ব্যবহারকারী:Owais Al Qarni/খেলাঘর ৩

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

একজন সাহিত্যিক।[১][২][৩][৪] লিস্ট অব বায়োগ্রাফি লেকচার

শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

মায়ের তরবিয়ত[সম্পাদনা]

শৈশবকালে মায়ের তরবিয়ত ছিল হযরত মাওলানা আলী মিয়ার জীবনের অত্যন্ত কার্যকর পাথেয়। হযরত সাইয়েদ আব্দুল হাই (রহ.)-এর ইন্তেকালের কারণে পরিবারে পুরুষ মুরবী কেউ ছিলেন না। তাই বালক আলী মিয়ার শৈশবের তন্বাবধান ও নৈতিকৃতা গঠনের সকল দায়িত্ব পালন করেন শ্রদ্ধেয় মাতা। কুরআন মজীদের বড় বড় সূরাসমূহ সে সময়েই তাঁর মাতা কে মুখস্থ করান। হযরত নিজেই লিখেছেন- পিতার ইন্তেকালের কারণে আম্মা আমাকে অন্য মায়েদের তুলনায় অনেক বেশী আদর যত্ব করতেন। কিন্ত দু'টি ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন।

প্রথমত, নামাযের ব্যাপারে তিনি কিছুতেই শৈথিল্য করতে দিতেন না। আমি এশার নামায না পড়ে ঘুমিয়ে গেলে যতই গভীর ঘুম হোক না কেন, তিনি জামাকে জাগিয়ে নামায পড়িয়ে নিতেন। নামায না পড়ে কিছুতেই ঘুমুতে দিতেন না। তেমনি ফজরের সময়েও জাগিয়ে দিতেন এবং মসজিদে পাঠাতেন। অতঃপর কুরআন মজীদ তেলাওয়াতে বসিয়ে দিতেন।

দ্বিতীয়ত, যে বিষয়ে তিনি কোন মতেই শৈথিল্য করতেন ন' এবং আমার প্রতি চরম শ্নেহ-মমতা তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারতো না তা হলো, আমি যদি খাদেমের বাচ্চাদের কিংবা কাজকর্মে নিয়োজিত গরীব বালকদের সাথে রূঢ় বা অন্যায় আচরণ করতাম, তাহলে তিনি শুধুমাত্র দুঃখ প্রকাশ করিয়েই ক্ষান্ত হতেন নাঃ বরং হাতজোড় করে মাফ চাইতে বাধ্য করতেন।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় বিশেষ উল্লেখযোগ্য । বালক আলী মিয়ার মধ্যে তার মাতা, সমবয়সী অন্যান্য বালকের মত মেধা ও প্রতিভা অনুভব করতেন না। সম্মানিতা মাতা এজন্য খুবই চিস্তিত ছিলেন এবং নিজের একমাত্র পুত্র সন্তানের ভবিষ্যত ভাল হবে না মনে করে নিরাশ হয়ে পড়তেন। তাই বালক আলী মিয়ার লালন-পালন শিক্ষা ও সাফল্যের জন্য তিনি মন খুলে দোয়া করতেন। শুধুমাত্র পুত্রের সাফল্য ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনায় তিনি যেসব গদ্য-পদ্য রচনা করেছেন, সমকালীন কোন মহিলার মধ্যে তা সাধারণতঃ দেখা যায় না।

হযরতের শ্রদ্ধেয় আম্মা বলেন- সে সময়ে আমি একদিন স্বপ্নে আমার পিতাকে হেযরতের নানা) দেখলাম, তিনি আমাকে তার 'পুরনো স্বপ্পের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন । যাতে তিনি- "

০০ 5৯ ০৪ ৮ এ ৮ পা পিসি

এর সূসংবাদ শুনেছিলেন। তিনি বললেন- তুমি এত অস্থির হয়ে পড়ছ কেন? হযরত মাওলানা বলেন_ আমার বারা যা কিছু হয়েছে এবং আমি আল্লাহর নেক বান্দাদের নৈকট্য ও দুআ লাভ করেছি তা আমার আম্মারই সেই ব্যাকুল দোয়ার ফল। তিনি আরো বলেন- যখন আমি কিছু লিখবার উপযুক্ত হলাম, তখন তিনি আমাকে 'জোর তাকীদ দিতেন আমি যেন বিসমিল্লাহর পর এই দোয়াটি অবশ্যই লিখি ৩১৮৭ ৯৬ ভেঠ ৮ ৫৮ ও পে)

উপদেশ দিতেন। তখন তার সকল আশা-আকাঙ্কা, কামনা-বাসনা ও চিত্ত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলাম আমি। আমাকে আমার পূর্বসূরীদের সঠিক বৈশিষ্ট্যের ধারক-বাহক, বরং ইসলামের নাম আলোকোজ্ববলকারী, দ্বীনের মুবান্লিগ ও দায়ী হিসেবে দেখার আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়

আকাংখা ও জীবন প্রদীপ; সব সময় কেবল তারই চিন্তা, সর্বদা তারই খ্যা- জ্ঞান, সব সময় তারই দুআ ও তারই আলোচনা ।

আমার লাখনৌ অবস্থান এবং আমার প্রাথমিক শিক্ষা লাভকালে তিনি আমাকে যেসব লম্বা ও বিস্তারিত চিঠি লিখেছিলেন সেসবের নির্বাচিত ভান্ভার আলহামদুলিল্লাহ আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। এগুলো তাঁর আন্তরিক আবেগের দর্শন, বরং তাঁর কামালিয়াত ও আল্লাহপ্রদত্ত গুণাবলীর এলবাম বিশেষ। যা আল্লাহ তায়ালা একেবারে গায়বীভাবে তাঁকে দীন করেছিলেন এবং যা ছিল তাঁর জীবনের আসল পুঁজি ও সম্পদ। অতীতে শিক্ষিত ও দ্বীনদার মুসলিম পিতামাতা তার সন্তানদেরকে যেসব চিঠিপত্র লিখেছেন তার বিস্তৃত ভান্ডারের মধ্যে আল্লাহর এই নেক বান্দীর, যদিও তিনি সীমিত লেখাপড়া শিখেছিলেন তা সব্বেও ভার লিখিত পত্রগুলো এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। এগুলো ছাড়া তাঁর জীবনের আর কোন জ্ঞানগত ও ধমীয় স্মৃতি যদি নাও থাকত তবুও এগুলোই যথেষ্ট হত।

হযরত বলেন যে, আমাদের খান্দানে ইংরেজী লেখাপড়া তখন মহাধুমধামে ও জোরে শোরে, চলছে। জমিদারী থেকে. মুক্তি, যুগের চাহিদা, রড় বড় পদের লোভ, উন্নতিকারীদের উদাহরণ- এসবগুলিই ছিল-এর আন্দোলক ও হতবুদ্ধি করার জন্য যথেষ্ট । বড় বড় দৃঢ়চেতা পুরুষদের পা পর্যস্ত এই স্রোতে টলমল করছিল । স্বয়ং আম্মার আপন ভাগনে ব্যারিষ্টারী পড়ার জন্য বিলেত গিয়েছিলেন এবং কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে দেশে ফিরেছিলেন। একজন ত্রাতুষ্পুত্রও আমেরিকা গিয়েছিলেন এবং সেসময় সেখানে লেখাপড়া করছিলেন। তার চিঠি আসত এবং পড়ে শোনা হত। আমাদের আরেক আত্ীয় জার্মানী ও জাপান গিয়ে উচু ডিঘ্রী নিয়ে এসেছিলেন। আরেক আত্তীয় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের জন্য নির্বাচিত হন। তিনিও লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে লন্ডন গিয়েছিলেন এবং আমার কৈশোরেই সেখান থেকে ফিরে এসে বড় পদে যোগদান করেছিলেন।

আমি তখন লাখনৌতে অবস্থান করি। গোটা পরিবেশ ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আহ্বান জানাচ্ছিল। আমার ভাই সাহেব আমার জন্য ধমীয় শিক্ষায় উপযুক্ত ও পারদর্শী হবার পথই বাছাই করে রেখেছিলেন । তাঁর নিজের ধারণা ছিল যে, আমাকে এই পথই বেছে নেওয়া উচিত। কোন কোন আত্রীয়-বন্ধুবান্ধব তাকে ভরসনা করেছিলেন এই বলে যে, এতিম ভাইটিকে আরবী পড়াচ্ছে এবং মোল্লা বানাচ্ছে।

আমার মুহতারাম ভাইজান এক বিশেষ মেযাজ ও খাস আন্দাযের লোক ছিলেন। অহেতুক তর্ক-বিতর্ক ও কথা কাটাকাটির সঙ্গে তার কোন সম্পর্কই ছিল না। তিনি এসব কথার এমন এক জওয়াব দিতেন যার কোন উত্তর তাদের কাছে ছিল না। তিনি বলতেন যে, এর কোন দরকার নেই আমাদের । আব্বাজান জীবিত থাকলে তাকে যা পড়াতেন, আমিও তাই পড়াচ্ছি। ভাইজানের এই সিদ্ধান্ত ও আকাজ্্ষার ওপর আম্মার প্রেরণা ও উৎসাহ, তাঁর ঈমানী শক্তি এবং পার্থিব সম্মান ও পদমর্যাদার প্রতি তাঁর নিরুত্তাপ মানসিকতা ও অনীহা সোনায় সোহাগ প্রমাণিত হয়েছিল ।

কয়েকটি প্রশিক্ষণমূলক পত্র[সম্পাদনা]

এক সময় আমার স্বভাবে ধর্মীয় শিক্ষার অনীহা দেখা দেয় এবং ইংরেজী শিক্ষার প্রতি আগ্রহ জন্মে। ভাইজান কোন পত্রে কিংবা রায়বেরেলীর কোন সফরে আম্মাকে গিয়ে আমার এই মানসিকতা সম্পর্কে অভিযোগ করেন। এরপর আম্মা আমাকে যে পত্র লিখেন তা থেকে তাঁর আন্তরিক ধ্যান-ধারণা, অন্তর্গত প্রেরণা, ঈমানী শক্তি ও ধর্মের প্রতি তাঁর প্রেম ও ডালবাসার গভীরতা আঁচ করা যায়। সম্ভবত ১৯২৯ কিংবা ৩০ সালের কোন এক সময়ে লিখিত সন-তারিখবিহীন এই পত্রের একটি অংশ হুবহু এখানে উদ্ৃত করা হচ্ছে।

“আলী! দুনিয়ার হালত খুবই বিপজ্জনক। এই সময় যারা আরবী লেখাপড়া শিখছে তাদের ঈমান-আকীদাই যখন ঠিক নেই, সেখানে যারা ইংরেজী পড়ছে তাদের কাছে আর কিইবা আশা করা চলে? আবদ ও তালহার মত কয়জনকে পাবে? আলী! লোকেরা বিশ্বাস করে যে, যারা ইংরেজী পড়ছে তারা বড় বড় পদমর্ধাদা লাভ করেছে।৯ কেউ ডেপুটি হচ্ছে, কেউ জজ, কমপক্ষে উকীল-ব্যারিষ্টার তো হবেই হবে । আমি এর সম্পূর্ণ বিরোধী ।

' আমি ইংরেজীওয়ালাদের জাহেল ভাবি এবং এই লেখাপড়াকে নিক্ষল ও অকেজো মনে করি। বিশেষ করে এই সময়ে জানা নেই কি হবে এবং কোন ধরণের শিক্ষা প্রয়োজন। সে সময় অবশ্য প্রয়োজন বেশী ছিল। এই পদমর্যাদা তো চামারও লাভ করতে পারে। এটা সর্বসাধারণের জুন্য উন্মুক্ত এমন কে আছে যে এর থেকে বঞ্চিত? তোমাকে তো এমন কিছু হাসিল করতে হবে যা এই মুহূর্তে দুর্লভ, যা কেউ হাসিল করতে পারে না। যা দেখার জন্য আমার চোখ উদগ্রীব এবং যা শোনার জন্য, আমার কান অধীর একং যার আকাঙ্ায় মন আমার ছটফট করছে, কিন্তু যা আমি দেখতে চাইছি তা চোখে পড়ছে না।

"আফসোস! আমরা এমন এক সময় জন্যেছি। আলী! তুমি কারও কথা শুনো না। যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাও এবং আমার হক আদায় করতে চাও তাহলে সেইসব সিংহপুরুষদের দিকে তাকাও যাঁরা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন। তাঁদের সম্মান ও মর্ধাদা কি ছিল? শাহ ওয়ালী উল্লাহ সাহেব, শাহ আব্দুল কাদির সাহেব, মৌলভী সহাম্মাদ ইবরাহীম সাহেব এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের ভেতর খাজা আহমাদ ও মৌলভী মুহাম্মাদ আমীন সাহেব মরহুম যাদের জীবন ও মরণ

১ ভাইজান সাইয়েদ আবদুল আলী পরিবারে এ নামেই পরিচিত ছিলেন। মাওলানা তালহা ছিলেন আমার ফুফা। তিনি দীর্ঘকাল যাবত লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজে অধ্যাপনার পর ১৯৭০ সালে করাটীতে ইনতেকাল করেন।

২ মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম ছিলেন প্রখ্যাত আহলে হাদীস আলেম। তিনি আমার নানা সাইয়েদ শাহ জিয়াউন্নবীর মুরীদ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন হস্কানী আলেম! তাঁর ওয়াবে খুবই প্রভাব হত এবং লোকে কাঁদত। তার একটি ওয়াজের দ্বারা আমাদের পরিবারের যুবকদের বিরাট সংশোধন ও পরিশুদ্ধি ঘটে এবং তাদের চরিত্রের আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়। ৬ই যিলহজ্জ ১৩১৯ হিজরী মকা! মুআড্জামায় তিনি ইনতেকাল করেন । জান্নাতুল মুআল্লায় তাঁর কবর অবস্থিত ।

  • খাজা সাইয়েদ আহমদ নাসিরাবাদী ছিলেন সাইয়েদ আহমাদ শহীদের খলীফা এবং

সাইয়েদ শাহ জিয়াউন্নবী ও হাকীম সাইয়েদ ফখরুদদীনের পীর ও মুরশিদ। কুরআন- সুন্নাহর প্রচারে ও তাওহীদী আদর্শের প্রসারে এবং মানুষের হেদায়েত ও সংস্কার সংশোধনে তার বিরাট অবদান রয়েছে। ১২৮৯ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। ঈর্ষণীয় ছিল। শান-শওকতের সঙ্গে তারা দুনিয়াতে থেকেছেন এবং সুন্দরভাবে তীরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। এই সম্মান ও মর্যাদা কিভাবে লাভ করা যেতে পারে? ইংরেজী মর্যাদাধারী তোমাদের পরিবারে সকলেই এবং আরও হবে, কিন্তু অনুরূপ মর্ধাদার অধিকারী কেউ নেই- এ মুহূর্তে এটার খুবই প্রয়োজন। তাঁদের ইংরেজীর প্রতি কোনরূপ আকর্ষণ কিংবা প্রীতি ছিল না। তাঁরা ইংরেজীতে অজ্ঞ ছিলেন। তাহলে এই মর্যাদা তারা কিভাবে লাভ করলেন?

আলী! আমার একশটা সন্তান থাকলেও আমি তাদেরকে এই শিক্ষাই দিতাম। এখন কেবল তুমিই আছ। আল্লাহ তাআলা আমার নেক নিম্নতের পুরস্কার দিন যেন, একশত সন্তানের গুণাবলী আমি তোমার থেকে পেতে পারি এবং এই জগতে ও পরগজতে সৌভাগ্য ও সুনামের অধিকারী হই, সুযোগ্য সন্তানের মা হিসেবে কথিত হই। আমীন! ছুম্মা আমীন! ইয়া রব্বাল আলামীন! "

আমি আল্লাহ্‌র কাছে সব সময় দোয়া করি যেন তিনি তোমাকে হিম্মত দান করেন এবং তোমার মধ্যে সেই আগ্রহ জাগিয়ে দেন যাতে তুমি সেই মহৎ গুণাবলী অর্জন করতে পার এবং তিনি যেন তোমাকে যাবতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য সুচারুরূপে আদায় করার তাওফীক দেন। আমীন! এর চেয়ে বেশী আমার আর কিছুই চাইবার নেই। চাইবার ইচ্ছাও নেই। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা তোমাকে যেন সেই মর্যাদায় উন্নীত করেন এবং তোমাকে দৃঢ়পদ রাখেন। আমীন!

আলী! তৌমাকে আরও একটি উপদেশ দিচ্ছি এই শর্তে যে, তুমি তা মেনে চলবে। তোমার পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া কিতাবগুলো কাজে লাগাও এবং এ ব্যাপারে পূর্ণ সচেতনতা অবলম্বন কর। কোন কিতাব যদি না থাকে তবে সেটি আবদুর মতামত সাপেক্ষে কিনে ফেল। অবশিষ্ট কিতাবাদি তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। এর ভেতর দিয়ে তোমার সৌভাগ্য প্রকাশিত হবে এবং কিতাবগুলো নষ্ট হবে না আর বুযুর্গরাও খুশী হবেন। এই সুবাদে আমার অপার ইচ্ছা রয়েছে যে, তুমি এসব কিতাবের খেদমত করবে। আমার আম্মার সবচে বড় আকাঙ্ক্া ও চিস্তা এই ছিল যে, আমি যেন

আমার বড় ভাইয়ের নির্দেশনায় চলি, তিনি যা বলেন আমি যেন চোখ বুজে তা মেনে নিই এবং সে মুতাবিক কাজ করি। তিনি তাকে সকল গুণের আধার ও আমাদের খান্দানের মর্যাদার প্রতীক ভাবতেন । -. আমাদের খান্দানে হযরত শাহ আবৃদুল কাদিরের কুরআনুল কারীমের তরজমা ও তাঁর তাফসীর মুধীহুল কুরআনকে (যা প্রাচীন তরজামাসমূহের হাশিয়ায় মুদ্রিত হয়েছে) সর্বদাই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং একে মহিলাদের ও লেখাপড়া জানা পুরুষদের পড়াশোনার সিলেবাস গণ্য করা হত। মনে হয় ভাইজানের অব্যাহত তাকীদ সত্তেও প্রতিদিন এটা পড়বার ও চোখ বুলাবার ক্ষেত্রে আমি অলসতা করতাম এবং বেশীর ভাগ সময় সাহিত্যমূলক ও হান্কা ধরনের বই-পুস্তক পড়ার ভেতরই মগ্ন থাকতাম । সম্ভবত ভাইজান কোন পত্রে আম্মার নিকট এ ব্যাপারে অভিযোগ করে থাকবেন । অতঃপর আম্মা আমাকে যে দীর্ঘ পত্র পাঠিয়েছিলেন এখানে তার উদ্ধৃতি পেশ করা হচ্ছে।

“যখন তুমি এখানে ছিলে তখন আবদু বিশেষভাবে লিখেছিল যে, শাহ আবৃদুল কাদির (রহ.)-এর তরজমা দৈনিক পড়বে এবং এ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা, করবে । কিন্তু তুমি তার হুকুম তামিল করনি। আমি তাড়া করে এসেছি এবং প্রতিদিন এটা বলেছি আর তুমি তা এড়িয়ে গেছ এবং এ বই সে বই নিয়ে মেতে থেকেছ। আমার অত্যন্ত অপছন্দনীয় ছিল, কিন্তু এতটা খারাপ ভাবতে পারিনি । সেই চিঠি দেখে আমার যতটা কষ্ট হয়েছে তা আমি বলতে পারবো না। এমনিতেই তো' তখনকার অরবস্থাদৃষ্টে আমার নিজেরই এতমিনান ছিল না। কিন্ত্ব এক্ষণে এই মুহূর্তে সমস্ত আশা-ভরসা বিপজ্জনক ও ভয়াবহরূপে দেখতে পাচ্ছি।

আলী! তোমার এই অযোগ্যতা ও অপদার্থতা আমাকে খুবই পীড়া দিচ্ছে। তোমা থেকে আমি এমনটি আশা করি না, আর এমন আশা ছিলও লা। আমার ধারণা ছিল যে, তুমি তোমার প্রিয় ভাইজানের সমচিস্তার অনুগত হবে। আর এই ধারণাতেই আমার তুষ্টি ও প্রশান্তি ছিল। কিন্ত আফসোস! এমন ভাই, যে তোমাকে নিজের জানের চেয়েও ভালবাসে, স্নেহ করে এবং নিজের সকল শক্তি-সাধনা দিয়ে তোমাকে গড়ে তুলবার জন্য প্রস্তুত, তার সকল চেষ্টা-সাধন। ব্যর্থ করে দেবে, তীর সমস্ত হক ভুলে যাবে এবং বেপরোয়া ও স্বাধীন হয়ে যাবে । এতো তোমার সেই ভাই, যে তোমাকে এমন এক নাুক মুহূর্তে আশ্রয় দিয়েছিল, তোমার সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল, যখন একমাত্র আল্লাহ ভিন্ন আর কেউ দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না।

আমি তোমার লেখাপড়ার ব্যাপারে অস্থিরতা প্রকাশ করতাম । সে নিজেই পেরেশান ছিল। তোমার জন্য সে নিজেই পরিশ্রম করেছে। তুমি যা কিছু লাভ করেছো তা তারই বদান্যতা ও অনুগ্রহের ফসল । দেখ, এটা ইলম আর আমল তাকে বলে। তুমি সাহিত্যের ময়দানে যতই অগ্রসর হও না কেন তুমি কখনই আবদুর সমকক্ষ হতে পারবে না এবং তার মধ্যে যেসব মহৎ গুণাবলী রয়েছে তাও তুমি অর্জন করতে পারবে না। কেননা এই মুহূর্তের ধ্যান-ধারণা তোমাকে সেই সুযোগই দেবে না।

আবদুর মত একজন আলেম, পঞ্তিত ও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি যদি তুমি আরেকজন দেখতে চাও তাহলে দেখতে পাবে না। তোমাদের খান্দানের বা কিছু ভাল সবকিছুর সমাবেশ আবদুর ভেতর পাবে।

সামনে অথসর হয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ, উদ্যমশীলতা ও চিরাচরিত ছাত্রসুলভ গুণাবলীর প্রতি উপদেশ দান করতে গিয়ে লিখেছেন £

“সবকিছুর প্রতি আগ্রহ অর্থহীন ভেবো। যাদের এ ধরনের মন-মেজায তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ো লা। একজন ছাত্রকে কেবল পড়াশোনাই করা উচিত। পরিধেয় কাপড় ছেড়া হোক কিংবা জুতা ফাঁটা, এতে লজ্জার কিছু নেই, বরং-এর জন্য গর্ববোধ করা দরকার । এমন অবস্থাই কল্যাণ ও মঙ্গলের কারণ হয়। এসব কষ্টের মধ্যেই ইলমের কদর হয়। বুদ্ধিমান ও সৌভাগ্যবান সেই, যে দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য বস্ত লাভ করে, আর তা হল শরীয়তের পাবন্দী। এক্ষণে ইলম সর্বসাধারণের জন্য সহজলভ্য হয়ে গেছে। যে কেউ তা সহজেই লাভ করতে পারে। দু-চারটে বই-পুস্তক কিংবা কিতাবাদি পড়ল, ব্যস! ছেলে আমার লায়েক হয়ে গেছে। হাজারও বিপদ-আপদ চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। এই চিঠি যদি মন চায় গভীর মনোযোগের সাথে দেখবে এবং বার বার পড়বে ।”

আরও একটি পত্রে ছীনী ইলম তথা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন ও আরবী শিক্ষার প্রতি পূর্ণ মনোনিবেশ প্রদান ও এক্ষেত্রে বিশিষ্টতা অর্জন এবং পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গদের পদাংক অনুসরণের ওপর জোর তাকীদ দিতে গিয়ে লিখেছেন “এখন আরবী শেখার জন্য পরিশ্রম কর। কিন্তু তা নিয়ম বহির্ভূতভাবে নয়। স্বাস্থ্যের দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখবে । যদি শরীর ভাল থাকে তো সব ভাল, যা চাও হাসিল করতে পারবে । তুমি যতটা পরিশ্রম ইংরেজীর বেলায় করেছ আরবীর বেলায় তা করলে এতদিনে অনেক কিছুই হাসিল হয়ে যেত। মনোযোগ দিয়ে এখনও যেসব কিতাবাদি পড়নি, পড়তে পারনি সেগুলো পড়ে ফেল। যতটা সম্ভব আগের যুগের আলেম-উলামার মত যোগ্যতা সৃষ্টি কর। যেগুলো শরীয়ত বিরুদ্ধ নয় সেগুলোই শিখতে চেষ্টা কর। সমস্ত মাসআলা- মাসায়েল খুব ভালভাবে অবগত হও । এই মুহূর্তে এই ইলমেরই প্রয়োজন ।

এখনকার আলেম-উলামারা তেমন কিছু জানে না এবং তারা ফেতনা সৃষ্টি করে। আমার অন্তরের কামনা, তুমি ইলমের ময়দানে সেই মর্যাদা অজনি কর যে মর্যাদা বড় বড় আলেম-উলামা অর্জন করেছিলেন। যাদের দেখবার জন্য আমার চোখ ব্যাকুল ও উন্মুখ, যাঁদের কথা শোনার জন্য কান অধীর আগ্রহী এবং অন্তর বেকারার। আলী! এর চেয়ে বেশী আমার আর কোন আকাজ্ষা নেই, অভিলাষ নেই। আল্লাহ তাআলার দরবারে দোয়া করছি, তিনি যেন তোমাকে সে গুণাবলী দান করেন যাতে সে যুগ আবার ফিরে আসে । আমীন!”

আরেকটি পত্রে লিখেছেন[সম্পাদনা]

আলী! আল্লাহর অপার রহমতের কাছে আমার গভীর প্রত্যাশা যে, তুমি সম্মান ও সফলতা দৃষ্টে প্রভাবিত হবে না। কেননা অন্যের সম্মান ও সফলতা দৃষ্টে প্রভাবিত হওয়াই সাধারণ নিয়ম। এগুলো অস্থায়ী ও নশ্বর। ঈর্ষাযোগ্য তো তাই ঘা হাজারে একজন পায় আর এ পাওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। ৪) ০৮০৪ 55 ০০৮৪ ০৯ ভ্ড শি ০8 এও উল এলি গড পস্পদ এ বন্টনকারী মহান সন্তা নিজ হাতে করেছেন বন্টন যাকে যার যোগ্য পেলেন তাকে জাই করেছেন অর্পণ । "তোমার এ জন্য অত্যন্ত সাহস ও শক্তির সাথে গর্ব করা উচিত। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তোমার মধ্যে এর প্রতি এমন আকর্ষণ সৃষ্টি করে দেন যাতে তুমি সবকিছুর উপরে একে প্রাধান্য দাও। তুমি যদি জজ হতে কিংবা এ ধরণের আরও কোন সম্মান বা পদমর্ধাদা লাভ করতে যা সাধারণে পেয়ে থাকে তবুও আমি তার ভেতর হাজারো বিপদাশংকা অনুভব করতাম। তিনি আমাকে সর্বপ্রকার মন্দের হাত থেকে নিরাপদ থাকার জন্য এমন সবোর্তিম উপায় নির্বাচন করেছেন যাতে স্বয়ং রক্ষকও পাহারাদার হবে। আমার চিন্তার কোন দরকার হবে না, কেবল একটাই চিন্তা যেন আমার হৃদয় মানস সর্বদা এমন এক খুশিতে ভরপুর ও উদ্বেলিত থাকে যা কোন বড় থেকে বড় মর্যাদার অধিকারী লোকেরও নেই ।” তীর বড় অভিলাষ ছিল যে, আমি নির্ভেজাল ধর্মীয় ওয়াজ-নসীহত করব, আল্লাহ্‌ ও তদীয় রাসূলের বিধিবিধান শোনাবার যোগ্য হব।

==== হাকীম মাওলানা সাইয়েদ আবৃদল আলী সংক্ষিপ্ত পরিচয় ====

মাওলানা আলী মিয়ার বড় ভাই হাকীম সাইয়েদ আবদুল আলী ছিলেন প্রখ্যাত এতিহাসিক আলেমে দ্বীন, নাষেমে দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামা, হযরত মাওলানা হাকীম সাইয়েদ আবদুল হাই (রহ.) এর বড় সাহেবযাদা। তিনি ১৮৯৩ সালের পহেলা ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি ১৯০১ সালে মাকে হারান। প্রাথমিক শিক্ষা নিজ নানা এবং দাদাবাড়ীতে শেষ করার পর তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা লাভের জন্য নদুয়ায় ভর্তি হন। এ সময় তাঁর পিতাও লাখনৌতে অবস্থান করছিলেন। নদুয়ার দফতর এ সময় শাহজাহানপুর থেকে লাখনৌ আসে । সাইয়েদ আবদুল আলী ১৯১০ সালে দেওবন্দে যেয়ে হযরত শায়খুল হিন্দের দরসে হাদীছে শরীক হন। " আল্লামা আনওয়ার শাহ সাহেবের নিকটও তিনি অধ্যয়ন করেন। তিনি সেখানে একবছর অবস্থান করার পর ১৯১২ সালে লাখনৌ ফিরে আসেন ।

তিব বা চিকিৎসাশান্ত্রে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিদ হাকীম আজমল খান এবং ডাক্তার মোখতার আহমাদখানের নিকট দিল্লী পাঠান। সেখানে তিনি ছয় মাস. অবস্থান করে চিকিৎসা শাস্ত্রে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। দিল্লীতে তিনি আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতিও ঝুঁকে পড়েন। এবং ইংরেজী শিক্ষা ছাড়া আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করা যে কষ্ট তা বুঝতে পারেন। এঁ সময় তার বয়স ২১/২২ বছর। এরপর তিনি ইংরেজী শিক্ষা শুরু করেন এবং প্রথম ক্লাশ থেকে শুরু করে বি.এস.সি পাশ করে ১৯২০ সালে লাখনৌ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ভর্তির তৃতীয় বা চতুর্থ বছরে হঠাৎ করে ১৯২৩ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী তার পিতার ইন্তেকাল হয়। তিনি তখন কলেজের পক্ষ হতে মান্রাজের এক সফরে ছিলেন। বোম্বাই এসে তিনি পিতার ইন্তেকালের সংবাদ পান।

সাইয়েদ আবদুল হাই এর ইন্তেকালের ফলে সংসারের সকল দায়িত্বের বোঝা সাইয়েদ আবদুল আলী (রহ.) এর উপর এসে পড়ে। সংসারে অভাব অনটন পূর্ব হতেই লেগেছিল। পিতার ইন্তেকালে তা আরো ঘনীভূত হয়। একদিকে সংসার চালানো অন্যদিকে কলেজের বড় ধরনের খরচ চালানোর ভারে তিনি মুষড়ে পড়েন। পিতার বন্ধু বান্ধব ও আত্রীয় স্বজনরা এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। কলেজ থেকে পাস করার পর হযরত মাওলানা আবদুল আলী সাহেব ১৯২৬ সলে লাখনৌতে চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহ.)-এর হাতে বায়আত হন এবং হজ্জ্ব করেন। পিতার ইন্তেকালের পর ডাক্তার সাহেব ১৯২৩ সালে নদওয়ার রূফনে ইন্তেজামী, ১৯৩০ সালে নায়েবে নাযেম এবং ১৯৩১ সালে নযেষে নদওয়াতুল উলামা নির্বাচিত হন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দীর্ঘ তিরিশ বছর এ খেদমতে নিজকে নিয়োজিত রেখে ১৯৬১ সালের নই মে লাখনৌতে ইন্তেকাল করেন।

বড় ভাই এর তরবিয়ত[সম্পাদনা]

পর্যন্ত ভাই বোনদের সাথে তার মহব্বতের তেমন অনুভূতি হয়নি। পিতার ইন্তেকালের সাথে সাথে তার মধ্যে এক নতুন ব্যক্তিত্ব জেগে ওঠে । যার মধ্যে পিতৃসুলভ আচরণ লক্ষ করা গিয়েছিল। এ সময় তিনি এ সব ইয়াতীম ভাই বোন এবং বিধবা আম্মাজানের সকল প্রকার তন্বাবধানকে নিজের সবচাইতে বড় দায়িত্ব মনে করেছিলেন. বিশেষ করে ছোট ভাই আলীকে মানুষের মত হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার চিন্তার অন্ত ছিল না। আলী মিয়ার তালীম এবং তরবিয়তে তিনি তার সকল অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা সফলভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন।

লাখনৌতে বড় ভাই ডাক্তার আবৃদুল আলী সাহেবের অবস্থান ও কাজকর্ম ভালভাবে শুরু হলে ছোট ভাই আলী মিয়ীকে তার নিকটে নিয়ে আসেন। এখানে এসেও তার বোস্তী পাঠ অব্যাহত থাকে। লাখনৌতে দু'ভাই অবস্থান করতেন নবাব নূরুল হাসান খানের বাড়িতে। অত্যন্ত জীকজমকপূর্ণ বাড়ী ছিল এটি। লোকজনের সমাগমও হত প্রচুর পরিমাণে । এই পরিবেশে বড় ভাই দু'টি বিষয়ের প্রতি অত্যন্ত কঠোরভাবে লক্ষ্য রাখতেন। প্রথমতঃ নামাযসমূহ যেন জামাআতের সাথে আদায় করা হয়। হযরত নিজেই বর্ণনা করেছেন- বড় ভাই মেডিকেল কলেজ থেকে সাধারণত মাগরিবের পরে ফিরতেন। এসেই "তিনি যোহর, আসর ও মাগরিবের নামায জামাআতের সাথে আদায় করা হয়েছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করতেন। আমি হাঁ সূচক জবাব দিতাম । কখনো সামান্য সন্দেহ হলে, আমাকে দ্বিতীয়বার নামাঘ পড়তে বাধ্য করতেন।

দ্বিতীয় যে বিষয়ের প্রতি বড় ভাইয়ের বিশেষ লক্ষ্য ছিল, তা হলো ছোট ভাই আলী মিয়া যেন নবাব বাড়ীর কর্মচারীদের সাথে বেশীক্ষণ সময় না কাটায় এবং তাদের সাথে খোলামেলা সম্পর্ক সৃষ্টি না করে। তাছাড়া কোন উপন্যাস ইত্যাদি যেন কারো কাছ থেকে নিয়ে না পড়ে। ছোট ভাইয়ের পাঠ করার জন্য তিনি নিজেই বই নির্বাচন করে দিতেন এবং পাঠ করাতেন। হযরত বলেন, খুব সম্ভব বড় ভাই আমাকে সর্বপ্রথম পড়তে দিয়েছিলেন সীরাতে খায়রুল বাশার, অতঃপর রহমাতুল্পসিল আলামীন । ছিল ফারসী ভাষা ও সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি অর্জন করা । পিতা সাইয়েদ আব্দুল হাই ও বড় ভাই ডাক্তার আবৃদুল আলী ফারসী ভাষা ও সাহিত্যে অনেক পারদর্শী ছিলেন। হযরত মাওলানা আলী মিয়া তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন_ আমি আমার পিতাকে অনেক দিন যাবত দেখেছি তিনি আমার বড় ভাইয়ের কাছে পত্র লিখতেন ফাসীতে। কিন্তু বড় ভাই ডাক্তার আবৃদুল আলীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। তিনি জানতেন যে, ভারতে ফাসীর যুগ শেষ হতে চলেছে এবং আরবী ভাষার যুগ অতি অল্প কালের মধ্যে শুরু হবে। তাই তিনি ছোট ভাইয়ের ফার্সী শিক্ষা বেশী দূর এগুতে দেননি। তখন আলী মিয়া মাওলানা মুহাম্মাদ ফারুক চিড়িয়াকোটীর নিকট ফাসীতে এ পরিমাণ যোগ্যতা অর্জন করেন যে, তাসাউফের কিতাবাদি, মাকতুবাতে ইমামে রব্বানী, ইযালাতুল থেফা ইত্যাদি অধ্যয়ন করার যোগ্যতা অর্জন হয়েছেন।

ডাক্তার সাহেব আলী মিয়ার ফাসী শিক্ষা এখানেই শেষ করে দেন এবং ইংরেজীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করান। অপর দিকে আরবী শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থাও গ্রহণ করেন। এবং তার জন্য এমন এক পাণ্ডিত্যপূর্ণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন যাকে.আল্লাহ পাকের বিশেষ তাওফীক ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এ সময়ের বাস্তব অবস্থা এটাই ইশারা দিচ্ছিল যে, আলী মিয়াকে স্বাভাবিক নিয়মে নদওয়ায় ভর্তি করানো হবে। কারণ ডাক্তার সাহেব নিজেই এঁ সময় নদওয়ায় দায়িতৃশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কিন্তু এটি একটি কুদরতী ব্যবস্থাপনা ছিল এবং কুদরতের পক্ষ হতে হযরত মাওলানাকে সারা বিশ্বে যে ইসলাহী এবং সাংস্কৃতিক খেদমত আজ্জাম দিতে হবে এবং যেভাবে আরবদের মাঝে বক্তব্য রাখতে হবে এবং তাদেরকে তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সজাগ করতে হবে, এ মহৎ চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ডাক্তার সাহেব আলী মিয়াকে দ্বীনী শিক্ষার পথে ধাবিত করেছিলেন।

আরবী শিক্ষার শুরুতে খান্দানের লোকেরা ডাক্তার সাহেবের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে বলেছিলেন আলীকে আধুনিক শিক্ষা দেয়া উচিত। তাকে আই. সি. এস. এর জন্য প্রস্তুত করা উচিত। জবাবে ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন, আব্বাজান বেচে থাকলে আলীকে যা পড়াতেন আমি সে শিক্ষাই আলীর জন্য নির্বাচিত করেছি।

একবার লাহোরে হযরতের ফুফা মাওলানা সাইয়েদ তালহা সাহেব সেখানকার ওরিয়েন্টাল কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপ্যাল মৌলভী মুহাম্মদ শফী সাহেবের সাথে আলী মিয়ার পরিচয় করান এবং তার কাছ থেকে আলী মিয়ার পড়াশুনার ব্যাপারে পরামর্শ চান, যে আলীর কোন লাইনে পড়াশুনা করা উচিত। মুহাম্মাদ শফী সাহেব হযরত আলী মিয়ার এ সময়ের কিছু আরবী যোগ্যতা এবং কিছু লেখা-লেখি দেখে ভবিব্যদ্বাণী করেছিলেন, এ ছেলে যেন আরবীকেই তার জীবনের উদ্দেশ্য বানায় এবং এ ভাষাতেই যেন সে বিশেষজ্ঞ হয়।

