অষ্ট নায়িকা

অষ্ট-নায়িকা হল আট ধরনের নায়িকা বা নায়িকাদের একটি সম্মিলিত নাম যা ভরত তার পরিবেশন শিল্পকলার উপর সংস্কৃত গ্রন্থ - নাট্য শাস্ত্রে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। আটটি নায়িকা তার নট বা নায়কের সাথে সম্পর্কযুক্ত আটটি ভিন্ন স্থিতি (অবস্থা )র প্রতিনিধিত্ব করে।[১] রোমান্টিক নায়িকার আদিরূপ অবস্থা হিসাবে, এগুলো ভারতীয় চিত্রকলা, সাহিত্য, ভাস্কর্যের পাশাপাশি ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য ও সঙ্গীতে থিম হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
নায়িকাগণ
[সম্পাদনা]অষ্ট নায়িকা অনুসারে আটটি নায়িকা নিম্নরূপ।
# | নাম | সংস্কৃত নাম | অর্থ |
---|---|---|---|
1 | বাসকসজ্জা নায়িকা | वासकसज्जा नायिका | যে মিলনের জন্য সজ্জিত |
2 | বিরহোৎকণ্ঠিতা নায়িকা | विरहोत्कंठिता नायिका | যে বিচ্ছেদে ব্যথিত |
3 | স্বাধিনভর্তৃকা নায়িকা | स्वाधीनभर्तृका नायिका | যে তার স্বামীকে বশীভূত করে |
4 | কলহান্তরিতা নায়িকা | कलहांतरिता नायिका | যে ঝগড়া করে বিচ্ছিন্ন |
5 | খণ্ডিতা নায়িকা | खंडिता नायिका | যে তার প্রেমিকের উপর ক্ষিপ্ত |
6 | বিপ্রলব্ধা নায়িকা | विप्रलब्धा नायिका | যে তার প্রেমিকের দ্বারা প্রতারিত |
7 | প্রষিতভর্তৃকা নায়িকা | प्रोषितभर्तृका नायिका | যে প্রবাসী স্বামীর বিরহী |
8 | অভিসারিকা নায়িকা | अभिसारिका नायिका | যে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে |
ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক বর্ণনা
[সম্পাদনা]
অষ্ট-নায়িকা শ্রেণিবিভাগ (নায়িকা-ভেদ ) প্রথম দেখা যায় নাট্য শাস্ত্রে (24.210-11), ভারতীয় পরিবেশন শিল্পকলা সম্পর্কিত একটি মূল সংস্কৃত গ্রন্থ, ভরত (খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী এবং খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর মধ্যে তারিখ)।[১][২] দশরূপক (দশম শতক), সাহিত্যদর্পণ (১৪শ শতক) এবং কাব্যতত্ত্বের অন্যান্য বিভিন্ন গ্রন্থের পাশাপাশি গণিকা, পঞ্চসায়ক, অনঙ্গরঙ্গ এবং স্মরদীপিকার উপর ভিত্তি করে কুট্টনিমাতা (৮ম-৯ম শতক) এর মতো কামশাস্ত্রের গ্রন্থের মতো শ্রেণিবিভাগের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। হিন্দিতে কেশবদাসের রসিকপ্রিয়া-তেও (ষোড়শ শতক) অষ্ট-নায়িকাকে বিশদভাবে বর্ণনা করে।[৩]
অষ্ট-নায়িকাকে ভারতীয় চিত্রকলা, সাহিত্য, ভাস্কর্যের পাশাপাশি ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য যেমন কত্থক- এ চিত্রিত করা হয়েছে।[৪][৫][৬] উল্লেখযোগ্য মধ্যযুগীয় চিত্রকর্ম যা অষ্ট নায়িকাকে চিত্রিত করে সেগুলো হল রাগমালা চিত্রকর্ম, যেমন বুন্দি চিত্রকলা ঘরানার।[৩]
ভারতীয় সাহিত্যে একটি বিখ্যাত উদাহরণ হল জয়দেবের গীত গোবিন্দ (দ্বাদশ শতক) এবং সেইসাথে বৈষ্ণব কবি বনমালীর রচনায় রাধা বিভিন্ন নায়িকার ভূমিকায় রূপায়িত যেখানে তার নায়ক দেবতা কৃষ্ণ।[৭]
