নেকমরদ ইউনিয়ন
নেকমরদ | |
---|---|
ইউনিয়ন | |
![]() বাংলাদেশে নেকমরদ ইউনিয়নের অবস্থান | |
দেশ | বাংলাদেশ |
বিভাগ | রংপুর বিভাগ |
জেলা | ঠাকুরগাঁও জেলা |
উপজেলা | রাণীশংকৈল উপজেলা ![]() |
সময় অঞ্চল | বিএসটি (ইউটিসি+৬) |
নেকমরদ ইউনিয়ন বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁও জেলার অন্তর্গত রাণীশংকৈল উপজেলার একটি ইউনিয়ন।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার এক ছোট্ট জনপদ—নেকমরদ। আজকের দিনে এটি হয়তো একটি সাধারণ জায়গা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এর বুকের নিচে লুকিয়ে আছে এক হারিয়ে যাওয়া শহরের গল্প। একসময় খরস্রোতা কাইচা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই জনপদে ছিল এক সমৃদ্ধ সভ্যতা। কতখানি প্রাচীন সেই ইতিহাস? তার স্পষ্ট উত্তর পাওয়া কঠিন, কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, এটি একসময় এক গৌরবময় নগর ছিল।[১]
করবর্তন রাজ্যের রাজধানী?
[সম্পাদনা]নেকমরদকে ঘিরে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক অনুমান ও বিতর্ক। প্রখ্যাত গবেষক ড. দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে উত্তরবঙ্গের এক প্রাচীন নগর ‘করবর্তন রাজী’(করবর্তনকরবর্তন রাজ্য) বা ‘কর্মবাটন’-এর কথা উল্লেখ করেছেন। অনেকে মনে করেন, এই রহস্যময় নগরীর রাজধানী ছিল নেকমরদ। এর আশেপাশে পাওয়া দিঘি,মন্দির-মন্ডপমন্দির-মন্ডপ,পাথরপাথর-ব্রোঞ্জের প্রতিমাসহ অসংখ্য ছোটো বড়ো পাথরের নিদর্শন, নেকমরদের মাজারকে কেন্দ্র করে প্রায়প্রায় কুড়ি বর্গকিলোমিটার ব্যাপী প্রাচীন ধ্বংসাবশেষগুলো এবং মাজারের দেড় কিলোমিটার উত্তরে 'গড়' গ্রামের প্রাচীন দুর্গ সেই রাজধানীর ধারণাকে সমর্থন করে এবং একটি প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদের স্মৃতিই বহন করে।
নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালির ইতিহাস’(আদিপর্ব) গ্রন্থে বলেছেন, করবর্তন বা করপর্তন বা করমবর্তন ছিল এমন এক জায়গা, যেখানে প্রতিদিন সকালবেলা ১৫০০ টাঙ্গন ঘোড়া(টাট্টু ঘোড়া) বিক্রি হতো। দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে আজও টাঙ্গন ঘোড়ার খ্যাতি রয়েছে, এবং নেকমরদ বাজারকে কেন্দ্র করেই এই ব্যবসা পরিচালিত হতো বলে অনুমান করা হয় এবং ধারণা করা হয় এখান থেকেই লক্ষণাবর্তীর ঘোড়া কেনা হতো।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও গুপ্ত রহস্য
[সম্পাদনা]নেকমরদে পাওয়া গেছে দুর্গ, দিঘি, মন্দির-মণ্ডপ, পাথর ও ব্রোঞ্জের অসংখ্য প্রতিমা। ১৯৬৭ সালে নেকমরদ আলিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের সময় পাল বা সেন যুগের ব্রোঞ্জের দশটি প্রতিমা আবিষ্কৃত হয়। ধারণা করা হয়, মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের সময় স্থানীয় হিন্দুরা এই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রতিমাগুলো মাটির নিচে ও পুকুরে লুকিয়ে রেখে যান।
পুকুরটির ঘাটে দুটি বেলে পাথর রয়েছে, যার একটিতে নৃত্যরতা রমণীর প্রতিমা উৎকীর্ণ পাথরে নির্মিত বৃষের ভাঙা পাথরের বৃষমূর্তির অংশও দেখা যায়। একসময় পুকুরটি সংস্কারের সময় প্রস্তরের তৈরি বহু প্রতিমা আবিষ্কৃত হয়েছিল। পুকুরটির পূর্ব পাড়ে ৮'x৩'x৫' আয়তনের একটি গ্রানাইট পাথর পড়ে আছে, যা নেকমরদের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য গ্রানাইট পাথরের মতোই। ঐতিহাসিকভাবে, পাল-সেন যুগে কালো পাথরের ব্যবহার বেশি দেখা গেলেও, গুপ্ত যুগে গ্রানাইট ও বেলে পাথরের প্রচলন ছিল ব্যাপক। এসব প্রমাণ থেকে ধারণা করা যায় যে, গুপ্ত যুগেই নেকমরদে একটি সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে উঠেছিল।
পীর শাহ নেকমরদঃ ইতিহাস না কিংবদন্তি?