আরবী রচনা এবং অনুশীলনে বুৎপত্তির জন্য ডাক্তার সাহেব এক বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেন। হযরত সাইয়েদ আহমাদ শহীদের উপর আরবীতে প্রথম প্রবন্ধ হযরত ডাক্তার সাহেবের তন্বাববানেই তিনি রচনা করেন। এর ফলে কয়েকটি ফায়েদা হয়েছিল এক আরবীতে প্রবন্ধ রচনার অনুশীলন দুই হযরত সাইয়েদ আহমাদশহীদের সংস্কার আন্দৌলনের উপর জ্ঞান লাভ এবং তার সাথে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি । ডাক্তার সাহেব তাঁকে হেদায়েত দিয়েছিলেন যে, প্রবন্ধ প্রস্তুত করার পূর্বে তিনি যেন ইতিহাস এবং জীবনী বিষয়ক বিখ্যাত প্রস্থাবলী প্রথমে মোতালা'আ করে নেন এবং কিছু কিছু বিষয় নোট করতে থাকেন। এবং প্র সব গ্রহ্থের বিভিন্ন ভাষা, উপমা, পরিভাষা ইত্যাদি যেন ভালো করে আয়ত্ব করে নেন। এ প্রেক্ষাপটে তিনি ইবনে আসিরের আল- কামেল খুব ভাল করে অধ্যয়ন করেন। এ গাইড লাইন পেয়ে হযরত আলী মিয়ী এ সময় হযরত সাইয়েদ সাহেবের উপর এমন এক প্রবন্ধ রচনা করেন যা পরবর্তী সময় তিনি তা তার প্রাণপ্রিয় উস্তাদ শায়খ তাকীউদ্দীন হিলালীর মাধ্যমে মিসরের বিখ্যাত আলেম আল্লামা রশিদ বেঘার নিকট পাঠিয়ে দেন এবং আল-মানার পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। পরে পৃথকভাবে পুম্তিকা আকারেও তা ছাপানো হয়। এ ছাড়া পত্রিকার কিছু কিছু প্রবন্ধ আলী মিয়ার দ্বারা উর্দূতে তরমজা করান এবং তা “যমীনদার" পত্রিকায় ছাপা হয়।

ডাক্তার সাহেবের জেহেনে বড় প্রশস্ততা (13799011716) এবং চিন্তাধারায় ছিল ব্যাপকতা । মুসলিম বিশ্বের অবস্থা সম্পর্কে তিনি সজাগ ছিলেন। এজন্য আরবী পত্র পত্রিকা খুব পড়তেন। অনেক পত্র পত্রিকা ঘরে আসতো । হযরত আলী মিয়া এ সব পত্র পত্রিকা হতে খুব লাভবান হতেন । ডাক্তার সাহেব ছোট ভাইকে পথ প্রদর্শন করতেন। নতুন নতুন বাচন ভঙ্গি এবং পরিভাষার ব্যাখ্যা দিতেন। এভাবে আস্তে আস্তে হযরত আলী মিয়া আরবী ভাবা এবং সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে থাকেন ।

ডাক্তার সাহেবের হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী, হ্যরত সাইয়েদ আহমাদশহীদ, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম ইবনে কাইয়েম এর উপর বড় আকীদা ছিল এবং তাদের লিখিত কিতাব পত্রের সাথে গভীর সম্পর্ক ছিল। আলী মিয়াকে তিনি এ সব মনীষীদের গ্রস্থাবলী পড়তে তাকীদ করতেন।

ডাক্তার সাইয়েদ আবদুল আলী (রহ.)-এর মাওলানা আলী মিয়ার ইসলাহ ও তরবিয়ত এবং সকল ধরণের দ্বীনী তরকীর সবসময় ইহতিমাম থাকত। এজন্য তিনি আলী মিয়াকে সর্ব প্রথম সীরাতের মাদরাসায় ভর্তি করেন। এবং সীরাত ব্ষিয়ক কিতাব পত্র তাঁকে পড়তে দেন। ডাক্তার সাহেব সর্ব প্রথম নদওয়ার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মদ আলী ম;গিরি এবং শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রহ.) এর নিকট বায়াত হবার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন কিন্তু সে সুযোগ না পাওয়ায় তাদের ইন্তেকালের পর শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমাদ মাদানীর কাছে তিনি বায়আত হন। হযরত মাদানী (রহ.) লাখনৌ এলে ডাক্তার সাহেবের বাসাতেও অবস্থান করতেন। এ সুবাদে হযরত মাদানী আলী মিয়াকে মহব্বত করতেন। পরবর্তীতে ডাক্তার সহেব আলী মিয়াকে চার মাসের জন্য হযরত মাদানীর সহচর্য লাভের এবং দরসে হাদীছে অংশ. গ্রহণ করার জন্যদেওবন্দে পাঠিয়ে দেন। ১৯২৮ সালে হযরত হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, (রহ.) লাখনৌ তাশরীফ নিয়ে আসলে, ডাক্তার সাহেব নিজেও পাবন্দীর সাথে মজলিসে হাজিরা দিতেন এবং আলী মিয়াকেও নিজের সাথে জরুরী ভিত্তিতে নিয়ে যেতেন।

হযরত আলী মিয়ার দ্বীনী উন্নতি এবং ইসলাহী খেদমতের মকবুলিয়াতের জন্য ডাক্তার সহেব সব সময় চিন্তিত থাকতেন । নিজ শায়খ হযরত মাদানীকে তিনি এক পত্রে লিখেছিলেন যে, “মনে চায় যেভাবে হযরত সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহ.) হতে আল্লাহ পাক ইসলাহী এবং জিহাদী খেদমত নিয়েছেন আলীর থেকে যেন তার চেয়েও বেশী খেদমত কবুল করেন ।”

হযরত মাদানী (রহ.) পত্রের জবাবে ডাক্তার সাহেবকে লিখেছিলেন, “এ কারীম রাব্লুল আলামীন আলীকে যেন কল্যাণের চাবী এবং অকল্যাণের প্রতিরোধক বানান এবং হযরত সাইয়েদু সাহেবের সাংস্কারিক কর্মকাণ্ডের ধারক ও বাহক বানিয়ে ইলমে লাদুন্নি দান করেন, আলীর জন্য এই দু'আই করি ।” ডাক্তার সাহেব আলী মিয়ার জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করতেন। ১৯২৯ সালে আলী মিয়ী এক পরীক্ষায় খুব ভালো নম্বর পেলে ডাক্তার সাহেব তাকে তৎকালীন বিশ টাকা পুরস্কার দিয়ে বলেছিলেন তোমার শিক্ষক মণ্ডলী ও সহপাঠীদের দাওয়াত করো। পরেই আবার বলে ওঠেন, না না এতে তেমন ফায়েদা হবে না বরং এ টাকাটা মদীনা শরীফের মাদরাসা উল্গুমে শরইয়্যায় পাঠিয়ে দাও । হযরত তাই করেছিলেন।

লাখনৌতে একজন ডাক্তার ছিলেন তিনি মেডিকেল সার্টিফিকেট দিতে কোন সতর্কতা অবলম্বন করতেন না। একদিন তার উপর সমালোচনা শুরু হলে আলী মিয়্াও তাতে শরীক হন। ডাক্তার সাহেব সাথে সাথেই আলী মিয়াকে বাধা দেন এবং বলেন যে, ছোট বেলায় তুমি সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে পড়লে এই ডাক্তারই তোমাকে অনেক সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। অতএব তার প্রতি তোমার শুকরিয়া আদায় করা দরকার । তার ভালো দিকের আলোচনা করা দরকার। এভাবে ডাক্তার সাহেব আলী মিয়ার তরবিয়ত করতেন। হযরত আলী মিয়ার বর্ণাট্য জীবন বিনির্মাণে বিভিন্ন ধরণের ব্যক্তিত্বের অবদান ছিল এতে কোন সন্দেহ নেই তবে এর মধ্যে চার জন ব্যক্তিত্বের অবদান ছিল বুনিয়াদী। যার সারাংশ এভাবে নেয়া যেতে পারে-

১) হযরত আলী মিরার মধ্যে ইখলাছ, লিল্লাহিয়াত, দ্বীনী মূল্যবোধ, দাওয়াতী জজবা, ইসলাহ ও সংস্কারের খেদমতের বুনিয়াদ পড়েছিল, - হযরত সাইয়েদ আহমাদশহীদ বেরলভীর সীরাত এবং জিহাদী কার্যক্রমের প্রভাবে

২) ইতিহাস এবং আরবী সাহিত্যের জওক পয়দা হয়েছিল হযরতের স্বনামধন্য পিতা নাযেমে নদওয়াতুল উলামা হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবৃদুল হাই (রহ.)-এর প্রভাবে, পৈত্রিক সুত্রে।

৩) কবুলিয়াত, গ্রহণযোগ্যতা এবং সম্মান লাভ করেছিলেন তিনি তাঁর মহীয়সী মাতা খায়রুন নিসার সার্বক্ষণিক দিল নিংড়ানো দুআ এবং আহাজারির কারণে ।

৪) আর আলী মিয়ার এতিহাসিক জীবন বিনির্মাণে সব চাইতে বড় অবদান রেখেছিলেন তারই যোগ্য বড় ভাই, ডাক্তার মাওলানা সাইয়েদ আবদুল আলী সাহেব । বড় ভাই এর তরবিয়তে, তার মধ্যে চিন্তার সমন্বয় এবং মেধাজের মধ্যে ভারসাম্যতা এসেছিল ।

এ প্রসঙ্গে হযরত আলী মিয়া তার আতুজীবনীতে লিখেছেন যে, আল্লাহ তাআলা যা কিছু খেদমতের তাওফীক দিয়েছেন এবং আরবদের সামনে কথা বলার এবং তাদের দায় দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়ার সুযোগ দিয়েছেন এ সবই আমার সম্মানীত পিতার ইখলাহু, আম্মাজানের দূআ, ভাই সাহেবের তরবিয়ত এবং শিক্ষক ও মাশায়েখের দুআ, মহব্বত ও শফকতেরই ফসল।

ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষা পদ্ধতি[সম্পাদনা]

তিনি নিজেই বলেন- “আমার শিক্ষা জীবনের গতিধারা অন্যদের তুলনায় ছিল একটু ভিন্ন প্রকৃতির । আমার শিক্ষা কার্যক্রমে আমি একটি বিরাট সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিলাম। সেই সুযোগকে শুধু সুবর্ণ সুযোগ বলেই চুপ থাকতে চাই না; বরং আমি তাকে আখ্যা দেই এক এশিদান হিসাবে । আর সেটি হল- আমি আমার ছাত্রজীবনে একটি একটি করে বিষয় আলাদাভাবে পড়েছি। একই সাথে বিভিন্ন ধরনের বিষয় পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। সুচিন্তাশীল অভিভাবক আল্লামা আরব সাহেব (রহ.) সর্বপ্রথম আমার আরবী সাহিত্যের পর্ব সেরে দেন। এ বিষয়ে পূর্ণতা অর্জন করতে যেয়ে আল- মুতালাআতুল আরাবিয়ার মত পুস্তিকা থেকে শুরু করে নাহজুল বালাগাহ, হামাসা ও দালায়েলুল ইজায-এর মত উচ্াঙ্গের গ্রন্থাবলী একাধারে তিন বছর তিনি আমাকে পড়ান এবং আরবী সাহিত্য ও তার আনুষঙ্গিক বিষয়াবলী আয়ত্ত করে নিই। সুরুচী সম্পন্ন যোগ্য উস্তাদের সার্বক্ষণিক সান্নিধোর মাধ্যমে অল্প কিছুদিনের মধ্যে আরবী ভাষার সাথে আমার গড়ে ওঠে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।

আরব সাহেবের নিকট পড়বার সময়ই এক পর্যায়ে তিনি লাখনৌ জামেয়া কয়েকটি সুরার তাফসীর পড়েন। তারপর তিনি মাওলানা উবায়দুল্াহ সিঙ্গীর চিন্তাধারার সাথে প্রথম পরিচয় লাভ করেন। তাছাড়া এসময় বিশেষ করে রায়বেরেলীতে অবস্থানের সময়ে চাচা মাওলানা সৈয়দ তালহা সাহেবের নিকট নাহ্‌-ছরফ পড়েন। মাওলানা তালহা সাহেব ছিলেন নাহু-ছরফের ইমাম তুল্য । "১৯২৭ সালে তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে লাখনৌ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং ১৯২৭ সালে ফাষেলে আদব সনদ লাভ করেন। এতে তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম হন এবং স্বর্ণপদকের উপযুক্ত হন। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ফান্ড সংকুলান না হওয়ায় তকে পদক দেয়া হয়নি। অতঃপর তিনি ফাযেলে হাদীছের সনদও লাভ করেন। হযরত মাওলানার ভাষায় এই সনদের কোন মূল্যই ছিল না।

শায়খুল হাদীছ মাওলানা হায়দার হাসান খান[সম্পাদনা]

আরবী সাহিত্যের পর তিনি ফিকাহ তথা ইসলামী আইন নিয়ে অধ্যয়ন করেন। অতঃপর .তিনি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় শায়খুল হাদীছ মাওলানা হায়দার হাসান খান টুংকির হাদীছের দরসে নিয়মিত ছাত্র হন এবং দুই বছরে হাদীছ শান্তর অধ্যয়ন শেষ করেন। তার নিকট তিনি বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ ও তিরমিযী শরীফ পড়েন। বায়যাবী শরীফের কিছু অংশও আলাদাভাবে তীর নিকট পড়েন| মানতেকের কয়েকটি পাঠও তিনি নিজ আগ্রহে আলী মিয়াকে পড়ান ।

মাওলানা হায়দার হাসান খান ছিলেন মাওলানা আলী মিয়ার পিতার সহপাঠী । কেননা দু'জনেই ইমামে হাদীছ শায়খ হুসাইন ইবনে মুহসিন আনসারী ইয়ামেনী ভূগালীর ছাত্র। হাকীম সাইয়েদ আবৃদুল হাই এর অনুরোধ ও গীড়াগীড়িতেই তিনি দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামায় ' তাদরীসের খেদমতে যোগ দেন। তাই আলী মিয়ার প্রতি তাঁর মুরবীসূলভ নয় বরং পিতৃসূলভ ন্নেহ ও মনোযোগ। গানাহারের সময়ও তিনি আলী মিয়াকে কাছে রাখতেন। তাঁর ব্যক্তিগত খরচাদির হিসাব থাকত আলী মিয়ার নিকট । কোথাও যাবার সময় তিনি আলী মিয্লাকেই সাথে রাখতেন ।,

তাঁর হাদীছের দরসের পদ্ধতি ছিল খালেস মুহাদ্দিছ সুলভ, গবেষণামূলক । তিনি ছিলেন ইয়ামানের মুহাদ্দিছধশের বৈশিষ্ট্যসমূহের অধিকারী এবং শায়খ হুসাইনের দরসের হুবন্ প্রতিচ্ছবি । তিনি দরসের মধ্যে ছাত্রদের দ্বারা যাঁচাই, অনুসন্ধান ও গবেষণার পুরো কাজ নিতেন। ছাত্রদের নিছক শ্রোতা হয়ে থাকতে দিতেন না। বরং কিতাবসমূহ থেকে উদ্ধৃতি বের করতে, রিজালের কিতাব ও জারাহ তা"দীলের বিষয় অনুসন্ধানে এবং মাসআলা লিখতেও তাদের শরীক রাখতেন, যাতে ছাত্রদের দৃষ্টিভি প্রসারিত ও গভীর হয় এবং তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়। তিনি ছিলেন হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ) এর খলীফা। নামাযে তিনি বিগলিত ও আগত হয়ে পড়তেন। শেৰ রাতে দীর্ঘ তাহাজ্জুদ ও দীর্ঘ সিদজায় কাটাতেন আর কান্নাকাটি করতেন। জীবনযাত্রা ছিল অতি সাধারণ । ছাত্র ও সাথীদের সাথে অকৃত্রিমতা এবং সকল কাজে অংশ নেওয়া ছিল তার সহজাত অভ্যাস। তিনি কাউকে হাদীছের সনদ দিতে হলে সাধারণত সুন্দর হাতের লেখা দেখে কোন ছাত্রকে দিয়ে লেখাতেন এবং নিজে দস্তখত করতেন। কিন্তু আলী মিয়াকে তিনি নিজ হাতে সনদ লিখে দেন যা প্রস্তুত করতে তার পুরো একদিনের মত ব্যয় হয়েছিল। এ ছিল আলী মিয়ার প্রতি তার বিশেষ স্নেহ ও মমতার প্রমাণ ।

আল্লামা তাকী উদ্দীন হেলালী[সম্পাদনা]

রা কই সমরে দার উলূম নল উলামা আরবী ভা ও সাহিত্যের দিকপাল আল্লামা তাকি উদ্দীন হেলালী উত্তাদ নিয়োজিত হন। আলী মিয়া তখন তার বিশেষ খাদেম হিসেবে সর্বক্ষণ সাথে থাকতেন এবং আরবী ভাষা ও সাহিত্যের যে পাঠ তিনি হযরত খলিল আরব সাহেবের নিকট শুরু করেছিলেন তার পূর্ণতা হাঁসিল করেন।

এক সময়ে মাওলানা আলী মিয়া ইংরেজী শিক্ষার প্রতি খুব ঝুঁকে গড়েন। তখনকার মেত্রিক ও ইন্টার্মিডিয়েটের ইংরেজী সাহিত্য তিনি চর্চা করতে থাকেন। কিন্তু তার মায়ের তাতে মোটেই সায় ছিল না। তান পুত্রকে এ থেকে নিবৃত্ত হতে এবং দ্বীনী শিক্ষায় আরো মনোযোগী হতে বললেন। অগত্যা তিনি ইংরেজী শিক্ষা মূলতবী করেন।

লাখনৌ ইউনিভার্সিটি থেকে ফাযেলে আদব সনদ লাভ করার পর তিনি লাহোর সফর করেন এবং মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিক্গীর বিশিষ্ট ছাত্র শায়খুত_ ভাফসীর মাওলানা আহমাদ আলী লাহোরীর সাথে পরিচিত হন। কিন্তু তখন বেশীদিন তার তাফসীরের দরসে থাকতে পারেননি। অতঃপর ১৯৩০ ও ১৯৩১ সালে দু'বার তিনি মাওলানা আহমাদ আলী লাহোরীর নিকট" গমন করেন এবং তার দরসে শরীক হন। তাফসীর ব্যতীত মাওলানা লাহোরীর নিকট তিনি হ্জাতরাহিল বালেগার দরস দেন।

দারুল উলুম দেওবন্দে[সম্পাদনা]

১৯৩২ সালে তিনি হযরত মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রেহ.)-এর নিকট হাদীছের দরস নেয়ার জন্য দারুল উলুম দেওবন্দে গমন করেন। সেখানে তিনি প্রায় চার মাস অবস্থান করে হযরত মাদানীর নিকট হাদীছের' উপর বিশেষ করে দরস লাভ করেন। একই সময়ে তিনি হযরত মাওলানা এজায আলী (ব্ুহ.)-এর নিকট ফিকাহর দরস গ্রহণ করেন।

লাহোরের তফসীর প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ[সম্পাদনা]

দেওবন্দ থেকে ফিরে এসে তিনি লাহোরে যান এবং মাওলানা লাহোরীর তাফসীরের দরসে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। মাওলানা লাহোরীর তাফসীরের নিয়মিত দরস হত শাওয়াল থেকে যিকাআদাহ। এ দু'মাস দরস শেষে যে পরীক্ষা হয় তাতে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। মাদরাসা কাসেমুল উলুমে সনদ বিতরণ অনুষ্ঠান হয়। হযরত মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) প্রধান অতিথি হিসেবে সনদ বিতরণ করেন। এরই মধ্য দিয়ে মাওলানা আলী মিয়ার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে ।

বিবাহ[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদর্তী (রহ.)-এর বিবাহ হয় তাঁরই আপন মামাতো বোন সাইয়েদ আহমাদ সাঈদ সাহেবের কন্যা, শাহ যিয়াউন্নবীর পৌত্রী এবং মুন্সী সাইয়েদ আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের দৌহিত্রীর সাথে । নদওয়ার শায়খুল হাদীছ হযরত মাওলানা হায়দার হাসান খান বিয়ের খুতবা পড়েন। বড় ভাই ডাঃ আবৃদুল আলী অত্যন্ত ধুমধামের সাথে ছোট ভাইয়ের ওলীমা সম্পন্ন করেন, যাতে কোন ক্রমেই পিতার অভাব অনুভব না হয়। হযরত আলী মিয়া চিরজীবনই নিঃসন্তান ছিলেন। অবশ্য তার হাজার হাজার রূহানী সস্তান পৃথিবীময় ছড়িয়ে রয়েছে। ১৯৮৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর তাঁর স্ত্রী তৈয়েবুননেসা ইন্তেকাল করেন।

অধ্যাপনা ও আধ্যাত্মিকতা[সম্পাদনা]

অধ্যাপনা[সম্পাদনা]

শিক্ষক হিসেবে দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায়[সম্পাদনা]

১৯৩৪ সাল। হযরত মাওলানা আলী মিয়া তখন বিশ বছরের যুবক। নিয়মতান্ত্রিক লেখাপড়া শেষ করেছেন। এখন শুধু অধ্যয়ন এবং পরিশ্রমের পালা। যার কোন সীমা নেই। প্রকৃতপক্ষে সুনির্দিষ্ট শিক্ষা পদ্ধতি ও নেসাব হল; অধ্যয়ন, চিন্তা-ফিকির ও পূর্ববর্তীদের পরিশ্রমের ফসল থেকে লাভবান হওয়া এবং ইলমের বাগিচা থেকে উপকৃত হওয়ার একটি মাধ্যম মাত্র। তা মূলতঃ জ্ঞান-সমূন্রে বিচরণের প্রথম পদক্ষেপ, মনযিলে মকসুদ নয়। এ ণব্দের ব্যবহারকে অযথা ও ভুল ধারণা সৃষ্টিকারী বলে মনে করেন।

১৯৩১ সালের শেষের দিকে মাওলানা আলী মিয়া একবার শায়খ তাকীউদ্দিন হেলালীর সাথে আজমগড় গিয়েছিলেন এবং “দারুল বুছান্নিফীন”-এ কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। সেখানকার নিরিবিলি ও শক্ষার পরিবেশ প্রত্যক্ষ করে তিনি মুগ্ধ হন এবং তীর প্রচন্ড ইচ্ছা হয় ঈীবনের বাকী দিনগুলো সেখানেই কাটিয়ে দিবেন। মাওলানা সাইয়েদ নূলায়মান নদভী (রহ.)-এর নেগরানী ও নির্দেশনায় অধ্যয়ন ও লেখালেখির চাজ করবেন এবং সর্বনি্ন আয়ের উপর (যা তৎকালীন জীবনযাপনের নাধারণ বিচারে এবং দ্রব্যমূল্য অনুসারে বিশ পঁচিশ টাকার বেশী ছিল না) তুষ্ট রাকবেন। তিনি তাঁর উস্তাদ হেলালী সাহেবের কাছে এ ইচ্ছার কথা ব্যক্ত চরেন, যিনি তাঁর আরবী যোগ্যতা সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন। সম্ভবত হলালী সাহেব সাইয়েদ সাহেবের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেন, কিন্ত তিনি নাইয়েদ সাহেবের এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা এবং প্রতিক্রিয়া কি তা হযরত মাওলানার কাছে উল্লেখ করেননি । শুধু তাঁকে বলেছিলেন “তোমার জন্য পারুল উলুমই উপযুক্ত জায়গা ।” এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা তাঁর মাত্বজীবনীতে লিখেছেন যে, “তখন পর্যস্ত লেখালেখি ও রচনার জগতে ্ামার উল্লেখযোগ্য কোন যোগ্যতার প্রকাশ ঘটেনি। আর দারুল মুছান্নিফীন ইল রচনা ও গবেষণার অনেক উন্নত প্রতিষ্ঠান। ভবে আসল কথা হল হকমতে ইলাহী ॥

তিনি বলেন, দারুল মুছান্নিফীনকে যদি আমার কর্মক্ষেত্র হিসাবে নির্বাচন করা হত তবে আমার জীবনের ভিত্তি অন্যভাবে রচিত হত এবং আমার সমস্ত ব্যস্ততা ও অক্লবিস্তর যোগ্যতা শুধু লেখালেখি ও গবেষণার কাজেই সীমাবদ্ধ হয়ে যেত। "

১৯৩২ সালে দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা থেকে হযরত মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী (রহ.)-এর পরামর্শ ও নিদের্শনায় “আয-যিয়া' নামে একটি আরবী পত্রিকা বের হয়। সম্পাদক নিযুক্ত হন মাওলানা মাসউদ আলম নদভী । মাওলানা আলী মিয়া তাতে একজন নিয়মিত লেখক ও সহযোগী হিসাবে কাজ করতে থাকেন। তাঁর এই লেখালেখি ও সহযোগিতা ছিল সম্পূর্ণ অবৈতনিক। ১৯৩৪ সালে শায়খ তাকীউদ্দীন হেলালী নদওয়া ছেড়ে ইরাকে চলে গেলে মাওলানা মাসুদ আলম শায়খের সান্নিধ্যে যেতে চাইলেন। আর স্থলাভিষিক্ত করে যাওয়ার জন্য মনোনীত করলেন মাওলানা আলী মিয়াকে । মাওলানা আলী মিয়া তখন লাহোরে হযরত মাওলানা লাহোরীর সান্নিধ্যে অবস্থান করছিলেন। মাওলানা মাসউদ আলম নদভী পত্র মারফত তাকে নদওয়ায় উক্ত পদে কাজ করার জন্য আহ্বান জানান। সে মতে ১৫€ই জুলাই'১৯৩৪ সালে পরিচালনা পরিষদের বৈঠকে মাওলানা আলী মিয়াকে দারুল উলৃমের একজন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মাসিক সম্মানী ধার্য হয় চক্লিশ টাকা। প্রকৃতপক্ষে পত্রিকা সম্পাদনার কাজেই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কয়েকটি দরসও দিতে বলা হয়। নিয়মতান্ত্রিক মুদীররিস হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয় ১২ জুলাই ১৯৩৫ সালে ।

- "দারুল উলৃমে আসার পর হযরত মাওলানাকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর কিছু কিতাব পড়াতে দেয়া হয়। ইতিপূর্বে যা অধিকাংশই হযরত মাওলানা আব্দুর রহমান কাশগড়ী (রহ.) পড়াচ্ছিলেন। তিনি দারুল উলুমের একজন শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ব্যক্তি এবং আরবী ভাষায় দক্ষ কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন। আল্লামা কাশগড়ী পরবর্তীকালে কলকাতা ' আলিয়া মাদরাসায় যোগদান করেন। ভারত বিভক্তির পর তিনি ঢাকা আলিয়ায় চলে আসেন। ঢাকায়ই তিনি ইন্তেকাল করেন।

প্রথম বছর তাকে কুরআন মজীদের প্রথম দশ পারা, তিরমিধী শরীফ ২র খন্ড, খাজারীর “তারিখুল উমামিল ইসলামিয়্যাহ' ১ম অংশ এবং হামাসার “বাবুল আদব ওয়াল নিয়াবি ওয়াল মারাসি' পড়াতে দেয়া হয়। প্রাথমিক শ্রেণীতে মিসরের আরবী পাঠ্যপুস্তক “আল কেরাআতুর রাশীদা' অথবা কামেল কীলানির “হেকায়াতুল আতফাল'-এর এক অংশও দেয়া হয়েছিল । - দারুল উলুমের প্রশাসনিক ভবনের উত্তর-পশ্চিমাংশের অসম্পূর্ণ গম্ুজের পাশের কামরায় হযরত মাওলানার থাকার ব্যবস্থা হয়, যেখানে পূর্বে দারুল উলুমের প্রখ্যাত মুহতামিম শামসুল উলামা মাওলানা হাফিজুল্পাহ সাহেব বান্দুলী (রহ.) (যিনি ছিলেন ফখরুল মুতাআধখিরীন মাওলানা আবৃদুল হাই সাহেব ফিরিংগী মহল্পী (রহ.)-এর একজন বিশিষ্ট ছাত্র) দীর্ঘকাল অবস্থান করেছিলেন। এ কামরাতে মাওলানা মাসউদ আলম নদভীও থাকতেন। তার কারণে তা তাদের থাকার কামরাও ছিল আবার “আয-যিয়া' (আরবী পত্রিকা)-. এর দফতরও ছিল। তাদের দু'জনের মধ্যে এমন মিল ছিল যে, যেন বড়- ছোট ভাই, অন্তরঙ্গ বন্ধু, সব সময়ের সঙ্গী, সব কাজে পরিপূরক।

হযরত মাওলানার দরসে কুরআনের ক্লাসে বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান ও মেধাবী ছাত্র ছিল। অধিকাংশই বয়সে তাঁর বড় কিংবা সমবয়সী ছিল। তারা একুজন বিদগ্ধ ও অভিজ্ঞ উত্তাদের (মাওলানা কাশগড়ী রহঃ) কাছে কুরআনে কারীমের সে অংশটি পড়েছিল, যে অংশে আহকাম, আকায়েদ এবং ফিকহী আয়াত অপেক্ষাকৃত বেশী। তাই তাঁর জন্য অধ্যয়ন ও মেহনতের মাধ্যমে নিজেকে এ মূল্যবান দরসের উপযুক্ত প্রমাণের প্রয়োজন ছিল। মাওলানা মাসউদ আলম সাহেব ইখলাস ও সহমর্মিতা বশতঃ ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া তাকে জানাতেন এবং মনে মনে চাইতেন, তিনি যেন অযোগ্য প্রমাণিত না হন।

ছাত্ররা এক রকম সন্তুষ্টি প্রকাশ করে কিছু প্রশংসাও করেছিল; কিন্তু তিনি জ্দ্রতার সাথে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, আরো ব্যাপক অধ্যয়নের প্রয়োজন। মাসউদ সাহেব তাঁকে এ সম্পর্কে অবগত করান। তিনি কুতুবখানা থেকে তাফসীরের প্রাচীন বড় বড় কিতাব এবং গুরুতৃপূর্ণ ও বুনিয়াদী গরন্থাদি সংগ্রহ করলেন। কিছু কিছু তাফসীরের কিতাব যেমন- কাশশাফ, মাআলেমুত তানবীল এবং মাদারেক শব্দে শব্দে অধ্যয়ন করেন। তাফসীরের নতুন গ্রন্থসমূহ; যেমন- তাফসীরুল মানার ও মাওলানা আযাদ রচিত তরজুমানুল কুরআন থেকে তিনি পুরোপুরি সহায়তা নেন। দরসে ছাত্রদের প্রশ্নের জবাব প্রদানে আল্লামা আলুসী (রহ.)-এর রুহুল মা'আনী সবচেয়ে বেশী কাজে লাগত। আধুনিক জ্ঞান ও তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য মাওলানা আবৃদুল মাজেদ দরিয়াবাদী (রহ.)-এর সাথে তিনি পত্র যোগাযোগ শুরু করেন এবং নতুন নতুন প্রশ্নের সমাধানে তাঁর সাহায্য কামনা করেন। এজন্য তিনি কয়েকবার দরিয়াবাদ সফর করেন এবং মাওলানা দরিয়াবাদীর ইলমী মজলিসে অংশগ্রহণ করেন। তিনি অধ্যবসায় ও গভীর মনোযোগ সহকারে দরসের জন্য সর্বোত্তম প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় শিক্ষা বছর শেষ হওয়ার পূর্বেই ছাত্রদের পুরোপুরি আশ্বস্ত করতে সক্ষম হন।

দারুল উলুমের সাধারণ পরিবেশ[সম্পাদনা]

এ সময় হেলালী সাহেবের উপস্থিতির কারণে, বিশেষ করে “আয-যিয়া'- এর কার্যক্রম ও কিছু তরুণ উত্তাদের প্রভাবে (যাদের কাছে ছাত্রদের আসা- যাওয়া ছিল এবং তাদের কাছে ছাত্রদের প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্যতাও ছিল) গোটা দারুল উলৃমে আরবী ভাষা-সাহিত্য রচনা ও বক্তৃতা, উদ সাহিত্য ও ইতিহাস অধ্যয়ন ও চর্চার এক সুন্দর পরিবেশ গড়ে ওঠে এবং এই মানসিকতাই প্রাধান্য বিস্তার করে। “আয-যিয়া'-এর বদৌলতে মিসরের আহমাদ হাসান আয-যায়্যাতের 'আর-রিসালাহ', ডঃ আহমাদ আমীনের 'আস-সাকাফা' (যাতে মিসরের প্রখ্যাত, নির্বাচিত কলামিস্ট ও সাহিত্যিক বৃন্দের রচনা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হত) দারুল উলৃমে নিয়মিত আসত । "আয- যিয়া' ভারতের একমাত্র আরবী পত্রিকা হওয়ার কারণে তাতে অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তির আরবী কিতাব ও প্রবন্ধ, মন্তব্য ও সমালোচনার জন্য আসত ।

হযরত মাওলানা লিখেছেন, “আমাদের তখনকার সেই ছোট কামরা ও ক্ষুদ্র পরিবেশকে মনে হচ্ছিল বিশাল ভারতীয় সমুদ্ধে একটি আরবী দ্বীপ। এ ধরনের অধ্যয়ন ও পরিবেশের কারণে মিসর-সিরিয়ার কলামিষ্ট-সাহিত্যিক, গবেষক, প্রবন্কার ও সাংবাদিকগণ দারুল উল্মের শিক্ষা সমাপনকারী চিন্তাশীল ছাত্র-উত্তাদের সম্পর্কে এ পরিমাণে অবগত ও পরিচিত ছিলেন, যে পরিমাণে পরিচিত ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, সমালোচক ও প্রাবন্দিকগণের সাথে । বরং কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্যদের তুলনায় দারুল উলৃমের সাহিত্যিক ও কলমিস্টবৃন্দ বেশী পরিচিত ছিলেন। তারা নির্ঘিধায় তাদের গুণাবলী, দোবক্রটি, দ্বীনী ও চিন্তাগত ভ্রান্তি সম্পর্কে পর্যালোচনা করতেন এবং মর্যাদা ও স্তর চিহ্িত করতেন। হযরত মাওলান৷ বলেন, এর পুরোপুরি উপকার আমি তখন অনুভব করেছিলাম যখন ১৯৫১ সালে আমি মিসরে সফরে গেলাম। সেখানের কোন ব্যক্তিই আমার জন্য নতুন, যাদুকরী ও প্রভাব সৃষ্টিকারী ছিল না। সেখানে আমার কাছে নতুন কোন রহস্যও উন্মোচিত হয়নি। বহিপর্বিশ্বের এসব (রাষ্ট্রে যাদের সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক উন্নতি এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা মন-মস্তিষ্কে ছেয়ে থাকে) দ্বীনের একজন খাদেম ও মুবাল্পিগের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী বিষয় যে, কোথাও যাওয়ার পূর্বে সে সেখানকার শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে সমালোচনামূলক রচনা অধ্যয়ন করবে এবং সেখানকার শিরা-উপশিরা সম্পর্কে অবগত হবে।

এ সময়ের একটি আকর্ষণীয় ঘটনা । “আঙ্জবমানে ইসলাহ" আরবীতে একটি বড় ধরনের বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এর বিষয়বন্ত ছিল ৬৯৮ (খা ও ৫৭১ 751 ৬৯ ০৯ মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি কে? তরুণ প্রতিযোগীরা অত্যন্ত আবেগ-উদ্দীপনার সাথে এতে অংশগ্রহণ করে, যেন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নিবচিন এখনই করা প্রয়োজন এবং তার মস্তকে ভক্তি ও শ্রদ্ধার তাজ এখনই পরাতে হবে। এ বিতর্ক অনুষ্ঠানে সিরিয়ার একজন সাংবাদিক ইউনুস খায়রুদ্দীন দামেশৃকী উপস্থিত ছিলেন (যিনি দারুল উলৃম পরিদর্শনে এসেছিলেন)। মাসউদ সাহেবের অভিমত এবং তখনকার অনুষ্ঠানের সভাপতি হযরত মাওলানার সিদ্ধান্ত অনুসারে আমীর শাকীব আরসালান মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রতিযোগীদের অধিকাংশই তার পক্ষে মতামত দিয়েছিলো । সে সময় হযরত আলী মিয়া 'হাযেরুল আলামিল ইসলামী'-এর নতুন পাঠক ছিলেন এবং 'আল-ফাতাহ'য় প্রকাশিত আমীরের অগ্নিঝরা ও আবেগঘন প্রবন্ধ পাঠে অভ্যস্ত ছিলেন। এ কারণে তীর সাথী-সঙ্গীদের মন-মস্তিক্কে আমীর শাকীবের নামই আসন গ্রহণ করেছিল। এ জলসার সংবাদ মিসরে পৌঁছে গিয়েছিল।

আমীর শাকীব আরসালান, মাসউদ সাহেবের কাছে ব্যক্তিগত পত্র লিখেছিলেন। তাতে তিনি তার না দেখা ভক্তদের সুধারণার শুকরিয়া আদায় করেছিলেন, কিন্তু স্পষ্ট শব্দে বিনমরতার সাথে লিখেছিলেন যে, এ দূর্লভ সম্পদ মূলতঃ বর্তমান যুগের প্রখ্যাত মুজাহিদ গাজী আবৃদুল করীম আরীফীর ব্যক্তিত্রে সাথেই মানানসই। যিনি খোদা প্রদত্ত তীক্ষ মেধা ও জেহাদী প্রেরণার দ্বারা ফ্রাল এবং স্পেনের অলিগলিকে আন্দোলিত করেছেন। আমীর সাকীব তার “আস-সাইয়েদ রশীদ রেজা ওয়া আখা আরবাইনা সানাহ" (আল্লামা রশীদ রেজা ও চল্লিশ বছরের ভ্রাতৃতু) গ্রন্থে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের উল্লেখ করেছেন। এর মাধ্যমে তখনকার নদওয়ার ছাত্রদের চিন্তা- চেতনার প্রসারতা, অধ্যয়ন ও রুটি অনুমান করা যায়।

