মাধ্যমিক শিক্ষা

মাধ্যমিক শিক্ষা হলো প্রাথমিক শিক্ষার পরবর্তী ও উচ্চশিক্ষার পূর্ববর্তী শিক্ষাস্তর।
দ্বিতীয় স্তর বা নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা (কখনো কখনো জুনিয়র মাধ্যমিক শিক্ষাও বলা হয়) হলো মৌলিক শিক্ষার দ্বিতীয় ও শেষ ধাপ। তৃতীয় স্তর বা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা (বা সিনিয়র মাধ্যমিক শিক্ষা) হলো উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার আগের ধাপ। প্রতিটি দেশই মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে চায়, তবে শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিভাষা দেশে দেশে আলাদা।
মাধ্যমিক শিক্ষা সাধারণত ছয় বছর প্রাথমিক শিক্ষার পর শুরু হয় এবং এর পর আসে উচ্চশিক্ষা, পেশাগত শিক্ষা বা কর্মসংস্থান।[১] অধিকাংশ দেশে মাধ্যমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক, কমপক্ষে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত। শিশু সাধারণত ১২ বছর বয়সে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রবেশ করে। কোনো কোনো দেশে বাধ্যতামূলক শিক্ষা ২০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে।
১৯৮৯ সাল থেকে শিক্ষা শিশুদের মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শিশু অধিকার সনদের ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক হতে হবে এবং বিভিন্ন ধরনের মাধ্যমিক শিক্ষা—সাধারণ ও পেশাগত—সব শিশুদের জন্য সহজলভ্য ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
পরিভাষাগত বিভ্রান্তির কারণে দীর্ঘদিন কোনো সার্বজনীন সংজ্ঞা ছিল না। পরবর্তীকালে ISCED এই শিক্ষাস্তরকে নিম্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ভাগ করে।
সংজ্ঞা
[সম্পাদনা]মাধ্যমিক শিক্ষা হলো প্রাথমিক শিক্ষার পরবর্তী এবং উচ্চশিক্ষার পূর্ববর্তী আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পর্যায়। সাধারণত এটি ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত, যদিও এই বয়সসীমা দেশে দেশে ভিন্ন হতে পারে। এই পর্যায়ের লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের এমনভাবে প্রস্তুত করা যাতে তারা উচ্চশিক্ষা বা কর্মজীবনে প্রবেশের জন্য উপযুক্ত হয়।
ISCED ১৯৯৭ অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাতটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে:[১]
- স্তর ০ – প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা
- স্তর ১ – প্রাথমিক শিক্ষা
- স্তর ২ – নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা
- স্তর ৩ – (উচ্চ) মাধ্যমিক শিক্ষা
- স্তর ৪ – মাধ্যমিকোত্তর, অ-উচ্চশিক্ষা
- স্তর ৫ – উচ্চশিক্ষার প্রথম স্তর
- স্তর ৬ – উচ্চশিক্ষার দ্বিতীয় স্তর
ISCED অনুযায়ী স্তর ১ ও ২ একত্রে গঠিত হয় মৌলিক শিক্ষা। দেশভেদে মাধ্যমিক শিক্ষাকে শুধু স্তর ২, স্তর ২ ও ৩, অথবা স্তর ২ থেকে ৪ পর্যন্ত ধরা হতে পারে। এই শ্রেণিবিন্যাস মূলত আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানগত তুলনার জন্য তৈরি হয়েছে এবং ২০১১ সালের হালনাগাদেও তা অপরিবর্তিত ছিল।[২]
নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু হয় সেই পর্যায়ে, যখন একজন শিক্ষক না থেকে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক দ্বারা পাঠদান শুরু হয়। এই স্তরের লক্ষ্য হলো মৌলিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করা এবং আজীবন শিক্ষার ভিত্তি তৈরি করা।[১]
নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য:
- প্রাথমিক শিক্ষার প্রায় ছয় বছর পরে শুরু
- বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের প্রয়োজন
