বৃহত্তর বাংলাদেশ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বৃহত্তর বাংলাদেশ[১] বা বৃহত্তর বঙ্গ[২] বা মহাবাংলাদেশ[৩] বা বিশাল বাংলা[৪] হল একটি তত্ত্ব যা দাবী করে যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে একটি বৃহত্তর ঐতিহাসিক অবিভক্ত বাংলা গঠন করার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে যা পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, নাগাল্যান্ডমিজোরাম, সেইসাথে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জমিয়ানমারের চিন রাজ্য, রাখাইন রাজ্য (প্রাক্তন আরাকান) পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের নিজস্ব ভূখণ্ডের অংশ নিয়ে গঠিত হবে।[৫]

পটভূমি[সম্পাদনা]

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়ে গঠিত বাংলা এবং পূর্ব বাংলা ও আসাম নামক দুইটি প্রদেশ

বাংলার ভূরাজনৈতিক অঞ্চল সর্বপ্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের অধীনে একীভূত হয় যিনি বর্তমান বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, দক্ষিণ আসামের অংশবিশেষ এবং মধ্য ও পূর্ব বিহার দখল করে বাংলার ভূ-রাজনৈতিক এলাকাসমূহকে একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে একত্রিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে বাঙালি বৌদ্ধ পাল শাসকগণ এই অঞ্চলগুলোকে একত্রিত করে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন যাদের ক্ষমতা এই অঞ্চল জুড়েই কেন্দ্রীভূত ছিল, তবে পালদের সাম্রাজ্য কাশ্মীরি পাহাড় থেকে বর্তমান অন্ধ্র প্রদেশ পর্যন্তও বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এর পরে বাংলায় হিন্দু সেন রাজবংশের সময়ে ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় এবং বাংলা যেখানে বিহারঝাড়খণ্ডও যুক্ত ছিল (যদিও এখন অ-বাংলা রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়) - এই সকল অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করে অবিভক্ত বাংলার ধারণা প্রথম উন্মোচিত হয়।[৬] সেন রাজবংশের পতনের পর এই অঞ্চলটি ইসলামী সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং ইসলামের পূর্বাঞ্চলীয় বিস্তারের একটি অভিক্ষিপ্ত অঞ্চল হয়ে ওঠে। অঞ্চলটি অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়। রাজমহলের যুদ্ধের পর বাংলা সালতানাত মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায় এবং মুঘল সাম্রাজ্যের যুবরাজগণ (ক্রাউন প্রিন্স) এই অঞ্চলের রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত হতেন।

উত্তর ভারতের মারাঠা বিদ্রোহের পর বাংলা প্রদশ স্বাধীন হয়ে যায় এবং বাংলার নবাবদের দ্বারাই বাংলা অঞ্চল শাসিত হত। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পর এই অঞ্চলটি ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনিক অঞ্চলে পরিণত হয়, এবং বাংলার রাজধানী কলকাতা হয় ভারতের রাজধানী। ১৭৬৫ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গঠিত হয়। ১৯০৫ সালে এই প্রেসিডেন্সি দ্বিখণ্ডিত হয়ে বাংলা প্রদেশ এবং পূর্ববঙ্গ ও আসাম রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়। ১৯১১ সালে বাংলা একীভূত হয়। আসাম মেঘালয়া ও সিলেট নিয়ে ১৮৭৪ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৯১২ সালে আসাম লুসাই পাহাড় অঞ্চল নিয়ে আসাম প্রদেশে পরিণত হয়। চাঞ্চল্যকর ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পর ১৯১২ সালে বাংলা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এই নতুন প্রদেশগুলো ছিল বিহার ও উড়িশ্যা, পূর্ববঙ্গ ও আসাম ও বঙ্গ, যদিও পরবর্তিতে ১৯১২ সালে বঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গ একীভূত হয়ে একটি ক্ষুদ্র অবিভক্ত বাংলা গঠন করেছিল। এই প্রদেশটি ১৯৪৭ সালে আবার বিভক্ত হয়ে হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গ ও মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) গঠন করেছিল আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান তৈরির জন্য, যেখানে পূর্ববঙ্গ একটি প্রদেশ ছিল।[৭]

অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা[সম্পাদনা]

১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে, শরৎ চন্দ্র বসু আংশিকভাবে বাংলা ভাগের প্রতিবাদ হিসেবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্র থেকে স্বাধীন বাংলার জন্য আহ্বান করেন, এবং একটি নিজস্ব রাজনৈতিক দল তৈরি করেন যার নাম ছিল সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টি[৮][৯] এই সময়ে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি এবং আবুল হাসেম, মুসলিম লীগের দুই বাঙ্গালী নেতাও একটি স্বাধীন বাংলার পক্ষে আসেন যা পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিমবঙ্গ (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ) উভয় অঞ্চল নিয়েই গঠিত হবে।[৮][১০]

অন্যদিকে মুসলিম লীগের অন্য দুই নেতা মোহাম্মদ আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন যুক্ত বঙ্গকে পাকিস্তানের একটি অংশ হিসেবে চাইতেন। অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা এবং ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা (যা পরবর্তীকালে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি-তে রূপান্তরিত হয়) শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি স্বাধীন বাংলা বা যুক্ত বঙ্গের ধারণার বিরোধিতা করেন।[৮] হিন্দু মহাসভা এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখারজি শরৎচন্দ্র বসু ও সোহরাওয়ার্দির সার্বভৌম বাংলা এর আলোচনার বিষয় উদ্বিগ্ন ছিলেন, যেখানে যুক্তবঙ্গকে ভারতের অংশ হিসেবে দেখার বিরোধিতা করা হয়। কংগ্রেসের সর্ববৃহৎ ভগ্নাংশের নেতা জহরলাল নেহেরু যুক্তবঙ্গের বিরোধিতা করেন যদিনা এটি ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হয়।[১১]

অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল সমূহ[সম্পাদনা]

ক্রমিক নং দেশ/রাজ্যের নাম আয়তন (ব. কি.মি.) জনসংখ্যা (কোটি) মুসলিম হার (%) হিন্দু হার (%) রাজধানী
বাংলাদেশ ১৪৭,৬৬৮ ১৮ ৯০.৪০% ৮.৫০% ঢাকা
পশ্চিমবঙ্গ ৮৮,৭৯৭ ৯.১৩ ২৭.২% ৭০.৫৪% কলকাতা
আসাম ৭৮,৪৩৮ ৩.২৩ ৩৪.২২% ৬১.৪৭% গুয়াহাটি
ঝাড়খণ্ড (৪ টি বাংলা ভাষাভাষী জেলা - ধানবাদ, সরাইকেলা, পূর্ব সিংভুমপশ্চিম সিংভূম) ১৩,৬৮৩ .৭৫ ১৪.৫০% ৬৭.৮০% চাইবাসা
পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৩ ; ২৯৪. ৮৯
সিকিম ৭,০৯৬ .০৬ ১.৪০% ৫৭.৮০% গ্যাংটক
ত্রিপুরা ১০,৪৯২ .৩৭ ৮.৬০% ৮৩.৪০% আগরতলা
রাখাইন রাজ্য ৩৬,৭৭৮ .৬০ ( রোহিঙ্গা সহ ) ৫৮% ০.৫০% সিত্বে
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ৬,৪০৮ .০৪ ৮.৫১% ৬৯.৪৪% পোর্ট ব্লেয়ার
মোট ৩,৮৯,৩৬০ ৩২.১৮

ভাষাতাত্ত্বিক ও জাতিগত যৌক্তিকতা[সম্পাদনা]

