গ্রিক পুরাণ
গ্রিক পুরাণ প্রাচীন গ্রীসে রচিত সেদেশের দেবদেবী ও বীর যোদ্ধাদের কাহিনী সংবলিত পুরাণকথা ও কিংবদন্তি সংক্রান্ত আখ্যানমালা। এই গল্পগুলিতে বিশ্বপ্রকৃতি এবং গ্রিকদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও প্রথা ও রীতিনীতির উদ্ভব ও গুরুত্বও ব্যাখ্যাত হয়েছে। এগুলি প্রাচীন গ্রিসের ধর্মীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হয়। আধুনিক বিশেষজ্ঞগণ এই সকল পুরাণকথা অধ্যয়ন করে প্রাচীন গ্রিসের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে পুরাণ-রচনার প্রকৃতিটি বুঝবারও চেষ্টা করে থাকেন।[১]
গ্রিক পুরাণের রূপায়ণ ঘটেছে মুখ্যত এক সুবিশাল উপাখ্যান-সংগ্রহে এবং গৌণত বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বমূলক শিল্পকলা, যেমন পাত্র-চিত্রকলা বা পূজাপহার ইত্যাদিতে। গ্রিক পুরাণে উল্লিখিত হয়েছে বিশ্বের সৃজন এবং বহু দেবদেবী, যোদ্ধা, নায়িকা ও অপরাপর পৌরাণিক জীবের বিস্তারিত বিবরণী। একটি মৌখিক কাব্যপ্রথায় এই কাহিনীগুলির বীজ উপ্ত হয়েছিল। আজকের পরিচিত গ্রিক পুরাণকথাগুলি পাওয়া যায় প্রধানত গ্রিক সাহিত্যে। গ্রিসের প্রাচীনতম সাহিত্য উপাদান ইলিয়াড ও ওডিসি গ্রন্থদ্বয়ে বর্ণিত হয়েছে ট্রয় যুদ্ধ ও তার পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলি। হোমার রচিত এই গ্রন্থদুটি হেসিয়ডের থিওগনি ও ওয়ার্কস অ্যান্ড ডেজ গ্রন্থের সমসাময়িক; যেগুলির বিষয়বস্তু হল জগতের সৃষ্টিতত্ত্ব, দৈবী শাসকদের আবির্ভাব, মানবীয় যুগগুলির পারম্পার্য, মানুষের দুঃখের সূত্রপাত এবং বলিপ্রথাগুলির উদ্ভব। এছাড়াও এই পুরাণকথাগুলি সংরক্ষিত হয়েছে হোমারীয় স্তোত্রাবলিতে, মহাকাব্য-চক্র বা এপিক সাইকেলের মহাকাব্যিক কবিতাবলিতে, গীতিকবিতায়, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের ট্রাজেডিয়ানদের রচনাবলিতে, হেলেনীয় যুগের পণ্ডিত ও কবিদের রচনায় এবং প্লুটার্ক বা পসানিয়াসের মতো রোমান সাম্রাজ্যের সমসাময়িক লেখকবৃন্দের রচনায়। বহু পুরাসামগ্রীর অলংকরণে দেবতা ও যোদ্ধাদের চিত্রাঙ্কণ করা হত বলে পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণও গ্রিক পুরাণ ব্যাখ্যানের অন্যতম প্রধান উপাদান। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর পাত্রগুলিতে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশার সাহায্যে ট্রয় চক্র বা ট্রোজান সাইকেল তথা হেরাক্লিসের অভিযানসমূহের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। পরবর্তীকালে প্রাচীন, ধ্রুপদী ও হেলেনীয় যুগগুলিতে হোমারীয় ও অন্যান্য পৌরাণিক দৃশ্যকলা সমকালে বিদ্যমান সাহিত্যিক প্রমাণের নিদর্শনস্বরূপ।[২]
গ্রিক পুরাণ শুধুমাত্র পাশ্চাত্য সভ্যতার কৃষ্টি, শিল্প ও সংস্কৃতিতেই গভীর প্রভাব বিস্তার করেনি, বরং পশ্চিমি ঐতিহ্য ও ভাষার একটি অংশ হিসাবে বিরাজমান হয়েছে। সুপ্রাচীন কাল থেকে অদ্যাবধি কবি ও শিল্পীগণ গ্রিক পুরাণ থেকে অনুপ্রেরিত হয়ে এসেছেন এবং আবিষ্কার করেছেন ধ্রুপদী পৌরাণিক বিষয়বস্তুর সমসাময়িক গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা।[৩]
গ্রিক পুরাণের সূত্র
[সম্পাদনা]প্রাথমিকভাবে গ্রিক সাহিত্য গ্রিক পুরাণের কথা জানা যায়। এছাড়া জ্যামিতিক যুগ (৯০০-৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং তৎপরবর্তীকালের দৃশ্য-মাধ্যমগুলির উপস্থাপনাসমূহ থেকেও এই পৌরাণিকীর অনেকাংশ জ্ঞাত হয়ে থাকে।[৪]
সাহিত্যিক উপাদান
[সম্পাদনা]গ্রিক সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখাতেই পৌরাণিক উপাখ্যানগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যদিও প্রাচীন গ্রিসের একমাত্র রক্ষাপ্রাপ্ত পৌরাণিক সারপুস্তিকা হল ছদ্ম-অ্যাপোলোডোরাসের লাইব্রেরি। এই গ্রন্থে বিভিন্ন কবিদের দ্বারা রচিত পরস্পরবিরোধী কাহিনীগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং গ্রিক পুরাণ ও নায়ক-সম্বন্ধীয় কিংবদন্তিগুলির একটি বৃহদাকার সারাংশ প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে।[৫]
