বিষয়বস্তুতে চলুন

হার্বার্ট স্পেনসার

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(হার্বার্ট স্পেন্সার থেকে পুনর্নির্দেশিত)
হার্বার্ট স্পেনসার
৭৩ বছর বয়সে হার্বার্ট স্পেনসার
জন্ম(১৮২০-০৪-২৭)২৭ এপ্রিল ১৮২০
ডার্বি, ডার্বিশায়ার, ইংল্যান্ড
মৃত্যু৮ ডিসেম্বর ১৯০৩(1903-12-08) (বয়স ৮৩)
ব্রাইটন, সাসেক্স, ইংল্যান্ড
জাতীয়তাব্রিটিশ
শিক্ষাক্লাসিক্যাল লিবারেলিজম
উল্লেখযোগ্য কর্ম
সামাজিক পরিসংখ্যান (১৮৫১)
দ্য ম্যান ভার্সাস দ্য স্টেট (১৮৮৪)
পরিবারজন ওয়েসলি (পিতা)
যুগ১৯-শতকের দর্শন
অঞ্চলপশ্চিমা দর্শন
প্রধান আগ্রহ
• নৃবিজ্ঞান জীববিজ্ঞান
• বিবর্তন
• লাইসেজ-ফেয়ার
• পজিটিভিজম
• মনোবিজ্ঞান
• সমাজবিজ্ঞান
• উপযোগবাদ
উল্লেখযোগ্য অবদান
• সামাজিক ডারউইনবাদ
• যোগ্যতমের বেঁচে থাকা
• সামাজিক জীব
• সমান স্বাধীনতার আইন
• এর কোনো বিকল্প নেই
ভাবশিষ্য
  • চার্লস ডারউইন . হেনরি সিডগউইক • উইলিয়াম গ্রাহাম সুমনার • থর্স্টেইন ভেবলেন • মারে রথবার্ড • এমিল ডুর্খেইমআলফ্রেড মার্শাল • হেনরি বার্গসন • জে.এফ.সি. ফুলার • নিকোলে মিখাইলভস্কি • অবেরন হারবার্ট • ভিক্টর ইয়ারোস • রডারিক লং • গ্রান্ট অ্যালেন • ইয়েন ফু • তোকুটোমি সোহো • কার্লোস ভাজ ফেরেইরা • জ্যাক লন্ডন • অ্যান্টন লাভে • আয়ন রান্ড
স্বাক্ষর

হার্বার্ট স্পেনসার (২৭ এপ্রিল ১৮২০ – ডিসেম্বর ৮, ১৯০৩) ভিক্টোরিয়ান যুগের একজন প্রখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক, জীববিজ্ঞানী, নৃতাত্ত্বিক, সমাজবিজ্ঞানী এবং ধ্রুপদী উদারতাবাদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান চিন্তাবিদ।

হার্বার্ট স্পেনসারের জীবনী

[সম্পাদনা]

ইংরেজ দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেনসার ১৮২০ সালের ২৭ এপ্রিল ইংল্যান্ডের ডার্বিতে জন্মগ্রহণ করেন। মা আর বাবা দু'দিকের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন প্রচলিত ধর্মমত বিরোধী (Non-conformist of dissenter)। তাঁর পিতামহী জন ওয়েসলির (John Wesley) গোঁড়া ভক্ত ছিলেন। তাঁর পিতৃব্য থোমাস যদিও ইংল্যান্ডের চার্চ মতাবলম্বী পাদ্রী ছিলেন কিন্তু চার্চের অভ্যন্তরে চালাতেন ওয়েসলীর আন্দোলন, তিনি কোন দিন দেখতে যাননি কনসার্ট বা নাটক আর সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন রাজনৈতিক সংস্কার আন্দোলনে।

পরিবারগতভাবেই স্পেনসার পরিবারের সদস্যরা গির্জার যাজকীয় ব্যবস্থার বিরোধী থাকায় হার্বার্ট স্পেনসারের পরিণতি লাভ করে মতদ্বৈধ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে স্পেনসারকে সামাজিক অসাম্য-বৈষম্যের রোষানলে পড়তে হয়। সেজন্য তিনি অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ লাভ করতে পারেননি। স্পেনসারের বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। শৈশব অবস্থাতে বাবা-মার কাছে এবং কৈশোরে কাকার কাছে গণিত ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে উচ্চমানের শিক্ষা লাভ করেন। প্রয়োজনের তাগিদে সতেরো বছর বয়সে ১৮৩৭ সালে তিনি লন্ডন বার্মিংহাম রেলরোড কোম্পানিতে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন। ১৮৪১ সালে তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আবার ডার্বিতে ফিরে এসে চিন্তা জগতে প্রবেশ করেন।

