২০১২ সালের একটি মানচিত্র, যেখানে ন্যুনতম পানি নিরাপত্তার দেশগুলোকে লাল দাগে চিহ্নিত করে দেখানো হয়েছে।
পানি নিরাপত্তা বা জল নিরাপত্তা বলতে পানি বা জল ব্যবহারের ঝুঁকি সীমার মধ্যে থাকা অবস্থায় খাদ্য, জীবিকা এবং প্রজননের জন্য গ্রহণযোগ্য গুণমান এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির নির্ভরযোগ্য প্রাপ্যতা বা লভ্যতা বুঝায়। [১]
"পানি নিরাপদ বিশ্ব ছাড়া স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব নয়। মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং মানব সভ্যতার উন্নয়নের জন্য পানির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাটাই হলো পানি নিরাপদ বিশ্বের মূলমন্ত্র। পানি নিরাপদ বিশ্বের আরও একটি উদ্দেশ্য হলো, পানির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এর বিধ্বংসী ক্ষমতার অপসারণ। এছাড়া পানি নিরাপত্তা বলতে পরিবেশ সংরক্ষণ করা এবং দুর্বল পরিবেশ ব্যবস্থাপনার নেতিবাচক প্রভাবগুলো চিহ্নিত করাকেও বুঝানো হয়। আর্থিক ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনায়ন, কৃষি, শক্তি (উৎপাদন), পর্যটন, শিল্প, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়ার ধারণাও পানি নিরাপত্তার মধ্যে পড়ে। পানি নিরাপদ বিশ্বে দারিদ্র্য বিমোচিত হয়, শিক্ষা অগ্রগামী হয় এবং জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন ঘটে। সবার জন্য উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা রয়েছে পানি নিরাপদ বিশ্বে; বিশেষ করে নারী এবং শিশুর, পানির উপযুক্ত পরিচর্যার কারণে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় তারা।"[২]
প্যাসিফিক ইনস্টিটিউট বলছে, “আঞ্চলিক পরিবর্তনগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি-উৎপাদন, মিঠাজলের উপস্থিতি এবং গুণগত মান, অতি-প্রয়োজনীয় খনিজগুলো ব্যবহার্যতা ইত্যাদি ব্যহত হবে, উপকূলীয় অঞ্চল এবং দ্বীপাঞ্চলে বন্যা বেড়ে যাবে, আরও দেখা দেবে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব। এই সব নেতিবাচকের প্রভাবের কারণে বিভিন্ন দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, প্রাকৃতিক শক্তি-বাজার এবং আঞ্চলিক অর্থনীতির পুণনির্মান ইত্যাদি কাজগুলো কঠিন হয়ে যাবে এবং বেড়ে যাবে নিরাপত্তা ঝুঁকি।”[৩]
এসব ঘটনার প্রভাব বিভিন্ন অঞ্চল, রাষ্ট্র এবং দেশের উপর পড়বে। পানি ব্যবহার করার ব্যক্তিগত এক্তিয়ার অনুযায়ী যারা এর অনুকূলে এবং প্রতিকূলে রয়েছে, তাদের মধ্যে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা সবসময়ই কাজ করে। [৪]
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার করা নিয়ে অনেক যুদ্ধ হয়েছে অতীতে; যেমন টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদী।[৫] আরেকটি চমৎকার রাজনৈতিক উদাহরণ হলো লেভ্যান্ট অঞ্চলের সূচনালগ্ন থেকে এর পানির উপর ইসরায়েলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ।[৬] ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েলের যে ছয় দিনের যুদ্ধ হয়েছিল, তার অন্যতম নিয়ামক ছিল- নিজেদের পানি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা।