সাহিত্যিক উপাদানগুলি মধ্যে প্রাচীনতার দিক থেকে সর্বাগ্রগণ্য হল হোমারের দুই মহাকাব্য – ইলিয়াড ও ওডিসি। অপরাপর কবিরা “মহাকাব্য-চক্র”টি সম্পূর্ণ করেছিলেন; কিন্তু সেই সকল অর্বাচীন ও অপ্রধান রচনাসমূহ বর্তমানে সম্পূর্ণই অবলুপ্ত। সনাতন নামটি ব্যতিরেকে হোমারীয় স্তোত্রাবলি সঙ্গেও হোমারের কোনও সম্বন্ধ নেই। তথাকথিত গীতিকাব্যিক যুগের প্রথমভাগে রচিত বৃন্দ-স্তোত্রগান এগুলি।[৬] হোমারের সম্ভাব্য সমসাময়িক হেসিয়ড থিওগনি (দেবগণের উদ্ভব) নামে একটি গ্রন্থে প্রাচীনতম গ্রিক পুরাণকথাগুলির সম্পূর্ণ বিবরণী লিপিবদ্ধ করেন। এই গ্রন্থে বর্ণিত হয় বিশ্বসৃষ্টি, দেবগণের উৎপত্তি, টাইটান ও দৈত্যদের কথা এবং বিস্তারিত পারিবারিক, লোককথামূলক ও রোগোৎপত্তির কারণ ব্যাখ্যামূলক পুরাণকথা। হেসিয়ডের ওয়ার্কস অ্যান্ড ডেজ কৃষিজীবন সংক্রান্ত একটি শিক্ষামূলক কবিতা। এই কবিতাটিতেও প্রমিথিউস, প্যান্ডোরা ও চার মানবীয় যুগের পুরাকথা বর্ণিত হয়েছে। কবি এই ভয়ানক বিশ্বে সাফল্যলাভের শ্রেষ্ঠ পন্থাটি বাতলেছেন, যে বিশ্বকে দেবগণ আরও ভয়ানক রূপে উপস্থাপনা করে থাকেন।[২]
গীতিকবিরা কখনও-সখনও পুরাণ থেকে তাদের রচনার উপাদান সংগ্রহ করতেন; কিন্তু সেগুলির প্রয়োগ যতটা না বর্ণনাত্মক, ততোধিক কল্পনামূলক। পিন্ডার, ব্যাকিলিডেস, সাইমনিডেস প্রমুখ গ্রিক গীতিকবি এবং থিওক্রিটাস ও বায়ন প্রমুখ রাখালিয়া কবিগণ একক পৌরাণিক ঘটনাবলির বর্ণনা দিয়েছেন।[৭] পাশাপাশি, ধ্রুপদী এথেন্সীয় নাটকের কেন্দ্রীয় বিষয়ও গৃহীত হয়েছিল গ্রিক পুরাণ থেকেই। একিলাস, সফোক্লিস, এবং ইউরিপিডিস প্রমুখ ট্র্যাজিক নাট্যকার তাদের কাহিনীর সারবস্তু চয়ন করেছিলেন বীরযুগ ও ট্রয় যুদ্ধের ঘটনা থেকে। বহু মহতী ট্র্যাজিক কাহিনী (যথা, অ্যাগামেনন ও তার অপত্যগণ, অয়দিপাউস, মিদিয়া প্রভৃতি) তাদের ধ্রুপদী রূপটি ধারণ করেছিল এই নাটকগুলিতেই। কমিক নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনিস তার দ্য বার্ডস ও দ্য ফ্রগস-এও গ্রিক পুরাণের সূত্র ব্যবহার করেছিলেন।[৮]
ঐতিহাসিক হেরোডোটাস ও ডিওডোরাস সিকিউলাস এবং ভূগোলবিদ পসানিয়াস ও স্ট্র্যাবো গ্রিক বিশ্ব পরিভ্রমণ করে তাদের শোনা অসংখ্য স্থানীয় পুরাকথা লিপিবদ্ধ করেন। এগুলির অনেকগুলিই অল্পজ্ঞাত পাঠান্তর।[৭] বিশেষত হেরোডোটাস বিভিন্ন প্রথাসমূহের উৎস সন্ধান করেন এবং প্রাচ্য ও গ্রিসের ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক মূলের পার্থক্যটি আবিষ্কার করেন।[৯]
হেলেনীয় ও রোমান যুগের কবিতাগুলি কৃষ্টিগত অনুশীলনের বদলে সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত হলেও বহু গুরুত্বপূর্ণ বিবরণী লিপিবদ্ধ করে রেখে তাদের অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছে। এই শ্রেণীতে যে সকল সাহিত্যিকের রচনা অন্তর্ভুক্ত তারা হলেন:
- রোমান কবি ওভিড, স্ট্যাটিয়াস, ভ্যালেরিয়াস ফ্ল্যাকাস, সেনেকা এবং সার্ভিয়াস-ভাষ্যসহ ভার্জিল।
- পরবর্তী প্রাচীন যুগের গ্রিক কবি নোনাস, অ্যান্টোনিয়াস লিবারেলিস, কুইন্টাস স্মায়ারনিয়াস।
- হেলেনীয় যুগের গ্রিক কবি রোডসের অ্যাপোলোনিয়াস, ক্যালিম্যাকাস, ছদ্ম-এরাটোস্থেনিস ও পার্থেনিয়াস।
- প্রাচীন গ্রিক ও রোমান উপন্যাসকার, যথা অ্যাপুলিয়াস, পেট্রোনিয়াস, লোলিয়ানাস ও হেলিয়োডোরাস।
রোমান ছদ্ম-হাইজিনাসের ঢঙে রচিত ফ্যাবুলা ও অ্যাস্ট্রোনোমিকা দুটি গুরুত্বপূর্ণ পুরাণ-সংক্রান্ত গদ্যরচনা। জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ ফিলোস্টেটাস রচিত ইম্যাজিনেস এবং ক্যালিস্ট্রাটাসের বিবরণী দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র।
সর্বশেষে, এইসব কৃষ্টিগত প্রথাকে হেয় করার জন্য খ্রিস্টান অ্যাপোলজিস্ট অর্নোবিয়াস প্রদত্ত উদ্ধৃতি ও কয়েকজন বাইজানটাইন গ্রিক লেখকের রচনা থেকে গ্রিক পুরাণের বহু গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যায়। এগুলির কয়েকটি অধুনাবিলুপ্ত গ্রিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত হয়েছিল। এই পুরাণ সংরক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে হেসিকিয়াসের লেক্সিকন, সুদা এবং জন জেজেস ও ইউস্টেথিয়াসের চুক্তিগুলি। খ্রিস্টীয় নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রিক পুরাণের মূল বক্তব্য মনে করা হয়ে থাকে - “প্রত্যেক পুরাণেই রয়েছে ডায়াডালাসের অসতীত্বের বিবরণী” (ἐν παντὶ μύθῳ καὶ τὸ Δαιδάλου μύσος/en panti muthōi kai to Daidalou musos)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুদাস বিশ্বকোষে পসেইডনের ষাঁড়ের প্রতি প্যাসিফের ‘অস্বাভাবিক কামনা’ চরিতার্থ করার পিছনে ডায়াডালাসে ভূমিকার কথা বলা হয়েছে : “এই সকল অশুভের উৎস ও দায় ডায়াডালোসের উপর বর্তায় এবং সে এগুলির জন্য চিহ্নিত বলে, আজ প্রবাদের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।”[১০]