১৮৪২ সালে তিনি Non-conformist পত্রিকায় "The proper sphere of government' সম্বন্ধে কতকগুলো পত্র প্রকাশ করেছিলেন, তাতে তাঁর পরবর্তী দর্শন প্রায় অপরিবর্তিতভাবেই বিধৃত ছিল ভূণাবস্থায়। ১৮৪৮ সালে তিনি 'Economist' নামে সমকালীন লন্ডনের এক প্রখ্যাত সাময়িকপত্রে সহসম্পাদকের পদ লাভ করেন।

হার্বার্ট স্পেনসারের মানস বিকাশ

[সম্পাদনা]

১৮৫০ সালে স্পেনসারের প্রথম গ্রন্থ 'Social Statics' প্রকাশিত হয়। ১৮৫২ তে তিনি লেখেন তাঁর "The Theory of Population' প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে তিনি 'জীবনযুদ্ধে যোগ্যতমেরই জয় হয়ে থাকে' এমত প্রকাশ করেছিলেন। সেই একই বছরের leader নামক এক পত্রিকায় "The Development of Hypothesis' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এ প্রবন্ধটিতে স্পেনসার বিবর্তনবাদের তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। ১৮৫৩ সালে স্পেনসারের কাকার মৃত্যু হলে উত্তরাধিকার সূত্রে স্পেনসার পর্যাপ্ত ধন-সম্পত্তির মালিক হন। সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তিনি তার পূর্ব কর্মদায়িত্ব Economist পত্রিকার সহ-সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি নেন।

১৮৫৪ সালে তাঁর 'The Principles of Philosophy' গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য যে, এই গ্রন্থটির জনপ্রিয়তার জন্য তিনি খুবই আশান্বিত ছিলেন। কিন্তু গ্রন্থটি জনপ্রিয়তা পেল না, বরং বহুলাংশে তৎকালীন সময়ে উপেক্ষিত হলো। ফলে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত হলেন। তাঁর বিচ্ছিন্ন জীবন ক্রমে ক্রমে তাকে নিঃসঙ্গ করে তোলে। এ নিঃসঙ্গতার মাঝে তিনি কয়েকবার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৮৫৫ সালে স্পেনসার তাঁর 'The Principles of Psychology'-তে মনের বিবর্তন ধারা অনুধাবন করতে সচেষ্ট হন; তারপর ১৮৫৭ সালে তাঁর Progress its Law and Causes' প্রবন্ধে তিনি ভন বেয়ারের (Von Bear) সব জীবিত পদার্থ সমজাতীয় সূচনা থেকে ধীরে ধীরে বিচিত্র জাতীয় হয়ে উঠার মতটাকে গ্রহণ করে তাকে ইতিহাস প্রগতির সাধারণ সূত্রে উন্নীত করেছেন। সংক্ষেপে বলা যায়, স্পেনসার যুগ ধর্মের সাথে সাথেই বেড়ে উঠেছেন এবং এখন বিশ্ব বিবর্তনের দার্শনিক হওয়ার জন্য হয়েছেন প্রস্তত। (উইল, ডুরান্ট অনুবাদ আবুল ফজল:

১৯৮০ : ৪৩৮: বাংলা একাডেমি ঢাকা) উনবিংশ শতকের পাঁচ দশকের শেষদিকে হার্বার্ট স্পেনসার সংশ্লেষণাত্মক দর্শন (Synthetic Philosophy) প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন। সর্বমোট দশখণ্ডে রচিত হলো 'সংশ্লেষণাত্মক' বা 'সমন্বয়ী দর্শনের প্রণালী' (Synthetic Philosophy)। তাঁর First principles of a new system of philosophy (1862), The Principles of Biology (two volumes, 1864, 1867), Principles of Psychology (1870-1872, three volumes, এর প্রথম খণ্ড ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হয়) Principles of Sociology, (Three volumes 1876, 1882, 1896) যা ১৮৭৩ সালে 'The Study of Sociology' নামে স্বতন্ত্র গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। Principles of Ethics (two volumes, 1892, 1893). The Man Versus the State (1884) আরো অনেক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তৎকালীন সময়ে স্পেনসারের The Study of Sociology' আমেরিকায় ব্যাপকভাবে পঠিত হয়েছিল। সমাজতত্ত্ব (Sociology) এই নামের পাঠ্য বিষয়বস্তু সর্বপ্রথম ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮৭৫-৭৬ শিক্ষাবর্ষে প্রচলিত হয়। তখন ছাত্রদের জন্য স্পেনসারের "The Study of Sociology' গ্রন্থখানি পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্ধারিত হয়। তবে পরে দশবছর এই পাঠ্য বিষয়টি বন্ধ রাখা হয় এবং ১৮৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষে এটি পুনঃপ্রচলিত হয়। স্পেনসারের রচনাবলি তাঁকে অসাধারণ মর্যাদায় উন্নীত করে।