- মোট নয় বা তার বেশি বছরের শিক্ষার পরে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তরণ, কারিগরি শিক্ষায় প্রবেশ বা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ
বেশিরভাগ দেশে বাধ্যতামূলক শিক্ষা এই পর্যায়ে শেষ হয়।[১]
(উচ্চ) মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু হয় মৌলিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার পরে। এখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের আগ্রহ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিষয় বেছে নিতে পারে। এই স্তরের শিক্ষা সাধারণত ঐচ্ছিক।
উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য:
- প্রায় নয় বছরের মৌলিক শিক্ষার পরে শুরু
- সাধারণত ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সে প্রবেশ
- শিক্ষকেরা বিষয়ভিত্তিক স্নাতক বা তদুর্ধ্ব ডিগ্রিধারী হন
- পরবর্তী স্তরে স্নাতক স্তর বা কারিগরি প্রশিক্ষণ কিংবা সরাসরি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ
এই ধাপে শিক্ষার্থীরা বিষয় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা পায় এবং বিশেষায়িত পাঠ্যক্রম গ্রহণ করে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, কারিগরি শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার প্রস্তুতির পথ সুগম করে।
২০১২ সালে ISCED আরও বিস্তারিতভাবে এই স্তরগুলো ব্যাখ্যা করে এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের দৈর্ঘ্য ২ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে বলে উল্লেখ করে।[২]
বিভিন্ন দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নাম আলাদা হতে পারে, যেমন: একাডেমি, কলেজ, জিমনেসিয়াম, হাই স্কুল, লিসিয়াম, মিডল স্কুল, প্রিপারেটরি স্কুল, সিক্সথ ফর্ম কলেজ, আপার স্কুল কিংবা কারিগরি বিদ্যালয়।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]লিখনপদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়া এবং বাণিজ্যের প্রসারে প্রতিটি সমাজেই কিশোরদের জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পশ্চিম ইউরোপে মাধ্যমিক শিক্ষার সূচনা প্রাচীন গ্রিসের আথেনীয় শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০) মাধ্যমে হয়। যদিও পরবর্তীতে গ্রিক সভ্যতা ম্লান হয়ে যায়, তবু হেলেনীয় শিক্ষকেরা রোমান শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
রোমান ও হেলেনীয় বাগ্মিতা শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে সাতটি মুক্ত শিল্পকলা ও বিজ্ঞান শেখানো হতো—ব্যাকরণ, বাগ্মিতা, যুক্তি, গণিত, জ্যামিতি, সঙ্গীত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান। এগুলো উচ্চশিক্ষায় ধর্মতত্ত্ব, আইন এবং চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে বিবেচিত হতো। ছেলেরা সাধারণত বাড়িতে শিক্ষকের মাধ্যমে এই স্কুলগুলোতে পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিত। মেয়েরা কেবল বাড়িতেই শিক্ষালাভ করত।[৩]
ইংল্যান্ড একটি ভালো উদাহরণ। ৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে অগাস্টিন খ্রিস্টধর্ম নিয়ে ইংল্যান্ডে আসেন, তখন সেখানে কোনো স্কুল ছিল না। তিনি গির্জায় প্রার্থনা পরিচালনার জন্য পুরোহিত এবং কোরাসে গান গাওয়ার জন্য বালক প্রয়োজন ছিল। এজন্য তাকে ব্যাকরণ বিদ্যালয় ও সঙ্গীত বিদ্যালয় গঠন করতে হয়। [৪][৩] ক্যান্টারবুরি (৫৯৭) এবং রোচেস্টার (৬০৪)-এর স্কুলদ্বয় এখনো টিকে আছে।
