জ্যামিতি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

জ্যামিতি গণিতের একটি শাখা যেখানে আকার ও আকৃতি এবং পরিমান এতদসম্পর্কিত বিভিন্ন আঙ্গিকের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা হয়।[১] জ্যামিতিকে স্থান বা জগতের বিজ্ঞান হিসেবে গণ্য করা যায়। পাটিগণিতে যেমন গণনা সংক্রান্ত আমাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করা হয়, তেমনি জ্যামিতিতে স্থান বা জগৎ নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দেয়া হয়। প্রাথমিক জ্যামিতিকে কাজে লাগিয়ে দ্বি-মাত্রিক বিভিন্ন আকারের ক্ষেত্রফলপরিসীমা এবং ত্রিমাত্রিক বস্তুসমূহের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল ও আয়তন নির্ণয় করা সম্ভব।

জ্যামিতিক বিশ্লেষণের পদ্ধতি[সম্পাদনা]

জ্যামিতিতে কতগুলি সরল ধারণা ব্যবহার করে যুক্তিভিত্তিক জটিলতর কাঠামো গঠন করা হয়। এই সরল ধারণাগুলিকে মোটামুটি তিনটি বড় শ্রেণীতে ভাগ করা সম্ভব - অসংজ্ঞায়িত পদসমূহ, সংজ্ঞায়িত পদসমূহ এবং স্বতঃসিদ্ধসমূহ।

অসংজ্ঞায়িত পদসমূহ[সম্পাদনা]

জ্যামিতির কিছু কেন্দ্রীয় ধারণার কোন সরল সংজ্ঞা নেই। এই অসংজ্ঞায়িত ধারণাগুলির মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হল বিন্দু, রেখাতলের ধারণা।

এই মৌলিক ধারণাগুলি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত। একটি বস্তু কোথায়? - এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট, স্থির অবস্থানের কথা চিন্তা করতে হয়। "বিন্দু" পদটি দিয়ে আমাদের এই স্বজ্ঞাভিত্তিক (intuitive) স্থির, নির্দিষ্ট অবস্থানের ধারণাকেই নির্দেশ করা হয়। অনেক ভৌত বস্তুই বিন্দুর ধারণা নির্দশ করে। যেমন কোন ব্লক আকৃতির বস্তুর কোনা, পেন্সিলের ডগা, কিংবা কাগজের উপর ফুটকি। এই জিনিসগুলিকে বিন্দু নামক মানসিক, বিমূর্ত ধারণাটির বাস্তব, মূর্ত প্রতিরূপ বা মডেল হিসেবে গণ্য করা হয়। একইভাবে একটি টানটান সুতা, টেবিলের ধার, পতাকাবাহী দণ্ড, ইত্যাদি পরপর সাজানো অনেকগুলি বিন্দুকে নির্দেশ করে। যদি কল্পনা করা যায় যে এই বিন্দুসারি দুই দিকে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত, তবে আমরা যে মানসিক ধারণাতে উপনীত হই, জ্যামিতিতে তার নাম দেয়া হয়েছে "রেখা"। আর "তল" পদটি কোন চ্যাপ্টা পৃষ্ঠ যেমন- মেঝে, টেবিলের উপরিভাগ, কিংবা ব্ল্যাকবোর্ড ইত্যাদি ভৌত বস্তু দিয়ে নির্দেশ করা যায়। কিন্তু আমাদেরকে কল্পনা করে নিতে হবে যে এটি চারিদিকে অসীম পর্যন্ত সম্প্রসারিত, অর্থাৎ রেখার যেমন কোন শেষবিন্দু নেই, ঠিক তেমনি তলের কোন ধার নেই।

জ্যামিতির অন্যান্য অসংজ্ঞায়িত পদগুলি বিন্দু, রেখা ও তলের মধ্যে সম্পর্কের বর্ণনা দেয়। যেমন - "একটি রেখার উপর অবস্থিত একটি বিন্দু" বাক্যাংশটি একটি অসংজ্ঞায়িত সম্পর্ক। অর্থাৎ এটিকে আরও কোন সরলতর ধারণার সাহায্য নিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না।

সংজ্ঞায়িত পদসমূহ[সম্পাদনা]

অসংজ্ঞায়িত পদগুলিকে একত্র করে অন্যান্য পদের সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব, যেগুলিকে বলা হয় সংজ্ঞায়িত পদ। যেমন অসমরেখ বিন্দু বলতে সেইসব বিন্দুকে বোঝায় যারা একই রেখার উপর অবস্থিত নয়। একটি রেখাংশ বলতে বোঝায় কোন দুইটি নির্দিষ্ট বিন্দু ও এদের মধ্যবর্তী সমস্ত বিন্দু নিয়ে গঠিত কোন রেখার অংশ। আবার রশ্মি বলতে বোঝায় একটি আংশিক রেখাকে বোঝায় যার একটিমাত্র শেষবিন্দু আছে এবং বাকি সমস্ত বিন্দু ঐ শেষবিন্দু থেকে কোন এক দিকে অসীম পর্যন্ত প্রসারিত।

সংজ্ঞায়িত পদগুলিকে একে অপরের সাথে এবং অসংজ্ঞায়িত পদের সাথে একত্র করে আরও অনেক পদের সংজ্ঞা দেয়া যায়। যেমন - কোণ বলতে দুইটি রশ্মিকে বোঝায় যাদের একটি সাধারণ শেষবিন্দু আছে। একইভাবে ত্রিভুজ ধারণাটিকে তিনটি অসমরেখ বিন্দু এবং এদের মধ্যে অবস্থানকারী রেখাংশের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা যায়।

স্বতঃসিদ্ধসমূহ[সম্পাদনা]

স্বীকার্য বা স্বতঃসিদ্ধগুলি হচ্ছে অপ্রমাণিত কিন্তু সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত কিছু অনুমান, যেমন - "দুইটি ভিন্ন বিন্দুর মধ্য দিয়ে একটি এবং কেবলমাত্র একটি রেখা গমন করতে পারে"। যে ব্যবস্থা বা সংশ্রয়ে বিন্দু, রেখা ও তল সম্পর্কিত কতগুলি বিরোধিতাহীন স্বতঃসিদ্ধ প্রস্তাব করা হয় এবং এই স্বতঃসিদ্ধগুলি থেকে বিভিন্ন উপপাদ্য প্রমাণ করা হয়, সেই সংশ্রয়কে একটি জ্যামিতিক ব্যবস্থা (বা সংক্ষেপে জ্যামিতি) বলা হয়। স্বতঃসিদ্ধসমূহের বিভিন্ন সেট ব্যবহার সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন জ্যামিতিক ব্যবস্থায় উপনীত হওয়া সম্ভব।

যদি ভৌত স্থান বা জগতের অভিজ্ঞতার সাথে স্বতঃসিদ্ধগুলির মিল থাকে, তবে যৌক্তিকভাবে আশা করা যায় যে ঐ স্বতঃসিদ্ধগুলি ব্যবহার করে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তগুলিও ভৌত জগতের অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যাবে। তবে যেহেতু যেকোন স্বতঃসিদ্ধের সেটই খণ্ডিত, অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে পছন্দ করা হয়, সুতরাং তাদের সিদ্ধান্তগুলিও বাস্তব জগতের সাথে পুরোপুরি মিলে যাবে না। তাই কিছু কিছু জ্যামিতিক ব্যবস্থা বাস্তব জগতে সম্পূর্ণ প্রয়োগ না-ও করা যেতে পারে।

উপপাদ্যসমূহ[সম্পাদনা]

উপপাদ্যগুলি স্বতঃসিদ্ধগুলি থেকে যুক্তিভিত্তিক আরোহী পদ্ধতিতে বের করা হয়। আর এই আরোহী পদ্ধতিকে বলা হয় উপপাদ্যটির প্রমাণ। কোন প্রমাণের প্রতিটি ধাপকে হয় কোন স্বতঃসিদ্ধ অথবা কোন পূর্ব-প্রমাণিত উপপাদ্য দিয়ে সমর্থিত হতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি উপপাদ্য বলে যে, যদি একটি রেখা কোন সমান্তরাল রেখাজোড়ের যেকোন একটির সাথে সমান্তরাল হয়, তবে সেটি রেখাজোড়ের অপর রেখাটির সাথেও সমান্তরাল। এখানে সমান্তরাল রেখা বলতে সেই সব রেখাকে বোঝায় যারা একে অপরের থেকে তাদের গোটা দৈর্ঘ্য বরাবর সমান দূরত্ব বজায় রাখে।