আরবী শিক্ষার এক নতুন অভিজ্ঞতা[সম্পাদনা]

হেলালীর শিক্ষা পৃদ্ধতি (যিনি কোন ভাষা শিক্ষার জন্য অন্য ভাষার সাহায্য নেয়াকে মৌলিকভাবে ভুল মনে করতেন) এবং উস্তাদ 'মুহান্মাদ আল- আরাবীর দিবারাত্রির সাহচর্ষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় হযরত মাওলানা নদভীসহ অন্যদের ইচ্ছা হল, আরবী ভাষা শিক্ষার জন্য সরাসরি পদ্ধতির অনুসরণ করে দেখা যাক।

হযরত মাওলানা তাঁর বড় ভাইয়ের অনুমতি ও উৎসাহ এবং মুহতামিম সাহেবের মঞ্জুরী নিয়ে প্রাথমিক স্তরের একদল ছাত্রকে নিজের কাছে রাখলেন, অন্য আরেকদল ছাত্রকে দারুল উলুমের কিছু অভিজ্ঞ ও সম্মানিত উত্তাঁদের কাছে প্রাচীন পদ্ধতিতে সোপর্দ করা হল। অবশেষে হযরত মাওলানার বড় ভাই উভয় দলের পরীক্ষা নেন এবং হযরত মাওলানার দলকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এ পদ্ধতিতে ছাত্রদেরতো উপকার হয়েছিলই কিন্ত তার চেয়ে বেশী উপকার হয়েছিল হযরত মাওলানার নিজের । এরই মাধ্যমে আরবী ভাষায় কথা বলার সাবলীলতা এবং বক্তব্য রাখার অনুশীলন হয়েছিল । ফলে দাওয়াতের ময়দানে আল্লাহ তায়ালা হযরত মাওলানাকে যে খেদমতের সৌভাগ্য দান করেছিলেন তার ভিত্তি রচিত হয়েছিল এখান থেকেই।

কিছু স্বভাবগত কারণে, আবার কিছু পরিবেশের কারণে যে সময় দরসের ছাত্রদের সাথে হযরত মাওলানার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যো উপকার গ্রহণ ও প্রদানের অন্যতম শর্ত) পড়া গুলিয়ে ছাত্রদের মুখে তুলে দেয়ার এক প্রবল প্রেরণা তখন: হযরত মাওলানার হৃদয়ে জেগে উঠেছিল। যা তিনি প্রিয় উত্তাদ শায়খ খলীল আরব থেকে লাভ করেছিলেন। সময় ও স্থানের কোন শর্ত ছিল না। মাদরাসার নিয়ম কানুন রক্ষা করে ছাত্রদের সর্বোতভাবে আরবী শিখানো ও অনুশীলনের উপর হযরত মাওলানী গুরুত্ব আরোপ করতেন' এবং এর জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বনে মেধা ও বুদ্ধি কাজে লাগাতেন। শায়খ তাকীউদ্দীন আল-হেলালীর ছোট ভাই উস্তাদ মুহাম্মাদ আল- আরাবী থেকে তিনি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিতেন।

অন্যান্য দরস ও কিতাব =[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা আরবী শিক্ষার ক্লাস ছাড়া অন্য ক্লাসগুলো অত্যন্ত সাফল্যের সাথে পরিচালনা করছিলেন। মাওলানা হায়দার হাসান খান (রহ.) , তিরমিযীর ছাত্রদের কাছে তাদের প্রতিক্রিয়া জিজ্ঞেস করতেন। একবার তিনি ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া অবগত হয়ে আশ্বস্ত হন এবং হযরত মাওলানার ব্যাপারে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। হযরত মাওলানা এক শ্রেণীতে মানতেকের ক্লাস নিতেন। নতুন ও পুরাতন মানতেকী পরিভাষার নিয়ম; যেমন- দালালাতে সুতাবেকী, দালালাতে তাজাম্মুনী, দালালাতে এলতেযামী ইত্যাদির উদাহরণ বাস্তব ও চাক্ষুস বিষয় দ্বারা দিতেন। মৌলভী ডেপুটি নাজির আহমাদ সাহেবের গ্রন্থ “মাবাদিউল হিকমাহ” থেকে তিনি এ ব্যাপারে সাহায্য নিতেন। সম্ভবত দ্বিতীয় বছরেই আরবী সাহিত্যের ইতিহাস ক্লাসটি হযরত মাওলানাকে সম্পূর্ণভাবে দেয়া হয়। সপ্তম শ্রেণীতে উত্তাদ আহমদ হাসান আয-যাইয়াতের তারিখুল আদাবিল আরাবি (আরবী সাহিত্যের ইতিহাস) গ্রন্থটি পাঠ্যতুক্ত ছিল। বিষয়টি হযরত মাওলানার প্রিয় ও পছন্দনীয় ছিল। তিনি লাগাতার বেশ ক'বছর এ বিষয়ে দরস দেন। দারুল উলুমের শিক্ষকতার শেষ কয়েক বছরে সহীহ বুখারীর কিতাবুল ওহী, কিতাবুল ঈমান এবং কিতাবুল ইলমের দরসও দেন। তিনি লেখেন, “এ সময় আমার মনে হত, যদি অধ্যয়ন ও মেহনতের সময় ও সুযোগ হয় তবে বুখারী শরীফ ইনশাআল্লাহ খুব ভালভাবে পড়াব।” আল্লাহর ইচ্ছায় এরপর হযরত মাওলানাকে এক বছর সম্পূর্ণ বুখারী শরীফ পড়ানোর দায়িত্ব দেয়৷ হয়। কিন্তু সফরের আধিক্য ও দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতা হেতু এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। এছাড়াও তিনি এক বছর হুজ্জাতুন্লাহিল বালেগা পড়িয়েছিলেন।

প্রসঙ্গ: দারুল উলুমের পরিবেশ, প্রতিষ্ঠাতা ও পথিকৃতৎ্গণ[সম্পাদনা]

দুঃখের বিষয় সে সময় দারুল উলুমে দ্বীনী ও দাওয়াতী পরিবেশ ছিল না। তার আসল কারণ ছিল, যে সকল উত্তাদের দ্বারা ছাত্ররা প্রভাবিত ছিল তাদের রুচি ও মানসিকতায় দাওয়াতী মনোভাব ছিল না। হযরত মাওলানা ছাড়া যারা দ্বীনী ও দাওয়াতী .চেতনা রাখতেন, সময়ের মুল্যায়ন করতেন, মাসুলাতের পাবন্দ ছিলেন, তাদের মধ্যেও ছাত্রদের মাঝে দ্বীনী ও ইসলাহী প্রেরণা সৃষ্টি করার মত শক্তি ও যোগ্যতা ছিল না। সারা দারুল উলৃমে জ্ঞানার্জন, সাহিত্যচর্চা, লিখন ও বক্তৃতা অনুশীলনের উষ্ণ আবহাওয়া বিরাত করছিল। দারুল উলুমের সবচেয়ে আদর্শ ব্যক্তিত্ব, যাকে আদর্শ ও অনুসরণযোগ্য মনে করা হত, যিনি ছাত্রদের স্বগ্নপুরুষ ছিলেন, তিনি ছিলেন আল্লামা শিবলী নোমানী (রহ.)। তাকে দারুল উলুমের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ও নির্মাতা মনে করা হত। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নদওয়ার জ্ঞান ও সাহিত্যের রূপ ও প্রকৃতি বিনির্মাণে বুনিয়াদি অবদান মাওলানা শিবলী নোমানীরই (রহ.)। তার রচনা পদ্ধতিই তখন পর্যন্ত ভাবগন্ভীর ও জ্ঞানগর্ভ মতামত প্রকাশের সর্বাধিক উত্তম পদ্ধতি ছিল এবং এখন পর্যন্ত তা জীবন্ত ও দ্যেদীপ্যমান রয়েছে । আশা করা যায়, দীর্ঘকাল তা অস্লান থাকবে।

কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, একটি এতিহাসিক ও স্বীকৃত বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হবে। মূলতঃ নদওয়াতুল উলামা আন্দোলন ছিল মাওলানা মুহাম্মদ আলী যুঙ্গেরী (রহ.)-এর স্বপ্ন ও তাঁর জীবনের একমাত্র আরাধনা । তিনিই তার প্রথম উদ্যোক্তা ও প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তাছাড়া নদওয়ার মাধ্যমে ষে কৃষ্টির আবহ সৃষ্টি হয়েছে, নদওয়া দৃষ্টিভঙ্গীর প্রবক্তা ও নদওয়া ভাল যা কিছু ধারণ করে আছে তাতে মাওলানা শিবলী, মাওলানা হাকীম সাইয়েদ আব্দুল হাই, সদর ইয়ারজং মাওলানা হাবীবুর রহমান খান শিরওয়ানী এবং ফখরে নদওয়া মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী প্রমুখের তাতে অবদান ' ছিল এবং এরা সবাই তার উত্তম নযুনা ও নিদর্শন ছিলেন। হযরত মাওলানা লেখেন, একটি শাখা তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শুধুমাত্র তার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা এবং উদ্যোক্তাদের বিস্মৃতই করে দেয় না; বরং তাদের সম্পর্কে অপরিচিতি ও সংকোচ উদ্রেক সৃষ্টির যে স্বাভাবিক ও স্বভাবগত প্রভাব সৃষ্টি করে এবং এতে যে বরকতহীনতা আসে তা বর্তমানে প্রচ্ভতাবে . উপলব্ি করছি।

মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী যিনি দ্বীনী চিন্তাধারার অনেককে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, যার সমস্ত কর্মকান্ড, স্বাধীন মানসিকতা ও উদার, দৃষ্টিভঙ্গি, গভীর অধ্যয়ন ও সমালোচনা শক্তির মাঝে সর্বদাই বংশীয় ও স্বভাবজাত ভদ্রতা প্রতিফলিত হত। যিনি নদওয়ার শুরু যুগে মাওলানা মুহাম্মাদ আলী সুঙ্গেরী (রহ.)-এর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পদে আসীন থাকা কালে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন এবং যিনি নদওয়ার প্রতিষ্ঠা ও ক্রমবিকাশ নিকটে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি এ বাস্তবতাকে গভীরভাবে উপলব্ধি . করেন এবং সুযোগ পেলেই এদিকে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। একবার শিক্ষা ভবনের দক্ষিণ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তিনি হযরত মাওলানাকে বললেন, মৌলভী আলী সাহেব, প্রত্যেক" প্রতিষ্ঠানেই এক বা একাধিক উপযুক্ত ব্যক্তি থাকেন, যাদেরকে অনুসরণযোগ্য ও আইডিয়েল মনে করা হয়, যাদের অনুসরণে গর্ববোধ করা হয়। মুসলিম ইউনিভার্সিটি আলীগড়ে স্যার আইডিয়েল মনে করা হয়। এ পর্যায়ে হযরত সাইয়েদ সাহেব দারুল উল্ম দেওবন্দের নাম উচ্চারণ করেন এবং সেখানকার কয়েকজনের নাম বলেন। এরপর তিনি বলেন, আপনারা নদওয়ার ছাত্রদের সামনে আইডিয়েল কাউকে পেশ করুন

আইডিয়েল হিসেবে দারুল উলৃমের চারজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে- মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ আলী মুন্গেরী, মাওলানা সাইয়েদ আবদুল হাই, নবাব সাইয়েদ আলী হাসান খান। এরপর বলেন, আপনার পিতা এদের সবার সমস্ত গুণের সমন্থিতরূপ ছিলেন। তিনি আধ্যাত্মিকতায়ও সমৃদ্ধ ছিলেন, যোগ্য আলেমও ছিলেন, উর্দু-আরবীর প্রাঞ্জলভাষী ও সুসাহিত্যিক ছিলেন, বহু গ্রন্থ রচয়িতাও ৷ তাকে ছাত্রদের সামনে আইডিয়েল হিসাবে পেশ করুন।

হযরত মাওলানা বলেন, সময়ের ব্যবধানে সাইয়েদ সাহেবের বলা শব্দগুলো কিছুটা হয়ত পরিবর্তিত হয়ে গেছে, কিন্তু ভাবার্থ একই রকম ছিল । অবস্থা এ রকম ছিল যে, সন্তান হেতু আমি পিতার গুণাগুণ ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করতে পারতাম না। যদি উপস্থাপন করতামও কেউ প্রভাবিত হতো না। শিক্ষকদের মধ্য থেকে মাওলানা আবদুস সালাম সাহেব কিদওয়ায়ী ছাড়া অন্যরা এ বাস্তবতার সাথে পরিচিত ছিলেন না, একে স্বীকারও করতেন না এবং সভা ও জলসায়-এর আলোচনাও করতেন না। ফলে প্রতিটি মেধাবী ছাত্রই মাওলানা শিবলীর অনুকরণে গ্রন্থ প্রণেতা, এঁতিহাসিক, সাহিত্যিক ও সমালোচক হওয়ার স্বপ্ন দেখতো এবং প্রাচীন দ্বীনী প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা কারিকুলাম ও শিক্ষা সিলেবাস এবং বাইরের মহান ব্যক্তিদের সম্পর্কে হয় অনবগত ছিল অথবা তাদের সম্পর্কে তুচ্ছ ও নিচু মানসিকতা পোষণ করত। মাওলানার বড় ভাইও এ পরিবেশে বেদনাবোধ করতেন এবং দ্বীনী ও রূহানী ব্যক্তিত্ব ও আলেমদের সাথে ছাত্রদের সম্পৃক্ত করতে চাইতেন। কিন্তু বহু বছরের প্রভাব, যার শিকড় বহু গভীরে প্রোথিত হয়েছিল । অল্প ক'বছরে তা উপড়ানো সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সে সময় এমন কোন দ্বীনী দাওয়াত ও আন্দোলনের আত্মপ্রকাশও ঘটেনি বা তরুণ ছাত্রদের প্রভাবিত ও আকৃষ্ট করতে পারে এবং যার সাথে সম্পৃক্ততা ও অংশগ্রহণের পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।

ছাত্রদের কিছু বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

সে সময়ের ছাত্রদের মাঝে যদিও স্বাধীনতা ও বেপরওয়া ভাব, আমলী দুর্বলতা এবং স্কুল-কলেজের ছাত্রদের অনুকরণপ্রিয়তা ছিল, কিন্তু উচু খান্দানের সাথে সম্পৃক্ততা, দ্বীনদার মুসলমান পরিবারের সন্তান হওয়াতে তাদের মাঝে তখনও পুরোনো আমলের রেওয়াজ ও ভদ্রতা বিদ্যমান ছিল। তাছাড়া বিহার ও উত্তর প্রদেশের সেসকল প্রখ্যাত ও মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে- যাদের মাঝে স্ব স্ব যুগে বড় বড় উলামা-মাশায়েখ এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের জন্ম হয়েছে। মেধা, জদ্রতা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা, আত্মোপলব্ধি, বড়দের সম্মান, উস্তাদদের প্রতি বিনয়-নম্র ব্যবহার ইত্যাদি গুণগুলি তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। তারা অহেতুক ও মূল্যহীন আচরণ পরিহার করে চলত। নিচের জামাআতের ছাত্ররা উপর জামাআতের ছাত্রদের এক রকম উতস্তাদের মর্যাদা দিত। উপর ক্লাসের ছাত্ররা নিচের ক্লাসের ছাত্রদের ভুল-ত্রান্তি নিঃসংকোচে শুধরে দিত। অল্প পরিশ্রমে বড় ও ভাল ফলাফল করার যোগ্যতা তাদের ছিল। বাইরের বড় কোন ব্যক্তিত্বের প্রভাবে তাদের দৃষ্টি অবনমিত হত না। বিত্তবান, নেতা, পদস্থ কর্মকর্তাদের প্রভাব ও ভীতি তাদেরকে কাবু করত না। সে যুগে ছাত্রদের মাঝে কিছু দুর্বলতাও ছিল। আবার এমন কিছু সৌন্দর্যও ছিল যা আজকের যুগে দ্বীনী ও শিক্ষাগত উন্নতি ও বিশিষ্টতা সন্তেও সাধারণতঃ গোচরীভূত হয় না।

মাওলানার দরসে কুরআন[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা বলেন_ আমার শিক্ষকতাজীবন শুরু হয় দরসে কুরআনের মাধ্যমে । ১৯৩৪ সালের পর দারুল উলৃমের গুরুত্পূর্ণ ক্লাসপ্তলো আমাকে সোপর্দ করা হয়। ১৯৩৯-৪০ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমি অনুভব করতে শুরু করি যে, ছাত্ররা কুরআন অধ্যয়ন ও তার থেকে সঠিক উপকারিতা অর্জনে অনেক: প্রাথমিক জ্ঞান ও নীতিমালার সাথে অপরিচিত। এই কুরআনের আবেদন ও তার ূুহ এবং তার উচ্চাঙ্গ সাহিত্য ও বালাগাত পুরোপুরি অনুধাবনে সক্ষম নয়, কিংবা তাদের জানার পরিধি সাধারণ ও প্রাথমিক পর্যায়ের । নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং কয়েক বছর দরসে কুরআনের খেদমত আঞ্জাম দেয়ার পর আমি এই তাগাদা অনুভব করি যে, তাফসীরের উপরের ক্লাসের ছাত্রদের জন্য কিছু এমন প্রবন্ধ তৈরী করি যা কুরআন গবেষণার জন্য সহযোগী, তার মর্যাদা ও মাহাত্য প্রমাণে সহায়ক প্রমাণিত হয়। তাই ১৯৩৮-৩৯ সালে ধারাবাহিক কিছু লেখায় সচেষ্ট হই, যার শিরোনামগুলি ছিল নিম্নরূপঃ

১. কুরআনের. ভাষায় কুরআনের পরিচিতি । ২. কুরআন শরীফ থেকে উপকারিতা অর্জনের শর্ত এবং তার প্রতিবন্ধকতা, ৩. কুরআনের এ'জায তথা অলৌকিকতা, ৪. কুরআনের মৌলিক আলোচ্য বিষয়, ৫. কুরআন মজীদের ভবিষ্যদ্বাণী, বিশেষতঃ রোমের বিজয়ী হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী, ৬. মৌলিক আকায়েদ, তাওহীদ, রেসালাত, পরকাল, ৭. আরকান চতুষ্ট় (এর সমাপ্তি অনেক পরে হয়েছে)

ছাত্ররা এসব বিষয়ের আলোচনা ক্লাসে লিখে নিত। পরে ১৯৪০ সালে যখন “আন-নদওয়া" মাসিক ম্যাগাজিনের প্রকাশনা শুরু হয়, তখন তা ধারাবাহিক প্রকাশের ব্যবস্থা হয় এবং সর্বত্র সমাদূত হয়। এরপর দীর্ঘ সময় এসব বিষয়ে কলম ধরা এবং প্রকাশের ব্যবস্থা করার আগ্রহ ছিল না। ধরে নেয়া হয়েছিল এসবের পান্ডুলিপি হারিয়ে গেছে। ১৯৮১ সালে হঠাৎ ন্নেহতাজন মৌলভী সাইয়েদ মুহাম্মাদ তাহের (সহকারী নাবেম, নদওয়াতুল উলামা)-এর কামরায় অবস্থানকারী দারুল উলৃমের ছাত্ররা এই পান্ডুলিপি আবিষ্কার করে । আমি তাতে দ্বিতীয়বার দৃষ্টি বুলাই এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ 'জ্ঞান ও ইতিহাসের কষ্টি পাথরে কুরআন মজীদ এবং পূর্ববর্তী আসমানী গরন্থ' তেলাভয়াত ও চিন্তা-গবেষণার কিছু নমুনা" “এক অভিজ্ঞতা ও এক পরামর্শ সংযোজন করি এবং তা মৌলভী সাইয়েদ মুহাম্মাদ হামযা নদভী আমা থেকে নিয়ে “কুরআনের নীতিমালা" নামে মাকতাবায়ে ইসলাম থেকে প্রকাশ করে। এ কিতাব কুরআন মজীদ অধ্যয়নকারীদের জন্য বিদগ্ধতা অর্জনে অত্যন্ত মূল্যবান এবং আরবী মাদরাসাগুলোতে পাঠ্যভুক্ত করার উপযোগী ।

দামেশৃক ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে[সম্পাদনা]

১৯৫৫ সালে দামেশ্ক ইউনিভার্সিটিতে শরীয়া বিভাগ খোলা হলে তার, প্রথম বিভাগীয় প্রধান হন উত্তাদ মোস্তফা সুবায়ী। ডঃ মোস্তফা সুবায়ী মুসলিম বিশ্বের খ্যাতনামী উলামা ও মুসলিম পন্ডিত ব্যক্তিদেরকে তীর প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত করার প্রবল আকাজ্ক্ষা রাখতেন। ভারত উপমহাদেশ থেকে এ পদের জন্য হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-কে দাওয়াত দেওয়া হয়। হযরত মাওলানা তার বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে স্থায়ীভাবে অধ্যাপনার পরিবর্তে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দাওয়াত কবুল করেন। কোন ভারতীয় আলেমের জন্য আরব দেশের ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর হিসেবে যোগ দেরাটা ধু হযরত আলী মিয়ার জনয নয় বরং উপমহাদেশীয় আলেম সমাজের জন্যও এক বিরল সম্মান বয়ে এনেছিল।

ইতিপূর্বে মাওলানা ১৯৫১ সালে দামেস্ষে প্রথম সফর করেছিলেন। এটা ছিল তীর দ্বিতীয় সফর । তিনি দামেশ্ক উপস্থিত হন এবং ১৯৫৬ সালের ৪ঠা এপ্রিল থেকে ইউনিভার্সিটির কেন্দ্রীয় হলে লেকচার শুরু করেন। প্রথম লেকচার ছিল, “আত-তাজদীদ ওয়াল মুজাদ্দেদুন ফি তারিখি ফিকরিল ইসলামী' । হযরত মাওলানার জন্য এ বিষয়টি নির্ধারণ করা এজন্য সহজ হরেছিল যে, এঁ সময় তিনি লাখনৌতে “তারিখে দাওয়াত ওয়া আযীমাত' বইখানি লেখা শুরু করেছিলেন। এর প্রথম খন্ড তৈরী হয়ে গিয়েছিল। ইউনিভার্সিটির দাওয়াত পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি আরবী প্রবন্ধের অধিকাংশই তৈরী করে ফেলেন।

তিনি এঁ সময় প্রায় তিন মাস দামেক্কে অবস্থান করেছিলেন এবং মোট আটটি বিষয়ে লেকচার প্রদান করেছিলেন। তীর বক্তব্যের বিষয় ছিল "ইসলামের ইতিহাসে সাংক্ষারিক কার্যক্রম এবং তার বিশ্ববিশ্রন্ত ব্যক্তিবর্গ । তিনি কয়েক শতান্দীর বেশ ক'জন বিখ্যাত মুজাদ্দেদের কার্যক্রমের প্রেক্ষাপট তার বক্তৃতায় তুলে ধরেন। তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে তাঁর এ সফর শেষ করেন। এ সময় ইখওয়ানের আলেম ডঃ সাঈদ রমযান সিরিয়ায় অবস্থান করছিলেন। হযরতের সাথে তাঁর ঘনিষ্ট পরিচয় হয়েছিল । হযরত মাওলানাকে তিনি খুবই কদর করতেন।

ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে মদীনা ইউনিভার্সিটিতে[সম্পাদনা]

১৯৬২ সালে মদীনা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হলেও এর দু'বছর আগে থেকে এই ইউনিভার্সিটির কার্যক্রম, চিন্তাধারা, সিলেবাস ইত্যাদি. বিষয়ে সারা দুনিয়ার খ্যাতনামা ইসলামী চিস্তাবিদগণের দিক-নির্দেশনা নেয়ার জন্য সৌদী পত্রিকাসমূহে বিভিন্ন আলোচনা চলে আসছিল । এ ব্যাপারে ভারত থেকে হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) পাকিস্তান থেকে জনাব আবুল আ'লা মওদুদীর নাম পত্র-পত্রিকায় জোরে-শোরে আসছিল । সুতরাং মদীনা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যদের সাথে এ বিখ্যাত দু'জন ব্যক্তিত্বকে মজলিসে শুরায় স্থান দেয়া হয়। জনাব মাওলানা মওদূদী দু'বছর পর্যন্ত এর সদস্য ছিলেন এবং হযরত মাওলানা আলী মিয়া ১৯৯৭ পর্যন্ত এর সদস্য ছিলেন।

ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যেসব ইসলামী ক্ষলারকে এ ভার্সিটিতে অধ্যাপনার জন্য আহ্বান জানান হয়, তার মধ্যে হযরত আলী মিয়ী ছিলেন উল্লেখযোগ্য ৷ গাড়ি, বাসা, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার রিয়ালের সম্মানজনক চাকুরীর দাওয়াত হযরত আলী মিয়া শত ব্যন্ততার জন্য গ্রহণ করতে পারেননি। অবশ্য মদীনা ইউনিভার্সিটির প্রধান শায়খ মুহাম্মাদ বিন নাসের আল-আবুদী ও শায়খ আবদুল্লাহ বিন বাঘ (রহ.)-এর অনুরোধে দু'মাসের জন্য ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দাওয়াত কবুল করেন। ইতিপূর্বে তিনি অবশ্য মজলিসে শূরার বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং মদীনা ভার্সিটির উদ্দেশ্য, নেসাবে তালিম ইত্যাদির উপর খুবই গুরুত্পূর্ণ দিক-নির্দেশনা পেশ করেছিলেন !

১৯৬৩ সালের ১১ই মার্চ তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে মদীনা ভার্সিটিতে উপস্থিত হন এবং 'আন-নবুওয়াহ ওয়াল আঘিয়া ফি যওইল কুরআন" শীর্ষক আলোচনাসহ ৮টি বক্তৃতা পেশ করেন। ৩০শে মার্চ থেকে তীর বক্তব্য শুরু হয়। শায়খ আবৃদুল্লাহ বিন বায ও' অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গও সেখানে উপস্থিত থাকেন।

আধ্যাত্মিকতা[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা আহমাদ আলী লাহোরীর খেদমতে[সম্পাদনা]

আন্নাহওয়ালাদের সোহবত হযরত আলী মিয়া প্রথম জীবন থেকেই পেয়ে আসছিলেন । খানদানের মধ্যে বিদ্যমান বুযুর্গানে দ্বীনের সোহবতও তিনি লাভ করেছিলেন। কিন্তু তার জীবনে যে মহান খ্যক্তিত্ের প্রভাব গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল এবং যার সোহবতে তাঁর জীবনের মোড় পরিবর্তন হয়েছিল, তিনি হলেন শায়খুত তাফসীর হযরত মাওলানা আহমাদ আলী লাহোরী (রহ.)।

মাওলানা আলী মিয়া তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “আমার জীবনের সবচেয়ে মোবারক ও পরম [সৌভাগ্যের দিন এ দিন ছিল, যেদিন আমি আমার পরম প্রিয় মোরশেদ হযরত মাওলানা আহমাদ আলী লাহোরীর সন্ধান পেয়েছিলাম । হযরত লাহোরীর সন্ধান না পেলে আমার জীবন বর্তমান অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হত। আর সম্ভবতঃ সে জীবনের মধ্যে শুধু সাহিত্য ও ইতিহাস সংকলন এবং লেখালেখি ব্যতীত অন্য কোন দিকের আকর্ষণ, ঝৌক ও মহব্বত পাওয়া যেত না। খোদাপ্রান্তি ও আল্লাহ পাকের মা'রেফাত হাসিলের কোন জযবাও সে জীবনে পাওয়া ফেত না।

মোরশেদের সোহবতে খোদাপ্রান্তির জওক, আল্লাহ পাকের নামের মাধুর্য উপলব্ধি, তার আশেকগণের মহব্বত এবং নিজের মধ্যে ইসলাহের প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল।

হযরত মাওলানা লাহোরীর সংক্ষিন্ত পরিচয়[সম্পাদনা]

জন্ম ৫ শায়খুত তাফসীর হযরত মাওলানা আহমাদ আলী লাহোরী (রহ.) ২রা রমযান ১৩০৪ হিজরী পাকিস্তানের গোজরাওয়ালা জেলার “কসবায়ে জালালে' নও মুসলিম শেখ হাবিবুল্লাহর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।

শিক্ষা ৪ প্রাথমিক শিক্ষা তিনি নিজ এলাকার মাদরাসায় সমাপ্ত করেন। এ সময় বিখ্যাত বিপ্লবী আলেম মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী দেওবন্দ থেকে ফারেগ হয়ে পাস্তাজে তাশরীফ আনেন। তিনি শেখ হাবীবুল্লাহর আত্তীয় ছিলেন। শেখ হাবীবুল্লাহ তার নয় বছরের সন্তান আহমাদ আলীকে দ্বীন ইসলামের জন্য ওয়াকফ করেন এবং মাওলানা সিম্ধীর হাতে তাকে তুলে দেন। হযরত মাওলানা উায়দুল্লাহ তাকে নিয়ে দীনপুর তাশরীফ নিয়ে যান। সেখানে তিনি তার মোরশেদের কাছে শিশু আহমাদ আলীকে বায়আত করান। এরপর তিনি শাগরেদকে নিয়ে আমরুত শরীফ ও গোট পীরঝান্তায় নিজের কাছে রেখে তালীম দিতে থাকেন। তিনি ১৩২৭ হিজরীতে দরসে নেষামী সম্পন্ন করেন।

কর্মজীবন ৪ ফারেগ হওয়ার পর হযরত মাওলানা সিদ্ধি স্থাপিত পীরঝান্ডার মাদরাসা দারুল ইরশাদে তিনি শিক্ষক নিযুক্ত হন এবং হযরত সিদ্ধির মেয়েকে বিবাহ করেন। ১৯০৯ সালে মাওলানা সিঙ্গি দ্বিতীয়বার দেওবন্দে আসলে দারুল ইরশাদের দায়িত্ব হযরত লাহোরীর উপর ন্যস্ত করা হয়। পরে অবশ্য তিনি হযরত সিঙ্ধি প্রতিষ্ঠিত অন্য এক মাদরাসায় দরস দেয়া শুরু করেন। প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই শিশু ও মা এক সপ্তাহের মধ্যে ইন্তেকাল করে। এরপর হযরত সিদ্ষির এক বন্ধুর মেয়েকে তিনি বিবাহ করেন। ১৩৩০ হিজরীর মুহররম মাসে দারুল উলুম দেওবন্দের মসজিদে হযরত শায়খুল হিন্দ এ বিবাহ পড়ান।

এ সময় মাওলানা উবায়দুন্লাহ সিঙ্গি দেওবন্দে এসে ফুযালায়ে জমিয়তুল আনছার প্রতিষ্ঠা করেন। তখন সিদ্ধান্ত হয় যে, আলীগড় থেকে পাঁচজন গ্রাজুয়েট ছাত্রকে কুরআনে হাকীমের বিপ্লুবী শিক্ষার সাথে পরিচয় করাবার জন্য একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান খোলা হবে। এ বিভাগটি নাষ্যারাতুল মা'আরিফিল কুরআনিয়া নামে দিল্লীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। উক্ত প্রতিষ্ঠানে পাঁচজন বিজ্ঞ আলেমকে ও গ্রাজুয়েটদেরকে একত্রিত করা হয়। হযরত মাওলানা সিন্ধি মাওলানা আহমাদ আলী সাহেবকে দিল্লীতে তার মাদরাসায় ডেকে আনেন এবং প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে ভর্তি করেন। এ সময় হযরত লাহোরী মাওলানা উবায়দুল্লাহ্‌ সিঙ্গির দরসী বক্ততাগুলি লিপিবদ্ধ করার অনুমতি লাভ করেন।

দরসে কুরআন £ কুরআনের ১৩তম পারার দরস 'চলাকালে হযরত শায়খুল হিন্দের রাজনৈতিক মিশন নিয়ে মাওলান। সিন্ষি কাবুল চলে গেলে হযরত মাওলানা লাহোরী এ প্রতিষ্ঠানের সকল দায়িত্বভার নিজের কীধে তুলে নেন। তিনি দু'বছর ধরে দরসে কুরআন দিতে থাকেন। এ সময় ভারতে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। নাযযারাতুল মা'আরিফে দরসে কুরআন দেয়া অবস্থায় হযরত লাহোরী থেফতার হন, যার ফলে মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কয়েকমাস বিভিন্ন জেলখানায় আটক থাকার পর বৃটিশ সরকার তাকে মুক্তি দেয়। কিন্ত শর্ত জুড়ে দেয় যে, তিনি সিন্ধু এলাকায় যেতে পারবেন না। বরং লাহোর এলাকায় থাকার জন্য তার উপর পাবন্দী লাগানো হয়।

লাহোরে অবস্থান ৪ লাহোরে আসার পর তিনি জুম'আর খুতবা দিতেন এবং একটি মসজিদে কুরআনের দরস দিতেন। এ সময় তিনি হজ্জ করেন। প্রথম হজ্জের পরে তিনি আরো ১৩ বার হজ্জ করেন। হজ্জের পরে তিনি এক মুহাজের কাফেলার আমীর হয়ে কাবুল উপস্থিত হন। মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিদ্ধি সেখানেই অবস্থান করছিলেন। উস্তাদে মোহতারামের সাথে তার দেখা হয়। হযরত আহমাদ আলী ১৯২০ সালে লাহোরে ফিরে আসেন। ১৯২২ সালে তিনি কুরআনে হাকীমের প্রচার-প্রসারের জন্য “আঞ্জুমানে খুন্দাযুদ্দীন' নামে একটি প্রতিষ্ঠান কায়েম করেন। এরপর ১৯২৪ সালে মাদরাসা কাসেমুল উলুম কায়েম করেন। ১৯৪৫ সালে আঙ্জুমানের পক্ষ হতে একটি মহিলা মাদরাসা ও ১৯৫৫ সালে সান্তাহিক খুদ্দামুদ্দীন পত্রিকা চালু হয়।

তাফসীর প্রশিক্ষণ £ শায়খুত তাফসীর হযরত লাহোরীর দরসে কুরআন গরন্থখানি খুবই প্রসিদ্ধ । তার দরসে কুরআন ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়। বর্তমানেও পাওয়া যায়। ইংরেজী শিক্ষিত সাধারণ শ্রেণী ও ফারেণতত তাহসীল উলামা উভয়ের জন্য পৃথক পৃথক দরস হত। ফারেগ আলেমগণের জন্য শাবান থেকে ৩ মাসব্যাপী একটি কোর্স পরিচালনা করতেন। তিনি ছিলেন, উপমহাদেশের বিপ্লবী আলেম হযরত মাওলানা উবায়দুন্লাহ সিদ্ধির বিশেষ মুখপাত্র । হ্যরত লাহোরী শাহ ওয়ালী উল্লাহর হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা গ্রন্থের দরস দিতেন। তিনি ছিলেন ওয়ালীউল্লাহী চিন্তাধারার বিপ্লবী কণ্ঠস্বর। হযরত- মাওলানা আলী মিয়া তার দরসে অংশগ্রহণ করেই তাকে চিনে ফেলেছিলেন।

ইন্তেকাল £ হযরত লাহোরী একজন মুজাহিদে মিল্লাত ছিলেন। তিনি ১৩৮১ হিজরীর ১৮ই রমযান, মোতাবেক ১৯৬২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী লাহোরে ইন্তেকাল করেন।

শায়খুত তাফসীর হযরত মাওলানা আহমাদ আলী লাহোরীর দরসে কুরআন (তাফসীরের ক্লাস) খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। বড় বড় মাদরাসার ফারেগ আলেমগণ দাওরার সনদ হাসেল করার পর হযরত লাহোরীর খেদমতে হাজির হয়ে তাফসীরের দরস গ্রহণ করতেন। হযরত মাওলানা মাদানী (রহ.) শায়খুত অফসীরের দরস সম্পর্কে বলতেন, “আপনারা আট বছর ধরে দেওবন্দে ইলম অর্জন করেছেন, কিন্তু আপনাদের তাকমীল মাওলানা আহমাদ আলী লাহোরীর দরসে তাফসীর থেকে হতে হবে।

আন্মাহ পাকের এক সিংহ লাহোরের শিরাওয়ালা গেইটে বসে আল্লাহ আল্লাহ যিকিরের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষের অন্তর নিজের দিকে আকৃষ্ট করছেন। তিনি আল্লাহ পাকের এমন মকবুল বান্দা যে, “তাঁর দরসে কুরআনে অংশগ্রহণের অর্থই হলো জান্নীতের গ্যারান্টি ।”

হযরত লাহোরী কুরআন পাকের প্রকৃত আশেক ছিলেন। দরসে কুরআন, কুরআন পাকের প্রচার-প্রসার ব্যতীত তাঁর হৃদয়ে প্রশান্তি আসতো না। এ ছিল তাঁর রূহের খাদ্য এবং বাথার প্রতিষেধক ৷ এই দরসে ঠিকমত উপস্থিত না হওয়াকে তিনি গুনাহে কবীরা এবং কঠিন দোষ মনে করতেন। তিনি দরসের এমন পাগল ছিলেন যে, তাঁর একটি শিশুর ইন্তেকাল হওয়ার দিনও তিনি দরস বন্ধ করেননি। দরসের পর উপস্থিত মেহমানদেরকে এ ঘটনা শুনিয়ে তিনি বাচ্চার কাফন-দাফনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

প্রথম সাক্ষাৎ[সম্পাদনা]

১৩৫১ হিজরীর শাবানের শেষের দিকে অথবা রমযানের প্রথমাংশে হযরত আলী মিয়া (১৯৩২ সালের শেষের দিকে) হযরত লাহোরীর দরসে তাফসীরে অংশথহণ করার জন্য তার খেদমতে উপস্থিত হন। অবশ্য ১৯৩০ সালেও একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে ঘটনাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য ।

১৯২৯ সালের মে মাসের কথা । সময় ছিল গরমের হযরত আলী মিয়া সদ্য ফারেগ হয়েছিলেন। ইতিপূর্বে তিনি কোন দূর-দূরান্তের সফরও করেননি। ঠিক এ মুহূর্তে তাঁর ফুফুআম্মার চিঠি আসে তাঁর আম্মার কাছে। যাওয়ার অনুরোধ করা হয়। এটাই ছিল হযরতের জীবনে সর্বপ্রথম ও এ্রতিহাসিক সফর। এ সফরেই তিনি আল্লামা ইকবালসহ খ্যাতনামা সাহিত্যিক, এতিহাসিক এবং বড় বড় মনীষীদের 'মজলিসে গমন করেন। হযরত লাহোরীর কথা তিনি ইতিপূর্বে শুনেছিলেন এবং এ সফরে হযরতের সাথে দেখা করার জন্য মানসিকভাবে তৈরী হয়েছিলেন। একই সময়ে তাঁর বড় ভাই ডাঃ সাইয়েদ আবদুল আলী সাহেবের চিঠি আসে হযরত আলী মিয়ার ফুফার কাছে। চিঠিতে আলী মিয়াকে অবশ্যই হযরত লাহোরীর সোহবতে হাজির করার জন্য তাকিদ করা হয়। মে মাসের শেষ সপ্তাহের দিকে বিজ্ঞ ফুপা সাইয়েদ তালহা সাহেব আলী মিয়াকে হ্যরত লাহোরীর খেদমতে নিয়ে যান। এঁ সময় তীর বয়স ছিল ১৫/১৬ বছর। তাঁর পরিচয়ে দু'টি কথা বলা হতো। প্রথমতঃ এ ছেলেটি নাষেমে নদওয়াতুল উলামা হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবদুল হাই (রহ.)- এর সাহেবজাদা। দ্বিতীয়তঃ এ ছেলেটি আরবী ভাষা লেখা এবং বলায় খুবই পারদশী। হযরত মাওলানা আহমাদ আলী লাহোরী এঁ সময় নওজোয়ান আলী মিয়াকে অত্যন্ত নেহ ও মহব্মতের সাথে গ্রহণ করেন। আলী মির়ীর অন্তরের নরম জমিতে হযরতের মহব্বত ও ভক্তির বীজ এ সময় থেকেই অংকুরিত হয়। ফলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বারও গরমের ছুটিতে তিনি দরসে তাফসীরে অংশগ্রহণ করার জন্য লাহোর গমন করেন। কিন্তু মাদরাসার ফারেগ ছাত্রদের জন্য রমযান, শাওয়াল ও জিলকদ তিন মাসব্যাপী যে দরস হত সে সময় তা ছিল না। এঁ সময় শুধু ফজরের নামাযের পর সাধারণ দরস হত এবং মাগরিবের নামাধের পর কেবল ইংরেজী শিক্ষিত লোকদের দরস হত। এরপরও হযরত লাহোরী আলী মিয়াকে নির্দিষ্ট একটি সময় দেন। এ থেকে হযরত আলী মিয়ার মধ্যে ইলমে মা'রেফাতের স্ষুরণ ঘটতে শুরু করে এবং দ্বীনী জযবা সৃষ্টি হয়।

হযরত আলী মিয়ী তার 'পুরানে চেরাগের' প্রথম খণ্ডে লিখেছেন যে, হযরত লাহোরীর তাফসীরের খোলাসা বা সারমর্ম ছিল তিনটি মৌলিক বিষয়_

প্রথমতঃ আকীদায়ে তাওহীদের ব্যাখ্যা। এ ব্যাপারে তার আলোচনার পদ্ধতি ছিল মাওলানা ইসমাঈল শহীদের আলোচনার মত। হযরতের আলোচনা যেহেতু আমাদের খানদানী মাসলাকের আলোচনা তাই তার মাধুর্য অন্তরে খুবই দৃঢ়ভাবে আসন গ্রহণ করেছিল!