বিড তার Ecclesiastical History of the English People (৭৩২)-এ উল্লেখ করেন, ক্যান্টারবুরি বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র লাতিন পাঠই নয়, বরং ছন্দরীতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণনা পদ্ধতি এবং সাধুদের জীবনীও শেখানো হতো। কিন্তু এই পর্যায়েই গির্জার মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয় যে, লাতিন ভাষার জ্ঞান শিক্ষার্থীদের অখ্রিস্টীয় গ্রন্থ পাঠের সুযোগ দেবে, যা গির্জা চায়নি।[৩]
পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে, বিশেষ করে পুনর্জাগরণ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের আগে পর্যন্ত গির্জাই মাধ্যমিক শিক্ষার প্রধান সংগঠক ছিল। তবে শহর-নগরের প্রসার ঘটলে ১১০০ খ্রিস্টাব্দের পর গির্জা-নির্ভরতা থেকে মুক্ত ব্যাকরণ বিদ্যালয় গড়ে ওঠে এবং কিছু গির্জা-চালিত বিদ্যালয় সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যেগুলো কেবল পুরোহিত প্রস্তুত করত না, বরং অন্যান্য বিদ্যাচর্চাও করত।[৩]
পুনর্জাগরণ ও ধর্মসংস্কার
[সম্পাদনা]ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে পুনর্জাগরণ আগে এলেও, ইংল্যান্ডে স্থানীয় পরিস্থিতির কারণে ধর্মসংস্কার আগে শুরু হয়। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষকে বাইবেল নিজ ভাষায় পাঠ করার সুযোগ দেওয়া, যা গির্জার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এর ফলে নতুন নতুন 'ফ্রি গ্রামার স্কুল' গড়ে ওঠে, যেগুলোর পাঠ্যক্রম তুলনামূলকভাবে মুক্ত ও বৈচিত্র্যময় ছিল।
উপনিবেশ স্থাপনের ফলে দিকনির্দেশনার জ্ঞান, পরিমাপবিদ্যা, ভাষাজ্ঞান এবং প্রশাসনিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়। সাধারণ মানুষ চেয়েছিল, তাদের সন্তানরা এসব বিষয় শিখুক। গুটেনবার্গ ১৪৫৫ সালে ছাপাখানা চালু করলে এবং টিনডেল ১৫২৫ সালে বাইবেল ইংরেজিতে অনুবাদ করলে, লাতিন ভাষা কেবল গির্জা এবং রক্ষণশীল অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ইউরোপ ও উপনিবেশগুলোতে ব্যবসায়ীদের ছেলেদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে—যেমন বোস্টন ল্যাটিন গ্রামার স্কুল (১৬৩৫)।
Comenius (১৫৯২–১৬৭০), একজন Moravian প্রোটেস্টান্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষার একটি নতুন মডেল প্রস্তাব করেন—যেখানে শিক্ষায় পুনরাবৃত্তির চেয়ে অভিজ্ঞতা থেকে তত্ত্বে উত্তরণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, ভাষা শেখানো হয় মাতৃভাষায়, এবং সর্বজনীন শিক্ষার পক্ষে মত দেওয়া হয়। তাঁর Didactica Magna (মহান শিক্ষাদর্শন)-এ তিনি এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো দেন যা আধুনিক পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার অনুরূপ—শিশু শ্রেণি, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। "Comenius, Johann Amos"। New International Encyclopedia। ১৯০৫। [[Category:উইকিপিডিয়া নিবন্ধ যাতে নিউ ইন্টারন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে একটি উদ্ধৃতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে]]
জন লক তাঁর Some Thoughts Concerning Education (১৬৯৩)-এ মেধা উন্নয়ন, নৈতিক গঠন ও শারীরিক শক্তিমত্তা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এই সময়ের গ্রামার স্কুলগুলো তিন ভাগে বিভক্ত ছিল: নয়টি নামকরা বোর্ডিং স্কুল যা মূলত অভিজাতদের জন্য ক্লাসিক ভাষা শিক্ষা দিত; বিভিন্ন দাতব্য তহবিল-নির্ভর স্থানীয় বিদ্যালয়; এবং শহরাঞ্চলের স্কুলগুলো যেখানে ব্যবসায়ী ও কারিগরদের সন্তানরা পড়ত, এবং যারা পরিবর্তনকে গ্রহণ করত।[৩]
শিল্পায়ন
[সম্পাদনা]১৮শ শতকে গ্রামার স্কুলগুলো ধীরে ধীরে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির জন্য উন্মুক্ত হয় এবং পাঠ্যক্রমে গণিত ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে এই শিক্ষা তখনও সর্বজনীন ছিল না—অর্থবিত্ত থাকলেই কেবল এ সুযোগ পাওয়া যেত।[৩]
