ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে তোলা ছবিতে হারিকেন ইসাবেল (২০০৩)

ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় হল একটি দ্রুত ঘূর্ণমান ঝড় যাতে থাকে একটি নিম্নচাপ কেন্দ্র, নিকটবর্তী নিম্ন-স্তরের দ্রুতবেগে প্রদক্ষিণরত বায়ু, ঝড়ো বাতাস, সর্পিল বিন্যাসের বজ্রঝড় যা প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। অবস্থান এবং শক্তির ভিত্তিতে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়কে বিভিন্ন নামে উল্লেখ করা হয়। নামগুলোর মধ্যে রয়েছে হারিকেন (/ˈhʌrɪkən, -kn/),[১][২] টাইফুন (/tˈfn/), গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়, সাইক্লোনিক ঝড়, সাইক্লোন ইত্যাদি।

হারিকেন হল আটলান্টিক মহাসাগর এবং উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়। অন্যদিকে টাইফুন হল উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর বা ভারত মহাসাগরে এই ঝড়গুলোকে কেবল ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় বা তীব্র সাইক্লোনিক ঝড় হিসাবে উল্লেখ করা হয়।[৩]

ক্রান্তীয় শব্দটি এই ঝড়গুলোর ভৌগোলিক উৎপত্তিস্থল নির্দেশ করে যা হল সাধারণভাবে ক্রান্তীয় [en] সমুদ্র। "সাইক্লোন" শব্দটি ঝড়ের বাতাসের বৃত্তাকার ঘূর্ণন বুঝায়।[৪] ঘূর্ণিঝড়ে বাতাস উত্তর গোলার্ধের ক্ষেত্রে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধের ক্ষেত্রে ঘড়ির কাঁটার দিকে কেন্দ্রীয় চোখের চারপাশে ঘুরতে থাকে। বিপরীত ঘূর্ণন কোরিওলিস প্রভাবের কারণে হয়। ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলি সাধারণত অপেক্ষাকৃত উষ্ণ জলের সাগরে গঠিত হয়। এগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পানির বাষ্পীভবনের মাধ্যমে শক্তি অর্জন করে, যা ঘণীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হয় এবং বৃষ্টিপাত ঘটায় যখন আর্দ্র বাতাস শীতল হয়ে সম্পৃক্ত হয়। এই শক্তির উৎসটি মধ্য অক্ষাংশের ঘূর্ণিঝড়গুলোর [en] থেকে ভিন্ন যেগুলো প্রাথমিকভাবে আনুভূমিক তাপমাত্রা বৈষম্য দ্বারা চালিত হয়। ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলির ব্যাস সাধারণত ১০০ এবং ২,০০০ কিমি (৬২ এবং ১,২৪৩ মা) এর মধ্যে হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের দ্রুত ঘূর্ণায়মান বাতাস কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণশীলতার ফলাফল। ঝড়গুলোর নিরক্ষরেখার ৫° এর মধ্যে তৈরি হওয়ার ঘটনা দূর্লভ।[৫] শক্তিশালী উইন্ড শিয়ার [en] এবং দুর্বল ইন্টারট্রপিক্যাল কনভারজেন্স জোনের [en] কারণে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলো দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে প্রায় অপরিচিত।[৬] এছাড়াও আফ্রিকান পূর্বদিকস্থ জেট [en] এবং বায়ুমন্ডলীয় অস্থিতিশীল অঞ্চলসমূহ যা আটলান্টিক মহাসাগর ও ক্যারিবিয়ান সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম দেয়, সাথে এশিয়ার মৌসুমী বায়ু, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় ওয়ার্ম পুল উত্তর গোলার্ধ এবং অস্ট্রেলিয়ার বৈশিষ্ট্য।

উপকূলীয় অঞ্চল দ্বীপ অঞ্চলের তুলনায় ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই ঝড়গুলোর প্রাথমিক শক্তিউৎস হল উষ্ণ মহাসাগরের পানি, সে কারণে সাগরের উপরে বা নিকটে এগুলো সাধারণত শক্তিশালী হয় এবং ভূমির উপরে কিছুটা দ্রুত দুর্বল হতে থাকে। উপকূলীয় অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি প্রবল বাতাস, বৃষ্টিপাত, উঁচু ঢেউয়ের কারণে হতে পারে। ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় একটি বড় অঞ্চল থেকে বাতাস টেনে নেয় — যা অত্যন্ত বৃহৎ অঞ্চল হতে পারে অধিকাংশ প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে — এবং সেই বাতাসে থাকা জলীয় অংশকে (বায়ুমণ্ডলীয় আর্দ্রতা ও বাষ্পীভবন থেকে সৃষ্ট আর্দ্রতা) একটি ছোট অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত করে। নতুন আর্দ্র বাতাস কর্তৃক আর্দ্র বাতাসের এই পুনঃপ্রতিস্থাপন উপকূলের ৪০ কিলোমিটার (২৫ মা) এর মধ্যে অতি ভারী বৃষ্টিপাত এবং বন্যা ঘটাতে পারে।

মানব জনগোষ্ঠীতে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের ফলাফল বিধ্বংসী হলেও, এগুলো খরা পরিস্থিতি লাঘব করে। এছাড়াও এগুলো ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে তাপশক্তি বহন করে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে নিয়ে যেতে পারে, যা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক জলবায়ুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

গঠন[সম্পাদনা]