আমরা যখন জ্যামিতিতে কোন উপপাদ্য প্রমাণ করি, তখন আমরা কতগুলি অনুমানের একটি সেট থেকে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হই।

ইউক্লিডীয় জ্যামিতি[সম্পাদনা]

বিভিন্ন জ্যামিতিক ব্যবস্থার মধ্যে ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সাথেই আমরা বেশি পরিচিত। ইউক্লিডীয় জ্যামিতি আমাদের চারপাশের প্রাত্যহিক জগতের বেশির ভাগ অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করতে পারে। প্রাচীন গ্রিক গণিতবিদ ইউক্লিডের নামে এই জ্যামিতিক ব্যবস্থার নামকরণ করা হয়েছে, কেননা তিনিই প্রথম এই জ্যামিতিক ব্যবস্থার বিবরণ দেন। যদিও ইউক্লিডীয় জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধগুলির সাথে বাস্তব জগতের অনেক মিল পাওয়া যায়, প্রমাণ পাওয়া গেছে যে এগুলি পুরোপুরি নিখুঁত নয়।

দ্বি-মাত্রিক ইউক্লিডীয় জ্যামিতিকে অনেকসময় সমতলীয় জ্যামিতি এবং ত্রি-মাত্রিক ইউক্লিডীয় জ্যামিতিকে অনেক সময় ঘন জ্যামিতি নামে ডাকা হয়। সমতলীয় জ্যামিতিতে কেবল সেইসব জ্যামিতিক বস্তু নিয়ে আলোচনা করা হয় যেগুলি কেবল একটি তলের উপর অবস্থিত। এগুলির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ - এই দুইটি মাত্রা আছে। অন্যদিকে ঘন জ্যামিতিতে সেইসব জ্যামিতিক বস্তু নিয়ে আলোচনা করা হয় যেগুলির তিনটি মাত্রা আছে: দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা।

ত্রিমাত্রিক ফাঁপা কোণককে একটি তল দিয়ে কাটলে যে দ্বিমাত্রিক রেখা পাওয়া যায়, তাকে কনিক ছেদ বলে; এটি জ্যামিতির একটি অন্যতম আলোচ্য বিষয়।

ইউক্লিডের স্বতঃসিদ্ধসমূহ[সম্পাদনা]

ইউক্লিড খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের জ্যামিতিবিদ ছিলেন। তিনি বুঝতে পারেন যে তার সময়কার বিভিন্ন জ্যামিতিক উপপাদ্যগুলিকে খুবই অল্প সংখ্যক স্বতঃসিদ্ধের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তিনি নির্ণয় করেন যে নিচের মাত্র পাঁচটি স্বতঃসিদ্ধ থেকে সমস্ত উপপাদ্যতে উপনীত হওয়া যায়:

  1. যেকোন দুইটি প্রদত্ত বিন্দুর মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র একটি সরলরেখা আঁকা সম্ভব।
  2. কোন সরলরেখাকে অসীম পর্যন্ত প্রসারিত করা যায় কিংবা যেকোন বিন্দুতে সীমাবদ্ধ করা যায়।
  3. যেকোন বিন্দুকে কেন্দ্র ধরে ও যেকোন ব্যাসার্ধ (বৃত্তের যেকোন বিন্দু থেকে কেন্দ্রের দূরত্ব) নিয়ে একটিমাত্র বৃত্ত আঁকা সম্ভব।
  4. সব সমকোণ সবসময় সমান।
  5. একটি প্রদত্ত সরলরেখার বহিঃস্থ একটি প্রদত্ত বিন্দু দিয়ে প্রথম সরলরেখার সমান্তরাল কেবলমাত্র একটি সরলরেখা আঁকা সম্ভব।

উপরের পাঁচটি স্বতঃসিদ্ধকে অন্যান্য সংজ্ঞায়িত পদের সাথে বিভিন্নভাবে সমন্বিত করে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিক বস্তুর ধর্মগুলি (যেমন ক্ষেত্রফল, পরিধি, ইত্যদি) প্রমাণ করা সম্ভব। এই ধর্মগুলি আবার আরও জটিল জ্যামিতিক উপপাদ্যের প্রমাণে ব্যবহার করা যায়।

দ্বিমাত্রিক ইউক্লিডীয় আকৃতি[সম্পাদনা]

দ্বিমাত্রিক জ্যামিতিতে প্রায়শই দেখা যায় এমন জ্যামিতিক আকৃতির মধ্যে আছে বৃত্ত, বহুভুজ, ত্রিভুজ, এবং চতুর্ভুজসমূহ। ত্রিভুজ ও চতুর্ভুজ দুইটি বিশেষ ধরনের বহুভুজ।

বৃত্ত[সম্পাদনা]

বৃত্ত একটি সমতলীয় বক্ররেখা যার প্রতিটি বিন্দু একই সমতলের উপর অবস্থিত একটি নিদিষ্ট বিন্দু থেকে সমদূরবর্তী, এই নির্দিষ্ট বিন্দুকে বৃত্তের কেন্দ্র বলে।তিনটি অসমরেখ বিন্দুর মধ্য দিয়ে কেবলমাত্র একটি বৃত্ত আঁকা সম্ভব। অনেকসময় বৃত্ত বলতে শুধু বক্ররেখাটিকে না বুঝিয়ে রেখাটি দ্বারা সম্পূর্ণ ক্ষেত্রকেও বোঝানো হয়।

যেসব বৃত্তের একটি সাধারণ কেন্দ্র আছে তাদেরকে সমকেন্দ্রিক বৃত্ত বলা হয়। যেসব কোণের শীর্ষবিন্দু বৃত্তের কেন্দ্র এবং দুই বাহু বৃত্তের দুইটি ব্যাসার্ধ, সেগুলিকে বৃত্তের কেন্দ্রীয় কোণ বলে। বৃত্তের পরিধিকে ৩৬০টি সমান ভাগ বা ডিগ্রিতে ভাগ করা হয় এবং কোন কেন্দ্রীয় কোণের ডিগ্রি পরিমাপ ঐ কোণটি বৃত্ত থেকে যে চাপ ছেদ করে তাতে অন্তর্গত ডিগ্রির সংখ্যার সমান।

বৃত্তের পরিধি (C) ও ব্যাসের (d) গুণফলকে ৪ দিয়ে ভাগ করলে এর ক্ষেত্রফল A পাওয়া যায় অর্থাৎ । পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতের আসন্ন মান ৩.১৪১৫৯২৬৫। দশমিকের পরে অসীমসংখ্যক অ-পর্যায়বৃত্ত অঙ্কবিশিষ্ট এই ধ্রুবকটিকে পাই নামে ডাকা হয়। বৃত্তের ক্ষেত্রফলকে আকারেও লেখা যায়, যেখানে r হল ব্যাসার্ধ। একইভাবে, বৃত্তের পরিধি হল ব্যাস ও পাই-এর গুণফল

বহুভুজ[সম্পাদনা]

সরলরেখা দ্বারা আবদ্ধ সমতল যেকোন চিত্রকে বহুভুজ বলা হয়। যদি বহুভুজের সবগুলি বাহু ও কোণ সমান হয়, তবে সেটিকে সুষম বহুভুজ বলে। সুষম বহুভুজের কেন্দ্র থেকে যেকোন বাহুর দূরত্বকে apothem বলে। কোন সুষম বহুভুজের ক্ষেত্রফল হল এর apothem (a) ও পরিসীমার (p) গুণফলের অর্ধেক, অর্থাৎ

ত্রিভুজ[সম্পাদনা]

ত্রিভুজ হল সমতলের উপর অঙ্কিত একটি চিত্র যা তিনটি সরলরেখা দ্বারা সীমাবদ্ধ। যদি ত্রিভুজের তিনটি বাহুই অসম হয়, তবে একে বিষমবাহু ত্রিভুজ বলে। আর কেবল দুই বাহু সমান হলে তাকে সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ এবং তিনটি বাহুই সমান হলে তাকে সমবাহু ত্রিভুজ বলা হয়। সমদ্বিবাহু ত্রিভুজে সমান বাহুদ্বয়ের বিপরীত কোণগুলি সমান। আর সমবাহু ত্রিভুজের সবগুলি কোণ সমান।

