হুদুড় দুর্গা
মহিষাসুর জয়ন্তী | |
---|---|
পালনকারী | অসুর, সাঁওতাল এবং অন্যান্য আদিবাসী উপজাতি |
তারিখ | দুর্গা পূজাকে ঘিরে উদযাপিত হয় |
সম্পর্কিত | দুর্গা পূজা এবং নবরাত্রি |
হুদুর দুর্গা হল খেরওয়াল সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উপাস্য দেবতা, যাকে সাঁওতালরা হিন্দুধর্মের মহিষাসুর বলে দাবি করে থাকে।[১] সাঁওতালরা হিন্দুধর্মের দেবী দুর্গাকে খলনায়িকা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে এবং এর বিপরীতে তারা মহিষাসুরপূজা করে থাকে।[১][২] অধিকাংশের মতে, এটি সম্পূর্ণ রুপেই গল্পকথা এবং এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, তাদের মতে, হুদুর দুর্গার গল্প আদতে রাজনৈতিক মদতপুষ্ট এবং দেবপক্ষ ও অসুরপক্ষের সংগ্রামকে আর্য ও অনার্য দ্বন্দ্ব বলে দাগিয়ে দেওয়ার একটি ভিত্তিহীন প্রয়াস।[৩] এই বর্ননার বিরোধীগণ এই বিষয়টিকে মূলনিবাসী তত্ত্ব ও এই ঘটনার সমর্থনকারী, বিশেষ করে এ ঘটনার সমর্থনকারী সাঁওতালদের মূলনিবাসীতাত্ত্বিক বলে অভিহিত করে থাকে।
২০১৩ সালের ১৭ই অক্টোবর দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ক্যাম্পাসের এসএসএস-১ প্রেক্ষাগৃহে "মহিষাসুর শাহাদাত দিবস" পালন করেন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধ মত হিসেবে এটিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়।[৪] অল ইন্ডিয়া ব্যাকওয়ার্ড স্টুডেন্টস ফোরাম অনুষ্ঠানটির আহ্বায়ক ছিল এবং এই অনুস্থানে দেবী দুর্গাকে গনিকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানি ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সালে সংসদে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।[৫] অধিকাংশ বিশ্লেষকদের মতে, দাসাই নৃত্য হল সম্পূর্ণরূপে কৃষিভিত্তিক পর্ব ও প্রকৃতিবন্দনার উৎসব এবং ইদানিং এটিকে হুদুড় দুর্গার কাহিনীর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের মতে, হুদুড় দুর্গা আসলে সাম্প্রতিককালের একটি অর্বাচীনতত্ত্ব এবং আদিবাসী অঞ্চলে যাঁরা দীর্ঘদিন ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছেন, সেইসব বিশেষজ্ঞরাও এই তত্বকে অস্বীকার করেছেন বলে তারা দাবি করেন।[৬][৭]
একটি পক্ষের মতে, সাম্প্রতিককালে অর্থাৎ ২০১০ এর দশকে কিছু বাম রাজনৈতিক দল হুদুর দুর্গার ভ্রান্ত তত্বকে কাজে লাগিয়ে হিন্দুধর্মের দেবী দুর্গাকে গণিকা প্রমাণে উদ্যোগী হয়েছে।
শব্দতত্ত্ব
