বিষয়বস্তুতে চলুন

মহাবিশ্ব

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(ব্রহ্মাণ্ড থেকে পুনর্নির্দেশিত)
মহাবিশ্ব বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড
হাবল আল্ট্রা-ডিপ ফিল্ড চিত্রটি বর্তমান প্রযুক্তির কাছে দৃশ্যমান কিছু দূরবর্তী ছায়াপথ দেখায় (তির্যক ~১/১০ আপাত চাঁদের ব্যাস)[]
বয়স (Λসিপিএম মডেল মতে)১৩.৭৮৭ ± ০.০২০ বিলিয়ন বছর[]
ব্যাসঅজানা[]
পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব: ৮.৮×১০২৬ মি (28.5 Gpc or 93 Gly)[]
ভর (সাধারণ বস্তু)অন্তত ১০৫৩ কিg[]
গড় ঘনত্ব (শক্তি সহ)৯.৯×১০−২৭ kg/m3[]
গড় তাপমাত্রা২.৭২৫৪৮ K
(−২৭০.৪ °সে, −৪৫৪.৮ °ফা)[]
প্রধান বিষয়বস্তু সাধারণ (ব্যারিয়নিক) পদার্থ (৪.৯%)
তমোপদার্থ (২৬.৮%)
তমোশক্তি (৬৮.৩%)[]
আকৃতি০.৪% ত্রুটি প্রান্তসহ সমতল[]

মহাবিশ্ব বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হলো অসীম স্থানকাল (spacetime) এবং তাতে যা কিছু আছে তার সবকিছুর সম্মিলিত রূপ। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত যেকোনো ধরনের অস্তিত্ব, মৌলিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া, ভৌত প্রক্রিয়া, ভৌত ধ্রুবক এবং সেগুলো যেসব কাঠামো তৈরি করে, যেমন- অতিপারমাণবিক কণা থেকে শুরু করে বিশাল ছায়াপথ। প্রচলিত বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রায় ১৩.৭৮৭±০.০২০ বিলিয়ন বছর আগে স্থানকালের উদ্ভব হয় এবং তখন থেকেই মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে থাকে। আজ যতটুকু পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, তার ব্যাস প্রায় ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ, তবে মহাবিশ্বের পুরো আকার (যদি থেকে থাকে) সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ।

মহাবিশ্ব সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারণাগুলো এসেছিল প্রাচীন গ্রিক এবং ভারতীয় দার্শনিকদের থেকে। তাদের মহাজাগতিক মডেলগুলোতে পৃথিবীকে কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে সূক্ষ্ম জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের ফলে নিকোলাস কোপারনিকাস সূর্যকেন্দ্রিক মডেল তৈরি করেন যেখানে সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত। বিশ্বজনীন মহাকর্ষ সূত্র প্রতিষ্ঠা করার সময় আইজ্যাক নিউটন কোপারনিকাসের কাজের উপর ভিত্তি করেই এগিয়েছিলেন, যেমন করেছিলেন জোহানেস কেপলারের গ্রহের গতির সূত্র এবং টাইকো ব্রাহের পর্যবেক্ষণগুলোর উপর।

আরও উন্নত পর্যবেক্ষণের ফলে জানা যায়, সূর্য আকাশগঙ্গার কয়েকশো বিলিয়ন তারার মধ্যে একটি মাত্র, এবং পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে আকাশগঙ্গার মতোই আরও কয়েকশো বিলিয়ন ছায়াপথ রয়েছে। একটি গ্যালাক্সির অধিকাংশ তারাই গ্রহসমূহ ধারণ করে। মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় স্কেলে, গ্যালাক্সিগুলি সুষমভাবে ও সকল দিকে সমানভাবে বিতরণ করা হয়েছে। এর অর্থ মহাবিশ্বের কোনো কিনারা বা কেন্দ্র নেই। ছোট স্কেলে গ্যালাক্সিগুলি ক্লাস্টার এবং সুপারক্লাস্টারে বিন্যস্ত যা মহাশূন্যতে বিশাল ফিলামেন্ট আর শূন্যতা তৈরি করে ফেনার মত বিশাল কাঠামো তৈরি করে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের আবিষ্কারগুলি থেকে জানা যায় যে মহাবিশ্বের একটি শুরু ছিল এবং এর প্রসারণ সেই সময় থেকে হচ্ছে।

বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী, মূলত যে শক্তি এবং পদার্থ উপস্থিত ছিল তা মহাবিশ্বের প্রসারণের সাথে সাথে কম ঘন হয়ে এসেছে। মাত্র ১০^-৩২ সেকেন্ডের মধ্যে মহাবিশ্বের ত্বরিত প্রসারণ (যাকে inflationary epoch বলা হয়), এরপর চারটি মৌলিক শক্তি পৃথক হয়ে যাওয়ার পর মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে এবং প্রসারিত হতে থাকে। এর ফলে প্রথম উপ-পারমাণবিক কণা এবং সাধারণ পরমাণু তৈরি হতে শুরু করে। হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের বিশাল মেঘ ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে সেইসব স্থানে প্রথম গ্যালাক্সি, তারা এবং বর্তমানে আমরা যা যা দেখি তৈরি করে।

পদার্থ এবং আলোর উপর মহাকর্ষের প্রভাব পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, মহাবিশ্বে দৃশ্যমান বস্তুর চেয়ে অনেক বেশি পদার্থ রয়েছে; তারা, ছায়াপথ, নীহারিকা (nebulas) এবং আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস ইত্যাদি। এই অদৃশ্য পদার্থকে বলা হয় ডার্ক ম্যাটার (ডার্ক বলতে বোঝায় এর সম্পর্কে আমাদের পরোক্ষ প্রমাণ আছে কিন্তু সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি)। এই ডার্ক ম্যাটার সৃষ্টি হয় বাকি মহাবিশ্বের সাথে সাথেই, এবং ফিলামেন্ট ও শূন্যতার ফেনার মত কাঠামো তৈরি করে অন্যান্য পদার্থকে দৃশ্যমান কাঠামো গঠন করতে সহায়তা করে। ΛCDM মডেল হলো বর্তমানে মহাবিশ্বের সবচেয়ে স্বীকৃত মডেল। এটি বলে যে মহাবিশ্বের প্রায় 69.2%±1.2% ভর-শক্তি হলো ডার্ক এনার্জি, যা মহাবিশ্বের ত্বরিত প্রসারণের জন্য দায়ী এবং প্রায় 25.8%±1.1% হলো ডার্ক ম্যাটার। সাধারণ ('ব্যারিওনিক') পদার্থ মহাবিশ্বের মাত্র4.84%±0.1%। তারা, গ্রহ এবং দৃশ্যমান গ্যাস মেঘ সাধারণ পদার্থের প্রায় 6% গঠন করে।

মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অনুমান রয়েছে এবং বলা হয় বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল। অনেক পদার্থবিজ্ঞানী ও দার্শনিক এসব বিষয়ে জল্পনা-কল্পনা থেকে বিরত থাকেন কারণ তাঁরা মনে করেন সেই আদি অবস্থা সম্পর্কে তথ্য কখনোই পাওয়া সম্ভব হবে না। কিছু পদার্থবিজ্ঞানী বহুবিশ্বের (multiverse) হাইপোথিসিস তুলে ধরেন যেখানে আমাদের এই মহাবিশ্ব অনেকগুলো মহাবিশ্বের একটি।

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

প্রাচীন কালে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য নানাবিধ বিশ্বতত্ত্বের আশ্রয় নেওয়া হত। পুরাতন গ্রিক দার্শনিকরাই প্রথম এই ধরনের তত্ত্বে গাণিতিক মডেলের সাহায্য নেন এবং পৃথিবী কেন্দ্রিক একটি মহাবিশ্বের ধারণা প্রণয়ন করেন। তাদের মডেলে পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সমস্ত গ্রহ, সূর্য ও নক্ষত্ররা ঘুরছে। গ্রীকদের এই মডেলে মহাবিশ্বের মোট আয়তন বর্তমানে জ্ঞাত বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথের মধ্যেই ছিল। তারা ভেবেছিলেন আকাশের তারারা আমাদের থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থিত নয়।

