মহাবিহার

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

মহাবিহার (Mahāvihāra) হলো সংস্কৃতপালি ভাষায় ব্যবহৃত বৃহদাকার বিহারের বা বৌদ্ধ ধর্মীয় মঠের প্রচলিত নাম। মূলত বৃহৎ বা একাধিক বিহারের কমপ্লেক্সকে নির্দেশ করতে "মহাবিহার" শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

ভারতের মহাবিহারসমূহ[সম্পাদনা]

প্রাচীন মগধে (বর্তমান বিহারবাংলা) বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার গড়ে ওঠে। তিব্বতীয় সূত্রানুসারে পাল সাম্রাজ্যের সময় ভারতের পাঁচটি মহাবিহার হলো: বিক্রমশিলা (বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়), নালন্দা (বিশ্বের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়), সোমপুর, ওদন্তপুরী ও জগদ্দল।[১] এই পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় একত্রে একটি নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করত। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি পাল রাজাদের তত্ত্বাবধানে থাকায় এগুলোর মধ্যে সমন্বয় ছিল। পাল সাম্রাজ্যের সময়ে পূর্ব ভারতের এই বিহারগুলো মূলত পরস্পর সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান ছিল। বিহারগুলোর আচার্যরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতেন এবং বিখ্যাত পণ্ডিতেরা পদবীর ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থানান্তরিত হতেন।[২]

নালন্দা[সম্পাদনা]

বিখ্যাত নালন্দা মহাবিহার বেশ কয়েক শতাব্দী পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এই মহাবিহারের অসাধারণত্ব এবং চাকচিক্যের বর্ণনা করেছেন। বেশ কিছু তিব্বতীয় ও চীনা মাধ্যমে এই বিহার সম্পর্কে জানা যায়। পাল রাজাদের আমলে খুব সম্ভবত নালন্দা বিশেষভাবে খুব কমই অসাধারণত্বের পরিচয় দিয়েছিল, যার কারণে নালন্দা থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা পাল রাজাদের অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যেত।[৩] তবুও, নালন্দা মহাবিহারের খ্যাতি পালযুগের পরেও স্থায়ী হয়েছিল।

ওদন্তপুরী[সম্পাদনা]

ওদন্তপুরী, ওদন্তপুরা বা উদ্দন্তপুর বর্তমান ভারতের বিহারে অবস্থিত একটি প্রাচীন মহাবিহার। খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দীতে পাল রাজা গোপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। মগধে স্থাপিত ওদন্তপুরীকে ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বর্তমানে বিহারটি নালন্দা জেলার সদর বিহার শরীফে অবস্থিত। বিক্রমশিলার বিখ্যাত আচার্য শ্রীগঙ্গা এই বিহারের শিক্ষার্থী ছিলেন৷ তিব্বতীয় নথি অনুসারে ওদন্তপুরীতে প্রায় ১,২০০ শিক্ষার্থী ছিলেন৷ মহাবিহারটি পঞ্চানন নদীর তীরে হিরণ্য প্রভাত পর্বতে অবস্থিত ছিল।

বিক্রমশিলা[সম্পাদনা]

তিব্বতে প্রাপ্ত নথিতে বিক্রমশিলা নামে একটি বৌদ্ধ বিহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। পাল রাজা ধর্মপাল এই বিহারের প্রতিষ্ঠাতা। বিহারটি বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের ভাগলপুর জেলার আন্তিচক গ্রামে অবস্থিত। এই মহাবিহারে প্রায় ১০৭টি মন্দির এবং ১০৮ জন ভিক্ষুর জন্য আরও ৫০টি স্থাপনা ছিল। তৎকালে আশেপাশের রাজ্যগুলো থেকেও পণ্ডিতেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন।

বাংলাদেশের মহাবিহারসমূহ[সম্পাদনা]

সোমপুর মহাবিহার[সম্পাদনা]

