বিদ্যাসুন্দর

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বিদ্যাসুন্দর বা কালিকামঙ্গল হল মধ্যযুগীয় বাংলা মঙ্গলকাব্য ধারার অন্তর্গত একটি প্রণয়কাব্য। খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর সংস্কৃত কবি বিলহণের চৌরপঞ্চাশিকা অবলম্বনে বিদ্যা ও সুন্দরের প্রণয়কাহিনি এই কাব্যের মূল উপজীব্য। ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে কবি কঙ্ক, শাহ বারিদ খান ও দ্বিজ শ্রীধর বিদ্যাসুন্দরের কাহিনি অবলম্বনে প্রথম বাংলা কাব্য রচনা করেছিলেন। পরে কৃষ্ণরাম দাস, বলরাম চক্রবর্তী, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন প্রমুখ কবিরাও এই ধারায় কাব্য রচনা করেন। এঁদের মধ্যে ভারতচন্দ্র রচিত বিদ্যাসুন্দরই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়।

আখ্যানবস্তু[সম্পাদনা]

বিদ্যাসুন্দর কাব্যের সাধারণ আখ্যানভাগটি নিম্নরূপ:[১]

রাজপুত্র সুন্দর গভীর রাতে ভদ্রকালীর পূজা করছিল। পূজায় সন্তুষ্ট দেবী সাক্ষাৎ উপস্থিত হয়ে সুন্দরকে আকাঙ্ক্ষিত বর প্রার্থনা করতে বললে সে নিভৃতে রাজকন্যা বিদ্যার সহিত সাক্ষাতের বর প্রার্থনা করল। কালী সেই বর মঞ্জুর করলেন এবং সুন্দরকে একটি শুক পাখি দিয়ে বললেন যে সেই শুকই তার কার্যের সহায়ক হবে। পাখিটিকে নিয়ে সুন্দর যাত্রা করল বিদ্যার পিতৃরাজ্যের উদ্দেশ্যে। রাজধানীতে পৌঁছে যখন সে গাছতলায় বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখন এক মালিনী সেখানে এল ফুল বিক্রি করতে। সেই মালিনীই রাজ-অন্তঃপুরে ফুল জোগাত। সুন্দরের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর মালিনী তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এল। সুন্দরও তাকে মাসি সম্বোধন করল। মালিনীর কাছ থেকে সুন্দর বিদ্যার বিস্তারিত পরিচয় পেল। জানতে পারল, বিদ্যা প্রতিজ্ঞা করেছে যে তাকে বিদ্যায় পরাজিত করতে পারবে তাকেই সে বিবাহ করবে – অন্য কাউকে নয়। শুনে বিদ্যার সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য সুন্দর অধীর হয়ে উঠল। মালিনী রোজকার রাজবাড়িতে ফুল নিয়ে যেত। সুন্দর সেই ফুলের মধ্যে একছড়া অতি চিকণ মালা গেঁথে সঙ্গে দিল, আর মালার সঙ্গে একটি লিখনে নিজের পরিচয় লিখে দিল। সেই লিপি পড়ে বিদ্যা আকৃষ্ট হল সুন্দরের প্রতি। মালিনীকে বলল, “সরোবরে স্নানের সময় তোর বোনপোকে দেখতে চাই।” স্নানের ঘাটে বিদ্যা ও সুন্দরের দেখা হল, সংকেতে আলাপও হল। সংকেতে সুন্দর জানাল যে সেই রাতেই সে তার সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু রাজ-অন্তঃপুরে কীভাবে প্রবেশ করবে তা ভেবে না পেয়ে শেষে কালীরই শরণাপন্ন হল সুন্দর। কালী পুনরায় আবির্ভূত হয়ে বললেন, “আমার বরে মালিনীর ঘর থেকে বিদ্যার কক্ষ পর্যন্ত সুড়ঙ্গ হয়ে যাবে, সেই সুড়ঙ্গপথে গেলেই তুমি বিদ্যার সাক্ষাৎ পাবে।” এরপর সেই সুড়ঙ্গপথেই বিদ্যা ও সুন্দরের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ হতে লাগল। গান্ধর্বমতে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হল, ক্রমে বিদ্যা গর্ভবতীও হল। দাসীর মুখে সেই সংবাদ পেয়ে রানি বিদ্যাকে ভর্ৎসনা করলেন। তারপর সংবাদ দিলেন রাজাকে। রাজা কোটালকে আহ্বান করে বিদ্যার কক্ষে গোপনে প্রবেশকারী আগন্তুককে ধরার আদেশ দিলেন। বহু অনুসন্ধানেও যখন চোর ধরা পড়ল না, সুন্দরের আনাগোনা লেগেই রইল। তখন কোটাল এক কৌশল অবলম্বন করল। সে বিদ্যার সমস্ত কক্ষ সিঁদুরে রাঙিয়ে দিল। সেই রাতে সুন্দর বিদ্যার কক্ষে এলে তার বস্ত্রও সিঁদুরে রঞ্জিত হয়ে গেল। রজকের গৃহে রঞ্জিত বস্ত্রের সূত্র ধরে কোটাল সুন্দরকে ধরল। রাজা তার শিরোশ্ছেদের আদেশ দিলেন। সুন্দরকে বেঁধে দক্ষিণ মশানে নিয়ে যাওয়া হল। মশানে সুন্দর কালীর স্তব করলে কালী আবার আবির্ভূতা হয়ে রাজাকে আদেশ করলেন বিদ্যাকে সুন্দরের হস্তে সমর্পণ করতে। রাজাও সুন্দরের প্রকৃত পরিচয় জেনে সাগ্রহে তাতে সম্মত হলেন। বিদ্যাকে বিবাহ করে সঙ্গে নিয়ে সুন্দর যাত্রা করল স্বদেশে।