পানি নিরাপত্তা বলতে কখনো কখনো পানির লবনাক্ততা দূরীকরণ, পানির উৎস এবং ব্যবহারকারীদের মধ্যে পাইপলাইন স্থাপন, যুদ্ধ সহ বিভিন্ন নিরাপত্তাজনিত ক্ষেত্রে পানি ব্যবহারের অনুমতি প্রদান ইত্যাদি বিষয়গুলোও বোঝানো হয়।
পানির কিংবা পানি-অনুমোদনের বাজার মূল্যের উপর ভিত্তি করে কোন এলাকায় কতটুকু পানি বণ্টন করা হবে, তা নির্ণয় করা হয়; যেহেতু সব এলাকাতেই পানির প্রচন্ড চাহিদা রয়েছে।[৭]
প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে পানির কমতি নেই। কিন্তু জাতিসংঘের বক্তব্য অনুযায়ী, মানব সম্প্রদায় এবং বাস্তুসংস্থানের জন্য ব্যবহার্য মিঠাপানির পরিমাণ মাত্র ২০০,০০০ ঘন কিলোমিটার; যা মোট মিঠাপানির পরিমাণের এক শতাংশেরও কম। যে সব পানি দূষিত নয় বা পানি দূষিতকারী রাসায়নিকে (যেমন নর্দমার ময়লা, বারবার ব্যবহারের কারণে পানিতে মিশে যাওয়া ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি) পূর্ণ নয় সেটাকেই বলা হয় ব্যবহারযোগ্য মিঠাপানি।[৮] শুধু গত শতাব্দীতেই পানি ব্যবহারের পরিমাণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। বিশেষত ২০২৫ সালের মধ্যে পানি-অপসারণের ঘটনা উন্নত বিশ্বে ৫০ শতাংশ এবং উন্নয়নশীল বিশ্বে ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হয়।[৯] উদাহরণ হিসেবে, আফ্রিকা মহাদেশে মিঠাপানির অনুলব্ধতা অচিরেই ৭৫ থেকে ২৫০ মিলিয়নে গিয়ে দাঁড়াবে।[১০] ২০২৫ সালের মধ্যে আক্ষরিক অর্থেই পানির অভাবে পড়বে পৃথিবীর ১.৮ বিলিয়ন মানুষ, আর পানি নিয়ে টানাটানি শুরু হবে দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার মধ্যে।[১১]
২০১০ সালে নেচার জার্নালে বলা হয়েছে, পৃথিবীর ৮০ শতাংশ (যা ২০১১ সালে ছিল ৫.৬ বিলিয়ন) মানুষই এমন সব এলাকায় বসবাস করছে যেখানে পানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে। বিশ্বব্যাপী পানি নিরাপত্তা মানুষ ও প্রকৃতি উভয়ের জন্যেই একটি সামগ্রিক ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া মানুষের পানি-ব্যবস্থাপনা কৌশল বন্যপ্রাণীদের জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে; যেমন প্রায়ই মাছের অভিগমন ঘটছে এসব কারণে। যে সব এলাকায় জনসংখ্যা বেশি এবং কৃষিকাজের পরিমানও বেশি (যেমন ইউরোপ, আমেরিকা), সে সব এলাকায় পানি নিরাপত্তার হুমকিও অনেক উচ্চ। পানিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব-অন্তর্ঘাতের ঘটনা বেড়ে চলেছে দিনদিন।[১২] পানি নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে সব সময় কিছু বিষয় জড়িত থাকে; তা হলো- দরিদ্রতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অনুল্লেখযোগ্য নারী-উন্নয়ন এবং পরিবেশের অবক্ষয়।[১৩] গবেষকেরা হিসেব করে দেখেছেন যে, ২০১০-২০১৫ সালের মধ্যে পানির অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য ৮০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। পানি সম্পদের যথাযথ দেখভাল করা হলে জীববৈচিত্র সংরক্ষণ এবং পানি নিরাপত্তা- দু’টো বিষয়ই পরিচালনা করা বেশ সহজ হয়ে যাবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী জলাধার তৈরি না করে করে বরং প্লাবনভূমি সংরক্ষণ করলেই কম খরচে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং একই সঙ্গে সম্ভব জীববৈচিত্র সংরক্ষণ করা এবং এ সব প্লাবন ভূমির বন্যপ্রাণীদের রক্ষণাবেক্ষণ করা।[১৪]