সামাজিক বিবর্তন

[সম্পাদনা]

সমন্বয়' বা সংশ্লেষণাত্মক দর্শনের প্রণালি (Synthetic Philosophy) ও সমাজবিজ্ঞানের বুনিয়াদ (Principles of Sociology) শীর্ষক গ্রন্থাবলিতে হার্বার্ট স্পেনসার অভিব্যক্তিবাদের এক দার্শনিক ও সমাজবৈজ্ঞানিক বুনিয়াদ রচনা করেন। স্পেনসার সমাজতত্ত্বের আলোচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন মূলত সমাজ বিবর্তনের বৈশিষ্ট্যসমূহকে বিচার বিশ্লেষণের বিজ্ঞান হিসেবে। সেজন্য অনেক সমাজবিজ্ঞানী একমত পোষণ করে বলেন, হার্বার্ট স্পেনসারের সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব দুটি প্রধান ধারণাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, একটি জৈবিক সত্তা হিসেবে সমাজের ধারণা এবং অন্যটি সামাজিক বিবর্তনের ধারণা (Spencer's sociological theory was built around two main principles conception of society as an organism and the idea of social evolution. - Igor Kor: 1989: 47)

স্পেনসারের মতানুসারে সমাজজীবনের ক্ষেত্রেও ক্রমবিবর্তনের সাধারণ নীতি ক্রিয়াশীল। এ নীতি হলো সরল অবস্থা থেকে জটিল অবস্থায়, ক্ষুদ্রাকার থেকে বৃহদাকারে, অসংলগ্নতা থেকে সংলগ্নতায়, অবিভক্ততা থেকে বিভক্ততায়, অনির্দিষ্টতা থেকে নির্দিষ্টতায়, সমসত্ত্বতা (homogneily) থেকে অসমসত্ত্বতায় (heterogenity) উপনীত হওয়া।

স্পেনসার জীবজগতের বিবর্তনকে জৈব বিবর্তন (Organic evolution), জড় জগতের বিবর্তনকে অজৈব বিবর্তন (Inorganic evolution) এবং সামাজিক বিবর্তনকে অতিজৈব বিবর্তন (Super-organic evolution) আখ্যা দিয়েছেন। সুতরাং জীবজগৎ, জড়জগৎ এবং মানবসমাজ সকল ক্ষেত্রেই বিবর্তনের নিয়ম কার্যকরী হয়। এ হলো এক সর্বজাগতিক নিয়ম বিশেষ। তাঁর এ মতবাদ অনুযায়ী অজৈব (Inorganic), জৈব (Organic) ও অতিজৈব (Super-Organic) এককথায় বিশ্বজাগতিক সকল বিষয় বিবর্তনের প্রাকৃতিক আইনের অধীন। অর্থাৎ বস্তুজগতে, জীবজগতে এবং সমাজব্যবস্থায় বিবর্তন সতত সংঘটিত হচ্ছে। বিবর্তন হলো একটি সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়ম। তিনি বলেন, 'Evolution, that is, a change from a state of relatively indefinite, incoherent, homogeneity to a state of relatively definite, coherent, heterogeneity." অনির্দিষ্ট অস্থির সমসত্ত্বতা থেকে সুনির্দিষ্ট স্থিতিশীল অসমসত্ত্বতায় উত্তরণই হচ্ছে বিবর্তন। স্পেনসার মনে করেন, একেবারে গোঁড়ার দিকে নিতান্তই অল্পসংখ্যক গঠনাকৃতি বর্তমান ছিল। কালক্রমে এদের মধ্যেই পৃথকীকরণ ও বিভাজন ঘটেছে। তার ফলে পরবর্তীকালে অধিকতর সংখ্যায় সৃষ্টি হয়েছে গঠনাকৃতির বা রূপের। এক্ষেত্রে রূপ বলতে প্রাণীরূপ ও সমাজরূপের কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক রূপ ছিল নিতান্তই সরল প্রকৃতির। কালক্রমে এ গঠনাকৃতি হয়েছে জটিল প্রকৃতির। অর্থাৎ বিবর্তনের এ প্রক্রিয়া অনুযায়ী আদিতে বস্তু, জীব ও সমাজ ছিল সরল ও অযৌগিক প্রকৃতির। পরবর্তীকালে বস্তু, জীব ও সমাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে জটিল ও যৌগিক প্রকৃতির। এ প্রক্রিয়ায় এদের কাজকর্মে সংখ্যাধিক্য দেখা দিয়েছে এবং সৃষ্টি হয়েছে বৈচিত্র্য।