যে ত্রিভুজের একটি কোন সমকোণ তাকে সমকোণী ত্রিভুজ বলে। সমকোণী ত্রিভুজের সমকোণের বিপরীত বাহুর নাম অতিভুজ। পিথাগোরাসের বিখ্যাত উপপাদ্য অনুযায়ী সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল ত্রিভুজটির সমকোণ-সংলগ্ন দুই বাহুর উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্র দুটির ক্ষেত্রফলের যোগফলের সমান। অর্থাৎ যেখানে c অতিভুজের দৈর্ঘ্য এবং a ও b হলো সমকোণ-সংলগ্ন বাহুদুটির দৈর্ঘ্য৷

ত্রিভুজের ভিতরের কোনগুলিকে অন্তঃস্থ কোণ বলে, আর ত্রিভুজের বাহুগুলিকে বাড়িয়ে দিয়ে যে কোণগুলি পাওয়া যায়, তাদেরকে হলে বহিঃস্থ কোণ। ত্রিভুজের তিনটি অন্তঃস্থ কোণের সমষ্টি ১৮০°। এছাড়াও, যেকোন বহিঃস্থ এর অন্তঃস্থ বিপরীত কোণদ্বয়ের সমষ্টির সমান।

ত্রিভুজের কোন শীর্ষবিন্দু থেকে বিপরীত বাহুর মধ্যবিন্দু পর্যন্ত আঁকা রেখাকে বলা হয় ত্রিভুজটির একটি মধ্যমা। ত্রিভুজের তিনটি মধ্যমা একই বিন্দুতে ছেদ করে এবং এটি প্রতিটি মধ্যমার শীর্ষবিন্দু থেকে দুই-তৃতীয়াংশ দূরত্বে অবস্থিত। ত্রিভুজের কোন শীর্ষবিন্দু থেকে বিপরীত বাহুর উপর অঙ্কিত লম্বকে ঐ ত্রিভুজের উচ্চতা বলে।

দুইটি ত্রিভুজকে সর্বসম বলা হয় যদি এগুলি নিচের তিনটি শর্তের যেকোনটি পূরণ করে: (১) একটি ত্রিভুজের এক বাহু ও দুইটি কোণ অন্যটির অনুরূপ বাহু ও দুইটি কোণের সমান; (২) কোন একটি ত্রিভুজের দুই বাহু এবং এদের অন্তর্ভুক্ত কোণ অন্য ত্রিভুজটির দুই বাহু ও অন্তর্ভুক্ত কোণের সমান; অথবা (৩) একটি ত্রিভুজের তিনটি বাহু অপর ত্রিভুজের তিন বাহুর সমান। যদি একই সমতলে অবস্থিত দুইটি ত্রিভুজকে নিখুঁতভাবে একটির উপর আরেকটিকে বসিয়ে দেয়া যায়, তবে তারা সরাসরি সর্বসম। আর যদি বসানোর আগে একটিকে উল্টে নিতে হয়, তবে ত্রিভুজ দুটি বিপরীতভাবে সর্বসম।

যদি দুইটি ত্রিভুজের একটির সবগুলি কোণ অন্যটির সবগুলি কোণের সমান হয়, তবে তাদেরকে সদৃশ ত্রিভুজ বলা হয় এবং এদের অনুরূপ বাহুগুলি সমানুপাতিক হয়।

ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল এর ভূমি (b) ও এই ভূমির উপর অঙ্কিত উচ্চতার (h) গুণফলের অর্ধেক ()। যেকোন বাহুকেই ভূমি ধরা যায়। যদি ত্রিভুজটি সমবাহু হয়, তবে এর ক্ষেত্রফল , যেখানে a যেকোন বাহুর দৈর্ঘ্য। যদি কোন ত্রিভুজের তিনটি বাহু a, b এবং c হয়, তবে গ্রিক গণিতবিদ আর্কিমিডিসের দেয়া সূত্র অনুযায়ী এর ক্ষেত্রফল , যেখানে s ত্রিভুজের পরিসীমার অর্ধেক

চতুর্ভুজ[সম্পাদনা]

চতুর্ভুজ হল চারটি সরলরেখা দ্বারা আবদ্ধ সমতল ক্ষেত্র। যেসব বিভিন্ন চতুর্ভুজের সাথে আমরা অতিপরিচিত তাদের মধ্যে আছে ট্রাপিজিয়াম, যার দুইটি সমান্তরাল কিন্তু অসমান। সামান্তরিকের বিপরীত বাহুগুলি সমান ও সমান্তরাল। রম্বস এক ধরনের সামান্তরিক যার সবগুলি বাহু সমান। আয়তক্ষেত্র এক ধরনের সামান্তরিক যার কোণগুলি সমকোণ। বর্গক্ষেত্র হল সমান বাহুবিশিষ্ট আয়তক্ষেত্র। সামান্তরিকের কর্ণদ্বয় পরস্পরকে সমদ্বিখণ্ডিত করে। আয়োতক্ষেত্রের কর্ণদ্বয় সমান। যেসব চতুর্ভুজের বাহুগুলি অসমান ও অসমান্তরাল, তাদেরকে বিষম চতুর্ভুজ বলে।

ট্রাপিজিয়ামের ক্ষেত্রফল এর সমান্তরাল বাহুদ্বয়ের সমষ্টি ও উচ্চতার গুণফলের অর্ধেক: A = [(b1 + b2)/2]h। সামান্তরিকের ক্ষেত্রফল এর ভূমি ও উচ্চতার গুণফলের সমান: A = bh।

বিষম চতুর্ভুজের ক্ষেত্রফল গণনার জন্য চতুর্ভুজটিকে সাধারণত কর্ণের সাহায্যে দুইটি ত্রিভুজে ভাগ করে নেয়া হয় এবং তারপর ত্রিভুজ দুইটির ক্ষেত্রফল আলাদা করে বের করে যোগ করে সম্পূর্ণ চতুর্ভুজের ক্ষেত্রফল বের করা হয়।

ত্রিমাত্রিক ইউক্লিডীয় আকৃতিসমূহ[সম্পাদনা]

ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিতে যে বস্তুগুলি প্রায়োই আলোচিত হয় তাদের মধ্যে আছে গোলক, বহুতলক, ত্রিশিরা বা প্রিজম, বেলন বা সিলিন্ডার, ও কোণক। বেলন আসলে প্রিজমেরই একটি বিশেষ রূপ; আর কোণক পিরামিডের বিশেষ রূপ।

গোলক[সম্পাদনা]

গোলক একটি তল যার সমস্ত বিন্দু কেন্দ্র নামের একটি বিন্দু থেকে সমদূরত্বে অবস্থিত। গোলককে একটি সমতল দিয়ে ছেদ করলে ছেদবিন্দুগুলি একটি বৃত্ত গঠন করে। তলটি গোলকের কেন্দ্র দিয়ে গেলে এরূপ বৃহত্তম বৃত্তটি পাওয়া যায়। পৃথিবীর বিষুবরেখা এরকম একটি বৃহত্তম বৃত্ত (যদি পৃথিবীকে একটি গোলক কল্পনা করি)। গোলকের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল A = 4pr2, এবং আয়তন V = 4/3pr3 সমীকরণ দিয়ে পাওয়া যায়।

বহুতলক[সম্পাদনা]

সমতল পৃষ্ঠ দ্বারা আবদ্ধ যেকোন ঘনবস্তুকে বহুতলক বলে। যদি কোন বহুতলকের পৃষ্ঠগুলির প্রতিটি সর্বসম সুষম বহুভুজ হয়, তবে এটিকে সুষম বহুতলক বলা হয়। প্রমাণ করা হয়েছে যে কেবল পাঁচ রকমের বহুতলকের জন্য সুষম বহুতলক সম্ভব। এগুলি হল চতুস্তলক (চারটি তল), ঘনক (ছয়টি তল), অষ্টতলক (আটটি তল), দ্বাদশতলক (১২টি তল), এবং বিশতলক (২০টি তল)। প্রাচীন গ্রিক জ্যামিতিবিদেরা এই পাঁচটি বহুতলক সম্পর্কে জানতেন। সুষম কিংবা অসম, যেকোন বহুতলকের একটি বিশেষ ধর্ম হচ্ছে এর তলের সংখ্যা ও শীর্ষবিন্দুর সংখ্যা যোগ করে ২ বিয়োগ করলে এর ধারের সংখ্যা পাওয়া যায়। সাম্প্রতিককাল পর্যন্তও বহুতলকগুলির সাথে প্রকৃতির রহস্যময়তার সম্পর্ক আছে বলে ধারণা করা হত।