[সম্পাদনা]এক শ্রেণীর মতে, হুদুর শব্দটির অর্থ বজ্র। আর দুর্গা শব্দটির অর্থ রক্ষক। শব্দটির সমন্বিত অর্থ হল বজ্রকঠিন দুর্গরক্ষক।[৮] আরেক শ্রেণীর মতে, হুদুড় বা হুডুর শব্দটির প্রকৃত অর্থ মেঘ। তাদের মতে, দাসাই উৎসবের গানে আদতে প্রকৃতি দেবীরই বন্দনা করা হয়েছে এবং এই হুদুর দুর্গা শব্দটির প্রকৃতপক্ষে কোন অস্তিত্বই নেই। সাঁওতাল বুদ্ধিজীবী বিবেকানন্দ সোরেনের মতে, “দাঁশায়” অর্থ- দা: + আঁশ + আয়, (কারো কারো মতে দা: + সাঁওহায়) “ইতিহাসের খোঁজে নয় জলের আশায় প্রকৃতি দেবীকে পুজা করাই দাঁশায়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল”। আর হুদুড় বা হুডুর শব্দটা মেঘের সাথে তুলনা করা হয়েছে। হুডুর বিজলী, হুদুড় হুদুড় হয় ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।[৯]
দাঁশায় উৎসবের প্রথম গানটার মূল অর্থ হল - “প্রচন্ড অনাবৃষ্টির ফলে দেশ দিশম জ্বলে পুড়ে যায়, হে ঠাকুর বৃষ্টি দাও”। এখানে কৃষিজীবী মানুষের করুণ আর্তি বোঝাতে “হায় হায়” শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে এবং এর সাথে মহিষাসুরের শহীদ-স্মরণের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। ভারতের আদিকালে যত ধর্মীয় উৎসব, তার প্রত্যেকটাই কৃষির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত।[১০]
উপকথা
[সম্পাদনা]ভারতের ঝাড়খণ্ডের খেরওয়াল সাঁওতাল ও অসুর নামক আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতে, হুদুর দুর্গা ছিলেন তাদের সহস্র বছরের পুরনো পূর্বপুরুষ, চাইচাম্পা নামক গ্রামের রাজা। তিনি অত্যন্ত বলশালী ও ক্ষমতাধর রাজা ছিলেন। আর্যরা ভারতে আসার পর কোনমতেই তাকে পরাজিত করতে পারছিল না। তখন তারা বিভিন্নভাবে রাজাকে মারার উপায় ভাবতে লাগল। তারা জানতে পারল রাজা অত্যন্ত নারীবৎসল এবং তাদের সমাজেও নারীদের অত্যন্ত উঁচু চোখে দেখা হয়। তাই আর্যগণ রাজাকে হত্যা করার জন্য গুপ্তচর হিসেবে এক গৌরবর্ণের রূপবতী নারীকে পাঠাল, কোন কোন বর্ণনামতে, উক্ত নারী গণিকা পেশাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত ছিল। আর্যগণ রাজার কাছে উক্ত নারীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিল এবং রাজাও নারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হলেন। বিয়ের পর নয়দিন রাজা উক্ত নারীর সাথে রাত্রি যাপন করেন এবং নবম দিনে উক্ত নারী রাজাকে হত্যা করে। রাজার মৃত্যুর খবর শুনে আর্যগণ রাজ্য দখলের উদ্দেশ্যে রাজ্যে আক্রমণ করে এবং রাজ্যের পুরুষগণ তাদের ধর্মগুরুর পরামর্শ অনুসারে সরস্বতী নদীতে স্নান করে নারীদের বেশ ধারণ করে দাসাই নৃত্য করতে করতে রাজ্য থেকে পালিয়ে যায়। উক্ত ঘটনার নারীকেই আর্যগণ বা হিন্দুগণ দেবী দুর্গা হিসেবে এবং রাজাকে মহিষাসুর হিসেবে অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করে তাদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ করেছে বলে সাঁওতালগণ দাবি করে থাকে, এবং তাদের আরও দাবি তাদের রাজা হুদুর দুর্গার নামই উক্ত নারীর নাম হিসেবে ভুলভাবে বর্ণিত হয়েছে। দুর্গাপূজার সময় তারা দুর্গাকে পূজা না করে মহিষাসুর পূজা করে থাকে এবং নারীদের বেশ ধরে পথে পথে দাসাই নৃত্য করে শোক পালন করে থাকে।[১১][১২][১৩] আর অনেকের দাবিমতে, উক্ত নারী গণিকা হওয়ার কারণে হিন্দুগণ দুর্গা পূজায় দুর্গার প্রতিমা তৈরি করতে গোমুত্র, গঙ্গাজল, গোবরের সঙ্গে গণিকালয়ের (পতিতালয়ের) মাটি ব্যবহার করে।