পুরাতাত্ত্বিক উপাদান
[সম্পাদনা]ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মান শখের পুরাতাত্ত্বিক হেইনরিক শিলিয়েম্যান কর্তৃক মাইসিনিয়ান সভ্যতার আবিষ্কার এবং বিংশ শতাব্দীতে ক্রিট দ্বীপে ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক স্যার আর্থার ইভানস কর্তৃক মিনোয়ান সভ্যতার আবিষ্কার হোমারের মহাকাব্য সংক্রান্ত বহু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পাশাপাশি খুলে দেয় বহু দেবতা ও যোদ্ধাদের পৌরাণিক বিবরণীর পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণের দরজাও। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মাইসিনিয়ান ও মিনোয়ান ক্ষেত্রগুলিতে প্রাপ্ত পুরাণ ও প্রথাসংক্রান্ত প্রমাণগুলি সম্পূর্ণত সৌধকেন্দ্রিক। কারণ এখানে ব্যবহৃত লাইনার বি হরফটি (গ্রিস ও ক্রিটে প্রাপ্ত গ্রিক ভাষার একটি প্রাচীন রূপ) মালপত্রের হিসাবরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হত। যদিও দেবদেবী ও যোদ্ধাদের নামও এখানে প্রকাশিত হয়েছে, তবে সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশও রয়েছে। [২]
খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর মৃৎপাত্র শিল্পে ব্যবহৃত জ্যামিতিক নকশাগুলিতে ট্রোজান চক্র তথা হেরাক্লেসের অভিযানের দৃশ্যাবলি চিত্রিত রয়েছে।[২] দুটি কারণে পুরাণের এই দৃশ্য উপস্থাপনাগুলি গুরুত্বপূর্ণ; একদিকে যেমন গ্রিসের বহু পুরাণকথা সাহিত্যিক উপাদানগুলির অনেক আগেই পাত্রগুলিতে অঙ্কিত হয়েছিল (যেমন, হেরাক্লেসের দ্বাদশ কৃত্য, কেবলমাত্র সারবারাসের অভিযানগুলির কাহিনী আগে সাহিত্যে বর্ণিত হয়[১১]); তেমনি, অন্যদিকে এই দৃশ্য উপস্থাপনাগুলি অনেক সময়ই এমন কিছু পুরাণ বা পৌরাণিক দৃশ্য দর্শায় যা অধুনারক্ষিত কোনও সাহিত্যিক উপাদানে দেখা যায় না। কখনও কখনও দেখা যায়, কোনও পুরাণকথার প্রথম জ্যামিতিক শিল্প উপস্থাপনাটি পরবর্তী প্রাচীন যুগে রচিত প্রথম কাব্য-উপস্থাপনার কয়েক শতাব্দী আগে রচিত হয়েছে। [৪] প্রাচীন (৭৫০-৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), ধ্রুপদী (৪৮০-৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ও হেলেনীয় যুগে হোমারীয় ও অপরাপর বিভিন্ন পৌরাণিক দৃশ্যাবলি রক্ষাপ্রাপ্ত সাহিত্যিক প্রমাণসমূহের সংযোজনরূপে পাওয়া যায়।[২]
পৌরাণিক ইতিহাসের সমীক্ষণ
[সম্পাদনা]গ্রিকদের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে তাদের পুরাণকথার রূপটিও। প্রসঙ্গত, এই সংস্কৃতির উল্লিখিত ও অনুচ্চারিত মূলসূত্র গ্রিক পুরাণই। গিলবার্ট কাথবার্টসনের মতে, যেসকল রক্ষাপ্রাপ্ত সাহিত্যিক রূপগুলিতে আমরা এগুলি পেয়ে থাকি, সেগুলি প্রকৃতিগতভাবে রাজনৈতিক।[১২]
বলকান উপদ্বীপ অঞ্চলের কৃষিজীবী আদিম অধিবাসীগণ প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক বিষয়ের উপর একটি করে সত্তা আরোপ করত। কালক্রমে এই অস্পষ্ট সত্তাগুলি ধারণ করল মানবীয় চেহারা। স্থানীয় পুরাণকথায় তারা প্রবেশ করল দেবদেবীর রূপে।[১৩] উত্তর বলকান উপদ্বীপের উপজাতিগুলি যখন বহিরাক্রমণ শুরু করল, তখন তাদের সঙ্গে সঙ্গে এল বিজয়, শক্তিমত্তা, যুদ্ধ ও ভয়ানক বীরত্বকেন্দ্রিক এক নতুন দেবমণ্ডলী। কৃষিজগতের প্রাচীন দেবতারা হয় এই সকল অধিক শক্তিমান দেবতাদের সঙ্গে মিশে গেল, নয়ত হারিয়ে গেল বিস্মৃতির অতলে।[১৪]
মধ্য প্রাচীন যুগের পর থেকে পুরুষ দেবতা ও পুরুষ যোদ্ধাদের সম্পর্ক বিষয়ক পুরাণকথাগুলির বাহুল্য দেখা যায়। এটি শিক্ষাকেন্দ্রিক পেডেরাস্টি বা বালক-পুরুষ যৌনসম্পর্কের (Eros paidikos, παιδικός ἔρως) একটি সমান্তরাল বিকাশের ইঙ্গিতবাহী যা আনুমানিক ৬৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ প্রবর্তিত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর শেষ নাগাদ, কবিরা অ্যারিস ভিন্ন অন্য সকল দেবতা ও অনেক কিংবদন্তি চরিত্রের সঙ্গে কমপক্ষে একজন এরোমেনোসের নাম যুক্ত করেছিলেন।[১৫] পূর্বকালে প্রচলিত কিছু পুরাণকথা, যেমন একিলিস ও প্যাট্রোক্লাসের কাহিনীও বালক-পুরুষ যৌনসম্পর্কের আলোকে দর্শিত হয়ে থাকে।[১৬] প্রথমে আলেকজান্দ্রীয় কবিগণ ও পরে আদি রোমান সাম্রাজ্যের সাহিত্যিক পুরাণকারেরা সাধারণভাবে গ্রিক পৌরাণিক চরিত্রগুলির কাহিনী গ্রহণ করতে শুরু করেন।