অষ্ট-নায়িকাপাহাড়ি সূচিকর্মের একটি কেন্দ্রীয় থিম যা বিশেষ করে হিমাচল প্রদেশের চম্বায় উৎপাদিত চম্বা রুমালকে সাজাতে ব্যবহৃত হয়। অষ্ট নায়িকারা সাধারণত রুমালে আটটি প্যানেলে চিত্রিত হয়।[৮]
ভারতীয় (হিন্দুস্তানি) শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে—রাধা-কৃষ্ণের চিরন্তন প্রেমকে রাধার চেতনার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় একটি লেইটমোটিফ(leitmotif) হিসাবে যা গীতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে। বিশেষ করে ঠুমরির আধা-শাস্ত্রীয় ধারা রাধার অগণিত মেজাজকে অষ্ট নায়িকা হিসাবে কৃষ্ণের প্রতি অনুরাগী প্রেমের দ্বারা চিত্রায়িত করে।
শ্রেণিবিভাগ
[সম্পাদনা]নাট্যশাস্ত্রে নায়িকাদের বর্ণনা করা হয়েছে নিম্নোক্ত ক্রমে: বাসকসজ্জা, বিরহোৎকন্ঠিতা, স্বাধিনভর্তৃকা, কলহান্তরিতা, খণ্ডিতা, বিপ্রলব্ধা, প্রষিতভর্তৃকা এবং অভিসারিকা। নায়িকাদের আবার শৃঙ্গার রসের দুটি প্রকারেও শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে, প্রেম সম্পর্কিত রস : সম্ভোগ (মিলনে প্রেম) এবং বিপ্রলম্ভ (বিচ্ছেদে প্রেম)। বাসকসজ্জা, স্বাধিনভর্তৃকা এবং অভিসারিকা সম্ভোগ সম্পর্কের; অন্যরা বিপ্রলম্ভ সম্পর্কের।[২]
শৃঙ্গার প্রকাশে, ভোজা বিভিন্ন নায়ক ও নায়িকাকে বাদ্যযন্ত্র রাগ এবং রাগিনী (স্ত্রী রাগ) এর সাথে সম্পর্কিত করেছেন। সোমনাথের রাগবিবোধ (১৬০৯) এবং দামোদরের সঙ্গীতদর্পণ (আনু. ১৬২৫) এই ধারা অব্যাহত রেখেছে।[২]
বাসকসজ্জা
[সম্পাদনা]বাসকসজ্জা (“যে সজ্জিত হয়েছে মিলনের জন্য”)[২] বা বাসকসজ্জিকা তার প্রেমিকের দীর্ঘ ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। তাকে পদ্ম পাতা এবং মালা দিয়ে সজ্জিত বিছানা-কক্ষে চিত্রিত করা হয়েছে।[৩] তিনি তার প্রেমিকের সাথে মিলনের জন্য নিজেকে সাজিয়েছেন এবং “প্রেমের আনন্দের প্রত্যাশায় অধীরা”।[৬] কেশবদাস তার সৌন্দর্যকে রতির সাথে তুলনা করেছেন—হিন্দু প্রেমের দেবী, তার স্বামী, প্রেম দেবতা কামদেবের জন্য অপেক্ষা করছেন।[৩] খাজুরাহোর লক্ষ্মণ মন্দির এবং দিল্লির জাতীয় জাদুঘরে একটি বাসকসজ্জা ভাস্কর্য পাওয়া যায়।[৬]
রাগবিবোধ রাগিনীদ্বয় ভূপালী এবং টোডিকে বাসকসজ্জার সাথে যুক্ত করে।[২]
বিরহোৎকণ্ঠিতা
[সম্পাদনা]বিরহোৎকণ্ঠিতা (“বিচ্ছেদের কারণে যে ব্যথিত”)[২] বা উত্কা (কেশবদাস বর্ণনা করেছেন) সেই ব্যথিত নায়িকা তার প্রেমিকের জন্য, যে তার ব্যস্ততার কারণে বাড়ি ফিরতে ব্যর্থ হয়। বিছানায় বা প্যাভিলিয়নে বসে বা দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ দেখানো হয়েছে।[৩]
রাগবিবোধ রাগিণী মুখরি, পৌরবী এবং তুরুশকাতোদিকে বিরহোৎকণ্ঠিতের রূপে চিহ্নিত করে, অন্যদিকে সঙ্গীতদর্পণ এই শ্রেণীতে পাতমঞ্জরির নাম দেয়।[২]
স্বাধিনভর্তৃকা
[সম্পাদনা]
