ইপন শিল্পকলা
ইপন ( কুমাওনি : Ēpaṇ ) ভারতীয় হিমালয়ের কুমায়ুন থেকে উদ্ভূত একটি প্রতিষ্ঠিত-আচারিক লোকশিল্প । শিল্পটি প্রধানত বিশেষ অনুষ্ঠান, পারিবারিক অনুষ্ঠান এবং আচার-অনুষ্ঠানের সময় করা হয়। অনুশীলনকারীরা বিশ্বাস করেন যে এটি একটি ঐশ্বরিক শক্তিকে আহ্বান করে যা সৌভাগ্য নিয়ে আসে এবং মন্দকে প্রতিরোধ করে।[১] শিল্পটির বিশেষত্ব এটি শুধুমাত্র লাল রঙের ইটের দেয়ালে করা হয়, যাকে গেরু বলে।[২] প্রকৃত শিল্পটি চালের আটা দিয়ে তৈরি সাদা পেস্ট ব্যবহার করে করা হয়। পূজা ঘরের মেঝে ও দেয়ালে এবং বাড়ির প্রবেশপথে এই শিল্পটি সচরাচর দেখা যায়। এটি বেশিরভাগ কুমাওনী মহিলাই অনুশীলন করে থাকে। এই শিল্পকলার ব্যাপক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে।
চর্চা[সম্পাদনা]
ইপন শিল্প বিভিন্ন উৎসবে করা হয়ে থাকে, তার মধ্যে কয়েকটি হল-
- গণেশ চতুর্থী[৩][৪]
- মকর সংক্রান্তি[৩]
- কার্ক সংক্রান্তি[৩]
- মহা শিবরাত্রি[৩]
- লক্ষ্মীপূজন[৩]
শিল্পটি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চর্চা করা হয় এবং বিভিন্ন পদ দ্বারাও পরিচিত। কুমায়নের স্থানীয় শিল্পটি সবসময় একটি ইটের লাল দেয়ালে করা হয়, যা ভাগ্য এবং উর্বরতার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়। কিছু জনপ্রিয় মোটিফ হল সরস্বতী চৌকি, চামুন্ডা হাত চৌকি, নব দুর্গা চৌকি, জ্যোতি পাট্টা, দুর্গা থাপা এবং লক্ষ্মী যন্ত্র। ইপন শিল্প মায়েদের থেকে তাদের কন্যা এবং পুত্রবধূদের মধ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সঞ্চালিত হয়েছে।[২] মূলত ধনী-উচ্চবিত্ত ব্রাহ্মণ নারীরা এর চর্চা করতো।
ব্যুৎপত্তি[সম্পাদনা]
ইপন শব্দটি সংস্কৃত লেপন শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ প্লাস্টার। ইপন শিল্প ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একই রকম, তবে এটি বিভিন্ন স্থানে পৃথক নামে পরিচিত।[৩]
- ইপন (কুমায়নে)
- ইপোনা (বাংলা ও আসামে)
- অরিপানা (বিহার ও উত্তরপ্রদেশে)
- মান্দানা (রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে)
- রঙ্গোলি (গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে)
- কোলাম (দক্ষিণ ভারতে)
- মুগু (অন্ধ্র প্রদেশে)
- আল্পনা (উড়িষ্যায় চিতা, ঝোতি এবং মুরুজায়)
- ভুগ্গুল (অন্ধ্র প্রদেশে)
ইতিহাস[সম্পাদনা]
ইপন শিল্পের উৎপত্তি উত্তরাখণ্ডের আলমোড়া থেকে, যা চাঁদ রাজবংশের শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কুমায়ুন অঞ্চলে চাঁদ রাজবংশের শাসনামলে এর বিকাশ ঘটে।[৫] এই শিল্পের নকশা এবং মোটিফ সম্প্রদায়ের বিশ্বাস এবং প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন দিক দ্বারা অনুপ্রাণিত।.
পরিধি এবং সংরক্ষণ[সম্পাদনা]
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে, মিনাক্ষী খাতি মিনাকৃতি দ্য ইপন প্রকল্প শুরু করেন। এর লক্ষ্য ছিল ইপন শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা। এ প্রকল্পের অধীনে এ পর্যন্ত ১০০০টি অর্ডার দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি কুমায়ুনের গ্রামীণ পরিবারের মহিলাদের আয়ের সংস্থান করে৷ প্রকল্পটি এমন পরিবারের মহিলাদের নিয়োগ দেয় যারা ইপন তৈরি করে এবং তাদের ক্রেতাদের কাছে অর্ডার সরবরাহ করে।[৬]
তরুণদের মধ্যে ইপন শিল্পকে উৎসাহিত করতে ইপনের সঙ্গে সেলফি তোলা শুরু করেন মিনাক্ষী খাতি।[৬]
ইন্দ্রপ্রস্থ কলেজ ফর উইমেন (আইপিসিডব্লিউ) এর এনাক্টাস ছাত্রদের দল ইপন শিল্পকে জনপ্রিয় করার জন্য ইপন প্রকল্প শুরু করেছে। এর লক্ষ্য ছিল শিল্পীদের প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক দক্ষতা প্রদানের মাধ্যমে ব্যবসায়ের স্টেকহোল্ডার বানানো।[২]
ইপন শিল্পের মতো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পণ্যের দেশীয় উৎপাদকদের রক্ষা করার জন্য ভারত সরকার ১৮৬০ সালে সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৮৬০- এর অধীনে উত্তরাখণ্ড হ্যান্ডলুম অ্যান্ড হস্তশিল্প উন্নয়ন কাউন্সিল (ইউএইচএইচডিসি) গঠন করে।[৭] দেশীয় শিল্প পণ্যের প্রচারের মাধ্যমে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করাই এর লক্ষ্য।[৮]
উত্তরাখণ্ড সরকার ২০১৫ সালে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ইপন চিত্রিত শিল্প সরকারি অফিস এবং ভবনগুলিতে প্রদর্শনের জন্য অধিগ্রহণ করা হবে।[৯] কিছু সরকারি ভবনের মধ্যে রয়েছে গাড়ওয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগম (জিএমভিএন), কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগম (কেএমভিএন) এবং উত্তরাখণ্ড পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেড (ইউপিসিএল)। হরিশ রাওয়াতের নেতৃত্বাধীন রাজ্য পর্যটন বিভাগ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চেলি ইপন হল ইপন শিল্পের প্রচারের জন্য একটি সরকারি উদ্যোগ।[১০]