প্রধান ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ

বাংলা, বিহারী, ওড়িয়া ও আসামীয় ভাষাকে ইন্দো-আর্য ভাষার পূর্বাঞ্চলীয় শাখার মাঝে গণ্য করা হয়, যা মাগধী প্রাকৃত (বা মতান্তরে গৌড়ী প্রাকৃত) থেকে উদ্ভূত। মাগধী প্রাকৃতকে মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষার অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়, এবং সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত ভাষায় বিবর্তনের এই পর্ব অন্ততঃ ৬০০ খ্রী.পূ. থেকে শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। অপরপক্ষে বর্তমান হিন্দি/উর্দুর আবির্ভাব হয় শৌরসেনী প্রাকৃত হতে ও মারাঠি ভাষার উৎপত্তি মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত থেকে। বর্তমানে উত্তর ভারতের ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহের শাখাগুলো অন্ততঃ ২৫০০ বছর ধরে আংশিক স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ায়, একই ভাষা পরিবারের অংশ হওয়া সত্ত্বেও উত্তর ও পূর্ব ভারতীয় ভাষাগুলোর মাঝে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।

পৃথিবীর পিতৃবংশসমূহের মানচিত্র।

অপরপক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশের পিতৃবংশসমূহ (ইংরেজি: Y-DNA Haplogroups) বিশ্লেষণে দেখা যায় উত্তর ও মধ্য ভারতে প্রধানত ইন্দো-ইরানি পিতৃবংশ এবং দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড়ীয় পিতৃবংশ অত্যন্ত প্রভাবশালী, কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চল বা বৃহত্তর বাংলা অঞ্চলে অস্ট্রো-এশীয় পিতৃবংশ এবং তিব্বতি-বর্মী পিতৃবংশের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে, যার কারণে অনেকে বৃহত্তর বঙ্গ অঞ্চলে বসবাসকারীদের উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে বসবাসকারী থেকে ভিন্ন জাতি হিসেবে গণ্য করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাপ্ত পিতৃবংশসমূহের মধ্যে ইন্দো-ইরানি পিতৃবংশের অভিপ্রয়াণ সবচেয়ে নতুন হওয়ায়, এবং অস্ট্রো-এশীয় পিতৃবংশ সবচেয়ে পুরনো হওয়ার কারণে, বৃহত্তর বাংলা অঞ্চলে উত্তর ভারতীয় ও মধ্য ভারতীয় জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তারকে অনেকে বহির্সংস্কৃতির আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করেন। দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদও অনুরূপ চিন্তাধারার উপর নির্ভরশীল, যেখানে উত্তর ভারতের ইন্দো-ইরানি ভাষা বা পিতৃবংশের বিস্তারকে বহিরাগত সংস্কৃতির আগ্রাসন হিসেবে ধরা হয়।

ষড়যন্ত্র তত্ত্বসমূহ[সম্পাদনা]

লেবেনস্রম তত্ত্ব[সম্পাদনা]

লেবেনস্রম (অতিরিক্ত বসবাসের স্থান) হিসেবে "বৃহত্তর বাংলাদেশ" অর্জন করাটা বাংলাদেশ থেকে ভারতের রাজ্যগুলোতে বড় আকারের অবৈধ অভিবাসনের কারণ হিসেবে অভিযোগ করা হয়।[১২] একইভাবে এও অভিযোগ করা হয় যে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে, বিশেষ করে আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গকে মুসলিম প্রধান অঞ্চলে রূপান্তরিত করার জন্য বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে এই অবৈধ অভিবাসনকে উৎসাহিত করে, যার ফলস্বরূপ এই অঞ্চলগুলো ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে যুক্ত হবে।[১২] একটি ভারতীয় প্রস্তাব এই যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র এর বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার জন্য লেবেনস্রমের উদ্দেশে একটি আঞ্চলিক নকশা খুঁজছে এবং বৃহত্তর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে।[৫] আরেকটি প্রস্তাব অনুসারে বাংলাদেশের একটি বা দুটো জেলা দখল করে সেখানে সকল অবৈধ অভিবাসীদের পাঠিয়ে দিতে হবে।[৫][১৩] যদিও আরেকটি প্রস্তাব হচ্ছে বাংলাদেশের বাংলাদেশের এই "নকশাকে" বানচাল করার জন্য বাংলাদেশী অভিবাসীদের হত্যা করতে হবে।[১৪]