শিল্পবিপ্লবের সময় পরিস্থিতি পাল্টে যায়। শিল্পকারখানায় শিক্ষিত শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে, যারা অন্তত মৌলিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছে। ফ্রান্সে, রাজা লুই চতুর্দশ যিশুসমাজের কাছ থেকে শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেন। পরে কঁদোরসে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সর্বজনীন নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর নেপোলিয়ন একটি নিয়ন্ত্রিত Lycee ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।[৫]
ইংল্যান্ডে, রবার্ট পিলের ফ্যাক্টরি আইন ১৮০২ অনুযায়ী, প্রতিটি মালিককে শিক্ষানবিশদের প্রথম চার বছর পড়া, লেখা ও অঙ্ক শেখাতে হতো। এর মাধ্যমে দরিদ্রদের জন্য মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র স্বীকার করে নেয়।
তবে তখনও বিদ্যালয়ের আসনসংখ্যা পর্যাপ্ত ছিল না। তাই ১৮৩৯ সালের ১০ এপ্রিল একটি ‘আদেশপত্র’ জারি করে গঠন করা হয় প্রিভি কাউন্সিলের শিক্ষা কমিটি।[৬]
সর্বজনীন শিক্ষা
[সম্পাদনা]সমস্ত শ্রেণির শিশুদের মৌলিক শিক্ষা দেওয়ার ধারণার বিরুদ্ধে অনেকের আপত্তি ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে শিল্প বিদ্যালয় এবং রবিবার বিদ্যালয় ছিল বেসরকারি বা গির্জার উদ্যোগে পরিচালিত।
তবে ১৮৫১ সালের গ্রেট এক্সিবিশনে ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা পিছিয়ে আছে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।[৬]
তিনটি পৃথক কমিশন গঠিত হয়—উচ্চ, মধ্য এবং শ্রমজীবী শ্রেণির শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্লেষণের জন্য। ক্লারেনডন কমিশন ৯টি নামকরা পাবলিক স্কুলের মান উন্নয়নে কাজ করে। টন্টন কমিশন ৭৮২টি দাতব্য গ্রামার স্কুল পরীক্ষা করে বৈষম্যমূলক মান ও অনুন্নত অবস্থার চিত্র তুলে ধরে। দেখা যায়, দুই-তৃতীয়াংশ শহরেই কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই এবং এই স্তরের শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়েও কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই।
তাদের প্রতিবেদনে তিন স্তরের বিদ্যালয়ের সুপারিশ করা হয়:
- প্রথম শ্রেণি – ১৮ বছর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়মুখী অভিজাতদের জন্য
- দ্বিতীয় শ্রেণি – ১৬ বছর পর্যন্ত সেনাবাহিনী বা নতুন পেশার জন্য প্রস্তুত শিক্ষার্থীদের জন্য
- তৃতীয় শ্রেণি – ১৪ বছর পর্যন্ত ক্ষুদ্র কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা দক্ষ শ্রমিক শ্রেণির সন্তানদের জন্য
এরই ফলস্বরূপ এনডাউড স্কুল আইন ১৮৬৯ পাস হয়, যেখানে ছেলেদের মতো মেয়েদেরও সমান শিক্ষার সুপারিশ করা হয়।[৭]
নিউক্যাসল কমিশন ”সকল শ্রেণির মানুষের জন্য সাশ্রয়ী ও গুণগত প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ প্রয়োজন কি না”—তা খতিয়ে দেখতে গঠিত হয়। এর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে Elementary Education Act 1870 (33 & 34 Vict. c. 75)—ফরস্টার আইন প্রণীত হয়।[৭]
১৮৭০ সালের আইনের পর গঠিত স্কুল বোর্ডগুলো ককার্টন রায় (১৮৯৯) অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষা দেওয়া থেকে বিরত থাকে। তখন বাধ্যতামূলক পড়াশোনার শেষ সীমা ছিল ১০ বছর বয়স। এই রায়ের পর শিক্ষা আইন ১৯০২ প্রণীত হয়। বাধ্যতামূলক শিক্ষা ১২ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয় এবং স্কুল বোর্ড বিলুপ্ত করে স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ (LEA) গঠন করা হয়। তারা পরবর্তীতে উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় বা কাউন্টি স্কুল স্থাপন করে।