ত্রিশিরা বা প্রিজম[সম্পাদনা]

প্রিজম হচ্ছে এমন এক ধরনের বহুতলক যার দুইটি পৃষ্ঠ পরস্পর সমান্তরাল ও সর্বসম (এদেরকে ভূমি বলে) এবং যার অন্য সব পৃষ্ঠ সামান্তরিক। parallelepiped এক ধরনের প্রিজম যার ভূমিদ্বয় সামান্তরিক। একটি সমকোণী প্রিজমের তলগুলি আয়তাকার(ভূমিগুলি আয়তাকার হতেও পারে নাও হতে পারে)। প্রিজমের আয়তন এর যেকোন ভূমির ক্ষেত্রফল ও উচ্চতার গুণফল: V = bh.

পিরামিড[সম্পাদনা]

পিরামিড একটি বহুতলক যার ভূমি একটি বহুভুজ এবং পার্শ্বগুলি একই শীর্ষবিন্দুবিশিষ্ট ত্রিভুজ। যদি কোন পিরামিডের ভূমি সুষম বহুভুজ হয় এবং এর শীর্ষ ও ভূমির কেন্দ্রবিন্দুকে সংযোগকারী রেখা ভূমির উপর লম্ব হয়, তবে এটিকে সুষম সমকোণী পিরামিড বলে। পিরামিডের ক্ষেত্রফল এর ভূমির ক্ষেত্রফলের এক-তৃতীয়াংশ ও এর উচ্চতার গুণফলের সমান।

বেলন বা সিলিন্ডার ও কোণক[সম্পাদনা]

বেলন বা সিলিন্ডার হল বৃত্তাকার ভূমিবিশিষ্ট প্রিজম। এর আয়তনের সূত্রও তাই প্রিজমের মত ভূমির ক্ষেত্রফল ও উচ্চতার গুণফল দিয়ে বের করা হয়। যদি দুইটি ভূমির কেন্দ্রকে সংযোগকারী রেখা ভূমিদ্বয়ের উপর লম্ব হয়, তবে সেই সিলিন্ডারকে সমকোণী সিলিন্ডার বলা হয়। নতুবা একে তির্যক সিলিন্ডার বলে।

কোণক (cone) হল বৃত্তাকার ভূমিবিশিষ্ট পিরামিড। পিরামিডের শীর্ষ ও ভূমির কেন্দ্রকে সংযোগকারী রেখা ভূমির উপর লম্ব হলে তাকে সমকোণী কোণক বলে। b ক্ষেত্রফলের ভূমি ও h উচ্চতার কোণকের আয়তনের সূত্র পিরামিডের অনুরূপ: V = €bh

কনিক ছেদ[সম্পাদনা]

কোণকের পৃষ্ঠতলকে সমতল একটি তল দিয়ে ছেদ করলে যে বক্ররেখা পাওয়া যায়, তাকে কনিক ছেদ বলে (উল্লেখ্য এখানে কোণক বলতে আসলে দুইটি সমকোণী বৃত্তভূমিক কোণকের একটিকে উল্টিয়ে দুই শীর্ষবিন্দু একত্রে স্থাপন করলে যে জ্যামিতিক চিত্রটি তৈরি হয়, তাকে বোঝাচ্ছে)। শীর্ষবিন্দুর দুইপাশের কোণকের যেকোন পৃষ্ঠকে nappe বলে।

যদি কোণকের অক্ষ ও এর পৃষ্ঠের অন্তর্বর্তী কোণ A হয় এবং কোণকটিকে একটি তল A-এর চেয়ে বড় কোণে ছেদ করে, তবে ছেদরেখাটি হয় একটি বদ্ধ বক্ররেখা যার নাম উপবৃত্ত। যদি তলটি কোণককে অক্ষের সাথে লম্বভাবে ছেদ করে, তবে যে আবদ্ধ বক্ররেখাটি পাওয়া যায়, তার নাম বৃত্ত। বৃত্ত তাই উপবৃত্তের একটি বিশেষ রূপ।

যদি তলটি অক্ষের সাথে A কোণের সমান কোণ করে ছেদ করে, অর্থাৎ কোণকের পৃষ্ঠতলের সমান্তরালে ছেদ করে, তবে যে উন্মুক্ত ও অসীমে বিস্তৃত বক্ররেখাটি ছেদরেখা হিসেবে পাওয়া যায়, তাকে পরাবৃত্ত বলে। আর যদি তলটি অক্ষের সমান্তরালে বা A কোণের চেয়ে ক্ষুদ্রতর কোণে ছেদ করে, তবে যে বক্ররেখাটি পাওয়া যায়, তাকে অধিবৃত্ত বলে। এইক্ষেত্রে কোণকটির উভয় nappe-ই ছিন্ন হয়, ফলে অধিবৃত্তের দুইটি শাখা থাকে, যাদের প্রতিটি অসীম পর্যন্ত প্রসারিত।

যেহেতু কনিক ছেদগুলি দ্বিমাত্রিক বক্ররেখা, তাই এদের সংজ্ঞায় ত্রিমাত্রিক কোণকের উল্লেখ না করে অন্য উপায়ে সংজ্ঞা দেয়া হয়। দ্বিমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোণকীয় ছেদ হল সেই সমস্ত বিন্দুর চলনপথ একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে যেগুলির দূরত্ব এবং ঐ নির্দিষ্ট বন্দুর বহিঃস্থ একটি নির্দিষ্ট রেখা থেকে ঐ একই বিন্দুগুলির দূরত্ব একটি ধ্রুব অনুপাত বজায় রাখে। নির্দিষ্ট বিন্দুটিকে বলা হয় ফোকাস বা উপকেন্দ্র, এবং নির্দিষ্ট রেখাটিকে বলা হয় নিয়ামক বা দিগাক্ষ। ধ্রুব অনুপাতটিকে বলা হয় কনিক ছেদের উৎকেন্দ্রিকতা এবং একে e দিয়ে নির্দেশ করা হয়। যদি P একটি বিন্দু হয় এবং Q বিন্দুটি P থেকে দিগাক্ষরেখার উপর অঙ্কিত লম্বের পাদবিন্দু হয়, তবে P বিন্দুটির F ফোকাসবিশিষ্ট একটি কনিক ছেদের উপর অবস্থিত হওয়ার একমাত্র শর্ত হল [FP] = e[QP]। যখন e = ১ তখন কনিকটি একটি পরাবৃত্ত; যখন e > ১, তখন এটি অধিবৃত্ত; এবং যখন e < ১, এটি একটি উপবৃত্ত।

কনিকের অনেক গাণিতিক বৈশিষ্ট্য গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে কাজে আসে। উদাহরণস্বরূপ, কোন কনিকের আকারে নির্মিত দর্পণে আলো নির্দিষ্ট ধর্ম অনুযায়ী প্রতিফলিত হয়। বৃত্তাকার দর্পণের ফোকাস থেকে উৎসারিত রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে আবার ফোকাসে ফিরে আসে। উপবৃত্তাকার দর্পণের দুইটি ফোকাসের যেকোন একটি থেকে উৎসারিত রশ্মি প্রতিফলনের পর অন্য ফোকাসটি দিয়ে গমন করে। পরাবৃত্তীয় দর্পণে ফোকাস থেকে উৎসারিত আলো প্রতিফলনের পর সমান্তরাল রেখায় গমন করে, এ কারণে স্পটলাইটে পরাবৃত্তীয় দর্পণ ব্যবহার করা হয়, যেন আলো চারপাশে বিক্ষিপ্ত না হয়। অধিবৃত্তের একটি ফোকাস থেকে উৎসারিত আলোকরশ্মি প্রতিফলনের পর এমনভাবে গমন করে যেন মনে হয় এগুলি অন্য ফোকাসটি থেকে উৎসারিত হচ্ছে।

