ভারতে নারী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ভারতে নারী
লিঙ্গ বৈষম্য সূচক-২০১৫[২]
মান০.৬৮৩ (২০১৬)
অবস্থান৮৭তম[১]
মাতৃত্বকালীন মৃত্যু (প্রতি এক লক্ষে)১৭৪
সংসদে নারী১২.২%
মাধ্যমিক শিক্ষাসহ ২৫ উর্ধ্ব নারী৩৫.৩% [M: ৬১.৪%]
শ্রম ক্ষেত্রে নারী২৮% [M: ৮২%]
বৈশ্বিক জেন্ডার গ্যাপ সূচক-২০১৭[৩]
মান০.৬৬৯
অবস্থান১৪৪-এর মধ্যে ১০৮তম

বিগত কয়েক সহস্রাব্দে ভারতীয় নারীর অবস্থা বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। প্রাচীণযুগ থেকে মধ্য যুগে তাদের অবস্থার অবনতি আর কয়েকজন সমাজ সংস্কারকের প্রচেষ্টায় আবার সমমর্যাদার অধিকারে উত্তরণের ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল। আধুনিক ভারতে নারীরা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার অধ্যক্ষ, বিরোধী দলনেতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন।

ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত নারীর অধিকারের অর্ন্তভুক্ত মূল বিষয়গুলি হল সাম্য, মর্যাদা,বৈষম্য থেকে স্বাধীনতা। এছাড়াও, নারীর অধিকার সংক্রান্ত বহু বিধি প্রযোয্য

2018 সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি, লোকসভার(সংসদের নিম্নকক্ষ) অধ্যক্ষ, লোকসভার বিরোধী দলনেতা তিনটি পদই অলংকৃত করেন মহিলারা। যদিও আজও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মহিলারা লিঙ্গবৈষম্য ও অপরাধের শিকার।

ভারতীয় নারীর ইতিহাস[সম্পাদনা]

প্রাচীন যুগ[সম্পাদনা]

বৈদিক যুগের আদি পর্বে নারীরা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে সমানাধিকার ভোগ করেছে। পতঞ্জলি বা কাত্যায়ণের মতো প্রাচীণ ভারতীয় বৈয়াকরণের লেখা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে আদি বৈদিক যুগে নারীরা শিক্ষিত ছিলেন। ঋক বেদের শ্লোক থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে নারীরা পরিণত বয়সে বিবাহ করতেন এবং সম্ভবত স্বয়ম্বরা নামক প্রথায় নিজের স্বামী নির্বাচনের বা গান্ধর্ব বিবাহ নামক প্রথায় সহবাসের স্বাধীনতা তাদের ছিল। ঋক বেদ, উপনিষদের মতো আদি গ্রন্থে বহু প্রাজ্ঞ ও ভবিষ্যদ্রষ্টা নারীর উল্লেখ আছে, গার্গী ও মৈত্রেয়ী যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বৈষয়িক শিক্ষার[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] ক্ষেত্রেও নারীরা সমান সুযোগের অধিকারী ছিলেন। কবি হালের কাব্যসংকলন গাথা সপ্তশতীতে আটজন কাব্যরচয়িত্রীর নাম পাওয়া যায়, যারা চারুকলা বিদ্যা শিক্ষাতেও সমান পারদর্শী ছিলেন।

মনু বলেছেন, "যত্র নার্যস্তু পয়জ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। / যত্রৈতাস্তুন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রফলাঃ ক্রিয়া।" অর্থাৎ যেখানে নারী পূজিতা, সেখানে দেবতাও খুশি হন, যেখানে তাঁদের পূজা নেই, সেখানে সকল ধর্মকর্মই নিস্ফল। সুতরাং লক্ষ করা যায়, ভারতে প্রাচীনকালে নারীদের সম্মান প্রদর্শন করে আসছে।

"আম্রপালী ও গৌতম বুদ্ধ", হাতির দাঁতে খোদাই করা, জাতীয় সংপগ্রহশালা, নতুন দিল্লী

নারীর বেদপাঠের অধিকার ছিল। হরিতের ধর্মশাস্ত্রে বলা আছে-

মধ্যযুগে তা এই যুক্তিতে খারিজ হয়ে যায় যে তা পূর্বযুগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ শতকে নারীর অবস্থার অবনতি শুরু হয়।হয়।যদিও জৈনধর্মের ন্যায় সংস্কার আন্দোলনগুলি

নারীদেরকে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের অনুমতি দেয়, তবুও ভারতে অধিকাংশ নারী বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। বাল্যবিবাহের প্রথা খুব সম্ভবত ছয় শতকের কাছাকাছি সময় থেকে প্রচলন লাভ করে।

বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে নারীদের উপর আরোপিত বিধিনিষেধের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন, মনু স্মৃতি অনুযায়ী: নারী শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী বার্ধক্যে পুত্রের[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] অভিভাবকত্বে থাকবে, একজন মহিলা স্বয়ংশাসিত থাকার উপযুক্ত নয়। তবে এটি আদর্শিক গ্রন্থ, এবং নারীর স্বাধীন ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করার, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস গ্রহণের বর্ণনামূলক বিবৃতিও পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতে কিছু রাজ্যে নগরবধূর মতো প্রথা প্রচলিত ছিল। নারীরা নগরবধূর ঈপ্সিত শিরোপা জয় করতে প্রতিযোগিতা করতো। আম্রপালী এরকমই একজন জনপ্রিয় নগরবধূ।

জৈন ও বৌদ্ধ যুগেও নারীদের সম্মান ম্লান হয়নি। পুরুষদের মতো তারাও সংঘে প্রবেশ করতে পারতেন, সর্বপ্রকার বিদ্যালাভ করার সুযোগ থেকে সামান্যও বঞ্চিত হতেন না। জৈন ধর্মে দেখা যায়, একসময় পুরুষ অপেক্ষা নারী সদস্যের সংখ্যাই বেশি ছিল (যেখানে ভিক্ষু মাত্র চৌদ্দ হাজার, সেখানে ভিক্ষুণীর সংখ্যা ছত্রিশ হাজার)। এই ভিক্ষুণী সংঘের নেত্রী ছিলেন মহাবীরের আপন আত্মীয় চন্দনা। বৌদ্ধ সংঘের ক্ষেত্রে একথা সত্য যে গৌতম বুদ্ধ প্রথমে সংঘে নারীদের প্রবেশের অনুমতি দেননি, পরে প্রিয় শিষ্য আনন্দের বিশেষ অনুরোধে নারীরা সংঘে প্রবেশাধিকার লাভ করে।

মধ্যযুগ[সম্পাদনা]

মধ্যযুগী ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটে এবং বাল্যবিবাহের প্রচলন এবং বিধবাদের পুনর্বিবাহের নিষেধাজ্ঞা ভারতে কিছু সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসকদের আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গেই ভারতীয় সমাজে পর্দা প্রথার প্রচলন ঘটে। রাজস্থানের রাজপুতদের মধ্যে জওহর প্রথার প্রচলন ছিল। ভারতে কিছু অংশে, দেবদাসীরা কখনো কখনো যৌন নির্যাতনের শিকার হন। রাজনৈতিক কারণে হিন্দু ক্ষত্রিয় শাসকদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। অনেক মুসলিম পরিবারে, নারীর গতিবিধি বাড়ির অন্দরমহলেই সীমাবদ্ধ ছিল।

