মহাগণপতি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রীতত্ত্বনিধি পুথিচিত্রে মহাগণপতি। এই ছবিটিতে দশভূজ মহাগণপতির স্ত্রী রূপে এক দেবীকেও দেখা যায়।

মহাগণপতি (সংস্কৃত: महागणपति, mahā-gaṇapati, আক্ষরিক অর্থে "মহৎ গণেশ"[১]) হলেন হিন্দু দেবতা গণেশের একটি বিশেষ রূপ। এই রূপটি গণেশের পরম দৈবসত্ত্বা ব্রহ্মের রূপকল্প এবং গণেশ-উপাসক গাণপত্য সম্প্রদায়ের প্রধান উপাস্য দেবতা। গণেশের ৩২টি রূপের মধ্যে এই রূপটি একটি বিশেষ জনপ্রিয় রূপ।

মূর্তিলক্ষণ[সম্পাদনা]

গণেশের অন্যান্য সকল রূপের ন্যায় মহাগণপতিও গজানন বা হস্তীমুণ্ডবিশিষ্ট। তাঁর গাত্রবর্ণ সিন্দূর[২] অথবা নবোদিত সূর্যের অনুরূপ।[১] অধিকাংশ মূর্তিলক্ষণ শাস্ত্রে তাঁর ললাটে তৃতীয় নয়ন, মস্তকে অর্ধচন্দ্র[১] ও দশভূজের উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাগণপতি তাঁর দশ হস্তে পদ্ম, দাড়িম্ব, গদা, চক্র, নিজের ভগ্ন দন্ত, পাশ, জলপূর্ণ রত্নময় কলস, নীলপদ্ম, ধান্যশীর্ষ ও ধনুকাকার ইক্ষুদণ্ড ধারণ করে থাকেন।[১][৩]

বিকল্প মূর্তিলক্ষণে মহাগণপতির হস্তে দাড়িম্বের পরিবর্তে আম্র, গদার পরিবর্তে শঙ্খ এবং জলপূর্ণ রত্নময় কলসের পরিবর্তে রত্নখচিত অমৃতকলসের উল্লেখ রয়েছে।[৪] একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, মহাগণপতির দশ হস্তে ধৃত দশটি বস্তু বিভিন্ন দেবতার উপহার। এই বস্তুগুলি সমগ্র দেবমণ্ডলীর উপর মহাগণপতির শ্রেষ্ঠত্বের এবং সকল দেবতার কর্ম সম্পাদনের যে ক্ষমতা মহাগণপতির রয়েছে, তারও প্রতীক।[৫] কোনও কোনও মূর্তিতে মহাগণপতির হস্তে বহুবীজসমন্বিত একটি জামির দেখা যায়, যা সৃষ্টিশক্তির প্রতীক তথা অপর হিন্দু দেবতা শিবের একটি রূপক। মহাগণপতির হস্তধৃত ইক্ষুদণ্ডটি প্রেমের দেবতা কামের রূপক এবং তীররূপী ধান্যশীর্ষটি দেবী ধরার (পৃথিবী) উপহার। এই ইক্ষুদণ্ড ও ধান্যশীর্ষ প্রজননশক্তি ও উর্বরতার প্রতীক। চক্র অপর হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রধান অস্ত্র এবং গদা বিষ্ণুর বরাহ অবতারের রূপক। কোনও কোনও মূর্তিতে রত্নখচিত কলসটিকে মহাগণপতির তুণ্ড বা শুঁড়ে দেখা যায়। এটি সম্পদের দেবতা কুবেরের রূপক তথা মহাগণপতি কর্তৃক প্রদত্ত সৌভাগ্য ও আশীর্বাদেরও প্রতীক।[৫]

