বিষয়বস্তুতে চলুন

বেনেডিক্ট বিকারক

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বেনেডিক্ট পরীক্ষা
ইতিবাচক বেনেডিক্ট পরীক্ষা
শ্রেণীবর্ণমিতিক (কালারিমেট্রিক) পদ্ধতি
বিশ্লেষকবিজারক শর্করা বা রিডিউসিং সুগার

বেনেডিক্ট বিকারক (কিংবা বেনেডিক্টের গুণগত দ্রবণ বা বেনেডিক্টের দ্রবণও বলা হয়) হলো সোডিয়াম কার্বনেট, সোডিয়াম সাইট্রেট এবং কপার (II) সালফেট পেন্টাহাইড্রেটের একটি জটিল মিশ্রণ, যা রাসায়নিক বিকারক বা রিঅ্যাজেন্ট হিসেবে কাজ করে।[] এটি প্রায়ই বিজারক শর্করা বা রিডিউসিং সুগারের উপস্থিতি শনাক্ত করতে ফেহলিং দ্রবণের স্থলে ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য বিজারক পদার্থের উপস্থিতিতেও এটি ইতিবাচক ফলাফল দেয়।[] বেনেডিক্টের বিকারক ব্যবহার করে এই ধরনের পরীক্ষাকে বেনেডিক্টের পরীক্ষা বলা হয়। বেনেডিক্টের বিকারকের সাথে ইতিবাচক পরীক্ষায় পরিষ্কার নীল রঙ বদলে গিয়ে ইটের মতো লাল রঙের অধক্ষেপ তৈরি হয়। এই বর্ণ পরিবর্তনের মাধ্যমে বিজারক শর্করা শনাক্ত করা যায়।

সাধারণত বেনেডিক্টের পরীক্ষা অ্যালডিহাইড গ্রুপ, আলফা-হাইড্রক্সি-কিটোন এবং হেমিয়াসিটালের উপস্থিতি শনাক্ত করে, যেগুলি নির্দিষ্ট কিটোজে ঘটে। এইভাবে, কিটোজ ফ্রুক্টোজ প্রখর রিডিউসিং সুগার না হলেও এটি একটি আলফা-হাইড্রক্সি-কিটোন হওয়ায় এই পরীক্ষায় ইতিবাচক ফলাফল দেয়। কারণ বেনেডিক্টের রিএজেন্টের মূল উপাদান এটিকে অ্যালডোজে গ্লুকোজ ও ম্যানোজে রূপান্তরিত করে। বিকারকের কিউপ্রিক (Cu2+) কমপ্লেক্স দ্বারা রিডিউসিং সুগারকে জারণ করলে একটি কিউপ্রাস (Cu+) উৎপন্ন হয়, যা অদ্রবণীয় লাল কপার (I) অক্সাইড (Cu2O) হিসাবে অধঃক্ষিপ্ত হয়।[]

এই পরীক্ষার নামকরণ করা হয়েছে আমেরিকান রসায়নবিদ স্ট্যানলি রোসিটার বেনেডিক্টের নামে।[]

উপাদন ও প্রস্তুতি

[সম্পাদনা]

বেনেডিক্টের বিকারক হল একটি গাঢ়-নীল জলীয় দ্রবণ। প্রতিটি লিটারে রয়েছে:[] ১৭.৩ গ্রাম কপার সালফেট, ১৭৩ গ্রাম সোডিয়াম সাইট্রেট এবং ১০০ গ্রাম অ্যানহাইড্রাস সোডিয়াম কার্বনেট অথবা, সমানভাবে ২৭০ গ্রাম সোডিয়াম কার্বনেট ডেকাহাইড্রেট।

বিকারকগুলির পৃথক পৃথক দ্রবণ তৈরি করা হয়। সোডিয়াম কার্বনেট এবং সোডিয়াম সাইট্রেট প্রথমে মিশ্রিত করা হয়, এবং তারপর ক্রমাগত নাড়াচাড়া করতে করতে এর সাথে ধীরে ধীরে কপার সালফেট যোগ করা হয়।

সোডিয়াম সাইট্রেট একটি কমপ্লেক্সিং এজেন্ট হিসাবে কাজ করে, যা দ্রবণে Cu2+ রাখে, কারণ এটি অন্যথায় অধক্ষেপ তৈরি করবে। সোডিয়াম কার্বনেট দ্রবণকে ক্ষারীয় রাখতে কাজ করে। হালকা রিডিউসিং অ্যাজেন্টের উপস্থিতিতে, কপার (II) আয়ন বা কিউপ্রিক আয়ন বিজারিত হয়ে কপার (I) বা কিউপ্রাস আয়নে পরিণত হয়। এটি ক্ষারীয় অবস্থায় অত্যন্ত সুস্পষ্ট লাল বর্ণের কপার (I) অক্সাইড হিসাবে অধঃক্ষিপ্ত হয়।