খুব অল্প সংখ্যক গ্রন্থেই স্ত্রী আচার ও মহিলাদের ক্রিয়াকলাপ মূল উপজীব্য বিষয়, তবে, ১৭৩০ সালে তাঞ্জৌরের জনৈক রাজকর্মচারী ত্রম্বকোয়জ্যন রচিত স্ত্রী ধর্ম পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম। প্রথম শ্লোকটি হল:

এই পরিস্থিতিতেও, রাজনীতি, সাহিত্য, শিক্ষা ও ধর্ম সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু বিশিষ্ট নারীর সন্ধান পাওয়া যায়। রাজিয়া (১২০৫-১২২০) একমাত্র মহিলা সুলতান যিনি দিল্লি শাসন করেছেন। ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে মুগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি আসাফ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারানোর আগে গোন্দ রানী দুর্গাবতী ১৫ বছর(১৫২৪-১৫৬৪) রাজ্যশাসন করেছিলেন। চাঁদ বিবি ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে আকবরের শক্তিশালী মুগল বাহিনীর বিরুদ্ধে আহমদনগরকে রক্ষা করেছিলেন। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহানের রাজ্যশাসনে কার্যকরী ভূমিকা ছিল এবং তিনি মুঘল সিংহাসনের পিছনে প্রকৃত ক্ষমতা হিসেবে পরিগণিত হতেন। মুঘল রাজকুমারী জাহানারা ও জিবন্নুসিসা ছিলেন বিখ্যাত কবি এবং তারা ক্ষমতাসীন শাসকদেরও প্রভাবিত করেছিলেন। যোদ্ধা এবং প্রশাসক হিসেবে তার দক্ষতার শিবাজীর মা জিজাবাইকে শাসক বা রাজপ্রতিনিধির মর্যাদা দিয়েছিল। তারাবাই ছিলেন আরেকজন মহিলা মারাঠা শাসক। দক্ষিণ ভারতে অনেক নারী গ্রাম, শহর ও বিভাগ পরিচালনা করেন এবং নতুন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।

ভক্তি আন্দোলন নারীর অবস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে এবং তাদের উপর হওয়া বিভিন্ন নিপীড়নের বিষয়ে প্রশ্ন তোলে।

ইতিহাসপ্রসিদ্ধ প্রথাসমূহ[সম্পাদনা]

কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত থাকা সতী, জওহর এবং দেবদাসীর মতো প্রথা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আধুনিক ভারতে এই প্রথাগুলি প্রায় অবলুপ্ত। যদিও ভারতেবর্ষের কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও এইসব প্রথা মাঝেমাঝে পালিত হয়। কিছু সম্প্রদায়ের মহিলারা আজও পর্দা প্রথা মেনে চলেন। বাল্যবিবাহ গ্রামাঞ্চলে আজও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি, যদিও এটি বর্তমান ভারতীয় আইন অনুযায়ী অবৈধ।

সতী বা সতীদাহ প্রথা[সম্পাদনা]

সতী বা সতীদাহ কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত থাকা একটি পুরানো, প্রায় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাওয়া প্রথা, যেখানে বিধবা মহিলারা স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিতেন। যদিও বিধবাদের এই প্রথায় অংশগ্রহণ স্বেচ্ছায় বলে ধরা হত, তবে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী বর্তমান যুগে অর্থাৎ কলি যুগে এটি নিষিদ্ধ। ভারতীয় উপমহাদেশের বৈদেশিক আগ্রাসনের পর থেকেই, এই প্রথাটি তার উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করে, কারণ, নারীরা প্রায়ই বৈদেশিক বাহিনীর দ্বারা ধর্ষিত বা অপহৃত হত। ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক এই প্রথাটির বিলোপ ঘটানো হয়। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ৪০টি সতীদাহর ঘটনা ঘটেছে বলে খবরে প্রকাশ। ১৯৮৭ সালে রাজস্থানের রূপ কানোয়ার মামলায় সতীদাহ(প্রতিরোধ) আইন বলবত্ হয়।

জওহর বা জহর প্রথা[সম্পাদনা]

কোনো যুদ্ধে পরাজিত বাহিনীর স্ত্রী ও কন্যারা শত্রুপক্ষের হাতে বন্দী হওয়া বা যৌন নিপীড়ন এড়াতে স্বেচ্ছয় অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিতেন। এই প্রথাটি জওহর প্রথা নামে পরিচিত এবং এটি মূলত রাজপুত সমাজে প্রচলিত ছিল, যেখানে জওহর ব্রতে শহীদ রমণীরা সম্মানের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হন। এই প্রথার চর্চা মূলত ভারতে ইসলামী আক্রমনের সময় ঘটেছিল।

পর্দা প্রথা[সম্পাদনা]

পর্দা প্রথা মূলত কিছু মুসলিম সম্প্রদায়ের মান্য প্রথা যেখানে মহিলারা নিজেদের সম্ভ্রম বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সর্বদা কোনো আড়াল বা অন্তরালের নেপথ্যে থাকেন।

দেবদাসী প্রথা[সম্পাদনা]

দেবদাসী প্রথাকে বহুক্ষেত্রেই ধর্মীয় অনুশাসন বলে ভুল করা হয়। এটি মূলত দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত একটি প্রথা। এই প্রথা অনুযায়ী, মহিলারা কোনো দেবতা বা মন্দিরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেন এবং এরপর তাদের সামাজিক বিবাহ থেকে বিরত থাকতে হত। এরপর, তারা দেবীকে সেবা করার জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করতেন। প্রথাটি ১০ম শতাব্দী থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।১৯৮৮ সালে এই প্রথাটি দেশে বেআইনি ঘোষণা করা হয়, কিন্তু দেশের কিছু অঞ্চলে এখনো, মূলত নিম্নতম বর্ণের মেয়েরা দেবদাসী হিসেবে কাজ করে।

ব্রিটিশ রাজত্বকাল[সম্পাদনা]

ব্রিটিশ রাজত্বকালে রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জ্যোতিরাও ফুলে এবং আরও অনেক সমাজ সংস্কারক নারীদের উন্নয়নের জন্য লড়াই করেছিলেন। কলকাতার হিন্দু কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এবং ইয়ং বেঙ্গল এর সদস্য পিয়ারী চরণ সরকার, ১৮৪৭ সালে কলকাতার শহরতলি বারাসতে ভারতের প্রথম অবৈতনিক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন (পরবর্তীকালে বিদ্যালয়টি কালীকৃষ্ণ গার্লস হাই স্কুল নামে পরিচিতি লাভ করে)।

যদিও ব্রিটিশ রাজত্বকালে বহুক্ষেত্রেই ইংরেজদের কোনও ইতিবাচক অবদান ছিল না, তবে এর বিপরীত ঘটনাও আছে। ক্রিশ্চান ধর্মপ্রচারকের(missionary) স্ত্রী মার্থা মোল্ট মিয়েড এবং তার কন্যা এলিজা ক্যাল্ডওয়েল মোল্ট দক্ষিণ ভারতে মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাব্যবস্থার পথিকৃত্ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এই প্রচেষ্টা তৎকালীন প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরোধী হওয়ায় প্রাথমিকভাবে স্থানীয় প্রতিরোধের মুখে পড়ে। রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় ১৮২৯ সালে গভর্নর-জেনারেল উইলিয়াম ক্যভেণ্ডিশ-বেন্টিঙ্কের কার্যকালে সতীদাহ প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। বিধবাদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের ফলে ১৮৫৬ সালে বিধবা পুনর্বিবাহ আইন পাশ হয়। নারী মুক্তি আন্দোলনে পণ্ডিত রমাবাঈ এর মতো অনেক মহিলা সমাজ সংস্কারকেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