এই ত্রিমাত্রিক চিত্রটি উত্তর মেরু থেকে গোলকের নিচে একটি সমতলের উপর স্টেরিওগ্রাফিক অভিক্ষেপ প্রদর্শন করে।

বিশ্লেষণী জ্যামিতি[সম্পাদনা]

কিছু কিছু সাংখ্যিকবীজগাণিতিক সমীকরণ দিয়ে বিন্দু, রেখা এবং অন্যান্য জ্যামিতিক আকৃতি নির্দেশ করা যায়, এই উপলব্ধি থেকেই বিশ্লেষণী জ্যামিতির জন্ম। অক্ষ ও স্থানাঙ্ক ব্যবহার করে সমীকরণগুলির চিত্রলেখ অঙ্কনের মাধ্যমে বিন্দু, রেখা ও অন্যান্য আকৃতি নির্দেশ করা সম্ভব। যেমন, লম্বভাবে অবস্থিত দুইটি অক্ষ থেকে দূরত্ব নির্দেশ করে কোন একটি বিন্দুর অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব। যদি কোনো বিন্দু x-অক্ষ থেকে ৫ একক দূরে এবং y-অক্ষ থেকে ৭ একক দূরে অবস্থিত হয়, তবে এটির অবস্থান x = 7, y = 5, এই সমীকরণ দুইটি দিয়ে নির্দেশ করা সম্ভব। একইভাবে, একটি সরলরেখাকে সবসময় ax + by + c = 0 আকারের একটি সমীকরণ দিয়ে নির্দেশ করা যায়। বৃত্ত, উপবৃত্ত, কোণীয় ছেদ ও অন্যান্য আকৃতির জন্য আরও জটিল সমীকরণ আছে।

বিশ্লেষণী জ্যামিতিতে দুই ধরনের সমস্যা খুবই সাধারণ। প্রথম ধরনের সমস্যাতে কতগুলি বিন্দুর জ্যামিতিক বিবরণ দেয়া থাকে, এবং সেখান থেকে এই বিন্দুগুলিকে সিদ্ধ করে এমন বীজগাণিতিক সমীকরণ করতে হয়। দ্বিতীয় ধরনের সমস্যা এর বিপরীত: প্রদত্ত বীজগাণিতিক সমীকরণ থেকে এমন কোন বিন্দু সমাহার বের করতে হয় যেগুলি একটি জ্যামিতিক বিবৃতি মেনে চলে। উদাহরণস্বরূপ ৩ ব্যাসার্ধবিশিষ্ট একটি বৃত্ত যার কেন্দ্র x ও y অক্ষের ছেদবিন্দু তথা মূলবিন্দুতে অবস্থিত, সেটির সমস্ত বিন্দু সমীকরণ মেনে চলবে। এই ধরনের সমীকরণ ব্যবহার করে জ্যামিতিক অন্যান্য সমস্যা যেমন কোন কোণ বা রেখাংশের সমদ্বিখণ্ডক বের করা, বা কোন রেখার নির্দিষ্ট বিন্দুতে লম্ব আঁকা, তিনটি প্রদত্ত অসমরেখ বিন্দুর মধ্য দিয়ে বৃত্ত আঁকা, ইত্যাদি সম্পাদন করা যায়।

একইভাবে তিনটি অক্ষ ব্যবহার করে ত্রিমাত্রিক জগতে বিন্দু, রেখা ও অন্যান্য চিত্র নির্দেশ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে তৃতীয় অক্ষ বা z অক্ষটি পর দুইটি অক্ষের উপর লম্বভাবে অবস্থিত থাকে।

গণিতের উন্নয়নে বিশ্লেষণী জ্যামিতি মূল্যবান ভূমিকা রাখে। এটি সংখ্যার সম্পর্ক তথা বিশ্লেষণী গণিতের সাথে জ্যামিতি তথা স্থানিক সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করে। বিশ্লেষণী জ্যামিতির কৌশলগুলি সংখ্যা ও বীজগাণিতিক রাশিমালার জ্যামিতিক উপস্থাপন সম্ভব করে। ফলে ক্যালকুলাস, ফাংশনের তত্ত্ব, ও উচ্চতর গণিতের অন্যান্য সমস্যা নতুন আলোকে দেখার সুযোগ হয়। বিশ্লেষণী জ্যামিতি ছাড়া অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি ও তিনের অধিক মাত্রার জ্যামিতির আলোচনা সম্ভবপর হত না।

অন্তরক জ্যামিতি[সম্পাদনা]

জার্মান গণিতবিদ কার্ল ফ্রিড্‌রিশ গাউস ভূমি জরিপ ও প্রভূমিতি (geodesy) সংক্রান্ত ব্যাবহারিক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে অন্তরক জ্যামিতি শাখা শুরু করেন। এতে তিনি অন্তরক ক্যালকুলাস ব্যবহার করে বক্ররেখা ও বক্রতলসমূহের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলি চিহ্নিত করেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি গাণিতিকভাবে দেখান যে একটি বেলনের স্বকীয় বক্রতা ও একটি সমতলের স্বকীয় বক্রতা একই, কেননা একটি ফাঁপা বেলনকে অক্ষ বরাবর কেটে চ্যাপ্টা করলে এটি একটি সমতলে পরিণত হয়, কিন্তু গোলকের ক্ষেত্রে রূপবিকার না করে এটি করা যায় না।

অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি[সম্পাদনা]

ইউক্লিডের পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধ বলে যে কোনো প্রদত্ত রেখার বহিঃস্থ একটি বিন্দু দিয়ে ঐ রেখার সমান্তরাল কেবল একটি রেখা আঁকা সম্ভব এবং এই সমান্তরাল রেখা কখনোই প্রদত্ত রেখাটিকে স্পর্শ করবে না, অসীম পর্যন্ত সমান্তরালে চলতে থাকবে। ১৯শ শতকের শুরুর দিকে জার্মান গণীতবিদ কার্ল ফ্রিড্‌রিশ গাউস, রুশ গণিতবিদ নিকলাই ইভানভিচ লোবাচেভ্‌স্কি এবং হাঙ্গেরীয় গণিতবিদ ইয়ানোশ বলিয়ই একে অপরের থেকে স্বাধীনভাবে দেখান যে এমন একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ জ্যামিতিক ব্যবস্থা গঠন করা সম্ভব যেখানে ইউক্লিডের এই পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটিকে অন্য একটি স্বতঃসিদ্ধ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব যেটি বলে যে কোন প্রদত্ত রেখার বহিঃস্থ কোন বিন্দু দিয়ে রেখাটির সমান্তরাল অসীম সংখ্যক রেখা আঁকা সম্ভব। পরবর্তীতে ১৮৬০ সালে জার্মান গণিতবিদ গেয়র্গ ফ্রিড্‌রিশ বের্নহার্ট রিমান দেখান যে আরেকটি জ্যামিতিক ব্যবস্থা গঠন করা সম্ভব যেখানে এরকম কোনো সমান্তরাল রেখাই আঁকা সম্ভব নয়।

উপরের দুই ধরনের অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির বিস্তারিত বিবরণ বেশ জটিল, তবে দুটিকেই সহজ মডেলের মাধ্যমে দেখানো সম্ভব। বলিয়াই-লোবাচেভ্‌স্কি জ্যামিতিতে (যাকে অনেক সময় অধিবৃত্তীয় জ্যামিতিও বলা হয়) এমন একটি জ্যামিতিক ব্যবস্থা আলোচনা করা হয় যার সমস্ত বিন্দু একটি বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং যার সমস্ত সম্ভাব্য রেখা বৃত্তটির জ্যা। যেহেতু সংজ্ঞা অনুসারে দুইটি সমান্তরাল রেখাকে যতই প্রসারিত করা হোক না কেন, এর কখনোই মিলবে না, এবং অধিবৃত্তীয় জ্যামিতিতে যেহেতু রেখাগুলি বৃত্তের ধারের বাইরে প্রসারিত করা সম্ভব নয়, সে কারণে যেকোন রেখার সমান্তরাল অসীম সংখ্যক রেখা রেখাটির বহিঃস্থ বিন্দু দিয়ে আঁকা সম্ভব।