এই LEA গুলোই ভবিষ্যতের সেকেন্ডারি মডার্ন স্কুলে পরিণত হয়।[৮]
১৯০৪ সালের মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্দেশনা অনুসারে, পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়:
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস, বিদেশি ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, অঙ্কন, হাতে-কলমে কাজ, শরীরচর্চা এবং মেয়েদের জন্য গৃহস্থালির কাজ।[৮]
শিক্ষা আইন ১৯১৮ (ফিশার আইন) বাধ্যতামূলক পূর্ণকালীন শিক্ষা ১৪ বছর পর্যন্ত বাড়ায় এবং ১৪–১৮ বছর বয়সীদের জন্য আংশিককালীন শিক্ষা সুপারিশ করে।
হ্যাডো প্রতিবেদন (১৯২৬) Education of the Adolescent–এ প্রস্তাব করে, ১১ বছর বয়সে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার বিভাজন হওয়া উচিত।[৮]
মাধ্যমিক শিক্ষার অধিকার
[সম্পাদনা]জাতিসংঘ সকলের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তবে সেই অধিকার কীভাবে সংজ্ঞায়িত হবে, তা নিয়ে ভাষাগত দ্বিধা দেখা দেয়।
"প্রবন্ধ ১: উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি ১. এই সংস্থার উদ্দেশ্য হলো শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা—শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে—যাতে ন্যায়বিচার, আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের প্রতি সার্বজনীন শ্রদ্ধা গড়ে ওঠে, যা জাতিসংঘ সনদে ঘোষণা করা হয়েছে।"
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার (১৯৪৮) ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:
২৬(১) প্রত্যেকের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার রয়েছে। প্রাথমিক ও মৌলিক শিক্ষার ক্ষেত্রে তা হবে বিনামূল্যে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা সহজলভ্য করা হবে এবং উচ্চশিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত থাকবে।
এখানে “প্রাথমিক শিক্ষা” বলতে বোঝানো হয়েছে শিশুদের জন্য মৌলিক শিক্ষা এবং “মৌলিক শিক্ষা” বোঝানো হয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য শিক্ষার অধিকার। তবে আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংজ্ঞা নির্দিষ্ট নয়—এটি ঠিক কখন শুরু হয় এবং কখন শেষ, তা বলা হয়নি। "মাধ্যমিক" শব্দটি এখানে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। ফলে অনেক দেশ বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যে শিক্ষাকে ১১ বছর বয়স পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছে বা কেবল ছেলেদের জন্য চালু রেখেছে।[৯]
শিশু অধিকার সনদের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদ (১৯৮৯) বলছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শিক্ষার বিভিন্ন ধরন—সাধারণ ও কারিগরি—সবার জন্য সহজলভ্য ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।[১০]
১৯৯০ সালে জমটিয়েন সম্মেলনে 'মৌলিক শিক্ষা'র সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা হয়। এখানে 'মৌলিক শিক্ষা' বলা হয়েছে এমন শিক্ষা যা ‘মূল শেখার প্রয়োজন’ মেটায়। ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়’ বিবেচিত হয় প্রধান শিক্ষা বাহন হিসেবে।[১১]
Principles for Action অনুযায়ী:
সবাইকে মৌলিক শেখার সুযোগ দেওয়ার অর্থ হলো: শিশুদের জন্য প্রাসঙ্গিক ও গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা; এবং কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাক্ষরতা, মৌলিক জ্ঞান ও জীবনদক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ।[১১]
ধারণা করা হয়েছিল, এই জীবনদক্ষতা শিক্ষার দায়িত্ব মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর বর্তায়। এই বিষয়গুলো পরবর্তীতে ISCED দলিলগুলোতে সুসংহত করা হয়।[১২]