দ্বিতীয়তঃ আহলুল্লাহ ও বুযুর্গানে দ্বীনের আলোচনা । হযরত লাহোরী তার তাফসীরের দরসে মাঝে মধ্যে নিজের সিলসিলার আকাবিরের বিভিন্ন চমকপ্রদ ঘটনা খুবই আবেগের সাথে বর্ণনা করতেন। তাঁর শায়খ ও পীর ছিলেন যথাক্রমে মাওলানা সাইয়েদ তাজ মাহমুদ সাহেব আমরূহী ও খলীফা গোলাম মুহাম্মাদ সাহেব দীনপুরী (রহ.)। হযরত লাহোরী যখন এ দুই বুষুর্গের আলোচনা করতেন তখন মনে হত তার সংগৃহীত তান্ডারের মুখ খুলে গেছে। শ্রোতাদের অন্তরে এসব আলোচনার ব্যাপক প্রভাব না পড়ে পারতো না। তৃতীয়তঃ জিহাদের জযবা ও ইংরেজদের সাথে দুশমনী বিষয়ক আলোচনা । হযরত আলী মিয়ার জীবন এ সময় পর্যন্ত গড়ে উঠেছিল নদওয়ার খালেছ ইলমী ও আদবী পরিবেশে । খান্দানের মধ্যেও এ ধরনের আলোচনা কমে গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে হযরত লাহোরীর দরসে তাফসীর থেকেই হযরত আলী মিয়া ইসলাহ ও সুলুকের এই নতুন জগতের সন্ধান পান।

১৯৩২ সালে হযরত আলী মিয়া হযরত লাহোরীর হুজ্ঞাতুল্লাহিল বালেগার দরসে অংশগ্রহণ করার জন্য হাজির হন। হযরত লাহোরীর দরসে কুরআন, জুম'আর খোতবা ও সাধারণ সমাবেশে আহ্লুল্লাহগণের আলোচনা চালু থাকতো এবং মনে হত যে, এটাই মাওলানার আসল আগ্রহ আসল দাওয়াত। এর সাথে সাথে হযরত লাহোরীর সোহবতে বার বার উপস্থিত হওয়ার এবং তার সরল, অনাড়ন্বর জীবনধারা কাছে থেকে দেখার সুযোগ আলী মিয়ার হয়েছিল। এতদিন তিনি যা শুধু শুনেই আসছিলেন এবার তাঁর বাস্তব চিত্র হযরত লাহোরীর মাঝে খুঁজে পেয়ে তাঁর ভক্ত ও অনুরক্ত হয়ে পড়েন।

দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ও প্রথম বায়আত[সম্পাদনা]

১৯৩১ আাল। দরসে তাফসীরে অংশথহণের পর পরই হযরত আলী মিয়ার অন্তরে হযরত লাহোরীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও আযমত বসে যায়। তখন তিনি হযরত লাহোরীর হাতে নিজের রূহানী, ইলাহী এবং তাকমীলের লাগাম ন্যন্ত করার জন্য চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। অবশেষে একদিন তিনি হযরত লাহোরীর কাছে নিজের মনের কথা খুলে বলেন এবং তাঁর হাতে বায়আত হওয়ার আরজু পেশ করেন। কিন্তু হযরত লাহোরী নিজের পরিবর্তে তাঁর শারখ হযরত খলীফা গোলাম মোহাম্মাদ সাহেব ভাওয়ালপুরীর খেদমতে কানপুর জেলার দীনপুরে একটি পরিচিতিমূলক পত্র দিয়ে আলী মিয়াকে পাঠিয়ে দেন।

দীনপুরের পরিবেশ ছিল খুবই সুন্দর। দীনপুর যথার্থই দীনপুর ছিল। কাদেরিয়া তরীকায় দিন-রাত মসজিদ, খানকাহ্‌ ও বস্তি আল্লাহর যিকিরে মুখরিত থাকতো । এটি ছিল একটি ছোট গ্রাম। সেখানে হযরত আলী মিয়া খলীফা সাহেবের হাতে বায়আাত হওয়ার পরও হযরত লাহোরীকে নিজের পীর ও মোরশেদ মনে করতেন এবং হযরত লাহোরীও তাকে নিজের প্রিয় শাগরেদে রশীদ মনে করতেন। ১৯৩৪ সালের এপ্রিল মাসের দিকে হযরত ইঙ্গিত দিলে তিনি নিরিবিলি পরিবেশে শায়খের সোহবতে থেকে যিকির- আযকার ও আত্মশুদ্ধির'ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি লাভের আশায় হযরত লাহোরীর খেদমতে হাজির হন। এ সময় হযরত লাহোরী তাঁকে লাহোরের শাহী মসজিদের একটি নীরব কামরায় অবস্থান করার এবং ইলমী কাজ ও কিতাবপত্র অধ্যরন করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। এঁ সময় তিনি প্রায় তিন মাস পর্যন্ত হযরতের খেদমতে অবস্থান করেছিলেন । শুধু যিকিরের শোগল জার তেলাওয়াত ব্যতীত অন্য কোন মা“মুলাত ছিল না। কারো সাথে কোন কথা বলারও অনুমতি ছিল না। মাগরিবের পর থেকে ইশা পর্যন্ত িকিরে মগ্ন থাকতেন।

ইজাযাত ও খেলাফত[সম্পাদনা]

লাহোর থেকে ফিরে আসার পর হযরত আলী মিয়া দারুল উল্‌্ম নদওয়াতুল উলামায় অধ্যাপনা ও কিতাবপত্র রচনায় মশগুল হন। মারকাষে নিযামুদ্দীনের সাথে যোগাযোগ এবং বুযুর্গানে দেওবন্দ, সাহারানপুর ও রায়পুরের সাথে ভক্তি ও মহব্বত সত্ত্বেও হযরত মাওলানা আহমাদ আলী লাহোরী (রহ.)-এর সাথে তীর রূহানী যোগাযোগ সব সময় চালু রাখেন। হযরত লাহোরীও তাঁর এই যোগ্য শাগরেদকে সব সময় মহব্ৰতের নজরে দেখতেন। ১৯৪৬ সালে হজ্জের সফর থেকে ফিরে এসে এক চিঠিতে হযরত লাহোরী আলী মিয়াকে লাহোরে আসার হুকুম দেন। হযরত আলী মিয়া বলেন, চিঠি পেয়ে আমি লাহোরে হযরতের খেদমতে হাজির হই। শর সময় একদিন আমাকে নিরিবিলি ডেকে নিয়ে নিজের কাদেরিয়া সিলসিলায় ইজাযত দান করেন। অবশ এই ইজাযত দেয়ার পূর্বে হযরত লাহোরী হজ্জের সময় তার এ প্রিয় শাগরেদের জন্য মসজিদে খায়েফে ও মীনা ময়দানে খুবই গুরুত্রে সাথে দু'আ করেছিলেন।

হযরত মাওলানা আবদুল কাদের রায়পুরী (রহ.)-এর খেদমতে[সম্পাদনা]

দেশ বিভক্তির পর পাকিস্তানে গিয়ে নিজের পুরানো রূহানী কেন্দ্র হতে ফায়েদা লাভ করা হযরত আলী মিয়ার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে; তাই তিনি এই রূহানী সফর ও ইসলাহী কার্যক্রম জারী রাখার জন্য নতুন রূহানী ব্যক্তিত্বের সন্ধান করতে থাকেন। এ ব্যাপারে শায়খুল হাদীছ হযরত মাওলানা জাকারিয়া (রহ.) তাঁকে এঁ সময়ের বিখ্যাত বুষুর্গ আলেম হযরত রায়পুরী (রহ.)-এর খেদমতে হাজির হওয়ার জন্য তাকীদ করতে থাকেন। সেমতে তিনি হযরত-রায়পুরীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চিন্তাভাবনা করতে থাকেন।

হযরত রায়পুরী (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়[সম্পাদনা]

জন্ম ৪ হযরত মাওলানা আবদুল কাদের রায়পুরী সম্ভবত ১২৯০ হিজরী, মোতাবেক ১৮৭৩ ইং সালের দিকে পশ্চিম পাঞ্জাবের সারগোদা জেলার ঢুড়িয়া নামক স্থানে জন্মঘরহণ করেন।

শিক্ষা ৪ প্রাথমিক শিক্ষা তিনি তাঁর চাচা হাফেয ইয়াসীন সাহেবের নিকট লাভ করেন। অতপর মাওলানা কলিমুল্াহর নিকট হেফয শেষ করেন। তারপর ঢুড়িয়ার নিকটে ভারত শরীফ এবং ঝাউরিয়া মাদরাসা হতে বুনিয়াদী ইলম হাসেল করেন।

উচ্চশিক্ষা £ প্রাথমিক ও বুনিয়াদী শিক্ষা লাভ করার পর তিনি কুরআন- হাদীছের উচ্চ শিক্ষা লাভ করার জন্য ভারতে আসেন এবং সাহারানপুর, দিল্লী, পানিপথ, রামপুর, বেরেলী প্রভৃতি স্থানে অত্যন্ত মুজাহাদার সাথে আর্থিক অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে ইলম হাসেল করেন। সম্ভবত ১৯০১ বা ০২ সালে বেরেলীতে থাকা অবস্থায় তার দরসিয়াত পূর্ণ হয়।

কর্মজীবন £ দরসিয়াত হতে ফারেগ হওয়ার পর তিনি বেরেলীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সাহেবযাদার শিক্ষক নিযুক্ত হন। কয়েকমাস পর সেখান থেকে তিনি বিজনৌরে তার এক সাথীর মাধ্যমে আফযলগড়ে হাজির হন এবং ছয় মাস যাবত হাকিমী পেশায় লিপ্ত থাকেন।

আধ্যাত্মিক সাধনা ৪ বেরেলী ও অন্যান্য জায়গায় থাকা অবস্থাতেই হযরত রায়পুরীর দিলের মধ্যে আল্লাহ পাকের মহব্বতের বীজ অংকুরিত হয়। সে সময় হতেই তিনি আল্লাহওয়ালা শায়খের তালাশ শুরু করেন। তিনি ইমাম গাজ্জালী (রহ.)-এর আল-মুনকেজ মিনাদদলাল খরন্থুখানি অধ্যয়ন করে অভিভূত হন এবং দেখতে পান যে, ইমাম গাজ্জালী রেহ.) নিজের রূহানী পিপাসা ও তলব মিটানোর জন্য নেযামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহওয়ালাদের সোহবত হাসেল করার জন্য কি রকম ব্যাকুল হয়েছিলেন। হযরতের চিন্তাধারার মধ্যেও বিরাট পরিবর্তন আসে। তিনি বুঝতে পারেন যে, আমরা যা কিছু দরস-তাদরীস করছি এর মধ্যে হাকীকত কিছুই নেই, সবই শাব্দিক ও মৌখিক। এর মধ্যে আল্লাহ পাকের মারেফাত ও মহব্বত কিছুই নেই। তাই তিনি একজন হন্কানী পীরের খোজে সারাক্ষণ পেরেশান থাকতেন। এঁ সময় হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (রহ.)-এর 'তুহফাতুল উশশাক' গরন্থখানা পড়ে তিনি আরো এশকের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকেন এবং তীর পেরেসানী বাড়তে থাকে।

তখন কুতুবে আলম হযরত মাওলানা রশীদ আহমাদ গংগুহীর রুশদ ও হেদায়েতের সূর্য সারা হিন্দুস্তানকে আলোকিত করে রেখেছিল। হযরত হাজী সাহেবের কিতাবপত্র অধ্যয়ন ও আকাবেরে উলামায়ে দেওবন্দের উপর ভালো ধারণা রাখার এবং সুন্নতের উপর পাবন্দ থাকার কারণে এ মোবারক সিলসিলার সাথেই তীর মুনাসাবাত বা চিন্তা-চেতনার সামঞ্জস্য হয়ে যায়। তৎকালে হযরত গংগুহীর বিখ্যাত খলীফা হযরত মাওলানা শাহ আব্তুর রহীম রায়পুরী সাহেব পূর্ব পাল্রাবে সফরে যেতেন। হযরতের কয়েকজন মুরীদের সাথে মাওলানা আবৃদুল কাদের রায়পুরীর দেখা-সাক্ষাৎ হয়।

তিনি আফযালগড় হতে হযরত মাওলানা শাহ আব্দুর রহীম (রহ.)-এর কাছে নিজের মনের আবেগের কথা জানিয়ে পত্র লেখেন । হযরত শাহ আব্দুর রহীম জবাবে বলেন যে, আমি কোন ব্যক্তিত্বই নই, আমার মধ্যে কিছু নেই, আপনি হযরত গংগুহীর কাছে মুরীদ হন। হযরত মাওলানা আবৃদুল কাদের সাহেব ইতিপূর্বে একবার হযরত গাংগুহীর দরবারে হাজির হয়ে ছিলেন, কিন্তু. তীর জালালাতে শান এবং উঁচু মরতব প্রত্যক্ষ করে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন যে এত বড় শায়খের কাছ থেকে ফায়েদা হাসেল করার সুযোগ খুবই কম মিলবে । তিনি আরো চিন্তা করেছিলেন যে, এখানে বড় সনদ ও বড় শায়খ উদ্দেশ্য নয়; বরং আসল ব্যাপাত্র হল মুনাসাবাত ও ফায়েদ' হাসেল করা। আন্রাহ পাক হযরত মাওলানা 'আবদুল কাদের রায়পুরীকে বিশেষভাবে রাস্তা দেখিয়েছিলেন, তাই তিনি হযরত মাওলানা শাহ আব্দুর রহীম রায়পুরীকেই নিজের ইসলাহ ও তারবিয়তের শায়খ নির্বাচন করেছিলেন এবং তার কদমেই নিজেকে সোপর্দ করেন।

চিঠিপত্রের মাধ্যমে তিনি শাহ সাহেবকে তা জানিয়ে দেন এবং (১৯০৫ সাল) ১৩২৩ হিজরীর দিকে রায়পুরে হাজির হয়ে দিনরাত হযরতের সোহবতে সময় কাটাতে থাকেন। হযরত শাহ সাহেবের অনুরোধে জীবনভর রায়পুরে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯১০ সালে তিনি শায়খের সাথে প্রথম হজ্জ করেন। ১৯২৭ সালে দ্বিতীয় বার হজ্জ করেন। ইসলামের দাওয়াত এবং পয়গাম নিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় সফর করতেন। দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি কঠোর মোজাহাদা করে খেলাফত লাভে ধন্য হন। হযরত শাহ আবদুর রহীম রায়পুরী রহ.) ইন্তেকালের পূর্বে আবৃদুল কাদের (রহ.)-কে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত করেন। তিনি ১৯১৯ সালের ২৯শে জানুয়ারী ইন্তেকাল করেন। অতপর হযরত আবদুল কাদের রায়পুরী (রহ.) নিজ শায়খের স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাষকিয়া ও সুলুকের কাজ আঞ্জাম দিতে থাকেন।

ইন্তেকাল 8 এ উপলক্ষে তিনি একবার তথকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও সফর করেছিলেন। এছাড়া পাকিস্তানে তার মুরীদ ও ভক্তের সংখ্যা কম ছিল না। তাই তিনি কয়েকবার পাকিস্তানে সফর করেছিলেন। ১৯৬২ সালের ১লা মে তিনি লাহোর হাজির হন। দাওয়াতী ও ইসলাহী সফর চলতে থাকে। ইতিমধ্যে ৮ই আগষ্ট হতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৬ই আগষ্ট বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে লাহোরে ইন্তেকাল করেন। লাহোরে প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়, অতঃপর লায়লপুর, সারগোদা এবং সবশেষে টুড়িয়া নামক স্থানে জানাযা শেষে ফজরের নামাযের পূর্ব মুহূর্তে হযরতের দাফনের কাজ শেষ হয়। প্রথম সাক্ষাৎ

ইতিপূর্বে হযরত আলী মিয়ার চিরজীবনের সাথী হযরত মাওলানা মনযুর নোমানী (রহ.) ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মাওলানা আলী মিয়া এবং হাজী আবদুল ওয়াহেদ সাহেবকে নিয়ে হযরত রায়পুরীর খেদমতে উপস্থিত হলে তিনি যখন আলী মিয়ার সাথে মোয়ানাকা করেন তখন বলেছিলেন যে, আমি তো আপনার অপেক্ষায়ই ছিলাম ।

তখন হযরত রায়পুরীকে কাছে থেকে দেখার এবং রায়পুরের খানকাহ ও সেখানকার পরিবেশ দেখার সুযোগ হয়েছিল। হযরত আলী মিয়া হযরত রায়পুরীর মাঝে খুঁজে পান নিজের রূহানী তম্তা নিবারণের সাম্রী। এ সময় তিনি রায়পুরে মাত্র ২১ দিন অবস্থান করলেও হযরত রায়পুরীর মহব্বত তার অন্তরে বসে গিয়েছিল।

হযরত মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের সাথে পরিচয় হওয়ার পর শায়খুল হাদীছ হযরত মাওলানা যাকারিয়া সাহেবের সাথে মাওলানা আলী গিয়ার পরিচয় হয়। এক চিঠিতে তিনি আলী মিয়াকে লিখেছিলেন. যে, “আমার অন্তরে আপনার রায়পুরের সফরের গুরুত্ব অনেক বেশী। আমি তো এ ব্যাপারে বার বার আপনাকে অনুরোধ কফরেছি। আহলে দিল ব্যক্তিরা এখন রায়পুরেই যেতে পারে । সুযোগ পেলেই কয়েক দিনের জন্য একাগ্তার সাথে থাকার জন্য রায়পুরীর খেদমতে হাজিরা দিবেন। অপর এক চিঠিতে বলেন, “ইঞ্জিনের জন্য আগুনের প্রয়োজন, আর লিল্লাহী আগুন এসব দরবারেই পাওয়া যায়।

রায়পুরের খানকাহ[সম্পাদনা]

সাহারানপুর শহর থেকে ২০/২১ মাইল দূরে শুয়ালাক পাহাড়ের পাদদেশে রায়পুর নামে একটি বস্তি রয়েছে। এটি এমন একটি অজগী ছিল যেখানে পৌঁছবার জন্য একটি পাকা সড়কও ছিল না, পাশে কোন রেল স্টেশনও ছিল না। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এমন একটি পল্লীতে পূর্ণ একাথতার সাথে তাআন্ুক মাআল্লাহর নিসবত কায়েম করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্তবৃনদরা ছুটে আসতেন। যেখানে হযরত মাওলানা শাহ আব্দুর রহীম রায়পুরী (রহ.)-এর সুযোগ্য খলীফা হযরত মাওলানা শাহ আবদুল কাদের রায়পুরী অবস্থান করতেন। রার়পুরের খানকাহ ছিল নীরব, তবে এসকল ঘিন্দা খানকাগুলো হতেই তখনকার যুগের মুসলমানদের দ্বীনী, ঈমানী এবং মামাজিক দিক-নির্দেশনা দেয়া হচ্ছিল।

মোর্শেদের দেলে আলী মিয়ার মাকাম

নিয়মতান্ত্রিক ইসলাহী সম্পর্ক স্থাপনের পর হযরত আলী মিয়ার রায়পুরে যাতায়াতের সিলসিলা শুরু হয়ে যায় এবং উভয়ের মধ্যে এ সম্পর্ক এমন রূপ লাভ করে যা অন্যদের জন্য ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।

হযরত রায়াপুরী হযরত আলী মিয়াকে 'এত মহব্বত করতেন যে, চিঠিতে তিনি তাঁকে সাইয়েদী ওয়া মাওলায়ী (আমার নেতা, আমার সর্দার) বলে সম্বোধন করতেন। হযরত আলী মিয়ী হযরত রায়পুরীকে সাইয়েদী ওয়া মুরশিদী সন্দোধন করে পত্র লিখলে হযরত রায়পুরী তার জবাবে লেখেন যে, হযরত “আপনি আমাকে কি সাইয়েদী ওয়া মাওলায়ী লেখেন? আমি তো আপনার খাদেম।” অপর এক চিঠিতে হযরত রায়পুরী নিজেকে মাওলানা রূমী ও হযরত মাওলানাকে শামছে তিবরিজ হিসেবে উল্লেখ করেন।

মোটকথা এ সম্পর্ক আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে । অবশেষে হযরত রায়পুরী লাখনৌ সফরের সময় ১৯৪৮ সালের ২৪ শে এপ্রিল রায়বেরেলীর তাকিয়া কেলায় হযরতের বাড়িতে উপস্থিত হন। এ সময় তিনি একদিন হযরত সাইয়েদ -আহমাদ শহীদের মসজিদের সামনে হযরত আলী মিয়াকে ডেকে বলেছিলেন, আমি আপনাকে চার সিলসিলারই বিশেষ করে সাইয়েদ সাহেবের সিলসিলায় ইজাযত দিচ্ছি।

১৯৫০ সালে হযরত আলী মিয়া স্বীয় মোরশেদ হযরত মাওলানা রায়পুরীর সাথে হজ্জ করেন। এটা ছিল মাওলানা আলী মিয়ার দ্বিতীয় হজ্জ। এ হজ্জের সফর সম্পর্কে হযরত রায়পুরী বলতেন, “এ সফর আমি তোমার জন্যই করছি। ৪ঠা সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে তিনি বোম্বাই হতে ইসলামী জাহাজে রওয়ানা হন। এই হজ্জের পর হযরতের জীবনের সবচেয়ে মোবারক দিন ছিল এদিন যেদিন তিনি কাবা শরীফের চাবি হেফাযতকারী শায়বী সাহেবের দাওয়াতে তিনি ও তাঁর সাথী-সঙ্গীরা পবিত্র কাবা ঘরে প্রবেশের সুযোগ পান। এ সুযোগ তাঁর পীর মোরশেদ হযরত রায়পুরীও পেয়েছিলেন। হ্যরত আলী মিয্না তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, রাবেতা আলমে ইসলামীর সদস্য হওয়ার কারণে এ সুযোগ পরবর্তী সময়ে আরো দু'বার হলেও তাতে তিনি সফলকাম হননি । শুধু তাঁর পীর যোরশেদের দু'আ ও আল্লাহপাকের মেহেরবানীতে এ হজ্জের সফরেই এই সৌভাগ্য লাভ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি দীর্ঘ সময় ধরে হযরত রায়পুরীর সোহবত শুধু এ সফরেই লাভ করেছিলেন।

নামাষের সময় হযরত রায়পুরীর অবস্থান হেরেম শরীফের একটি তাবুতে থাকতো । দুপুরে তিনি সেখানেই খেতেন। হযরত আলী মিয়ার তাবলীগী এজতেমা এবং উলামা ও বিশেষ ব্যক্তিবর্গের সাথে আলাপ আলোচনার কারণে তাবুতে ফিরতে প্রায়ই বেশ দেরী হয়ে যেত। তিনি ফিরে এসে দেখতেন তাঁর পীর ও মোরশেদ বসে আছেন আর সামনে রুমালে রুটি পড়ে আছে। তিনি আলী মিয়াকে দেখেই বলে উঠতেন, “আলী মিয়া তোমার খানারও হুশ নেই; এই দেখ, আমি তোমার জন্য চাপাতি-কুটি নিয়ে বসে আছি, কেননা সাধারণ রুটি তোমার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর । মদীনা শরীফে যাওয়ার সময় হলে তিনি হযরত আলী মিয়াকে বলেছিলেন, “এখন থেকে তুমি আমার সাথে থাকবে, শায়খের মেহমানী শেষ।” (এ সময় আলী মিরা শায়খের পক্ষ থেকে বদলী হজ্জ করছিলেন) .

মদীনাতে তিনি নিজ শায়খের সাথেই ছিলেন। ১৯৫০ সালের ২রা

নভেম্বর হযরত রায়পুরী নিজের সাথী-সঙ্গীসহ জাহাজে আরোহণ করেন। হযরত রায়পুরীর একজন খাদেম বলেন যে, লঞ্চ থেকে যত সময় আলী মিয়াকে দেখা যাচ্ছিল ততক্ষণ পর্যস্ত হযরত রায়পুরী তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হযরত রায়পুরী তাঁর এ মুরীদকে কেমন মহব্বত ও শফকতের নজরে দেখতেন তা উক্ত ঘটনা দ্বারা ভালভাবে বুঝা যায়। হযরত আলী মিয়া সৌদী আরব ও অন্যান্য দেশে সফরের কর্মসূচী থাকার কারণে হযরতের সাথে ফিরে আসতে পারেননি ।

হযরত থানভীর সোহবতে মাওলানা নদভী[সম্পাদনা]

হাকিমুল উম্মত মুজাদদেদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ১৯৩৮ সালের আগষ্ট মাসে চিকিৎসার জন্য লাখনৌ তাশরীফ নিয়ে আসেন। এ সময় মাওলানা আলী মিয়ার বড় ভাই ডাঃ সাইয়েদ আব্দুল আলী সাহেব আলী মিয়াকে নিয়ে প্রতিদিন হযরত থানভীর খেদমতে হাজির হতেন। এ সময় হযরত থানভীর ভাগিনা মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী (রহ.) আল-কওলুল মানসর গ্রন্থ প্রণয়ন করছিলেন। এ গ্রন্থ হযরত থানভীর খুবই প্রিয় ছিল। এ গ্রন্থে অনেক আরবী ইবারত ঠিক করার দায়িত্ব তিনি হযরত আলী মিয়ার উপর ন্যস্ত করেন। এর ফলে আলী মিয়া হযরত থানভীর নেক নজরে পড়েন এবং হযরত থানভীর বিশেষ দোয়া লাভে ধন্য হন। একদিন হযরত থানভী (রহ.) পায়ে হেঁটে হযরত আলী মিয়ার বড় ভাইয়ের বাড়িতে উপস্থিত হন এবং কিছু সময় অবস্থান করেন।

এই তিনজন বুমুর্গ ব্যতীতও তিনি তাঁর যামানার প্রায় সকল বিখ্যাত বুধূ্গানে দ্বীনের সোহবতে যাওয়া আসা করতেন এবং তাঁদের থেকে ফয়েয হাসিল করতেন।

যিকরে ইলাহী ও মুজাহাদা[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) যখন সুলুক ও মারেফাতের পথে পদচারণা শুরু করেন তখন হতে তিনি যিকরে ইলাহিকে নিজের প্রাণ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাহাজ্জুদ হতে ফারেগ হওয়ার পর তিনি “নফি-ইসবাতের' যিকির করতেন। যৌবনকালে মাগরিব বাদ যিকিরের নিয়ম ছিল। অধ্যাপনার যামানায় তিনি কুরআন পাক হেফয করা শুরু করেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হেফয করতেন। তেলাওয়াতের মা'মুল ছিল পৃথক। ইশরাক হতে ফারেগ হওয়ার পর মুখস্ত কুরআন শোনাতেন এবং দেখে দেখেও তেলাওয়াত করতেন। তারপর নিজ পিতার লেখা কিতাব “তাহযীবুল আখলাক' মোতালা'আ করতেন। এ সময় দেড়-দু'ঘন্টা বুখারী শরীফ শোনারও নিয়ম হয়ে গিয়েছিল । তাকিয়া কেলায় অবস্থান কালে মাওলানা আবদুল্লাহ আব্বাস নদভী এই দায়িত্ব পালন করতেন।

হযরতের পুরো৷ জীবন ছিল মুজাহাদার এক উজ্জ্বল নমুনা। নদওয়ার জীবনে অধিকাংশ সময় এমন ইতো যে, নাশতারই সুযোগ হতো না। নাস্তা ছাড়াই সবক পড়ানো শুরু করতেন। প্রচন্ড গরমের দিনেও সফরের ধারাবাহিকতায় তেমন একটা ছেদ পড়ত না। অন্যের খাতিরে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি তিনি লক্ষ্য রাখতে পারতেন না।

নিজের ইচ্ছাশক্তি ও সিদ্ধান্তকে মুরুবীর ইচ্ছার নিকট সঁপে দেয়া ব্যতীত সুলুকের লাইনে কেউই অগ্রসর হতে পারেনি । তিনি পুরো জীবন এটি পালন করে দেখিয়ে গিয়েছেন।

তিনি নিজের ইলমী ও ফিকরী অসাধারণত্ের পরেও সব সময় নিজের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে মুরববীদের পরামর্শের উপর চলতেন। তিনি বড় ভাই ডাঃ আব্দুল আলী সাহেবের নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। একবার এক গুরুত্ৃপূর্ণ সফরের প্রোথাম ছিল। হযরত রায়পুরীর খেয়াল ছিল তখন সফর না করার। হযরত আলী মিয়া সাথে সাথে হযরতের কথা মেনে নেন। হযরত রায়পুরী তখন আলী মিয়ার চেহারার দিকে নজর করে দেখেন আলী মিয়া নারাজ হয়েছে কিনা। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ! হযরত আলী মিয়া অন্তর থেকেই তা মেনে নিয়েছিলেন। ফলে তাঁর চেহারায় কোন আছর পড়েনি । হযরত রায়পুরী এ অবস্থা দেখে খুবই খুশী হন।

হযরত রায়পুরীর ইন্তেকালের পর তিনি সব সময় হযরত শায়খুল হাদীছ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে চলতেন। আসলে মুরব্বীদের কথা মেনে চলাই মানুষের উন্নতির সিঁড়ি।

বাতেনী অবস্থা[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা আলী মিয়া আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এশক ও মুহাববতে ডুবে থাকতেন । মাঝে মাঝে তিনি বিভিন্ন কবিতা শোনাতেন। তিনি আল্লামা ইকবালের কবিতা থেকে বিভিন্ন কবিতা পড়তেন। আল্লামা ইকবালের সাথে তাঁর গভীর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

হযরত আলী মিয়ার মধ্যে তাওহীদ ও সুন্নাতের কেমন মহব্বত ছিল তা তার সাথে সফরে যাঁরা থাকতেন তারাই অধিক বুঝতে পারতেন । তিনি বেশী বেশী বলতেন- ০৮ 4 ০ 91 ৪1 ৭৮ তিনি ওয়াজের মধ্যে আকীদা- বিশ্বাসের উপর খুবই জোর দিতেন। হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর ওয়াজ, হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর অসিয়ত, হযরত আবৃদুল কাদের জিলানী, শায়খ শরফুদ্দীন মানেরী প্রমুখ মনীষী তাওহীদ সম্পর্কে যেসব ঘটনা লিখেছেন, তিনি সেগুলিই বেশী বেশী বয়ান করতেন। শেষের দিকে এ বিষয়টি এতবেশী প্রাধান্য পেয়েছিল যে, তিনি কোন ব্যক্তিকে বায়আত করানোর সময় বায়আতের শব্দের পর আকীদায়ে তাওহীদ গ্রহণ করার এবং তার উপর দৃঢ় থাকার উপদেশ দিতেন এবং শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকার তালকীন করতেন। "

বৈশিষ্ট্য। হযরত আলী মিয়ার মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যটি প্রত্যক্ষ করা যেত এবং যা তাঁকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছিল, তাহল উম্মতে মুসলিমার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা। মুসলিম বিশ্ব তাঁকে "মুফাক্কিরে ইসলাম” উপাধীতে ভূষিত করেছিল। তিনি এ উম্মতের জন্য এতটাই ব্যাকুল থাকতেন যে, মাঝে মাঝে বিনিদ্র রাত কাটাতেন। উম্মতে মুসলিমাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর চিন্তা-ভাবনা তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্যবন্তুতে পরিণত হয়েছিল । তাই তিনি এই ব্যথা নিয়ে সমগ পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতেন।

ফানাইয়াত (আত্মবিলোপ)[সম্পাদনা]

হযরত আলী মিয়া এতবড় আলেম ও চিন্তাবিদ হওয়ার পরও কোন সময় নিজের প্রশংসা বা আত্মগ্ৌৌরবে বিভোর হয়ে কোন বাক্য বলেননি । তিনি সব সময় নিজেকে গোপন রাখতে ভালবাসতেন । একবার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হযরত রায়পুরীর খেদমতে বসা ছিলেন। এ সময় হযরত রার়পুরী চুপ ছিলেন। মজলিস চলছিল । খাদেমরা এজন্য পেরেশান হচ্ছিল যে, হযরত কিছু কথা বললে নুতন আগন্তকরা ফায়েদা পেত। একজন খাদেম জিজ্ঞাসা করল, “হযরত সবরের অর্থ কি?” *

হযরত চুপচাপ বসে থাকলেন । জিজ্ঞাসাকারী মনে করলেন, হযরত বোধ হয় শুনতে পাননি । পুনরায় উচ্চস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, হযরত, “সবরের অর্থ কি?" তখন হযরত বললেন, “আলী মিয়ার কাছে জিজ্ঞাসা কর।” আলী মিয়া বললেন, আমিতো এটার শুধু জাহেরী অর্থ বলতে পারি। হযরত রায়পুরী বললেন, আমি তো তাও পারি না। বে-নফসি আর কাকে বলে! এই অবস্থায়ই হযরত আলী মিয়ী পুরো জীবন কাটিয়েছেন। দেখা গেছে কেউ আসুক বা না আসুক কখনও ইশীরাও করেননি যে, আমার কাছে মুরীদ হও । শুরুতে কেউ মুরীদ হতে এলে তিনি তাকে অন্যান্য মাশায়েখের খেদমতে পাঠাতেন। কেউ নাছোড়বান্দা হলে হযরত বায়আত করে নিতেন।

হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী জীবনে অনেক কাজই করেছেন ও তার জীবনের সাথে পৃথিবীর বড় বড় সংস্থার যোগাযোগ ছিল? কিন্তু ঘূর্ণাক্ষরেও তীর মুখ থেকে কেউ কোন দিন একথা বলতে শুনেনি যে, আমি এ কাজ করেছি, এটা আমার কীর্তি। সম্ভবত আমি ও আমর এ দু'টি শব্দ হযরত আলী মিয়ার অভিধানে ছিল না। আল্লাহ পাকের রেযামন্দী ও মহব্বতের সাগরে আমি ও আমরা এ দু'টি শব্দ হারিয়ে গিয়েছিল। কোন সময় আল্লাহ পাকের নেয়ামতের শোকর আদায় করতে গিয়ে মুখ খুললে শোনা যেত, আল্লাহ পাকের তাওফীকে এ কাজ হয়েছে। এসব আমার আব্বাজানের ইখলাস ও ভাই সাহেবের তারবিয়তের ফল, আম্মাজানের দু'আর ফসল, বুষুর্ণানে দ্বীনের সোহবত ও শায়খের তাওয়াজ্জুহর প্রতিক্রিয়া; অন্যথায় আমি গ্রাম্য এলাকায় অবস্থানকারী একজন সাধারণ মানুষ । আমার মুখস্থশক্তিও কম। কবিতা -