এটা সন্দেহ করা হয় যে, নিশ্চয়তার সাথে ভারতে বাংলাদেশী অভিবাসীদের সংখ্যা নির্ণয় করা খুব কঠিন।[১৫] বৃহত্তর বাংলাদেশ এর পরিকল্পনার কারণে ভারতের বিদ্রোহীদেরকে সমর্থন করলে বাংলাদেশের খুবই কম লাভ হবে - ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের এটা বুঝতে ব্যর্থতার কারণে কূটনৈতিক জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।[১৫] পণ্ডিতগণ এও বলেছেন যে বাংলাদেশী অভিবাসন আন্দোলনের ছদ্মবেশে এটা আসলে একটি মুসলিম মিথ্যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা এবং অভিবাসী জনগণের উপর একটি ভীষণ অস্পষ্ট দাবী।[১৬] আসামকে বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গের অংশ করারও একটি কথিত সমান্তরাল আরেকটি হুমকির কথাও জানা যায়।[১৭][১৮]

অভিবাসন তত্ত্ব[সম্পাদনা]

২১ শতকের শুরুতে, ভারতীয় রাজনৈতিক চক্র ভারতে বাংলাদেশীদের অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি গুরুতর হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করে।[৫] ভারতের এই মনোভাবের জন্য ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহের উৎস্য হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের চাপের মুখে রয়েছে।[১৫] ভারতকে এটা বোঝানোও বাংলাদেশের জন্য কঠিন যে, অভিবাসনকে উৎসাহিত করা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি নয়।[১৫] বাংলাদেশ রাষ্ট্র এসব অভিবাসীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে যাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে।[৫] দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক দলের জ্যোতি এম. পাঠানিয়ার মতে বাংলাদেশী অভিবাসীদের ভারতে আসার কারণগুলো হচ্ছে: ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশ মৌলিক অভাব তত্ত্ব যেমন: খাদ্য, বাসস্থান এবং বস্ত্র, অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা যেমন: চাকুরির সুযোগ, ভাল মজুরি এবং তুলনামূলকভাবে ভাল জীবনযাত্রার মান, সংখ্যালঘুদের (হিন্দু) জনতাত্ত্বিক অসামঞ্জস্য; ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৭৮০ জন যেখানে বর্ডার পার করলে জনসংখ্যার ঘনত্ব এর অর্ধেক, এবং বাংলাদেশীরা সস্তা শ্রমিক হওয়ায় খুব সহজেই ভারতের বাড়িগুলোতে "ঘরোয়া সাহায্যের" জন্য গৃহীত হয় যার ফলে ঘরোয়া সাহায্যের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে অভিবাসনও বৃদ্ধি পাচ্ছে।[১৯] নারী ও শিশু গবেশণা কেন্দ্রের হিসাব অনুসারে ১৯৯৮ সালে ২৭,০০০ বাংলাদেশীকে জোড় করে ভারতে পতিতাবৃত্তির কাজে নিযুক্ত করা হয়।[২০][২১]

জঙ্গিবাদ তত্ত্ব[সম্পাদনা]

ভারতের কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক অভিযোগ করেন যে বৃহত্তর বাংলাদেশের সমর্থকগণ আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয় এবং ত্রিপুরা এবং বার্মা (মায়ানমার) এর আরাকান রাজ্য সহ উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশী আধিপত্য বৃদ্ধির উপায় খুঁজছেন, যেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাঙ্গালী মুসলিম বসবাস করে।[২][১২] এও অভিযোগ করা হয় যে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ অসম (ULFA) আসামের পাঁচটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার মধ্যে চারটিকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে বৃহত্তর বাংলাদেশ গঠনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সাথে ষড়যন্ত্র করেছে, যেখানে বিপরীতে বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কার্যক্রমকে সহায়তা করার জন্য কয়েকজন উলফা (ULFA) নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে,[২২] যাদের মধ্যে রয়েছেন রঞ্জু চৌধুরি, অরবিন্দ রাজখোয়া এবং অনুপ চেতিয়া[২৩]

