জগন্মোহনী বাউল মতবাদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

জগন্মোহনী বাউল মতবাদ একটি দর্শন যা বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু অঞ্চলে প্রচলিত। এরা মূলতঃ বৈষ্ণব ধর্মীয় বিশ্বাসে জড়িত।

উৎপত্তি[সম্পাদনা]

এই মতবাদের উৎপত্তি ১৪'দশ শতকে বাংলাদেশের সিলেটের হবিগঞ্জে

নামকরণ[সম্পাদনা]

জগন্মোহন গোসাঁই নামীয় একজন বাউল সাধক কর্তৃক এই মতবাদের উৎপত্তি ঘটে বলে একে “জগন্মোহনী বাউল মতবাদ” বলে অভিহিত করা হয়। তিনি উৎকলের(উড়িষ্যা) একজন রামানন্দী (রামানন্দ) বৈষ্ণবের নিকট দীক্ষা লইয়া ভেক ধারণ করেন। জগন্মোহনের শিষ্য গোবিন্দ গোসাঁই,তার শিষ্য শান্ত গোসাঁই,শান্তের শিষ্য রামকৃষ্ণ গোসাঁই। জগন্মোহনী বাউল ভক্তদের হিসাব অনুসারে হাজার-হাজার লোক এই সম্প্রদায়ে সন্নিবিষ্ট আছে।

বিশ্বাস[সম্পাদনা]

ইহারা নির্গুণ উপাসক কোন সাকার দেবতার উপাসনা করে না। কিন্তু,দীক্ষা গুরুকে স্বাক্ষাত ভগবান বলিয়া স্বীকার করে। তিনি মূর্তিমান ঈশ্বর,তিনিই শিষ্যগনের ত্রান কর্তা। ইহারা দীক্ষাকালে "গুরু সত্য" এই বাক্য উচ্চারন পূর্বক গুরুকেই প্রত্যক্ষ পরম দেবতা বলীয়া স্বীকার ও বিশ্বাস করে। এবং তার নিকট হইতে ব্রক্ষ্মনাম গ্রহণ পূর্বক তাদের উপাসনা অবলম্বন করিয়া থাকে। ইহারা অন্যান্য উপাসক সম্প্রদায়ের ন্যায় দুই ভাগে বিভক্ত,গৃহী ও উদাসীন। গৃহস্থের ভাগ অধিক বোধ হয়।

প্রসার[সম্পাদনা]

তার প্রশিষ্যের শিষ্য রামকৃষ্ণ গোসাঁই কর্তৃক এই মত জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি মুসলমানদের রাজ্যধিকার সময়ে বিরাজমান ছিলেন।[১]

বিস্তৃতি[সম্পাদনা]