সমাজতত্ত্বকে স্পেনসার সমাজবিবর্তনের বৈশিষ্ট্যসমূহের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বিজ্ঞান হিসেবে দেখেছেন। সামাজিক বিবর্তনের বিশেষ বিশেষ অবস্থার বা মুহূর্তের নির্দিষ্ট ধ্যান-ধারণার বিকাশের বিষয়ে সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন। তারই অংশ হিসেবে সামাজিক ঘটনাবলির ক্ষেত্রে তিনি জীববিজ্ঞানের নিয়ম প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেন।

জৈবিক সাদৃশ্যমূলক মতবাদ

[সম্পাদনা]
  • জীবদেহ ও মানবসমাজের মধ্যে সাদৃশ্যমূলক স্বীকৃতি: হার্বার্ট স্পেনসার বিবর্তনবাদের প্রাথমিক বিষয় হিসেবে যে বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে সমাজের ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন তা হলো জীবদেহ ও মানবসমাজের মধ্যে সাদৃশ্যমূলক স্বীকৃতি। স্পেনসারের অভিমত অনুযায়ী জীবদেহের ক্ষেত্রে যা প্রাসঙ্গিক মানবসমাজের ক্ষেত্রেও তা সমভাবে প্রাসঙ্গিক বা প্রযোজ্য। এ ধারণাকেই তিনি জৈবিক অভিব্যক্তির সূত্রে গ্রথিত করেছেন, যা তার জৈবিক সাদৃশ্যমূলক মতবাদ নামে স্বীকৃত। এ মতবাদের সার-সংক্ষেপ বক্তব্য হলো, জীবজগতের সাথে মানবসমাজের কাঠামোগত গূঢ় সাদৃশ্য আছে। সুতরাং জীবজগতের ক্ষেত্রে যে তত্ত্ব সত্য প্রতিপন্ন হয়, মানবসমাজের ক্ষেত্রেও তা সমভাবে প্রযোজ্য। তাঁর মতানুসারে জীবজগতে এককোষ বিশিষ্ট প্রাণীর মধ্যেই সর্বপ্রথম প্রাণের উন্মেষ ঘটে। গঠনগত দিক থেকে এই এককোষী প্রাণী ছিল অত্যন্ত সহজ সরল ধরনের। ঠিক তেমনি প্রাচীনকালের আদিম সমাজে ছোট ছোট দল বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে মানুষ বসবাস করতো। কালক্রমে বিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসেবে জীবজগতের ক্ষেত্রে কাঠামো ও কার্যগত পরিবর্তন ঘটেছে, বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছে, জটিলতা দেখা দিয়েছে। সেভাবে মানুষের সমাজজীবনের পরিবর্তন, বিভিন্নতা ও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ জীবজগৎ এবং মানবসমাজ উভয়েরই ক্রমবিকাশ বা ক্রমবর্ধমানের ধারা অভিন্ন। প্রাণিদেহের মতো আদিকালের সমরূপতা থেকে ধীরে ধীরে চূড়ান্তভাবে বিষমরূপতায় উপনীত হয়েছে।
  • সহজ সরল অবস্থা থেকে জটিল অবস্থায় রূপান্তর: জীবদেহ যেমন সহজ সরল কাঠামো থেকে জটিল কাঠামোর রূপ পরিগ্রহ করে তেমনি সমাজকাঠামোও ক্রমান্বয়ে জটিলরূপ নেয়।
  • কাঠামোগত পরিবর্তনের সাথে সাথে তার কার্যক্রমের পরিবর্তন: জীবদেহের কাঠামোগত পরিবর্তনের সাথে সাথে তার কার্যক্রমের পরিবর্তন ঘটে, তেমনি সমাজের জটিলতা বৃদ্ধির সাথেও কার্যক্রমের পরিবর্তন ঘটে।
  • আয়তন বৃদ্ধির সাথে সাথে কাঠামোর বৃদ্ধি: প্রাণিদেহের ও সমাজদেহের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। তাদের আয়তন বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের কাঠামোরও বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। অতি নিম্নশ্রেণির একটি জীবের মতো একটি উচ্চ শ্রেণির জীবের ভূণেরও কিছু বিভাজনযোগ্য অংশ থাকে। কিন্তু ভূণটি যখন আয়তনে বাড়তে থাকে, তখন এর অংশগুলোও বাড়তে থাকে এবং বিভাজিত হয়। একই ধারা সমাজের ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়। আদিতে সমাজের বিভিন্ন এককের গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে সংখ্যা ও মাত্রাগত বিচারে বৈসাদৃশ্য অস্পষ্ট থাকে। কিন্তু কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বিভাজন পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং ক্ষয় হওয়ার সময় হয়। তখন মানবদেহ এবং সমাজদেহ উভয় ক্ষেত্রেই এ বৃদ্ধি ও বিভাজনের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ জীবদেহ ও সমাজদেহ উভয়েরই বৃদ্ধি ঘটে। সুতরাং সমাজ হলো জীবদেহ সদৃশ। স্পেনসার এভাবে জৈবিক এবং সামাজিক সত্তার মধ্যে সামঞ্জস্য নির্ণয় করেন। কিন্তু এ দুটির ভিতর পার্থক্যও লক্ষ করেছেন। যেমন-