মহাকাব্যিক কবিতার কৃতিত্বই হল একটি কাহিনী-চক্র সৃষ্টি করা, যার ফলস্রুতিতে পৌরাণিক কালনির্ঘণ্টের একটি ধারণা বিকাশলাভ করে। এইভাবে গ্রিক পুরাণ বিশ্ব ও মানবসভ্যতার বিকাশের একটি পর্যায়ের ন্যায় প্রতিভাত হয়।[১৭] বহু পরস্পরবিরোধী বক্তব্য কাহিনীগুলির একটি সুনির্দিষ্ট কালপরম্পরা নির্ধারণের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ালেও, একটি মোটামুটি কালপঞ্জি উপস্থাপনা অসম্ভব নয় :
- সৃষ্টিপুরাণ বা দেবযুগ (থিওগনিস, দেবগণের উদ্ভব) : বিশ্ব, দেবগণ ও মানবজাতির উৎপত্তি সংক্রান্ত পুরাণকথা।
- দেব-মানবের অবাধ মেলামেশার যুগ : দেবতা, উপদেবতা ও মানুষের আদি যোগসূত্রের কাহিনী।
- যোদ্ধাদের যুগ (বীরযুগ) : যেখানে দেবতাদের ক্রিয়াকলাপ কমে এসেছে। সর্বশেষ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ বীরত্বব্যঞ্জক কিংবদন্তি হল ট্রয় যুদ্ধ ও তার ফলস্রুতি (কোনও কোনও গবেষক এই অংশটিকে চতুর্থ কালের অন্তর্ভুক্ত করেছেন)।[১৮]
গ্রিক পুরাণের আধুনিক ছাত্রদের নিকট দেবযুগ অধিক আকর্ষণীয় হলেও, প্রাচীন ও ধ্রুপদী যুগের গ্রিক লেখকদের যে বীরযুগই প্রিয় ছিল তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, আকার ও জনপ্রিয়তায় গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াড ও ওডিসি-র কাছে দেবকেন্দ্রিক থিওগনি ও হোমারীয় স্তোত্রগুলি বামনতুল্য। হোমারের প্রভাবে যে বীরপূজন বা হিরো-কাল্ট সৃষ্টি হয়, তা আধ্যাত্মিক জীবনেও পরিবর্তন সূচিত করে; যার প্রকাশ ঘটে দেব রাজ্য ও মৃত (বীর) রাজ্যের বিচ্ছিন্নতা এবং অলিম্পিয়ান ও ক্থনিকের বিভেদনে।[১৯] ওয়ার্কস অ্যান্ড ডেজ গ্রন্থে হেসিয়ড চার মানবীয় যুগের (বা জাতি) কথা বলেছেন : স্বর্ণযুগ, রৌপ্যযুগ, ব্রোঞ্জযুগ ও লৌহযুগ। এই যুগ বা জাতিগুলি দেবতাদের বিচ্ছিন্ন সৃষ্টি। স্বর্ণযুগ ক্রোনাসের রাজত্ব; অন্যান্য যুগগুলি জিউসের সৃষ্টি। ব্রোঞ্জযুগের ঠিক পরেই হেসিয়ড প্রক্ষিপ্ত বীর যুগ (বা জাতি) অংশটি যুক্ত করেছেন। সর্বশেষ যুগটি হল লৌহযুগ; যে যুগে বাস করতেন কবি স্বয়ং। প্যান্ডোরার পুরাণকথার সূত্র ধরে অমঙ্গলের উপস্থিতির কারণ দর্শিয়ে কবি এই যুগকে বলেছেন সর্বনিকৃষ্ট।[২০] মেটামরফোসিস-এ ওভিডও হেসিয়ডের চতুর্যুগ-ধারণার অনুসরণ করেছেন।[২১]
দেবযুগ
[সম্পাদনা]সৃষ্টিকথা ও সৃষ্টিতত্ত্ব
[সম্পাদনা]লোকসাধারণের বোধ্য ভাষায় বিশ্বের বর্ণনা ও তার উৎপত্তি ব্যাখ্যার প্রয়াসটিই হল উৎপত্তির পুরাণকথা বা সৃষ্টিপুরাণ।[২২] হেসিয়ডের থিওগনি-তে উৎপত্তি-সংক্রান্ত সর্বাধিক লোকমান্য বিবরণটি পাওয়া যায়। এই বিবরণ অনুসারে সব কিছুর শুরু ক্যাওস নামে এক পরিব্যাপ্ত শূন্যতায়। এই শূন্যস্থান থেকে উৎপন্ন হয় গে বা গাইয়া (পৃথিবী) এবং আরও কয়েকটি দৈবী সত্তা : এরোস (প্রেম), অ্যাবিস (টারটারাস) ও এরিবাস।[২৩] পুরুষ-সংসর্গ ছাড়াই গাইয়া জন্ম দেন ইউরেনাসের (আকাশ), যিনি পরে গাইয়ার গর্ভাধান করেন। উভয়ের সঙ্গমে প্রথমে জন্ম নেন টাইটানগণ : ছয় পুরুষ ও ছয় নারী (ওশেনাস, কোয়েয়াস ও ক্রিয়াস, হাইপেরিয়ন ও ইয়াপেটাস, থেইয়া ও রেহ্য়া, থেমিস ও নিমোসিন, ফোয়েবি ও টেথিস); অতঃপর একচক্ষু সাইক্লোপস ও সহস্রভুজ হেকাটোনচিরেস। ক্রোনাস (“গাইয়ার সন্ততিদের মধ্যে চতুর, কনিষ্ঠতম ও সর্বাধিক ভয়ানক”[২৩]) তার পিতাকে খোজা করে দেবতাদের রাজা হন। ভগিনী রেহ্য়াকে তিনি বিবাহ করেন এবং অন্যান্য টাইটানগণ তার অমাত্য হন। পিতা-পুত্র বিরোধের পুনরাবৃত্তি হয় ক্রোনাসের পুত্র জিউসের ক্ষেত্রেও। পিতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার পর ক্রোনাসের মনে ভীতি জন্মেছিল যে তার সন্তানও তার সঙ্গে অনুরূপ আচরণ করতে পারে। তাই প্রতিবার রেহ্য়া সন্তানের জন্ম দিলে ক্রোনাস সেই সন্তানকে কেড়ে ভক্ষণ করতেন। এই কাজটি রেহ্য়া অত্যন্ত ঘৃণা করতেন; তাই জিউসের জন্ম হলে তাকে লুকিয়ে নবজাতকের কাঁথায় একটি পাথর মুড়ে ক্রোনাসকে ধোঁকা দেন তিনি। এই পাথরটিই ভক্ষণ করেন ক্রোনাস। জিউস বড় হলে তিনি তার পিতাকে একটি ঔষধিমিশ্রিত পানীয় পান করান, যাতে ক্রোনাস জিউসের সকল ভ্রাতা ও ভগিনীদের বমন করেন এবং সেই পাথরটিও বেরিয়ে আসেন, যেটি তার উদরে রাখা ছিল। তারপর জিউস দেবরাজের পদের জন্য ক্রোনাসকে যুদ্ধে আহ্বান করেন। শেষে সাইক্লোপসের সাহায্যে (যাকে জিউস টারটারাস থেকে মুক্ত করেন) জিউস ও তার ভ্রাতা-ভগিনীগণ যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ক্রোনাস ও টাইটানগণ টারটারাসে নিক্ষিপ্ত ও বন্দী হন।[২৪]