বেশ কয়েক জন জ্যোতির্বিদ পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করলেও যতদিন না চৌদ্দশো শতকে কোপের্নিকাস সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বকে যৌক্তিক ভাবে তার বইয়ে উপস্থাপনা করলেন ততদিন পৃথিবীকেন্দ্রিক ধারণা মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে গেঁড়ে ছিল। পরবর্তীকালে নিউটনের গতি ও মহাকর্ষ সংক্রান্ত গভীর ধারণা পর্যবেক্ষণের সাথে সৌরকেন্দ্রিক জগতের সামঞ্জস্য নির্ধারণ করে। ধীরে ধীরে জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করেন সূর্যের মতই কোটি কোটি তারা দিয়ে একটি ছায়াপথ গঠিত। কয়েক শত বছর বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল সমগ্র মহাবিশ্ব মানে শুধুমাত্র আমাদের এই ছায়াপথ ছায়াপথটিই। ১৯২০র দশকে উন্নত দুরবীনের কল্যাণে জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করলেন ছায়াপথের বাইরে অন্য ছায়াপথদের। [১০][১১]

সেই কোটি কোটি ছায়াপথদের মধ্যে ছায়াপথের মতই কোটি কোটি নক্ষত্রদের অবস্থান। সেই সমস্ত ছায়াপথদের থেকে আগত আলোর বর্ণালি বিশ্লেষণে বোঝা গেল সেই ছায়াপথগুলি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। [১২]

এর সহজতম ব্যাখ্যা হল ছায়াপথদের মধ্যে স্থানের প্রসারণ হচ্ছে এবং প্রতিটি ছায়াপথই অন্য ছায়াপথ থেকে দূরে সরছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা হল সুদূর অতীতে সমস্ত ছায়াপথগুলি বা তাদের অন্তর্নিহিত সমস্ত পদার্থই একসাথে খুব ঘন অবস্থায় ছিল এবং কোন মহা বিস্ফোরণের ফলে বস্তুসমূহ একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই বিস্ফোরণের নাম দেওয়া হল বিগ ব্যাং। ১৯৬০এর দশকে বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাংএ সৃষ্ট উষ্ণ বিকিরণের শীতল অবশেষের সন্ধান পেলেন।[১৩] এই তরঙ্গ বিগ ব্যাং ঘটনার প্রায় ৪০০,০০০ বা চার লক্ষ বছর পরে, বস্তু ঘনত্বের হ্রাসের পর, মুক্ত হয়েছিল। এই মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ মহাবিশ্বের প্রতিটি জায়গাতেই পাওয়া যায়। এক অর্থে বলা যায় এই তরঙ্গ দৃশ্যমান মহাবিশ্বের শেষ প্রান্ত থেকে আসছে। বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করলেন মহাবিশ্বের প্রসারণ ত্বরাণ্বিত হচ্ছে।[১৪] এই আবিষ্কারটি বিশ্বতত্ত্বের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিল।