৪র্ত ৩০ « ওক ১০ ৩৮ এ উ্ ওএস শে পলা

এ কথা বলতে বলতে তার চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়ে গড়তো। বিশেষ করে নিজের বড় ভাই ও মুরব্বী ডাক্তার আব্দুল আলী সাহেবের প্রসঙ্গ এলে তিনি কেঁদে ফেলতেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে খোশখবরীর চিঠি আসতো । কখনো কখনো তাঁর কোন বই সম্পর্কে প্রশংসা পত্র আসতো । কেউ কেউ মুখে হযরতের এবং তার লেখনীর উপর খোশখবরী শুনালেও হযরত তা কোন দিন তার লেখায়ও আনতেন না বা কাউকে বলতেনও না, শুধু বলতেন, আমি এর যোগ্য নই। এগুণটি তার মধ্যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল। এই,গুণকে তিনি সালেকের জন্য জরুরী মনে করতেন। তিনি বলতেন, নিজের অযোগ্যতার অনুভূতি ও নিজেকে ছোট মনে করা এবং নিজেকে যোগ্য মনে না করা এই রাস্তার সবচেয়ে বড় কথা এবং এরই মধ্যে রয়েছে সালেকের হেফাযত, তারাল্কী ও উন্নতি।

বায়আত[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা বলতেন, বায়আত করা বা সিলসিলায় দাখেল হওয়া নিছক কোন রীতি বা প্রথা নয় যে, এর জন্য কোন মামুলাত আদায় করতে হবে না বা এর জন্য কোন মুজাহাদারও প্রয়োজন নেই। শুধু বরকত লাভ এবং বিখ্যাত হওয়ার উদ্দেশ্যে বায়আত হওয়াকে তিনি পছন্দ করতেন না। বরং তিনি বলতেন- এটা একটা প্রতিজ্ঞা, চুক্তি এবং নতুন দ্বীনী ও ঈমানী জীবন শুরু করার পদক্ষেপ মাত্র। যার ফলে জীবনে কিছু পরিবর্তন, কিছু নিয়মনীতি ও দায়িত্ববোধ এসে যাওয়া সহজ হয়ে যায়।

এ সম্পর্কে তিনি তাঁর মুরীদীন এবং সুহিববীনদেরকে যেসমন্ত প্রয়োজনীয় ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ হেদায়েত দান করতেন তার কিছুটা এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে 8

(১) সর্বপ্রথম জরুরী কথা এই যে, বায়আত হওয়া ও সিলসিলায় দাখেল হওয়ার অর্থ হল, কালেমার উপর নতুন পাঠ, ইসলামী প্রতিজ্ঞা চুক্তি ও বায়আতকে দ্বীনী ও ঈমানী জীবন শুরু করার এবং সে অনুযায়ী রাসূলের হুকুম মোতাবেক জীবনযাপন করার একটি চুক্তি মনে করতে হবে।

(২) সবচেয়ে বড় কথা এই যে, আকীদা বিশুদ্ধ ও পরিপন্ধ করতে হবে। কালেমার উপর ঈমান রাখতে হবে এবং মুখেও স্বীকার করতে হবে যে, আল্লাহ ব্যতীত জীবন-মরণ, শেফা-বিমারী, সন্তান দেয়া, রিঘিক দেয়া, তাকদীরের ভালো-মন্দ করার শঞ্তি আর কারো নেই। আন্মাহ ব্যতীত কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয়। তাঁকে ব্যতীত কাউকে সেজদা করা যায় না। বন্দেগীর শুধু আকৃতি ধারণ করলে চলবে না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে বালা- সুসিবত দূরকারী, হাজত পুরনকারী ভাবা যাবে না।

(৩) সাইয়েদুল মুরসালীন খাতামুন নাবিয়্িনকে আল্লাহ পাকের আখেরী নবী, হেদায়েতের মাধ্যম, শাফাআতের ওসীলা, মহব্বত এবং অনুসরণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে হকদার মনে করতে হবে । সকল ক্ষেত্রে মহানবীর শিক্ষা পালন করার চেষ্টা করা প্রয়োজন। মহানবী (সা.)-এর সীরাত অনুযায়ী জীবন গড়ার চেষ্টা করা এবং তাঁর হাদীছুসমূহ ও সীরাতের কিতাবসমূহ মোতালাজা করার শওক পয়দা করার চেষ্টা করা উচিত।

(8) জীবনকে ইসলামী কাঠামোতে ঢেলে সাজানো এবং জীবনের সঠিক উদ্দেশ্য বুঝবার জন্য “দসতুরে হায়াত” শ্রস্থখানা মোতালাআয় রাখবে। সাথে সাথে হযরত হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর মাওয়ায়েষ ও মালফুযাত মোতালাআ করবে । "

(৫) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো নামাযসমূহ নিষ্ঠার সাথে আদায় করা এবং সুন্নাতের পাবন্দী করা। নামাযের মধ্যে অলসতা ও গাফলতির ক্ষতিপূরণ কোন কিছুতেই হয় না। নামায জামাআতের সাথে মসজিদে আদায় করতে হবে। মহিলারা নামায সঠিক সময়ে পড়বে। মহিলাদের নামায সাধারণতঃ ব্যস্ততার কারণে এবং সাংসারিক ঝামেলার কারণে সঠিক সময়ে পড়া হয়ে ওঠে শা। এটি ঠিক নয়।

(৬) দ্বীনী ও দুনিয়াবী উভয় কাজে সওয়াব এবং রেযায়ে ইলাহীর নিয়তের অনুশীলন করা প্রয়োজন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আখলাকের অনুশীলন করা প্রয়োজন, যেন তাতে ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়। আর সকল কাজ যথাসম্ভব শরীয়ত মোতাবেক এবং সুন্নাত অনুযায়ী করা উচিত। চারিত্রিক ও মেধাগত দুর্বলতা, হিংসা-বিদ্বেষ, অতিরিক্ত ক্রোধ, বেশী কথা বলা, ধন-সম্পদ ও দুনিয়ার মহব্বত পরিত্যাগ করা উচিত।

€৭) যতদূর সম্ভব কুরআনে পাক তেলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন।

(৮) ফজরের নামাযের পূর্বে বা মাগরিবের নামাযের পর অথবা বাদ ইশা (যে সময় সহজ হয় এবং নিয়মিত করা যায়) এক তাসবীহ দুরূদ শরীফ, এক তাসবীহ কালেমায়ে সুওম পড়বে । আর আল্লাহ পাক তাওফীক দিলে শেষ রাতে কয়েক রাকআত তাহাজ্জুদ নামা পড়ার চেষ্টা করবে এবং নিজের সিলসিলার মাশায়েখ ও বুযুর্গদের জন্য দু'আ করবে ।

সালেকীনদের তরবিয়ত ও মামুলাত[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা আলী মির রহ.) তালেবীন ও সালেকীনের তরবিয়তের ব্যাপারে তাদের জওক, ব্যস্ততা, স্বাস্থ্য, ধারণ ক্ষমতা, যোগ্যতা ও উন্নতির দিকে খেয়াল রাখতেন। তিনি সকল অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে যিকিরের তালকীন করতেন এবং সহজতার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতেন। প্রাথমিকভাবে শুধু তিন তাসবীহ আদায়ের মা'মুলাত দিতেন। কেউ বেশী চাইলে অনুমতি দিতেন না। কাউকে সূরায়ে ইখলাসের দু'এক তাসবীহের অনুমতি দিতেন। কাউকে মোয়ামালা পরিশুদ্ধ করতে, ফারায়েযসমূহের পাবন্দী করতে এবং তিনি যেসকল দ্বীনী কাজে লিপ্ত আছেন সেগুলিতে নিয়ত খালেস রাখতে পরামর্শ দিতেন। অধিকাংশ তালেবকে ৫০০ বার কলবী যিকির করার আমল দিতেন অথবা প্রয়োজন অনুযায়ী বা যোগ্যতানুসারে " যিকরে জেহরীর তালকীন করতেন । কেউ বায়আাত হলেই তাকে ২৪ ঘন্টার মা'মুলাত বাতিয়ে দিতেন।

হযরত মাওলানা আলী মিয়া (রহ.) মা'মুলাতের পাবন্দী করাকে খুবই জরুরী মনে করতেন। এক চিঠিতে তিনি তার একজন মুরীদকে লিখেছিলেন, “মাসুলাতের পাবন্দী করবে, কেননা এর দ্বারা কাজের মধ্যে বরকত ও নুরানিয়াত আসবে । অধিকাংশ সময় বায়আতের শব্দাবলী বলার পর পরই তালেবীনের অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যেত। এরকম বহু ঘটনা রয়েছে যে, হযরতের হাতে বায়আত হওয়ার পর ব্যক্তির জীবনের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এক ব্যক্তি বায়আত' হওয়া পছন্দ করতো না। হযরত মাওলানা এমন ব্যক্তিত্ব ছিলেন যার হাতে এমন আলেম ও সাধারণ লোকেরাও বায়আত হত যারা সুলুক এবং তাসাউফের পথ পছন্দ করত না। কিন্তু তারা হযরতের চিন্তা ধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং তার মহব্বতের সাগরে হাবুডুবু খেয়ে হযরতের কাছে বায়আত হয়ে নতুন জীবন লাভ করতেন। এদিকে লক্ষ্য করেই হযরত রসিকতার ছলে বলতেন, আমার খানকাহ “আধুনিক খানকাহ" ।

বায়আতের পর সাধারণ মানুষদের বলতেন_ ওলী, আবদাল, কুতুব কারো থেকে কিছু হয় না, ষ' কিছু হয় আল্লাহ থেকে । তিনি বায়আতের মধ্যে যে সকল কথার অঙ্গীকার নিতেন তা নিম্নূপ-

055) এ ঝা এ খা এ

টা নাত জোন ইলাহ হা মাহ সো মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ পাকের সত্য রাসূল।

আয় আল্লাহ! আমি তওবা করছি কুফর থেকে, শিরক থেকে, বেদআত থেকে, যেনা থেকে, চুরি থেকে, পরের মাল আত্মসাৎ করা থেকে, কারো উপর অপবাদ লাগানো থেকে, নামায ছেড়ে দেয়া থেকে, মিথ্যা বলা থেকে এবং সকল গুনাহ থেকে, যে গুনাহ আমি সারা জীবন করেছি- ছোট হোক বা বড়। আরো অঙ্গীকার করছি যে, রাসূলে পাক (সা.)-এর তাবেদারী করব এবং আপনার সকল হুকুম মানব। আয় আল্লাহ! আমাদের তওবা কবুল করুন। আমাদের গুনাহ খাতা মার্জনা করুন। আমাদের নেক আমল করার এবং আপনার রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ করার তাওফীক দিন।

এরপর হাত ছেড়ে দিতেন এবং বলতেন, এই বিশ্বাস রাখতে হবে 'যে, আল্লাহ পাকই এই' পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, তিনিই শাসক, তিনিই বিধানদাতা এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী । তিনিই দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই চালান। তাঁর হুকুম ব্যতীত বৃক্ষের পাতা নড়তে পারে না এবং ক্ষুদ্র জিনিস উড়তেও পারে না। তিনিই রুজি দান করেন। তিনিই সুস্থতা দেন, তিনিই ইজ্জত দেন, তিনিই বেইজ্জত করেন।

বায়আত হওয়ার পর সালেকরা চিঠিপত্রের মাধ্যমে বা তার খেদমতে উপস্থিত হয়ে নিজেদের হালাত জানিয়ে ব্যবস্থাপত্র নিতেন। হযরত তাদের আত্মশুদ্ধির এই মোবারক রাস্তার সঠিক পথ প্রদর্শন করতেন। হযরত মাওলানা আলী মিয়ী (রহ.) তাঁর সাথে সম্পর্কিত সালেকীন ও তালেবীনদের মধ্যে যাদেরকে ভালো মনে করেছেন তাদেরকে ইযাযত ও খেলাফত দিয়ে গিয়েছেন।

নদওয়াতুল উলামা ও নদভী[সম্পাদনা]

নদওয়াতুল উললামার প্রতিষ্ঠা ও প্রেক্ষাপট[সম্পাদনা]

হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এবং ঈসায়ী উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মুসলিম বিশ্ব বিশৃংখলা ও অনৈক্যের বিভীষিকায় চরম নৈরাশ্য আর বিপর্যয়ের -দারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। এমত পরিস্থিতি থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষার একমাত্র উপায় ছিল পরিবর্তনশীল আধুনিকতা ও নিত্য নতুন সমস্যা আর নবতর প্রশ্নগুলোর সুষ্ঠু সমাধান দেয়ার মত যোগ্যতাসম্পন্ন আলেমে দ্বীন তৈরী করা (যারা মুসলিম মিল্লাতের প্রকৃত দিশারী) এবং সেজন্য যথোপযুক্ত শিক্ষা কারিকুলামের মাধ্যমে যুবকদেরকে প্রস্তুত করা।

তখন সমাজে অবাঞ্ছিত বিষয়গুলোর দ্রুত প্রসার ঘটছিল। যুসশমানদের জীবনযাত্রা দটি সমান্তরাল ধারায় আটকা পড়ে গিয়েছিল। একদিকে ছিল আলেম সমাজ, যাঁরা আরবী মাদরাসাগুলো থেকে প্রাচীন ধাচের শিক্ষাপদ্ধতিতে লেখাপড়া করে বের হয়েছিলেন অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণী, যারা কলেজ- ইউনিভার্সিটির আধুনিকতায় লালিত-পালিত হয়ে বের হয়েছিলেন ।

এ উভয় শ্রেণী ছিল পরস্পরের নিকট অপরিচিত ও দুর্বোধ্য । পরস্পরের এই দুরত্ দিন দিন বেড়েই চলছিল । ফলে ক্রমেই এমন একটা আশংকা স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছিল যে, এ উভয়পক্ষের দূরত্বে এমন একটা বিচ্ছিন্নতার সাগর সৃষ্টি হবে যার দ্রুত কোন বিহিত না করলে এ দ:শ্রেণীর মাঝে কোন সেতুবন্ধন রচনা করা সম্ভব হয়ে উঠবে না।

সমস্যা শুধু এ দুই শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মুসলিম মিল্লাত বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মাযহাবী ফেরকা, বিভিন্ন মাসআলাকে অবলম্বন করে দলবদ্ধতা এবং এক্ষেত্রে একে অপরকে নিকৃষ্ট ও পাপী মনে করা, পরস্পর ঝগড়া-ফ্যাসাদ ছাড়াও একে অপরকে অত্যন্ত কুদৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল । এ সমস্ত বিষয়ের উপর প্রকাশ্যভাবে দিন-তারিখ ধার্য করে ব্যাপক প্রস্তুতির মাধ্যমে 'মুনাযারা' বা তকযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হতো। এসব 'মুজাদালা-যুনাযারা' বা পরস্পর ঝগড়া-ফ্যাসাদ আর তর্ক বিতর্কের বাজার বেশ সরগরম হয়ে উঠেছিল । কখনো কখনো এসব অনুষ্ঠান চরম আক্রমণাত্মক ও আত্মঘাতি রূপ পরিগ্রহ করতো । ূ ' অবস্থা শুধু নেতিবাচক আর নৈরাশ্যজনকই ছিল না, বরং এক দল অন্যদলকে ফাসেক ও কাফের বলে ঘোষণা দেয়ার মত চরম দেখাতে শুরু করে। মাদরাসা শিক্ষায় যে সিলেবাস নিধাঁরিত ছিল তার সামান্য রদবদল করার কোন সুযোগ আছে বলে মনে করা যেতো না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণত চিন্তাধারার প্রশস্ততা ছিল না। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তাধারা ও ইলমী গবেষণার কোন সুযোগ সেখানে ছিল না। দ্বীনী সার্কেলের প্রাণবন্ত হতো যখন আলেম সমাজ কোন উপলক্ষে রাজনীতির ময়দানে নেমে আসতেন । মুসলিম উম্মাহর জীবনযাত্রায় যারা অতন্দ্র প্রহরী হবার কথা, সে আলেম সমাজ পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধ্বংসাত্মক আক্রমণ ও বিষাক্ত ছোবল থেকে মুসলিম যুব সমাজকে রক্ষা করার গুরু দায়িত্বকে একান্ত হেলাচ্ছলে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন । শুধু তাই নয়, শিক্ষিত শ্রেণী ছিল তখন পাশ্চাত্যের তগ্লিবাহক। তারা দেশীয় চিন্তা-চেতনা ও কৃষ্টি-কালচার ধ্বংস করার প্রধান হোতাদের দয়া-অনুকম্পার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল ।

হিজরী ১৩১০, ঈসায়ী ১৮৯২ সালের এই নাজুক ও নিদারুণ ক্রান্তিকালে সময়ের এক আলোকবর্তিকা, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী আলেম মাওলানা সাইয়েদ সুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী (রহ-)-এর একান্ত প্রচেষ্টায় মাদরাসা ফয়ষে আম কানপুরের বাৎসরিক সম্মেলনে দস্তারবন্দীর (পাগড়ী প্রদান) সময় “আঞ্জুমানে নদওয়াতুল উলামা' নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।

===নদওয়াতুল উলামার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী (রহ.) (১৮৪৬-১৯২৭)=== জন্ম 8 মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী (রহ.) ২রা শাবান ১২৬২ হিজরী, মোতাবেক ১৮৪৬ সালের ২৮শে জুলাই উত্তর ভারতের কানপুরে জন্মঘহণ করেন। মাত্র দু'বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। ফলে শিশুকালে তিনি তার দাদা সাইয়েদ শাহ গওস আলী রেহ.)-এর তত্বাবধানে প্রতিপালিত হন। প্রাথমিক শিক্ষা $ তিনি কুরআন শরীফ নিজ চাচা সাইয়েদ জছুর আলীর নিকট ও ফারসীর প্রাথমিক গ্রস্থাদি মাওলানা সাইয়েদ আব্দুল ওয়াহেদ বিলগামীর নিকট অধ্যয়ন করেন। তিনি কুরআন শরীফ হিফয করা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে এ'মোবারক সিলসিলা চালু রাখতে পারেননি ।

উচ্চশিক্ষা হযরত মাওলানা মুঙ্গেরী উচ্চ শিক্ষার জন্য ১২৭৭ হিজরীতে কানপুরের ফয়যে আম মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা ইনায়েত আহমাদ কাকুরীর নিকট বিভিন্ন কিতাবপত্র অধ্যয়ন করেন। দু'বছর পর তিনি হজ্জে তাশরীফ নিয়ে গেলে হযরত মুঙ্গেরী মাওলানা ইনায়েত আহমাদ (রহ.)-এক্স বিখ্যাত সাগরেদ উত্ত বুল উলামা হযরত মাওলানা লুতফুল্লাহ আলীগড়ী ও মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন শাহ সাহেবের নিকট ইলম হাসেল করতে থাকেন।

বিবাহঃ মাদরাসা ফয়যে আমে অবস্থান কালে তিনি তাঁর মায়ের অনুরোধে আত্মীয়ের খান্দানে ২২ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং সেখানে দু'বছর অবস্থান করেন।

দরসিয়াতের তাকমীল ঃ এঁ সময় হযরত মাওলানা লুৎফুল্লাহ আলীগড়ী কানপুর হতে আলীগড়ে এসে দ্রস-তাদরীস শুরু করেন। হযরত মুক্গেরী এ সংবাদ গেয়ে সোজা আলীগড়ে এসে পুনরায় উত্তাদের দরসে হাজির হন এবং সিহাহসিত্তাসহ দরসিয়াতের কিতাবাদি সমাপ্ত করেন। হযরত ফযলে রহমান গঞ্জমুরাদাবাদীর নিকট বায়আত হওয়ার পর তার ইলমের পিপাসা নতুনভাবে জাত হয় ফলে তিনি সে যুগের বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ হযরত মাওলানা আহমাদ আলী সাহারানপুরীর নিকট দীর্ঘ এগারো মাস অবস্থান করে সিহাহসিত্তার সনদ হাসেল করেন। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ছাত্র জীবনে অন্যান্য ছাত্রদের পড়াতেন। মানতেক, ফালসাফার প্রতি তার তেমন কোন আর্কষণ ছিল না। কুরআন হাদীছের প্রতি তার আগ্রহ ছিল বেশী।

আধ্যত্মসিক সাধনা £ ছোটকাল হতেই হযরত মাওলানা আল্লাহওয়ালাদের সোহবত লাভের আশায় পেরেশান থাকতেন। প্রথম দিকে তিনি যথাক্রমে হাফেষ মুহাম্মাদ সাহেব ও মাওলানা কারামত আলী (রহ.)-এর সোহবতে নিজেকে সোপর্দ করেন এবং কঠোর রিয়াষত মুজাহাদা সহকারে আধ্যাত্মিক জগতের সিড়িগুলি দ্রুত অতিক্রম করতে সক্ষম হন। মাওলানা ফযলে রহমান গঞ্জমুরাদাবাদীর খেদমতে £ মাওলানা কারামত আলী (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত মুঙ্গেরী আর একজন আল্লাহওয়ালার সন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। ফলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে শীঘ্রই একজন আদর্শ কামেল পীরের সোহবত নসীব করেন। যার সোহবতের বরকতে হযরত মুঙ্গেরী অল্প দিনের মধ্যে রূহানী জগতের উচ্চ মার্ণে বিচরণ করতে সক্ষম হন।- এ বুযুর্গ ছিলেন হযরত মাওলানা ফযলে রহমান গঞ্জমুরাদাবাদী। তিনি ভারত উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত বুযুর্গ ও আলেম ছিলেন। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী তার হাতে বায়আত হয়ে মাঝে মাঝে তার সোহবতে আসা-যাওয়া করতে থাকেন।

ইজাযত ও খেলাফত ৪ সাহারানপুর হতে ফিরে আসার সময় তিনি গঞ্জমুরাদাবাদে নিজের মোর্শেদের সোহবতে হাযির হয়ে তার থেকে সিহাহসিতা হাদীছের সনদ লাভ করেন। এ সময় হযরত মাওলানা ফযলে রহমান গঞ্জমুরাদাবাদী তাকে খেলাফত দীন করেন।

কর্মজীবন ঃ গঞ্জমুরাদাবাদ হতে ফিরে আসার পর তিনি কানপুরের এক মসজিদে দরস দেয়া শুরু করেন। পরে তিনি কানপুরের বিখ্যাত মাদরাসা ফয়যে আমে ২/৩ বছর শিক্ষাকতা করেন।

নদওয়াতুল উলামা ও দারুল উলুম প্রতিষ্ঠা ৪ হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী (রহ.) উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের উপমহাদেশীয় উলামা সমাজ, দ্বীনী মাদরাসা এবং বিভিন্ন ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্পের নৈরাশ্যজনক অবস্থা কাছ থেকে উপলদ্ধি করছিলেন। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের ইসলাম বিদ্বেবী আগ্রাসনের ঢেউ ভারতের মুসলমানদের ছ্বীনী ও ঈমানী চিন্তা-চেতনাকে ভূলুষ্ঠিত করে চলছিল। এ আগ্রাসনের মোকাবেলায় যে ধরনের ব্যক্তিত্ব তৈরীর প্রয়োজন ছিল তৎকালীন দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলি সে ধরনের যোগ্য ব্যক্তিত্ব গঠনের কাজ আঞ্জাম দিতে হিমসিম খাচ্ছিলো । এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করার জন্য তিনি আল্লাহ পাকের উপর ভরসা করে কানপুরের ফয়যে আম মাদরাসার দস্তারবন্দীর সময় উপস্থিত বিখ্যাত উলামায়ে কেরামের পরামর্শে উপমহাদেশীয় মুসলমানদের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ছীনী চিন্তা-চেতনা হেফাবতের উদ্দেশ্যে “নদওয়াতুল উলামা" নামে একটি প্রতিষ্ঠান কায়েম করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।মাওলানা মুহাম্মাদ আলী (রহ.) ১৮৯৮ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর নদওয়াতুল উলামার চিন্তা-চেতনাকে বাস্তবে রূপ-দেয়ার জন্য যোগ্য লোক - তৈরীর উদ্দেশ্যে নদওয়ার পক্ষ হতে “দারুল উন্ুম নদওয়াতুল উলামা” নামে ' একটি স্বীনী মাদরাসার ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম নাযেম নিযুক্ত হন।

দারুল উলুম হতে বিদায় ৪ দীর্ঘ কয়েক বছর সফলতার সাথে নদওয়াতুল .উলামার খেদমতের সাথে সাথে দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা পরিচালনার পর বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে তার পীর ও মোরশেদ হযরত মাওলানা ফযলে রহমান গঞ্রযুরাদাবাদীর ইন্তেকালের পর বিহার ও তার আশেপাশে দাওয়াত ও ইসলাহের ময়দানে এবং ইসলাম বিধ্বংসী কাদিয়ানী ও ঈসায়ী ফেনা নিল করার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯০৩ সালের ১৯শে জুলাই নদওয়া হতে তার কয়েকজন বিশিষ্ট মুরীদানের আকুল আবেদনে সাড়া দিয়ে বিহারের মুঙ্গেরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। অবশ্য তিনি তার এ নতুন ময়দানে পদচারণার পরও নদওয়ার সাথে আমৃত্যু সম্পর্ক অটুট রেখেছিলেন ।

ইন্তেকাল & হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মুনেরী প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল ব্যাপী সফলতার সাথে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে ১৯২৭ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর বাদ যোহর মুঙ্গেরে ইন্তেকাল করেন।

নদুয়াতুল উলামার কর্মতৎপরতা £ এক বছর পর. ১৬, ১৭ ও ১৮ই শাওয়াল ১৩১১ হিজরী, মোতাবেক ২২, ২৩ ও ২৪শে এপ্রিল ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে মাদরাসা ফয়যে আমের এ দস্তারবন্দীর সময়ই কানপুরে “নদওয়াতুল উলামা'র প্রথম সম্মেলনটি বড় আড়ম্থরপূর্ণ ভাবেই অনুষ্ঠিত হয়। বিশিষ্ট চিত্ত 1বিদ, বুদ্ধিজীবী, ইসলাম দরদী ব্যক্তিবর্গ সেদিন এক জায়গায় জমায়েত হয়েছিলেন এবং তারা আবহমান সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের একটি পথ খুঁজে পেতে চাচ্ছিলেন। এটি ছিল একটি এতিহাসিক ও বৈপ্রবিক পদক্ষেপ; এখানে সাধারণ জ্ঞানী-গুণী, বুদ্ধিজীবী, চিস্তাবিদ ও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের সাথে উলামায়ে ' দ্বীন, আধুনিক শিক্ষিতদের সাথে হানাফী মাযহাবের বিশ্ববরেশ্য আলেম, আহলে হাদীছদের সাথে দুনিয়াত্যাগী নির্জনবাসী পীর-বুুর্ণ, আমীর-উমরাহ প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ আর পণ্ডিত বুদ্ধিজীবীদের সাথে, কীধে কাঁধ মিলিয়ে সারিবদ্ধভাবে দুর্নিবার এক বিজয় কাফেলা হয়ে মজবুত প্রাচীরের মত উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সংগঠনটির নাম 'নদওয়াতুল উলামা' এ জন্য রাখা হয়েছিল যে, এ সংগঠন মূলতঃ আলেম সমাজেরই চিন্তা-চেতনায় এবং তাদের ডাকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর তারাই এর প্রাণ বলে বিবেচিত হয়েছিলেন । এ সংগঠন ষে কয়টি প্রতিজ্ঞা সামনে রেখে যাত্রা শুরু করেছিল তাছিল নিন্নরূপ- (১) মুসলমানদের পারস্পরিক এঁক্য, (২) ইসলামী দৃষ্টিতঙ্গীর অধীনে ইহ ও পারলৌকিক সফলতার জন্য বিভিন্ন রকম সাংগঠনিক ইসলাহী ও শিক্ষাগত পদক্ষেপ গ্রহণ, (৩) উচ্চতর আদর্শ ও মযবুত কর্মসূচী হণ, (৪) কুসংস্কার ও কুপ্রথার মুলোৎপা্টন, €৫) যুসলমানদের কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন মাসলাকের (পথ ও মতের) বিশুদ্ধ আক্ীদা-বিশ্বাসের (আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত) আলেমদের এক মিলিত প্রাটফরম তৈরী (৬) ইসলামী শরীয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে দ্বীনী শিক্ষার সিলেবাসে এমন পরিবর্তন-পরিবর্ধন আনা যা বর্তমান চাহিদা পূরণে কার্বকরীভাবে সক্ষম হয়। (৭) উলামায়ে কেরামের ছবীনী অবস্থার উন্নয়ন এবং তাদের টিন্তা-ভাবনা ও জ্ঞান-বিদ্যার পরিধির ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং ৮৮) এমন আলেম তৈরী করা যারা প্রাচীন ও আধুনিক উভয় দিক থেকে নির্ভরযোগ্য ও মর্যাদার উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠবে । তীরা মুসলমানদের ধর্মীয় ও অন্যান্য চিন্তা-চেতনা ও আবদা-বিশ্বাসের এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে নেতৃতৃ দেয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, যেদিকটায় বেশ কিছুকাল ধরে শূন্যতা বিরাজ করছিল।

এই সমস্ত ব্যক্তি কোন নির্দিষ্ট একটি এলাকার নাগরিক ছিলেন না। বরং রাখতেন। কিন্ত জাতির ঘোর দুরবস্থা আর অধঃপতনোন্মুখতা তাঁদেরকে মারাত্মকভাবে মর্মাহত ও ব্যথিত করে তুলেছিল। তীরা সবাই এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য আন্তরিকভাবে আশা করতেন, ব্যাকুল হয়ে খুজতেন একটি মজবুত অবলম্বন। এটা সেই সময়ের কথা, যখন একদিকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসন ইসলামী এঁতিহ্যকে ধ্বংস. করে দিচ্ছিল, অন্যদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রগুলো বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল। লাইব্রেরী আর গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো পোকামাক়ে দখল করে নিয়েছিল। তার একমাত্র কারণ, মুসলমানরা পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ আর দবন্্-কলহে লিগ হয়েছিল। এর অনিবার্ধ ফলস্বরূপ পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা, চিন্তা-চেতনা, মন-মস্তিক্ষকে যেভাবে ধোলাই করে ফেলেছিল, সে তুলনায় মুসলমানদের শিক্ষা-সভ্যতা, প্রতীয়মান হয়েছিল । ১৩১১ হিজরী, মোতাবেক ১৮৯৪ ঈসায়ীতে যে সংস্কার আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়েছিল, “নদওয়াতুল উলামা' সংগঠনের মাধ্যমে যে সংস্কার আন্দোলনের অগষাত্রা শুরু হয়েছিল, তা সফলতার সাথেই অথসর হচ্ছিল নির্দিষ্ট মঞ্জিলের দিকে। এই সংগঠনের বার্ষিক সম্মেলন অত্যন্ত সুশৃংখলভাবে এবং ব্যাপক প্রস্তরতির মাধ্যমে আড়ম্বরতার সাথে হিন্দুস্তানের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে অনুষ্ঠিত হতে থাকে । এর আলোচনা গোটা হিন্দুস্তানে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু এই পর্যন্তই শেষ নয়, এমন একটা পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায় যে, তারা ১৩১৬ হিজরীতে (১৮৯৮ খুঃ) লাখনৌতে নিজেদের চিন্তাধারা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুসারে একটি সময়োপযোগী দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা প্রতিষ্ঠা করেন। যেখান থেকে প্রতি বছর বহু সংখ্যক নামীদামী আলেম, গবেষক, চিন্তাবিদ, লেখক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট, ভাষাবিদ ও দ্বীনের দাঈ হয়ে বের হয়েছেন। যারা নদওয়ার নাম বিশ্বের আনাচে-কানাচে পৌঁছে দিয়েছেন এবং নিজেদের জন্য বিশ্ব দরবারে এক বিশেষ সম্মান ও মর্ধাদার আসন দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

নদওয়ার এই গ্রহণযোগ্যতার পেছনে বেশ কিছু কারণ নিহিত ছিল। প্রথমতঃ এটা ছিল সময়ের দাবী অনুযায়ী জাতিকে সমস্যা থেকে উত্তরণের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। নদওয়া জাতিকে দেখাচ্ছিল সফলতার রাজপথ । দ্বিতীয়তঃ এই নদওয়া ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় দিকের চাহিদা পূরণে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম ছিল । উপরস্তযুগশ্রেষ্ঠ বুধূর্ণ হযরত মাওলানা ফযলে রহমান গঞ্জমুরাদাবাদী (রহ.). শায়খুল আরব ওয়াল আযম হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মী (রহ.)-এর আস্তরিক দু'আ, উত্তাযুল উলামা মাওলানা লুৎফুল্লাহ আলীগড়ীসহ তৎকালীন আলেম সমাঞ্জের গৌরব মাওলানা আবৃদুল হাই লাখনৌভীর সুযোগ্য শিষ্যবৃন্দের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন, মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী (রহ.)-এর মত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের অক্লান্ত পরিশ্রম, শাহ সুলায়মান, ফুলওয়ারীর প্রভাব সৃষ্টিকারী বক্তৃতামাধুরী, মাওলানা শিবলী নোমানীর ব্যাপক অধ্যয়ন, জ্ঞানগভীরতা, মাওলানা মসীহজ্জামান খান সাহেবের বিচক্ষণতা ও দূরদশীতা, মাওলানা সাইয়েদ জহুরুল ইসলাম ফতেহপুরীর গভীর অন্তদৃষ্টি, মাওলানা আবু মুহাম্মাদ ইব্রাহীম আরবীর পক্লান্তিকতা আর দরদ, মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন ইলাহাবাদী, মাওলানা আবৃদুল হক হক্কানী সাহেব ও মাওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরীর জ্ঞান-পরজ্ঞা, মাওলানা হাবীবুর রহমান খান শিরওয়ানী সাহেবের (সহ-সভাপতি ইয়ারজঙ্গ বাহাদুর) হুদ্যতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, মু্সি আতহার আলী রঈসে কাকুরী ও মাওলানা খলীলুর রহমান সাহারানপুরীর শ্রম-সাধনা ও বুদ্ধিমত্তা, মাওলানা হাকীম সাইয়েদ আবৃদুল হাই সাহেবের ধৈর্য, সহনশীলতা আর পান্তিত্য, হুসামুল সুলক শামসুদ্দৌলা নওয়াব সাইয়েদ আলী হাসান খান সাহেবের মধ্যপন্থা নীতি ও বুদ্ধিগত কৌশল, ডাক্তার হাকীম সাইয়েদ আবৃদুল আলী সাহেব (রহ.)-এর ধর্মীয় উদার দৃষ্টিভঙ্গী, পুরাতন আর আধুনিক জ্ঞানের গভীরতা ও সংস্কার (যিনি ৩০ বছর নদওয়াতুল উলামায় মহাপরিচালকের দায়িতৃ পালন করেছেন), মাওলানা সাইয়েদ জহুর আহমাদ ও মৌলভী মুহাম্মাদ নাসিম সাহেবের আইনী কঠোরতা আর নিয়মতান্ত্রিকতা, সফলতাপূর্ণ মধ্যস্থতা আর মীমাংসার কিংবদন্তী, মাওলানা গোলাম মুহাম্মাদ সাহেব, মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী রেহ.)-এর নদওয়ার প্রতিনিধিত্ব, দ্বীনী ও ইলমী দিক-নির্দেশনা এবং বিশ্বে মান-মর্যাদাপূর্ণ আসন দখলে কৃতিত্ব, মাওলানা মাসউদ আলম নদভী সাহেবের জ্ঞান-গরিমা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা ইত্যাকার গুণাগুণ এ সংস্কার আন্দোলনের দুর্গ নদওয়াতুল উলামায বিদ্যমান ছিল। যার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া দিন দিন উদ্ভাসিত হচ্ছিল। আর অনুভূত হচ্ছিল যে, মুসলিম মিল্লাতের পুনর্জাগরণ এই সর্বমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই আসতে পারে।

নদওয়াতুল উলামার সাথে মাওলানা আলী মিয়ার সম্পর্ক[সম্পাদনা]

পহেলা আগষ্ট ১৯৩৪ সালে হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রেহ.) দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে ইন্তেকাল করেন। পূর্ণ পয়ষন্তি বছর তিনি ও নদওয়া পরস্পর জড়িয়ে খাকেন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি একজন শিক্ষক হিসাবে পাঠদানের খেদমত আজ্রাম দেন। তিনি সহকারী শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর শিক্ষাসচিবের পদে আসীন হন। অতঃপণ্র পরিচালক হিসেবে নদওয়াতুল উলামার সকল বিভাগের জিম্মাদারী বহন করেন এবং জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। মুফাসসির ও-সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হতেন। কিন্তু দুনিয়া এমন যুগও প্রত্যক্ষ করেছে যখন নদওয়া তাঁর নামেই পরিচিত হতে থাকে এবং মুসলিম বিশ্বের শিক্ষিত সমাজে সবাইকে ছাড়িয়ে তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে। তাঁর প্রচেষ্টায় যেই নূরানী পরিবেশ ও দ্বীনী প্রাঙ্গণ গড়ে উঠেছিল তার রোশনীতে আজো নদওয়ার প্রতিটি অঙ্গণ দেদীপ্যমান ও সেই অনুগ্রহবারিতে এখানকার প্রতিটি পত্র-পল্পব, সবুজ-শ্যামল ও সজীবতায় ভরপুর ।