পপুলেশন ইনস্টিটিউটের সভাপতি লরেন্স স্মিথ বলেছেন, যদিও পৃথিবীর বেশিরভাগ অংশ জুড়েই পানি রয়েছে, কিন্তু মোট পানিরাশির ৯৭ শতাংশই লবণাক্ত। মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যে মিঠাপানির দরকার, তার পরিমাণ পৃথিবীর মোট পানিরাশির মাত্র ৩ শতাংশ। তাই স্মিথ বিশ্বাস করেন যে, জনসংখ্যাবহুল পৃথিবীতে পানি নিয়ে যে প্রতিযোগিতা চলছে, তা মানুষের অস্তিত্বের প্রতি অন্যতম প্রধান হুমকি।[১৫] এমনকি সরু হয়ে আসা বরফ চাদর এবং প্রায় শুকিয়ে যাওয়া জলাধারগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ দাবী করতে গিয়ে একটি রহস্যময় তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। তবুও ১৯৯০ সাল থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ প্রতিনিয়ত নিরাপদ পানির নাগাল পাচ্ছে, অথচ অনেক আগেই এদের পানির অভাবে ভোগার কথা ছিল।[১৬] ১৯৭০ সালে উন্নত বিশ্বে মাত্র ৩০% মানুষ নিরাপদ পানির নাগাল পেত,[১৭] ১৯৯০ সালে এই অনুপাত এসে দাড়িয়েছে ৭১ শতাংশে, ২০০০ সালে বেড়ে হয়েছে ৭৯% এবং ২০০৪ সালে ৮৪ শতাংশে দাড়িয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে এই অনুপাত বেড়ে চলবে ক্রমাগত।
পৃথিবীতে অত্যন্ত সীমিত পরিমাণ নবায়নযোগ্য মিঠাপানি রয়েছে; যা জমে আছে বিভিন্ন জলস্তরে, পৃষ্ঠ পানি হিসেবে এবং বায়ুমন্ডলে। ব্যবহার্য পানির জন্য মহাসাগর যদিও একটি ভাল উৎস, তবে প্রচলিত পদ্ধতিতে এত বিপুল পরিমাণ লবণাক্ত পানিকে পানযোগ্য পানিতে পরিণত করা প্রায় অসম্ভব। এ কারণেই আমরা লবণাক্ত পানি থেকে অত্যন্ত অল্প পরিমাণ ব্যবহার্য পানি পেয়ে থাকি।[১৮] তবে নানা ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন নোনাপানির গ্রীনহাউজ (সৌরশক্তি ব্যবহার করে সামুদ্রিক পানিকে লবণমুক্ত করে পানযোগ্য এবং কৃষিকাজে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা) অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ পন্থা।
চীন মেকং নদীতে একটি বাঁধ নির্মাণ করছে। এই বাঁধ তৈরি হলে ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া এবং থাইল্যান্ড আগের মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পাবে না। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদীর স্রোতের গতিপথ বদলে দেবার জন্য বড়সড় একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে; এই নদীটি বর্তমানে চীন-তিব্বত হয়ে এসে ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি নিয়ে নানা ধরনের সংগ্রাম-লড়াই দেখা যাচ্ছে বলে কিছু নিপীড়িত এলাকার মানুষজন নিজেদের পানির কুয়োগুলো রক্ষা করার জন্য রীতিমতো ভাড়া করা প্রহরী নিয়োজিত করেছে। এছাড়া আমু দরিয়া নদীর পানি প্রায় শুকিয়ে গেছে; যেটি যৌথভাবে উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল এতদিন। এখন এই নদীর পানি ভীতিকর রকম বাষ্পীভূত হয়ে আরাল হৃদে মিলিত হবার আগেই থেমে পড়েছে। নদীটি উজবেকিস্তানে প্রবাহিত হবার আগে এর বেশিরভাগ পানি তুর্কিমেনিস্তান সংগ্রহ করত।[২২]
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড, নিউ সাউথ ওয়েল্স এবং দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ডার্লিং নদীর পানি-সম্পদ নিয়ে এক ধরনের অন্তর্জাতীয় প্রতিদন্দ্বিতা রয়েছে। সেখানকার ভিক্টোরিয়া এলাকায় গুলবার্ন থেকে মেলবোর্ন পর্যন্ত একটি একটি পাইপলাইন নির্মাণের প্রস্তাব তোলা হয়েছিল, যেটা তীব্রভাবে কৃষকদের প্রতিবাদের মুখে পড়েছে।[২৩]