বাংলাদেশের পূর্বখণ্ডে নানা স্হানে ইহাদের অনেক গুলি আখড়া বাড়ী আছে। শিষ্যদের কোন অভিষ্ট সিদ্ধ হইলে,তাহার পূর্ব প্রতিশ্রুত মানসিক অনুযায়ী ভোগাদি প্রদান করেন। ইহাতে ঐ সকল আখড়ার ব্যয় নির্বাহ হইয়া থাকে। ইহাদের একটি সাম্প্রদায়িক গৃন্থ আছে,তাহা লবণী দাস রচিত জগন্মোহন ভাগবত। কথিত আছে,লবণী দাস নিজেই জগন্মোহনের শিষ্য ছিলেন,এবং তিনি স্বহস্তে জগন্মোহন ভাগবত রচনা করেন। তাহাতে জগন্মোহন বাউলের লীলী বর্নিত আছে। ধর্ম সঙ্গীত ইহাদের সাধনার মূল অবলম্বন। সেই সঙ্গীতের নাম নির্বান সঙ্গীত,জগন্মোহন গোসাঁইর শিষ্য গোবিন্দ গোসাঁই এই সঙ্গীত প্রবর্তন করেন। আখড়ায় কোন বিগ্রহ থাকেনা। এরা সন্ধ্যার পর একত্রিত হইয়া হরির নাম উচ্চারন ও তাহার গুনগান এবং মহিমা কীর্তন করিয়া থাকে। ভারতবঙ্গ উভয় দেশে এই সম্প্রদায়ের অনেক ভক্তবৃনন্দ আছে। ইহাদের মধ্যে গৃহী অধিকবোধ হয়,কিন্ত উদাসীনও দেখিতে পাওয়া যায়। উভয়ে গুরুর পদ গ্রহণে অধিকারী। ইহারা দীক্ষা গুরুকে গোসাঁই বলে থাকে। এরা অন্যকোন বৈষ্ণবদের মতো ভেক লয় না,ডোর কপীনও ধারণ করেনা। কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মত কন্ঠী ধারণ করে। উদানী এদেশে যে হরিলুটের প্রচলন হইয়াছে,উহারা ইহার প্রবর্তন করিয়াছে। এদের মধ্যে অনেকে তুলসী তলায় মোয়া,বাতাসা,নবাত প্রভৃতি মিষ্টান্ন সামগ্রী শ্রীহরিকে নিবেদন করিয়া ভূমি তলে নিক্ষেপ করে। উপস্হিত ব্যক্তিরা ও বিশেষত বালকগন তাহা সত্ত্বর গ্রহণ করিয়া ভক্ষন করে,ইহাকে হরিলুট বলে। বিবাহদি শুভ কর্ম উপস্হিত বা রোগ,শান্তি বিপদ উদ্ধার প্রভৃতির উদ্দেশ্যে মানসিক সুসিদ্ধ হইলে হরিলুট দেওয়া হয়। ইহারা বাংলাদেশের অনেক গুলি গৃহস্থের মধ্যে একটি গুরুতর বিষয়ের প্রবর্তন করিয়া স্ত্রী জাতির ক্ষিত সাধন ও ক্লেশ লাঘব করিয়াছে। এদেশে প্রসবকালে যে সেক তাপের ব্যবস্হা আছে,ইহারা স্বসম্প্রদায়ের মধ্যে তাহা রঞ্জিত করিয়া দিয়াছে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হইলে,তাহাকে তদীয় গর্ভধারনীকে স্নান করায়,প্রসবকালে হরিলুট দেওয়া আবশ্যক। একুশ দিন পর্যন্ত যাহার যে রূপ সাধ্য সে সেরূপ দিয়া থাকে। প্রসবান্তের উল্লেখিতরূপ ব্যবহার ও হরিলুট অন্য অন্য সম্প্রদায়ে প্রচলিত আছে। বুদ্ধি বিদ্যাতে যাহা সাধন করিতে না পারে,অনেকস্হলে গুরু ভক্তিতে তাহা অক্লেশ করিয়া দেয়। বিবাহ শ্রাদ্ধাদি সংস্কার বিষয়ে এ সম্প্রদায়ে যে জাতির যে রূপ প্রথা আছে,সে রূপ হইয়া থাকে। অতিরিক্ত কেবল হরিলুট দেওয়া হয়। ঐ সমস্ত উপস্হতি কর্মে প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে ইহারা হরি লুটের জন্য অর্থ জমা করিয়া রাখে। মুমূর্ষু ব্যক্তি তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্হা যে রূপে বলিয়া যায়,তাহার দেহ সৎকার সে রূপে সম্পন্ন হয়। কাহারো শব মৃত্তিকাতে খনন এবং কাহারো শব জলে নিক্ষেপ করা হয়। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় প্রদেশ এই সম্প্রদায়ের মত প্রচলিত আছে। সাতক্ষীরা, যশোর খণ্ডে ঘোষ,জৌঁগা প্রভৃতি নানা স্হানের লোক এই মতাবলম্বী। ইতি পূর্বে বরাহ নগরে গোলকচাঁদ গোসাঁইর আখড়া ছিল,এখন ঐ গ্রামে প্রেমচাঁদ গোসাঁইর আখড়া আছে। এরা গুরুর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করে গুরুর অধীনে থেকে বৃক্ষ্মচর্য পালন করিতে হয়। সচরাচর সমাজে তিন প্রকার বৃক্ষ্মচারী দেখিতে পাওয়া যায়। বাল বৃক্ষ্মচারী,বৃদ্ধ বৃক্ষ্মচারী এবং কূল বৃক্ষ্মচারী। যে সমস্ত ব্রাক্ষ্মন কিছুদিন গ্রহাশ্রমে থাকিয়া পশ্চাৎ বৃক্ষ্মচর্য পালন করে তাহারাই প্রথমোক্ত দুই প্রকার বৃক্ষ্মচারীর পদ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। তাহার মধ্যে যাহারা অবিবাহিত অবস্হায় সংসার ধর্ম পরিত্যাগ করে,তাহারাই বাল বৃক্ষ্মচারী। আর যাহারা দ্বার পরিগৃহপূর্বক কিছুকাল সংসার যাত্রা নির্বাহ করিয়া পশ্চাৎ বৃক্ষ্মচর্য অবলম্বন করে তাহারাই বৃদ্ধ ব্রক্ষ্মচারী। এই তিন প্রকার ব্রক্ষ্মচারীর মধ্যে যাহারা বিষ্ণু মন্ত্রে দীক্ষিত তাহারাই বৈষ্ণব ব্রক্ষ্মচারী। এরা বংশ পরম্পরা গুরুর চরনকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে,গুরুর চরনকে তাহারা উপাসনার প্রধান অবলম্বন করিয়া প্রত্যেক দিন তাহার সেবা অর্চ্চনা করে। তাহারা বেদী করে সেখানে গুরুর চরন রাখে,একে গুরুর আশ্রিত সিংহাসন বলা হয়। এই চরন তলে প্রতিদিন গুরুর ভোগ দেওয়া হয়,ভোগের অংশকে বস্তু বলা হয়। এবং তার শিষ্যদের মাঝে বিতরন করা হয়। এদের মাঝে প্রত্যহ দুইবার সেবা অর্চ্চনা করার রীতি প্রচলিত আছে। আখড়ায় যারা প্রধান সেবায়েতের কাজ করে তাদেরকে মোহন্ত নামে অভিহিত করা হয়। এরা জাতিগতভাবে নিরামীষভোজী। অন্যান্য বৈষ্ণদের মত এরাও কপালে তিলক ধারণ করে,তবে ক্ষেত্রবিশেষ ইহাদের তিলকের শ্রী পরিবর্তন হইয়া থাকে।