লাখনৌতে হযরত মাওলানা হোসাইন আহমাদ মাঁদানী (রহ.)-এর সভাপতিত্বে ১৯৪৯ সালে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের বার্ষিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। হযরত মাদানী (রহ.)-এর সাথে বিশেষ সম্পর্কের কারণে ডাক্তার সাইয়েদ আবদুল আলী (রহ.) এ কনফারেন্সের আহ্বায়ক ছিলেন। এ সময় মাওলানা আলী মিয়া বিভিন্ন যুগের আরবী শিক্ষার সিলেবাস সম্পর্কে একটি চার্ট তৈরী করেন। এতে হিন্দুস্তানের পুরো ইসলামী শিক্ষার ইতিহাস এসে যায়। যেসকল উলামায়ে কেরাম হাদীছে নববীতে গভীরতা ও দক্ষতা রাখতেন এবং মুহাদ্দিছ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি তাদেরও একটি তালিকা তৈরী করেন। যুক্তিবিদ্যা, তর্কশান্ত্র, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রে অভিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের নাম, জন্ম ও মৃত্যু তারিখ, তাদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থাবলী, প্রবন্ধ ও কবিতার নামও তালিকাভুক্ত করেন। শিক্ষা সিলেবাস কোন যুগে কি ছিল এবং শিক্ষার মান কিভাবে পরিবর্তন হয়েছে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পেশ করেন।

এতে হিন্দস্তানের শিক্ষার ইতিহাস বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়। হিন্দুস্তানের কোথায় কোথায় মাদরাসা ছিল, কোথায় খানকাহ ছিল তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। এ চার্টাটি দারদল উলুমের আব্বাসীয়া হলে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারী উলামায়ে কেরাম ও শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ সেখানে এসে তা পর্যবেক্ষণ করেন। এটি ছিল মাওলানা আলী মিয়ার এক উল্লেখযোগ্য ইলমী অবদান ।

১৯৪৮ সালে যখন হযরত মাওলানা সহকারী শিক্ষাসচিব নিযুক্ত হন তখন হিন্দুস্তানে তীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল । এ সময়ই জপ ৮৬৪5 (খা পাটি ডি

এর উদ্দু অনুবাদ প্রকাশ পায়। এরপর মিসর থেকে মুল আরবীতে

'লাজনাতুত তালীফ ওয়াত তারজমা" এ গ্রন্থ প্রকাশ করে। হযরত সাইয়েদ

সুলায়মান নদভী রেহ.)-এর মৃত্যুর পর ১৯৫৪ সালে তিনি শিক্ষাসচিব

মনোনীত হন। লেখালেখির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে । দারন্ল উলৃমের

উত্তাদদের সংশোধন ও শ্রেণীকক্ষে গিয়ে তাদের ক্লাসের খোঁজ-খবর নেয়া এবং তাদের মতামত ও পরামর্শ অনুযায়ী সিলেবাসে পরিবর্তন ও সংযোজনের কাজও সমানতালে চলছিল । হেজাযের দ্বিতীয় সফর থেকে ফিরে তীর প্রিয়ভাজন ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্কিতব হযরত মাওলানা মুরীনুল্লাহ সাহেব কনস্ট্রাকশনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন এবং সফরে ও নদওয়ায় অবস্থানকালে তাঁর সার্বক্ষণিক সাহচর্য গ্রহণ করেন।

হযরত মাওলানা মুযীনুল্লাহ সাহেবকে আল্লাহ তাআলা চতুর্মুখী যোগ্যতা দান করেছিলেন। মাওলানা আলী মিয়া (রহ.) নদওয়াতুল উলামার পরিচালক হওয়ার পর নিয়মতান্ত্রিকভাবে না হলেও কার্যত তিনিই নদওয়ার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আগ্াম দেন। বিল্ডিং নির্মাণ, মসজিদে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কার, শিক্ষকদের কোয়ার্টার নিমণ, মযবুত বৈদ্যুতিক খুঁটি তৈরী এসব মাওলানা মুগলীনুল্লাহ সাহেবের অবদান। হযরত মাওলানা আলী মিয়া পরিচালক হওয়ার পর মাদরাসার ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক যোগানের দায়িত্‌ মাওলানা মুয়ীনুল্লাহ সাহেব গ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত সুন্দরভাবে তা আঙ্জাম দেন। হযরত মাওলানার জনপ্রিয়তাকে ওসীলা করে নদওয়ার জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টিতে ভার ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। ডাক্তার সাইয়েদ আবৃদুল আলী যখন রোগাক্রান্ত হন মূলতঃ তখন থেকেই হযরত মাওলানা আলী মিয়া পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন এবং তাঁরই পরামর্শে তিনি মুযীনুল্লাহ সাহেবকে তার দক্ষিণ হস্ত ও নির্ভরতার প্রতীক মনে করতেন। ক্রমান্বয়ে ছাত্রদের সংখ্যা বাড়ছিল। একে একে রাহমানিয়া হল, সুলায়মানিয়া হল, শিবলী হলের পার্শের তিনতলা ছাত্রাবাস নির্মিত হয়। এরপ্র অন্যসব বিল্ডিং নির্মিত হয়। দেখতে দেখতেই ডালপালা ছড়িয়ে নদওয়ার চেহারায় নতুন জীবনের ছায়া ফুটে ওঠে ।

হযরত মাওলানা আলী মিয়া পরিচালক থাকাকালে পুরো হিন্দুস্তান নদওয়া শুধু একটি মাদরাসা হিসাবেই পরিচিত ছিল না, বরং চেতনা ও চিন্তাধারার এক বিপ্রুবী ও স্বাতন্ত্মপ্ডিত প্রতিষ্ঠান ছিল। অবশ্য ছাত্রসংখ্যা খুব কম ছিল। কারণ সাম্য নেই এমন ছাত্রদের বৃত্তি ও ফ্রী থাকার ব্যবস্থা ছিল না এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্রল ঘুরে চাঁদা আদায় করার নির্ধারিত কোন লোকও ছিল না। হায়দারাবাদ ও অন্যান্য কিছু এলাকার বিস্তবানদের সাহায্যই মাদরাসার আয় ছিল। আর এটা জানা কথা যে, মাদরাসায় সামর্ঘ্যবান ছাত্রদের সংখ্যা সব সময়ই কম, সামর্থ্য নেই এমন ছাত্রদের সংখ্যাই বেশি। বিত্তবান, উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা সাধারণত স্কুল, কলেজে পড়াশুনা করে। মধ্যবিত্ত ও নিমবিত্ত পরিবারের ছেলেরাই মাদরাসায় পড়তে আসে । অর্থ ব্যয় করে তাদের পড়াশোনার সুবিধা থাকে না। এদের জন্য নদওয়ায় সুযোগ খুব কম ছিল । ছাত্র সংখ্যার স্বল্পতা বিভিন্ন ধরনের খারাপ ধারণার জন্ম দিত।.কোন কোন মহল প্রচার করছিল, জাতি নদওয়ার সিলেবাস গ্রহণ করেনি; বরং ইসলামী ইতিহাসের পতন যুগে প্রণীত পুরাতন দরসে নেযামীর সিলেবাসই জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য ও সমাদৃত । অথচ বাস্তবতা হল, দারুল উলুম নদওয়া সূচনা লগ্ন থেকেই বিশেষ ধারায় চলছিল এবং জনসাধারণ থেকে চাদী আদায়ের জন্য এর বিশেষ কোন ব্যবস্থা ছিল না। তাছাড়া এমন ব্যক্তিত্বেরও অভাব ছিল যারা দ্বীনদার ও পপ্ডিত ব্যক্তি হিসাবে সর্বসাধারণের কাছে সমাদৃত । আর যারা ছিলেন, তাদের ব্যাপারে পূর্ণ নির্ভরতার সাথে বলা যায় যে, তারা স্বীয় সাবজেক্টে শ্রেষ্ঠতম আলেম ছিলেন।

হযরত মাওলানা হায়দার হাসান খান (রহ.), মাওলানা শিবলী, মাওলানা মুহাম্মাদ নাযেম নদভী, মাওলানা আবদুস সালাম কাদওয়ায়ী রেহ.) প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ও পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তাদের সাথে সর্বসাধারণের সম্পর্ক ছিল না। হযরত মাওলানা আলী মিয়্ী (রহ.) প্রাচীনপন্থী ও প্রগতিবাদী উভয়শ্রেণীর আস্থা অর্জন করেন। তিনি সত্যিকারের নদী চিন্তা- ধারা ও চেতনার নমুনা ছিলেন। নদওয়ার প্রতিষ্ঠাতাগণ যে ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব গড়তে চেয়েছিলেন হযরত মাওলানা ছিলেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি সাইয়েদ সুলায়মান নদভীর মত নদভী চিন্তাধারা থেকে চুল পরিমাণও না হটে নতুন প্রজন্মের জনা আদর্শ পথ-নির্দেশক ছিলেন। মাওলানা মুরীনুল্লাহ সাহেব (রহ.) যখন হযরত মাওলানার জনপ্রিয়তা, ইলমী ও রূহানিয়তকে কাজে লাগিয়ে লোকদেরকে দ্বীনী শিক্ষার জন্য নদওয়ার প্রতি আকৃষ্ট করেন, তখন দলে দলে ছাত্র নদওয়ায় আসতে থাকে । এতে নদওয়ার উদারসূলভ চিন্তাধারা ব্যাপকতা লাভ করে এবং সর্বমহল এর প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে।

মোটকথা, হযরত মাওলানা আলী মিয়া পরিচালক থাকাকালে 'নদওয়া' স্বীয় চিন্তাধারা ও শিক্ষার মানে অধিষ্ঠিত থেকেও মুসলিম বিশ্বে পূর্ণ গ্রহণ- যোগ্যতা অর্জন করে, স্বদেশের হৃদয়বান ও ন্যায় নিষ্ঠাবান মুসলমানগণ এর স্বীকৃতি প্রদান করে। কিছু লোক যারা নদওয়ার মূল চিস্তাধারার সাথে পরিচিত নয়, যাদের জ্ঞানের পরিধি সীমিত, তারা নদওয়ার নামে কিছু অপপ্রচারের চেষ্টা করে, যেমন বলা হত-নদওয়াকে দেওবন্দের পদ্ধতিতে সাজানো হচ্ছে। অথচ এক দিনের জন্যও নদওয়া অন্য কোন মাদরাসার সিলেবাস অথবা শিক্ষাপদ্ধতি গ্রহণ করেনি এবং অনদভী চিন্তাধারার অনুসরণ করেনি। অতীত বছরগুলোতে নদওয়াকে একটি “এ্যারাবিক কলেজ" নামে প্রচারের প্রচেষ্টা চালানো শুরু“ হয় । যখন এ ধারণার অপনোদন করা হয় তখন লোকেরা কঠোরভাবে এর বিরোধিতা শুরু করে।

হযরত মাওলানাকে আল্লাহ তা"আলা সার্বজনীনতা ও মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয়তা দান করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই নদভী চিন্তাধারার সাথে মানুষকে পরিচিত করিয়েছেন। নিঃসন্দেহে তিনি বুযূর্গানে দ্বীন থেকে পাওয়া আধ্যাত্মিকতার ফয়েঘে ন্‌দওয়াকে সিক্ত করেছেন। তাঁর দু'আর প্রভাব অনস্বীকার্য । তিনি আধ্যাত্িকতা, খোদাভীতি ও পরকালভীতির যে প্রাণ জাথত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তাতে কিছুটা অতুপ্তি ও পিপাসা ছিল সত্য, কিন্ত্র চেতনার বিনির্মাণে, চিন্তাধারা ও ইলমী স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে, নদওয়ার বুনিয়াদি উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এবং সিলেবাসের পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও উন্নয়নে এক বিন্দুও অতৃপ্তি, অসম্পূর্ণতা ও অসামঞ্জস্যতা থাকেনি । ৰরং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কোন না কোন উপায়ে নদওয়ার সিলেবাসের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করেছে অথবা নাম পরিবর্তন করে এ কাঠামো অবলম্বনের চেষ্টা করেছে! মোটবথা, প্রশ্ন উ্থাপনকারী আগের হোক বা পরের হোক তাদের কথা সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিবর্জিত ছিল। আসল সত্য তাই যা হযরত মাওলানা তার পরিচালক থাকাকালে সাম্যের সবটুকু দিয়ে পরিচিত করিয়েছেন, প্রচার করেছেন, যার উর্ধ্বগতি ও অগ্রসরতা কামনা করেছেন। দ্বীনী খেদমতের যে ধারাবাহিকতা তিনি শুরু করেছিলেন, সদকায়ে জারিয়া হিসাবে তার সৃওয়াব ও পুরক্ষার ইনশাআল্লাহ তিনি পেতে থাকবেন। হযরত মাওলানা তাঁর এ কথাগুলি নিজের আত্মজীবনী “কারওয়ানে জিন্দেগী”-এর প্রথম খণ্ডে এভাবে উল্লেখ করেছেন। পাঠকের সুবিধার্থে হুবহু নিম্নে তা তুলে ধরা হল

“দ্বীন ও আকায়েদের ক্ষেত্রে খালেস ছ্ীনের উপরই নদওয়াতুল উলামার মত ও পথের ভিত্তি, সর্বপ্রকার দোষ-ক্রটি ও 'মলিনতা থেকে পবিত্র, ব্যাখ্যা ও বিকৃতি থেকে মুক্ত, মিশ্রণ ও ভ্তামী থেকে দূরে এবং সবদিক থেকে পরিপূর্ণ

' ও নিরাপদ ।

দ্বীনের অনুধাবন, তার ব্যাখ্যা ও প্রকাশের ক্ষেত্রে নদওয়ার নীতি হল, ইসলামের প্রাথমিক, নির্মল ও পরিচ্ছন্ন উৎসধারাকে অবলম্বন এবং মূলের 'দিকে ফেরার মানসিকতা ।

আমল ও আখলাকের ক্ষেত্রে এর নীতি হল, দ্বীনের মগজ ও মৌল জিনিসকে গ্রহণ করা, “তার উপর দৃঢ়তার সাথে কায়েম থাকা! আহকামে শরইয়্যার উপর আমল, হাকীকতে দ্বীন ও রূহে দ্বীনের সাথে নৈকট্য এবং তাকওয়া ও আত্মসংশোধনকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান।

ইতিহাস বিচারের ক্ষেত্রে তার ভিত্তি এই সিদ্ধান্তের উপর যে, ইসলামের উথান ও বিকাশের যুগ সবচেয়ে উত্তম ও মর্যাদাবান যুগ । নবুয়তের ছায়াতলে ও রেসালাতের আদর্শে যারা দীক্ষা লাভ করেছেন এবং কুরআন ও ঈমানের শিক্ষালয় থেকে তৈরী হয়ে বের হয়েছেন, তাঁরাই সবচেয়ে বেশী আদর্শবান ও অনুসরণযোগ্য। আমাদের সৌভাগ্য ও নাজাত, সফলতা ও কামিয়াধী এতেই সীমাবন্ধ। অতএব বেশী বেশী ভাঁদের জ্ঞান ও ইলম আমরা আহরণ ফরব এবং তাঁদের পদচিহ অনুসরণ করে চলার চেষ্টা, করব।

বিদ্যার্জন ও শিক্ষা দর্শনের ক্ষেত্রে নদওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি হল, জ্ঞান মূলত সবই এক ধরনের; পুরাতন ও নতুন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শব্দ দ্বারা জ্ঞানকে বিভাজন করা যায় না। যদি কোন বিভাজন সম্ভব হয়, তবে তা হবে শুদ্ধ ও অশুদ্ধ, উপকারী ও অপকারী হিসাবে, আহরণের মাধ্যম ও উদ্দেশ্যের বিচারে। জ্ঞানদান ও জ্ঞান আহরণে, গ্রহণ ও বর্জনে নদওয়ার নীতি সেই বিজ্ঞোচিত নববী শিক্ষার উপর ভিত্তিশীল যা মহানবী (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “জ্ঞান মুমিনের হারানো সম্ষ্দ, যেখানেই সে তা পায়, সেই তার সবচেয়ে বেশী হকদার” এবং প্রজ্ঞাময় সেই পুরাতন উক্তির উপর যে, ১5৮ €১১ 4৮৬ ১৯ যা কিছু পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন তা নিয়ে নাও এবং যা কিছু অপবিত্র ও অস্বচ্ছ তা পরিহার কর। , ইসলামের শক্রদের মোকাবেলায় এবং আজকের প্রগতিবাদী ধর্মহীন শক্তির প্রতিরোধে নদওয়ার দৃষ্টিভি আল্লাহর এ বাণীর উপর যে,

58 ০০ পেলো ও ৮515953 তাদের মোকাবেলায় যথাসম্ভব সবটুকু শক্তি তোমরা অর্জন কর।

দাওয়াত ইলাল্লাহ, ইসলামের সৌন্দর্য ও মাহাত্য্ের ব্যাখ্যা, বিবেক ও বুদ্ধিকে তার হক্কানিয়্যাতের ও সত্যতার উপর নিশ্চিত করার জন্য নদওয়ার পদক্ষেপ হল, সেই বিজ্ঞোচিত উপদেশের উপর যে,

4১১ 2 8 কক 0 03-45 ₹৯৪০ ১ ৬৮ লে এগ মানুষের সাথে কথা বল তাদের বিবেকের পরিধি অনুসারে । তোমরা কি চাও, আল্লাহ-ও তাঁর রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হোক।

আকারে ও মৌলিক নীতিমালার ক্ষেত্রে নদওয়া আহলুস সুপলা ওয়াল , জামাআতের পথের অনুসরণ এবং সকলের মতামত ও গবেষণালন্ধ সিদ্ধান্তের আওতাধীন থাকাকে জরুরী- মনে করে। ফুরূয়ী ও ফিকহী মাসায়েলের ক্ষেত্রে এর দৃষ্টিভঙ্গি হল, যতটুকু সম্ভব ইখতিলাফী মাসায়েল ও এসকল পথ পরিহার করা যদ্বারা পারস্পরিক দলাদলি এবং উম্মতের মাঝে বিভক্তি এসে যায়। সলফে সালেহীনের প্রতি সুধারণা পোষণ করতে হবে এবং তাদের কাজের সঠিক ও সুন্দর ব্যাখ্যা দিতে হবে । ইসলামের স্বার্থকে সামগ্রিক্‌ স্বার্থের উপর প্রাধান্য দিতে হবে।

সংক্ষেপ কথা হল, নদওয়া হাকীমুল ইসলাম শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (রহ.)-এর চিন্তাধারার সাথে বেশী ঘনিষ্ট ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই হিসাবে নদওয়াতুল উলামা সাধারণ একটি প্রতিষ্ঠানই নয়; বরং পরিপূর্ণ ও বহুমুখী এক বিপ্লবী চেতনায় উদ্দীপ্ত প্রতিষ্ঠান, চিন্তাধারার একটি নতুন সঙ্গমস্থল।

নদওয়াতুল উলামার দ্বীনী মাসলাক, জ্ঞানার্জন ও ইতিহাস পর্যালোচনার

ভঙ্গি, চিন্তাধারা এবং এ আন্দোলনের প্রকৃতি বুঝাতে এবং নদশয়াতুল উলামার প্রতিষ্ঠাতাগণের গভীর দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা দিতে যেয়ে হযরত ' মাওলানা আলী মিয়া বলেন, “মুসলমানরা হিন্দুস্তানে এসে যে ইসলামী-হিন্দুস্তানী কৃষ্টি ও সভ্যতার জন্ম দিয়েছে সে কৃষ্টি ও সভ্যতার মাঝে আড়ম্বরতাও আছে, বিনয়-ন্মৃতাও আছে, সাহসিকতাও আছে, নৈতিকতাও আছে, গভীরতাও আছে, কাঠিন্যও আছে, সিক্ততাও আছে, আবার সহিষ্ক্তাও আছে। তাঁর আঁচলে উলুমে শরীয়তও আছে, হেকমতও আছে, সাহিত্য ও কবিতাও আছে, দারিদ্র ও 'দদরবেশীও আছে, সুস্ম্াদর্শিতাও আছে, আবার সৌখিনতাও আছে। তার প্রিয় ময়দান কেন্লাও আবার কুতুবখানাও। এখানে মাদরাসাও আছে, খানকাহও আছে। আবার গবেষণা ও রচনার পরিসরও আছে। তাতে গা্তীর্য আছে, আবার কৌতুকও আছে। তার মতামত প্রকাশের ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখার মাধ্যম- আরবী, উর্দু, ফাসী, হ্রিদী প্রতিটি ভাষাই ।

নতুন সিলেবাসের প্রয়োজনীয়তা[সম্পাদনা]

আরবী ভাষা, সাহিত্য, ব্যাকরণ ও ফিকাহ-এর নতুন গ্রছ্সমূহ প্রণয়নে মাওলানার অবদান

নদওয়াতুল উলামা আন্দোলন সূচিত হয় সুনির্দিষ্ট শিক্ষানীতি, অভিজ্ঞতা ও অধ্যয়নের উপর ভিত্তি করেই। দ্বীনী শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন প্রাণ সঞ্চারের এবং পরিবর্তনশীল যুগ ও পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার বৈধ ও স্বভাবগত চাহিদার সাথে দ্বীনী শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করতে চেয়েছিল এ আন্দোলন। তাছাড়া কিতাবের পরিবর্তে সাবজেক্টের সাথে, মাসায়েলের পরিবর্তে মাকসাদের সাথে, মুতাআখখিরীনের শাব্দিক বিতর্ক, মস্তিষব প্রসৃত ভাবনা এবং ব্যাখ্যাগস্থ ও টাকায় মেধা ব্যয়ের পরিবর্তে মুতাকাদ্দেমীনের জ্ঞান নিঃসৃত ও রুচিশীল পদ্ধতি পুনর্গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। এ জামাআত সাথে সাথে আরবী ভাষাকে একটি জীবন্ত ও জাগ্রত ভাষারূপে পাঠদানের ব্যবস্থা করার ্রয়াসী ছিল। যাতে করে আরবদের মাঝে দাওয়াত ও পৃনর্গঠনের কাজ করা যায় এবং'ছাত্র, শিক্ষক ও শিক্ষা সমাপ্তকারীদের মাঝে আরবী পঠন-পাঠন, লিখন ও বক্তৃতার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে এবং শিক্ষকদের সামনে এর উদাহরণ পেশ করার জন্য ১৩১৬ হিজরী লাখনৌতে দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা নামে এর প্রধান মারকায প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন ছিল দু'টি জিনিসের

এক, এমন সিলেবাস প্রণয়ন যা এসব বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে এবং সেসব খন্থের প্রয়োজনীয়তা হাস করবে যা তার মান ও উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, বরং বাধ্য হয়ে তা গ্রহণ করা হয়েছিল। যে সিলেবাস এই বিদ্যাপীঠের দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং যা ছাত্রদের জ্ঞান ও রুচিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে তা অবলম্বন করা এক ধরনের স্ববিরোধিতা এবং যে মহান উদ্দেশ্যে এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা ব্যর্থ করার প্রচেষ্টার নামান্তর । ,

দ্বিতীয় মৌলিক প্রয়োজন ছিল- সেসকল উত্তাদ তৈরী ও প্রস্তুত করা যারা: এ আন্দোলন ও প্রতিষ্ঠানের চিন্তাধারা ও মানসিকতার সাথে শুধু পুরোপুরি একমতই নয়; বরং তাঁরা প্রত্যেকে এর একজন আহবায়ক ও বাস্তব নগুনা হবেন। যারা নিজেদের সমস্ত যোগ্যতা, সহযোগিতা ও আত্তরিক প্রচেষ্টা এ শিক্ষা পদ্ধতির সাফল্য অর্জনে ব্যয় করবেন এবং অন্য সকল শিক্ষা ব্যবস্থার মোকাবেলায় এর স্বাতন্ত্য তুলে ধরবেন। শুরুতেই এ শিক্ষা ব্যবস্থা ও সিলেবাসের সাথে পরিচিত ও অভিজ্ঞ শিক্ষক পাওয়া না গেলেও এজন্য প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অভিজ্ঞলোক খুঁজে বের করা এবং সৃক্্মভাবে তাদেরকে যাঁচাই-বাছাই করা। কিন্তু এ এক তিক্ত এতিহাসিক বাস্তবতা যে, নদওয়াতুল উলামা তার প্রারভিক যুগে প্রতিকূল ও রুণ্নু অবস্থা অতিবাহিত করে। অল্পকালের মধ্যে আভ্যন্তরীণ মতানৈক্য দেখা যায় এবং তার শক্তি ও সময়ের বড় অংশই অর্থনৈতিক সুবিধা সৃষ্টি, কনস্ট্রাকশন, পারস্পরিক মতভেদ দূরীকরণে, দেশের মাঝে পরিচিত হতে ও দ্বীনী হালকাতে বিশ্বাসভাজন হতে ব্যয় হয়েছিল। এর ফলে চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে নতুন সিলেবাস প্রণয়ন এবং উপযুক্ত শিক্ষকমণ্ডলী তৈরীর সুযোগ ঘটেনি। তাই দরসে নেযামীর পুরাতন সিলেবাসের এক বড় অংশ এর শিক্ষা ব্যবস্থায় গৃহিত হয়। উত্তাদগণের বৃহত্তর অংশও পুরাতন পদ্ধতির মাদরাসা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং পুরাতন সিলেবাস পাঠদানে অভ্যস্ত ছিল। এ কারণেই প্রাথমিক সময়ে দারুল উলৃম নিজ দেশে ও বহির্বিশ্বে নিজের সঠিক যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেনি এবং বড় কোন অবদান রাখতে ব্যর্থ হয় ।-এ প্রতিষ্ঠানের কিছু সংখ্যক মহান শিক্ষার্থী যে ব্যতিক্রমী উদাহরণ ছিলেন তারা ব্যক্তিগত অধ্যয়ন ও পরিশ্রম এবং কোন মহান ব্যক্তি বা উস্তাদের সাহচর্যের বদৌলতে স্বাতন্ত্য অর্জন করেছিলেন এবং পুরাতন সিলেবাস পড়েও (যাতে কিছু নতুন কিতাবও ছিল এবং নামকাওয়াস্তে আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল) উদার চিন্তা-চেতনা, রচনা ও সংকলনের উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন। এ+অবস্থা দারুল উলুমের ষষ্ঠ পরিচালক মৌলভী হাকিম ডাক্তার সাইয়েদ আব্দুল আলী সাহেব (বি.এস.সি. এম.বি.বি.এস) (হযরত মাওলানার বড় জাই) পরিচালক পদে আসীন হওয়া পর্যন্ত ছিল। ডাক্তার স্রাহেব দীর্ঘ তিরিশ . বছর নদওয়াতুল উলামার পরিচালক ছিলেন । এ দীর্ঘ সময়ে তিনি নদওয়াতুল উলামীর ব্যবস্থাপনা পরিষদের অসাধারণ সহযৌগিতা লাভ করেছিলেন এবং তাদের আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন । এ সময়ে ছাত্রদের দু'টি স্ট্রাইক ছাড়া নদওয়াতুল উলামা সকল ধরনের হাঙ্গামা ও বিশৃংখলা মুক্ত থাকে। ডাক্তার সাহেব পুরাতন ও আধুনিক, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের জ্ঞানের সমন্থিত রূপ ছিলেন। তিনি একাধারে নদওয়াতুল উলামার শিক্ষাসমাপক, দারুল উলুম দেওবন্দের বিশিষ্ট আলেম, সায়েন্সের মেধাবী ছাত্র ও ডিথীপ্রাপ্ত ছিলেন। দু'টি রাজকীয় পদক লাভ করেছিলেন। তিনি প্রাচীন ও আধুনিক চিকিৎসা বিদ্যার একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। সাথে সাথে ছিলেন শান্ত স্বভাবী। সায়েন্সের 'সুশ্খল ছাত্রজীবন এবং যুগের অবস্থা ও প্রেক্ষিত অনুসারে আধুনিক ও গবেষণাধর্মী অধ্যয়ন তাকে বাস্তববাদী বানিয়েছিল। বিশেষ করে তাঁর প্রতি শিক্ষাসচিব মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভীর পূর্ণ সহযোগিতা ও আস্থা ছিল। এছাড়া মাওলানা মাসউদ আলম সাহেব যিনি দারুল উলৃমের কাজে বিশেষ আন্তরিকতা রাখতেন। অর্থসচিব মুনশী এহতেশাম আলী সাহেব যিনি নদওয়ার কার্ষনির্বাহী পরিষদের প্রবীণ সদস্য এবং প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। নবাব সদর ইয়ারজং বাহাদুর, মাওলানা হাবীবুর রহমান খান শেরওয়ানী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ তাঁর গুণমুধী, সহায়ক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এসব কারণে সে সময় ও পরিবেশ সিলেবাস সংশোধন, উন্নয়ন ও ভাতে পরিবর্তন- পরিবর্ধন আনয়নে এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের সমাপ্তির জন্য সবদিক থেকে উপযুক্ত ও অনুকূল ছিল।

ডাক্তার সাহেব সর্বপ্রথম আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ শিক্ষার পরিবর্তন ও সংস্কার শুরু করেন। যদিও আরবী ভাষা ও সাহিত্য উন্নয়নে নদওয়ার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী (রহ.) ্দীয় লেখনী ও বক্তৃতায় এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার উপর খুব জোর দিয়েছিলেন এবং তার সুষ্ঠু ও মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য তিনি কোন কোন আরবী সাহিত্যিকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন । কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে আরবী ভাষা শিক্ষার জন্য নদওয়ার শিক্ষাসমাপক আলেমদের কলমে একটি মাত্র গ্রস্থ “দুরুসুল আদব” ১ম ও ২য় (মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী রচিত) প্রকাশ পেয়েছিল। এ কিতাবটি শু নদওয়ার সিলেবাসেই অন্তর্তুক্ত হয়নি; বরং অন্যান্য মাদরাপায়ও পাঠ্য তালিকাভুক্ত হরেছে। ভারতে এ ধরনের প্রচেষ্টা এটাই ছিল প্রথম। কিন্তু এর পরের গ্রহ্গুলো প্রণীত হয়নি, যেগুলো আরবী গদ্য ও পদ্যের সিলেবাসে পূর্ণতা আনবে, আরবী সাহিত্যের বিভিন্ন, শাখা ও ভঙ্গিমার মাধ্যমে ছাত্রদের পরিচিত করবে এবং বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে নিজ ভাবনা ও বক্তব্য প্রকাশের যোগ্যতা সৃষ্টি করবে। দীর্ঘকাল দুরুসুল আদব ও মাকামাতে হারারীর মাঝে (যা নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে সাহিত্যের ছাত্রদের জন্য সব সময়ের জন্মই উপযোগী ও গুরুতৃপূর্ণ) আর কোন পাঠ/রন্থ ছিল না। বাধ্য হয়ে প্রাচীন গদ্যের কিছু গ্রন্থের সাহাব্য নেয়া হয়েছে। দীর্ঘকাল “এখওয়ানুস সাফা" (যা মূলতঃ সাহিত্যের গ্রন্থ নয়) পাঠ্য তালিকাভুক্ত ছিল। কিছুদিন মুহাম্মাদ তালাআত হারবের “তারিখু দুওয়ালিল আরব ওয়াল ইসলাম” এবং “সিরাতে মুগলতায়ী” পড়ানো হয়। আল্লামা যামাখশারী রেহ.)-এর “আতওয়াকুষ যাহাব”ও পাঠ্যতুক্ত ছিল। পদ্যের জন্য “দিওয়ানে আবুল আতাহিয়াহ” পাঠ্যভুক্ত ছিল এবং এ নির্বাচন খারাপও ছিল না। এর পরের. স্থান ছিল গদ্যে “হারীরী” এবং পদ্যে “হামাসা” .ও "সুআল্লাকাত” ।

আরবী ভাষা ও সাহিত্যের সিলেবাসে সংস্কারের সূচনা[সম্পাদনা]

মাওলানা সাইয়েদ আব্দুল আলী সাহেব (হযরত মাওলানার বড় ভাই) সর্বপ্রথম মিসরের শিক্ষামন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত আরবী পাঠ্যপুস্তক সিলেবাসভুক্ত করার ইচ্ছা করেন। সেসময় সিলেবাসে সামান্যতম পরিবর্তনও ব্যবস্থাপনা পরিষদের মঞ্জুরী ছাড়া সম্ভব ছিল না। সাইয়েদ সাহেব এবং উস্তাদ খলীল আরব সাহেব এর উদ্যোক্তা ছিলেন এবং তারা মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদীর সমর্থন পাবেন বলে আশা করছিলেন।

সাইয়েদ সাহেব এ ব্যাপারে খুব সুন্দর একটি ঘটনা বলতেন। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী “কাকুরী কুঠিতে” (মুনশী এহতেশাম আলী সাহেবের নিবাস) ব্যবস্থাপনা পরিষদের বৈঠক ছিল। মাওলানা শেরওয়ানী (নবাব সদর ইয়ার জং) সভাপতিত্ব করছিলেন। খলীল আরব সাহেব ভুলে গিয়েছিলেন বা কোন জরুরী কাজে আটকা পড়েছিলেন, তিনি বৈঠকে আসেননি। সাইয়েদ সাহেব প্রস্তাব পেশ করলেন যে, “আল-কেরাআতুর রাশীদা” সিলেরাসভূক্ত করা হোক। শেরওয়ানী সাহেব বলেন, এ প্রস্তাব সমর্থন করেই সাইয়েদ সাহেব চুপ থাকলেন। মুনশী এহতেশাম আলী সাহেব বললেন, আমি সমর্থন করি। বিপক্ষে কেউ হাত তুললেন না। প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল। সাইয়েদ " সাহেব বললেন, আমি মুনশী সাহেবকে (তিনি আরবী জানতেন না, আলেমও ছিলেন না) জিজ্ঞাসা করলাম আপনি এ প্রস্তাব কিভাবে সমর্থন করলেন? তিনি বললেন, “এ প্রস্তাব তোমার' পক্ষ থেকে এসেছে আর তোমার উপর আস্থা আছে বলেই আমি তোমাকে সমর্থন করেছি।”

এ ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, সিলেবাস পরিবর্তন কত মুশকিল ও কঠিন ছিল। “আল কেরাআতুর রশীদা” এর পুরো সিরিজ পাঠ্য হুরুার কিছু পরেই মিসরের প্রখ্যাত শিশু সাহিত্য রচয়িতা কামেল কিলানীর “হেদায়াতুল আতফাল” সিরিজ পাঠ্যভুক্ত হয় ।

হেদায়াতুল আতফাল” শিশুদের পছন্দ অনুযায়ী ও ভাষা শিক্ষার আধুনিক নিয়মে লিখিত, সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষা, ধাপে ধাপে 'অ্সরতা, মজার মজার ঘটনা ও ছবি দ্বারা সাজানো; তবে ছ্ীনী রহানিয়াত ও চারিত্রিক শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ শূন্য ছিল। সারা বইতে কোথাও আল্লাহ্‌ ও তার রাসূলের উল্লেখ নেই। বিভিন্ন প্রাণীর ঘটনা ও ছবিতে ভরা বইটিকে সহজেই খৃষ্টান লেখকের নামে চালানো যেত। কিন্ত এতসব দোষক্রটি সত্বেও এ ছিল ভাষা শিক্ষার জন্য সফল ও বাচ্চাদের জন্য আকর্ষণীয় ও সুন্দর একটি বই।

মুখতারাত' সংকলন[সম্পাদনা]

আরবী ভাষা-সাহিত্যের সিলেবাস আধুনিকায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল প্রথমে “হেদায়াতুল আতকাল' ও “আল কেরাআতুর রাশিদার' পরিবর্তে এমন বই তৈরী করা যা ভাষার মৌলিক নিয়মাবলী, শিশুদের মানসিকতা ও আধুনিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে ইসলামের নৈতিক ও চারিত্রিক- শিক্ষা, মহান ইসলামী ব্যক্তিত্বদের পরিচিতি এবং ইসলামের কৃষ্টি সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতিবিশ্ব বলে প্রমাণিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা সব সময় ভাবনা ও চাহিদার অনুকূল হয় না। হযরত মাওলানা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “আমার সর্বপ্রথম ইচ্ছা হল আমি আরবীতে এমন সব গদ্য ও পদ্যের সমন্বয়ে একটি সংকলন তৈরী করি, যা সাহিত্যের প্রথম যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সব যুগেই উচ্চাঙ্গের সাহিত্য হিসেবে সমভাবে স্বীকৃত হবে। যা কাব্যিক ছন্দ, লৌকিকতা ও কৃত্রিমতা মুক্ত, যা হৃদয়ের আবেগ- উচ্ছাস, সুস্থচিত্তা এবং সদুদ্দেশ্যের প্রতিচ্ছবি এবং যা আরবী ভাষাকে শুধু একটি রূপ ও ঢঙ্গে প্রকাশ করবে না। এমনই এক গ্রন্থ মাকামাতে হারীরী যা গোটা ভারতের পাঠ্য তালিকা ও শিক্ষাঙ্গনে ছয়শত বছর আধিপত্য করেছে। এই মৌলিক চিন্তা বাস্তবায়নে প্রথমে মুখতারাত সংকলনের প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং এর উপর ভিত্তি করেই পরে মানসুরাত (পদ্য) সংকলন ও অন্যান্য * গ্রন্থ রচনা করা হয়। অবশেষে ১৯৮১ সালের ১৭-১৯ পিল দারুল উপৃম নদওয়াতুল উলামাতে_

৬৯০২1 ১9 এ] 55০

শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। যাতে প্রচুর সংখ্যক আরবী সাহিত্যিক, গুণীজন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিভিন্ন আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগের প্রধানগণ অংশগ্রহণ করেন।