কর্ণাটকের স্থানীয় রাজশাসিত রাজ্য কিত্তুরের রানী, কিত্তুর চেন্নাম্মা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সশস্ত্র বিপ্লবীদের নেতৃত্ব দেন।কলকাতার বিখ্যাত জনদরদী জমিদার রানি রাসমণি বহুবার ব্রিটিশ সিপাহিদের উপর মামলা করেন।এবং বহু সামাজিক উন্নয়ন এ অবদান রাখেন। উপকূলবর্তী কর্ণাটকের রানী আব্বাক্কা, ইউরোপীয় সৈন্যদের, বিশেষত ১৬ শতকের পর্তুগিজ সৈন্যদের আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বাই ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশ বিরোধী সিপাহী বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। তিনি বর্তমানে জাতীয় নায়কের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিতা। অযোধ্যার যুগ্ম শাসক বেগম হযরত মহল, ছিলেন আর এক জন শাসক যিনি ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে সন্ধিস্থাপনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরে নেপালে আত্মগোপন করেন। ভোপালের বেগমরাও এই সময়ের উল্লেখযোগ্য মহিলা শাসক হিসেবে বিবেচিত হন। তারা মার্শাল আর্টেও প্রশিক্ষিত ছিলেন।

চন্দ্রমুখী বসু, কদম্বিনী গাঙ্গুলী এবং আনন্দীগোপাল জোশি সফল শংসাপত্র অর্জনকারী ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে অগ্রগণ্য।

১৯১৭ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সমর্থিত প্রথম নারী প্রতিনিধিদল নারীর রাজনৈতিক অধিকার নিষ্চিত্ করার দাবি নিয়ে রাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ১৯২৭ সালে পুণেতে নিখিল ভারত নারীশিক্ষা বিষয়ক আলোচনাচক্র(অল ইন্ডিয়া উইমেনস এডুকেশন কনফারেন্স) অনুষ্ঠিত হয়, এবং এটি সামাজিক উন্নয়ণমূলক আন্দোলনের একটি প্রধান সংগঠন হয়ে ওঠে। ১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিবর্তন আইন পাস হয়, যেখালে একটি মেয়ের বিয়ে করার ন্যূনতম বয়স ১৪ বছর বলে স্থির করা হয়। যদিও মহাত্মা গান্ধী নিজে তেরো বছর বয়সে বিবাহ করেন, পরে তিনি বাল্যবিবাহ বর্জন করার জন্য এবং বাল-বিধবাদের বিয়ে করার জন্য দেশের যুবকদের আহ্বান জানান।

স্বাধীন ভারতে নারীসুরক্ষা[সম্পাদনা]

ভারতে নারীরা এখন শিক্ষা, ক্রীড়া, রাজনীতি, গণমাধ্যম, শিল্প ও সংস্কৃতি, সেবা খাত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পূর্ণরূপে অংশগ্রহণ করছেন।ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সময়যাবত্ দায়িত্ব সামলানো নারী প্রধানমন্ত্রী, যিনি একটানা পনের বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ভারতের সংবিধান সব ভারতীয় নারীকে সাম্য (অনুচ্ছেদ ১৪), রাষ্ট্রের দ্বারা কোন বৈষম্যের মুখোমুখি না হওয়া (অনুচ্ছেদ ১৫(১)), সমান সুযোগলাভ (অনুচ্ছেদ ১৬) এবং একই কাজের জন্য সমান বেতন (অনুচ্ছেদ ৩৯ঘ ও ৪২) লাভের অধিকার দিয়েছে। এছাড়াও, সংবিধান নারী ও শিশুদের সুবিধার্থে রাজ্য কর্তৃক বিশেষ বিধান প্রণয়নকে মান্যতা দেয়, নারীর প্রতি অবমাননামূলক আচরণের বিরোধিতা করে (অনুচ্ছেদ ৫১কঙ) এবং কাজকর্মের অনুকূল সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করার ও মাতৃত্বকালীন সুযোগসুবিধা প্রাপ্তির ব্যবস্থা যাতে রাজ্য করতে পারে, সেই সংস্থান রাখে (অনুচ্ছেদ ৪২)।

ভারতে নারীবাদী কর্মকান্ডের সক্রিয়তা ১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকে গতি লাভ করে। জাতীয় স্তরের যে বিষয়গুলি প্রথম নারীবাদী সংগঠনগুলিকে সংঘবদ্ধ করে মথুরা ধর্ষণ মামলা তাদের মধ্যে একটি। ১৯৭৯-১৯৮০ সালে থানায় ভিতর মথুরা নামের একটি অল্পবয়সী মেয়েকে ধর্ষণে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মীরা বেকসুর খালাস পাওয়ায় দেশব্যাপী বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয়। জাতীয় প্রচার মাধ্যমগুলি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রচারিত এইসমস্ত বিক্ষোভ সরকারকে সাক্ষ্য আইন, ফৌজদারি কার্যবিধি ও ভারতীয় দণ্ডবিধি সংশোধন করতে বাধ্য করে; এবং হেফাজতে থাকাকালীন ধর্ষণ(custodial rape) নামে একটি নতুন অপরাধ নথিবদ্ধ হয়। শিশুকন্যা হত্যা, লিঙ্গ বৈষম্য, নারী স্বাস্থ্য, নারী নিরাপত্তা এবং নারী শিক্ষার মতো বিষয়গুলি নিয়েও নারী আন্দোলনের কর্মীরা একতাবদ্ধ হন।

যেহেতু ভারতবর্ষে মদ্যাশক্তি অধিকাংশ সময়েই নারীদের বিরুদ্ধে হিংসার সঙ্গে জড়িত, তাই বেশ কয়েকটি মহিলা সংগঠন অন্ধ্র প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা, ওড়িশা, মধ্য প্রদেশ এবং অন্যান্য রাজ্যে মদ বিরোধী প্রচার শুরু করে। অনেক ভারতীয় মুসলিম নারী শরীয়তের আইন অনুসারে নারীর অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন এবং তিন তালাক ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন (২০১৭-এর ঘটনাবলী জানতে নিচে দেখুন)।

১৯৯০ এর দশকে বেশ কিছু বিদেশী সংস্থার অনুদানে কিছু নতুন নারী-কেন্দ্রিক বেসরকারি সংগঠন গড়ে ওঠে। এইসব স্বনির্ভর গোষ্ঠী এবং “স্ব-নিযুক্ত নারী সমিতি” (Self Employed Women's Association বা সেবা)-র মতো বেসরকারি সংগঠন ভারতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। স্থানীয় আন্দোলনের নেতা হিসেবে উঠে এসেছেন মেধা পাটেকারের(নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন) মতো বহু প্রভাবশালী নারী।

ভারত সরকার ২০০১ সালকে নারীর ক্ষমতায়ন বা স্বশক্তি বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেন। নারী ক্ষমতায়নের জন্য জাতীয় নীতিটি পাস ২০০১ সালেই হয়।