প্রথমত, জীবদেহ হলো বিভিন্ন অঙ্গের এক সংলগ্ন সমাহার। জীবদেহের অঙ্গসমূহ পরস্পরের সাথে অতি দৃঢ় ও ঘনিষ্ঠভাবে সংলগ্ন ও সম্পর্কযুক্ত থাকে। সেজন্য জীবদেহটির একটি অখণ্ড সমগ্ররূপ হিসেবে অবয়ব লক্ষ করা যায়। কিন্তু সমাজের অংশগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন। একটি সামগ্রিক সমাজের অবয়ব পরিলক্ষিত হয় না। সেজন্য সমাজকে বিমূর্ত ধারণা হিসেবে গণ্য করা হয়।

দ্বিতীয়ত, জীবদেহের অঙ্গসমূহের মধ্যে একটি সুবিন্যস্ত আয়তন থাকে এবং অঙ্গসমূহের সংখ্যাও থাকে, কিন্তু সমাজের ক্ষেত্রে এর সুবিন্যস্ত আয়তন ও গঠনের সুসামঞ্জস্যতা নেই।

সর্বশেষে জীবদেহের ক্ষেত্রে চেতনা দেহের একটি অংশে সীমাবদ্ধ থাকে। মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রে জীবদেহের চেতনা কেন্দ্রীভূত থাকে। কিন্তু সমাজের ক্ষেত্রে এ চেতনা পরিব্যাপ্ত থাকে সমাজের সমগ্র অংশে।

হার্বার্ট স্পেনসারের জৈব সাদৃশ্য মতবাদ সম্পর্কে তার পরবর্তী সময়ের অভিমত ছিল, সমাজ হলো জীবদেহের মতো পরস্পরের উপর নির্ভরশীল অংশসমূহকে নিয়ে গড়ে উঠা একটি কাঠামো মাত্র, এর বেশিকিছু নয়।

বস্তুত জীবদেহ ও মানবসমাজের মধ্যে সাদৃশ্যমূলক আলোচনার মাধ্যমে স্পেনসার জীবদেহে ও মানবসমাজের উৎপত্তি, বিকাশ, পরিণতি ও অবক্ষয়ের এক প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। এ ব্যাখ্যার মধ্যেই বিবর্তনের বীজ নিহিত আছে। তাঁর বিবর্তনতত্ত্বে সাদৃশ্য থেকে বৈসাদৃশ্যে এবং সরল থেকে জটিল অবস্থায় রূপান্তরের কথা বলা হয়েছে। স্পেনসার বিবর্তনের এ নিয়মের তিনটি প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছেন; যথা: * পৃথকীকরণ (Differentiation), * সংহতি সাধন (Integration) এবং * নিয়মানুগত্য (Determination)।

  • পৃথকীকরণ (Differentiation): বিবর্তন হলো ক্রমাগত পৃথকীকরণ। পৃথকীকরণের কারণে জীবদেহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিভক্ত হয়ে যায়। আঙ্গিক বিবর্তনে পৃথকীকরণের মতো সমাজব্যবস্থায়ও বিভিন্ন জাতি, উপজাতি প্রভৃতির সৃষ্টি হয়।
  • সংহতি সাধন (Integration): পৃথকীকরণের ফলে জীবদেহের অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের এবং তাদের কার্যকলাপের ধরন বা প্যাটার্নের বিশেষীকরণ ঘটে এবং বিভিন্ন অঙ্গের পুষ্টি ও বিকাশ সাধিত হয়। আবার এ বিশেষীকৃত কার্যধারার সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়োজন দেখা দেয়। সমাজজীবনেও সমাজের বিশেষীকৃত অংশসমূহের মধ্যে সংহতি সাধন অপরিহার্য।
  • নিয়মানুগত্য (Determination): নিয়মানুগত্য হচ্ছে শৃঙ্খলার ধারাবাহিকতা। অনির্ধারিত শৃঙ্খলা থেকে নির্ধারিত শৃঙ্খলায় নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে সম্পাদিত হয়। এ রীতির ধারাবাহিকতাকেই স্পেনসার নিয়মানুগত্য বলেছেন। স্পেনসার এভাবে জীবদেহের ক্রমবিকাশের সাথে সমাজদেহের ক্রমবিকাশের তুলনামূলক আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, উভয় ক্ষেত্রেই বিবর্তন সুশৃঙ্খলভাবে সম্পাদিত হয়। তাঁর মতানুসারে সামাজিক বিবর্তন ও সামাজিক অগ্রগতি ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, সামাজিক বিবর্তন সামাজিক অগ্রগতিরই নামান্তর। সমাজজীবনের ক্ষেত্রে ক্রমবিবর্তনের সাধারণ নীতি ক্রিয়াশীল। সামাজিক বিবর্তনের গতি সর্বদাই উন্নতির দিকে। তাঁর মতে, সামাজিক প্রগতি একরৈখিক নয়, বরং বিচিত্র ধরনের ".... he stressed, social progress was not linear, but divergent.