গ্রিকদের প্রাচীনতম কাব্যচেতনায় সৃষ্টিপুরাণ ছিল আদর্শ কাব্যধারা— আদর্শ “মিথোস” বা পুরাণকথা— এবং প্রায় অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন হিসাবে চিহ্নিত। অ্যাপোলোনিয়াসের আর্গোনটিকা গ্রন্থে দেখা যায়, সৃষ্টিপুরাণের আদর্শ কবি ও গায়ক অর্ফিয়ুস শুধুমাত্র যে সমুদ্র ও ঝড়কেই শান্ত করতেন তাই নয়, হেডিস-এ পতনের পর পাতালের পাষাণহৃদয় দেবতাদেরও বিচলিত করে তুলেছিলেন। হার্মিসের প্রতি হোমারীয় স্তোত্র-এ দেখা যায়, হার্মিস লায়ার আবিষ্কার করে প্রথমেই যে গান গেয়েছিলেন, তা দেবতাদের জন্মবিষয়ক সংগীত।[২৫] আবার হেসিয়ডের থিওগনি-ও শুধুমাত্র দেবতাদের সম্পূর্ণ রক্ষাপ্রাপ্ত বিবরণীই নয়; এর দীর্ঘ প্রাথমিক মিউজ আবাহনীগুলি সহকারে এটি আদিম কবিদের উদ্দেশ্যেরও এক পূর্ণ বিবরণী। সৃষ্টিপুরাণ আবার বেশ কিছু অধুনাবিলুপ্ত কবিতারও বিষয়বস্তু। এগুলির মধ্যে রয়েছে অর্ফিয়ুস, মিউজেয়াস, এপিমেনিডেস, অ্যাবারিস ও অন্যান্য কিংবদন্তি ভবিষ্যদ্দ্রষ্টাদের রচনা, যা ব্যবহৃত হত ব্যক্তিগত আচারসংক্রান্ত শুদ্ধিকরণ ও বিভিন্ন গুপ্তপ্রথায়। প্লেটো অরফিক সৃষ্টিপুরাণের কয়েকটি সংস্করণের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যায়।[২৬] এই রচনাগুলির কিছু খণ্ডাংশের সন্ধান মেলে নব্য প্লেটোপন্থী দার্শনিকদের উদ্ধৃতি ও সম্প্রতি আবিষ্কৃত কিছু প্যাপিরাস পুঁথি থেকে। এই পুঁথিগুলির অন্যতম ডারভেনি প্যাপিরাস প্রমাণ করেছে যে অন্ততপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত অর্ফিয়ুসের একটি সৃষ্টিপৌরাণিক-সৃষ্টিতত্ত্বসংক্রান্ত কবিতার অস্তিত্ব ছিল। এই কবিতাটি হেসিয়ডের থিওগনি-কেও ছাপিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। এখানে দেবতাদের সৃষ্টি ইউরেনাস, ক্রোনাস ও জিউসেরও আগে নিক্সের (রাত্রি) কাহিনী পর্যন্ত পিছিয়ে গেছে।[২৭]
প্রথম যুগের দার্শনিক সৃষ্টিতাত্ত্বিকগণ কখনও গ্রিসে সেকালে প্রচলিত জনপ্রিয় পুরাণ-ধারণার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, কখনও বা তার উপর নির্ভর করেছেন। হোমার ও হেসিয়ডের কবিতা থেকে এই জনপ্রিয় ধারণাগুলির কিছু দৃষ্টান্ত পাওয়া যেতে পারে। হোমারের রচনায় পৃথিবী ওশেনাস নদীর উপর ভাসমান একটি চ্যাপ্টা চাকতি; তার উপরে অর্ধগোলকাকার আকাশ; সেই আকাশে সূর্য, চাঁদ ও তারা। সূর্য (হেলিওস) রথীর বেশে স্বর্গ পরিক্রমা করেন; রাত্রে একটি সুবর্ণ পাত্রে ভেসে বেড়ান পৃথিবীর চারিধারে। সূর্য, পৃথিবী, স্বর্গ, নদী ও বায়ু সম্বোধিত হত এবং তা সাক্ষীশপথ বলে কথিত হত। প্রাকৃতিক গর্তগুলিকে মনে করা হত, মৃতদের রাজ্য হেডিসের ভূগর্ভস্থ ভবনের প্রবেশদ্বার।[২৮]
গ্রিক দেবমণ্ডলী
[সম্পাদনা]ধ্রুপদী যুগের পুরাণ অনুসারে, টাইটানদের নির্বাসিত করার পর দেবদেবীদের এক নতুন দেবমণ্ডলী গঠিত হয়। প্রধান গ্রিক দেবতাদের মধ্যে ছিলেন অলিম্পিয়ানগণ (সম্ভবত অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালেই তাদের সংখ্যা বারোয় সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল)।[২৯] মাউন্ট অলিম্পাসের শীর্ষে দেবরাজ জিউসের নজরদারিতে তারা বাস করতেন। অলিম্পিয়ানদের পাশাপাশি গ্রিকরা একাধিক গ্রাম্য দেবতাও পূজা করতেন। যেমন, প্যান, নিম্ফগণ (জলদেবী), নায়াডগণ (ঝর্ণাবাসী), ড্রায়াডগণ (বৃক্ষদেবতা), নেরেইডগণ (সমুদ্রবাসী), নদী দেবতাগণ, স্যাটারগণ প্রমুখ। এর সঙ্গে ছিলেন পাতাললোকের অন্ধকারের শক্তিগুলিও। যেমন, এরিনেস; কথিত হয় যিনি রক্তের সম্বন্ধীদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধে দোষীদের তাড়া করে ফিরতেন।[৩০] এই গ্রিক দেবমণ্ডলীর সম্মানেই কবিগণ রচনা করেছিলেন হোমারীয় স্তোত্রসমূহ (৩৩টি গানের সংকলন)। [৩১] গ্রেগরি ন্যাগি মনে করেন, “অধিকাংশ হোমারীয় স্তোত্রই হল সাধারণ মুখবন্ধ (থিওগনি-র তুলনায়) যার প্রত্যেকটি একজন দেবতাকে আবাহন জানায়।”[৩২]