২০০২ সালে মুসলিম ইউনাইটেড লিবারেশন টাইগারস অফ আসাম (MULTA), মুসলিম ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম (MULFA) এবং মুসলিম ভলান্টিয়ার ফোর্স (MVF), পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন হরকাত-উল-মুজাহিদিন (HUM), মিয়ানমারের সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন (RSO) এবং আরাকান রোহিঙ্গা ইসলামিক ফ্রন্ট অফ মিয়ানমার (ARIFM), এবং একটি সর্ব-দক্ষিণ এশীয় জঙ্গী সংগঠন হরকাত-উল-জিহাদ আল-ইসলামি সহ ৯টি ইসলামী সংগঠন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় এবং এদের নেতাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দান করা হয়।[২৪] এই সংগঠনগুলো একটি জোট তৈরি করেছিল এবং ঘোষণা করেছিল যে বৃহত্তর বাংলাদেশ গঠন করা তাদের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি।[২][২৫] ঐতিহাসিকভাবে ভারত বাংলাদেশকে ULFA এবং ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড (NSCN) এর মত মৌলবাদী সংগঠনকে সমর্থন প্রদানের জন্য অভিযুক্ত করে আসছে, যেখানে বাংলাদেশ ভারতকে স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলন এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (UPDF) এর মত একইরকম সংগঠনকে সমর্থন করার জন্য অভিযুক্ত করে আসছে।[২৬]

অভিযোগের প্রভাব[সম্পাদনা]

নেলি গণহত্যা[সম্পাদনা]

আসামে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা ১৯৭৯ এর প্রথম দিকে শুরু হয়েছিল, যার নেতৃত্ব দিয়েছিল অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (AASU)।[২৭] তাদের দাবী ছিল আসামে অভিবাসীদের আগমন বন্ধ করা এবং যারা ইতোমধ্যে আসামে প্রবেশ করেছে তাদেরকে তাদের প্রাক্তন বাসভূমিতে পাঠিয়ে দেয়া।[২৮] ধীরে ধীরে এটি হিংস্র রূপ ধারণ করে এবং অসমীয়া এবং বাঙ্গালীদের (বেশিরভাগই মুসলিম) মধ্যে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়। এরই পরিণামস্বরূপ ১৯৮৩ সালের নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের কারণে ১৯৮৩ সালে ঘটে কুখ্যাত নেলি গণহত্যা[২৯] ১৯৮৫ সালে ভারত সরকার এই সমস্যার সমাধানের জন্য আসাম আন্দোলনের নেতাদের সাথে অসম চুক্তিতে সাক্ষর করে।[২৮][৩০] চুক্তি অনুযায়ী ভারত আসাম-বাংলাদেশ সীমান্তে বেড়া তৈরি করা শুরু করে যা এখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।[৩১] কিন্তু আসামে বিশাল সংখ্যক সত্যিকারের ভারতীয় মুসলিম বাঙ্গালী রয়েছে। অবৈধ বাংলাদেশী এবং স্থানীয় বাংলা ভাষাভাষীদেরকে পৃথক করা কঠিন।[৩২]

ভারতের উত্তর-পূর্বে জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নেলিতে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমদের গণহত্যার কারণ হয়।[৩৩] নেলিতে ৯৯০ জন অভিবাসী এবং বারবরিতে ৫৮৫ জন অভিবাসীকে ১৮ই ফেব্রুয়ারিতে হত্যা করা হয়।[৩৪] গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল এবং নারী ও শিশুকেও অভিবাসী মুসলিম হিসেবে চিহ্নিত করা গেলে তাদেরকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছিল।[৩৫] ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান এবং অবৈধ অভিবাসনকেই গণহত্যায় ৩,০০০ জনেরও বেশি মানুষের হত্যার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।[৩৬] নেলি গণহত্যাকে রাষ্ট্রীয় মদতে জাতিগত নিঃশেষের একটি অন্যতম উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়, যার পর দিল্লী (১৯৮৪), ভাগলপুর (১৯৮৯), মুম্বাই (১৯৯৩) এবং গুজরাটে (২০০২) একইরকম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।[৩৫]