২০০৬ সালে, ইমরানা নাম্নী এক মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণের মামলটি গণমাধ্যম কর্তৃক প্রচারিত হয়। ইমরানাকে তার শ্বশুর ধর্ষণ করে। কিছু মুসলিম নেতাদের ধর্মীয় করা ইমরানর সঙ্গে তার শ্বশুরের বিবাহের সুপারিশ ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয় এবং অবশেষে ইমরানার শ্বশুরের ১০ বছরের কারাদন্ড হয়। এই রায়কে বহু মহিলা সমিতি এবং সর্বভারতীয় মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বোর্ড(All India Muslim Personal Law Board) স্বাগত জানায়।

থমসন রয়টার্সের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারত মহিলাদের জন্য বিশ্বের চতুর্থ বিপজ্জনক দেশ। রিপোর্টটিতে ভারত জি-২০ দেশগুলির মধ্যে নারীদের জন্য সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর দেশ হিসেবেও উল্লিখিত হয়, তবে এই রিপোর্টটি ভ্রান্তিযুক্ত হওয়ার জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। ৯ মার্চ ২০১০ তারিখে, আন্তর্জাতিক মহিলা দিবসের একদিনের পর, রাজ্যসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিল পাস হয়, যা ভারতের সংসদ ও রাজ্য বিধানসভাগুলিতে মহিলাদের জন্য ৩৩% আসন সংরক্ষিত করে। ২০১৭ সালে থমসন রয়টার্স কর্তৃক প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় অনুযায়ী,দিল্লী মহিলাদের জন্য চতুর্থ বিপজ্জনকতম মহানগর(বিশ্বের ৪০ টি মহানগরের মধ্যে) এবং মহিলাদের উপর যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও হয়রানির ঝুঁকিতে এটি বিপজ্জনকতম মহানগর।

২০১৪ সালে, মুম্বাইয়ের একটি ভারতীয় পরিবার-আদালতের রায় অনুযায়ী, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে কুর্তা ও জিন্স পরিধানে বাধা দিলে এবং শাড়ি পরিধানে বাধ্য করলে তা স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুরতার প্রদর্শন হিসেবে গণ্য হবে এবং তা বিবাহবিচ্ছেদের দাবির বৈধ কারণ হতে পারে। এভাবে ১৯৫৪ সালের বিশেষ বিবাহ আইনের ধারা ২৭(১)ডি অনুসারে নিষ্ঠুরতার ভিত্তিতে ওই মহিলার বিবাহবিচ্ছেদের দাবি মঞ্জুর করা হয়।

২২ আগস্ট ২০১৭ তারিখে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাত্ক্ষণিক তিন তালাক (তালাক-ই-বিদ্বাত) অসাংবিধানিক বলে মন্তব্য করেন।

ভারতীয় নারীর অর্জিত সাফল্যের কালানুক্রমিক তালিকা[সম্পাদনা]

নারীর অবস্থার ধারাবাহিক পরিবর্তন কীভাবে হয়েছে, নারীদের অর্জিত এই সাফল্যগুলি তা তুলে ধরতে পারে:

  • ১৮৪৮:
  • ১৮৭৯:
  • ১৮৮৩:
  • ১৮৮৬:
  • ১৮৯৮:
  • ১৯০৫:
  • ১৯১৬:

রাজনীতি[সম্পাদনা]

বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি নারী রাজনীতিবিদ আছেন, ভারত তাদের মধ্যে অন্যতম। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার স্পিকার, বিরোধী দলনেতা সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে মহিলারা বিভিন্ন সময় দায়িত্ব সামলেছেন। ভারতের অঙ্গরাজ্য মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, কেরালা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, রাজস্থান ও ত্রিপুরায় নারীদের জন্য পি.আর.আই গুলিতে ৫০% সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই পঞ্চায়েতগুলির বেশিরভাগ প্রার্থীই নারী। বর্তমানে(২০১৫ সালে) কেরালার কোদাসেরী পঞ্চায়েতের সকল নির্বাচিত সদস্যই মহিলা। বর্তমানে ভারতের একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মহিলা।

২০১৬ সাল পর্যন্ত হিসাবে, ২৯ টি রাজ্যের মধ্যে ১২ টিতে এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দিল্লিতে স্বাধীনতার পর থেকে কমপক্ষে এজন করে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী কার্যভার গ্রহণ করেছেন।

সংস্কৃতি[সম্পাদনা]

ভারতে মহিলাদের অবস্থা ভীষণভাবে পারিবারিক গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ভারতে, পরিবার এবং পারিবারিক সম্পর্কে ভীষণরকম গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারগুলি পিতৃগোত্রজ। পরিবারগুলি সাধারণত বহু-প্রজন্মের, এবং বিবাহিত মহিলারা শ্বশুরালয়ে বাস করেন। অধিকাংশ পরিবারে নবীন সদস্যরা প্রবীনদের এবং মহিলারা পুরুষদের অভিভাবকত্বে থাকেন। অধিকাংশ বিবাহই একগামী (এক স্বামী এবং এক স্ত্রীর), তবে ভারতে কিছু জনকোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষ ও নারী উভয়েরই বহুবিবাহ করার ঐতিহ্য রয়েছে। ভারতে বিবাহানুষ্ঠান বেশ ব্যয়বহুল একটি অনুষ্ঠান। ভারতে অধিকাংশ বিবাহই সম্বন্ধের মাধ্যমে স্থির হয়।

শাড়ি (লম্বা একখন্ড কাপড় যা শরীরের চারপাশে বিভিন্ন কায়দায় জড়িয়ে বা পেঁচিয়ে পড়া হয়) এবং সালোয়ার কামিজ ভারতীয় মহিলাদের প্রধান পোশাক। টিপ এদেশের মহিলাদের প্রসাধনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। কপালের টিপ বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকার নির্দেশক নয়; তবে, সিঁথির সিঁদুর বহন করে বিবাহিতা সধবা হিন্দু মহিলার পরিচয়চিহ্ণ

রঙ্গোলি (বা কোলাম) ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় একটি প্রথাগত শিল্প।

ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী, পরিবারগুলি সাধারণত দিনের শুরুতে ঈশ্বরের পূজা-উপাসনা করেন ("আরতি" -ভারতীয় পূজাপদ্ধতির অঙ্গ)।

"ভারতীয় জীবনধারা স্বাভাবিক, বাস্তব জীবনধারার দৃষ্টিকেভঙ্গিকে নির্দেশ করে। আমরা কৃত্রিমতার মুখোশ দিয়ে নিজেদেরকে ঢেকে রেখেছি। ভারতের মুখভঙ্গির কোমল ভাব সৃষ্টিকর্তার হাতের চিহ্ন বহন করে।"......জর্জ বার্নার্ড শ

সামরিক ক্রিয়াকলাপ[সম্পাদনা]

১৯৯২ সাল থেকে ভারতীয় সেনা বাহিনী চিকিৎসা বা শুশ্রুষা সংক্রান্ত নয় এমন পদেও মহিলাদের নিয়োগ করা শুরু করে। ১৯৯২ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী নারী অধিকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ২০১৩ সালের ২৫ মার্চ নারী অধিকর্তা নিয়োগ শুরু করে। ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ, তনুশ্রি পারেখ বিএসএফ এর প্রথম মহিলা সামরিক আধিকারিক(Combat Officer) নিযুক্ত হন।