টি. কে. গোপীনাথ রাও মহাগণপতিকে পঞ্চ শক্তিগণেশের অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শক্তিগণেশ হল গণেশের সেই রূপভেদগুলি, যে রূপে গণেশের সঙ্গে একজন শক্তি (স্ত্রী বা দিব্য সঙ্গিনী) বিরাজমানা থাকেন।[৬] মহাগণপতির বাম ক্রোড়ে যে শ্বেতবর্ণা দেবীকে দেখা যায়, তাঁর দক্ষিণ হস্তে থাকে পবিত্রতার প্রতীক পদ্ম এবং বাম হস্ত দ্বারা তিনি মহাগণপতিকে আলিঙ্গন করে থাকেন।[৩][৫] মথুরার দসবোদ্ধি গণেশ মন্দিরে মহাগণপতির শক্তিকে সম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী মহালক্ষ্মী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।[৭] অপর একটি ধর্মগ্রন্থে তার নাম পুষ্টি।[২] মহাগণপতি যে বামহস্তে নীলপদ্ম ধারণ করেন, সেই হস্তেই তিনি তাঁর শক্তিকে আলিঙ্গন করে থাকেন।[৪] এছাড়া অন্যান্য দেবদেবী ও অসুরেরা মহাগণপতিকে ঘিরে থাকেন।[৫]

পূজা[সম্পাদনা]

মহাগণপতি পরমসত্ত্বা পরব্রহ্মের রূপকল্প।[৫] তাই তিনি গণেশ-উপাসনাকেন্দ্রিক গাণপত্য সম্প্রদায়ের প্রধান উপাস্য। মহাগণপতি গণেশের বহুপরিচিত ও বহুপূজিত মূর্তিগুলির অন্যতমও বটে।[৫] এই মূর্তিটি আনন্দ, সম্পদ ও গণেশের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক।[৪]

মহাগণপতিকে গাণপত্য সম্প্রদায়ে ছ’টি প্রধান শাখার অন্যতম মহাগাণপত্য উপসম্প্রদায়ের রক্ষাকর্তা মনে করা হয়। এই উপসম্প্রদায়ের অনুগামীদের বিশ্বাস অনুযায়ী, মহাগণপতি হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকর্তা। তাঁদের মতে, ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির পূর্ব হতেই মহাগণপতির অস্তিত্ব রয়েছে এবং মহাপ্রলয়ের পরেও তাঁর অস্তিত্ব থাকবে। ব্রহ্মাণ্ড ও জীব সৃষ্টির কাজে সাহায্যের জন্য তিনিই ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁদের মতে, যিনি মহাগণপতির ধ্যান করেন, তিনিই সচ্চিদানন্দ লাভ করতে পারেন।[৮]

তন্ত্রমতে মহাগণপতি ছ’টি অভিচার ক্রিয়ার (মারণ, মোহন, স্তম্ভন, বিদ্বেষণ, উচ্চাটন ও বশীকরণ) সঙ্গে যুক্ত।[৯]

রঞ্জনগাঁও গণপতি মন্দিরে মহাগণপতির পূজা হয়। এই মন্দিরটি অষ্টবিনায়ক মন্দিরগুলির অন্যতম। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে, মহাগণপতি তার পিতা শিবকে ত্রিপুরাসুর বধে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু ত্রিপুরাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধারম্ভের পূর্বে শিব স্বীয় পুত্রের স্তুতি করতে ভুলে যান। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে মহাগণপতি শিবের রথটি নিষ্ক্রিয় করে দেন। শিবও নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং মহাগণপতির স্তুতি করেন। তারপর তিনি ত্রিপুরাসুরকে বধ করতে সক্ষম হয়।[১০]

পাদটীকা[সম্পাদনা]

  1. Subramuniyaswami p. 71
  2. Saligrama Krishna Ramachandra Rao (১৯৮৯)। Gaṇapati: 32 Drawings from a 19th Cent. Scroll। Karnataka Chitrakala Parishath। পৃষ্ঠা 18। 
  3. Rao p. 55
  4. Jagannathan, T. K. (২০০৯)। Sri Ganesha। Pustak Mahal। পৃষ্ঠা 106। আইএসবিএন 978-81-223-1054-2 
  5. Grewal pp. 120–1
  6. Rao p. 53
  7. Brown p. 134
  8. Bhandarkar p. 213
  9. Grewal pp. 122–3
  10. Grewal pp. 133–4

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]