নিউ সাউথ ওয়েলসের ম্যাকোয়ার জলাশয়ের পানি দিয়ে কৃষিকাজ এবং গোচারণ নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার স্নোয়ি মাউন্টেন স্কিম একটি জলবিদ্যুৎ ব্যবস্থা, যেটি স্নোয়ি নদীর স্রোতকে কৃষিকাজ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুবিধার্তে মুরে নদী এবং মার্ম্ব্রিজ নদীর দিকে প্রবাহিত করে থাকে। সাম্প্রতিককালে সরকার মুরে-ডার্লিং অববাহিকাকে খরা থেকে রক্ষা করার জন্য বেশ কিছু পরিবেশ বান্ধব পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা পানি বরাদ্দ সংক্রান্ত মালিকানাগুলো বিক্রি হবার পর পুনরায় কিনে নিচ্ছে, উদ্দেশ্য হলো পরিবেশ প্রবাহের প্রবর্ধন করা।
ব্রক্ষ্মপুত্র নদী ছাড়া ভারতের প্রায় সবগুলো নদী দিয়ে সেখানকার বিভিন্ন নদী-তীরস্থ অঙ্গরাজ্যে চলমান দ্বন্দ্ব রয়েছে। এ দ্বন্দ্ব পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও দেখা যায়, যেমন- নেপাল, চীন, পাকিস্তান, ভুটান, বাংলাদেশ ইত্যাদি।[২৪] ভারতীয় উপমহাদেশে দাধারণত ক্রান্তীয় আবহাওয়া দেখা যায়; যেটা কৃষির জন্য খুবই সুবিধাজনক আবহাওয়া। কারণ উষ্ণ ও রোদেলা আবহাওয়ায় বহুবর্ষজীবী গাছগুলো ফলন ভালো দেয় এবং কৃষিজমিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সরবরাহকৃত পানি বাষ্পীভূত হয়ে যায় সহজেই। যদিও উপমহাদেশের মোট পানিসম্পদ সেখানকার চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট, তবুও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে সময় এবং স্থানসাপেক্ষে পানি বণ্টন ব্যবস্থায় যে অসাম্য রয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে অচিরেই।
ভারতের কাভেরি, কৃষ্ণ, গোদাভরি, ভামসাধারা, মন্দবী, রবি, নর্মদা, তাপ্তি, মাহান্দি ইত্যাদি নদীগুলোকে নিয়ে অন্ত-রাজ্য দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। তবে নদীস্থ অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে ব্রক্ষ্মপুত্র, হিমালয় এবং পশ্চিম-ঘাটের দিকে বয়ে চলা গঙ্গা উপনদীগুলোর উচ্ছিষ্ট পানি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক দেখা যায় না সেভাবে। যখন বৃষ্টির অকাল দেখা দেয় গরমকালে, তখন মোটামুটি সবগুলো নদীতেই মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর জন্য প্রয়োজনীয় পানির প্রচন্ড সংকট তৈরি হয়।
শক্তি নিরাপত্তা অর্জনের মাধ্যমে পানি নিরাপত্তাও অর্জন করা সম্ভব; যেহেতু শক্তি নিরাপত্তার কারণে বিদ্যুৎ খরচ করে উচ্ছিষ্ট পানিরাশি পানি সংকটে ভোগা এলাকায় খাল, লিফট, পাইপলাইন ইত্যাদি দ্বারা[২৫] প্রবাহিত করা হয়। সবগুলো নদীর লবণ/পরিবেশগত উপযোগিতা বাড়াতে মধ্যম মাত্রায় উপযোগী উপাদান নদীতে ছড়ানোর পর মোট পানিসম্পদ থেকে প্রায় ১২০০ ঘনমিটার সমুদ্রেই নষ্ট হবে।[২৬] উপমহাদেশের সবগুলো দেশের সক্রিয় সহযোগিতায় অন্তর্সংযুক্ত নদীগুলোর পানি সম্পদ ব্যবহার করে এখানে পানি নিরাপত্তা অর্জন করা সম্ভব।
মার্কিন নৌবাহিনীর নির্মাণ প্রকৌশলী দল আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশে একটি আর্তেজীয় কুয়ো খনন করছে।
