বিষয়বস্তুতে চলুন

সন্ত্রাসবাদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে (১৯৭৩-২০০১) ঘটানো সন্ত্রাসবাদের ছবি

সন্ত্রাসবাদ হল সন্ত্রাসের পদ্ধতিগত ব্যবহার যা প্রায়শই ধ্বংসাত্মক এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ঘটানো হয়। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্ত্রাসবাদের কোন বেধে দেওয়া সীমারেখা অথবা সঙ্গায়ন নেই।[][] প্রচলিত সঙ্গানুযায়ী যে সকল বিধ্বংসী কার্যকলাপ জনমনে ভীতির উদ্বেগ ঘটায়, ধর্মীয়, রাজনৈতিক অথবা নীতিগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য কৃত রুচিবিরুদ্ধকাজ, ইচ্ছাপূর্বক সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার বিষয় উপেক্ষা অথবা হুমকি প্রদান করা। আইন বহির্ভূত কার্যকলাপ এবং যুদ্ধকেও সন্ত্রাসবাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।


সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা

[সম্পাদনা]

সন্ত্রাসবাদের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র, সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। জাতিসংঘ (UN), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইন্টারপোলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকার সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা পৃথকভাবে নির্ধারণ করেছে।[]

জাতিসংঘের মতে,

"সন্ত্রাসবাদ হলো এমন কোনো কর্মকাণ্ড, যা জনগণের মধ্যে ভয় সঞ্চার করে এবং রাজনৈতিক বা আদর্শগত উদ্দেশ্যে নির্দোষ ব্যক্তিদের ওপর সহিংসতা চালায়।"

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (FBI) সন্ত্রাসবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে—

"সন্ত্রাসবাদ হলো রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত, অবৈধ সহিংস কার্যক্রম, যা নির্দোষ জনগণের ওপর আক্রমণ বা বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।"


সন্ত্রাসবাদের ধরণ

[সম্পাদনা]

সন্ত্রাসবাদ বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেতে পারে এবং এর প্রকারভেদ নির্ভর করে উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ডের উপর। সাধারণত, সন্ত্রাসবাদের কয়েকটি প্রধান ধরন হলো—

১. রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ

[সম্পাদনা]

এটি কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংঘটিত সহিংস কর্মকাণ্ড। সাধারণত সরকারবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা চরমপন্থী রাজনৈতিক দল এ ধরনের সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়।

উদাহরণ:

  • ফরাসি বিপ্লবের সময় "Reign of Terror"
  • ১৯৭০-এর দশকে ইতালিতে "Red Brigades" গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড

২. ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ

[সম্পাদনা]

ধর্মীয় আদর্শকে ভিত্তি করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এটি সাধারণত ধর্মীয় উগ্রবাদী দল বা সংগঠনের মাধ্যমে সংঘটিত হয়।

উদাহরণ:

  • আইএসআইএস (ISIS) এবং আল-কায়েদার (Al-Qaeda) সন্ত্রাসী কার্যক্রম
  • ভারত ও পাকিস্তানে উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর হামলা

৩. রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ

[সম্পাদনা]

কিছু সরকার বা রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক বা সামরিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য সন্ত্রাসী কৌশল অবলম্বন করে। এটি সাধারণত রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা তাদের মদদপুষ্ট গোষ্ঠীর মাধ্যমে সংঘটিত হয়।

উদাহরণ:

  • সিরিয়ায় সরকারি বাহিনীর নিরীহ জনগণের ওপর হামলা
  • উত্তর কোরিয়ার গুপ্তচর সংস্থার কর্মকাণ্ড

৪. বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসবাদ

[সম্পাদনা]

একটি অঞ্চল বা গোষ্ঠী স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম চালায়।

উদাহরণ:

  • কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ড
  • স্পেনে বসক বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী "ETA"-এর সহিংসতা

৫. সাইবার সন্ত্রাসবাদ

[সম্পাদনা]

প্রযুক্তির অপব্যবহার করে ইন্টারনেট, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়।

উদাহরণ:

  • সরকার বা বড় প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হ্যাকিং
  • মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা

সন্ত্রাসবাদের কারণ

[সম্পাদনা]

সন্ত্রাসবাদের পেছনে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ থাকতে পারে।

১. রাজনৈতিক কারণ

[সম্পাদনা]
  • দমনমূলক শাসন ব্যবস্থা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
  • একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসন
  • রাজনৈতিক বৈষম্য ও অন্যায়

২. অর্থনৈতিক কারণ

[সম্পাদনা]
  • দারিদ্র্য ও বেকারত্ব
  • সম্পদের বৈষম্য
  • উন্নয়ন ও শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা

৩. ধর্মীয় ও আদর্শগত কারণ

[সম্পাদনা]
  • ধর্মীয় উগ্রবাদ ও বিভ্রান্তিকর মতবাদ
  • জাতিগত বা ধর্মীয় নিপীড়ন

৪. সামাজিক কারণ

[সম্পাদনা]
  • সামাজিক অবিচার ও বৈষম্য
  • গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষ প্রচার

সন্ত্রাসবাদের প্রভাব

[সম্পাদনা]

সন্ত্রাসবাদ শুধু নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর নয়, বরং সামগ্রিকভাবে সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে।

১. জনজীবনে প্রভাব

[সম্পাদনা]
  • সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি
  • ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি
  • নিরীহ মানুষের হতাহতের ঘটনা

২. অর্থনৈতিক প্রভাব

[সম্পাদনা]
  • বিনিয়োগ ও ব্যবসায় ধ্বস
  • রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি
  • পর্যটন শিল্পের ক্ষয়ক্ষতি

৩. রাজনৈতিক প্রভাব

[সম্পাদনা]
  • সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব
  • কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে নাগরিক স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া
  • যুদ্ধ ও সামরিক অভিযানের বৃদ্ধি

বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার উদ্যোগ

[সম্পাদনা]

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

১. জাতিসংঘের উদ্যোগ

[সম্পাদনা]
  • জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের (UNSC) সন্ত্রাসবাদবিরোধী রেজুলেশন
  • আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা বৃদ্ধি

২. আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী সংস্থাগুলো

[সম্পাদনা]
  • ইন্টারপোল (Interpol)
  • ন্যাটো (NATO)
  • ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) সন্ত্রাসবিরোধী নীতি

৩. বাংলাদেশে সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ

[সম্পাদনা]

বাংলাদেশ সরকার সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে।

  • সন্ত্রাস দমন আইন, ২০০৯
  • র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (RAB)-এর কার্যক্রম
  • জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (NSI)ডিজিএফআই (DGFI) এর ভূমিকা

সন্ত্রাসবাদ আধুনিক বিশ্বের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এটি শুধু একটি দেশের সমস্যা নয়, বরং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাই, সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে শিক্ষার প্রসার, দারিদ্র্য দূরীকরণ, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি। শক্তিশালী আইন ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের দমন করতে হবে, পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি স্তরে শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "The Right of Self-Defence under International Law-the Response to the Terrorist Attacks of 11 September"। ২৯ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জানুয়ারি ২০১৩ 
  2. Thalif Deen POLITICS: U.N. Member States Struggle to Define Terrorism ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১১ জুন ২০১১ তারিখে
  3. Silkworth, David (২০২০-০৩-২০)। "FaultTree: Fault Trees for Risk and Reliability Analysis"CRAN: Contributed Packages। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০২-১৫ 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]
  1. সন্ত্রাসবাদ এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইন আর্কাইভইজে আর্কাইভকৃত ৮ মার্চ ২০১০ তারিখে