ডাকার কাঠামো (২০১০)-এর লক্ষ্য ২ অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মধ্যে সব শিশু, বিশেষ করে মেয়েশিশু, সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য গুণগত এবং বাধ্যতামূলক মৌলিক শিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
লক্ষ্য ৫ বলছে: ২০০৫ সালের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা এবং ২০১৫ সালের মধ্যে লিঙ্গ-সমতা অর্জন করতে হবে, বিশেষ করে মেয়েদের সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ ও সফলতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে।[১৩]
১৯৯৬ সালে ইউরোপীয় পরিষদ গৃহীত Revised European Social Charter মাধ্যমিক শিক্ষার অধিকার স্বীকার করে।[১৪]
২০১৭ সালে মালালা ইউসুফজাই, নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত, বলেন:
"আমার লক্ষ্য হলো নিশ্চিত করা যে প্রতিটি শিশু—ছেলে ও মেয়ে—বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। এটা তাদের মৌলিক মানবাধিকার। আমি কাজ করে যাব, যতদিন না শেষ শিশুটিও বিদ্যালয়ে যায়।"[১৫]
২০১৭ সালে Human Rights Watch একটি নীতি গ্রহণ করে, যেখানে দেশসমূহকে আহ্বান জানানো হয় যে তারা যেন অবিলম্বে মাধ্যমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যে করে, অন্তত নিম্ন মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত। এটি শিক্ষা-অধিকার বাস্তবায়নের ন্যূনতম উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বলা হয়।[১৬]
মাধ্যমিক শিক্ষার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
[সম্পাদনা]UNESCO মনে করে, দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে জীবন ও কর্মজীবনের জন্য তরুণদের প্রস্তুত করতে হলে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে সেখানে জীবনদক্ষতা শেখানো হয়।
এই দক্ষতার মধ্যে থাকতে হবে:
- সাধারণ ও পেশাভিত্তিক কাজের দক্ষতা
- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি জ্ঞান
- স্বশিক্ষার সক্ষমতা
- দলবদ্ধভাবে কাজ করার অভ্যাস
- উদ্যোগ গ্রহণের মানসিকতা এবং
- নাগরিক দায়িত্ববোধ[১৭]
এই দক্ষতাগুলো অর্জনের জন্য প্রথমে একটি সাধারণ ভিত্তিভিত্তিক পাঠ্যক্রম রাখা উচিত এবং শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও পেশাগত ধারায় বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত যত দেরিতে সম্ভব নেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীরা যাতে এক ধারার থেকে অন্য ধারায় যেতে পারে, সে সুযোগ রাখা উচিত। এমনকি একটি ধারায় অর্জিত সনদ যেন অন্য ধারায়ও স্বীকৃত হয় এবং উচ্চশিক্ষায়ও গ্রহণযোগ্য হয়।
এর ফলে শিক্ষার্থীরা বহু দক্ষতা অর্জন করতে পারবে, কর্মজীবনে একাধিকবার কাজ পরিবর্তন করতে পারবে এবং প্রয়োজনে নিজেদের পুনরায় প্রশিক্ষণ নিতে পারবে।
UNESCO স্বীকার করে, একক কোনো শিক্ষামডেল সব দেশের জন্য উপযোগী হবে না। মাধ্যমিক শিক্ষার নীতিমালা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিয়মিত হালনাগাদ হওয়া উচিত।[১৭]
আইনের শাসনের প্রচার
[সম্পাদনা]কিশোরকাল এমন একটি সময়, যখন একজন মানুষের আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে, সমাজে স্থান পাওয়ার অনুভূতি তৈরি হয়, এবং বন্ধুবান্ধবের প্রভাব বেড়ে যায়। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো তরুণদের সমাজে মেলামেশা ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং তাদের ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সম্পর্কে চিন্তাভাবনার ভিত্তি গড়ে তোলে।[১৮]