একইভাবে রিমানীয় বা উপবৃত্তীয় অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে জ্যামিতিক "বিশ্ব" বা "জগত" একটি বিশাল গোলকের পৃষ্ঠ যেখানে সব সরলরেখা একেকটি বৃহত্তম বৃত্ত। এই জ্যামিতিতে এক জোড়া সমান্তরাল রেখা আঁকা অসম্ভব।

অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বের জন্য, অর্থাৎ আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে, ইউক্লিডীয় ও অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তবে মহাজাগতিক দূরত্ব এবং আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা যেমন আপেক্ষিকতার সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য ইউক্লিডীয় জ্যামিতির চেয়ে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি পর্যবেক্ষণকৃত ঘটনাবলির আরও সূক্ষ্ম ও সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বক্রতলের একটি রিমানীয় জ্যামিতির উপর ভিত্তি করে সম্পাদিত।

অভিক্ষেপী জ্যামিতি[সম্পাদনা]

বিভিন্ন জ্যামিতিক বস্তু ও এদের অভিক্ষেপের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করতে গিয়ে ১৭শ শতকে জ্যামিতির আরেকটি শাখা শুরু হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কনিকগুলিকে অভিক্ষেপের মাধ্যমে একটি থেকে আরেকটিতে রূপান্তরিত করা যায়। কোন ফ্ল্যাশলাইটকে দেয়ালের সাথে লম্বভাবে ধরলে বৃত্তাকার আলোকপট্টি ফেলে, কিন্তু কোণ করে হেলিয়ে ধরলে দেয়ালে উপবৃত্তাকার আলোকপট্টির সৃষ্টি হয়।

অভিক্ষেপী রূপান্তরের পরেও জ্যামিতিক চিত্রের কিছু কিছু ধর্ম অপরিবর্তনশীল থাকে। এই অপরিবর্তনশীল ধর্মগুলি কী, তাই অভিক্ষেপী জ্যামিতির বিভিন্ন উপপাদ্যের আলোচ্য।

চার বা তার বেশি মাত্রার জ্যামিতি[সম্পাদনা]

অভিক্ষেপী ও বিশ্লেষণী জ্যামিতির উন্নয়ন গণিতবিদদেরকে তিনের বেশি মাত্রার জগতের জ্যামিতি অধ্যয়নে উৎসাহী করে। অনেকে মনে করেন এ ধরনের বহুমাত্রিক জগৎ নিয়ে চিন্তা করা খুব কঠিন। কিন্তু আসলে গণিতবিদেরা এগুলি আরও সহজ উপায়ে কল্পনা করেন।

ভৌত বিশ্বের যেকোন বিন্দুর অবস্থান তিনটি অক্ষের (সাধারণত x, y, ও z-অক্ষ নামে পরিচিত) সাপেক্ষে নির্দেশ করা সম্ভব। ভৌত বিশ্বের স্থান বিষয়ক জ্যামিতি তাই ত্রিমাত্রিক।

এই ত্রিমাত্রিক জগতের প্রতিটি বিন্দুকে কল্পনায় যদি একটি গোলক দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে নেওয়া হয়, তবে এটি একটি চতুর্মাত্রিক জগতে পরিণত হয়। কেননা তখন প্রতিটি বিন্দু-গোলকের অবস্থান নির্দেশ করার জন্য চারটি নির্দেশক লাগবে: গোলকের কেন্দ্র নির্দেশকারী x, y, ও z-স্থানাংক এবং গোলকটির ব্যাসার্ধের দৈর্ঘ্য।

একইভাবে দ্বিমাত্রিক জগৎ দিয়ে একটি ত্রিমাত্রিক জগতকে উপস্থাপন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে দ্বিমাত্রিক জগতের প্রতিটি বিন্দুকে একটি বৃত্ত দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়, এবং ত্রিমাত্রিক জগতের তিনটি মাত্রা হল বৃত্তের কেন্দ্র নির্দেশক দুইটি স্থানাংক এবং এর ব্যাসার্ধ।

তিনের বেশি মাত্রার জগৎ নিয়ে জ্যামিতিক ধারণাগুলি ভৌত বিজ্ঞানে, বিশেষ করে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

চার বা তার বেশি মাত্রার জগতের সুষম জ্যামিতিক বস্তুগুলির অধ্যয়নে বিশ্লেষণী জ্যামিতির পদ্ধতিও প্রয়োগ করা হয়। এই জ্যামিতিকে বলে সাংগঠনিক জ্যামিতি (structural geometry)। সাংগঠনিক জ্যামিতির একটি সরল উদাহরণ হল শুন্য, এক, দুই, তিন, চার বা তার বেশি মাত্রার জগতের সরলতম জ্যামিতিক বস্তুটির সংজ্ঞা বের করা, যাকে সবচেয়ে কম সংখ্যক শীর্ষ, ধার ও পৃষ্ঠ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায়। এদের মধ্যে শুন্য, এক, দুই ও তিন মাত্রার জন্য বস্তুগুলি হচ্ছে আমাদের পরিচিত বিন্দু, রেখা, ত্রিভুজ ও চতুস্তলক। চার মাত্রার জগতের জন্য দেখানো যায় যে সরলতম জ্যামিতিক বস্তুটির পাঁচটি শীর্ষ, ১০টি ধার এবং ১০টি পৃষ্ঠ আছে।

জ্যামিতিশাস্ত্রের ইতিহাস[সম্পাদনা]

প্রাচীন জ্যামিতিবিদেরা ভূমিক্ষেত্রসমূহের ক্ষেত্রফল ও ঘরবাড়ি নির্মাণের সময় সঠিকভাবে সমকোণ নির্ণয়ের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতেন। প্রাচীন মিশরে প্রতি বছর নীল নদের বন্যায় জমিসমূহের সীমানা নষ্ট হয়ে যেত এবং এই সীমানাগুলি পুনরুদ্ধারের জন্য জ্যামিতির সাহায্য নেয়া হত। এই ধরনের অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্যামিতি প্রাচীন মিশর, সুমের এবং ব্যাবিলনিয়াতে বিকাশ লাভ করে এবং পরবর্তীতে গ্রিকদের হাতে পরিশীলিত ও নিয়মাবদ্ধ হয়।

প্রাচীন মেসোপটেমিয়া[সম্পাদনা]

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া এবং মিশরে জ্যামিতির প্রথম নথিভুক্ত সূচনা পাওয়া যায়। জ্যামিতির প্রাচীনতম পাঠ্যগুলি হল মিশরীয় রিন্ড প্যাপিরাস (২০০০ খ্রিস্টপূর্ব ),মস্কো প্যাপিরাস (c. ১৮৯০ খ্রিস্টপূর্ব ), এবং ব্যাবিলনীয় মাটির ট্যাবলেট, যেমন Plimpton ৩২২ (১৯০০ খ্রিস্টপূর্ব )। মস্কো প্যাপিরাস ছোট পিরামিড বা ফ্রাস্টামের আয়তন গণনার জন্য একটি সূত্র দেয়।[২] মাটির ট্যাবলেটগুলি (৩৫০-৫০ খ্রিস্টপূর্ব ) দেখায় যে ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সময়-বেগ স্থানের মধ্যে বৃহস্পতির অবস্থান এবং গতি গণনা করার জন্য ট্র্যাপিজয়েড পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন।

প্রাচীন গ্রিসের জ্যামিতি[সম্পাদনা]

একজন গ্রীক মহিলা জ্যামিতি শিক্ষা দিচ্ছে

ইতিহাসের সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ জ্যামিতিবিদ হিসেবে যার নাম পাওয়া যায়, তিনি হলেন মিলেতুসের থালেস। থালেস ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে গ্রিসে বাস করতেন। থালেসকে অনেকগুলি সরল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উপপাদ্যের জনক হিসেবে গণ্য করা হয়; এদের মধ্যে অন্যতম হল অর্ধবৃত্তস্থিত কোণ যে সমকোণ, তার প্রমাণ।