বিভিন্ন দেশের অন্তর্সংযুক্ত নদীগুলোকে পারস্পরিক সহযোগিতার হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলার একটি পদ্ধতি হলো নীল শান্তি। পানি নিয়ে অন্তর্দন্দ্বকে পারস্পরিক সহযোগিতার একটি সুযোগে পরিণত করার এই চমৎকার ধারণাটি সুইস সরকারের অংশদারিত্বে স্ট্রাটেজিক ফোরসাইট গ্রুপ কর্তৃক বিকশিত হয়েছে।
“নীল শান্তি হলো রাজনৈতিক নেতা, কূটনীতিবীদ সহ আপামর জনতাকে স্থায়ী পানি ব্যবস্থাপনা উন্নীতকরণের কাজে নিয়োজিত করার একটি উদ্ভাবনী ধারণা।”
— সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিদিয়ার বুলখালতার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বলেছিলেন
জীবাশ্ম বা পারমাণবিক শক্তি নির্ভর গতানুগতিক পদ্ধতিতে নির্লবণীকরণ[সম্পাদনা]
নিত্য-নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে নির্লবণীকরণের খরচও কমে আসছে দিন দিন। অনেক দেশই নিজেদের পানি সংকট চিহ্নিত করে নির্লবণীকরণ প্রকল্প তৈরি করছে।[২৭]
ইজরায়েল পানি নির্লবণীকরণ করতে প্রতি ঘনমিটার পানিতে খরচ করছে ৫৩ সেন্ট করে।[২৮]
সিঙ্গাপুরে প্রতি ঘনমিটার পানি নির্লবণীকরণে খরচ ৪৯ সেন্ট,[২৯] একই সঙ্গে সেখানে নর্দমার পানিকে বিপরীত অভিস্রাবণের মাধ্যমে পানযোগ্য এবং শিল্প কারখানাগুলোতে ব্যবহার উপযোগী হিসেবে পরিশুদ্ধ করা হয়ে থাকে (নিওয়াটার)।
পৃথিবীর সবচেয়ে জনসংখ্যাবহুল দেশ চীন এবং ভারত তাদের চাহিদার ছোট একটি অংশ পূরণ করতে পানি নির্লবণীকরণ করে থাকে। [৩০][৩১]
২০০৭ সালে পাকিস্তান পানি নির্লবণীকরণ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। [৩২]
২০০৫ সালের গ্রীষ্মে সামিউরা বাঁধের পেছনে অবস্থিত এই জলাধারে রেকর্ড পরিমাণে কম বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এই জলাধারের পানি জাপানের তাকামাস্তুর শিকোকু দ্বীপে প্রবাহিত হয়।অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সবগুলো প্রধান শহরে (ডারউইন এবং হোবার্ট ছাড়া) হয় নির্লবণীকরণ প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে অথবা ব্যবহার করা হচ্ছে ইতিমধ্যেই। ২০১১ সালের শেষের দিকে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় পানি নির্লবণীকরণ প্রকল্প চালু হয়েছে, এটাকে উনথাগি নির্লবণীকরণ প্রকল্প বলা হয়। এটি তৈরির উদ্দেশ্য ছিল নিম্ন স্তরের জলাধারগুলোকে উত্তোলন করা।
২০০৭ সালে বারমুডা একটি পানি নির্লবণীকরণ চুক্তিপত্রে সই করেছিল।[৩৩]
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পানি নির্লবণীকরণ প্রকল্পটি ফ্লোরিডার টেম্পা সাগরে অবস্থিত;[৩৪] যেখানে প্রতিদিন ২৫ মিলিয়ন গ্যালন (৯৫,০০০ ঘণমিটার) পানি নির্লবণীকরণ করা হয় (২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাওয়া তথ্য)। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১,০০০ গ্যালন পানি নির্লবণীকরণে খরচ হয় ৩.০৬ ডলার অথবা প্রতি ঘণমিটারে ৮১ সেন্ট।[৩৫] যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, এরিজোনা, টেক্সাস এবং ফ্লোরিডায় সরবরাহকৃত পানির একটি ছোট অংশ নির্লবণীকরণ করা হয়। [৩৬][৩৭][৩৮]
সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ থেকে জুবাইল পর্যন্ত ২০০ মাইল (৩২০ কিমি) দীর্ঘ অন্তর্দেশীয় পাইপলাইন দ্বারা নির্লবণীকরণকৃত পানি সরবরাহ করা হয়ে থাকে।[৩৯]