বিগ ব্যাং মডেল অনুযায়ী মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল একটা ভীষণ ঘন ও উষ্ণ দশা থেকে। এই সময় বা অবস্থাকে প্ল্যাঙ্ক ইপোখ বলে অভিহিত করা যায়। সেই সময় থেকে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হয়ে চলেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা শুরুর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই (১০−-৩২ সেকেন্ডের মধ্যেই) মহাবিশ্বের অতি স্ফিতী (inflation) হয় যা কিনা দেশ বা স্থানের প্রতিটি অংশে প্রায় একই তাপমাত্রা স্থাপন করতে সাহায্য করে।[১৫] এই সময়ে সুসম ঘনত্বের মাঝে হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যত ছায়াপথ সৃষ্টির বীজ তৈরি হয়। মহাকর্ষ শক্তি মাধ্যমে সম্প্রসারণের বিরূদ্ধে বস্তুজগতকে আকর্ষিত করে ছায়াপথ সৃষ্টির পেছনে কৃষ্ণ বা অন্ধকার বস্তুর বিশেষ ভূমিকা আছে। অন্যদিকে মহাবিশ্বের বর্তমান প্রসারণের মাত্রার ত্বরণের জন্য কৃষ্ণ বা অন্ধকার শক্তি বলে একটি জিনিসকে দায়ী করা হচ্ছে। তাত্ত্বিক ভাবে কৃষ্ণ বস্তু মহাকর্ষ ছাড়া অন্য বলগুলোর সাথে (তড়িৎ-চুম্বকীয়, সবল ও দুর্বল) খুব অল্পই বিক্রিয়া করে সেইজন্য ডিটেকটর দিয়ে তাকে দেখা মুশকিল। বর্তমান মহাবিশ্বের মূল অংশই হচ্ছে কৃষ্ণ শক্তি, বাকিটা কৃষ্ণ বস্তু। আমরা চোখে বা ডিটেকটর মাধ্যমে যা দেখি তা মহাবিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশের কম। এই মডেলে মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স ১,৩৭৫ কোটি বছর। এই মহাবিশ্বের দৃশ্যমান অংশের "এই মুহূর্তের" ব্যাস প্রায় ৯,৩০০ কোটি আলোকবর্ষ। যেহেতু মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দু প্রতিটি বিন্দু থেকে প্রতি মুহূর্তে আরো দ্রুত সরছে, মহাবিশ্বের ব্যাস ১,৩৭৫ × ২ = ২,৭৫০ কোটি আলোক বছরের চাইতে বেশি। দেশ বা স্থানের প্রতিটি বিন্দু বহু দূরের কোন বিন্দুর তুলনায় আলোর গতির উর্ধে ভ্রমণ করে, যতক্ষণ না সেই বিন্দুগুলির মাঝে তথ্য আদানপ্রদান না হচ্ছে এই গতি বিশেষ বা সাধারণ আপেক্ষিকতার কোন নিয়ম ভঙ্গ করে না।

হাবল মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র মহাশূন্যের একটি মোটামুটি ফাঁকা অংশকে তাক করে বেশ কিছুদিন ধরে এই উচ্চ রেজোলিউশনের ছবিটি ধারণ করে। এই অংশটির মোট আকার চাঁদের কৌণিক ব্যাসের (অর্ধেক ডিগ্রি) সমান। নিচের বাঁদিকের বাক্সে সেটা দেখানো হয়েছে। এই ছবিতে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চলের ছায়াপথসমূহ দেখা যাচ্ছে। এখানে প্রতিটি ছায়াপথে অন্তত ১০০ কোটি নক্ষত্র রয়েছে। এছাড়া এই ছবিতে প্রায় ১০০টি খুবই ছোট লাল ছায়াপথ আছে যাদের দূরত্ব হয়তো আমাদের জানা মতে সবচেয়ে বেশি, সেগুলো মহাবিস্ফোরণের পরে কয়েক শত কোটি বছরের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল।

বর্তমান মহাবিশ্বের উপাদানসমূহ

[সম্পাদনা]