হযরত মাওলানা লেখেন যে, আমি হাদীছ পড়ার সময়ই লক্ষ্য করেছিলাম, সহীহ হাদীছ গ্রন্থে এমন অনেক দীর্ঘ রেওয়ায়েত আছে যাতে সাহাবী -কিৎবা সাহাবিয়াগণ হুযুরের (সা.)-এর বা নিজের কোন সফরের ঘটনা, সফরের “অবস্থা, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা বিস্তারিতভাবে, অকৃত্রিম ও নিঃসংকোচে বর্ণনা করেছেন এবং তাতে আবেগ-অনুভূতির রূপ ও চিত্র নিজন্ব সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে উঠেছে। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদীছে হিজরত, হাদীছে ইফক, হযরত হালীমা সাদিয়া রো.) বর্ণিত দুগ্ধী পানের ঘটনা, হযরত কাব ইবনে. মালিক রো.) বর্ণিত তাবু যুদ্ধ ও তাদের পরীক্ষা ইত্যাদি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এসব হাদীছে আরবী ভাষা ও আরব সাহিত্যিকদের বর্ণনা শক্তি সর্বোচ্চ মানের। আরবী ভাষা, আরবী ভাষার প্রকাশ ভঙ্গী ও আরবী প্রবাদ-প্রবচন-বাগধারার উৎকৃষ্ট নমুনা কুরআনে কারীমে ছাড়া আরবী ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে কোথাও পাওয়া যাবে না। এমনিভাবে এঁসকল হাদীছও উল্লেখযোগ্য, যেখানে প্রাঞ্জলভাষী ও বাগী কোন সাহাবী হুযুর (সা.)-এর শারীরিক সৌন্দর্যের বা অন্য কোন প্রখ্যাত সাহাবীর দৈহিক রূপের বিবরণ দিয়েছেন।

যখন আয-যিয়া-এর প্রকাশনা শুরু হয় তখন হযরত মাওলানা প্রথম সংখ্যায় আল-আদাবুন নববী (নবী সাহিত্য) শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৫৭ সালে দামেস্কের বিশ্ববিখ্যাত ও প্রাচীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান “আল-মাজমাউল ইলমী' হযরত মাওলানাকে ভারতবর্ষ থেকে একমাত্র সদস্য হিসাবে নির্বাচন করে এবং তাদের পত্রিকায় প্রকাশের জন্য আরবী ভাষার যে কোন দিক নিয়ে একটি প্রবন্ধ রচনার অনুরোধ করে। হযরত মাওলানা “আরবী ভাষার লাইব্রেরী নতুন করে মন্তুন করা জরুরী” শিরোনামে আরবী - সাহিত্ড ও তার ইতিহাসকে পুনর্বিন্যাস করা ও তার সেসকল মনিমুক্তা খুঁজে . বের করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রবন্ধ রচনা করেন এবং এর জন্য সাহিত্যে ব্যাপক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। এটা হযরত মাওলানার এক সময়ের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এবং প্রত্যেক ভাষার ক্ষেত্রেই তিনি এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। তারিখে দাওয়াত ও আবীমাত (জনুবাদ- ইসলামী রেনেসাঁর অগ্ষপথিক)-এর ৩য় খণ্ডে মাওলানা মাখদুম বিহারীর 'মাকতুবাতে ছেছদী'-এর সাহিত্য মাধুরী সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি একথা উল্লেখ করেছেন, সদর ইয়ারজং-এর ভূমিকাতেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। 7 ূ

বড় ভাইয়ের অনুমতিক্রমে হযরত মাওলানা সংকলনের কাজ শুরু করেন। ১৩৫৯ হিজরী (১৯৪০ সালে) এমন এক সংকলন প্রস্তুত হয় যা দারুল উলুমের মাধ্যমিক ষষ্ঠ শ্রেণীর মানসম্পন্ন, যার পরে কঠিন ইবারত আয়ত্ত করার যোগ্যতা সৃষ্টির জন্য এবং অন্যান্য দ্বীনী মাদরাসাগ্ডলোর সাথে মিল রক্ষার জন্য শুধু মাকামাতে হারীরী পড়ানোর প্রয়োজন অবশিষ্ট থাকে । তিনি সংকলনে এসকল দীর্ঘ হাদীছ ও সীরাতের বর্ণনা ছাড়াও ভাষার মাধূর্যতা ও প্রাঞ্জল বর্ণনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ রূপে বিবেচিত অনেক গদ্য- পদ্যকে এবং এমন ব্যক্তিবর্গের আলোচনা স্থান দিয়েছেন, যাদেরকে সাহিত্যাঙ্গণে সাহিত্যিক বা কবি হিসেবে কল্পনাও করা হয় না। এটি তাদের প্রতি এক ধরনের 'অপবাদ' যা সুধারণার ফলাফল ৷ যেমন- শায়খ মহীউদ্দীন ইবনে আরাবী (শায়খে আকবর), হযরত হাসান বসরী, ইবনুস সাম্মাক মাসউদী, ইমাম গাজালী, ইবনে জাওযী, ইবনে হিব্বান আল বাসতী, হাফেয ইবনে তাইমিয়া, আল্লামা ইবনে কাইয়িম, ইবনে খালদুন, শাহ ওয়ালী উল্লাহ প্রমুখ ।

সংকলন তৈরীর পর এক-দু'বছর তিনি ক্লাসে ছাত্রদের তা লিখিয়ে দিতেন। কিন্ত এতে প্রচুর সময় ব্যয় হত। তাই তা ছাপানোর প্রয়োজন অনুভব করেন। শিক্ষাসচিব মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী (রহ.) সম্মতি প্রদান করেন। তৎকালে আরবী টাইপ হিন্দুস্তানে শুধুমাত্র দু'জায়গায় ছিল-দায়েরাতুল মাআরেফ'. হায়দারারাদ ও 'মাতবায়ে কায়্যিমা' বোম্বাই । অবশেষে লাখনৌর নিযামী প্রেসে তা ছাপানোর ব্যবস্থা হয় এবং তার স্বত্বাধিকারী মির্যা মুহাম্মাদ জাওয়াদ এমন নিপুণ কারিগর দ্বারা কেতাবাত করালেন যাকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে টাইপের ছাপা মনে হত। ছাপানোর পূর্বে মাওলানা আবৃদুল হাফিয বলিয়াবী (মেসবাহুল লোগাত প্রণেতা এবং দারুল উলৃমের আরবী সাহিত্যের উত্তাদ)-কে হযরত মাওলানা কঠিন শব্দগুলোর বিশ্লেষণ ও প্রয়োজনীয় টীকা সংযোজনের অনুরোধ করেন। তাঁরা অত্যন্ত উৎসাহের সাথে এ কাজে এগিয়ে আসেন এবং মেধা ও পরিশ্রম ব্যয় করে এ খেদমত আশ্রম দেন। রমযানুল মোবারক ১৩৬১ হিজরী, মোতাবেক ১৯৪২ সালে এ সংকলন প্রথম বের হয়। কিছুদিন পরেই হযরত মাওলানা বন্ধুবর মাওলানা আব্দুস সালাম সাহেবের পরামর্শে ছাত্রদের সুবিধার্থে এ খরন্থ দু'খণ্ডে বিভক্ত করেন।

১৯৫৩ সালে দামেশ্ক ইউনিভার্সিটির দাওয়াতে হযরত মাওলানা (রহ.) যখন দামেশুক গমন করেন তখন সুযোগের সদ্যবহার করে “আল- মাতবাআতুল জাদীদা' তে নদওয়াতুল উলামার পক্ষে এর প্রথম খণ্ড অত্যন্ত সুন্দর টাইপে প্রকাশ করেন এবং তার স্টক হিন্দুস্তানে পাঠিয়ে দেন। চার- পাঁচ বছর পরে ১৯৬২ সালে ২য় খণ্ড “দায়েরাতুল মাআরেফ' হায়দারাবাদ থেকে ছাপানোর সুযোগ হয়। ১৩৮৫ হিজরী (১৯৬৫ সালে) বৈরতের মাকতাবাতু দারিল ফিকরিল হাদীছ, লেবানন এ বইখানি দৃষ্টি নন্দন ছাপা ও উন্নত কাগজে এক ভলিউমে প্রকাশ করে। এতে প্রথমবারের মত বইখানি আরব বিশ্বে প্রচারের ও সাগ্রহে পাঠের উপযোগী হয় এবং এ বছরই তা দামেশ্‌ক ইউনির্ভাসিটির শারইয়্যাহ অনুষদের আরবী সাহিত্যের সিলেবাসভুক্ত হয় । একজন হিন্দুস্থানী লেখকের জন্য এটা বড় সম্মান ছিল যে, নির্ভেজাল আরবী ভাষা ও সাহিত্যের উপর লিখিত তার কোন বই আরব ইউনির্ভা্সিটির পাঠ্যতালিকাভুক্ত হল।

এঁ সময় বিশিষ্ট আরবী সাহিত্যিক ও প্রবন্ধকার (যাকে হযরত মাওলানা তার দক্ষ রচনাশৈলী ও শক্তিমান লেখনীর কারণে মিসরের অনেক প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও কলমিষ্টরের উপর প্রাধান্য দিতেন, সাহিত্যাঙ্গজণে যার খ্যাতি ক্রমশঃ বিস্তৃতি লাভ করছিল) দামেস্কের হাইকোর্টের বিচারক এবং বাগদাদ ইউনিভার্সিটির আরবী সাহিত্য বিভাগের সাবেক প্রফেসর উত্তাদ আলী তানতাবীর দৃষ্টিও এ গ্রন্থের উপর পড়ে। তিনি “মুখতারাত' এর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং অন্যদের প্রাচীন সংকলন পদ্ধতির সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, আরবী সাহিত্যের ধতিহাসিক গ্রন্থ রচয়িতাগণ কিভাবে এসব সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিকের গোলাম হয়ে আছে এবং আমাদের ছাত্র ও ' তরুণদেরকেও সেই চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ করে রেখেছে, যারা সাহিত্য রচনাকে জীবনের আসল সত্য ও আত্মিক সৌন্দর্যের ভাষ্যরূপে গ্রহণ করার পরিবর্তে কথার ফুলঝুরি, শাব্দিক অলংকরণ, শৈল্পিক নৈপুণ্য ও ভেক্ি প্রদর্শনের আখড়ায় পরিণত করেছে?

মুখতারাত খুব দ্রন্ত গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। তবে তা অনেকাংশেই আধুনিক অঙ্গনে ও ইউনিভার্সিটির বি.এ. এমএ. ক্লাসের অন্তরতক্ত হয়েছে। শায়খ উবায়েদ মুহাম্মাদ আরব সাহেবের (খলীল আরব সাহেবের সহোদর, তিনি আরবী সাহিত্যের সিলেবাস বিন্যাসের অধিকাংশ কমিটির মেম্বার ছিলেন ' এবং যিনি কোন আরব বার প্রধানের পক্ষ থেকে প্রথম পদক লা্ড করেন) ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় আলীগড় ও ইলাহাবাদ থেকে নিয়ে হায়দারাবাদ ও মান্রাজের ইউনির্ভাসিটির কোর্সে এ বইখানি অন্তর্ভুক্ত হয়। অবশ্য আমাদের পুরোনো মাদরাসাগুলোতে তা বহু কষ্টে স্থান পায়, কিন্তু স্থান হতে না হতেই আবার ছাঁটাই করা হয়। তাদের পদক্ষেপ- ০৬ ০১ 5 2533 5 ৭৬ ৬ 1750 অর্থাৎ “কি বলা হচ্ছে তা দেখ, কে বলছে তা দেখ না” এর পরিবর্তে ৭৩ ৩ রো ০১ ০৬ ০১ এ 501

অর্থাৎ “কে বলেছে তা দেখ, কি বলছে তা দেখ না” এর উপর । হযরত মাওলানা লেখেন, তবে এটা জেনে খুবই উৎসাহবোধ করছি ও আনন্দিত হয়েছি যে, আমাদের মুহতারাম উত্তাদ ও আরবী সাহিত্যের সবচেয়ে বড় শিক্ষক মাওলানা এজাঘ আলী সাহেব তা গছন্দ করেছেন। এটা তখনকার কথা যার কিছুদিন. আগে তিনি নিজেই “নফহাতুল আরব" নামে একটি সংকলন তৈরী করেছিলেন এবং 'নফহাতুল ইয়ামান' এর স্থানে সমস্ত মাদরাসাতে (বিশেষ করে যেসব মাদরাসা দেওবন্দের অনুসারী ছিল) পাঠ্যভুক্ত হয়। কিছুকাল পরে এ মুখতারাতের উপর সৌদী আরবের শিক্ষামন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তার নজর পড়ে । তিনি তা কলেজের সিলেবাসভুক্ত করার সুপারিশ করেন এবং বিশ হাজার কপির অর্ভার দেন। ১৩৯৮ হিজরী, ১৯৭৮ সালে “দারুশ শুরুক জিন্দা” তা প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা করে।

আল কেরাআতুর রাশেদা[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানার বেশ কয়েক বছর নিচের ক্লাসগ্জলোতে মিসরের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্ততকৃত “আল কেরাআতুর রশীদা” (৪১০১০ ৪৮2) সিরিজ পড়ানোর সুযোগ ঘটে। বইটি ভাষাগত শুদ্ধতা, পাঠের দিয়মনীতি, শিশুদের পছন্দ, বয়স ও সাধারণ জ্ঞান সবদিক থেকেই সফল এবং দ্বীনী রূহ ও চারিত্রিক শিক্ষা থেকেও খালি নয়; কিন্তু বইটি মূলতঃ মিসরের শিশুদের (যাদের একটি বড় অংশ খৃষ্টান ও কিবতী) জন্য সংকলন করা হয়েছিল ।

তাতে ঘটনাক্রমে এবং অনেকটা প্রয়োজনে আঞ্চলিক ও দেশীয় ছাপ ছিল। বেশীরভাগ পাঠেই মিসরের আশপাশের অঞ্চল, প্রাচীন নিদর্শন ও মিসরের ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন- জাধিরাতুর রওযা, আল-আহরাম, আল-কানাতিরিল খাইরিয়্যাহ, হিওয়ার বাইনা মিসর ওয়াল এসকান্দারিয়্যাহ, আঞ্চলিক উৎসব ও মাহফিল, যেমন- ঈদু ওফাইন নীল । ব্যক্তিত্বদের মধ্যে মুহাম্মাদ আলী পাশা সম্পর্কে স্বতন্ত্র অধ্যায় আছে। সবচেয়ে বড়কথা, তাতে মিসরের জাতীয় সংগীতও আছে, যাতে মিসরের বড়ত্ব-ও মহিমা কীর্তন করা হয়েছে এবং তার বিশেষত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। আরবী মাদরাসার হিন্দুস্থানী মুসলমান শিশুদের জন্য এ সংগীতে কি মাধুর্য ও আকর্ষণ থাকতে পারে? এমনিভাবে “ঈদু ওফাইন নীল” যাতে মিসরের খৃষ্টানরা দারুণ আকর্ষণ অনুভব করে, হিন্দুস্তানের অবস্থার সাথে এর কি সামঞ্তস্য রয়েছে? হযরত মাওলানা বলেন, ধীরে ধীরে অন্তরে এ খেয়াল আসতে শুরু করে যে, এর স্থান পূরণের জন্য আরবী শিশু পাঠ্যের নতুন সিরিজ লেখা প্রয়োজন। ভাই সাহেবের উপস্থিতি, সাইয়েদ সাহেবের স্নেহ এবং সেসময়ে দারুল উলৃমের মুহতামিম মাওলানা ইমরান খান সাহেব থাকাতে এ বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চয়তা ছিল যে, যদি এ সিরিজ তৈরী হয়ে যায় তবে সিলেবাসভুক্ত হতে সময় লাগবে না। সুতরাং তিনি আল্লাহর নাম নিয়ে কাজ শুরু করে দেন। সম্ভবত ১৯৪৪ সালের কাছাকাছি সময়ে রচনার কাজ শুরু হয় এবং দু'বছরের মধ্যেই তার তিনটি খণ্ড তৈরী হয়ে যায়।

বইতে খুব সতর্কতার সাথে লক্ষ্য রাখা হয় যে, যাতে কোন পাঠই যেন দ্বীনী উপদেশ থেকে খালি না যায় এবং এ থেকে যেন কোন দ্বীনী বা আখলাকী রেজাল্ট বের হয় অথবা কোন দ্বীনী শিক্ষা বা শিষ্টাচারের প্রতি নির্দেশন। হয়। এ পদ্ধতিতে ছাত্ররা টেরও না পায় যে, কোন জিনিস উপর থেকে বা বাহির থেকে আমদানী করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে ২য় খণ্ডের ১19 ৪ (রুটির এক টুকরা) ০০০৪) 6১8 (কোর্তার কাহিনী) 1১৬ 95 91 এ (তুমি কি হতে চাও) জা এ। ওঠ (সোতজনের একজন হও) ষ্টব্য। সাধারণ জ্ঞান হিসাবে আল-আইন, আল-আসাদ, আল-জামাল, আল- কাতেরা, জিসমুন নাবাত, আল-বাখেরা ইত্যাদি সবক। এতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্য থেকে এ]। 8 ৪১৮৫১ এ ১1 &। ০5০১ এ আল) ৬১০০৭ 9 ইত্যাদি সবক, বড় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে খলীফা উমর ইবনে সুলতান মুজাফৃকর হালিম, আওরঙ্গজেব আলমগীর এবং আলেমদের মধ্যে থেকে ইমাম গাজালী, ইবনে তাইমিয়া, মোল্লা নিযামুদ্দীন ফিরিঙ্গী মহল্লী ও শাহ আবদুল আবীষ সাহেবকে নেয়া হয়েছে। শিক্ষা কেন্দ্র থেকে জামেয়া, আযহার, দারুল উলৃম দেওবন্দ, মাযাহেরুল উলুম ও নদওয়াকে নেয়া হয়েছে।' কুতুব মিনারের ভাষায় ৬১4 5১1 (মিনারের আত্মকথা) শিরোনামে হিন্দুস্তানের ইসলামী শাসনের ইতিহাসকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করা হয়েছে, . যাতে হিন্দুস্তানের ইসলামী ইতিহাসের সারবস্ত এবং সহস্র পৃষ্ঠার সার সংক্ষেপ এসে গেছে। ৮৮১ 1 ৫৮০ ৩+ শিরোনামে ইসলামী ইতিহাসের সেই আলোকচ্ছটা কিঞ্চিত তুলে ধরা হয়েছে, যা দর্শকের দৃষ্টিতে একটি নক্ষত্রের মত ধরা পড়ে। এই সিরিজ লাখনৌ থেকে ছাপার পরে প্রথমে দারুল উলুম নদওয়াতে অতঃপর অন্য সব মাদরাসায় পাঠ্যভুক্ত হয়ে যায় এবং পাকিস্তানেও ছেপে সেখানকার মাদরাসার সিলেবাসভুক্ত হয়। কাসাসুন নাবিয়্টান লিল আতফাল

হ্যরত মাওলানা যেই খেদমত ও আল্লাহর তাওফীকের সবচেয়ে বেশী . শুকরিয়া আদায় করতেন এবং যাকে মাগফেরাতের ওসীলা ও আখেরাতের সম্বল মনে করতেন তা হল কাসাসুন নাবিয়্যিন সিরিজ। পুর্বেই উল্লেখ করা পাঠ্যতুক্ত ছিল। তৎকালে আরব বিশ্বের সর্বত্র তা জনপ্রিয় ও সমাদূত ছিল। হ্যরত মাওলানা বলেন, “আমারও এ কিতাব পড়াতে হয়েছে । আমাকেও এর জন্য খালেছ প্রগতিবাদী হয়ে যেতে হত এবং বিভিন্ন জীবজন্তর ছবি সামনে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পড়াতে হতো । কিন্তু মাধদুম ও মুহতারাম মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী (যার দ্বীনী সম্রমবোধ ও অনুভূতি আলেমদের গর্বের বিষয় ছিল) বিশেষ করে এদিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি ১৯৪২ সালে আমার কাছে লিখিত এক পত্রে এ বই পাঠ হওয়াতে সমালোচনা করেন। *

এ কাজ সম্ভবত ৪৩-৪৪ সনের মাঝামাবিতে শুরু হয়েছিল এবং এর ধারাবাহিকতা সফরে ও নিজ গৃহে অবস্থানকালে ট্রেনে, রাস্তার পারে "পরিবহণের অপেক্ষায় থাকা কালে, লাহোর, সোহাওয়া ও নিযামুদ্দীনে অবস্থান কালে চলাফেরায় মানসিক বিক্ষিপ্ততার অবস্থাতেও জারি ছিল এবং আল্লাহর তাওফীকে এক সময় তা সমাপ্ত হয়। হযরত মাওলানা বলেন, এটি শুরু করার পর মনে হত আল্লাহ তা আমার জন্য এ কাজ এত সহজ করে দিয়েছেন যে, যখনই চাইতাম সাধারণ কথাবার্তা বলার মতো অনায়াসে লিখতে পারতাম।

পুরো বইতে তিনটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে- এক, বই কুরআনের ভাষায় লেখা। স্থানে স্থানে কুরআনের আয়াত অলংকার রূপে জুড়ে দেওয়া হয়েছে-।

দুই, শব্দ ভাণ্ডার &০০৪১%) কম, কিন্তু পুনঃ উল্লেখ ও পুনঃ আবৃত্তির দ্বারা স্মৃতিতে অংকন করে দেয়া হয়েছে।

তিন, ইসলামের বুনিয়াদি আকায়েদ (তাওহীদ, রিসালাত ও পরকাল)- এর শিক্ষা ও আলোচনা প্রসঙ্গত এসে গেছে।

চার, ঘটনা বিশদ লেখা হয়েছে এবং তাতে এমন পথ-নির্দেশনা রয়েছে যাতে কুফর ও শিরকের প্রতি দ্ৃণা, তাওহীদ ও ঈমানের মুহাব্বত ও আব্দিয়া আলাইহিমুস সালামের প্রতি শ্রদ্ধা শিশুদের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত হয়ে যায় এবং এসবই হয় অবচেতন মনে ।

এ কিতাবে শিশুদের আকায়েদ শুদ্ধ করা ও তাদের মন-মানসিকতা গড়ে তোলার খোরাক আছে। তাই এর প্রতি মাওলানা আবৃদুল মাজেদ দরিয়াবাদী (রহ.)-এর দৃষ্টি পড়ে সর্বপ্রথম । তিনি এর উপর মতামত পেশ করতে গিয়ে বলেন, এ কিতাবের মাধ্যমে শিশুদের ইলমে কালাম তৈরী হয়ে গিয়েছে। মাওলানা মাসউদ আলম সাহেব তার ভূমিকায় লেখেন, “এ কিতাবে ভাষা সাহিত্য ও দ্বীনকে এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেমন নখ গোশতের সাথে মিশে থাকে ।” মাওলানা আবৃদুল মাজেদ (রহ.) এ কিতাবের এত মূল্যায়ন করেছিলেন যে, তিনি চাইতেন হযরত মাওলানা সব কাজ ছেড়ে এর পিছনে সময় ব্যয় করুন। কিন্তু ৩য় খণ্ড শেষে (হযরত মুসা (আ.) সম্পর্কিত) এ ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে যায়।

কিতাবের ২য় এডিশন যখন মিসর থেকে ছাপা হয়েছিল, তখন হযরত মাওলানা চেয়েছিলেন, যেন সাইয়েদ কুতুব এর ভূমিকা লেখেন। তিনি ভূমিকা লেখেন এবং তাতে হৃদয় খুলে বইটির প্রশংসা করেন।

এ কিতাব মিসরের পর বৈরতের প্রসিদ্ধ প্রকাশনা সংস্থা 'মুআসসাতুর রিসালাহ'-এর পক্ষ থেকে কয়েক হাজার কপি প্রকাশ পায় এবং সৌদি আরবের বহু প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যভুক্ত হয়। হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের বহু মাদরাসা, স্কুল ও কলেজে আরবী শাখায় তা সিলেবাসতুক্ত হয়। হযরত মাওলানা বলেন, যদি আমার কোন কিতাব পাঠ্যভুক্ত না হওয়াতে আশ্চর্যবোধ এবং বন্ধুসুলভ অভিযোগ করার সুযোগ থাকে, তবে তা এ কিতাব সম্পর্কে। এ কিতাব একই সাথে ভাষার দক্ষতা সৃষ্টি ও দ্বীনী মূল্যবোধ জাগ্রত করে। কিন্তু আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মগ্রীতি অনেক বড় বড় সত্যকে ঢেকে দেয়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এ ব্যাপারে আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণী অনেক বেশী উদার ও প্রসারিত দৃষ্টিসম্পন্ন প্রমাণিত হয়েছে।

মাওলানা আবৃদুল মাজেদ সাহেবের মত ব্যক্তির তাগাদা, অনুরোধ এবং কিতাব সম্পর্কে তার উচু দৃষ্টিভি সত্তেও প্রায় ত্রিশ বছর অতিবাহিত হয়ে যায়, কিন্তু তৃতীয় খণ্ডের পর ৪র্থ খণ্ড লেখার এবং অবশিষ্ট নবীদের সম্পর্কে বিশেষ করে খাতামুন্নাবিয়্যিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসান্নামের মোবারক জীবনচরিত সম্পর্কে (আরবী ভাষায় শিশুদের জন্য যে গ্রন্থের স্বল্পতা প্রচণ্তভাবে অনুভূত হত) লেখার জন্য হযরত মাওলানা সুযোগ করে উঠতে পারছিলেন না।

১৩৯৫ হিজরী, ১৯৭৬ সনে রমযান মাসে হঠাৎ করে এ ব্যাপারে তিনি জেগে ওঠেন এবং হযরত মূসা (আ.)-এর পর আগমনকারী নবীদের সম্ম্পকে লিখতে শুরু করেন। প্রথমে শিশুদের ভাষা ও বুঝার এঁ স্তরে নামতে সমস্যা হচ্ছিল, যা কাসাসুন নাবিগ্্যিন লিল আতফালের জন্য তিনি অবলম্বন করেছিলেন। মনে হচ্ছিল সেই ভাবা ও স্টাইলে লিখতে ভুলে গেছেন। কিন্ত কিছু চেষ্টার পর কলনের গতি ফিরে আসে এবং আল্লাহর তা'ওফীকে ৪র্থ খণ্ডের রচনা সমাপ্ত হয়। এ খণ্ড হযরত শুয়াইব (আ.) থেকে শুরু হয় এবং ঈসা (আ.)-এ শেষ হয়। এবার সমান্তি টানার পালা। আল্লাহ তা'আলা এরও তাওফীক দেন এবং জিলকদ ১৩৯৭ হিজরী, অক্টোবর ১৯৭৭ সনে খাতামুন নাবিয়্যিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনচরিত আলোচনার মধ্য

" দিয়ে এর শুভ সমাপ্তি হয়। এ দু'খস্ডও “মুআসসাতুর রেসালাহ” টবরুত থেকে প্রকাশ পায় এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

৫ম খণ্ডের বিষয়বস্তু সামনে রেখেই হযরত মাওলানা আরো বিস্তারিত- ভাবে তীর বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ ০1 5/-|। (অনুবাদ, নবীয়ে রহমত) রচনা করেন, যা দারুশ শুরুক জিদ্বা থেকে ছেপে সৌদি আরব ও অন্যান্য রাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি ও কলেজে সিলেবাসতুক্ত হয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে বিশ্বের আনাচে-কানাচে আলোড়ন সৃষ্টি করে। মূলতঃ কাসাসুন নাবিগ্যিনের সিরিজই এ' বিশাল গ্রন্থ রচনার উদ্দীপক ও নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল। া

সিলেবাস প্রণয়নের অন্যান্য প্রচেষ্টা[সম্পাদনা]

নতুন সিলেবাস প্রণয়নের যে কাজ কোন সুনির্দিষ্ট প্রান ছাড়াই ব্যক্তিগতভাবে শুরু হয়েছিল তা কোননা কোনতাবে অব্যাহত ছিল। মুখতারাত ও আল কেরাআতুর রাশেদার মধ্যবতী শূন্যতা পূরণের জন্য মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ রাবে নদভী (বর্তমান পরিচালক, দারুল উলৃম নদওয়া) মানসুরাত (গদ্য) সংকলন করেন। যাতে এমন অনেক উৎকৃষ্ট সাহিত্য নিদর্শন অন্তর্তৃক্ত হয় যা তুলনামূলকভাবে মুখতারাতের ' সাহিত্য নিদর্শনের চেয়ে সহজ, কিন্তু ছাত্রদের জন্য উপযোগী ছিল। এ গ্রন্থ নির্বাচনে তার সাহিত্য রুচি ও অধ্যয়নের সুস্পষ্ট ছাপ ফুটে ওঠে এবং তা পাঠ্যতালিকাভুক্ত হওয়ারও যোগ্য । এছাড়া তিনি ৮১১ 4 ৫৮ 4০1 ০০১২ নামে তৃতীয় আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। যাতে তিনি আরবী গদ্যের নির্বাচিত অংশ নিয়ে তার সৌন্দর্য ও বিশেষত্বের প্রতি ইশারা করেছেন এবং ছাত্রদের মাঝে সাহিত্য সুধা আহরণের ও সাহিত্যের মান নির্ণয়ের যোগন্তা সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছেন। অন্যদিকে মাওলানা আবৃদুল মাজেদ নদভীর কলমে “মুআল্পিমুল ইনশা" সংকলনের কাজ আরন্ত হয়, যা লেখনী ও রচনা অনুশীলনের সহায়ক হয়। তিনিও অত্যন্ত পরিশ্রম ও মেধা ব্যয় করে এর দু'খণ্ড সমান্ত করেন।

এমনিভাবে ইসলামের ইতিহাসের জন্যও নতুন গ্রন্থের প্রয়োজন ছিল। মাওলানা মাহবুবুর রহমান আযহারী (উস্তাদ, দারুল উলুম নদওয়া) আল মুহওয়ারাতুল আরাবিয়াহ নামে প্রাথমিক শ্রেণীর জন্য আরবী কথ্য ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন পরিভাষা *ও প্রবাদ-প্রবচন নিয়ে একটি লহপাঠ্য গ্রন্থ রচনা রূরেন। তাও সিলেবাসতুক্ত করা হয়। আরবী ব্যাকরণে মিযান-মুনশাইব ও নাহবেমীরের স্থলাভিিক্ততার জন্য আধুনিক নীতিমালার সংযোজনে উর্দুতে মৌলভী মোস্তফা ও মৌলভী আবৃদুল মাজেদ সাহেব 'তামরীনুন নাছ", মোলভী মুরীন উল্লাহ সাহেব নদবী “তামরীনুস সরফ' ও মৌলভী সায়ীদুর রহমান সাহেব নদভী “ইলমুত তাসরীফ' রচনা করেন এবং তা পাঠ্যভূক্ত হয়। নতুন সিলেবাস প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি জরুরী ও. উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে নদভী (সম্ভবত সাইয়েদ আবদুল আলী সাহেবের উৎসাহে)। তিনি মুসলিম বিশ্বের ভূগোল নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। শুধু হাদীছ ও সীরাত নয়, বরং আরবী সাহিত্য ও ইতিহাসের ছাত্রও যখন নিজস্ব পাঠ অধ্যয়নে বসে, মনে হয় সে একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গে প্রবেশ করছে। ডানে-বায়ে-সামনে-পিছনে কিছুই তার গোচরে আসে না। হাজারো স্থানের নাম হাদীছ, সীরাত ও জাহেলী যুগের কাব্যে পাওয়া যায়, অথচ এ সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। এই না জানার কারণে বহু এঁতিহাসিক সত্য, সীরাত ও হাদীছের ঘটনাবলীর শুরুত্ব এবং তাঁর পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট বুঝা থেকে অসম্পূর্ণতা থেকে যায়, একজন -অনুভূতিশীল ছাত্রের জন্য যা' জানা অত্যন্ত জরুরী, একজন ভাল শিক্ষক ও উন্তাদের জন্য তা ছিল আরো গুরুতৃপূর্ণ। এ কাজে তিনি অত্যন্ত যোগ্যতা ও পরিশ্রম ব্যয় করে ম্যাপ তৈরী করেন। হাদীছ ও সীরাতের ঘটনাবলীর দিকে প্রয়োজনীয় ইঙ্গিত করেন এবং আরবী কবিতা উল্লেখ করে তাতে বর্ণিত স্থান নির্দেশ করেন। কিন্ত আফসোস! দ্বীনী মাদরাসাগুলো এ কাজের তেমন কোন মূল্যায়ন করেনি ।

আরবী ভাষা ও সাহিত্যের নতুন গ্রন্থাদি প্রণয়নের পর হযরত মাওলানা আলী মিয়া রেহ.) ইলমে ফিকাহর দিকে নজর দেন। তিনি বলেন, আমার কিতাব গড়তে বাধ্য হয় এবং মানতেক ইত্যাদি পুরাতন পদ্ধতি অবলম্বন না করেই অপ্রাপ্ত বয়সে নূরুল ইযা, কুদুরী পড়তে অপারগ হয়, তাদের জন্য এমন কোন কিতাব লিখব, যাতে ইবারতের সাবলীলতা, অনুচ্ছেদ বিভক্তি, উদাহরণ ও ব্যাখ্যামলক আলোচনায় বয়সের প্রতি লক্ষ্য রাখা হবে। মাসায়েলের ক্ষেত্রে আমলী ও প্রয়োজনীয় মাসায়েল নির্বাচন করা হবে এবং যা আরবীতে ফিকাহর প্রথম কিতাব হিসেবে পড়ানো হবে । আমি নিজেই এ কাজ আরম্ভ করেছিলাম, কিন্ত সম্পূর্ণ করতে পারিনি । আলহামদুলিল্লাহ, গত বছর ন্নেহাস্পদ মৌলভী শফীকুর রহমান নদভী ,_...1 424) (সহজ ফিকাহ) নামে একটি কিতাব তৈরী করেছে এবং তা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ পছন্দ করেছেন। এখন তা দারুল উলুমের পাঠ্যভুক্ত। এদিকে বেশ কয়েকবছর পূর্বে মাওলানা মুহাম্মাদ উয়াইস নদভী শাহ ওয়ালী উল্লাহ সাহেব (রহ.)-এর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ 'আল-আকীদাতুল হাসানাহ' প্রয়োজনীয় টীকাসহ 'আল-আকীদাতুস সুম্নিয়াহ' নামে বিন্যস্ত করেছেন। হযরত মাওলানা তাতে লম্বা ভূমিকা লিখেছেন। এভাবে ইলমে কালামের পরিচিতি এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকায়েদের ব্যাখ্যার জন্য একটি ভাল গ্রন্থ রচিত হয়। মানতেক, দর্শন, আকায়েদ ও উসূলে ফিকাহ বিষয়ে হযরত মাওলানার এরূপ নতুন গ্রন্থ রচনার আগ্রহ ছিল, যা দ্বারা দ্বীনী মাদরাসাসমূহের পাঠ্যপুস্তকসমূহ পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করতো এবং উম্মতের চাহিদা অনুযায়ী নেসাব তৈরী করা সহজ হতো ।

দ্বীনী মাদরাসাগুলোর জন্য আরেকটি চিন্তার বিষয় ছিল আমাদের প্রাচীন দ্বীনী সিলেবাসে (আজকের দরসে নিযামী মাদরাসাগুলোর সূচনাকাল পর্যন্ত) যুগের পরিবর্তন, উন্নতি ও অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তন- পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছিল। এতে যেমন পাঠ্যপুস্তক রদবদল করা হয়েছে, তেমনি সনদের মানও পুন্মূল্যায়ন করা হয়েছে। এটা হয়েছে এমন এক যুগে যখন এ উপমহাদেশের ধর্মও এক ছিল, শাসনও এক ছিল, দ্বীনী ভাষা (আরবী) ও প্রশাসনিক ভাষা ফোরসী) এক ছিল, সভ্যতা- কৃষ্টিও এক ছিল, আইনও হোনাফী ফিকাহ অনুসারে) এক ছিল, ক্ষমতাও একই বিশ্বাসভাবাপন্ন (হানাফী মাযহাব অনুসারী) সুন্নী লোকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু যখন হিন্দুস্তানের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেল, প্রশাসনিক শক্তি, সম্যতা-কৃষ্টি, ভাষা, আইন সব পরিবর্তন হয়ে গেল এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতির পরিধি বিস্তৃত, গভীর ও প্রশস্ত হয়ে গেল, তখন এ সিলেবাস এক জায়গায় এসে এমনভাবে থমকে গেল যে, তার কোন একটি কিতাবের পরিবর্তনকে বিদআত ও পুর্বসূরী উলামায়ে কেরামের পথ থেকে বিচ্যুতির প্রতিরূপ হিসেবে সাব্যস্ত হল।

অথচ বাস্তবতা হল, আমাদের বুযুর্গগণ যীরা হিন্দুস্থানে শিক্ষার সূচনাপরিবেশ সৃষ্টি করেছেন এবং যীরা ছ্বীনী শিক্ষার জিম্মাদার ছিলেন, নিজেদের সঠিক নির্বাচন ও যুগ পরিচিতি, বরং মিল্লাত ও জাতির প্রয়োজনীয়তার সঠিক উপলব্ধির প্রমাণ প্রত্যেক যুগে এমনভাবে দিয়েছেন, আজকের উলামায়ে কেরাম ও মাদরাসার পরিচালকগণ যা অনুধাবন করতেও অপারগ; অথচ জাতির প্রয়োজনে এবং আধুনিক চাহিদাকে সামনে রেখে সময়ের উন্নতি ও অশ্গতির সাথে এ সিলেবাসের পাল্লা দেওয়ার প্রয়োজন এখন সবচেয়ে বেশী!