গ্রিক পুরাণের বিভিন্ন উপকথা ও কিংবদন্তি অনুসারে, গ্রিকদের সুপরিচিত দেবতাদের শরীর ছিল মানবীয়, কিন্তু আদর্শ। ওয়াল্টার বারকার্ট মনে করেন, গ্রিক নরত্বারোপবাদের মূল বৈশিষ্ট্যই হল, “গ্রিক দেবতাগণ ব্যক্তি, বিমূর্ত কোনও কল্পনা বা ধারণা নন।”[৩৩] তাদের আসল রূপটির কথা বাদ দিলেও, প্রাচীন গ্রিক দেবতাগণ অনেকগুলি আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই যে তারা রোগবিসুখ দ্বারা আক্রান্ত হতেন না এবং কোনও কোনও অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ব্যতিরেকে তাদের আহতও করা যেত না। গ্রিকরা মনে করত, দেবতাদের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল অমরত্ব। এই অমরত্ব তথা অনন্ত যৌবন ধরে রাখত নেক্টর ও অ্যামব্রোসিয়ার ক্রমান্বয় ব্যবহার, যা দেবতাদের শিরায় দৈবী রক্তকে সর্বদা পুনরুজ্জীবিত করত।[৩৪]
প্রত্যেক দেবতা উদ্ভূত হতেন তার নিজস্ব বংশধারা থেকে। তাদের প্রত্যেকের আগ্রহ ও বিশেষত্বের ক্ষেত্রগুলি হত ভিন্ন ভিন্ন; প্রত্যেকেই চালিত হতেন এক-একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার দ্বারা। যদিও এই বর্ণনাগুলি অনেক ক্ষেত্রেই উৎপন্ন হয়েছিল প্রাচীন স্থানীয় পাঠান্তরগুলির বিভাজনের দ্বারা, যা সর্বদা পরস্পরের বক্তব্যের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হত না। কবিরা যখন কাব্যে, প্রার্থনায় বা পূজনে দেবতাদের স্মরণ করতেন, তখন তারা দেবতাদের নাম ও উপাধিগুলি সংমিশ্রিত করে উল্লেখ করতেন। যার ফলে তাদের বিশেষ বিশেষ দিকগুলি অন্যান্য দিকগুলির থেকে সহজেই পৃথক করা যেত (উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপোলো মিউজগেট হলেন মিউজদের নেতা অ্যাপোলো)। বৈকল্পিকভাবে, উপাধিও দেবতাদের কোনও নির্দিষ্ট ও স্থানীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করত, যা অনেক সময় গ্রিসের ধ্রুপদী যুগেও প্রাচীন বলে বিবেচিত হত।
অধিকাংশ দেবতাই জীবনের কোনও না কোনও দিকের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রোদিতি ছিলেন প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী, অ্যারিস ছিলেন যুদ্ধের দেবতা, হেডিস ছিলেন মৃতের দেবতা এবং অ্যাথিনা ছিলেন জ্ঞান ও সাহসিকতার দেবী।[৩৫] অ্যাপোলো বা ডায়োনিসাস প্রমুখ দেবতারা ছিলেন একাধিক গুণের অধিকারী ও জটিল চরিত্রবিশিষ্ট। আবার হেস্টিয়া (আক্ষরিকভাবে অগ্নিকুণ্ড) বা হেলিওস (আক্ষরিকভাবে সূর্য) ছিলেন ব্যক্তিত্বারোপ ভিন্ন আর কিছুই না। খুব অল্পসংখ্যক দেবতাদের উদ্দেশ্যেই মনোহর মন্দির নির্মিত হত। এই দেবতারা হতেন বৃহত্তর-হেলেনীয় কৃষ্টির মুখ্য আকর্ষণকেন্দ্র। যদিও স্বতন্ত্র অঞ্চল বা গ্রামে অধিবাসীদের স্থানীয় কৃষ্টি অপ্রধান দেবতাদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে দেখা যেত প্রায়শই। অনেক শহরে আবার বিশ্রুত দেবতাদের এমন সব স্থানীয় প্রথার মাধ্যমে সম্মান জানানো হত যা অন্যত্র সচরাচর লক্ষিত হত না। এসব ক্ষেত্রে অন্যান্য অঞ্চলে অপ্রচলিত অদ্ভুত সব উপকথাও সেই সব দেবতাদের কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করা হত। বীরযুগে বীর বা উপদেবতাদের পূজন শুরু হলেও সেখানেও অনুরূপ ঘটনা ঘটতে থাকে।
অবিনশ্বর ও নশ্বরদের যুগ
[সম্পাদনা]দেবযুগে দেবতারা ছিলেন একা; এবং বীরযুগ বা যোদ্ধাদের যুগে মানবজীবনের উপর দৈবী হস্তক্ষেপ অনেক কমে এসেছিল। আবার এই দুই যুগের সংযোগ সাধন করেছিল একটি যুগসন্ধি যে সময়ে দেবতা ও মানব অবাধে মেলামেশা করতে পারতেন। দেব-মানবের এতটা ঘনিষ্ঠতা পরবর্তী সময়ে আর সম্ভব হয়নি। এই যুগের কাহিনীগুলি অধিকাংশই বর্ণিত হয়েছে ওভিডের মেটামরফোসিস গ্রন্থে। এই কাহিনীগুলি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। যথা – প্রেমের কাহিনী ও শাস্তিদানের কাহিনী।[৩৬]
প্রেমের কাহিনীগুলির বিষয়বস্তু ছিল অজাচার (অর্থাৎ, আত্মীয়কুটুম্বের সঙ্গে নিষিদ্ধ যৌনসংসর্গ) ও পুরুষ দেবতাদের দ্বারা মর্ত্যনারীর সতীত্বহনন বা ধর্ষণ; যার ফলে জন্ম হয় বহু বীর যোদ্ধার। তবে দেবতা ও নশ্বরের এই ধরনের সম্পর্ক পরিহার্য – এমন একটি ইঙ্গিতও এই কাহিনীগুলিতে লক্ষিত হয়। কারণ, খুব অল্পক্ষেত্রেই এই ধরনের কাহিনী মিলনান্তক হত।[৩৭] আবার অন্যদিকে অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রে স্বর্গের দেবীরাও মর্ত্যপুরুষের সঙ্গে যৌনসংসর্গে লিপ্ত হয়েছেন। এমনই একটি উদাহরণ মেলে অ্যাফ্রোদিতির প্রতি হোমারীয় স্তোত্র-এ। এখানে অ্যাফ্রোদিতি অ্যাঙ্কিসেসের সঙ্গে মিলিত হয়ে অ্যানিসের জন্ম দিয়েছেন।[৩৮]