মহাবিশ্বের আকার বিশাল। বর্তমান বিশ্বতত্ত্বের মডেল অনুযায়ী মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স ১,৩৭৫ কোটি বছর। এই মহাবিশ্বের দৃশ্যমান অংশের "এই মুহূর্তের" ব্যাস প্রায় ৯,৩০০ কোটি আলোকবর্ষ। যেহেতু মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দু প্রতিটি বিন্দু থেকে প্রতি মুহূর্তে আরো দ্রুত সরছে, মহাবিশ্বের ব্যাস ১,৩৭৫ x ২ = ২,৭৫০ কোটি আলোকবর্ষের চাইতে বেশি। দেশ বা স্থানের প্রতিটি বিন্দু বহু দূরের কোন বিন্দুর তুলনায় আলোর গতির উর্ধে ভ্রমণ করে, যতক্ষণ না সেই বিন্দুগুলির মাঝে তথ্য আদানপ্রদান না হচ্ছে এই গতি বিশেষ বা সাধারণ আপেক্ষিকতার কোন নিয়ম ভঙ্গ করে না। কাজেই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে মহাবিশ্বকে যদি একটা গোলক কল্পনা করা হও তবে তার ব্যাসার্ধ হবে প্রায় ৪,৬০০ কোটি আলোকবর্ষ। যদিও সেই দূরত্ত্বে অবস্থিত ছায়াপথ থেকে এই মুহূর্তে যে বিকিরণ বার হচ্ছে তা আমরা কখনই দেখতে পাব না।

জ্যোতির্বিদরা মনে করছেন দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রায় ১০ হাজার কোটি (১০+১১) ছায়াপথ আছে। এই ছায়াপথগুলো খুব ছোট হতে পারে, যেমন মাত্র ১ কোটি তারা সংবলিত বামন ছায়াপথ অথবা খুব বড় হতে পারে, দৈত্যাকার ছায়াপথগুলিতে ১০০ হাজার কোটি নক্ষত্র থাকতে পারে (আমাদের ছায়াপথের ১০ গুণ বেশি)। দৃশ্যমান মহাবিশ্বে আনুমানিক ৩ x ১০+২৩টি নক্ষত্র থাকতে পারে।[১৬]

বর্তমানের মহাজাগতিক মডেল অনুযায়ী মহাবিশ্বের মূল উপাদান মূলতঃ কৃষ্ণ বা অন্ধকার শক্তি। ধরা হচ্ছে যে এই শক্তি সারা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে এবং মহাবিশ্বের প্রসারণের পিছনে মূল ভূমিকা পালন করছে। কৃষ্ণ শক্তির পরিমাণ যেখানে ৭৪% ভাগ ধরা হয়, মোট বস্তুর পরিমাণ সেখানে ২৬%। কিন্তু এই বস্তুর মধ্যে ২২% কৃষ্ণ বস্তু ও ৪% দৃশ্যমান বস্তু। কৃষ্ণ বস্তুর অস্তিত্ব পরোক্ষভাবে ছায়াপথর ঘূর্ণন, ছায়াপথপুঞ্জ, মহাকর্ষীয় লেন্সিং, ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে। কৃষ্ণ বস্তু যেহেতু মহাকর্ষ ছাড়া অন্য কোন বলের সংঙ্গে পারতপক্ষে কোন মিথষ্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না, সেই জন্য তাকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা কঠিন।

মহাবিশ্বের সংঙ্গে আমাদের পরিচয় দৃশ্যমান বস্তুর আঙ্গিকে। পরমাণু ও পরমাণু দ্বারা গঠিত যৌগ পদার্থ দিয়ে এই দৃশ্যমান বিশ্ব গঠিত। পরমাণুর কেন্দ্রে নিউক্লিয়াস প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে গঠিত। প্রোটন ও নিউট্রনকে ব্যারিয়ন বলা হয়। ব্যারিয়ন তিনটি কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত। অন্যদিকে দুটি কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত কণাদের মেজন বলা হয়। অন্যদিকে লেপটন কণা কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত নয়। সবেচেয়ে পরিচিত লেপটন কণা হচ্ছে ইলেকট্রন। প্রমিত মডেল বা স্ট্যান্ডার্ড মডেল কোয়ার্ক, লেপটন ও বিভিন্ন বলের মিথষ্ক্রিয়ায় সাহায্যকারী কণাসমূহ (যেমন ফোটন, বোজন ও গ্লুয়োন) দিয়ে তৈরি। বর্তমানের কণা পদার্থবিদ্যাকে ব্যাখ্যা করতে এই মডেল সফল হয়েছে।