[সম্পাদনা]নেকমরদের আরেকটি রহস্যময় দিক হলো পীর শাহ নেকমরদের মাজার। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, “শেখ নাসির-উদ-দীন” নামে এক পুণ্যবান ব্যক্তি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তৎকালীন 'ভবানন্দপুর'(বর্তমান নেকমরদ) নামক গ্রামে আসেন(সম্ভবত সুলতানি আমলে অর্থাৎ ১৪ শতকের কোনো একসময়)। তিনি 'পীর শাহ নেকমরদ' নামে পরিচিত হন।যার নামেই বর্তমান নেকমরদের নামকরণ। শোনা যায় 'মুঘল সম্রাট খানকাহ' নেকমরদ এর উন্নয়নের জন্য ৭০০ বিঘা জমি দান করেন।
পীর শাহ নাসির উদ্দিন এর জীবন নিয়ে রয়েছে নানা কিংবদন্তি। কেউ বলেন, তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, কেউ বলেন, তিনি ছিলেন এক মহান সাধক।আরব থেকে যে সূফি সাধক(৩ জন) উত্তর বাংলায় শান্তির বাণী প্রচারে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ' সৈয়দ নাসির উদ্দীন' অন্যতম। কথিত আছে, তিনি যখন এ অঞ্চলে আসেন, তখন "ভীমরাজ" ও "পীতরাজ" নামে দুই অত্যাচারী রাজা এ জনপদ শাসন করতেন। পীর শাহ নেকমরদ তাঁদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং অলৌকিক শক্তিতে তাঁদের পরাজিত করেন। সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীর ওপরই গড়ে ওঠে বর্তমান নেকমরদ।
আবার অনেকে বলে, তিনি ভিমরাজের কাছে জায়গা চান বসবাসের জন্য। কিন্তু তিনি তাকে নদীর মধ্যে জায়গা দেখিয়ে দেন। পীর নদীর মাঝে গিয়ে জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়েন আর তখন পানির ভিতর থেকে মাটি উঠে আসে আর তার উপর তিনি ঘরবাড়ি তৈরি করেন।
আবার অনেকে ভিন্ন মত পোষণ করে বলেন যে, এই পীরের আসল নাম 'নাসির উদ্দীন পীর' তিনি যখন ভবানন্দপুর আসেন তখন এখানকার রাজা ছিল ভীমরাজ। সেই সময় এখানে একটি নদী ছিল। সেই নদী নেই কিন্তু বর্তমানে তার চিহ্ন আছে। বর্তমানে এখানে বড়ো খাল বা নালা আছে। পীর ভিমরাজার কাছে আশ্রয় চান কিন্তু তিনি আশ্রয় দেননি। রাজা নদীর মধ্যে জায়গা দেখিয়ে দেন। তখন পীর কলার পাতায় বসে রওনা হন মুনির দিকে। নদীর মধ্যখানে গিয়ে কলার পাতা আটকে যায়। তখন ঐখানে হঠাৎ করে বালুচর হয়ে যায়। পীর সিজদায় যান আর আশেপাশের সব রাজ প্রাসাদ ভেঙ্গে পড়ে। কিছু পানির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। যার ধবংশাবশেষ এখনো নালার মধ্যে পাওয়া যায়। তারপর থেকে পীর এখানে বসবাস শুরু করেন।
নেকমরদ মেলা: ইতিহাসের সাক্ষী
[সম্পাদনা]বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন মেলা ‘নেকমরদ ওরস মেলা’ প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় । ব্রিটিশ মানচিত্রবিদ রেনেল ১৭৬০ সালে তাঁর দিনাজপুর মানচিত্রে এই মেলার কথা উল্লেখ করেছেন, যা প্রমাণ করে যে এটি বহু শতাব্দী প্রাচীন।আবার ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত মেজর শের উইলের ভূমি নকশায় মেলাটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। একসময় এটি এক মাসব্যাপী চলতো, এখনো এটি তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়।