তিলক ধারণ[সম্পাদনা]
তিলকের ধারণ

উপরের বাম থেকে ডানদিকে নিচের দিকে ১১নং তিলক ইহারা কপালে ধারণ করে। এই তিলকের নাম কবীর সেঠ তিলক,জগন্মোহন গোসাঁই যে রামানন্দের নিকট দীক্ষাগ্রহণ করেন,কবীর যিনি প্রথম জীবনে মুসলমান ছিলেন,তিনিও পরবর্তীকালে রামানন্দের নিকট দীক্ষালাভ করেন,তার অগাধ জ্ঞান এবং মহান বৈষ্ণব হওয়ার কারণে তার নামানুসারে এই তিলকের নামকরন করা হয় কবীর সেঠ তিলক।আর এই তিলক জগন্মোহন পন্থী বাউলেরা কপালে ব্যবহার করেন। কবীর এবং জগন্মোহন গোসাঁই একই গুরুর শিষ্য ছিলেন (রামকৃষ্ণ চরিত্র) কবীর স্বহস্তে রামকৃষ্ণ চরিত্র গৃন্থ রচনা করেন। তবে ক্ষেত্রবিশেষ এদের তিলকের শ্রী পরিবর্তন হইয়া থাকে। মাঝে মাঝে ইহারা শ্বেত বর্নের সুগন্ধি তিলক কপালে ধারণ করে,ইহা তাদের তিলকের কাজ সাধন করিয়া রাখে। এরা গুরু আশ্রিত,গুরুর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করে,এরূপে তাহারা দ্বিতীয়বার জন্ম গ্রহণ করে বলে স্বীকার করে। এবং নাম গ্রহণ করে পূর্বের গোত্র বিসর্জন দিয়া, তাহাদের অচ্যুতানন্দ গোত্র বলিয়া পরিচয় প্রদান করে। যে সকল শিষ্য গ্রহাশ্রমে থাকিয়া ব্রক্ষ্মচর্য ধর্মের নিয়মানুসারে চলে তাহাদের নাম কূল ব্রক্ষ্মচারী। তাহারা যথাবিধানে সন্তান উৎপাদন করিলেও ধর্মের হেরপের হয় না।

গুরুবোলা[সম্পাদনা]