As Perrin justly noted, Spencer had not one but at least four interpretation of social evolution. (1) as progress toward an ideal 'Social State'; (2) 'as the differentiation of social aggregates into functional subsystems'; (3) 'as an advancing division of labour'; and (4) 'as the origin of species of societies. (Robert, C. Perrin, Herbert Spencer's four theories of social evolution. In American Jourmal of Sociology 1976-81,6: 1339-1359 (As Qt. from: Igor. Kon : 1989: 52).

স্পেনসারের উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা যা পেররীন (Perrin) তুলে ধরেছেন, তা থেকে আমরা বিবর্তনের যে ধারণা পাই তা হলো, (ক) আদর্শ সামাজিক অবস্থায় উত্তরণ; (খ) সামাজিক বৈচিত্র্যের সমগ্র থেকে একটি কার্যকরী ব্যবস্থায় উত্তরণ; (৩) শ্রমবিভাজনের উত্তরোত্তর অগ্রগতি এবং (৪) সমাজের প্রজাতিগত উৎপত্তি। কিন্তু তিনি এসবের মধ্যে সমন্বয় সাধনে সফলতা অর্জন করতে পারেননি।

সামাজিক বিবর্তনবাদ

[সম্পাদনা]

স্পেনসারের সমাজ বিবর্তনের ধারণাটি তাঁর জৈব বিবর্তনের তত্ত্ব থেকে উদ্ভুত। জৈবিক অভিব্যক্তি সূত্রের সাহায্যে তিনি সমাজের ক্রমবিকাশের ব্যাখ্যা করেন।

সামাজিক বিবর্তনকে তিনি দুটি পর্যায়ে বিশ্লেষণ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি সরল সমাজ থেকে বিভিন্ন স্তরের মৌণিক সমাজে না জটিলতর সমাজে উন্নয়নের কথা বলেছেন। এ পর্যায়ে তাঁর আলোচনায় চার খরনের সমাজের কথা বলেছিলেন।

১. সরল সমাজ, ২. যৌগিক সমাজ। ৩. দ্বিগুণ যৌগিক সমাজ এবং ৪. ত্রিগুণ যৌগিক সমাজ।

এ শ্রেণিবিভাজন প্রাথমিকভাবে পরিমাণ বা আয়তন ভিত্তিক। তবে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয় যেমন- অধিকতর বিস্তৃত শ্রমবিভাগ, বেশি সুবিন্যস্ত রাজনৈতিক সংগঠন, ব্যাপক ধর্মীয় ভেদাভেদ বা উঁচু-নিচু জরভেদ, সামাজিক মর্যাদার স্তরবিন্যাস ইত্যাদিকেও তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। টিম বটোমোর। অনুবাদ। হিমাচল চক্রবর্তী। ১৯৯২ ১২৯/

  • সরল সমাজ (Simple society): স্পেনসার সরল সমাজের বিবরণ দিতে গিয়ে একক গঠন ও পারস্পরিক এক ধরনের সমবেদনার নিয়মের অনুগামী কার্যক্রম প্রাধান্য জনসমষ্টিকে বুঝিয়েছেন। কেবল কিছুসংখ্যক পরিবারের সমন্বয়ে সরল সমাজ গড়ে উঠে।
  • যৌগিক সমাজ (Compound society): সমাজের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে সরল সমাজের বহুসংখ্যক পরিবার কালক্রমে কিছুসংখ্যক গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। গোষ্ঠীবদ্ধ এ সমাজই যৌগিক সমাজ হিসেবে পরিগণিত হয়।
  • দ্বিগুণ যৌগিক সমাজ (Double compound society): আবার কারকগুলো যৌগিক সমাজের সমাহারে সৃষ্টি হয় দ্বিগুণ যৌগিক সমাজের। এ পর্যায়ে গোষ্ঠীগুলো কতকগুলো উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ল।
  • ত্রিগুণ যৌগিক সমাজ (Treple compound society): যখন সমাজে অধিকতর বিস্তৃত শ্রমবিভাগ, বেশি সুবিন্যস্ত রাজনৈতিক সংগঠন, ব্যাপক ধর্মীয় ভেদাভেদ, সামাজিক মর্যাদার স্তরবিন্যাস ঘটে তখন উপজাতিগুলো একত্রিত হয় এবং জাতি রাষ্ট্রের মধ্যে সংগঠিত হয়। স্পেনসারের মতে, তখন এ ত্রিগুণ যৌগিক সমাজ মানবসভ্যতার অগ্রগতির প্রতিভূ হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে। এ রকম সমাজের উদাহরণ আায়ীন মেক্সিকো, এ্যাসিরিয় সাম্রাজ্য, রোমান সাম্রাজ্য, মেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মান, ইতালি এবং রাশিয়া উল্লেখযোগ্য।