দাসাই উৎসবের মূল গীতি এবং তার অর্থ:
হায়রে হায়রে
অকয় যাপে জুঁডিয়াদা দেশ দ
অকয় যাপে আতার আদা দিশম দ
দেশ দরে ল-লাটিচ এন দ
দিশম দরে হাসায় ডিগিরেন
ঠাকুর গেচয় জুঁডিয়াদা দেশ দ
ঠাকুর গেচয় আতার আদা দিশম দ
হায়রে হায়রে
দেশ দরে ল-লাটিচ এন দ
দিশম দরে হাসায় ডিগিরেন
দেশে ঠাকুর জৗডি মেসে দা: দ
দেশে ঠাকুর জারগে মেসে জাপুদ দ
দেশ দরে ল-লাটিচ এন দ
দিশম দরে হাসায় ডিগিরেন।
- অর্থ - “প্রচন্ড অনাবৃষ্টির ফলে দেশ দিশম জ্বলে পুড়ে যায়, হে ঠাকুর বৃষ্টি দাও” - এটাই মূল কথা, কৃষিজীবী মানুষের করুণ আর্তি বোঝাতে “হায় হায়” শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে।[৭]
হায়রে হায়রে
অকয় যাপে জুঁডিয়াদা হায়রে হায
সিঞবির দ ল: কান দ হায়রে হায
মানবির দ হাসায় ডিগিরেন
দেসে ছিতৗ দেসে কৗপরা হায়রে হায
জারগে দা: দ নতে বিন হায়রে হায
তারসে রাকাব, তারসে নাড়গ হায়রে হায়
সিঞবির দ ল: কা দ হায়রে হায়
মানবির দ ল: কান দ হায়রে হায়।
- অর্থ - অনাবৃষ্টির ফলে মানভূমের জঙ্গল এবং সিনভূমের জঙ্গলও যেন জ্বলে পুড়ে গেল। ছিতা- কাপরা (ছিতা ও কাপরা জাহের দেবীদের অন্যতম দুই দেবী) বৃষ্টি দাও | [৭]
হায়রে হায়রে দিবি দুর্গা দয় ওডোক এনা রে
আয়নম কাজল দকিন বাহের এনা রে
হায়রে হায়রে চেতে লাগিদ দয় ওডোক এনা রে
চেতে লাগিদ দ কিন বাহের এনা রে
হায়রে হায়রে দেশ লাগিদ দয় ওডোক এনা রে
দিশম লাগিদ দ কিন বাহের এনা রে
হায়রে হায়রে সুনুম সিঁদুর লাগিদ ওডোক এনা রে
বাহা টুসৗ লাগিদ দ কিন বাহের এনা রে
হায়রে হায়রে দেলা সে দিবি দুর্গা হয় লেকাতে
দেলাসে আয়নম কাজল বার্ডু লেকাতে
হায়রে হায়রে অটাং হিজু পেসে সেরমা সাগিন খন
ঘুরলাউ হিজু: পেসে সরগ পুরী খন
বঠেল বঠেল সেকরেজ সেকরেজ।
- অর্থ - অর্থাৎ, দেবী দুর্গা বাহির হলো, আয়নম, কাজল (আয়নম ও কাজল দেবীর সহচর, লক্ষ্মী, সরস্বতীর প্রতিরূপ ও বলা যেতে পারে) বাইরে এল, দেশের জন্য, দিশমের জন্য এবং সিঁদুর-তেল-পুস্পের জন্য। অর্থাৎ পুজা পাবার জন্য এরা বাহির হলো, এসো দুর্গা বাতাস হয়ে, এসো আয়নম কাজল ঘুর্ণি হয়ে সুদূর মহাকাশের স্বর্গপুরী থেকে। এটা দেবী আবাহনও বলা যেতে পারে। এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে দেবী বন্দনা বা পুজো করার ফলে ভালো বৃষ্টি হয়েছিল- তাই “বঠেল বঠেল” আনন্দসূচক ধ্বনি প্রয়োগ হয়েছে। [৩] [৭]
বিতর্ক
