যূথ অনাক্রম্যতা
রোগবিস্তার বিজ্ঞানের আলোচনাতে যূথ অনাক্রম্যতা বা যূথ প্রতিরক্ষা বলতে মানুষ থেকে মানুষে বাহিত কোনও সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে পরোক্ষ সুরক্ষামূলক একটি অবস্থাকে বোঝায় যেখানে কোনও জনসমষ্টির যথেষ্ট বড় একটি অংশ টিকাদান বা অন্য কোনও উপায়ে অনাক্রম্যতা (রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা) অর্জন করার সুবাদে রোগটির বিস্তার প্রতিরোধ করতে সক্ষম, যার ফলে রোগটি কেবল খুবই সীমিত সংখ্যায় রোগাক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য কোনও ঝুঁকিপ্রবণ ব্যক্তির দেহে ছড়াতে পারে।[১][২] যখন কোনও জনসমষ্টির সিংহভাগ ব্যক্তিই কোনও মনুষ্যবাহিত সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা অর্জন করে, তখন তারা সেই রোগের সংবহনে আর অংশগ্রহণ করে না; এর ফলে রোগ সংবহন ও সংক্রমণের শৃঙ্খল ব্যহত হয়, এবং রোগটির বিস্তার ধীর হতে হতে শেষ পর্যন্ত থেমে যায়।[৩] কোনও জনসমষ্টি বা সম্প্রদায়ে যত বেশি সংখ্যায় অনাক্রম্য বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাবিশিষ্ট ব্যক্তি থাকে, একজন অনাক্রম্যতাহীন (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন) ব্যক্তির পক্ষে একজন সংক্রামক ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা ততটুকুই কমে যায়, ফলে অনাক্রম্যতাহীন ব্যক্তিরা সংক্রমণের হাত থেকে এক ধরনের পরোক্ষ সুরক্ষা লাভ করেন।[১] যূথ অনাক্রম্যতাকে সম্প্রদায়ব্যাপী অনাক্রম্যতা-ও (Community immunity) বলা হতে পারে।
প্রধানত দুইটি উপায়ে যূথ অনাক্রম্যতা অর্জন করা সম্ভব: অতীতে একই রোগের শিকার হয়ে সেরে ওঠা (অর্জিত প্রতিরক্ষা বা অনাক্রম্যতা), এবং বহুসংখ্যক ব্যক্তিকে টিকা প্রদান করা।[৩] যূথ অনাক্রম্যতা অর্জনের জন্য কোনও জনসমষ্টির সব ব্যক্তিকে অনাক্রম্য হতে হয় না। বরং এক্ষেত্রে সংক্রমণ-ঝুঁকিপ্রবণ ব্যক্তিদের ঘনত্ব এতটাই কমে যায় যে একজন সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে একজন অ-সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা খুবই কম হওয়ার জন্য সেটি যথেষ্ট হয়। তখন বলা হয় যে যূথ অনাক্রম্যতা অর্জিত হয়েছে। যূথ অনাক্রম্যতা জনসমষ্টির দীর্ঘ সময় ধরে রোগ ছড়িয়ে পড়াকে প্রতিরোধ করে, এবং এভাবে সম্ভাব্য ঝুঁকিপ্রবণ ব্যক্তিদেরকে সংক্রমণের হাত থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। তবে মানব সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ানো সংক্রামক রোগগুলির জন্যই এই ধারণাটি প্রযোজ্য।[৪] যেমন ধনুষ্টঙ্কার একটি সংক্রামক ব্যাধি হলেও ছোঁয়াচে নয়, সুতরাং যূথ অনাক্রম্যতার ধারণাটি এই রোগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। [৫]
একটি জনসমষ্টি বা সম্প্রদায়ের কিছু ব্যক্তি চিকিৎসাগত কারণে (যেমন অনাক্রম্যতার অভাব বা অনাক্রম্যতা লোপ) কোনও একটি সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা অর্জনে অসমর্থ হতে পারেন। এইসব ব্যক্তিদের বাঁচাবার জন্য যূথ অনাক্রম্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা।[৪][৫]
কোনও জনসমষ্টির কত শতাংশ অনাক্রম্য হলে যূথ অনাক্রম্যতা সৃষ্টি হবে, তা সংক্রামক রোগভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। কোনও রোগ যদি অত্যন্ত ছোঁয়াচে হয়, যেমন - হাম, তাহলে সেক্ষেত্রে জনসমষ্টির একটি বিরাট অংশকে অনাক্রম্য হতে হয়। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত কম ছোঁয়াচে রোগের জন্য (যেমন- যক্ষ্মা) অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর একটি অংশের অনাক্রম্যতা অর্জন করতে হয়। অধিকন্তু ব্যক্তি-স্তরের ও জনসমষ্টি-স্তরের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেগুলি কোনও রোগের বিস্তারের উপর নিয়ামক ভূমিকা রাখতে পারে, যেমন - সহজে রোগাক্রান্ত হবার ঝুঁকি, জনতত্ত্ব, সামাজিক অভ্যাসসমূহ, ইত্যাদির মতো ব্যাপারগুলিও যূথ অনাক্রম্যতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
