ইসলামে আরবি ভাষা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ইসলাম ধর্মে আরবি ভাষা কে অন্য যে কোন ভাষার থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যার কারণ হল ইসলামের মূল ধর্মীয় উৎস কোরআনহাদীসের ভাষা হল আরবি, যাকে কুরআনীয় আরবি বলে ডাকা হয়।

কোরআনে[সম্পাদনা]

কুরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ বলেন,

‘সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি।’

— সুরা শুআরা : ১৯৫

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আবুল হুসাইন আহমদ বিন ফারেস বলেন,

‘আল্লাহ কোরআনকে বয়ান বা সুস্পষ্ট শব্দ দিয়ে অভিহিত করেছেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, অন্য ভাষায় এ বৈশিষ্ট্য নেই এবং মানমর্যাদায় আরবি ভাষা সব ভাষার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’ আস সাহিব ফি ফিকহিল লুগাহ : ৪/১[১]

হাদীসে[সম্পাদনা]

রাসূল (সা.) বলেছেন,

مَنْ ‌قَرَأَ ‌حَرْفًا ‌مِنْ ‌كِتَابِ ‌اللَّهِ ‌فَلَهُ ‌بِهِ ‌حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ

‘আল্লাহ তাআলার কিতাবের একটি হরফ যে ব্যক্তি পাঠ করবে তার জন্য এর সওয়াব আছে। আর সওয়াব হয় তার দশ গুণ হিসেবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ।’

— [সুনানে তিরমিযি, হাদিস: ২৯১০]

অধিকাংশ মুসলিম আলেম ইসলামী নবী মুহাম্মদের উক্ত হাদীসটি পেশ করে করেন ও কুরআনীয় শব্দ বলায় প্রতি হরফে দশ নেকি প্রাপ্তির কথা থাকার কারণে অনারবীয় ও আরবীয় উভয় ভাষায় মূল ইসলামী আরবী শব্দ "আল্লাহ" (ﷲ), নবী" (نبي), "রাসূল" (رسول), "মালাইকা" (ملاءكة‎‎)"জান্নাত" (جنّة‎‎), "জাহান্নাম" (جهنم‎‎) ইত্যাদি এর ব্যবহারকে অধিক উৎসাহিত করে থাকেন, যুক্তি হিসেবে তারা বলেন, আল্লাহ শব্দটি কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই শব্দটি বলার সময় প্রতি হরফে দশ নেকি করে সাওয়াব পাওয়া যাবে, "যা খোদা, সৃষ্টিকর্তা, ঈশ্বর, পয়গম্বর, ফেরেশতা, বেহেশত, দোযখ বা অন্যান্য অ-কুরআনীয় তথা অনারবীয় প্রতিশব্দ উচ্চারণে পাওয়া যাবে না"।

সালাফ ও আলেমদের অভিমত[সম্পাদনা]

উমর বিন খাত্তাব বলেন,

‘তোমরা আরবি ভাষা শেখো। তা তোমাদের দীনের অংশ।’।

— (মাসবুকুজ জাহাব ফি ফাদলিল আরব ওয়া শারফুল ইলমি আলা শারফিন নাসবি:১/৯)

[২]

[৩][৪] ইবনে তাইমিয়া বলেন,

আরবি ভাষা ইসলাম এবং এর জনগণের (মুসলিমদের) প্রতীক।

— ইকতিদা আল-সিরাত আল-মুস্তাকিম, ১/৫১৯ থেকে শেষ উদ্ধৃতি[৫]

তিনি আরও বলেন,

আল্লাহতায়ালা আরবি ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। আর প্রিয় নবী (সা.)-কে আরবি ভাষায় কোরআন-সুন্নাহ প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন। দ্বীনের প্রথম অনুসারীরা ছিল আরবি ভাষী। তাই দ্বীনের গভীর জ্ঞানার্জনের জন্য এই ভাষা আয়ত্তের বিকল্প নেই। আরবি চর্চা করা দ্বীনেরই অংশ ও দ্বীনের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক।’ মাজমুউল ফতোয়া : ৮/৩৪৩[২]