কবিগণ[সম্পাদনা]

রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র বিদ্যাসুন্দর-কালিকামঙ্গল ধারার শ্রেষ্ঠ কবি এবং ভারতচন্দ্রের সমসাময়িক রামপ্রসাদ সেন এই কাব্যের অপর এক উল্লেখযোগ্য কবি হলেও এই দুই জন এই কাব্যধারার আদি কবি নন। অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্যের অনুমান, পূর্ব ময়মনসিংহ-নিবাসী কবি কঙ্কই এই কাব্যের আদি রচয়িতা। তিনি ছাড়াও শ্রীধর কবিরাজ, চট্টগ্রামের কবি শাহ বারিদ খান ও গোবিন্দ দাস, নিমতা-নিবাসী কবি কৃষ্ণরাম দাস, প্রাণারাম চক্রবর্তী, বর্ধমান-নিবাসী কবি বলরাম চক্রবর্তী এবং কবীন্দ্র ভারতচন্দ্র-রামপ্রসাদের পূর্বেই কালিকামঙ্গল রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন এবং ভারতচন্দ্র-রামপ্রসাদের প্রভাবে পরবর্তীকালে চট্টগ্রামের নিধিরাম আচার্য ও দ্বিজ রাধাকান্ত নামে দুই জন কবিও এই ধারায় কাব্য রচনা করেছিলেন। এছাড়াও মধুসূদন, ক্ষেমানন্দ, বিশ্বেশ্বর দাস, কবিচন্দ্র প্রমুখ কবিগণের প্রণীত কালিকামঙ্গলের নাম পাওয়া যায়, তবে এই সকল কাব্যের কবিদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

কঙ্ক[সম্পাদনা]

সত্যনারায়ণ পাঁচালির অন্তর্গত ক্ষুদ্র একখানি বিদ্যাসুন্দর আখ্যানকাব্যের কবি কঙ্কের সময়কাল নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কারও কারও মতে তিনি ষোড়শ শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব তথা বাংলায় বিদ্যাসুন্দর কাব্যের আদি কবি, আবার অপর মতে তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর আগের ব্যক্তিত্ব হতেই পারেন না।[২] কঙ্ক ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধিবাসী। চন্দ্রকুমার দে তাঁর লেখা বিদ্যাসুন্দর পুঁথি আবিষ্কার করেন। একখানি পুঁথি তিনি দিয়েছিলেন গবেষক দীনেশচন্দ্র সেনকে এবং আরও একখানি পুঁথি তাঁর সন্ধানে ছিল বলে জানিয়েছিলেন। ১৩২৫-২৬ সালে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত সৌরভ পত্রিকায় চন্দ্রকুমার কঙ্কের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেছিলেন।[৩]