পূর্ণিয়া ও পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে আসত গরু, মহিষ ও ভেড়া, আর ময়মনসিংহ, সিলেট ও যমুনা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল থেকে আসত ঘোড়া, মহিষ ও উট। আসাম ও দার্জিলিং থেকে হাতি আসত, যা কিনতেন স্থানীয় জমিদারগণ।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও কাশ্মীর থেকে সওদাগরেরা উটের পিঠে শুকনা ফল, কারুকার্য খচিত ঘোড়ার জিন, ছোরা, তরবারি ও স্ফটিক আয়না আনত। শিখেরা হাতির দাঁত, চন্দন ও কাঠের চিরুনি, পাহাড়ীয়ারা কাজল, মৃগনাভি, গরম বস্ত্র, বাদাম ও চামরী গাভীর লেজ, নেপালীরা কুকুরি ও চিরতাপাতা, আর দিনাজপুরের ব্যবসায়ীরা মুক্তার মালা, রেশমি কাপড় ও টাঙ্গন ঘোড়া বিক্রি করত। মেলায় উট, দুম্বা ও ঘোড়া বেচাকেনার মূল আকর্ষণ ছিল। বিশেষত, তেজস্বী টাঙ্গন ঘোড়া কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে জমিদার ও সৌখিন সওয়াররা আসতেন।
প্রাচীনকালে মেলাটি প্রায় দশ বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং পানি সরবরাহের জন্য পাঁচশো গভীর কুয়া খনন করা হয়েছিল।পীর শাহ্ নেকমরদ (রঃ)-এর ইসলাম প্রচারের জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেব ওয়াকফ হিসেবে প্রায় সাতশো বিঘা জমি দান করেন। ওয়াকফের আয় থেকেই আস্তানার ব্যয় নির্বাহ হতো এবং মেলাটিও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। পীরের আধ্যাত্মিক প্রভাব ও মর্যাদার কারণে এই মেলা সর্বত্র প্রসিদ্ধি লাভ করে।
এটি কেবল বাণিজ্যিক মেলা নয়, বরং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। বর্তমানে মেলাটি এক মাস ধরে চলে, যেখানে যাত্রাপালা, সার্কাস, চলচ্চিত্র তারকাদের আগমন, খেলনা, কাপড় ও খাবারের দোকান সারাদিন-রাত খোলা থাকে। আশপাশের মানুষ সারা বছরের অপেক্ষার পর এই মেলায় আনন্দ উপভোগ করে।
শেষ কথা
[সম্পাদনা]নেকমরদ শুধুই একটি জনপদের নাম নয়, এটি এক হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। এর ধ্বংসাবশেষের নিচে লুকিয়ে রয়েছে এক গৌরবময় নগরীর স্মৃতি, সুফি সাধকদের কাহিনি, আর এক বিস্মৃত সভ্যতার চিহ্ন। আজকের দিনে আমরা যা দেখি, তা কেবলমাত্র সেই ইতিহাসের একটি ক্ষীণ ছায়ামাত্র। কিন্তু প্রতিটি ইট, প্রতিটি পাথর যেন আমাদের ফিসফিসিয়ে বলে যায়—নেকমরদের গল্প এখনো শেষ হয়নি...
অবস্থান ও সীমানা
[সম্পাদনা]রাণীশংকৈল উপজেলা সদর হতে ৯ কিলোমিটার উত্তরে নেকমরদ ইউনিয়ন অবস্থিত৷
আয়তন
[সম্পাদনা]
নেকমরদ ইউনিয়নের আয়তন প্রায় ৩৮.১৯ বর্গ কিলোমিটার৷
জনসংখ্যা
[সম্পাদনা]ক্রম নং | গ্রাম | জনসংখ্যা |
---|---|---|
০১ | চন্দনচহট | ২৯৪৯ |
০২ | দূর্লভপুর | ২৩৯১ |
০৩ | বামনবাড়ী | ৬৭০ |
০৪ | পারকুন্ডা | ১৭৯৬ |
০৫ | ভবানন্দপুর | ৪৯৮৬ |
০৬ | ঘনশ্যামপুর | ২২০৬ |
০৭ | যদুয়ার | ১২৪১ |
০৮ | ভবানীপুর | ৯৭৪ |
০৯ | গন্ডগ্রাম | ১৪৪৫ |
১০ | করনাইট | ৩৩৯৭ |
১১ | ভকরগাঁও | ১১৬০ |
১২ | ফরিদপাড়া | ৯৭৮ |
১৩ | আলশিয়া | ১১৩৫ |
১৪ | গোরকই | ৪৪৯ |
১৫ | নারায়নপুর | ৭৮৬ |
প্রশাসনিক অবকাঠামো
[সম্পাদনা]ইউনিয়ন চেয়ারম্যানগণের তালিকা
[সম্পাদনা]ক্রম নং | চেয়ারম্যানের নাম | সময়কাল |
---|---|---|
০১ | একেএম কলিম উদ্দীন | |
০২ | মোঃ শাহাদত মোস্তফা | |
০৩ | মোঃ গোলাম মোস্তফা | |
০৪ | মোঃ দবিরুল ইসলাম | |
০৫ | আলহাজ্ব মোঃ এনামুল হক | |
০৬ | আলহাজ্ব মোঃ এনামুল হক | |
০৭ | আলহাজ্ব আবুল হোসেন | |
০৮ | আলহাজ্ব মোঃ এনামুল হক | |
০৯ | আলহাজ্ব আবুল হোসেন |
দর্শনীয় স্থান
[সম্পাদনা]- পীর নাছিরউদ্দীন শাহ্ এর মাজার শরীফ
- গোরকই মন্দির
শিক্ষা
[সম্পাদনা]শিক্ষার হার ২৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ৷
নদ-নদী
[সম্পাদনা]অর্থনীতি
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা “ঠাকুরগাঁও”। বাংলা একাডেমি। আইএসবিএন 9840751166।