স্বাধিনভর্তৃকা (“যে তার স্বামীকে বশীভূত করে”)[২] বা স্বাধিনপতিকা (যেমন কেশবদাস নাম দিয়েছেন) হল সেই নারী যিনি তার স্বামীর প্রিয় এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। স্বামী তার তীব্র প্রেম এবং মনোরম গুণাবলী দ্বারা বশীভূত হয়। সে তার অনুগত এবং বিশ্বস্ত।[৩][৬] চিত্রসমূহে এই নায়িকাকে তার নায়কের সাথে চিত্রিত করা হয়েছে, তিনি পায়ে আলতা পরে আছেন সাথে হয়ত তার কপালে সিঁদুর তিলক।[৩] জয়দেব প্রণীত গীত গোবিন্দের পাশাপাশি কুরু যদুনন্দনা কাব্যে রাধাকে স্বাধিনভতৃকা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। পরেরটিতে, রাধা তার প্রেমিকা, দেবতা কৃষ্ণকে তার সাজসজ্জাকে পুনর্বিন্যাস করার জন্য আদেশ দেন যা এলোমেলো হয়ে আছে।[৬]
মালশ্রী, ত্রাবণিকা, রামাকৃতি, জৈতশ্রী এবং পূরবীর মতো অনেক রাগিণী স্বাধীনভর্তৃকার সাথে যুক্ত।[২]
কলহান্তরিতা
[সম্পাদনা]কলহান্তরিতা (“যে ঝগড়ার কারণে পৃথক হয়েছে”)[২] বা অভিসন্ধিতা (কেশবদাস নাম দিয়েছেন)[৩] এমন নায়িকা যে তার প্রেমিকের থেকে ঝগড়া বা ঈর্ষা[৬] বা তার নিজের অহংকারের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়।[৩] তার প্রেমিককে সাধারণত তার কক্ষ থেকে ভগ্নহৃদয়ে প্রস্থানরত চিত্রিত করা হয়, যখন নায়িকাও তাকে ছাড়া মর্মপীড়িত এবং অনুতপ্ত হয়ে ওঠে।[৩][৬] অন্যান্য চরিত্রে, তাকে তার প্রেমিকের অগ্রগতি প্রত্যাখ্যান করা বা তার কাছ থেকে একটি মদিরা পাত্র প্রত্যাখ্যান করা চিত্রিত করা হয়েছে। গীত গোবিন্দে, রাধাকে একটি উদাহরণে কলহান্তরিতা হিসাবেও চিত্রিত করা হয়েছে।[৬]
খণ্ডিতা
[সম্পাদনা]
খণ্ডিতা (“যে তার প্রেমিকের উপর ক্রুদ্ধা”)[২] এক রাগান্বিত নায়িকা, যার প্রেমিক তাকে তার সাথে রাত কাটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তার পরিবর্তে অন্য নারীর সাথে রাত কাটানোর পর পরদিন প্রাতে তার বাড়িতে আসে। তাকে বিক্ষুব্ধ চিত্রিত করা হয়েছে, তিনি নিজ প্রেমিককে তার অবিশ্বাসের জন্য ভর্ৎসনা করছেন।[৩][৬]
সঙ্গীতদর্পণে, রাগিণী ভারতি খণ্ডিতা নায়িকাকে প্রতিনিধিত্ব করে।[২]
বিপ্রলব্ধা
[সম্পাদনা]বিপ্রলব্ধা (“যে তার প্রেমিক দ্বারা প্রতারিতা”),[২] একজন প্রতারিত নায়িকা,[৬] যে সারা রাত তার প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করেছিল।[৩] তার প্রেমিকা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি বলে তাকে তার গহনা ফেলে দেওয়ার চিত্রিত করা হয়েছে।[৩] এটি ঘটে যখন এক প্রেমিক এক খণ্ডিতার সাথে দেখা করে এবং মিলনের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।[৬]
সঙ্গীতদর্পণ রাগিনী ভূপালীকে বিপ্রলব্ধা হিসেবে চিত্রিত করে। যাইহোক, রাগবিবোধে ভারতী এবং ভেলবতী রাগিণীদ্বয়কে বিপ্রলব্ধ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।[২]
প্রষিতভর্তৃকা
[সম্পাদনা]