সোমপুর মহাবিহার

সোমপুর মহাবিহার বাংলাদেশের মহাস্থানগড় থেকে ৪৬.৫ কিলোমিটার দূরে পাহাড়পুরে অবস্থিত। ধারণা করা হয় পাল রাজা ধর্মপাল বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর কেন্দ্রীয় মন্দিরে প্রথাগত ক্রুশাকৃতির স্থাপত্যের অনুদরণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বিচারালয়ের পাশে প্রায় ১৭৭টি প্রকোষ্ঠ ছিল। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে কেন্দ্রীয় ব্লক ছিল। এগুলোকে পরিপূরক উপাসনালয় বলে মনে করা হয়। এ ধরনের বিহারের মধ্যে সোমপুর ছিল অগ্রণী এবং এর খ্যাতি খ্রিষ্টীয় একদশ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল।

জগদ্দল[সম্পাদনা]

জগদ্দল মহাবিহার উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র ছিল।[৪] পাল সাম্রাজ্যের শেষ দিকের রাজা রামপাল (আনু. ১০৭৭ – আনু. ১১২০) এই বিহার প্রতিষ্ঠা করেন বলে ধারণা করা হয়। জগদ্দল বিহার বর্তমান উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশে ভারত-সীমান্তবর্তী ধামইরহাট উপজেলায়, পাহাড়পুর বিহারের নিকটে অবস্থিত।[৫]

শালবন বিহারব[সম্পাদনা]

শালবন বিহার

ভবদেব বিহার নামেও পরিচিত এই মহাবিহারটি ৭ম থেকে ১২শ শতাব্দীতে খ্যাতির শীর্ষে ওঠে।[৬] বিহারটি রাজা ভবদেব কর্তৃক লালমাই পাহাড়ে (বর্তমান কুমিল্লা, বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠিত হয়।

শ্রীলঙ্কার মহাবিহার[সম্পাদনা]

অনুরাধাপুরা মহাবিহারায় (পালি ভাষায় মহাবিহার) শ্রীলঙ্কায় থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ বিহার। রাজা দেবনামপিয়া তিসসা (খ্রিষ্টপূর্ব ২৪৭–২০৭) রাজধানী অনুরাধাপুরায় বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিহার‍টি বুদ্ধঘোষ প্রভৃতি ভিক্ষু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মহাবিহার ধ্যানধারণার কেন্দ্রে পরিণত হয়। পঞ্চম শতাব্দীর প্রথমার্ধে (খ্রিষ্টীয় ৩৯৯ থেকে ৪১৪) ভারত ও শ্রীলঙ্কা পরিভ্রমণকারী চীনা ভিক্ষু ও পরিব্রাজক ফা হিয়েনের (চীনা 法顯) বর্ণনার সাথে মহাবংশ প্রবর্তিত থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের পার্থক্য দেখা যায়। মহাবিহারটি শুধু সম্পূর্ণই ছিল না, এতে প্রায় ৩০০০ ভিক্ষু বাস করতেন।[৭]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Vajrayogini: Her Visualization, Rituals, and Forms by Elizabeth English. Wisdom Publications. আইএসবিএন ০-৮৬১৭১-৩২৯-X pg 15
  2. Buddhist Monks And Monasteries Of India: Their History And Contribution To Indian Culture. by Dutt, Sukumar. George Allen and Unwin Ltd, London 1962. pg 352-3
  3. Buddhist Monks And Monasteries Of India: Their History And Contribution To Indian Culture. by Dutt, Sukumar. George Allen and Unwin Ltd, London 1962. pg 344
  4. Buddhist Monks And Monasteries Of India: Their History And Contribution To Indian Culture. by Dutt, Sukumar. George Allen and Unwin Ltd, London 1962. pg 377
  5. UNESCO World Heritage website
  6. এম হারুনুর রশীদ (২০১২)। "শালবন বিহার"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  7. "Chapter XXXIX: The Cremation of an Arhat"A Record of Buddhistic Kingdoms। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৪-৩০ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]