উত্তরাখণ্ডের স্থানীয় শিল্পকলার প্রচার এবং শিল্পীদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে চোপতা, রুদ্রপ্রয়াগ, উত্তরাখণ্ডে দ্য ইপন রিসোর্ট[১১] স্থাপিত হয়েছিল। রিসোর্টটির লক্ষ্য ছিল স্থানীয় শিল্পকে এক স্থানে নিয়ে আসা এবং এর অনুশীলন করা। তরুণ উদ্যোক্তাদের একটি দল দ্বারা গঠিত রিসোর্টটি অ-উত্তরাখণ্ডী মানুষদের কাছেও এ শিল্প প্রচারে সফল হয়েছে।
জিআই ট্যাগ[সম্পাদনা]
কুমাওনি লোকশিল্প, অর্থাৎ ইপন শিল্প ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি জিআই শংসাপত্র পায়।[১২]
বিভিন্ন ইপনের বিন্যাস[সম্পাদনা]
বিভিন্ন ইপন ফর্ম/মোটিফ আছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি হল-[১৩][১৪][১৫]
- সরস্বতী চৌকি: শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরুর স্মরণে করা হয়।
- চামুণ্ডা হস্ত চৌকি: এটি শুভ বা বলিদানের জন্য তৈরি করা হয়।
- নব দুর্গা চৌকি: পূজার আচারের জন্য ব্যবহার করা হয়। শিল্পটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে নব দুর্গার প্রতিনিধিত্বকারী ৯টি বিন্দু রয়েছে।
- শিবর্চন পীঠ: যখনই শিবের উপাসনা করা হয়।
- আচার্য চৌকি: হিন্দুধর্মে জনপ্রিয়। পণ্ডিত/গুরুকে বরের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। গুরুর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোটিফ তৈরি করা হয়।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রূপগুলি হল আসান চৌকি, দুর্গা থাপা, জ্যোতি পাট্টা, লক্ষ্মী যন্ত্র, জেনেউ চৌকি এবং সূর্য দর্শন চৌকি। শওকদের নিজস্ব শিল্প ফর্ম রয়েছে যা তিব্বতি এবং কুমাওনি শিল্পের মিশ্রিত রূপ। এটি ড্যানস নামে পরিচিত গদি সাজাতে ব্যবহৃত হয়।
আরও দেখুন[সম্পাদনা]
- লিখাই - উত্তরাখণ্ডে কাঠের খোদাই শিল্প
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]
- ↑ Baral, Bibhudutta (২০১৫-০৭-১৫)। "D'source Design Gallery on Aipan Uttarakhand Part 1"। D'Source। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৮।
- ↑ ক খ গ Virmani, Meeta; Bansal, Nitansha (ফেব্রুয়ারি ২০১৮)। "Seeking Sustainable Heights in the Lives of Women Through Aipan: Case Study ofEnactus IP College Initiative" (পিডিএফ): 40–44।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ Baral, Bibhudutta (২০১৫-০৭-০৯)। "Introduction"। D'Source। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৮।
- ↑ "Aipan : Traditional Art (Painting form) Of Uttarakhand | मेरा पहाड़ (Mera Pahad)" (ইংরেজি ভাষায়)। আগস্ট ১৯, ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৮।
- ↑ "Aipan: Ritualistic Folk Art of Kumaon"। Google Arts & Culture (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৮।
- ↑ ক খ "Uttarakhand girl revives traditional Himalayan artform Aipan, creates jobs"। Hindustan Times (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-১১-২৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৮।
- ↑ "Industries Department Uttarakhand | Single Window Industries Department | Industrial Policies | Hill Policy | Industrial Schemes"। doiuk.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৮।
- ↑ "Uttarakhand Handloom and Handicraft Development Council Dehradun"। www.uttarakhandcrafts.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৮।
- ↑ Kunwar, Darshan (ডিসেম্বর ৪, ২০১৫)। "Aipan paintings to brighten govt offices | Dehradun News - Times of India"। The Times of India (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৮।
- ↑ Krishna, Geetanjali (২০১৮-১১-০২)। "Cheli Aipan: A unique initiative to make traditional folk art lucrative"। Business Standard India। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৮।
- ↑ "Home"। aipanresort.com।
- ↑ "GI tag for 7 indigenous products of Uttarakhand | Dehradun News - Times of India"। The Times of India।
- ↑ https://www.euttaranchal.com/culture/aipan-other-arts-form.php EUttaranchal, Aipan Art Forms via Bhupendra Kunwar. Retrieved 8 January 2021
- ↑ https://mediaindia.eu/culture/the-tradition-of-aipan/ MediaIndia. Retrieved 8 January 2021.
- ↑ http://www.bharatonline.com/uttarakhand/arts-crafts/aipan.html BharatOnline. Retrieved 8 January 2021.