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ তারিখে, ভারত সরকার ঘোষণা করেন যে, ভারতীয় বিমান বাহিনী (আইএএফ)-এ মহিলারা যোদ্ধা বিমানচালক(fighter pilot) হিসেবে কাজ করতে পারবেন, যার আগে মহিলাদেরা কেবলমাত্র পণ্যবাহী বিমান ও হেলিকপ্টার চালনার অনুমতি ছিল। সিদ্ধান্তটির ফলে মহিলারা বিমান বাহিনীর যেকোনও পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা লাভ করেন। ২০১৬ সালে, ভারত সরকার তার একটি ঘোষণায় সেনা এবং নৌবাহিনীর সব বিভাগে নারীদের যুদ্ধক্ষেত্র অবতীর্ণ হওয়ার অনুমতি দেয়।

২০১৪ সালের হিসাবে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩%, নৌবাহিনীর ২.৮% এবং বিমান বাহিনীর ৮.৫% সদস্য মহিলা। ২০১৬ সালের হিসাবে, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সকল সক্রিয় এবং সংরক্ষিত বাহিনীর ৫% নারী।

শিক্ষাক্ষেত্রে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন[সম্পাদনা]

১৯৯২-৯৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে মাত্র ৯.২% পরিবার নারীদের দ্বারা চালিত হয়। তবে, দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারগুলির প্রায় ৩৫% নারীদের পরিচালনাধীন।

শিক্ষাক্ষেত্র[সম্পাদনা]

যদিও ভারতে মহিলা সাক্ষরতার হার দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবু তা এখনো পুরুষ সাক্ষরতার হারের তুলনায় কম। ছেলেদের তুলনায় কম সংখ্যক মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয় এবং অনেক মেয়েই স্কুলছুট। দেশের শহরাঞ্চলে মেয়েরা শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলেদের প্রায় সমান। তবে, গ্রামাঞ্চলে এখনো মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় কম শিক্ষিত হয়। ১৯৯৭ সালের জাতীয় নমুনা জরিপের তথ্য অনুযায়ী, কেবলমাত্র কেরালা ও মিজোরাম সার্বজনীন মহিলা সাক্ষরতা অর্জন করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেরালায় নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের উন্নতির প্রধান কারণ হচ্ছে সাক্ষরতা।

অপ্রথাগত শিক্ষাদান কর্মসূচি (Non-Formal Education programme বা NFE)-এর অধীনে, রাজ্যগুলির প্রায় ৪০% এন.এফ.ই কেন্দ্র এবং কেন্দ্রেশাসিত অঞ্চলগুলির প্রায় ১০% এন.এফ.ই কেন্দ্র মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত। ২০০০ সালের হিসাব অনুযায়ী, আনুমানিক প্রায় ৩ লাখ এনএফই কেন্দ্র ৭.৪২ মিলিয়ন শিশুকে উপকৃত করছে। প্রায় ১২০,০০০ এনএফই কেন্দ্র এককভাবে মেয়েদের জন্য।

মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের(U.S. Department of Commerce) ১৯৯৮ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতে নারী শিক্ষার প্রসারের প্রধান বাধাগুলি হল বিদ্যালয়ে সুযোগ-সুবিধার অভাব (যেমন শৌচালয় না থাকা), শিক্ষিকার অভাব এবং পাঠ্যক্রমে লিঙ্গ বৈষম্য (মহিলাদের দুর্বল এবং অসহায় হিসাবে চিহ্নিতকরণ)।

পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের সাক্ষরতার হার কম: সাক্ষরতার হার নারীদের ক্ষেত্রে ৬০.৬%, এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ৮১.৩%। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে সাক্ষরতা ৯.২% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আগের দশ বছরের বৃদ্ধির তুলনায় কম। ভারতে সাক্ষরতার হারে ব্যাপক লিঙ্গবৈষম্য আছে: ২০১১ সালে কার্যকরী সাক্ষরতার হার (৭ বছর বা তারও বেশি বয়সী) পুরুষদের জন্য ৮২.১৪% এবং মহিলাদের জন্য ৬৫.৪৬% ছিল। (১৫ বছর বা তারও বেশি বয়সী জনগণের থেকে পাওয়া ২০১৫ সালের তথ্য)

কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ[সম্পাদনা]

প্রচলিত ধারণাকে নস্যাত্ করে, ভারতের বিপুলসংখ্যক নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। জাতীয় তথ্য সংগ্রহের সংস্থাগুলি স্বীকার করে যে নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে অবদান সম্পর্কে পরিসংখ্যানগুলি ভীষণরকম কমিয়ে বলে। যদিও, উপার্জনশীল কর্মীবাহিনীতে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের সংখ্যা এখনো কম। দেশের শহরাঞ্চলে বহু সংখ্যক নারী কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেন। উদাহরণস্বরূপ, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ৩০% কর্মচারী মহিলা।

গ্রামীণ ভারতে কৃষি এবং কৃষিসংক্রান্ত শিল্প খাতে, শ্রমিকদের ৮৯.৫% নারী। সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন ক্ষেত্রে, মোট শ্রমিকের মোটামুটি শতকরা ৫৫% থেকে ৬৬% নারী। ১৯৯১ সালের বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে দুগ্ধোত্পাদন শিল্পে নিযুক্ত কর্মীদের ৯৪% নারী। অরণ্যভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্পে নিযুক্ত কর্মীদের ৫১% মহিলা।

‘শ্রী মহিলা গৃহ উদ্যোগ লিজ্জত পাঁপড়’ মহিলা ব্যবসায়ীদের সাফল্যের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ২০০৬ সালে বায়োকন-এর প্রতিষ্ঠাতা কিরণ মজুমদার-শাহ ভারতের সবচেয়ে ধনী নারী নির্বাচিত হন। বায়োকন ভারতের প্রাচীনতম জৈবপ্রযুক্তির কোম্পানিগুনির একটি। ভারতীয় ব্যবসায়ী ললিতা ডি গুপ্তে এবং কল্পনা মোরপাড়িয়া ২০০৬ সালে ফোর্বস নির্দেশিত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নারীদের(Forbes World's Most Powerful Women) তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। ললিতাদেবী অক্টোবরে ২০০৬ পর্যন্ত ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক আইসিআইসিআই ব্যাংক পরিচালনা করেন এবং কল্পনাদেবী জেপি মরগান ইন্ডিয়ার মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক(C.E.O.) ছিলেন।

ভূমি ও সম্পত্তির অধিকার[সম্পাদনা]

বেশিরভাগ ভারতীয় পরিবারে, মহিলাদের নামে কোনো সম্পত্তির মালিকানা নেই, এবং তারা পৈতৃক সম্পত্তির অংশ পান না। তাদের সুরক্ষার্থে থাকা আইনগুলির যথাযথ প্রয়োগের অভাবে নারীরা এখনো বহু ক্ষেত্রে জমি ও সম্পত্তির প্রকৃত অধিকার পায়না। ভারতে সম্পত্তির উপর নারীর অধিকার ধর্ম ও গোত্রের উপর নির্ভরশীল এবং বহু আইনি ও প্রথাগত জটিলতার জালে আবদ্ধ, কিন্তু মূলগতভাবে এই পদক্ষেপগুলির লক্ষ্য নারীকে সমান ও বৈধ অধিকার প্রদান করা, বিশেষতঃ হিন্দু উত্তরাধিকার (সংশোধন) আইন(The Hindu Succession (Amendment) Act, 2005), ২০০৫ পাশ হওয়ার পর থেকে।