উপর্যুক্ত আলোচনাটি হলো তাঁর প্রথম পর্যায়ের বিশ্লেষণ। পরবর্তীকালে তিনি সামাজিক বিবর্তনের আর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাখ্যায় স্পেনসার সমাজের দুটি ভাগ দেখিয়েছেন। (১) সমরভিত্তিক (Military society) এবং শিল্পভিত্তিক সমাজ (Industrial society)। অবশ্য এ দুই স্তরের অন্তর্বর্তী পর্যায়ে আর এক ধরনের সমাজের অস্তিত্বের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। যাকে তিনি অবস্থজর প্রাপ্তিকালীন সমাজ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

যুদ্ধভিত্তিক সমাজে বা সমরভিত্তিক সমাজে সকলকে কঠোর নিয়ম-নীতির অধীনে থাকতে হতো। সরকারের বিধি-নিষেধের কড়াকড়িতে ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল কুক্ষিগত। সরকারের নিয়ম-নীতির নিষেধাজ্ঞার চাইতে ধর্মীয় বিধিবিধানের কঠোরতা ছিল আরো বেশি। অর্থাৎ সমরভিত্তিক সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল উপেক্ষিত, অবহেলিত। ফলে রাষ্ট্রের জন্যই ছিল ব্যক্তি, ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়।

শিল্পভিত্তিক সমাজকাঠামোতে ব্যক্তিস্বাধীনতা 'সামাজিক চুক্তি'র মাধ্যমে বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ চুক্তির ভিত্তিতেই সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের উপর গুরুত্বারোপ করা হতো। সরকার হয় বিকেন্দ্রীভূত। সামাজিক স্তরবিন্যাস ব্যবস্থা অর্জিত মর্যাদার ভিত্তিতে মূল্যায়িত হতে থাকে। এরকম সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়। শিল্পভিত্তিক সমাজে সহযোগিতার বিষয়টি স্বেচ্ছামূলক। স্বেচ্ছামূলক সহযোগিতার উপর এ সমাজ প্রতিষ্ঠিত।

সমাজবিজ্ঞানে হার্বার্ট স্পেনসারের অবদান

[সম্পাদনা]

ইংল্যান্ডের সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারা বিকাশের সাথে হার্বার্ট স্পেনসারের নাম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অগাস্ট কোঁৎ 'সমাজবিজ্ঞানে'র নামকরণের পর জন স্টুয়ার্ট মিল এবং হার্বার্ট স্পেনসার এ দুই ইংরেজ দার্শনিকের হাতে সমাজবিজ্ঞান বিকশিত হয় এবং সমৃদ্ধি লাভ করে। বিশেষকরে হার্বার্ট স্পেনসার এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পূর্ব পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ঘটেনি। ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত 'The Study of Sociology' গ্রন্থটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাজগতে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সমকালীন সমাজবিজ্ঞানের প্রাণপুরুষ চার্লস হর্টন কুলী (Charles Horton Cooley) এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের বিশিষ্ট অধ্যাপক উইলিয়াম গ্রাহাম সামনার (William Graham Sumner) স্পেনসারের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন।

সামাজিক বিবর্তনের বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করাই হলো স্পেনসারের সমাজবিজ্ঞান আলোচনার মূল বিষয়। মানবসমাজের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে স্পেনসারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর অগ্রণী ভূমিকায় সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে গড়ে উঠে।

আমরা এখানে সমাজবিজ্ঞান বিকাশে স্পেনসারের অবদান সম্পর্কে তিনটি প্রধান বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো।

প্রথম বিষয়টি হলো জীববিদ্যার তত্ত্বগুলো সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্বে প্রয়োগ করার প্রয়াস। সমাজসম্পর্কিত বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা বহুদিন পর্যন্ত জীববিদ্যার তত্ত্বগুলোর সাহায্যে করা হয়েছে। সমাজ ও জীবকে অভিন্ন না ভেবে কেবল এদের মধ্যে সাদৃশ্যের বিষয়টি মনে রেখে অগ্রসর হলে অর্থবহ আলোচনা সম্ভব। সামাজিক গঠনতন্ত্রের ধারণা (Social System) এরূপ আলোচনা থেকে উদ্ভূত। সমাজবিজ্ঞানী Igor Kon তাঁর 'Herbert Spencer's Sociological Conception' নিবন্ধে বলেন, 'He was the first in sociology to begin systematic use of the concepts system 'function', 'structure' and 'institution'. His superiority to Comte was his much more consistent reliance on empirical, above all comparative historical investigations. He was one of the first to try and demarcate the concepts of evolution and progress and overcome the short comings of the linear conception of development, throwing a bridge from sociology to ethnology.

