সার্বজনীন পেনশন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

সার্বজনীন পেনশন হলো বাংলাদেশ সরকারের অবসরভাতা উদ্যোগের একটি ব্যবস্থা। একজন ব্যক্তির বয়স ও অবদানের হিসাবের উপর নির্ভর করে এই সুবিধার তারতম্য হয়ে থাকে। যদি অবদানের ন্যূনতম সংখ্যক অবদানের যোগ্যতার বছর থাকে সেক্ষেত্রে কেউ পেনশন দাবি করতে পারে।

পটভূমি[সম্পাদনা]

২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রকাশিত ইশতেহারে দলটি সব শ্রেণীর নাগরিকের জন্য একটি অবসরভাতা ব্যবস্থা প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো।[১] ৩০ জুন ২০১৬ সালে, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের বাজেট পরিকল্পনা পেশ করার সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেসরকারি খাতের কর্মচারীদের জন্য একটি পেনশন স্কিম প্রবর্তন ও দেশের পেনশন ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তিনি এই পরিকল্পনার প্রস্তাব করেন।[২] ২০১৯ সালে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ঘোষণা করা হয়েছিলো।[৩] একই বছরে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম. এ. মান্নান জানিয়েছিলেন যে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য প্রস্তাবিত পেনশন প্রকল্পটি সর্বজনীন হবে ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ সেল ইতিমধ্যে এটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করেছে।[২] ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার উপর প্রস্তুতকৃত কৌশলপত্র উপস্থাপনের পর দ্রুত সম্ভব এই নতুন পেনশন ব্যবস্থার উদ্দেশ্যে একটি আইন প্রণয়নের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন।[১] ৩০ মার্চ ২০২২-এ সার্বজনীন পেনশন আইনের খসড়া প্রকাশিত হয়।[৪] অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ৯ জুন ২০২২ সালে ঘোষণা করেন যে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হবে।[৫] ৬ জুলাই ২০২৩ সালে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়।[৬] সার্বজনীন পেনশন জুলাই ২০২৩ সালে চালু হওয়ার কথা ছিলো, তবে পরে ১৭ আগস্ট ২০২৩ সালে চালু হবে বলে নিশ্চিত করা হয়।[৭][৮] প্রতিশ্রুত দিনে শেখ হাসিনা সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার উদ্বোধন করেন।[৯]

বিস্তারিত[সম্পাদনা]

নীতি[সম্পাদনা]

সার্বজনীন পেনশন সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে।[৭] ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিক স্বেচ্ছায় এই পেনশন পেতে পারেন, ভবিষ্যতে এই পেনশন সবার জন্য বাধ্যতামূলক হবে। পেনশন পেতে হলে একজন নাগরিককে কমপক্ষে দশ বছরের জন্য অবদান রাখতে হবে, যার পরিমাণ তিনি নিজেই নির্দিষ্ট করতে পারবেন। দশ বছর বয়সের আগে কেউ মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীদের টাকা দেওয়া হবে। বেসরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তাদের সংস্থাটি সার্বজনীন পেনশনে যোগদান করলে তাদের ক্ষেত্রে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অবদানের পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে। বছর শেষ হওয়ার আগে সম্পূর্ণ অবদানের অর্থ প্রদান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে অস্থায়ী সময়ের জন্য পেনশন হিসাব স্থগিত করা হবে যা বকেয়া পরিশোধের মাধ্যমে সক্রিয় করা যেতে পারে। পেনশন হিসাবধারীর বয়স ৬০ বছর হয়ে গেলে তারা মাসিক হারে পেনশন পেতে থাকবেন যা তাদের জমাকৃত পরিমাণের মোট পরিমাণ ও বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশের সমান হবে। ৮০ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার ৫ বছর আগে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ব্যক্তির পেনশন তার মনোনীত ব্যক্তিকে দেওয়া হবে। জমাকৃত অর্থের অর্ধেক অর্থ ঋণ হিসাবে নেওয়া যেতে পারে। যদি কোনো ব্যক্তি ১৮ থেকে ৪২ বছর বয়স পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে অবদান রাখেন, তবে ৬০ বছর বয়স থেকে তারা প্রতি মাসে পেনশন হিসাবে ৳৬৪,৭৭৬ পাবেন এবং যদি কেউ ৩০ বছর বয়স থেকে ৩০ বছর ধরে অবদান রাখেন তবে তাকে প্রতি মাসে ৳১৮,৯০৮ দেওয়া হবে।[৩]

প্রকারভেদ[সম্পাদনা]

সার্বজনীন পেনশনের অধীনে চার ধরনের অবসরভাতা প্রদান করা হবে:[৭][৮]

  • প্রগতি: এটি বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের জন্য। এর মাসিক চাঁদার হার ৳১০০০ থেকে ৳৫০০০ হবে।
  • সুরক্ষা: এটি আত্মনির্ভরশীল ব্যক্তিদের জন্য। এর মাসিক চাঁদার হার ৳৫০০ থেকে ৳৫০০০ হবে।
  • সমতা: এটা নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এর মাসিক চাঁদার হার হল ৳৫০০। চাঁদার ৫০% সরকার প্রদান করবে।
  • প্রবাসী: এটি দেশের বাইরে কর্মরত নাগরিকদের জন্য। এর মাসিক চাঁদার হার ৳৫০০ থেকে ৳৫০০০ হবে।