সিনহা প্রতিবেদন[সম্পাদনা]

১৯৯৮ সালে তদকালীন লেফটেনেন্ট জেনারেল শ্রীনিবাস কুমার সিনহা; যিনি পরবর্তীকালে আসামের গভর্নর এবং পরবর্তীকালে জম্বু এবং কাশ্মীরের গভর্নর হন; তিনি কে. আর. নারায়ণনকে (পরবর্তীকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি হন) একটি প্রতিবেদন লিখে পাঠিয়েছিলেন; যেখানে দাবী করা হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে বৃহদাকারের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা "দীর্ঘদিনের লালিত বৃহত্তর বাংলাদেশ পরিকল্পনা" এর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত, এবং তিনি ১৯৭১ এর পূর্বে দুজন রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভূট্টো (পরবর্তীকালে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী) এবং শেখ মুজিবুর রহমান (৭১ এর পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) এর উদ্ধৃতি তুলে ধরেন যারা পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) আসামের অন্তর্ভুক্তি অনুমোদন করেছিলেন।[১২][৩৭] অবৈধ অভিবাসন নিয়ে উদ্বিগ্নতা এবং জনরোষ আসামে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে, এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখতে এবং অবৈধ অভিবাসনকে আটকাতে ব্যর্থমনোরথ হবার জন্য ভারত সরকারের উপর সমালোচনাও বৃদ্ধি পায়।[১২][৩৭]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Mahendra Gaur, Indian affairs annual (Volume 2), 2007, আইএসবিএন ৮১-৭৮৩৫-৪৩৪-৯
  2. Col. Ved Prakash, Terrorism in India's north-east: a gathering storm (Volume 1), Kalpaz Publications, 2008, আইএসবিএন ৮১-৭৮৩৫-৬৬০-০
  3. James Warner Björkman, Fundamentalism, revivalists, and violence in South Asia, page 38, Riverdale Company, 1988, আইএসবিএন ০-৯১৩২১৫-০৬-৬
  4. Venkata Siddharthacharry, Jambudwipa, a blueprint for a South Asian community, page 256, Radiant Publishers, 1985, আইএসবিএন ৮১-৭০২৭-০৮৮-X
  5. Willem van Schendel, The Bengal borderland: beyond state and nation in South Asia, page 233-34, Anthem Press, 2005, আইএসবিএন ১-৮৪৩৩১-১৪৫-৩
  6. Mikey Leung and Belinda Meggitt, Bangladesh, page 7-8, Bradt Travel Guides, 2009, আইএসবিএন ১-৮৪১৬২-২৯৩-১
  7. Soumyendra Nath Mukherjee (১৯৮৭)। Sir William Jones: A Study in Eighteenth-century British Attitudes to India। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 230। আইএসবিএন 978-0-86131-581-9। ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ নভেম্বর ২০১৮ 
  8. Bashabi Fraser, Bengal Partition Stories: An Unclosed Chapter, page 24-25, Anthem Press, 2008, আইএসবিএন ১-৮৪৩৩১-২৯৯-৯
  9. Anton Pelinka and Renée Schell, Democracy Indian style, page 79, Transaction Publishers, 2003, আইএসবিএন ০-৭৬৫৮-০১৮৬-৮
  10. M. Bhaskaran Nair, Politics in Bangladesh: a study of Awami League, 1949-58, page 46, Northern Book Centre, 1990, আইএসবিএন ৮১-৮৫১১৯-৭৯-১
  11. Benjamin Zachariah, Nehru, page 136, Routledge, 2004, আইএসবিএন ০-৪১৫-২৫০১৭-X
  12. Braja Bihari Kumara (২০০৬)। Illegal migration from Bangladesh। Concept Publishing Company। আইএসবিএন 978-81-8069-224-6 
  13. "Send All Infiltrators to a Space in Bangladesh", The Shillong Times, 20 January 2003