শিক্ষাব্যবস্থা যদি আইনের শাসন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা শেখায়, তাহলে তরুণদের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা বাড়ে। এই শিক্ষার মাধ্যমে তারা ন্যায় ও শান্তির পক্ষেও সোচ্চার নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। এই কাজের অগ্রভাগে থাকেন শিক্ষকরা—তারা পরিবারগুলোর সঙ্গে মিলে তরুণদের মানসিকতা ও আচরণ গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।[১৮]
ক্যারিয়ার ও জীবন পরিকল্পনা শিক্ষা
[সম্পাদনা]হংকংয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ক্যারিয়ার ও জীবন পরিকল্পনা শিক্ষা (Career and Life Planning Education - CLPE) এবং ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
হংকংয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়। সে কারণে সিনিয়র মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যারিয়ার শিক্ষা প্রদান করা হয়।
তবে এখানকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখনও জব শ্যাডোয়িং কার্যক্রম (অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের প্রকৃত কর্মক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ করতে দেওয়া) চালু হয়নি।[১৯]
দেশভেদে মাধ্যমিক শিক্ষা
[সম্পাদনা]প্রতিটি দেশ তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
মাধ্যমিক শিক্ষার কার্যকারিতা তুলনার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে PISA (Programme for International Student Assessment) নামক এক সমীক্ষা পরিচালিত হয়।
এই সমীক্ষা প্রতি তিন বছর অন্তর ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের গণিত, বিজ্ঞান ও পাঠ্যবোঝার দক্ষতা মূল্যায়ন করে। প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রায় ৫,০০০ শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়।[২০]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ ঘ ISCED 1997।
- ↑ ক খ ISCED 2012।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ Gillard 2017।
- ↑ Leach 1915, 3।
- ↑ Markham, David J। "The Revolution, Napoleon, and Education"। www.napoleon-series.org। সংগ্রহের তারিখ ১৬ মার্চ ২০১৭।
- ↑ ক খ Gillard 2017, Section 2।
- ↑ ক খ Gillard 2017, Section 3।
- ↑ ক খ গ Gillard 2017, Section 4।
- ↑ Basic Education 2007।
- ↑ Basic Education 2007, পৃ. 25।
- ↑ ক খ Basic Education 2007, পৃ. 6।
- ↑ Basic Education 2007, পৃ. 8।
- ↑ Basic Education 2007, পৃ. 14।
- ↑ "European Social Charter"। Council of Europe। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুন ২০২৩।
- ↑ "Malala Yousafzai receives offer to study at UK university"। The Guardian। Press Association। ১১ মার্চ ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ১১ মার্চ ২০১৭।
- ↑ Sheppard, Bede (৩০ মে ২০২২)। "It's Time to Expand the Right to Education"। Nordic Journal of Human Rights। 40: 96–117। ডিওআই:10.1080/18918131.2022.2071401।
- ↑ ক খ ED-2005/WS/37 2005।
- ↑ ক খ Empowering students for just societies: a handbook for secondary school teachers। UNESCO। ২০১৯। আইএসবিএন 978-92-3-100340-0।
- ↑ Lee, John Chi-Kin (২০১৭)। "Curriculum reform and supporting structures at schools: challenges for life skills planning for secondary school students in China (with particular reference to Hong Kong)"। Educational Research for Policy and Practice। 16: 61–75। এসটুসিআইডি 151763255। ডিওআই:10.1007/s10671-016-9202-y।
- ↑ Berger, Kathleen (৩ মার্চ ২০১৪)। Invitation to The Life Span (second সংস্করণ)। worth। আইএসবিএন 978-1-4641-7205-2।