কঙ্কের আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়, রাজ্যেশ্বরী নদীর তীরে বিপ্রগ্রামের এক ব্রাহ্মণবংশে কবির জন্ম। তাঁর পিতার নাম গুণরাজ ও মাতা বসুমতী। শৈশবে মাতৃপিতৃহীন হয়ে কঙ্ক মুরারি নামে এক চণ্ডালের গৃহে প্রতিপালিত হন। চণ্ডালিনী পালিকা মাতা কৌশল্যাই তাঁর নামকরণ করেন কঙ্ক (কঙ্কধর)[৪]। বাল্যকালে কঙ্ক রাখালের কাজে নিযুক্ত হন গর্গ নামে এক পণ্ডিত ব্রাহ্মণের বাড়িতে। গর্গ ও তাঁর পত্নী গায়ত্রী প্রায়শ্চিত্ত সংস্কারের মাধ্যমে কঙ্ককে সমাজে স্থান দেওয়ার চেষ্টা করলেও, ব্রাহ্মণ-সমাজের বিরোধিতায় তা সফল হয়নি। গর্গকন্যা লীলার সঙ্গে কঙ্কের প্রণয়কাহিনি অবলম্বনে কবি রঘুসূত রচনা করেন কঙ্ক ও লীলা নামে এক পালাগান, যা পরবর্তীকালে মৈমনসিংহ গীতিকা-য় অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়।[৫]

কঙ্কের বিদ্যাসুন্দর দেবী কালীর মাহাত্ম্যসূচক কাব্য নয়। বিপ্রগ্রামবাসী এক পীরের আদেশে রচিত হওয়ায় এই কাব্যের উদ্দিষ্ট দেবতা সত্যপীর। কঙ্কও এই কাব্যকে “পীরের পাঁচালী” বলে উল্লেখ করেছেন (“গুরুর আদেশে গাহি পীরের পাঁচালী”)। অবশ্য বিদ্যাসুন্দর-কালিকামঙ্গল ধারার অপরাপর কাব্যের মতো কঙ্কের কাব্যেও দেবতা মুখ্য বিষয় নন। এই ধারার কবিদের মধ্যে স্থাননাম এবং বিদ্যা ও সুন্দরের নাম ছাড়া অন্যান্য চরিত্রনামের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই অসাম্য দেখা গিয়েছে। কঙ্ক ও পরবর্তীকালের কবিদের বিদ্যাসুন্দর কাব্যে কতকগুলি বিষয়ে কিছু পার্থক্য দেখা যায়; কঙ্কের আখ্যানবস্তু বর্ণনাও একটু ব্যতিক্রমী। কঙ্কের কাব্যে “কবে বা হেরিব আমি গৌরার চরণ” ইত্যাদি পংক্তির মাধ্যমে চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতি যে ভক্তি প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে অনুমিত হয় যে কঙ্ক ছিলেন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত কবি। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, এই কারণেই তাঁর কাব্য আদিরস-প্রধান নয় এবং রচনায় নীতি-সংযম লঙ্ঘিত হয়নি। কঙ্কের কাব্য সরল ও মধুর। এই কাব্যের অনেক স্থানে বৈষ্ণব পদের শৈলী লক্ষিত হয়। আশুতোষ ভট্টাচার্য কঙ্কের “বাজন্ত নূপুর হয়্যা চরণে লুটিব” পংক্তিটির সঙ্গে লোচন দাসের প্রসিদ্ধ পদ “বাজন নূপুর হয়্যা চরণে রহিব গো”-র তুলনা করেছেন। ময়মনসিংহ অঞ্চলে কঙ্কের বিদ্যাসুন্দর ব্যাপক প্রচার লাভ করেছিল।[৬]

দ্বিজ শ্রীধর[সম্পাদনা]

মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ চট্টগ্রাম থেকে দ্বিজ শ্রীধরের বিদ্যাসুন্দর কাব্যের একটি পুঁথির অতি সামান্য অংশ (২-৮ পৃষ্ঠা) এবং অপর একটি পুঁথির ২৭ সংখ্যক পৃষ্ঠাটি আবিষ্কার করেন।[৭] অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, শ্রীধরের কাব্য “বিদ্যাসুন্দর” না “কালিকামঙ্গল” কোন নামে পরিচিত ছিল তা জানা যায় না। আবিষ্কৃত খণ্ডিত পুঁথিতে দেবী কালীর মাহাত্ম্যবর্ণনা না থাকায় তিনি “বিদ্যাসুন্দর” নামটিই গ্রহণ করেন।

শ্রীধরের উপাধি ছিল কবিরাজ। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীধরের কালনির্ণয়ের জন্য পুঁথিতে উল্লিখিত তিনটি ভণিতা অংশের উল্লেখ করেছেন:[৮]