[Igon Kon: 1989:53]

বাংলা ভাবার্থ হচ্ছে, সমাজবিজ্ঞানে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি 'ব্যবস্থা', 'ক্রিয়া', 'কাঠামো' এবং 'প্রতিষ্ঠান' ইত্যাদি সমাজতাত্ত্বিক প্রত্যয়ের সুসংবদ্ধ প্রয়োগ শুরু করেন। তিনি অন্তত একদিক থেকে অগাস্ট কোঁৎ-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারেন, সেটি হচ্ছে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাভিত্তিক সমাজ গবেষণার উপর তাঁর গুরুত্ব প্রদান। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তিনি সমাজ গবেষণায় তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি পরিত্যাগ করেছেন। তিনিই সমাজবিজ্ঞানে সর্বপ্রথম 'বিবর্তন' এবং 'প্রগতি' নামক সমাজতাত্ত্বিক ধারণা দুটির মধ্যে বিদ্যমান অর্থগত সঙ্গতির অস্পষ্টতা নির্ধারণ করে অধিকতর বিজ্ঞানসম্মতরূপে তুলে ধরার প্রয়াস পান। তিনি এর মাধ্যমে 'উন্নয়ন'-এর একরৈখিক তত্ত্বের ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা করেন। আর এভাবে তিনি সমাজবিজ্ঞানের সাথে জাতিতত্ত্বের একটি সেতুবন্ধন রচনা করতে সমর্থন হন।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো সমাজের বিভিন্ন অংশের পরস্পর নির্ভরশীলতা। স্পেনসার তাঁর 'Principles of Sociology' নামক গ্রন্থে জোর দিয়ে বলেন, "জীবদেহ ও সমাজের মধ্যে সাদৃশ্য কেবল বিভিন্ন অংশের পরস্পর নির্ভরশীলতায় পাওয়া যাবে।" অর্থাৎ স্পেনসারের মতে, সমাজকে পরস্পর নির্ভরশীল অংশের দ্বারা গঠিত একটি কাঠামো ভাবা যেতে পারে। কেবল তাই নয়, এ অংশগুলোকে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করে প্রত্যেক অংশের প্রকৃতি নিরূপণ করা যেতে পারে। এখানে আমরা দেখতে পাই, স্পেনসার সমাজকাঠামোর আলোচনায় জীববিদ্যায় ব্যবহৃত ধারণার যেমন- জৈব কাঠামো, বিবর্তন ইত্যাদির সাহায্য নিয়েছিলেন। তাঁর এ জাতীয় ভাবনা পরবর্তীকালে সামাজিক কাঠামো ও তৎসম্পর্কিত কাঠামোগত ক্রিয়াবাদ (Structural functionalism theory) এর সূচনা করে।

তৃতীয়ত, স্পেনসার সমাজের অভিব্যক্তি সম্পর্কে যে আলোচনার সূত্রপাত করেন, তা সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রত্যয় বিনির্মাণে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীদের চর্চায় অনুসৃত হয়েছে।

স্পেনসার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মূল রূপরেখা তাঁর 'The Man Versus the State'-এর মধ্যে বিধৃত। তিনি মনে করেন, ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সমাজ ও পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তনশীল। হার্বার্ট স্পেনসার একজন বিবর্তনবাদী ও জৈবিক মতবাদের তাত্ত্বিক প্রবক্তা হলেও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হিসেবেও তিনি অনেকের কাছে অধিক সুপরিচিত।

পরিশেষে আমরা স্পেনসারের অবদান মূল্যায়নে একথা উল্লেখ করতে পারি যে, সমাজবিজ্ঞানের উন্নয়ন ও ক্রমবিকাশের চলমান প্রবাহে স্পেনসারের বিবর্তনবাদ ঘরানা যে শক্তিশালী গতিধারার সঞ্চার করেছিল তা সমাজবিজ্ঞানের সীমিত গণ্ডিকে ব্যাপক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত করতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে।

জীবনের শেষপ্রান্তে এসে স্পেনসার যে দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছেন তা তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯০৪ সালে তা প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯০৩ সালের ৮ ডিসেম্বর পরলোকগমন করেন।

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]
জীবনী