দ্বিতীয় ধরনের কাহিনীর (শাস্তিদানের কাহিনী) সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রথার প্রবর্তন ও আবিষ্কার সংক্রান্ত কিংবদন্তি। যেমন – স্বর্গ থেকে প্রমিথিউসের আগুন চুরি, জিউসের টেবিল থেকে ট্যান্টালাসের অমৃত ও অ্যাম্রোসিয়া চুরি এবং সেই গুপ্ত দেবরহস্য নিজের প্রজাদের নিকট প্রকাশ, প্রমিথিউস বা লাইকনের বলিদান প্রথা প্রবর্তন, ট্রিপ্টোলেমাসকে ডিমিটরের কৃষি ও এলিসিনীয় রহস্য শিক্ষাদান, মার্সিয়াসের আউলোস আবিষ্কার এবং অ্যাপোলোর সহিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রমিথিউসের অভিযান সম্পর্কে বলা হয়, এগুলি “দেবতা ও মানুষের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী”।[৩৯] তৃতীয় শতকে লিখিত একটি অজ্ঞাতনামা প্যাপিরাস পুঁথিতে বর্ণিত এক বিস্তারিত কাহিনী থেকে জানা যায়, কীভাবে থ্রেসের রাজা লিকারগাসের উপর ডায়োনিসাসের ভয়ংকর অভিশাপ রাজার দেবত্বলাভে বিলম্বের সুযোগে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনেও প্রসারিত হয়েছিল।[৪০] থ্রেসে নিজ কৃষ্টির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ডায়োনিসাসের আগমনের কাহিনীও এসকিলীয় ত্রয়ীর অন্যতম বিষয়।[৪১] অপর এক ট্রাজেডি, ইউরিপিডিসের দ্য ব্যাকে-তে থিবসের রাজা পেন্থেয়াসকেও ডায়োনিসাসের শাস্তির মুখে পড়তে হয়; কারণ তিনি তাকে অসম্মান করেছিলেন এবং মিনাড নামে মহিলা পুরোহিতদের পশ্চাতে গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন।[৪২]
প্রাচীন লোককথা-জাতীয়[৪৩] একই ধরনের একটি কাহিনীতে দেখা যায়, কন্যা পারসিফোনির অনুসন্ধানে বের হয়ে দোসো নামে এক বৃদ্ধার ছদ্মবেশে ডিমিটর অ্যাটিকার এলেসিস রাজ্যের রাজা সেলিয়াসের সাদর অভ্যর্থনা লাভ করেন। সন্তুষ্ট হয়ে তিনি ডেমোফোনকে দেবত্বে উন্নীত করতে চান। কিন্তু দেবত্ব-উপনয়নের সেই আচারানুষ্ঠানে বিঘ্ন ঘটে। ডেমোফোনের মা মেটানিরা অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়ে পুত্রকে জ্বলন্ত আগুনের উপর দণ্ডায়মান দেখে ভয়ে চিৎকার করে ওঠেন। ক্রুদ্ধ ডিমিটর খেদ করতে থাকেন যে মূর্খ নশ্বরেরা ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানের মর্ম বোঝে না।[৪৪]
গ্রিক ও রোমান পুরাণ-ধারণা
[সম্পাদনা]দর্শন ও পুরাণ
[সম্পাদনা]হেলেনীয় ও রোমান যুক্তিবাদ
[সম্পাদনা]সমন্বয় প্রচেষ্টাসমূহ
[সম্পাদনা]আধুনিক ব্যাখ্যাসমূহ
[সম্পাদনা]তুলনামূলক ও মনোবীক্ষণাত্মক প্রক্রিয়া
[সম্পাদনা]মূলসংক্রান্ত তত্ত্বসমূহ
[সম্পাদনা]পাশ্চাত্য সাহিত্য ও শিল্পে অভিপ্রকাশ
[সম্পাদনা]আরও পড়ুন
[সম্পাদনা]- Gantz, Timothy (১৯৯৩)। Early Greek Myth: A Guide to Literary and Artistic Sources। জন্স হোপকিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। আইএসবিএন 0-8018-4410-X।
- Graves, Robert (1955—Cmb/Rep edition 1993)। The Greek Myths। Penguin (Non-Classics)। আইএসবিএন 0-14-017199-1। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - Hamilton, Edith (১৯৪২—নতুন সংস্করণ ১৯৯৮)। Mythology। Back Bay Books। আইএসবিএন 0-316-34151-7। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - Kerenyi, Karl (১৯৫১—পুনঃপ্রকাশ সংস্করণ ১৯৮০)। The Gods of the Greeks। টেম্স & হাডসন। আইএসবিএন 0-500-27048-1। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - Kerenyi, Karl (১৯৫৯—পুনঃপ্রকাশ সংস্করণ ১৯৭৮)। The Heroes of the Greeks। টেম্স & হাডসন। আইএসবিএন 0-500-27049-X। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - Morford M.P.O., Lenardon L.J. (২০০৬)। Classical Mythology। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। আইএসবিএন 0-19-530805-0।
- Powell, Barry (২০০৮ —৬ষ্ঠ সংস্করণ)। Classical Myth। Prentice-Hall। আইএসবিএন 978-0-13-606171-7। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - Powell, Barry (২০০১)। A Short Introduction to Classical Myth। Prentice-Hall। আইএসবিএন 978-0-13-025839-7।
- Ruck Carl, Staples Blaise Daniel (১৯৯৪)। The World of Classical Myth। Carolina Academic Press। আইএসবিএন 0-89089-575-9।
- Smith, William (1870), Dictionary of Greek and Roman Biography and Mythology ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ এপ্রিল ২০০৬ তারিখে.