থালেসই প্রথম দেখান যে কতগুলি সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত বিবৃতি তথা স্বতঃসিদ্ধ থেকে যৌক্তিকভাবে অগ্রসর হয়ে একটি জ্যামিতিক সত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। এই স্বতঃসিদ্ধগুলিকে থালেস ও তার পরবর্তী গ্রিক জ্যামিতিবিদেরা স্ব-প্রমাণিত সত্য বলে মনে করতেন। তবে আধুনিক গাণিতিক চিন্তাধারায় এগুলিকে কতগুলি সুবিধাজনক কিন্তু যথেচ্ছ অনুমান বলে গণ্য করা হয়। থালেসের এই আরোহী পদ্ধতির ধারণা সমস্ত জ্যামিতিক গবেষণায়, এমনকি সমস্ত গাণিতিক গবেষণায় বর্তমান কাল পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করেছে।

থালেসের এক বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন পিথাগোরাস। পিথাগোরাস ও তার সহযোগীরা ত্রিভুজ, বৃত্ত, অনুপাত, ও কিছু কিছু ঘনবস্তুর জন্য অনেক নতুন নতুন উপপাদ্য প্রমাণ করেন। পিথাগোরাসের সবচেয়ে বিখ্যাত উপপাদ্যটি বর্তমানে তার নামে নামান্বিত এবং বলে যে, সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের বর্গ বাকি বাহুদ্বয়ের বর্গের যোগফলের সমষ্টি।

গ্রিকদের প্রস্তাবিত ও স্বীক্রৃত স্বতঃসিদ্ধগুলি ছিল এই জাতীয়: “দুইটি বিন্দুর মধ্যবর্তী ক্ষুদ্রতম পথ সরলরেখা।” এই ধরনের স্বতঃসিদ্ধ থেকে বিন্দু, রেখা, কোণ, বক্ররেখা ও তলসমূহ সম্পর্কে বিভিন্ন উপপাদ্যে যৌক্তিকভাবে উপনীত হওয়া যেত। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে ইউক্লিডই সর্বপ্রথম বিভিন্ন ছড়িয়ে থাকা উপপাদ্য ও স্বতঃসিদ্ধগুলি একটি সমন্বিত ব্যবস্থার অধীনে এনে তার Elements গ্রন্থতে প্রকাশ করেন। ১৩টি পার্চমেন্ট রোল বা পুস্তকে লেখা এই গ্রন্থ মানবমনের চরম উৎকর্ষের একটি নিদর্শন। প্রকাশের প্রায় ১০০০ বছর গণিতবিদের এগুলোতে সামান্যই কোন গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন যোগ করতে পেরেছিলেন। বিংশ শতাব্দীতেও জ্যামিতির প্রাথমিক পাঠ্য হিসেবে ইউক্লিডের বইটি অবিকৃতভাবে ব্যবহার করা হত। ইউক্লিডের কাজের গুরুত্ব তার ফলাফলে নয়, বরং তার পদ্ধতিতে। তার প্রমাণিত বেশির ভাগ উপপাদ্যই বহু বছর আগেই জানা ছিল, কিন্তু তার আগে কেউই দেখাতে পারেনি যে এগুলি সব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত এবং সামান্য কিছু প্রাথমিক স্বতদঃসিদ্ধ থেকে এগুলিতে উপনীত হওয়া সম্ভব। ইউক্লিড এভাবে তার কাজের মাধ্যমে আরোহী পদ্ধতির গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন।

গ্রিকরা কেবল রুলার ও কাঁটা-কম্পাস ব্যবহার করে জ্যামিতিক চিত্র আঁকার সমস্যা (সমপাদ্য) উদ্ভাবন করেছিল। সরল সমস্যাগুলির মধ্যে আছে কোন প্রদত্ত রেখাংশের দ্বিগুণ দৈর্ঘ্যের রেখাংশ আঁকা, কোন একটি কোণকে সমদ্বিখণ্ডিত করা, ইত্যাদি। গ্রিকদের এ সংক্রান্ত তিনটি বিখ্যাত সমস্যা বহু বছর ধরে গণিতবিদেরা সমাধান করতে পারেন নি: প্রদত্ত ঘনকের দ্বিগুণ আয়তনের ঘনক আঁকা, প্রদত্ত বৃত্তের ক্ষেত্রফলের সমান ক্ষেত্রফলের বর্গ আঁকা, এবং একটি কোণকে সমত্রিখণ্ডিত করা। এগুলির কোনটিই রুলার ও কাঁটাকম্পাসের সাহায্য নিয়ে আঁকা সম্ভব নয়। এদের মধ্যে বৃত্তের বর্গীকরণের অসম্ভাব্যতা ১৮৮২ সালের আগে প্রমাণিত হয়নি।

গ্রিক গণিতবিদ পের্গার আপোল্লনিয়ুস কনিক ছেদগুলি নিয়ে গবেষণা করেন এবং এগুলির অনেক মৌলিক ধর্ম খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দেই আবিষ্কার করেন। কনিকগুলি ভৌত বিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রে কাজে আসে। যেমন যেকোন খ-বস্তুর কক্ষপথ, যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এমন গ্রহ বা ধূমকেতুর গতিপথ সবসময় কোন এক ধরনের কনিকের উপর অবস্থান করে। ক্রৃত্রিম উপগ্রহগুলিও পৃথিবীকে উপবৃত্তাকার পথে প্রদক্ষিণ করে।

মহান গ্রিক বিজ্ঞানী আর্কিমিদিস খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে জ্যামিতিতে অনেকগুলি অবদান রাখেন। তিনি অনেকগুলি বক্ররেখাবদ্ধ আকৃতির ক্ষেত্রফল এবং বক্রতলাবদ্ধ ঘনবস্তুর, যেমন সিলিন্ডারের পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল ও আয়তন নির্ণয় করার সূত্র বের করেন। এছাড়াও পাই-এর আসন্ন মান নির্ণয়ের একটি পদ্ধতি বের করেন এবং বলেন যে এই মান ৩ ১০/৭০ ও ৩ ১০/৭১ এর মধ্যবর্তী।

মধ্যযুগে জ্যামিতি[সম্পাদনা]

১৫শতকে জ্যামিতিচর্চা, একজন আরব ও একজন ইউরোপীয়ান জ্যামিতি গবেষণা করছে

৫ম শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৫শ শতক পর্যন্ত ইউরোপে জ্যামিতির তেমন উন্নতিসাধন হয়নি।এসময় ইউরোপ অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে এবং উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানেরা এবং ভারতের হিন্দুরা জ্যামিতির বেশির ভাগ উন্নতি সাধন করেন।গ্রিক গণিতের বেশির ভাগই ছড়িয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। তবে এদের কিছু কিছু, যেমন ইউক্লিডের এলিমেন্টস মুসলমান ও হিন্দুরা অনুবাদ করে সংরক্ষণ করেন ও অধ্যয়ন করেন।

ভারতীয় গণিতবিদরাও জ্যামিতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। শতপথ ব্রাহ্মণ (খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক) ও সুল্ব সূত্রে জ্যামিতিক নির্মাণের নিয়ম রয়েছে।সুলবা সূত্রে,পিথাগোরিয়ান থিওরেমের প্রাচীনতম বিদ্যমান মৌখিক অভিব্যক্তি রয়েছে।[৩] তারা পিথাগোরিয়ান ট্রিপলের তালিকা তৈরি করে, যেগুলো মূলত ডায়োফ্যান্টাইন সমীকরণ।[৪]

আর্যভট্টের “আর্যভটিয়া”(৪৯৯), ক্ষেত্র এবং আয়তনের গণনা অন্তর্ভুক্ত করে। ৬ষ্ঠ শতকের ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট্ট সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের ক্ষেত্রফলের সূত্র পুনরাবিষ্কার করেন। এছাড়াও তিনি পাই-এর অত্যন্ত সঠিক মানের একটি সূত্র দান করেন; তিনি পাই-এর মান ধরেন ৬২৮৩২/২০০০০, বা ৩.১৪১৬, যা দশমিকের পর চার ঘর পর্যন্ত পাইয়ের সঠিক মান।