জৈব বিশ্লেষণ

[সম্পাদনা]

খাবারে মনোস্যাকারাইড এবং বিজারক ডিস্যাকারাইডের উপস্থিতি পরীক্ষা করার জন্য খাবারের নমুনা পানিতে দ্রবীভূত করে অল্প পরিমাণে বেনেডিক্টের বিকারক যোগ করা হয়। মিশ্রণটিকে ওয়াটার বাথে সাধারণত ৪-১০ মিনিট গরম করার সময় দ্রবণটি নীল রঙের (কোনও রিডিউসিং সুগারের উপস্থিতি নেই) মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে কমলা, হলুদ, সবুজ, লাল এবং তারপরে ইটের মতো লাল বা বাদামী অধঃক্ষেপ (যদি রিডিউসিং সুগারের উচ্চ ঘনত্ব উপস্থিত থাকে) তৈরি করে থাকে। রঙের এই পরিবর্তন কোনো একটি রিডিউসিং সুগার বা বিজারক শর্করার উপস্থিতি নির্দেশ করবে।[]

পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ অনুমান
পানিতে নমুনা পদার্থ + ৩ মিলি বেনেডিক্টের দ্রবণ, তারপর কয়েক মিনিটের জন্য ফুটিয়ে এবং ঠান্ডা করা হয়। লাল, সবুজ বা হলুদ অধঃক্ষেপ পাওয়া যায় রিডিউসিং সুগার, যেমন গ্লুকোজ, উপস্থিত
পানিতে নমুনা পদার্থ + ৩ মিলি বেনেডিক্টের দ্রবণ, তারপর কয়েক মিনিটের জন্য ফুটিয়ে এবং ঠান্ডা করা হয়। দ্রবণ পরিষ্কার থাকে বা সামান্য নীল হয় রিডিউসিং সুগার অনুপস্থিত

সাধারণ ডিস্যাকারাইড ল্যাকটোজ এবং মল্টোজ সরাসরি বেনেডিক্টের বিকারক দ্বারা শনাক্ত করা হয় কারণ প্রতিটিতে আইসোমারাইজেশনের পরে একটি মুক্ত রিডিউসিং অ্যালডিহাইড ময়েটি সহ একটি গ্লুকোজ থাকে।

সুক্রোজ (খাবার চিনি) দুটি শর্করা (ফ্রুক্টোজ এবং গ্লুকোজ) ধারণ করে তাদের গ্লাইকোসিডিক বন্ড দ্বারা এমনভাবে যুক্ত হয় যাতে গ্লুকোজকে অ্যালডিহাইডে আইসোমারাইজেশন বা ফ্রুক্টোজ থেকে আলফা-হাইড্রক্সি-কিটোন গঠনে বিরত থাকে। সুক্রোজ একারণে একটি অ-বিজারক শর্করা, যা বেনেডিক্টের বিকারকের সাথে বিক্রিয়া করে না। যাইহোক, সুক্রোজ পরোক্ষভাবে বেনেডিক্টের রিএজেন্টের সাথে একটি ইতিবাচক ফলাফল দেয়, যদি পরীক্ষার আগে পাতলা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড দিয়ে উত্তপ্ত করা হয়। যদিও এসময় সুক্রোজে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে কারণ অম্লীয় অবস্থা ও তাপ আর্দ্র বিশ্লেষণ বা হাইড্রোলাইসিসের মাধ্যমে সুক্রোজের গ্লাইকোসিডিক বন্ধন ভেঙে দেয়। সুক্রোজ ভেঙে উৎপন্ন শর্করাগুলো হলো গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ। উভয়ই উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে বেনেডিক্টের বিকারকের মাধ্যমে শনাক্ত করা যেতে পারে।

কার্বোহাইড্রেট শিকলের শেষ প্রান্তে রিডিউসিং সুগারের উপাদানগুলির সংখ্যা কম হওয়ার কারণে স্টার্চ বা শ্বেতসা বেনেডিক্টের বিকারকের সাথে বিক্রিয়া করে না বা খুবই সামান্য বিক্রিয়া দেখায়। অন্যান্য যেসব কার্বোহাইড্রেট এই পরীক্ষায় নেতিবাচক ফলাফল দেয় তার মধ্যে রয়েছে ইনোসিটল।