১৯৫৬ সালের হিন্দু ব্যক্তিগত আইন(Hindu personal laws) (হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈনদের উপর প্রোযোজ্য) নারীকে উত্তরাধিকারেসূত্রে প্রাপ্তির অধিকার প্রদান করে। পুত্রসন্তানরা পূর্বপুরুষের সম্পত্তি একটি অংশের প্রাপক ছিলেন, কিন্তু কন্যাসন্তানরা কেবলমাত্র তাদের পিতার প্রাপ্ত অংশের উপর একটি অংশ পেতেন। অতএব, একজন পিতা তার পূর্বপুরুষের সম্পত্তির দাবি ত্যাগ করলে তার কন্যা উত্তরাধিকারেসূত্রে প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন, কিন্তু তার পুত্র তার নিজের অংশের উপর অধিকার বজায় রাখতে পারতেন। উপরন্তু, বিবাহিতা মহিলা, এমনকি বৈবাহিক জীবনে নিপীড়নের সম্মুখীন মহিলাদেরও তাদের পূর্বপুরুষের বাড়িতে বসবাসের কোনো অধিকার ছিল না। ২০০৫ সালে হিন্দু আইন সংশোধনের ফলে নারী এখন পুরুষদের সমান মর্যাদা ভোগ করেন।

১৯৮৬ সালে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেন, জনৈকা বয়স্ক তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম মহিলা শাহ বানু খোরপোশ পাওয়ার অধ্কারী। যদিও, মৌলবাদী মুসলিম নেতারা সিদ্ধান্তটির বিরোধিতা করে অভিযোগ করেন যে আদালত তাদের নিজস্ব আইনে হস্তক্ষেপ করছেন। এরপর কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিম মহিলা (বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কিত অধিকার সুরক্ষা) আইন(Muslim Women's (Protection of Rights Upon Divorce) Act) পাস করেন।

একইভাবে, খ্রিস্টান নারীরাও বিবাহবিচ্ছেদ এবং উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমান অধিকারে লাভের জন্য বহু বছর ধরে লড়াই করছেন। ১৯৯৪ সালে, নারী সংগঠনগুলির সঙ্গে যৌথভাবে সমস্ত গীর্জা, খৃস্টান বিবাহ এবং বিবাহ নিবন্ধকরণ বিল নামে একটি খসড়া আইন তৈরি করে। তবে, সরকার এখনও এবিষয়ে প্রাসঙ্গিক আইন সংশোধন করেনি। খ্রিস্টান নারীরা যাতে সম্পত্তিলাভের ক্ষেত্রে সমানাধিকার ভোগ করেন ভারতীয় আইন কমিশন ২০১৪ সালে সেজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় আইন পরিবর্তন করতে সুপারিশ করেন।

মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ[সম্পাদনা]

ভারতে ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের দাবিতে হত্যাকাণ্ড, পারিবারিক সম্মানরক্ষার্থে হত্যাকাণ্ড এবং যুবতী মেয়েদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার মতো অপরাধ নারীদের বিরুদ্ধে সংঘঠিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভারতে পুলিশি তথ্যভান্ডারে মহিলাদের বিরুদ্ধে বহু অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে বলে দেখা যায়। জাতীয় অপরাধ নিবন্ধীকরণ বিভাগ(National Crime Records Bureau) ১৯৯৮ সালে জানিয়েছিল যে ২০১০ সালের মধ্যে মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘঠিত অপরাধের বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যাবে। এর আগে, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের পর সামাজিক কলঙ্ক লাগার ভয়ে নারীদের বিরুদ্ধে সংঘঠিত অনেক অপরাধের ঘটনা পুলিশকে জানানোও হতনা। সরকারি পরিসংখ্যানে এখন নারীদের বিরুদ্ধে সংঘঠিত অপরাধে অভিযোগ নথিবদ্ধ হওয়ার সংখ্যা উল্লেযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

অ্যাসিড নিক্ষেপ[সম্পাদনা]

থমাস রয়টার্স ফাউন্ডেশন একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, নারীদের বসবাসের জন্য ভারত বিশ্বের চতুর্থ বিপজ্জনকতম স্থান। যেকোন শ্রেণি, বর্ণ, বা ধর্মের মহিলা এই নিষ্ঠুর হিংসা এবং বিকৃতির শিকার হতে পারেন, মহিলাদের হত্যা বা স্থায়ীভাবে জখম করার উদ্দেশ্যে করা এইসব পূর্বপরিকল্পিত অপরাধ যা নাকি নারীকে তার সঠিক ভূমিকায় নিয়োজিত করার একটি পাঠ হিসাবে কাজ করবে। ভারতে, যেসব মহিলা কোনো পুরুষের দেওয়া বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন বা বিবাহবিচ্ছেদের দাবি জানিয়েছেন অ্যাসিড আক্রমণ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধগ্রহণের একটি উপায়। ভয়ংকর এই অপরাধের কারনে এসিড নিক্ষেপকারী প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় নিজের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড হতে পারে তা জেনেও এসিড নিক্ষেপ করে নারীকে আমৃত্যু যন্ত্রনার দিকে ঠেলে দেয়। এসিড আক্রমণের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় অ্যাসিড প্রস্তুতকরণ, বিক্রয় ও পরিবহনের উপর বহু কঠোর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে।

নাবালিকার বিবাহ[সম্পাদনা]

ভারতে বাল্যবিবাহ বহুদিন থেকে প্রচলিত আছে এবং আজও তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়নি। ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী, বালিকাবধূরা বয়ঃসন্ধিকালে উপনীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পিতামাতার সঙ্গে থাকত। অতীতে, অল্পবয়সী বিধবাদের তীব্র যন্ত্রণাময় জীবনযাপনে বাধ্য করা হত, তাদের মাথা কামানো হত, সমাজের লাঞ্ছনার সহ্য করে তাদের বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে হত। ১৮৬০ সালে বাল্যবিবাহ বেআইনি ঘোষিত হয়েছে, তবে এই প্রথা এখনও সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ণ হয়নি। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রণ আইন(Child Marriage Restraint Act) এবিষয়ে একটি প্রাসঙ্গিক আইন।

ইউনিসেফের "বিশ্বের শিশুদের অবস্থা-২০০৯(State of the World’s Children-2009)" প্রতিবেদন অনুসারে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪৭% ভারতীয় মহিলা ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে করেন, যা গ্রামাঞ্চলে বেড়ে হয় ৫৬%। রিপোর্টে আরো দেখানো হয়েছে যে পৃথিবীর ৪০% বাল্যবিবাহের ঘটনা ভারতে ঘটে থাকে।

গার্হস্থ্য হিংসা[সম্পাদনা]

প্রাক্তন মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী রেণুকা চৌধুরীর মতে ভারতে প্রায় ৭০% মহিলা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। ১৯৮৩ সালের ফৌজদারী আইনে ৪৯৮-এ ধারা "একজন মহিলার স্বামী বা স্বামীর আত্মীয় কর্তৃক তার প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন(Husband or relative of husband of a woman subjecting her to cruelty)” অন্তর্ভুক্তির মধ্যে দিয়েই গৃহাভ্যন্তরীণ হিংসার বিষয়টি প্রথম আইনি পথে মোকাবিলা করা হয়।