উত্তর গোলার্ধের হারিকেনের গঠন বিষয়ক রেখাচিত্র

ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় হল আপেক্ষিকভাবে ট্রপোস্ফিয়ারের নিম্ন চাপ অঞ্চল, সাথে ভূপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতায় ঘটা সবচেয়ে বড় চাপজনিত বিশৃঙ্খলা। পৃথিবীতে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের চাপ সমুদ্র সমতলে এ পর্যন্ত পরিমাপ করা চাপের মধ্যে সর্বনিম্ন।[৭] ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের কাছের পরিবেশ সব উচ্চতায় আশেপাশের পরিবেশের চেয়ে উষ্ণতর, তাই তারা "উষ্ণ কেন্দ্র" ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত।[৮]

বায়ু ক্ষেত্র[সম্পাদনা]

ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুক্ষেত্র ঘূর্ণন কেন্দ্রের চারপাশে দ্রুত ঘূর্ণায়মান বায়ু ও একই সময়ে অরীয় অন্তর্মুখী প্রবাহ দ্বারা চিহ্নিত। ঝড়ের বহিঃপ্রান্তে বাতাস অনেকটা শান্ত থাকতে পারে, অবশ্য পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে বাতাস অশূন্য পরম কৌণিক ভরবেগ [en] সম্পন্ন হবে। যেহেতু বাতাস অরীয়ভাবে ভিতরের দিকে প্রবাহিত হয়, এটা কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণের জন্য ঘুরতে শুরু করে। একটি অভ্যন্তরীণ বৃত্তাকার অংশে বাতাস ট্রপোস্ফিয়ারের শীর্ষে উঠতে থাকে। এই বৃত্তাকার অংশ সাধারণত চোখপ্রাচীরের [en] অভ্যন্তরীণ বৃত্তাকার অংশের সমস্থানিক এবং এতে ঝড়ের সবচেয়ে জোরালো ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বাতাস রয়েছে, ফলস্বরূপ, এটি সর্বোচ্চ বায়ু ব্যাসার্ধ [en] হিসেবে পরিচিত।[৯] একবার শীর্ষে উঠলে বাতাস ঝড়ের কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যায় এবং সিরাস মেঘের [en] ঢাল তৈরি করে।[১০]

পূর্বে উল্লেখ করা প্রক্রিয়াগুলো বায়ু ক্ষেত্র তৈরি করে যা প্রায় অক্ষীয় প্রতিসম: কেন্দ্রে বাতাসের বেগ নিম্ন, বাইরে "সর্বোচ্চ বায়ু ব্যাসার্ধ"-এ বেগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এরপর ক্রমাগত কমতে থাকে। অবশ্য বায়ু ক্ষেত্র কখনো কখনো স্থানীয় প্রক্রিয়াগুলো যেমন - বজ্রঝড়, আনুভূমিক প্রবাহ স্থিতিহীনতা ইত্যাদির কারণে সময়গত পরিবর্তনশীলতা প্রদর্শন করে। উলম্ব দিকে বায়ু ভূ-পৃষ্ঠের কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ট্রপোস্ফিয়ারে উচ্চতা বরাবর বেগ কমে যায়।[১১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Hurricane – Definition and More from the Free Merriam-Webster Dictionary"। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ১, ২০১৪ 
  2. "Definition of "hurricane" – Collins English Dictionary"। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ১, ২০১৪ 
  3. "What is the difference between a hurricane, a cyclone, and a typhoon?"OCEAN FACTSNational Ocean Service। সংগ্রহের তারিখ ডিসেম্বর ২৪, ২০১৬ 
  4. "Oxford English Dictionary"OED Online। Oxford University Press। ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৭a general term for all storms or atmospheric disturbances in which the wind has a circular or whirling course. 
  5. Henderson-Sellers, A.; Zhang, H.; Berz, G.; Emanuel, K.; Gray, W.; Landsea, C.; Holland, G.; Lighthill, J.; Shieh, S.L.; Webster, P.; McGuffie, K. (১৯৯৮)। "Tropical Cyclones and Global Climate Change: A Post-IPCC Assessment"। Bulletin of the American Meteorological Society79 (1): 19–38। ডিওআই:10.1175/1520-0477(1998)079<0019:TCAGCC>2.0.CO;2বিবকোড:1998BAMS...79...19H 
  6. Landsea, Chris (১৩ জুলাই ২০০৫)। "Why doesn't the South Atlantic Ocean experience tropical cyclones?"Atlantic Oceanographic and Meteorlogical Laboratory। National Oceanographic and Atmospheric Administration। সংগ্রহের তারিখ ৯ জুন ২০১৮ 
  7. Symonds, Steve (নভেম্বর ১৭, ২০০৩)। "Highs and Lows"Wild WeatherAustralian Broadcasting Corporation। অক্টোবর ১১, ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ২৩, ২০০৭ 
  8. Atlantic Oceanographic and Meteorological Laboratory; Hurricane Research Division। "Frequently Asked Questions: What is an extra-tropical cyclone?"National Oceanic and Atmospheric Administration। ফেব্রুয়ারি ৯, ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ২৩, ২০০৭ 
  9. National Hurricane Center (২০১৬)। "Glossary of NHC/TPC Terms"। United States National Oceanic and Atmospheric Administration। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ৩০, ২০১৬ 
  10. Marine Meteorology Division। "Cirrus Cloud Detection" (পিডিএফ)Satellite Product Tutorials। Monterey, CA: United States Naval Research Laboratory। পৃষ্ঠা 1। এপ্রিল ৩, ২০১৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুন ৪, ২০১৩ 
  11. Frank, W.M. (১৯৭৭)। "The structure and energetics of the tropical cyclone I. Storm structure"। Monthly Weather Review105 (9): 1119–1135। ডিওআই:10.1175/1520-0493(1977)105<1119:TSAEOT>2.0.CO;2বিবকোড:1977MWRv..105.1119F 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]