গণটিকাদান কর্মকাণ্ডগুলির জন্য যূথ অনাক্রম্যতা একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। যদি কোনও সংক্রামক রোগের জন্য একটি সস্তা, নিরাপদ ও কার্যকরী টিকা থেকেও থাকে, তা সত্ত্বেও বিদ্যমান কাঁচামাল ও সম্পদ, কাঁচামাল ও পণ্য স্থানান্তর প্রক্রিয়া ও সমাজ সংক্রান্ত বিভিন্ন বাধ্যবাধকতার কারণে জনসমষ্টির শতকরা ১০০ ভাগ ব্যক্তিকে টিকা প্রদান করা সম্ভব হয় না। বরং টিকাদানের বাস্তবনির্ভর যুক্তিসঙ্গত একটি লক্ষ্যমাত্রা হল যূথ অনাক্রম্যতার ন্যূনতম মাত্রা অর্জন করা। সম্প্রদায়ব্যাপী ন্যূনতম মাত্রা H = 1 - 1/R0 এই সূত্রটি দিয়ে গণনা করা হয়, যেখানে R0 হল মৌলিক জনন সংখ্যা। কোনও রোগে সংক্রমিত একজন ব্যক্তি ঝুঁকিপ্রবণ জনসমষ্টিতে প্রবেশ করলে গড়ে আরও কতজন মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে, তাকেই ঐ রোগটির মৌলিক জনন সংখ্যা বলে। যূথ অনাক্রম্যতার নীতিগুলি প্রয়োগ করে গণটিকাদান কর্মসূচি সফল হতে পারে। যূথ অনাক্রম্যতা অর্জনের পরেও রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে, তবে সেগুলির বিস্তার তুলনামূলকভাবে কম হয়ে থাকে। এভাবে রোগটির সংক্রমণের সংখ্যা কমতে কমতে যখন স্থায়ীভাবে ও বিশ্বব্যাপী শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, তখন সেই ঘটনাটিকে রোগের নির্মূলকরণ বলা হয়।.[৬] যেমন টিকাদান কর্মসূচির কারণে সৃষ্ট যূথ অনাক্রম্যতার সুবাদে ১৯৭৭ সালে গুটিবসন্ত রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে গেছে বলে দাবী করা হয় এবং অন্যান্য অনেক রোগের প্রাদুর্ভাবও এভাবে অনেক কমে এসেছে।[৭]
১৯৩০-এর দশকে যূথ অনাক্রম্যতার ব্যাপারটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সেসময় সবার নজরে আসে যে তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক শিশু হামের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা অর্জনের পরে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা সাময়িকভাবে হ্রাস পায়, এমনকি ঝুঁকিপ্রবণ শিশুদের মধ্যেও।[৮] এরপর থেকে বহু সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধের জন্য যূথ অনাক্রম্যতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গণটিকাদান কর্মসূচির প্রয়োগ খুবই সাধারণ একটি ঘটনায় পরিণত হয়েছে এবং এগুলি সাফল্যের মুখ দেখেছে।[৯] সাম্প্রতিককালে কোনও কোনও দেশে বা অঞ্চলে স্বল্পসংখ্যক কিছু ব্যক্তির টিকাগ্রহণে বিরোধিতার কারণে যূথ অনাক্রম্যতা অর্জনের প্রক্রিয়াটি বাধার সম্মুখীন হয়েছে, এবং এর ফলে ঐসব দেশ, অঞ্চল বা সম্প্রদায়ে অপর্যাপ্ত টিকাগ্রহণের হারের কারণে প্রতিরোধযোগ্য রোগগুলি হয় এখনও টিকে আছে, কিংবা আবার ফেরত এসেছে।[১০][১১][১২]
পরিভাষা
[সম্পাদনা]- অর্জিত অনাক্রম্যতা - Acquired immunity
- ঝুঁকিপ্রবণতা - Susceptibility
- ঝুঁকিপ্রবণ ব্যক্তি - Susceptible individual
- গণটিকাদান - Mass immunization
- ছোঁয়াচে - Contagious
- জনতত্ত্ব - Demography
- জনসমষ্টি - Population
- টিকাদান - Immunization
- ন্যূনতম মাত্রা - Threshold level
- মৌলিক জনন সংখ্যা - Basic reproduction number
- সংক্রামক ব্যক্তি - Infectious individual
- সংক্রামক রোগ - Infectious disease