ব্রহ্মগুপ্ত তার জ্যোতির্বিদ্যা রচনা ”ব্রহ্মস্ফটসিদ্ধান্ত” লিখেছিলেন ৬২৮সালে যা ১২অধ্যায়, ৬৬টি সংস্কৃত শ্লোক সম্বলিত। এতে চক্রীয় চতুর্ভুজের কর্ণ,চক্রীয় চতুর্ভুজের ক্ষেত্রফলের সূত্র (হেরনের সূত্রের একটি সাধারণীকরণ), মূলদ ত্রিভুজের সম্পূর্ণ বিবরণ অন্তর্ভুক্ত আছে।[৫] ৪র্থ ও ১৩শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে জ্যামিতির জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ত্রিকোণমিতি শাস্ত্রের উন্নতি সাধন করা হয়।

আল-মাহানি (৮৫৩) জ্যামিতিক সমস্যা যেমন বীজগণিতের সমস্যাগুলির সাথে ঘনকের প্রতিলিপি করার ধারণাটি কল্পনা করেছিলেন।[৬] থাবিত ইবনে কুররা (ল্যাটিনে থিবিট নামে পরিচিত) (৮৩৬-৭০১) জ্যামিতিক পরিমাণের অনুপাতের উপর পাটিগণিতিক ক্রিয়াকলাপ প্রয়োগ নিয়ে কাজ করেছিলেন এবং বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতির বিকাশে অবদান রেখেছিলেন।[৭] ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১) ঘন সমীকরণের জ্যামিতিক সমাধান খুঁজে পান। [৮]

১২শ ও ১৩শ শতকে ইউক্লিডের এলিমেন্টস গ্রিক ও আরবি থেকে লাতিনে ও আধুনিক ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয় এবং ধর্মীয় শিক্ষালয়ে জ্যামিতি শিক্ষা যোগ করা হয়।

১৭শ ও ১৮শ শতকের জ্যামিতি[সম্পাদনা]

ফরাসি দার্শনিক ও গণিতবিদ রেনে দেকার্তে জ্যামিতিকে সামনের দিকে এগিয়ে দেন। ১৬৩৭ সালে তার প্রভাবশালী রচনা Discourse on Method প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার সাহায্যে জ্যামিতিক আকৃতি প্রকাশের পদ্ধতি উপস্থাপন করেন। তার কাজ জ্যামিতি ও বীজগণিতের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। এই যোগসূত্রই বিশ্লেষণী জ্যামিতি এবং আধুনিক জ্যামিতির ভিত্তি।

১৭শ শতকের জ্যামিতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল অভিক্ষেপী জ্যামিতির উদ্ভাবন। অভিক্ষেপী জ্যামিতিতে কোন জ্যামিতিক বস্তুর এক তল থেকে আরেক তলে অভিক্ষেপ ফেললে এর ধর্মের কী পরিবর্তন ঘটে তা নিয়ে গবেষণা করা হয়। জেরার দ্যজার্গ নামের এক ফরাসি প্রকৌশলী perspective নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অভিক্ষেপী জ্যামিতি উদ্ভাবন করেন। ১৮শ শতকে গাসপার মোঁজ নামের ফরাসি এক গণিতের অধ্যাপক বিবরণমূলক জ্যামিতি নামে জ্যামিতির আরেকটি শাখা উদ্ভাবন করেন। বিবরণমূলক জ্যামিতিতে দ্বি-মাত্রিক চিত্রের সাহায্যে ত্রিমাত্রিক বস্তুসমূহকে কীভাবে ত্রুটিহীনভাবে উপস্থাপন করা যায় এবং এর সাহায্যে কীভাবে ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির নানা সমস্যা সমাধান করা যায়, তার আলোচনা করা হয়। প্রকৌশলস্থাপত্যের অঙ্কনের ভিত্তি হল এই বিবরণমূলক জ্যামিতি।

আধুনিক জ্যামিতি[সম্পাদনা]

ইউক্লিডীয় জ্যামিতির কাঠামোর ভেতরেই বিশ্লেষণী, অভিক্ষেপী ও বিবরণমূলক জ্যামিতির আবর্ভাব ঘটে। বহু শতাব্দী ধরে গণিতবিদেরা বিশ্বাস করতেন যে অনন্য সমান্তরাল রেখা সংক্রান্ত ইউক্লিডের পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটি বাকী চারটি স্বতঃসিদ্ধ থেকে প্রমাণ করা যাবে, কিন্তু এই প্রমাণ বের করার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু ১৯শ শতকে এসে নতুন নতুন জ্যামিতিক ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা হয় যেগুলিতে ইউক্লিডের পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটিকে অন্য কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। এইসব নতুন ধরনের অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দেন কার্ল ফ্রিড্‌রিশ গাউস, ইয়ানোশ বলিয়ই, নিকলাই লবাচেভ্‌‌স্কি এবং গেয়র্গ ফ্রিড্‌রিশ বের্নহার্ট রিমান

১৮৭২ সালে জার্মান গণিতবিদ ফেলিক্স ক্লাইন গণিতের একটি অপেক্ষাকৃত নবীন শাখা গ্রুপ তত্ত্ব ব্যবহার করে তার সময়কার সমস্ত জ্যামিতিক ব্যবস্থাগুলিকে এক ব্যবস্থার অধীনে আনেন। ১৮৯৯ সালে আরেকজন জার্মান গণিতবিদ ডাভিড হিলবের্ট তার Foundations of Geometry বইটি প্রকাশ করেন, যাতে ইউক্লিডীয় জ্যামিতির জন্য স্বতঃসিদ্ধসমূহের একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা প্রদান করা হয় এবং এটি গণিতের অন্যান্য শাখায় গভীর প্রভাব ফেলে।

১৯১৬ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে দেখা যায় অনেক ভৌত ঘটনা জ্যামিতিক মূলনীতি থেকে উপনীত হওয়া সম্ভব। এই তত্ত্বের সাফল্য অন্তরক জ্যামিতি ও টপোগণিতের গবেষণায় জোয়ার আনে।

১৯শ শতকের ব্রিটিশ গণিতবিদ আর্থার কেলি চার বা তারও বেশি মাত্রার জ্যামিতি প্রবর্তন করেন। ১৯শ শতকে ফ্র্যাক্টাল মাত্রার আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭০-এর দশকে ফ্র্যাক্টালের ধারণা কাজে লাগিয়ে জ্যামিতির নতুন শাখা ফ্র্যাক্টাল জ্যামিতির উদ্ভব হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Vincenzo De Risi (৩১ জানুয়ারি ২০১৫)। Mathematizing Space: The Objects of Geometry from Antiquity to the Early Modern Age। Birkhäuser। পৃষ্ঠা 1–। আইএসবিএন 978-3-319-12102-4 
  2. Boyer, C.B. (1991) [1989]. A History of Mathematics (Second edition, revised by Uta C. Merzbach ed.). New York: Wiley. ISBN 978-0-471-54397-8.Egypt" p. 19
  3. Staal, Frits (1999). "Greek and Vedic Geometry". Journal of Indian Philosophy. 27 (1–2): 105–127. doi:10.1023/A:1004364417713. S2CID 170894641.
  4. (Cooke 2005, p. 198): "The arithmetic content of the Śulva Sūtras consists of rules for finding Pythagorean triples such as (3, 4, 5), (5, 12, 13), (8, 15, 17), and (12, 35, 37). It is not certain what practical use these arithmetic rules had. The best conjecture is that they were part of religious ritual. A Hindu home was required to have three fires burning at three different altars. The three altars were to be of different shapes, but all three were to have the same area. These conditions led to certain "Diophantine" problems, a particular case of which is the generation of Pythagorean triples, so as to make one square integer equal to the sum of two others."
  5. Hayashi, Takao (2003). "Indian Mathematics". In Grattan-Guinness, Ivor (ed.). Companion Encyclopedia of the History and Philosophy of the Mathematical Sciences. Vol. 1. Baltimore, MD: The Johns Hopkins University Press. pp. 118–130. ISBN 978-0-8018-7396-6.
  6. O'Connor, John J.; Robertson, Edmund F. "Al-Mahani". MacTutor History of Mathematics Archive. University of St Andrews.
  7. O'Connor, John J.; Robertson, Edmund F. "Al-Sabi Thabit ibn Qurra al-Harrani". MacTutor History of Mathematics Archive. University of St Andrews.
  8. O'Connor, John J.; Robertson, Edmund F. "Omar Khayyam". MacTutor History of Mathematics Archive. University of St Andrews.