বাস্তবায়ন[সম্পাদনা]

১৫ সদস্য নিয়ে গঠিত গভর্নিং বোর্ড এই ব্যবস্থা পরিচালনা করবে।[৪]

প্রতিক্রিয়া[সম্পাদনা]

দৈনিক যুগান্তর সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয়তে এই প্রকল্পকে "একটি মহান ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ" হিসেবে অভিহিত করে বলা হয়েছে যে এটি দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।[১০] এই পেনশন ব্যবস্থাটিকে "সার্বজনীন" বলা হলেও অর্থনীতিবিদদের মতে এটি সার্বজনীন নয় কারণ এই ব্যবস্থায় সমস্ত শ্রেণীর নাগরিকদের অংশগ্রহণের উপায় নেই। তারা একে "অবদানমূলক পেনশন" বলে অভিহিত করেছেন। অর্থনীতিবিদদের মতে সরকারের এই পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিলো রাষ্ট্রের সর্বাধিক সংখ্যক নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনার চেষ্টা করা।[১১] বিরোধী রাজনৈতিক দল সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছে। কিছু সংসদ সদস্য সার্বজনী পেনশন ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইনটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করার সময় এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। সংসদ সদস্যজাতীয় পার্টির রাজনীতিবিদ মুজিবুল হক চুন্নুর মতে ব্যাংকগুলোর আমানত পেনশন স্কিমের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য নেই। তার মতে সার্বজনীন পেনশনে সরকারের অবদানও অস্পষ্ট। সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু এই সার্বজনীন পেনশন থেকে মানুষ আসলেই উপকৃত হবে কি না সন্দেহ প্রকাশ করেন কেননা দেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা থাকলেও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে তাদের অনেকেই অবসর গ্রহণের পর পেনশন সুবিধা পাচ্ছেন না। জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম এই পেনশন ব্যবস্থাকে দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন। তহবিল ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ইয়াওয়ার সাঈদের মতে সরকার যদি জবাবদিহিতা ছাড়া পেনশনের অর্থ যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করতে না পারে তবে এটি একটি ভালো উদ্যোগ।[১২] ১৮ আগস্ট ২০২৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন যে সরকার এই অবসরভাতা ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করে আসন্ন নির্বাচন করতে চায়।[১৩] বাংলাদেশী আলেম শায়খ আহমাদুল্লাহ এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন এবং একই ব্যবস্থার অধীনে একটি ইসলামি স্কিম চালু করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।[১৪]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "সার্বজনীন পেনশন: জরুরিভিত্তিতে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ"সমকাল। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০২৩ 
  2. "ষাটোর্ধ্ব সবার জন্য আসছে পেনশন সুবিধা"বাংলানিউজ২৪.কম। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০২৩ 
  3. "সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় মাসে পাওয়া যাবে ৬৪ হাজার টাকা"রাইজিংবিডি.কম। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০২৩ 
  4. "সার্বজনীন পেনশন আইনের খসড়া প্রকাশ, ১২ এপ্রিল পর্যন্ত মতামত দেওয়ার সুযোগ"দ্য ডেইলি স্টার। ৩০ মার্চ ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০২৩ 
  5. "সার্বজনীন পেনশন আগামী অর্থবছর থেকেই: অর্থমন্ত্রী"বিডিনিউজ২৪.কম। ৯ জুন ২০২২। ১৫ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০২৩ 
  6. করিম বায়রন, রেজাউল (৬ জুলাই ২০২৩)। "Universal Pension: Govt forms Nat'l Pension Authority"দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২৩ 
  7. কাশেম, আবুল; আবদুল্লাহ, শেখ (১২ জুন ২০২৩)। "জুলাই থেকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা, মাসে দিতে হবে ৫০০-৫,০০০ টাকা"দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০২৩ 
  8. "সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচির উদ্বোধন বৃহস্পতিবার"বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা। ১৪ আগস্ট ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০২৩ 
  9. "আমার প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা অব্যাহত রাখুন: অনুরোধ প্রধানমন্ত্রীর"আমাদের সময়। ১৭ আগস্ট ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ১৭ আগস্ট ২০২৩ 
  10. "সর্বজনীন পেনশন স্কিম: জনকল্যাণমুখী এক বড় পদক্ষেপ"যুগান্তর। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০২৩ 
  11. স্বপন, হারুন উর রশীদ (১০ জুন ২০২২)। "সার্বজনীন পেনশন স্কিম : যেমন হতে পারে, যেমন হওয়া 'উচিত'"ডয়েচে ভেল। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০২৩ 
  12. ইসলাম, সায়েদুল (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। "সর্বজনীন পেনশন তহবিল কি ব্যাংকের ডিপিএসের মতো?"বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০২৩ 
  13. "সর্বজনীন পেনশন টাকা চুরির নতুন ফন্দি : ফখরুল"কালের কণ্ঠ। ১৮ আগস্ট ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ১৯ আগস্ট ২০২৩ 
  14. "সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে যা বললেন শায়খ আহমাদুল্লাহ"চ্যানেল টুয়েন্টিফোর। ১৭ আগস্ট ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০২৩ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]