বেনেডিক্টের বিকারক মূত্রে গ্লুকোজের উপস্থিতি (এর উচ্চ মাত্রা গ্লুকোসুরিয়া নামে পরিচিত) পরীক্ষা করার জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। গ্লুকোসুরিয়া ডায়াবেটিস মেলিটাসের নির্দেশক হতে পারে। তবে বেনেডিক্টের পরীক্ষাটি পূর্বোক্ত অবস্থা নির্ণয়ের জন্য সুপারিশ করা বা ব্যবহার করা হয় না। কারণ এক্ষেত্রে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড, ওষুধ (লেভোডোপা, রেডিওলজিক্যাল পদ্ধতিতে ব্যবহৃত কনট্রাস্ট) এবং হোমোজেন্টিসিক অ্যাসিডের (আলকাপটোনুরিয়া) মতো অন্যান্য বিজারক পদার্থের উপস্থিতি্তে একটি মিথ্যা মিথ্যা ইতিবাচক ফলাফল দিবে।

দ্রবণে উপস্থিত শর্করার পরিমাণ অনুমান করতে প্রাপ্ত অধঃক্ষেপের রঙ ব্যবহার করা যেতে পারে। এই পরীক্ষাটি অর্ধ-পরিমাণগত। একটি সবুজাভ অধঃক্ষেপ প্রায় ০.৫ গ্রাম% ঘনত্ব নির্দেশ করে; হলুদ অধঃক্ষেপ ১ গ্রাম% ঘনত্ব নির্দেশ করে; কমলা ১.৫ গ্রাম% ঘনত্ব নির্দেশ করে; এবং লাল ২ গ্রাম% বা উচ্চতর ঘনত্ব নির্দেশ করে।

পরিমাণগত বিকারক

[সম্পাদনা]

বেনেডিক্টের পরিমাণগত বিকারক পটাসিয়াম থায়োসায়ানেট ধারণ করে এবং এটি পরিমাণগতভাবে রিডিউসিং সুগারের ঘনত্ব নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়।[] এই দ্রবণটি একটি কপার থায়োসায়ানেট অধঃক্ষেপ তৈরি করে যা সাদা এবং টাইট্রেশনে ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্রমাঙ্কনের জন্য নমুনার পরিবর্তে ১% গ্লুকোজ দ্রবণ দিয়ে টাইট্রেশন পুনরাবৃত্তি করা উচিত।

নেট বিক্রিয়া

[সম্পাদনা]

বেনেডিক্টের দ্রবণে একটি অ্যালডিহাইড (বা একটি আলফা-হাইড্রক্সি-কিটোন) এবং কপার (II) আয়নগুলির মধ্যে নেট বিক্রিয়া এভাবে লেখা হতে পারে:

RCHO + 2 Cu+2 + 5 OH → RCOO + Cu2O + 3 H2O

সোডিয়াম কার্বনেট পানিতে দ্রবীভূত হলে সমীকরণের হাইড্রক্সাইড আয়ন তৈরি হয়। সাইট্রেট অন্তর্ভুক্ত করা হলে বিক্রিয়াটি হয়:

RCHO + 2 Cu(C6H5O7) + 5 OH → RCOO + Cu2O + 2 C6H5O3−7 + 3 H2O[]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]
  • ডেক্সট্রোজ সমতুল্য

অন্যান্য জারক বিকারক

অন্যান্য বিজারক বিকারক

  • জোন্স রিডাক্টর
  • ওয়াল্ডেন রিডাক্টর

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Robert D. Simoni; Robert L. Hill (২০০২)। "Benedict's Solution, a Reagent for Measuring Reducing Sugars: the Clinical Chemistry of Stanley R. Benedict": 10–11। ডিওআই:10.1016/S0021-9258(19)61050-1অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  2. Collins Edexcel International GCSEBiology, Student Book (আইএসবিএন ৯৭৮-০-০০-৭৪৫০০০-৮ISBN 978-0-00-745000-8) p.42-43
  3. "Carbohydrates - Benedict's Test"dept.harpercollege.edu। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-০৮ 
  4. Benedict, S. R. (১ জানুয়ারি ১৯০৯)। "A Reagent For the Detection of Reducing Sugars": 485–487। ডিওআই:10.1016/S0021-9258(18)91645-5অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  5. "Benedict's Test- Objectives, Principle, Procedure, Results"। ২১ এপ্রিল ২০২১। 

টেমপ্লেট:বিশ্লেষণী বিকারক টেমপ্লেট:জৈব বিক্রিয়া