা নিউজ। ২২ আগস্ট ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগষ্ট ২০২৪।
{{সংবাদ উদ্ধৃতি}}:|সংগ্রহের-তারিখ=এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)