[সম্পাদনা]অনেকের মতে, প্রকৃতপক্ষে 'সাঁওতাল' এবং 'অসুর' দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং এক্ষেত্রে এক গোষ্ঠীর উপকথা অন্য গোষ্ঠীর মিথে সাথে মিশিয়ে যে উদ্ভট কল্পনার সৃষ্টি করা হয়েছে তা যুক্তিযুক্ত নয়। পুরাণ অনুসারে 'মহিষাসুরের পিতা রম্ভাসুর ছিলেন কশ্যপ-পত্নী দনুর সন্তান। কশ্যপ ঋষি ছিলেন ব্রহ্মাপুত্র মরীচির পুত্র এবং তাঁর পত্নী দানব কুলজননী দনু হলেন ব্রহ্মানন্দন প্রজাপতি দক্ষের তনয়া। ফলে উক্ত দাবীকৃতদের মতে, পুরান অনুসারে মহিষাসুরের শরীরে ছিল ব্রাহ্মণ্য রক্ত এবং মহিষাসুর ও দুর্গার লড়াইকে আর্য ও অনার্য দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখাতে গিয়ে এখানে এক বিকৃত উপকথার সৃষ্টি করা হয়েছে।[৩]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ "দুর্গাপূজার সময়ে যেভাবে শোক পালন করেন 'মহিষাসুরের বংশধরেরা'"। বিবিসি বাংলা। ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০২১।
- ↑ "Not Durga Puja! It's Mahishasura's martyrdom that these tribals observe"। The New Indian Express (ইংরেজি ভাষায়)। ৮ অক্টোবর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০২১।
- ↑ ক খ গ "অসুরপূজা নিয়ে ঘোর বিতর্ক; দুর্গা-মহিষ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কী কী বলে আবহমান সংস্কৃতি?"।
- ↑ "Mahishasur Day observed at JNU"।
- ↑ "Cited Durga, Mahishasur to explain the truth: Smriti Irani to Oppn"।
- ↑ Prohor। "অসুরপূজা নিয়ে ঘোর বিতর্ক; দুর্গা-মহিষ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কী কী বলে আবহমান সংস্কৃতি? - Prohor"। অসুরপূজা নিয়ে ঘোর বিতর্ক; দুর্গা-মহিষ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কী কী বলে আবহমান সংস্কৃতি? - Prohor (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৫-১৫।
- ↑ ক খ গ ঘ "সাঁওতাল সম্প্রদায়ের "দাঁশায়" উৎসব এবং দুর্গা পূজা"।
- ↑ "Descendant of Mahishasur to inaugurate puja at an east Kolkata pandal"। The Times Of India (ইংরেজি ভাষায়)। ৩ অক্টোবর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০২১।
- ↑ "সাঁওতাল সম্প্রদায়ের "দাঁশায়" উৎসব এবং দুর্গা পূজা"।
- ↑ "সাঁওতাল সম্প্রদায়ের "দাঁশায়" উৎসব এবং দুর্গা পূজা"।
- ↑ "Myth against myth"। Dhaka Tribune (ইংরেজি ভাষায়)। ২ অক্টোবর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০২১।
- ↑ "For The Asurs of Bengal, Durga Puja Is The Time To Celebrate The 'Demon God' Durga Slayed"। ScoopWhoop (ইংরেজি ভাষায়)। ৭ অক্টোবর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০২১।
- ↑ Chattopadhyay, Arunava (সেপ্টেম্বর ২০১৮)। DURGA: Ekti Obolokon। Atmajaa Publishers। পৃষ্ঠা ৪৮, ৪৯। সংগ্রহের তারিখ ১৭ মার্চ ২০২১।