জাতীয় অপরাধ নিবন্ধীকরণ বিভাগ(National Crime Records Bureau) কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী প্রতি তিন মিনিট মহিলার বিরুদ্ধে একটি অপরাধের ঘটনা সংঘটিত হয়, প্রতি ২৯ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিতা হন, প্রতি ৭৭ মিনিটে একজন মহিলার পণপ্রথার শিকার হয়ে মৃত্যু হয় এবং প্রতি নয় মিনিটে একজন মহিলা তার স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকের নির্যাতনের শিকার হন। ভারতবর্ষের নারীদের জন্য পারিবারিক হিংসার থেকে সুরক্ষা আইনের(Protection of Women from Domestic Violence Act) আইনি রক্ষাকবজ থাকা সত্ত্বেও এধরনের ঘটনা বন্ধ হয়নি।

ভারতে, নারীদের প্রতি যে কোনো ধরনের পারিবারিক হিংসা যথা, বর্তমান বা প্রাক্তন জীবনসঙ্গীর করা শারীরিক, মানসিক, বা যৌন নির্যাতন বিপজ্জনক আখ্যা পাওয়ার মতো নির্যাতন বলে বিবেচিত হয়। পারিবারিক হিংসা একটি অপরাধ বা অভিযোগ হিসাবে না দেখে একটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয় হিসেবে দেখা হয়। অভিযোগের প্রকার নির্ধারণে, বর্ণ, শ্রেণী, ধর্মীয় প্রবণতার বিষয়গুলি বিবেচনার মধ্যে রাখা হয়, যা কখনো কখনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে কিনা তা নির্ধারণ করে দেয়। বহু গবেষণায় হিংসার প্রাদুর্ভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং অপরাধের ন্যায়বিচার করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ মহিলা অভিযোগ জানানোর ব্যাপারে অনাগ্রহী। এই মহিলারা ন্যায়বিচার, মর্যাদা এবং সমতালাভের সাংবিধানিক অধিকারের অধিকারী কিন্তু সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে সমর্থন করে তারা অভিযোগ জানানোর ব্যাপারে অনাগ্রহী। যেহেতু নারীরা হিংসার কথা বলতে এবং সাহায্য খুঁজতে অস্বীকার করছেন, তারা বহুক্ষেত্রে যথোপযুক্ত প্রতিকারও পাচ্ছেন না।

পণপ্রথা বা যৌতুক[সম্পাদনা]

১৯৬১ সালে, ভারত সরকার পণপ্রথা নিষিদ্ধকরণ আইন পাস করেন যার ফলে বৈবাহিক ব্যবস্থাগুলিতে যৌতুকের দাবি বেআইনি তবে, কিছু জায়গায় যৌতুক সংক্রান্ত পারিবারিক হিংসা, আত্মহত্যা এবং খুনের ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮০ এর দশকে এরকম অনেকগুলি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।

১৯৮৫ সালে পণপ্রথা নিষিদ্ধকরণ (নববধূ এবং বরের পাওয়া উপহারের তালিকা বজায় রাখা) বিধি প্রণয়ন করা হয়। এই নিয়ম অনুযায়ী, বিবাহের সময় নববধূ এবং বরের পাওয়া উপহারের একটি স্বাক্ষরিত তালিকায় লিপিবদ্ধ রাখা উচিত। তালিকাটিতে প্রতিটি উপহারের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ, তার আনুমানিক মূল্য, উপহারদাতার নাম এবং প্রাপকের সাথে তার সম্পর্কের উল্লেখ থাকা উচিত। তবে, এই ধরনের নিয়মগুলি খুব কমই মেনে চলা হয়।

১৯৯৭ সালের এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, প্রতিবছর ভারতে যৌতুক সংক্রান্ত কারণে কমপক্ষে ৫০০০ নারীর মৃত্যু হয় এবং প্রতিদিন কিছু সংখ্যক মহিলার 'রান্নাঘরের আগুনে' মৃত্যু হয় যা খুব সম্ভবত ষড়যন্ত্রমূলক। বধূর অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর এইসব ঘটনা ভারতেই সমালোচিত হয়। শহুরে শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে।

নারী সুরক্ষা সংক্রান্ত আইন[সম্পাদনা]

১)বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধকরণ আইন।২) সতীদাহ প্রথ নিষিদ্ধকরণ আইন।

নারীর অধিকার[সম্পাদনা]

জাতীয় অপরাধ নিবন্ধীকরণ বিভাগ ২০১১ সালে পণের দাবিতে অত্যচারে ৮৬১৮-টি মৃত্যুর ঘটনার কথা জানায়। বেসরকারি দাবি অনুযায়ী আনুমানিক সংখ্যাটা অন্তত তিনগুণ বেশি।

ভারতে পুরুষ-নারী লিঙ্গ অনুপাতে পুরুষের সংখ্য উল্লেখযোগ্যভাবে কম, যার প্রধান কারণ পরিণত বয়সে পৌঁছানোর আগেই বহু কন্যা মারা যায়। অন্যান্য বর্ণের গোষ্ঠীর তুলনায় ভারতে আদিবাসী সমাজের লিঙ্গ অনুপাতে ভারসাম্য বেশি যদিও উপজাতি সম্প্রদায়ের আয়ের মাত্রা বা সাক্ষরতার হার অনেক নিচে, স্বাস্থ্য সুবিধা অপর্যাপ্ত। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে ভারতে বেশি সংখ্যক পুরুষের উপস্থিতি বালিকা শিশুর মৃত্যু ও কন্যাভ্রূণ হত্যার কথা ইঙ্গিত করে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে হরিয়ানা এবং জম্মু ও কাশ্মীরে লিঙ্গ অনুপাত উল্লেখযোগ্যভাবে আশঙ্কাজনক।

শব্দোত্তর-তরঙ্গ অভিবীক্ষণ(Ultrasound Scanning) মা এবং গর্ভস্থ শিশুর সুরক্ষা প্রদানের পথে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবং অভিবীক্ষক যন্ত্রগুলি বহণযোগ্য হয়ে ওঠার সঙ্গেই এর সুবিধা গ্রামীণ এলাকাগুলিতেও পৌঁছেছে। তবে, শব্দোত্তর-তরঙ্গ অভিবীক্ষণে গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ প্রকাশ পায়, যা গর্ভবতী মহিলাদের কন্যা ভ্রূণ হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে যাতে পরবর্তীকালে পুত্র সন্তান লাভের জন্য পুনরায় চেষ্টা করা যায়। এই অভ্যাসই সদ্যোজাত শিশুদের মধ্যে পুরুষ ও নারীর অনুপাতের পরিবর্তনের মূল কারণ বলে মনে করা হয়।

১৯৯৪ সালে ভারত সরকার শব্দোত্তর-তরঙ্গ অভিবীক্ষণের(Ultrasound Scanning) (অথবা অন্য যে কোনও পরীক্ষা যা এই তথ্য প্রদান করবে) পরে মহিলাদের বা তাদের পরিবারের তরফে শিশুর লিঙ্গ সম্পর্কে প্রশ্ন করার উপর নিষধাজ্ঞা আরোপ করে একটি আইন পাস করে এবং চিকিৎসক বা অন্য কোন ব্যক্তিকে স্পষ্টভাবে এই তথ্য প্রদান থেকে বিরত থাকতে বলে। বাস্তবে পণপ্রথা নিষিদ্ধকরণ আইনের মতোই এই আইনেরও যথাযথ প্রয়োগ হয়নি এবং কন্যা ভ্রূণ হত্যা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি এবং সদ্যোজাত শিশুদের লিঙ্গ অনুপাত আরও ভারসাম্য হারাচ্ছে।