- যূথ অনাক্রম্যতা / প্রতিরক্ষা - Herd immunity, Community immunity
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ Fine, P.; Eames, K.; Heymann, D. L. (১ এপ্রিল ২০১১)। "'Herd immunity': A rough guide"। Clinical Infectious Diseases। 52 (7): 911–16। ডিওআই:10.1093/cid/cir007। পিএমআইডি 21427399।
- ↑ Gordis, L. (২০১৩)। Epidemiology। Elsevier Health Sciences। পৃষ্ঠা 26–27। আইএসবিএন 978-1455742516। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১৫।
- ↑ ক খ Merrill, R. M. (২০১৩)। Introduction to Epidemiology। Jones & Bartlett Publishers। পৃষ্ঠা 68–71। আইএসবিএন 978-1449645175। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১৫।
- ↑ ক খ Somerville, M.; Kumaran, K.; Anderson, R. (২০১২)। Public Health and Epidemiology at a Glance। John Wiley & Sons। পৃষ্ঠা 58–59। আইএসবিএন 978-1118308646। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১৫।
- ↑ ক খ "Herd Immunity"। Oxford Vaccine Group, University of Oxford। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১৭।
- ↑ Cliff, A.; Smallman-Raynor, M. (১১ এপ্রিল ২০১৩)। Oxford Textbook of Infectious Disease Control: A Geographical Analysis from Medieval Quarantine to Global Eradication। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 125–36। আইএসবিএন 978-0199596614। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১৫।
- ↑ Kim, T. H.; Jonhstone, J.; Loeb, M. (সেপ্টেম্বর ২০১১)। "Vaccine herd effect"। Scandinavian Journal of Infectious Diseases। 43 (9): 683–89। ডিওআই:10.3109/00365548.2011.582247। পিএমআইডি 21604922। পিএমসি 3171704 ।
- ↑ *Hinman, A. R.; Orenstein, W. A.; Papania, M. J. (১ মে ২০০৪)। "Evolution of measles elimination strategies in the United States"। The Journal of Infectious Diseases। 189 (Suppl 1): S17–22। ডিওআই:10.1086/377694। পিএমআইডি 15106084।
*Sencer, D. J.; Dull, H. B.; Langmuir, A. D. (মার্চ ১৯৬৭)। "Epidemiologic basis for eradication of measles in 1967"। Public Health Reports। 82 (3): 253–56। জেস্টোর 4592985। ডিওআই:10.2307/4592985। পিএমআইডি 4960501। পিএমসি 1919891 । - ↑ Garnett, G. P. (১ ফেব্রুয়ারি ২০০৫)। "Role of Herd Immunity in Determining the Effect of Vaccines against Sexually Transmitted Disease"। The Journal of Infectious Diseases। 191 (Suppl 1): S97–106। ডিওআই:10.1086/425271। পিএমআইডি 15627236। ২৩ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০২০।
- ↑ Quadri-Sheriff, M.; Hendrix, K. S.; Downs, S. M.; Sturm, L. A.; Zimet, G. D.; Finnell, S. M. (সেপ্টেম্বর ২০১২)। "The role of herd immunity in parents' decision to vaccinate children: a systematic review"। Pediatrics। 130 (3): 522–30। ডিওআই:10.1542/peds.2012-0140। পিএমআইডি 22926181।
- ↑ Dubé, E.; Laberge, C.; Guay, M.; Bramadat, P.; Roy, R.; Bettinger, J. (আগস্ট ২০১৩)। "Vaccine hesitancy: an overview"। Human Vaccines & Immunotherapeutics। 9 (8): 1763–73। ডিওআই:10.4161/hv.24657। পিএমআইডি 23584253। পিএমসি 3906279 ।
- ↑ Ropeik, D. (আগস্ট ২০১৩)। "How society should respond to the risk of vaccine rejection"। Human Vaccines & Immunotherapeutics। 9 (8): 1815–18। ডিওআই:10.4161/hv.25250। পিএমআইডি 23807359। পিএমসি 3906287 ।