  14. Falguni Burman, "Check Bangla Influx for Survival: VHP", The Assam Tribune, 20 January 2003
  15. Zakia Soman and Jimmy Dabhi, Peace and Justice, page 138-39, Pearson Education India, 2010, আইএসবিএন ৮১-৩১৭-২৯৪৪-৩
  16. POLITICS AND ORIGIN OF THE INDIA-BANGLADESH BORDER FENCE, p: 12
  17. Harendranath Barua and Yogeśa Dāsa, Reflections on Assam, 1944-1983, page 185, Harendranath Barua Memorial Society, 1992
  18. Joya Chatterji, The spoils of partition: Bengal and India, 1947-1967, page 46, Cambridge University Press, 2007, আইএসবিএন ০-৫২১-৮৭৫৩৬-৬
  19. Jyoti M. Pathania, India & Bangladesh - Migration Matrix- Reactive and not Proactive ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে, Paper no. 632, South Asia Analysis Group
  20. Donna M. Hughes, Laura Joy Sporcic, Nadine Z. Mendelsohn and Vanessa Chirgwin, Factbook on Global Sexual Exploitation ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ এপ্রিল ২০১২ তারিখে, Coalition Against Trafficking in Women
  21. Bimal Kanti Paul; Syed Abu Hasnath, "Trafficking in Bangladeshi Women and Girls", Geographical Review, p.268-276, April 2000
  22. M. Sakhawat Hussain, South Asian tangle, page 204, Palok Publishers & Bangladesh Research Forum, 2007
  23. PTI, "ULFA leader arrested in Bangladesh", The Hindu, 2010-06-07
  24. Three to die for UK envoy attack, BBC, 2008-12-23
  25. Hiranmay Karlekar, Bangladesh: the next Afghanistan?, page 169, Sage Publications, 2005, আইএসবিএন ০-৭৬১৯-৩৪০১-৪
  26. Ashley J. Tellis and Michael Wills, Strategic Asia 2007-08: domestic political change and grand strategy, page 231, National Bureau of Asian Research, 2007, আইএসবিএন ০-৯৭১৩৯৩৮-৮-৫
  27. "From 1979 to 1985: The Anti-Foreigners Movement in Assam"। ২৫ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ নভেম্বর ২০১৮ 
  28. Report on illegal migration into assam
  29. Nellie 1983: A series by TwoCircles.net
  30. "Full text of the accord" (পিডিএফ)। ১৭ জানুয়ারি ২০০৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ নভেম্বর ২০১৮ 
  31. Achievements of Assam accord
  32. "Indifference, impotence, and intolerance:transnational Bangladeshis in India, Sujata Ramachandran" (পিডিএফ)। ২৩ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ নভেম্বর ২০১৮ 
  33. K. Warikoo, Himalayan Frontiers of India, page 174, Taylor & Francis, 2009, আইএসবিএন ০-৪১৫-৪৬৮৩৯-৬
  34. Hemendra Narayan, 25 years on Nellie Still haunts, Nellie India Massacre Assam, 2008, আইএসবিএন ৮১-৭৫২৫-৯৪২-৬
  35. Harsh Mander, "Nellie: India’s forgotten massacre ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ নভেম্বর ২০১২ তারিখে", The Hindu, 2008-12-14
  36. Gupta, Basu and Chattarji, Globalization in India: Contents and Discontents, page 66, Pearson Education India, 2010, আইএসবিএন ৮১-৩১৭-১৯৮৮-X
  37. Arup Chandra (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯)। "Assam governor asks Centre to seal Bangladesh border"। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৮-২১