কিছু গ্রামীণ এলাকায় এখনও শিশুকন্যাদের হত্যা করা হয়। কখনও কখনও পরিবারের অবহেলাও তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, উদাহরণস্বরূপ যদি কোনো পরিবার অসুস্থ কন্যার উচ্চমূল্য ওষুধের জন্য অর্থ ব্যয় না করে বা অসুস্থ কন্যার যথাযথ শুশ্রূষা না করে।

পণপ্রথার অত্যাচার বন্ধ না হওয়া ভারতে কন্যাভ্রূণ হত্যা এবং শিশুকন্যা মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।

ভারতবর্ষের উত্তর অঞ্চলে, প্রধানত পাঞ্জাব, রাজস্থান, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশে পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া গেছে, যেখানে পারিবারিক স্বীকৃতি ছাড়াই বিবাহ করার জন্য বা কখনও কখনও ভিন্ন বর্ণ বা ধর্মের মানুষকে বিবাহ করার জন্য তাদের এই পরিণতি হয়। হরিয়ানা পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলির জন্য কুখ্যাত, যা কিনা হরিয়ানা গ্রামগুলিতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত বলে জানা গেছে। অপরপক্ষে, পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে হত্যাকাণ্ড দক্ষিণ ভারতের এবং মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মতো পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে বিরল বা অস্তিত্বহীন। ভারতের অন্য কিছু অংশে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ, পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে হত্যাকাণ্ড প্রায় এক শতাব্দী আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, বিশেষত বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, বিদ্যাসাগর এবং রাজা রামমোহন রায়ের মতো মনীষীদের সংস্কারমূলক আন্দোলনের ও কর্মকাণ্ডের প্রভাবে। ২০১০ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পাঞ্জাব, হরিয়ানা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে সম্মান রক্ষার্থে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করে।

ডাইনি অপবাদ দিয়ে কোনো একজন মহিলার উপর অত্যাচার ভারতে বিশেষ করে উত্তর ভারতের কিছু অংশে ঘটে। ভারতীয়দের মধ্যে অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস অত্যন্ত দৃঢ়, এবং ডাইনি অপবাদে কাউকে হত্যার ঘটনাও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৩ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে ডাইনি অপবাদ সংক্রান্ত ঘটনায় প্রায় ৭৫০ টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ছত্তীসগঢ়ে সরকারি সূত্রে ২০০৮ সালে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ডাইনি সন্দেহে বছরে অন্তত ১০০ জন নারীকে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়।

রাধা কুমারের মতে ধর্ষণ ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে সংঘঠিত অপরাধগুলির মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার সুরক্ষা প্রধানের মতে ভারতে ধর্ষণ একটি "জাতীয় সমস্যা"। ১৯৮০ এর দশক থেকে, নারীবাদী সংগঠনগুলি বৈবাহিক ধর্ষণকে বেআইনি ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে, কিন্তু ফৌজদারী আইন (সংশোধনী) আইন, ২০১৩ তার ধারা ৩৭৫ এর অধীনে ব্যতিক্রম ধারায় বৈবাহিক সম্পর্কের ব্যতিক্রমটি বজায় রাখে, যেখানে বলা আছে: "নিজের স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ বা যৌনক্রিয়া ধর্ষণ নয়, যেখানে স্ত্রীর বয়স পনের বছরের নিচে নয়"। যদিও প্রতি মাথাপিছু হিসেবে অভিযোগের সংখ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম, এমনকি অনেক উন্নত দেশের তুলনায়ও কম, কিন্তু তবু প্রতি ২0 মিনিটে একটি অভিযোগ নথিবদ্ধ হয়।

ভারতীয় শহরগুলির মধ্যে যেগুলিতে ধর্ষণের অভিযোগের হার সবচেয়ে বেশি দিল্লি সেগুলির মধ্যে একটি। বিভিন্ন সূত্রে দেখা যায় যে ১৯৯০ থেকে ২০০৮ এর মধ্যে ভারতে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

যৌন হেনস্থা

ইভ টিজিং একটি পুরুষতান্ত্রিকতা পুরুষরা মহিলাদের যৌন হয়রানি বা যৌন হেনস্থা করার জন্য ব্যবহার করে। অনেক সমাজকর্মী নারীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য "পশ্চিমা সংস্কৃতির" প্রভাবকে দোষারোপ করেন। ১৯৮৭ সালে, নারীদের

অশালীনভাবে উপস্থাপন (নিষিদ্ধকরণ) আইন পাস হয় যাতে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বা প্রকাশনায়, রচনায়, চিত্রশিল্পে বা অন্য কোনও ভাবে নারীকে অশালীনভাবে প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়।

১৯৯০ সালে নথিবদ্ধ নারীর বিরুদ্ধে মোট অপরাধের সংখ্যার অর্ধেক কর্মস্থলে নিপীড়ন ও হয়রানি সম্পর্কিত। ১৯৯৭ সালে একটি ঐতিহাসিক রায়ে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে একটি দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। এবিষয়ের প্রতিকার এবং অভিযোগের নিষ্পত্তির বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশিকাও আদালত জারি করেন। জাতীয় মহিলা কমিশন পরবর্তীকালে এই নির্দেশিকাগুলি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে নিয়োগকর্তাদের জন্যে একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করে। ২০১৩ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের এক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচাপতির বিরুদ্ধে একজন আইন-গ্র্যাজুয়েট ছাত্রীর করা যৌন হেনস্থার অভিযোগের তদন্ত করেন। কর্মক্ষেত্রে নারীর হয়রানি রোধ করার জন্য ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানি (প্রতিরোধ, নিষিদ্ধকরণ ও প্রতিকার) আইন(Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition and Redressal) Act) কার্যকর করা হয়।

অ্যাকশনএড ইউকে'র একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ভারতে ৮০% নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে, তা সে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য, অনঅভিপ্রেত শারীরিক স্পর্শ বা নির্যাতন যেভাবেই হোক না কেন। অনেক ঘটনায়ই অভিযোগ নথিবদ্ধ হয় না কারণ নির্যাতিতারা তাদের পরিবারের থেকে সমর্থন ও সহমর্মিতা না পাওয়ার আশঙ্কায় ভোগে।

অনৈতিক পাচার (প্রতিরোধ) আইন ১৯৫৬ সালে পাস হয়। তবে অল্পবয়সী ও বয়স্ক মহিলাদের পাচারের অনেক ঘটনাই প্রকাশিত হয়েছে। এই মহিলাদের হয় পতিতাবৃত্তি, গার্হস্থ্য কাজ বা শিশু শ্রমে বাধ্য করা হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২২ মে ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মে ২০১৮ 
  2. "Gender Inequality Index"। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি। সংগ্রহের তারিখ ২১ মার্চ ২০১৭ 
  3. "The Global Gender Gap Report 2017" (পিডিএফ)বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম। পৃষ্ঠা ১১। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জানুয়ারি ২০১৮