প্রষিতভর্তৃকা (“যার স্বামী প্রবাসী”)[২] বা প্রষিতপতিকা (কেশবদাসের দেয়া নাম) হল সেই নারী যার স্বামী তার কাছ থেকে কোনো কাজের জন্য চলে গেছে এবং নির্ধারিত দিনে ফিরে আসে না। তাকে শোকে উপবিষ্টা চিত্রিত করা হয়েছে, তার গৃহকর্মীরা ঘিরে রেখেছে, কিন্তু কারুর সান্ত্বনা মানছে না।[৩]
রাগবিবোধে, রাগিণীদ্বয়—ধনশ্রী ও কামোদীকে প্রষিতভর্তৃকা বলে বর্ণনা করা হয়েছে।[২]
অভিসারিকা
[সম্পাদনা]অভিসারিকা (“যে ধাবমান”)[২] একজন নায়িকা, যে তার শালীনতাকে দূরে রেখে তার প্রেমিকের সাথে গোপনে দেখা করার জন্য তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।[৬] ঝড়, সাপ এবং বনের বিপদের মতো সমস্ত ধরনের বাধাকে উপেক্ষা করে তাকে তার বাড়ির দরজায় এবং মিলনস্থানে যাওয়ার পথে চিত্রিত করা হয়েছে।[৩][৬] শিল্পে, অভিসারিকাকে প্রায়শই তার গন্তব্যের দিকে তাড়াহুড়ো করে ধাবমান চিত্রিত করা হয়।[৬]
রাগিণীদ্বয় বাহুলী এবং সৌরাষ্ট্রীকে সাহসী অভিসারিকার বৈশিষ্ট্যে বর্ণনা করা হয়েছে।[২]
জনপ্রিয় সাহিত্যে
[সম্পাদনা]
অষ্ট-নায়িকা ভারতের শিল্প, সাহিত্য এবং কবিতার সমসাময়িক কাজেও প্রাসঙ্গিক।
কবিতা
[সম্পাদনা]- বিজয় কুমার সিংয়ের ২০২২ সালের হিন্দি কবিতার সংকলন “চিত্রলেখা”য় অষ্ট-নায়িকাকে উৎসর্গ করা ৮টি কবিতার একটি সম্পূর্ণ বিভাগ রয়েছে। ৮টি কবিতার প্রতিটিতে তাদের নায়িকার আলাদা বিবরণ রয়েছে।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ "Erotic Literature (Sanskrit)"। The Encyclopaedia Of Indian Literature। Sahitya Akademi। ২০০৫। আইএসবিএন 81-260-1194-7।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ Luiz Martinez, José (২০০১)। Semiosis in Hindustani music। Motilal Banarsidas Publishers। পৃষ্ঠা 288–95। আইএসবিএন 81-208-1801-6।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ Sodhi, Jiwan (১৯৯৯)। A study of Bundi school of painting। Abinav Publishers। পৃষ্ঠা 52–3। আইএসবিএন 81-7017-347-7।
- ↑ Pratishtha), Pratishtha saraswat (Acharya (২০১৪)। Essential Elements of Kathak। Acharya Pratishtha। পৃষ্ঠা 43। GGKEY:3KKQDB5P3C5।
- ↑ Banerji, Projesh (১৯৮৬)। Dance in thumri। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 13। আইএসবিএন 81-7017-212-8।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ Varadpande, Manohar Laxman (২০০৬)। "Shringara nayika"। Woman in Indian sculpture। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 93–106। আইএসবিএন 81-7017-474-0।
- ↑ "Learn the lingo"। The Hindu। সেপ্টে ১৪, ২০০৭। ফেব্রুয়ারি ১২, ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ Naik, Shailaja D. (১৯৯৬)। Traditional embroideries of India। APH Publishing। পৃষ্ঠা 40। আইএসবিএন 81-7024-731-4।