(ক)
নৃপতি নাসির সাহা তনএ সোন্দর।
নাম ছিরি পেরোজ সাহা রসিক শেখর।।

দ্বিজ ছিরিধর কবি রচিলেক পুনি।।
(খ)
নৃপতি নাসির
যাহার নন্দনে
ভোগপুরে মেদনি মদনে।
রাজা শ্রীপেরোজ
সাহা জানে
ছিরিধর কবিরাজ ভণে।।
(গ)
শীরি পেরোজ সাহা বিদিত জুবরাজ।
কহিল পাঞ্চালি ছন্দে ছিরি কবিরাজ।।

এখানে উল্লিখিত “নাসির সাহা” ও “পেরোজ সাহা” হলেন যথাক্রমে গৌড়ের সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ (সুলতান হুসেন শাহের পুত্র) ও সুলতান ফিরোজ শাহ (নুসরাত শাহের পুত্র)।[৯] ফিরোজ শাহের রাজত্বকাল ১৫৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দ; তাই এই উল্লেখ থেকে কবির সময়কাল নির্ণয়েও অসুবিধা হয় না। পুঁথির আবিষ্কর্তার মতে, শ্রীধর ছিলেন ফিরোজ শাহের সভাকবি। কিন্তু আবিষ্কৃত খণ্ডিত পুঁথিতে সে কথার কোনও উল্লেখ নেই, বরং ভণিতায় ফিরোজ শাহের প্রশংসা মাত্র করা হয়েছে। তাছাড়া মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্ত সহ অনেক মধ্যযুগীয় কবিই গৌড়েশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও গৌড়েশ্বরের প্রশংসা করেছিলেন। আর ফিরোজ শাহও খুব অল্পদিন রাজত্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন; তাই শ্রীধর ফিরোজ শাহের সভাকবি হয়েছিলেন কিনা তা নিশ্চিত করে বলা চলে না।[১০] তবে শ্রীধর ফিরোজ শাহের অনুরক্ত ছিলেন এবং হুসেন শাহের সুফি সভাকবি কুতবনের মৃগাবতী কাব্যের আদলে বিদ্যাসুন্দরে পার্থিব জীবনের চিত্র এঁকে ছিলেন, একথা সুকুমার সেন ও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় উভয়েই স্বীকার করেছেন।[১১]

শ্রীধরের কাব্যে ফিরোজ শাহকে কোথাও রাজা, কোথাও যুবরাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তা থেকে অনুমান করা হয় যে, ফিরোজ শাহ যখন যুবরাজ তখনই এই কাব্যের রচনা আরম্ভ হয়। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, “সম্ভবত কোনও উপায়ে যুবরাজ কবির পৃষ্ঠপোষকতা করিয়াছিলেন – নতুবা গৌড়ের সুলতানকে বাদ দিয়া তাঁহার পুত্রের নিকট কবির কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপনের কোনও কারণ থাকিতে পারে না।” সম্ভবত নুসরৎ শাহের রাজত্বকালের (রাজত্বকাল: ১৫১৯-১৫৩২ খ্রিস্টাব্দ) শেষভাগে শ্রীধর বিদ্যাসুন্দর রচনায় হাত দেন, তারপর ফিরোজ শাহ গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণের পরে কাব্য রচনার কাজ সম্পূর্ণ হয়। ১৫৩২ সালে সিংহাসনে আরোহণের কয়েক মাসের মধ্যেই ফিরোজ শাহ প্রয়াত হন। শ্রীধরের কোনও কোনও ভণিতায় ফিরোজ শাহকে রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে দেখে অনুমিত হয় যে, তাঁর স্বল্প কয়েকমাসব্যাপী রাজত্বকালের মধ্যেই এই কাব্য রচনার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল। পুঁথির আবিষ্কর্তা শ্রীধরের কাব্য নুসরাত শাহের রাজত্বকালে সম্পূর্ণ হয়েছিল বলে উল্লেখ করলেও উপরিউক্ত কারণের প্রেক্ষিতে আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, এই কাব্যের সমাপ্তিকাল ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ।[১২]