- Veyne, Paul (১৯৮৮)। Did the Greeks Believe in Their Myths? An Essay on Constitutive Imagination। (translated by Paula Wissing)। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়। আইএসবিএন 0-226-85434-5।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Volume: Hellas, Article: Greek Mythology"। Encyclopaedia The Helios। ১৯৫২।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "Greek Mythology"। Encyclopaedia Britannica। ২০০২।
- ↑ J.M. Foley, Homer's Traditional Art, 43
- ↑ ক খ F. Graf, Greek Mythology, 200
- ↑ R. Hard, The Routledge Handbook of Greek Mythology, 1
- ↑ Miles, Classical Mythology in English Literature, 7
- ↑ ক খ Klatt-Brazouski, Ancient Greek nad Roman Mythology, xii
- ↑ Miles, Classical Mythology in English Literature, 8
- ↑ P. Cartledge, The Spartans, 60, and The Greeks, 22
- ↑ Pasiphae, Encyclopedia: Greek Gods, Spirits, Monsters
- ↑ Homer, Iliad, 8. An epic poem about the Battle of Troy. 366–369
- ↑ Cuthbertson, Political Myth and Epic (Michigan State university Press) 1975 has selected a wider range of epic, from Gilgamesh to Voltaire's Henriade , but his central theme, that myths encode mechanisms of cultural dynamics, structuring a community by creating a moral consensus, is a familiar mainstream view that applies to Greek myth.
- ↑ Albala-Johnson-Johnson, Understanding the Odyssey, 17
- ↑ Albala-Johnson-Johnson, Understanding the Odyssey, 18
- ↑ A. Calimach, Lovers' Legends: The Gay Greek Myths;, 12–109
- ↑ W.A. Percy, Pederasty and Pedagogy in Archaic Greece, 54
- ↑ K. Dowden, The Uses of Greek Mythology, 11
- ↑ G. Miles, Classical Mythology in English Literature, 35
- ↑ W. Burkert, Greek Religion, 205
- ↑ Hesiod, Works and Days, 90–105
- ↑ Ovid, Metamorphoses, I, 89–162
- ↑ Klatt-Brazouski, Ancient Greek and Roman Mythology, 10
- ↑ ক খ Hesiod, Theogony, 116–138
- ↑ Hesiod, Theogony, 713–735
- ↑ Homeric Hymn to Hermes, 414–435 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৫ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে
- ↑ G. Betegh, The Derveni Papyrus, 147
- ↑ W. Burkert, Greek Religion, 236
* G. Betegh, The Derveni Papyrus, 147 - ↑ "Greek Mythology"। Encyclopaedia Britannica। ২০০২।
* K. Algra, The Beginnings of Cosmology, 45 - ↑ H.W. Stoll, Religion and Mythology of the Greeks, 8
- ↑ "Greek Religion"। Encyclopaedia Britannica। ২০০২।
- ↑ J. Cashford, The Homeric Hymns, vii
- ↑ G. Nagy, Greek Mythology and Poetics, 54
- ↑ W. Burkert, Greek Religion, 182
- ↑ H.W. Stoll, Religion and Mythology of the Greeks, 4
- ↑ H.W. Stoll, Religion and Mythology of the Greeks, 20ff
- ↑ G. Mile, Classical Mythology in English Literature, 38
- ↑ G. Mile, Classical Mythology in English Literature, 39
- ↑ Homeric Hymn to Aphrodite, 75–109 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ তারিখে
- ↑ I. Morris, Archaeology As Cultural History, 291
- ↑ J. Weaver, Plots of Epiphany, 50
- ↑ R. Bushnell, A Companion to Tragedy, 28
- ↑ K. Trobe, Invoke the GOds, 195
- ↑ M.P. Nilsson, Greek Popular Religion, 50
- ↑ Homeric Hymn to Demeter, 255–274
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- বিবিসির ইন আওয়ার টাইম-এ গ্রিক পুরাণ
- শাস্ত্রীয় পুরাণ পাঠের গ্রন্থাগার শাস্ত্রীয় সাহিত্যের রচনাগুলির অনুবাদ
- এলআইএমসি-ফ্রান্স গ্রেকো-রোমান পুরাণ এবং ইহার আইকনোগ্রাফিক নিবেদিত উপাত্তে উপলব্ধ।
- থিয়োই প্রকল্প, গ্রিক পুরাণ গাইড মূল উৎস থেকে উদ্ধৃতি এবং শাস্ত্রীয় শিল্প থেকে চিত্রসমূহের সাথে পৌরাণিক কাহিনী থেকে চরিত্রসমূহের জীবনী
- মার্টিন পি. নীলসন, গুগল বইয়ে গ্রিক পুরাণের মাইসেনেয়ান উৎস