মহাবিশ্বের গঠন ও আকার ও সম্ভাব্য ধ্বংসের পথ

[সম্পাদনা]

সূর্য আমাদের নিকটবর্তী নক্ষত্র। সূর্য থেকে আলো আসতে ৮ মিনিট মত সময় লাগে, কাজেই সূর্যের দূরত্ত্ব হচ্ছে আনুমানিক ৮ আলোক মিনিট। আমাদের সৌর জগতের আকার হচ্ছে ১০ আলোক ঘন্টার মত। সূর্যের পরে আমাদের নিকটবর্তী তারা হচ্ছে ৪ আলোক বর্ষ দূরত্বে। নিচের চিত্রে ১৪ আলোক বর্ষের মধ্যে অবস্থিত সমস্ত তারাদের দেখানো হয়েছে।

আমাদের ১৪ আলোকবর্ষের মধ্যে যে সমস্ত তারা আছে

আমাদের ছায়াপথ

[সম্পাদনা]

গ্যালাকটিক বারের মহাকর্ষীয় প্রভাবের বাইরে, আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ডিস্কে আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যম এবং তারার গঠন চারটি সর্পিল বাহুতে সংগঠিত। [১৭] সর্পিল বাহুগুলো সাধারণত গ্যালাকটিক বার থেকে উচ্চ ঘনত্বের আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস এবং ধূলিকণার থাকে। এটি H II অঞ্চল এবং আণবিক মেঘ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।[১৮]

নিচের ছবিতে ছায়াপথ ছায়াপথর বাহুসমূহ দেখানো হয়েছে। সূর্য থেকে ছায়াপথর কেন্দ্রের দূরত্ব প্রায় ৩০,০০০ আলোক বর্ষ। ছায়াপথর ব্যাস ১০০,০০০ বা এক লক্ষ আলোক বর্ষ। কেন্দ্রের উল্টোদিকের অংশকে আমরা দেখতে পাই না।

আমাদের ছায়াপথর সর্পিল বাহুসমূহ

স্থানীয় ছায়াপথপুঞ্জ

[সম্পাদনা]

নিচের চিত্রে ছায়াপথের ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লক্ষ আলোকবর্ষের মধ্যে অবস্থিত ছায়াপথগুলো দেখানো হয়েছে। এই স্থানীয় ছায়াপথ দলের মধ্যে বড় তিনটি সর্পিল ছায়াপথ - ছায়াপথ, অ্যান্ড্রোমিডা বা M31 এবং M33 একটি মহাকর্ষীয় ত্রিভুজ তৈরি করেছে। অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথ আমাদের নিকটবর্তী বড় ছায়াপথ। এর দূরত্ব হচ্ছে ২.৫ মিলিয়ন বা ২৫ লক্ষ আলোকবর্ষ। স্থানীয় দলের মধ্যে বেশির ভাগ ছায়াপথই বড় ম্যাজিল্লান মেঘের মত অনিয়মিত ছায়াপথ।

স্থানীয় ছায়াপথপুঞ্জ

স্থানীয় ছায়াপথ মহাপুঞ্জ

[সম্পাদনা]

ডান দিকের চিত্রে স্থানীয় ছায়াপথ দল থেকে স্থানীয় ছায়াপথ মহাপুঞ্জের অন্যান্য দলের দূরত্ত্ব দেখানো হয়েছে। এই মহাপুঞ্জের কেন্দ্র কন্যা ছায়াপথ দল হওয়াতে তাকে কন্যা মহাপুঞ্জ বা মহাদল বলা হয়। কন্যা ছায়াপথ পুঞ্জ আমাদের থেকে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বা ৬.৫ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই ধরনের মহাপুঞ্জগুলো ফিতার আকারের মত। সাবানের বুদবুদ দিয়ে এই ধরনের ছায়াপথপুঞ্জ গঠনের মডেল করা যায়। দুটো বুদবুদের দেওয়াল যেখানে মেশে সেখানেই যেন ছায়াপথর ফিতা সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় ছায়াপথ মহাপুঞ্জ বা সুপারক্লাস্টার।