ইসলামী আলেমদের মতে, "আরবী ভাষার গুরুত্বের কারণ হলো, আরবি ভাষার অনেক সুবিধা এবং বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তবে যা এটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে তা হল এই ভাষায় প্রকাশিত ইসলাম ধর্মের সাথে এর সংযোগ। কুরআন নাযিলের সাথে আরবি ভাষার সংযোগ রয়েছে, যা সমস্ত মানুষের কাছে এসেছিল। ইসলামের আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় শুধুমাত্র আরবি ভাষায়। অভিব্যক্তিতে পরিশীলিততা, বক্তব্যে বাকপটুতা এবং শৈল্পিক চিত্রের প্রাচুর্যের সাথে আরবি ভাষার স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। আলেমদের মতে, আরবি ভাষা রক্ষা করা হল ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করা। একটি লিখিত পাঠ্যের সম্পূর্ণ বিবৃতি দেওয়া যায় শুধুমাত্র আরবি ভাষায়, এবং তাই কুরআন এটি ছাড়া অবতীর্ণ হয়নি। ক্রমাগত আরবি ভাষায় কথা বলা মন, ধর্ম এবং নৈতিকতার উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। আরবী ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতা সঠিক ধর্ম থেকে বিচ্যুতির অন্যতম কারণ। আরবি ভাষা একটি প্রাচীন, স্থির এবং ঐতিহাসিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ভাষা।"[৬]

নামাজ আরবিতে পড়ার কারণ[সম্পাদনা]

আহমেদ হুসাইন শরীফ তার "হোয়াই প্রে ইন এরাবিক" (নামাজ কেন আরবিতে পড়া হয়?) বইতে আরবিতে নামাজ পড়ার পেছনে যে সকল কারণ বলেছেন তা হল,

  1. আরবি হল একটি গভীর ও বিস্তৃত ভাষা
  2. নামাজের জন্য একটি সাধারণ ও সার্বজনীন ভাষা
  3. (আরবির মাধ্যমে) ইসলামী ভ্রাতৃত্বে সংযোগ স্থাপন।
  4. কুরআন হল আল্লাহর সৃজনকর্ম
  5. কুরআনের পূর্নাঙ্গ ও পরিপূর্ণ অনুবাদ করা অসম্ভব
  6. কুরআনই একমাত্র (ঐশীভাবে) সংরক্ষিত ওহী
  7. কুরআনের নিজস্ব ছন্দ রয়েছে
  8. দোয়া এবং নামাজের পার্থক্য হলোঃ দোয়া হল আমন্ত্রণ বা মিনতি, যা ঐচ্ছিক, তাই তা শিথিল এবং তা যে কোন ভাষায় করা যায়, আর নামাজ হলো প্রার্থনা, যা বাধ্যতামূলক ও তার নীতিমালা কঠোর, এছাড়া জামাতে ফরজ নামাজের ক্ষেত্রে মুসলিমদের সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত রাখারও বাধ্যবাধকতা রয়েছে, একারণে নামাজ শুধু আরবিতে পড়তে হয়।
  9. আরবি নামাজ বুঝতে শেখা কঠিন কিছু নয় এবং তা সহজ।

পরিশেষে তিনি বলেন, "এইভাবে আমরা দেখতে পাই যে, নামাজের মাধুর্য, মর্যাদা, সৌন্দর্য এবং আধ্যাত্মিকতা মূল আরবীতে নামাজ পড়ার উপর নির্ভর করে; এবং যদি অনুবাদে নামাজ পড়া হয়, তবে কুরআনের সাহিত্যিক এবং শৈল্পিক মূল্যবোধ হারিয়ে যেতে বাধ্য; এবং অনূদিত নামাজের ফলে সর্বপ্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব।"[৭]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. উবাইদুল্লাহ, মুনশি মুহাম্মদ (১৮ ডিসেম্বর ২০২১)। "আরবি ভাষার গুরুত্ব"দেশ রূপান্তর। সংগ্রহের তারিখ ২৩ নভেম্বর ২০২২ 
  2. উবাইদুল্লাহ, মুনশি মুহাম্মদ (২৪ ডিসেম্বর ২০২১)। "আরবি ভাষার গুরুত্ব"দৈনিক ইত্তেফাক। সংগ্রহের তারিখ ২৩ নভেম্বর ২০২২ 
  3. ইউসুফ, মাহমুদ (২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)। "আরবিই পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা"দৈনিক ইনকিলাব (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৩ নভেম্বর ২০২২ 
  4. রশীদ, মো. হারুনুর (১৮ ডিসেম্বর ২০২১)। "আরবি ভাষা শেখায় মহানবী (সা.) যেভাবে উৎসাহ দিয়েছেন | কালের কণ্ঠ"কালের কণ্ঠ 
  5. "Virtue of teaching Arabic - Islam Question & Answer"islamqa.info (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৩ নভেম্বর ২০২২ 
  6. "أهمية اللغة العربية في الإسلام"موضوع (আরবি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১২ নভেম্বর ২০২২ 
  7. Sheriff, Ahmed H. (১ জানুয়ারি ১৯৯১)। Why Pray in Arabic? (ইংরেজি ভাষায়)। Bilal Muslim Mission of Tanzania। সংগ্রহের তারিখ ১১ নভেম্বর ২০২২ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]