আবিষ্কৃত দু’টি পুঁথিই খণ্ডিত বলে শ্রীধরের ব্যক্তিপরিচয় সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কোনও কোনও ভণিতায় তিনি নিজেকে “দ্বিজ” বলে উল্লেখ করেছেন দেখে অনুমান করা হয় যে তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। দু’টি পুঁথিই চট্টগ্রাম থেকে আবিষ্কৃত হওয়ায় এও অনুমান করা হয় যে তিনি ওই অঞ্চলেরই অধিবাসী ছিলেন। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, “চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যাসুন্দরের কাহিনিটি পূর্বপরিচিত ছিল – তথাকার আরও কয়েকজন প্রাচীন কবি এই বিষয় লইয়া পরবর্তী কালেও কাব্য রচনা করিয়া গিয়াছেন – মনে হয়, দ্বিজ শ্রীধরই তাঁহাদের পথপ্রদর্শক ছিলেন। শুধু তাহাই নহে, প্রাচীন বাংলার বিদ্যাসুন্দরের কবিদিগের মধ্যে শ্রীধর কবিরাজের সময় সম্বন্ধে সর্বপ্রথম স্পষ্ট ঐতিহাসিক নির্দেশ পাওয়া যায়। কবি কঙ্কের সময় সম্পর্কে একমাত্র অনুমানের উপরই নির্ভর করিতে হইয়াছে।”[১৩]

শ্রীধরের রচনায় সুন্দরের পিতার নাম গুণসার ও মাতার নাম কলাবতী এবং সুন্দরের পৈত্রিক রাজ্যের নাম বিজয়নগরী রত্নাবতী। অন্যদিকে বিদ্যার পিতার নাম বীরসিংহ, মাতার নাম শীলাদেবী এবং রাজধানী কাঞ্চী।[১৪] শ্রীধরের কাব্যে পাণ্ডিত্যের পরিচয় যথেষ্ট পাওয়া গেলেও যথার্থ কবিত্বের তেমন পরিচয় পাওয়া যায় না। বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তিত ধর্ম ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বিদ্যাসুন্দরের কবিদের মধ্যে সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী বিদ্যার রূপবর্ণনার যে বিশেষ রীতি প্রচলিত হয়েছিল, শ্রীধরের রচনাতেও তার পরিচয় পাওয়া যায়। এর সঙ্গে পরবর্তী বিদ্যাসুন্দরের কবিদের বর্ণনার তুলনা করলে দেখা যায় যে এই বিষয়ে একটি বিশেষ অলংকারসম্মত রূপ আগেই স্থাপিত হয়েছিল এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদ পর্যন্ত সকলেই তা অনুসরণ করে গিয়েছিলেন।[১৫] তবে শ্রীধরের কাব্যে কালী বা অন্য কোনও দেবতার মাহাত্ম্য যে কীর্তিত হয়নি, এই বিষয়ে গবেষকেরা একমত। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “মুসলমান পাঠান নৃপতির অনুগ্রহভাজন কবি কাব্যে হিন্দু ধর্মবিশ্বাস বা অনুরূপ আখ্যায়িকা বর্জন করিবেন, এইরূপ অনুমানই স্বাভাবিক।”[১৬]

শ্রীধরের কথা অনুযায়ী তিনি “দেসিভাসে” (দেশীয় ভাষায়) ও “পরাকৃতে” (প্রাকৃত অসংস্কৃত বাংলা ভাষায়) বিদ্যাসুন্দর রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন।[১৭] কিন্তু কাব্যে অনেক জায়গাতেই তিনি সংস্কৃত ভাষার সাহায্য গ্রহণ করেন এবং রচনার মধ্যে মধ্যে অনেকগুলি স্বরচিত সংস্কৃত বচনিকার প্রয়োগ ঘটান। যেমন কাব্যের সূচনায় তিনি লিখেছেন:

অস্তি উত্তর দেশে রত্নাবতী নাম দিব্যা পুরী। তত্র রাজা সর্বগুণ-বিভূষিতো গুণসারো নানা-শাস্ত্র-সুনিপুনো ধর্মপরায়ণস্তস্য কলাবতী নাম্নী ভার্যা সর্বগুণশালিনী। তস্যাঃ গর্ভে সুতো জাতঃ কালিকায়াঃ প্রসাদাৎ। সাক্ষাৎ কামঃ সর্বশাস্ত্রবিশারদঃ।[১৮]