নিচের চিত্রে আমাদের ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি আলোকবর্ষের মধ্যে অবস্থিত প্রধান ছায়াপথপুঞ্জ ও ছায়াপথ দেওয়াল দেখানো হচ্ছে। এই চিত্রে বুদবুদগুলোর মাঝের শূন্যতা (void) খুব ভাল করেই বোঝা যাচ্ছে। কন্যা ছায়াপথ মহাপুঞ্জসহ ৫০ মেগাপার্সেকের (৫০ মিলিয়ন পার্সেক বা ১৬৩ মিলিয়ন আলোকবর্ষ)মধ্যে সমস্ত পদার্থ ৬৫ মেগাপার্সেক দূরের নর্মা পুঞ্জের (Abell 3627)দিকে ৬০০ কিমি/সেকেন্ডে ছুটে যাচ্ছে। বৃহত্তর স্কেলে ছায়াপথ সৃষ্টির জন্য ব্যারিয়ন ধ্বনি স্পন্দন (Baryon Acoustic Oscillation) যথেষ্ট সফল হয়েছে। এই মডেল অনুযায়ী ছায়াপথ পুঞ্জ মোটামুটি ১০০ মেগাপার্সেক (~৩০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ)স্কেলে বা স্থান জুড়ে সৃষ্টি হবে। স্লোয়ান ডিজিটাল স্কাই সার্ভের ডাটাতে ব্যারিয়ন স্পন্দন ২০০৫এ ধরা পড়ে।[১৯]

আমাদের ৫০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষের মধ্যের মহাবিশ্ব। নিকটবর্তী ছায়াপথ দেওয়াল দেখা যাচ্ছে

'

===মহাবিশ্বের ধ্বংস=== মহাবিশ্বের ধ্বংস কিভাবে হবে বা আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে বিজ্ঞান এখনো সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয়। নিচের ধারণাগুলো সবচেয়ে বেশি পরিচিত:

  • মহাসংকোচন: সময়ের সঙ্গে মহাকর্ষ বল ও গুপ্ত শক্তির দ্বন্দ্বে যদি মহাকর্ষ বল জিতে যায় তাহলে ধারণা করা হয় সকল গ্রহ,উপগ্রহ, নক্ষত্র,গ্যালাক্সি সব আবার একত্রিত হতে শুরু করবে। যার ফলে অবশেষে আবার বিগ ব্যাং এর সেই বিন্দুতে পরিণত হবে। তারপরে আবার একটি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে ব্রহ্মাণ্ড আবার শুরু হতে পারে। নাও হতে পারে।
  • মহাপ্রসারণ: মহাকর্ষ বল ও গুপ্ত শক্তির দ্বন্দ্বে যদি গুপ্ত শক্তি জিতে যায় তাহলে মহাকর্ষ বলের অভাবে গ্রহ,নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ছিটকে যাবে। সূর্য তখন পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ কে আর ধরে রাখতে পারবে না। এমনকি ধারনা করা হয় পরমাণুর ইলেকট্রন,প্রোটন এবং নিউট্রন গুলোও ছিটকে যাবে।
  • মহাহিমায়ন:এমনটি ঘটতে পারে যদি মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের হার এখন যেমন আছে ঠিক তেমনই থাকে। সেক্ষেত্রে মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে ঠিক এভাবেই প্রসারিত হতে থাকবে, মহাজাগতিক বস্তুসমূহ পরস্পর থেকে অনেক দূরে সরে যাবে এবং এ দূরত্ব বাড়তে থাকবে। বাড়তে বাড়তে এক সময় মহাবিশ্ব তার বর্তমান শ্রী হারিয়ে অপেক্ষাকৃত বিচ্ছিন্ন একটি স্থানে পরিণত হবে। এর সমস্ত শক্তিই এক সময় তাপে রূপান্তরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে, ঘটবে তাপীয় মৃত্যু।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "Hubble sees galaxies galore"spacetelescope.org। ৪ মে ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ৩০ এপ্রিল ২০১৭
  2. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Planck 2015 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  3. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Brian Greene 2011 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  4. Bars, Itzhak; Terning, John (২০০৯)। Extra Dimensions in Space and Time। Springer। পৃ. ২৭–। আইএসবিএন ৯৭৮-০-৩৮৭-৭৭৬৩৭-৮। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০১১
  5. Davies, Paul (২০০৬)। The Goldilocks Enigma। First Mariner Books। পৃ. ৪৩ff। আইএসবিএন ৯৭৮-০-৬১৮-৫৯২২৬-৫
  6. NASA/WMAP Science Team (২৪ জানুয়ারি ২০১৪)। "Universe 101: What is the Universe Made Of?"। NASA। ১০ মার্চ ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
  7. Fixsen, D.J. (২০০৯)। "The Temperature of the Cosmic Microwave Background"The Astrophysical Journal৭০৭ (2): ৯১৬–৯২০। আরজাইভ:0911.1955বিবকোড:2009ApJ...707..916Fডিওআই:10.1088/0004-637X/707/2/916আইএসএসএন 0004-637Xএস২সিআইডি 119217397
  8. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; planck2013parameters নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  9. NASA/WMAP Science Team (২৪ জানুয়ারি ২০১৪)। "Universe 101: Will the Universe expand forever?"। NASA। ৯ মার্চ ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১৬ এপ্রিল ২০১৫
  10. Curtis, H. D. (১৯৮৮)। "Novae in Spiral Nebulae and the Island Universe Theory"। Publications of the Astronomical Society of the Pacific১০০: ৬। বিবকোড:1988PASP..100....6Cডিওআই:10.1086/132128
  11. Hubble, E. P. (১৯২৯)। "A spiral nebula as a stellar system, Messier 31"Astrophysical Journal৬৯: ১০৩–১৫৮। বিবকোড:1929ApJ....69..103Hডিওআই:10.1086/143167
  12. Hubble, E. P.; Humason, M. L. (১৯৩১)। "The Velocity-Distance Relation among Extra-Galactic Nebulae"Astrophysical Journal৭৪: ৪৩।
  13. Penzias, A. A. & Wilson, R. W. 1965, A Measurement of Excess Antenna Temperature at 4080 Mc/s, Astrophysical Journal, vol. 142, p.419-421
  14. Adam G. Riess et al. 1998, Observational Evidence from Supernovae for an Accelerating Universe and a Cosmological Constant, The Astronomical Journal, 116, #3
  15. Guth A.,H.. 1981, Inflationary universe: A possible solution to the horizon and flatness problems, Phys. Rev. D 23, 347–356
  16. van Dokkum, Pieter G; Conroy, Charlie (২০১০)। "A substantial population of low-mass stars in luminous elliptical galaxies"Nature৪৬৮: ৩।
  17. , E., Churchwell; এবং অন্যান্য (২০০৯)। "The Spitzer/GLIMPSE surveys: a new view of the Milky Way"। Publications of the Astronomical Society of the Pacific১২১ (877): ২১৩–২৩০। বিবকোড:2009PASP..121..213Cডিওআই:doi:10.1086/597811 {{সাময়িকী উদ্ধৃতি}}: |ডিওআই= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য); |শেষাংশ1=-এ "et al." এর সুস্পষ্ট ব্যবহার (সাহায্য)
  18. Dame, T. M.; Hartmann, D.; Thaddeus, P. (২০০১)। "The Milky Way in molecular clouds: A new complete CO survey"The Astrophysical Journal৫৪৭ (2): ৭৯২–৮১৩। আরজাইভ:astro-ph/0009217বিবকোড:2001ApJ...547..792Dডিওআই:10.1086/318388এস২সিআইডি 118888462
  19. Eisenstein, D. J. et al. 2005, Detection of the Baryon Acoustic Peak in the Large-Scale Correlation Function of SDSS Luminous Red Galaxies, The Astrophysical Journal, Volume 633, Issue 2, pp. 560-574