২০০৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলেছে, “আন্তর্জাতিক নির্লবণীকরণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রতিদিন ১৩,০৮০ পানি নির্লবণীকরণ প্রকল্প হতে ১২ বিলিয়ন পানি পরিশুদ্ধ করা হয়।”[৪০]
সংযুক্ত আরব আমিরাতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পানি নির্লবণীকরণ প্রকল্প জেবেল আলি অবস্থিত। এটি একটি দ্বৈত উদ্দেশ্য সম্পন্ন প্রযুক্তি যেখানে বিভিন্ন ধাপে পানির পাতন করে বছরে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি উৎপাদন করা সম্ভব। [৪১]
যুক্তরাষ্ট্রের গতানুগতিক বিমান বহনকারী যে কোন জাহাজ নিজের পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে প্রতিদিন ৪০০,০০০ গ্যালন (১,৫০০,০০০ লিটার) পানি নির্লবণীকরণ করতে পারে।[৪২]
যেখানে ১,০০০ গ্যালন (৩,৮০০ লিটার) পানি উৎপাদনে খরচ ৩ ডলার, সেখানে সম পরিমাণ বোতলজাত পানির খরচ ৭,৯৪৫ ডলার।[৪৩]
পানি নির্লবণীকরণ সম্ভব হলেও, আনুষঙ্গিক অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত খরচের কারণে নির্লবণীকরণ প্রক্রিয়াকে পানি সংরক্ষণের সর্বশেষ অবলম্বন মনে করা হয়। তবে বর্তমানে খরচ কমে আসার সাথে সাথে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে।
এমএসএনবিসি বলছে, লাক্স গবেষণা অনুযায়ী ২০০৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী নির্লবণীকরণকৃত পানি সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হবে।[৪৪]
যাই হোক, অর্থনৈতিকভাবে কিংবা পরিবেশগতভাবে অদূর ভবিষ্যতে পানি সমস্যা নিরসনে নির্লবণীকরণ একটি স্থায়ী সমাধান- এমনটা সবাই মনে করে না। ক্যালিফোর্নিয়ার হান্টিংটং বিচের মেয়র ডেবি কুক যখন থেকে ক্যালিফোর্নিয়া ডিস্যালাইনেশন টাস্ক ফোর্সের সদস্য হয়েছেন, তখন থেকেই পানি নির্লবণীকরণের সমালোচনা করে আসছেন। প্রচুর পরিমাণে শক্তিশোষণ করা ছাড়াও এ ধরনের প্রকল্পগুলো ভীষণ ব্যয়বহুল বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি নিজের লেখায় অনেকগুলো প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলোকে অর্থনৈতিক কিংবা অন্য কোন কারণে রদ করা হয়েছিল। একই সাথে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে, পানি নিয়ে সংকটে ভোগা অঞ্চলগুলো যেন পানি নির্লবণীকরণ প্রকল্পের পেছনে খরচ না করে পানি সংরক্ষণ এবং সরবরাহ করতে গিয়ে সম্মুখীন হওয়া সমস্যাগুলো নিরসন করার জন্য অর্থ ব্যয় করে।[৪৫]
পানি নির্লবণীকরণ করার একটি চমৎকার পদ্ধতি হলো নোনাপানির গ্রীনহাউজ, যেখানে একটি বিশেষভাবে তৈরি গ্রীনহাউজে সৌরশক্তি ব্যবহার করে সামুদ্রিক পানিকে লবণমুক্ত করে পানযোগ্য এবং কৃষিকাজে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়।
↑"The changing image of desalination"। ২০০৭-১০-০৭। Archived from the original on ২০০৭-১০-০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০২-১৬।উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: বট: আসল-ইউআরএলের অবস্থা অজানা (link)
↑"Pakistan embarks on nuclear desalination"। ২০০৮-১২-১৬। Archived from the original on ২০০৮-১২-১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০২-১৬।উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: বট: আসল-ইউআরএলের অবস্থা অজানা (link)