আশুতোষ ভট্টাচার্য লিখেছেন, “ইহা হইতে পুঁথির আবিষ্কর্তা মনে করিয়াছেন যে, বিদ্যাসুন্দরের কোনও সংস্কৃত আখ্যায়িকা হইতে শ্রীধর তাঁহার কাব্যখানি বাংলায় অনুবাদ করিয়া লইয়াছেন। কিন্তু এই উক্তি সমর্থনযোগ্য নহে; কারণ, প্রাক্-চৈতন্যযুগের বাংলা সাহিত্য সংস্কৃত রচনার প্রভাব হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত হইয়া আসিতে পারে নাই – বাংলা ভাষায় কাব্য রচনা করিলেও, সেকালের কোনও কোনও কবি তাঁহাদের রচনার স্থানে স্থানে স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোক যোজনা করিয়া দিতেন – তাহার প্রমাণ বড়ু চণ্ডীদাসেরশ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। সংস্কৃত পুরাণ পাঠে অভ্যস্থ পাঠকের নিকট ইহাতে ভাষা-সাহিত্যের মর্যাদা বৃদ্ধি পাইত – সাধারণ অজ্ঞ লোকের নিকটও কাহিনীর আভিজাত্য সহজেই প্রতিষ্ঠিত হইত। অতএব ইহা প্রাক্-চৈতন্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট রীতি বলিয়া গণ্য করিতে হয়, ইহার আর কোনও তাৎপর্য আছে বলিয়া মনে করা যাইতে পারে না।”[১৯] অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন যে, পুঁথিটি সংস্কৃত কাব্যের অনুবাদ, এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না।[২০]

শ্রীধরের কাব্যের মূল্যায়ন করতে গিয়ে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন যে, “ধর্মপ্রভাবিত মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের বাহিরে এই লৌকিক প্রেমের কাব্য স্বাদবৈচিত্র্যের জন্য এযুগের পাঠকেরও বিস্মিত দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারিত; কিন্তু এখন আর এ পুঁথি প্রাপ্তির কোন সম্ভাবনা নাই, বিশিষ্ট কাব্যটি চিরকালের জন্য লোকলোচনের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে।”[২১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, পৃ. ৩৯২-৩৯৩
  2. ক্ষেত্র গুপ্ত, বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস, পৃ. ১৮৩
  3. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, পৃ. ৬৯৬ (পাদটীকা)
  4. "পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫৫৯ - উইকিসংকলন একটি মুক্ত পাঠাগার"bn.wikisource.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-০৮ 
  5. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, পৃ. ৬৯৭
  6. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, পৃ. ৬৯৬-৯৮
  7. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: প্রথম পর্ব, পৃ. ১৮৮
  8. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: প্রথম পর্ব, পৃ. ১৮৯
  9. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: প্রথম পর্ব, পৃ. ১৮৯
  10. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, পৃ. ৬৯৮
  11. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: প্রথম পর্ব, পৃ. ১৯০
  12. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, পৃ. ৬৯৮-৯৯
  13. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, পৃ. ৬৯৯
  14. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: প্রথম পর্ব, পৃ. ১৯১
  15. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, পৃ. ৭০০-৭০১
  16. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: প্রথম পর্ব, পৃ. ১৯০-৯১
  17. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: প্রথম পর্ব, পৃ. ১৮৯
  18. অনুবাদ: উত্তরদেশে রত্নাবতী নামে এক দিব্য নগরী ছিল। সেখানকার রাজা ছিলেন সর্বগুণ-বিভূষিত ও নানা শাস্ত্রবিদ গুণসার। তাঁর পত্নী ছিলেন ধর্মপরায়ণা ও সর্বগুণশালিনী কলাবতী। দেবী কালীর প্রসাদে তাঁর গর্ভে এক কন্যার জন্ম হয়। সে ছিল সাক্ষাৎ কামদেবের ন্যায় সর্বশাস্ত্রবিশারদ।
  19. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, পৃ. ৬৯৯-৭০০
  20. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: প্রথম পর্ব, পৃ. ১৯১
  21. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: প্রথম পর্ব, পৃ. ১৯১

উল্লেখপঞ্জি[সম্পাদনা]

  • অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: প্রথম পর্ব, মডার্ন বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৯৯৩ সংস্করণ, ২০০৬-০৭ মুদ্রণ
  • অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: দ্বিতীয় পর্ব, মডার্ন বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ২০০১ সংস্করণ, ২০০৬-০৭ মুদ্রণ
  • আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, এ মুখার্জি অ্যান্ড কোং প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ২০০৯ সংস্করণ
  • ক্ষেত্র গুপ্ত, বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস, গ্রন্থনিলয়, কলকাতা, ২০০১ সংস্করণ
  • সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৯৯১ সংস্করণ, ২০১৭ মুদ্রণ
  • সুখময় মুখোপাধ্যায়, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম, ভারতী বুক স্টল, কলকাতা, ২০০৭ সংস্করণ

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]