গুরুর নামে সাধন ভজন করা এই সম্প্রদায়ের প্রধান অবলম্বন। গুরুর নাম গান ও কীর্তন করাই ইহাদের প্রধান ধর্মানুষ্ঠান,এই কারণে ইহাদের গুরুবোলা বলা হয়। বাংলাদেশের পূর্বস্হানে বিথাঙ্গল নামক স্হানে এই সম্প্রদায়ের সবচাইতে বড় আখড়া বিথাঙ্গল আখড়া বিদ্যমান আছে। তথাকার মোহন্ত শ্রীযুক্ত বাবু বজচন্দ্র রায়ের অনুরোধক্রমে যেরূপ বিবরন পাঠাইয়া দেন,তাহা অবলম্বন করিয়া অক্ষয় কুমার দত্ত,তার ভারতবর্ষীয় উপাসক গৃন্থে সেই রূপ বিবরন লিখিয়া দেন। ইহাদের জপমালা নাই মনে মনে গুরুর নাম জপ করিতে হয়। গুরুই ইহাদের দেবতা স্বরূপ। গুরুকে অহরহ নেচার অর্থাং,বিশেষরূপে স্মরণ করা শিষ্যের পক্ষে অবশ্যই করনীয়। ইহারা নিজ গুরুর অবয়কে ছবির অবয়ব জ্ঞানন করিয়া ভজনা করে এবং যে সময়ে হোক,স্বসম্প্রদায়ী অনেকে একত্রে উপবিষ্ট হইয়া নাম সংকীর্তন করিয়া থাকে। গুরুবোলাদের জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ অবলম্বন,তাহা শুনিলেই ইহাদের পরিচয় পাওয়া যায়। এস্হলে তাহাদের দুই,একটি সংঙ্গীত রচনা করা হল।

গোসাঁই ও আখড়ার নাম[সম্পাদনা]

মাছুলিয়ার আখড়া জগন্মোহনী বাউল বৈষ্ণবদের প্রথম ও প্রধান আখড়া ।

  1. জগন্মোহন গোসাঁই
  2. গোবিন্দ গোসাঁই
  3. শান্ত গোসাঁই ( শ্যাম বাউল)
  4. রামকৃষ্ণ গোসাঁই
  5. কৃপালু মোহন্ত
  6. মায়ারাম মোহন্ত
  7. বাঞ্চিতরাম মোহন্ত
  8. গোবিন্দ রাম মোহন্ত
  9. রামকৃষ্ণ দাস মোহন্ত
  10. বৃন্দাবন দাস
  11. মানিকরাম দাস

বিথঙ্গল আখড়া এটি জগন্মোহনী বাউল বৈষ্ণবদের দ্বিতীয় বৃহত্তম আখড়া বর্তমানে এই আখড়াটি বৃহত্তম আখড়া হিসেবে বিবেচিত ।

  1. রামকৃষ্ণ গোসাঁই
  2. কৃপালু মোহন্ত
  3. চৈতন্র মোহন্ত
  4. নয়নচন্দ্র মোহন্ত
  5. নরেন্দ্র মোহন্ত
  6. কুশাল মোহন্ত
  7. রামহরি মোহন্ত
  8. রাজচন্দ্র মোহন্ত

জলসুখা আখড়া , এই আখড়াটি জগন্মোহনী বাউল বৈষ্ণবদের তৃতীয় বৃহত্তম আখড়া ।

  1. শান্ত গোসাঁই
  2. গোপীনাথ গোসাঁই
  3. বিষ্ণু গোসাঁই
  4. আত্মারাম গোসাঁই
  5. মুক্তারাম গোসাঁই
  6. নেহাল ঠাকুর
  7. চরন ঠাকুর
  8. কালিদাস বাবাজী
  9. রাধাচরন দাস (শিষ্য নয়)
  10. চন্দ্রনাথ দাস

ঢাকা জেলার বাউল আখড়া, এই আখড়া জগন্মোহনী বাউল বৈষ্ণবদের চতুর্থ বৃহত্তম আখড়া ।

  1. কৃপালু মোহন্ত হইতে
চিত্রশালা[সম্পাদনা]

[২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. অক্ষ কুমার দত্ত। ভারতবর্ষীয় উপাসক (প্রথম খন্ড)। জগন্মোহনী সম্প্রদায়।
  2. "http://www.habiganj.gov.bd/node/1042036/বিতঙ্গল-আখড়া"। ১৮ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  |title= এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]