৮৫ বর্ষপূর্তি শিক্ষা সম্মেলন[সম্পাদনা]

নদওয়াতুল উলামা সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিয়ম ছিল ভারতের কোন কেন্দ্রীয় স্থানে এর বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হওয়া। এতে বিশিষ্ট উলামায়ে কেরাম, উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ ও দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সমবেত হতেন এবং উচ্চমানের বক্তৃতা হত। এতে নদওয়াতুল উলামার লক্ষ্য উদ্দেশ্য প্রচার প্রসার ব্যতীত মুসলমানদের দ্বীনি জীবন ও শিক্ষার উন্নতিতে আলোড়ন সৃষ্টি হত। কিন্তু ১৯২৭ সালে অমৃতসরের সভার পর বার্ষিক সভার ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর অর্ধ শতাব্দীকাল পার হয়ে গেল।

আরববিশ্বে নদওয়াতুল উলামার শিক্ষাপ্রাপ্তগণের দাওয়াতী ভূমিকা, তাদের রচনাবলীর ব্যাপক প্রসার, আরবী সাময়িকী “আল বা'ছুল ইসলামী' ও 'আর রায়েদ' এর চালু হওয়া এবং ভারতের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন রাজনৈতিক শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে খুব বেশী প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল ইসলামী দেশসমূহের শিক্ষাবিদ, আরবদেশসমূহের বুদ্ধিজীবী, ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য প্রচেষ্টাকারী আন্দোলন ও দলসমূহের নেতৃবৃন্দ একদিকে এসব সংস্কার প্রচেষ্টা ও অভিজ্ঞতাসমূহের সাথে পরিচিত হওয়া যা তারতভূমিতে সম্পন্ন হয়েছে, অন্যদিকে ভারতীয় উলামায়ে কেরামের সে কীর্তিসমূহ অবহিত হওয়া ঘা তারা একট নতুন দেশে (যার নিজস্ব সভ্যতা, ধর্ম ও দর্শন ছিল) নিজ জাতীয় স্থাতন্ত্র রক্ষা, ইসলামের প্রচার প্রসার এবং ইসলামী শাস্্রসমূহের ভাণ্ডারে সংযোজন ও ইসলামী চিন্তাধারার নবায়ন ও পুনর্জীগরনের গ্ষেত্রে রচনা করেছেন। তৃতীয়তঃ নদওয়াতুল উলামার ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষাদর্শন এবং প্রাচীন ও আধুনিকের সমন্বয় প্রচেষ্টার সাথে পরিচিত করানোর জন্যও একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রয়োজন ছিল, যাতে ইসলামী দেশসমূহের বিশেষ করে আরব রাষ্ট্রসমূহের চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের দাওয়াত করতে হবে।

১৯৪৬ সালে ডক্টর জাকির হুসাইন খান (পরবর্তীকালে ভারতের প্রেসিডেন্ট) এর আমন্ত্রনে দিল্লীতে জামেয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়ার রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানে হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) “নবী (সো.) যুগে শিক্ষা ব্যবস্থা' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। উক্ত সভ্ভা থেকেই হযরত মাওলানার মধ্যে এ আকাংক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল যে, ভারতের দ্বীনী শিক্ষার প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকেও এমন একটি প্রতিনিধিতৃমূলক ও প্রভাবশালী সম্মেলন করতে হবে যেখানে দ্বীনি শান্ত্রসমূহের উন্নতি ও তার প্রস্তাবাদি নিয়ে অতীতের পর্যালোচনা ভবিষ্যতের জন্য রূপরেখা প্রস্তুত করতে হবে। এজন্য খোদারীভাবে হযরত মাওলানা আলী মিয়ার সামনে ছিল নদওয়াতুল উলামার কেন্দ্র ও 'প্লাটফর্ম। এটিকেই সাজানো ও কাজে লাগানো তারপক্ষে সহজ ছিল। ূ

১এছাড়া আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল এই যে, ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার ও সেখানকার সংখ্যা্তরু অধিবাসী ও বিভিন্ন সম্প্রদায় দেখবে যে, মুসলমানরা আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ । ভারা কোন একটি নির্দিষ্ট দেশে সীমবদ্ধ নয়। তারা অতীতে ও বর্তমানে সেসব দেশ থেকে যেখানকার ভাষা আরবী এবং যাদের ইতিহাস শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দ্বীনি শিক্ষার সেবা ও উন্নয়নের ইতিহাস রয়েছে, শুধুমাত্র হণ করেনি, প্রদানও করেছে এবং ইসলামী চিন্তাধারাকে নবায়ন করার জন্য তারা নেতৃত্বের দায়িত্বও কখনো কখনো পালন করেছে। এখানকার মাদরাসাসমূহ এবং তা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ ও তার পরিচালকবৃন্দকে আরব দেশসমূহে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয় এবং তাদেরকে শিক্ষাসভাসমূহে শেষ সারিতে নয়, বরং প্রথম সারিতে ও বিশেষ স্থানে আসীন করা হয়। এসব জানার প্রয়োজন এজন্যও যে, এসব বাস্তবতা প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের কর্তাব্যক্তিরা দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্রসমূহের সাথে সমীহ আচরণ করবেন এবং এসব দেশের সাথে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্কের খাতিরে দেশের মাদরাসাগুলোর প্রতি সুনজরে তাকাবেন। সুতরাং এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুধু নদওয়ার জন্য নয় বরং গোটা ভারতের দ্বীনি মাদরাসাগ্ডলোর স্বার্থেই প্রয়োজন ছিল। এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রয়োজনীয়তা নদওয়াতুল উলামার দায়িত্রশীলরা দীর্ঘদিন ধরে অনুভব করে আসছিলেন।

১৯৬৩ সাল থেকে বিভিন্নজনের লেখা ও বক্তৃতায় বিষয়টি উন্লিখিত হতে থাকে। কিন্তু তা বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেনি। ১৯৭৪ সালের ২৩শে মার্চ নদওয়াতুল উলায়ার ম্যানেজিং কমিটির সভায় এ ব্যাপারে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। হযরত মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী রেহ.)-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে নদওয়াতুল উলামার পচাশিতম বার্ষিকী শিক্ষা মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বশীল মনোনীত করা হয় মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ ইমরান খাঁন নদীকে । সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচনে দ্বিধাদ্বনদ দেখা দেয়। অবশেষে হজ্ের সময় হযরত মাওলানা মনযুর নো'মানী (রহ.)-এর প্রস্তাবক্রমে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটর ডষ্টর আবদুল হালীম মাহমুদকে নির্বাচিত

করা হয়। নদওয়াতুল উলামার নাজেম হযরত মাওলানা আলী মিয়া সর্ব প্রথম এ সম্মেলনের দাওয়াতনামা প্রেরণ করেন রাবেতা আলমে ইসলামীর ' সেক্রেটারী জেনারেল শায়খ মুহাম্মপ সালেহ কায্যাযের নিকট। তিনি

দাওয়াত কবুল করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে, রাবেতার .একটি প্রতিনিধিদল

সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করবে।

এতদুপলক্ষে বেশ কয়েকটি জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। সম্মেলনের তারিখ ধার্য হয় ৩১শে অক্টোবর থেকে ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫। হঠাৎ করে ১৯৭৫

সালের জুন মাসে গোটা ভারতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। ইতোমধ্যে

সম্মেলনের ব্যাপক প্রচার করা হয়েছে। বিদেশী মেহমানদের দাওয়াত করা

হয়েছে। আরব রাষ্ট্রসমূহ, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ১3 বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে

- যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে। সুতরাং সম্মেলন সুলতবী করা কোন মতেই

সম্ভব ছিল না। এদিকে ভারত সরকার বিদেশী মেহমানদের ভিসা প্রদানে

কড়াকড়ি আরোপ করে কি না সে বিষয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। কিন্তু ভারত

সরকার তা করেনি। তখন ভারতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জনাব ফখরুদ্দীন

আলী আহমদ। তিনি ভারতের দীনদার শ্রেনীর সাথে সুসম্পর্ক রাখতেন ।

মাওলানা আলী মিগ্নার সাথে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল । সম্মেলনে তাঁকে

দাওয়াত না দেওয়া যেমন অনভিপ্রেত ছিল, তেমনি তাঁর আগমনে যেসব

প্রটোকল মেনে চপতে হত। তাতে সম্মেলনের দ্বীনি পরিবেশ বিপ্ল হওয়ার

আশংকা ছিল। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে প্রেসিডেন্ট শুধু বানী প্রেরণ

করে ক্ষান্ত রইলেন। কেননা তার রাষ্ট্রীয় কাজে খুবই ব্যস্ততা ছিল। উত্তর

প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হীমঅতিনন্দন ভোগনাজী এতদুপক্ষে রাজ্য সরকারের পক্ষ

থেকে সকল প্রকারের সহযোগিতার প্রস্তাব দেন। এমনকি বিভিন্ন দেশ থেকে

আগমনকারী' মন্ত্ীবর্গ ও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাগণকে ভারতের রাষ্ট্রীয়

মেহমান হিসেবে অভ্যর্থনা, আপ্যায়ন ও আবাসনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব

দেন। কিন্তু নদওয়ার পক্ষ থেতে তা কবুল করতে অপারগতা জানানো হয়।

তবে নদওয়ার আগমনের রাস্তা মেরামত ও পানি সরবরাহের দায়িত্ব রাজ্য

সরকার গ্রহণ করে এবং সুচারুরূপে তা পালন করে।

হজ্ের সময় হযরত মাওলানা মনযুর নো'মানী (রহ.)-এর প্রস্তাবক্রমে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটর ডষ্টর আবদুল হালীম মাহমুদকে নির্বাচিত

করা হয়। নদওয়াতুল উলামার নাজেম হযরত মাওলানা আলী মিয়া সর্ব প্রথম এ সম্মেলনের দাওয়াতনামা প্রেরণ করেন রাবেতা আলমে ইসলামীর ' সেক্রেটারী জেনারেল শায়খ মুহাম্মপ সালেহ কায্যাযের নিকট। তিনি

দাওয়াত কবুল করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে, রাবেতার .একটি প্রতিনিধিদল

সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করবে।

এতদুপলক্ষে বেশ কয়েকটি জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। সম্মেলনের তারিখ ধার্য হয় ৩১শে অক্টোবর থেকে ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫। হঠাৎ করে ১৯৭৫

সালের জুন মাসে গোটা ভারতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। ইতোমধ্যে

সম্মেলনের ব্যাপক প্রচার করা হয়েছে। বিদেশী মেহমানদের দাওয়াত করা

হয়েছে। আরব রাষ্ট্রসমূহ, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ১3 বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে

- যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে। সুতরাং সম্মেলন সুলতবী করা কোন মতেই

সম্ভব ছিল না। এদিকে ভারত সরকার বিদেশী মেহমানদের ভিসা প্রদানে

কড়াকড়ি আরোপ করে কি না সে বিষয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। কিন্তু ভারত

সরকার তা করেনি। তখন ভারতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জনাব ফখরুদ্দীন

আলী আহমদ। তিনি ভারতের দীনদার শ্রেনীর সাথে সুসম্পর্ক রাখতেন ।

মাওলানা আলী মিগ্নার সাথে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল । সম্মেলনে তাঁকে

দাওয়াত না দেওয়া যেমন অনভিপ্রেত ছিল, তেমনি তাঁর আগমনে যেসব

প্রটোকল মেনে চপতে হত। তাতে সম্মেলনের দ্বীনি পরিবেশ বিপ্ল হওয়ার

আশংকা ছিল। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে প্রেসিডেন্ট শুধু বানী প্রেরণ

করে ক্ষান্ত রইলেন। কেননা তার রাষ্ট্রীয় কাজে খুবই ব্যস্ততা ছিল। উত্তর

প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হীমঅতিনন্দন ভোগনাজী এতদুপক্ষে রাজ্য সরকারের পক্ষ

থেকে সকল প্রকারের সহযোগিতার প্রস্তাব দেন। এমনকি বিভিন্ন দেশ থেকে

আগমনকারী' মন্ত্ীবর্গ ও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাগণকে ভারতের রাষ্ট্রীয়

মেহমান হিসেবে অভ্যর্থনা, আপ্যায়ন ও আবাসনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব

দেন। কিন্তু নদওয়ার পক্ষ থেতে তা কবুল করতে অপারগতা জানানো হয়।

তবে নদওয়ার আগমনের রাস্তা মেরামত ও পানি সরবরাহের দায়িত্ব রাজ্য

সরকার গ্রহণ করে এবং সুচারুরূপে তা পালন করে। সম্মেলনের সকল প্রস্তুতির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল এই যে, একদল ই'তেকাফকারীকে শুধু সম্মেলনের সাফল্য ও উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দুয়া ও যিকিরে মশগুল রাখা হয়। তাবলীগী জামায়াতের আমীর হযরত মাওলানা ইনআমুল হাসান ও শারখুল হাদীছ হযরত মাওলানা- মুহাম্মদ যাকারিয়া (রহ.)-এর পরামর্শ ও ইংগিতে এ ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

৩০শে অক্টোবরের মধ্যেই শায়খুল আযহারসহ বিদেশী মেহমানরা আগমন করেন। ৩১শে অক্টোবর শুক্রবার কারী অদুদ আবদুল হাই সাভহবের কুরআন মজীদ তেলাওয়াতের মাধ্যমে সম্মেলন শুরু হয়। অতঃপর নদওয়ার সঙ্গীত পাঠ করা হয়। অতঃপর ভারতের প্রেসিডেন্ট এবং বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের পাঠানো বাণী পড়ে শোনানো হয়। এরপর স্বাগত ভাষণ হয়। হযরত মাওলানা আলী মিয়ার দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতার কারণে স্বগত ভাষণের আরবীপাঠ উপস্থাপন করেন মাওলানা সাইয়েদ ওয়াজিহ রশীদ নদভী এবং উদ্দু পাঠ উপস্থাপন করেন সম্মেলনের ব্যবস্থাপক মাওলানা হাফেজ মৃহাম্মদ ইমরান খান নদভী । স্বাগত ভাষণের পর শায়খুল আযহার সভাপতির ভাষণ দেন। ইতোমধ্যে জুমআর নামাজের সময় হয়ে যায়। প্রথম অধিবেশনের সমান্তি ঘোষণা করা হয়। এসময়ে শ্রোতার সংখ্যা প্রায় ঘাট হাজার দাঁড়ার়।

সেদিন জুমআর নামাজে ইমামতি করেন শায়খুল আযহার । বিকালে শিক্ষা প্রদর্শনী উদ্ধোধন করেন মিসরের মন্ত্রী ডক্টর মুহাম্মদ হুসাইন যাহাবী। মাগরিবের পরে দ্বিতীয় অধিবেশন হয়। এতে দারুল উলৃম নদওয়াতুল উলামার শিক্ষাসচিব মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়াই নদভী নদওয়াতুল উলামার পচাশি বছরের রিপোর্ট ও ভবিষ্যত কর্মসূচী পেশ করেন।

চারদিনব্যাগী সম্মেলনের মাঝখানে অন্যান্য মজলিসে তাহকীকাত ওয়া নাশরিয়াতে ইসলামের পরিচিতি সভা, শিক্ষা বিষয়ে ভাষণ ও প্রবন্ধা, রাশিয়ার প্রতিনিধি মীর শরফুদ্দীন মুহাম্মদ-এর উর্দু তাকরীর, নদওয়ার ছাত্রদের সংগঠন জমিয়তে আল ইসলাহ-এর স্ধর্ষনা, সংবাদ ও সাহিত্য বিষয়ক প্রদর্শনী। দ্বীনি তা'লীমী কাউন্সেলের নৈশভোজ । শহরবাসীদের পক্ষ থেকে মেহমানদেরকে সম্বর্ধনা প্রদান এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পক্ষ থেকে গুলমার্গ হোটেলে সম্বর্ধনা ও নৈশভোজ । সম্মেলনে প্রচুর সংখ্যক আরব মেহমান উপস্থিত থাকলেও নদওয়াতুল উলামা! কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত করে রেখেছিলেন যে, চাঁদার নামও নেয়া হবে না। সে মতে বিরাট সুযোগ থাকা সত্তেও আর্থিক সহায়তার কথা ভুলক্রমেও উচ্চারণ করা হয়নি। ওরা নভেম্বর দিবাগত রাতে মাওলানা সাইয়েদ মিন্নাতুল্লাহ রহমানীর সভাপতিত্বে শেষ অধিবেশন হয়। সভাপতির ভাষণ ও দুয়ার মাধ্যমে নদওয়াতুল উলামার পঁচাশিতম বার্ষিক সম্মেলন সমাপ্ত হয়।

কাদিয়ানী বিরোধী আন্তর্জাতিক সম্মেলন[সম্পাদনা]

কাদিয়ানী মতবাদ ইসলামী উম্মতের স্থায়িত্ব ও দ্বীনিএক্যের বিরুদ্ধে এক গভীর চক্রান্ত এবং বৃটিশ শাসনের অন্যতম পরিকল্পনা। নদওয়াতুল উলামার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী (রহ) কাদিয়ানী ফিতনা নির্মূলের জন্য বিহার এলকায় যথেষ্ট কাজ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) ইসলাম বিরোধী চত্রান্ত ও তার বিরুদ্ধে মুসলিম মনীষীগণের সংস্কারমূলক কার্যক্রম অধ্যয়ন ও পর্যালোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, কাদিয়ানী ফেতনা এই উম্মতের বিরুদ্ধে সবচেয়ে মারাতক। তিনি আল্লামা ইকবালের সঙ্গে এঁকমত্য পোষণ করতেন যে, ছ্বীন ও শরীয়তের স্থায়িত্ব কিতাব ও সুন্নাহর সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও উম্মতের স্থায়িত্ব ও এক্য খতমে নবুওয়ত আকীদার সাথে জড়িত এবং এর উপর নির্ভরশীল। এজন্য তিনি কাদিয়ানী ফিতনা সম্পর্কে আরব বিশ্বকে অবহিত করার জন্য আরবীতে আল-কাদিয়ানিয়াত নামে একখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন । আফ্রিকা এবং যে সব দেশে এ দ্বীনী ইলম ও উলামায়ে কেরামের স্বল্পতা রয়েছে সে সব দেশে কাদিয়ানী মতবাদ ছড়িয়ে পড়তে থাকে । বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক স্থানে তাদের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারা জোরদার কার্যক্রম চালায়। ফলে কাদিয়ানী মতবাদ দ্রণ্ত প্রসার লাভ করতে থাকে। এবং যুবকশ্রেণী তাদের ভ্রান্ত মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী এ ফেতনা সম্পর্কে অত্যন্ত চিন্তিত ও উদ্দিপ্ন ছিলেন। তিনি তার বাসস্থান বিহারে এ ফেতনার মোকাবেলা করেন এবং তাতে সফল হন। যেহেতু দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা একটি আন্তর্জাতিক মানের দ্রনী প্রতিষ্ঠান ও দ্বীনী চেতনা ও চিস্তাধারা লালনের কেন্দ্র, এজন্য হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী নদওয়ায় একটি আন্তর্জাতিক মানের সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং তাতে আরব ও ইসলামী বিশ্বের প্রখ্যাত মনীষীগণের অংশ গ্রহণের জরুরী ব্যবস্থা করেন। সেমতে, ১৯৯৭ সালের ১২ ও ১৩ই নভেম্বর এক আর্তজাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এ সম্মেলন ছিল এক অসাধারণ ও উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুযারী এতে প্রায় ছয়লক্ষ শ্রোতা শরীক হন। এতে সভাপতিত্ব করেন মসজিদুল হারামের ইমাম শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আস-সুবাইল। তিনি তাঁর বিশেষ বিমানে লাখনৌ আসেন। তার সাথে .ছিলেন মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যাঞ্চেলর ডঃ সালেহ আবৃদুল্লাহ আল আবুদীসহ একটি প্রতিনিধি দল । এ প্রতিনিধি দলের সকল সদস্যই ছিলেন ফকীহ ও আলেম।

তাছাড়া সৌদী আরবের শরীয়া বিষয়ক মন্ত্রী ডঃ আবৃদুল্লাহ আবদুল মুহসেন তুকী এর নায়েব ডঃ আদনান ওয়াষ্যান উম্মুল কোরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'জন অধ্যাপক প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ দারুশ শুরুক ও দারুল মারেফা- এর প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও কায়েরোর মজলিসে ইসলামীর প্রধান অধ্যাপক কাসেম শরীফ, রাবেতা আলমে ইসলামীর উপ-মহাসচিব অর্ধশতাধিক গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক মুহাম্মাদ নাছের আল-আবুদী, ইস্তাম্বল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শায়খ মুহাম্মদ আমিন সিরাজ সহ পার্টজন সদস্য, অধ্যাপক হামদী আরসালান, শায়খ নুরুদ্দীন বেলানীয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে অধ্যাপক আমিনুল্লাহ, অধ্যাপক আব্দুর রহমান, অধ্যাপক সুফিয়ান, মালয়েশিয়া থেকে ডঃ আবুবকর, অধ্যাপক আহমদ ফাহমী নদতী, ডঃ জাহেদ আরশাদ প্রমুখ এতে অংশ গ্রহণ করেন।

তাদের আগমনে সম্মেলন যেন আরবদেশের সম্মেলনে পরিণত হয়। বক্তৃতা হয় আরবীতে । পরে উর্দুতে তার তরজমা হয়। ভারতের প্রায় সকল প্রদেশ থেকে উলামায়ে কেরাম, ইসলামী চিন্তাবিদ, মাদ্রাসা সমুহের মুহতামিমগণ, বনী দাওয়াতের সাথে জড়িত বযতিবরগ, গবেষক, প্রচারক এবং প্রায় ১৭টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন।

হ্যরত মাওলানা আলী মিয়ী উদ্ধোধনী ভাবণ দেন। এতে তিনি সম্মেলনের উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন এবং বলেন কাদিয়ানী মতবাদ নবুওয়তে যুহাম্মাদীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ইসলামের বিরুদ্ধে মৃন্যতম চক্রান্ত । অতঃপর শায়খ মুহাম্মদ বিন আবৃদুল্পাহ আস সুবাইল এক জোরালো বক্তৃতা দেন। অতপর অন্য বক্তাগণ বক্তৃতা করেন। অধ্যাপক কামেল শরীফ বলেন আমি অসংখ্য সমাবেশে অংশ গ্রহণ করেছি। কিন্তু এত ভাবগান্তীযপূর্ণ সমাবেশ আর কোথাও দেখিনি। দ্বিতীয় অধিবেশনে মক্কার মাদ্রাসায়ে সৌলতিয়ার নাযেম, ভারতের প্রধান প্রধান মান্রীসার দায়িতৃশীলগণ ও প্রতিনিধিগণ বন্ৃতা করেন। তৃতীয় ও শেষ অধিবেশনে মসজিদুল আকসার সাবেক ইমাম ডঃ মুহাম্মাদ সিয়ামও উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তৃতা করেন।

  • শায়খ সুবাইলের দোয়ার মাধ্যমে সম্মেলন সমাপ্ত হয়। তিনি জুমার নামাযে

ইমামতিও করেন।

দীর্ঘ অর্থ শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে এ মহামনীমী দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার উন্নয়নে জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ হয়ে নদওয়া আজ সম পৃথিবীতে তার চিন্তাধারা এবং আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং পৃথিবীর জ্ঞানী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মুসলিম ঘুবা-তরুণনদের হাতে তিনি একটি সুচিন্তিত রূপরেখা তুলে দিতে সমর্থ হয়েছেন।

_-5০০০- �

তাবলিগ জামাত ও নদভী[সম্পাদনা]

নতুন দ্বীনী ব্যক্তিত্ব সন্ধান[সম্পাদনা]

১৯৩৯ সালে হযরত মাওলানা আলী খিয়ার সাড়া জাগানো গস্থ “সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ” প্রকাশিত হলে তিনি গ্রন্থখানি তাঁর সাথী বিখ্যাত আলেম ও আল-ফুরকান সম্পাদক হযরত মাওলানা মনযুর নোমানী সাহেবের নিকট পাঠিয়ে দেন। হযরত নোমানী (রহ.) কিতাবখানি পড়ে এতই মুগ্ধ হন যে, সাথে সাথে লেখককে পত্র লিখে মোবারকবাদ দেন এবং একটি আবেগ প্রকাশ করেন যে, আসুন আমরা কোন নতুন দ্বীনী আন্দোলন শড়ে তুলি। হযরত আলী মিয়া নোমানী সাহেবের এ আহবানে সাড়া দিয়ে তার এক বিশেষ বন্ধু হাজী আবৃদুল ওয়াহেদসহ পরামর্শ করার জন্য নোমানী সাহেবের সাথে মিলিত হন। পরামর্শে এ ব্যাপারে তিন জনেই একমত হন যে,তারা প্রথমে কয়েকটি দ্বীনী মারকায পরিদর্শন করবেন। সেসকল স্থানের কোন কাজ তাদের পছন্দমত হলে তারা সেখানেও সহযোগিতা করবেন এবং তাদেরকে যামানার নতুন চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতে অনুপ্রাণিত করা হবে। এ উদ্দেশ্যে সাহারানপুর, দেওবন্দ, থানাভবন, রায়পুর, নিযামুদ্দীন, দিল্লী প্রভৃতি স্থানের দ্বীনী মারকাযসমূহ সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করার প্রোগাম নেওয়া হয়।

এর কয়েক মাস পূর্বে মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের দাওয়াত ও তাবলীগের উপর মাওলানা মওদূদী সাহেবের একটি শক্তিশালী প্রবন্ধ মাসিক তর্জমানুল কুরআন পত্রিকায় "একটি গুরুতুপূর্ণ দ্বীনী আন্দোলন" নামে প্রকাশিত হয়েছিল। জনাব মওদুদী স্বয়ং নিযামুদ্দীন ও মেওয়াত সফর করেছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি নিজে কিছু পরামর্শ দিয়ে এই ধনী প্রচেষ্টার পরিচ করিরেছিলেন এবং এ সম্পর্কে তার গভীর অনুভূত প্রকাশ করেছিলেন।

উল্লেখ্য, সমসামরিক হওয়ার সুবাদে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিভা মাওলানা মওদুদী সাহেবের প্রতি এক সময় হযরত মাওলানা আলী মিয়া সুধারণা পোষণ করতেন। বিশেষ করে পশ্চিমা সভ্যতা ও জীবনদর্শন এবং

আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আঁলী নদভী রহ, - ১০২

বস্তবাদের সমালোচনায় মাওলানা মুওদুদী সাহেবের ক্ষুরধার লেখনী মাওলানা আলী মিয়াকে আকৃষ্ট করে।

১৯৪০ সালের দিকে তাদের মধ্যে পত্র যোগাযোগ শুরু হয় । এক পযায়ে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে ফলে জামায়াতে ইসলামীর অনেক কর্মসূচীতে তিনি অংশখহণ করতে থাকেন। কিন্ত্র কিছু বিষয় তাঁর মনে সংশয়ের জন্ম দেয়। মওদুদী সাহেবের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অতিরঞ্জিত মনোভাব, পূর্বসূরী বুযুর্গানে দ্বীন ও মনীষীগণের মওদুদী সাহেবের লাগামহীন সমালোচনা ও মওদুদী সাহেবের মধ্যে রৃহানিয়াত, সুন্নাতের পাবন্দি, ইসলাহে নাফস ও তাআন্ুক মাআল্লাহর অভাব ছাড়াও ইসলামের মৌলিক কিছু বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যার ফলে তিনি মওদুদী সাহেবের সংস্রব ত্যাগ করেন। জামায়াতে ইসলামী ও মওদুদী সাহেব সম্পর্কে তাঁর ধারণা পাল্টে যায়।

পরবতীকালে মওদুদী সাহেবের “কুরআন মজীদ কি চার বুনিয়াদী ইস্তি লাহে" বইয়ের জবাবে তিনি 'আসরে হাযের মে দ্বীন কি তাফহীম ওয়া তাশরীহ' শীর্ষক বই লেখেন।

যাই হোক, হযরত আলী মিয়া এ প্রবন্ধটি পড়ে খুবই অনুপ্রাণিত হন। তিনি হযরত মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী (রহ.)-এর সাথে পানিপথ ও কর্নালের এক সফরে থানেশ্বরে সেখানকার ডেপুটি কমিশনার হাফেয আবদুল মজীদ সাহেবের বাসায় হযরত মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের নাম এবং তার তাবলীগী প্রচেষ্টার কথা সর্বপ্রথম শুনেছিলেন। অবশ্য হযরতজীর সাথে মাওলানা মনযুর নোমানী সাহেবের পরিচয় ইতিপূর্বেই হয়েছিল।

১৯৩৯ সালের শেষ দিকে তীরা তিনজন সর্বপ্রথম সাহারানপুর রওয়ানা হন। সেখান থেকে এ যামানার বিখ্যাত শায়খ হযরত মাওলানা আবদুল কাদের রায়পুরীর খেদমতে উপস্থিত হন। হযরত রায়পুরী তাদেরকে অভ্যর্থনা জানান এবং খুবই খুশী হন। হযরত রায়পুরীকে এ সফরের উদ্দেশ্য জানানো হুলে তিনি বলেন যে, আমার বয়সতো অনেক বেশী, আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি, তবে এ কাজের জন্য দু'আ ও সহযোগিতা থাকবে। তিনি একজন নওমুসলিম মাওলানাকে দিয়ে আগন্তবকদের সাহায্য করেন, যিনি অনেক সামাজিক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। অবশ্য তিনি পরামর্শ দেন যে, আপনারা সর্বপ্রথম নিষায়ুদ্দীন গিয়ে হযরত মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের সাথে মোলাকাত করুন এবং তার তাবলীগী মেহনত দেখুন। যদি এ কাজ

আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. - ১০৩

সম্পর্কে আপনারা নিশ্চিন্ত হন তবে এ কাজেই লেগে যান। হযরত আলী মিয়া রায়পুর থেকে দেওবন্দ হয়ে সোজা দিল্লী হাজির হন। সেখান থেকে মেওয়াতও সফর করেন।

এ সফর থেকে ফিরে এসে তিনি এক প্রবন্ধে লেখেন যে, এ সফরে সব চেয়ে আশ্চর্য যে, বিষয় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তা হল মেওয়াত এলাকায় হযরত মাওলান। ইলিয়াস সাহেবের তাবলীগী কাজের ব্যবস্থাপনা ' আমরা যা কিছু দেখেছি তা বিংশ শতাব্দীর কোন দৃশ্য নয় ; বরং তা প্রথম হিজরী শতাব্দীর দৃশ্যাবলী মনে হচ্ছিল। মহানবী (সা.)-এর যামানার মানুষের অবস্থা এবং তাদের ইসলাম গ্রহণের যে সকল জযবার কথা আমরা সীরাত গ্রন্থসমূহে পড়েছিলাম, মেওয়াতের গোড়গানোর জামে মসজিদ, কসবায়ে নূহ ও শাহপুরের গলিসমূহে তার একটি নমুনা আমরা দেখে এসেছি। বাস্তবতা এই যে, এই চিশতী দরবেশ ও মুজাদ্দেদ আলেম বস্তি নিষাযুদ্দীনে হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়ার মাযারের পাশে বসে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন আজমীরীর ইসলাম প্রচার এবং হযরত মুজাদ্দেদী সেরহিন্দী ও সাইয়েদ আহমাদ শহীদ বেরেলভীর ইসলামের হেফাযতের আদর্শ পুনরুজ্জীবিত করছেন।

১৯৪০ সালের জানুয়ারী মাসে তিনি যখন নিযামুদ্দীন হাজির হন তখন হযরত মাওলানা ইলিয়াস সাহেব (রহ.) সাহারানপুরে কোন এক তাবলীগী এজতেমায় গিয়েছিলেন। মারকাষ থেকে তাকে জানানো হয় যে, হযরতজী ১/২ দিন পর নেযামুদ্দিন ফিরে আসবেন। এ সময় নিযামুদ্দীনের কাজের দায়িত্বে ছিলেন মাওলানা এহতেশামুল হাসান কান্দলভী (রহ.)। তিনি এ সময়টা কাজে লাগানোর জন্য হযরত মাওলানাকে মেওয়াতের নৃহ এলাকার এক এজতেমায় পাঠিয়ে দেন। দিল্লী এসে হাজী আবৃদুল ওয়াহেদের সঙ্গে তার এক বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করতে বান। ঠিক এ মুহুর্তে নিযামুদ্দীনে হযরতজীর সাথে সাক্ষাৎ করার এক জযবা তাকে পাগল করে তোলে । তার অন্তরে এক ধরনের ঝড় বইতে থাকে।

তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন_ তখন আমার অবস্থা এমন হয়েছিল ঘে, মনে হচ্ছিল আমি দরজা খুলে নিষামুদ্দীনের দিকে দৌড় দিই । সেই সাথে দু'আ এবং আল্লাহপাকের সাথে সম্পর্কের এক ঢেউ আমার অন্তরকে ঘিরে ফেলেছিল, যা সাধারণত কোন বিশেষ সময়ে হয়ে থাকে। এরপর তিনি নিযামুদ্দীনে ফিরে আসেন। অল্পক্ষণ পর হযরতজী তাশরীফ নিয়ে আসেন

এবং হরযত আলী মিয়ার সাথে এমনভাবে মিলিত হন যেন বহু বছরের পরিচিত মানুষ, অথবা মনে হচ্ছিল তিনি আলী মিয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুণছিলেন। বিশেষ করে হযরতজী যখন বুঝতে পারলেন যে, আলী মিয়া সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদের লেখক এবং শহীদ বেরেলভীর সাথে তাঁর খান্দানী সম্পর্ক রয়েছে, তখন তিনি শফকত-মহবব্ত ও মেহমানদারিতে আরো এক ধাপ এগিয়ে যান। সর্বপ্রথম যে বিষয় মাওলানা আলী মিয়াকে আকর্ষণ করেছিল, তা হল হযরতজীর তার প্রতি বিশেষ স্নেহ ও মহব্রতের নজর এবং হষরতজীর অন্তরে বিশেষ অবস্থান। প্রথম সাক্ষাৎ হওয়া সত্বেও কোন অপরিচিত ভাব পরিলক্ষিত হয়নি।

দ্বিতীয় দিন সকালে মজলিসের অবস্থা এ একই ছিল। তৃতীয় দিন মাওলানা আলী মিয়া বখন বিদায় নিচ্ছিলেন তখন হযরতজী (রহ.) দীর্ঘক্ষণ তাঁর জন্য দু'আ করেন। যার প্রতিক্রিয়া হযরত আলী মিম্নীর উপর. পড়ে । ফলে তিনি অতিশীস্রই হযরতজীর খেদমতে ফিরে আসার নিয়ত করেন।

লাখনৌর আশেপাশে দাওয়াতী কাজের সুচনা[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা আলী মিয়া লাখনৌ এসেই মেওয়াতের নূহ এলাকায় যে ধরনের মেহনত দেখে এসেছিলেন এবং নিযায়ুদ্দীনে হযরতজীর সোহবতে যা কিছু বুঝে ছিলেন, সেই অনুযায়ী শহরের আশপাশে কাজ শুরু করেন। এ সময় পর্যন্ত শহরের সাথে হযরতের তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। শুধুমাত্র তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত কয়েকজন ছাত্রকে সাথে নিয়ে তিনি এ কাজ শুরু করেন। লাখনৌ শহরের গরীব মহন্লাগুলিতে যাতায়াত শুরু করেন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ছ্বীন-ঈমানের হারিয়ে যাওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন ; সাথে সাথে হযরতজীর নিকট পত্র দিয়ে অবস্থাদি জানাতে থাকেন।

১৯৪০ সালের মার্চ মাসে হযরতজীর প্রথম পত্র আসে। দ্বিতীয় পত্র আসে এপ্রিলে । এরপর চিঠিপত্র আসার ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে যায়। এ সকল চিঠিতে হযরতজী (রহ.) আলী মিয়ার কাজে খুশি প্রকাশ করেন এবং তাকে অনেক বড় মর্যাদায় ভূষিত করেন। তিনি চিঠিপত্রে তাকে এমনভাবে সম্বোধন করতেন ষা অন্যের জন্য ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াতো। ১৯৪০ ইং সালের মার্চ থেকে ১৯৪৪ ইং সালের মার্চ পর্যন্ত হযরত আলী মিয়ার কাছে ৩৪ খানা চিঠি আসে। এ সকল চিঠিসহ অন্যান্য পত্রাদি মাকাতিবে ইলিয়াস নামে প্রকাশিত হয়েছে। চিঠিগুলি খুবই গুরম্তুপূর্ণ বিষয়ের সমষ্টি। যার মধ্যে হযরতজী (রহ.)-এর উম্মতের জন্য পেরেশানী, ঈমানী শক্তি, ইসলামী জাগরণ, দ্বীনের চিন্তাভাবনা, তায়াম্গুক মাআল্লাহ ইত্যাদি বিষয়ের ঈমানদীর্ত নূরানী চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়।

হযরতজীর সঙ্গে সম্পর্কের কারণ[সম্পাদনা]

হযরতজীর সাথে আলী মিয়ার গভীর সম্পর্কের কারণ এই ছিল যে, তিনি ইতিপূর্বে মাকতুবাতে ইমামে রব্বানী, ইযালাতুল খেফা, সীরাতেমুস্তাকীম, মানসাবে ইমামত গ্রস্থাদি পড়েছিলেন। ফলে, ইতিহাস ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর মধ্যে আগ্রহ ও তা মোতালাআ সত্তেও এই যোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছিল যে, তিনি এই দুই দাওয়াতী প্রোথাম ও প্রচেষ্টার কর্মপদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য করতে শিখেছিলেন। কারণ একটির সম্পর্ক শুধু মেধা, মোতালাআ, কোন বিশেষ দর্শন, আন্দোলন ইত্যাদির সাথে। অপরপক্ষে দ্বিতীয় আন্দোলনের মূলপুঁজি হলো ইবাদাত, ইনাবাত, দু'আ, কুরআনের উপর গভীর চিন্তা- ফিকির, সীরাতে নববীর আশেকানা মোতালাআ এবং উম্মতের জন্য বিশেষ চিন্তাভাবনা । .

মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) দ্বীনের জন্য, উম্মতের জন্য সব সময় ব্যাকুল ও পেরেশান থাকতেন । অপরদিকে মাওলানা আলী মিয়ার উপর ছিল হযরতজীর বিশেষ মনোযোগ ও মহব্বত। ফলে অল্পদিনের মধ্যে তিনি হযরতজীর নয়নমণি হয়ে যান।

এসময় পর্যন্ত দ্বীনী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকগণ এ কাজের দিকে আকৃষ্ট হয়নি। হযরতজীর এ কাজের উপর তখনও অনেকের শরহে সদর হয়নি। এমুহূর্তে দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার মতো এঁতিহাসিক দরসগাহের একজন শিক্ষক ও ছাত্রদের এ কাজে অংশগ্রহণ করা এবং বার বার হযরতজীর খেদমতে হাজির হওয়া হযরতজীর নিকট খুবই গ্ররুতুপূর্ণ ছিল। এর ফলে এ প্রতিষ্ঠানের উপর তার নেকদৃষ্টি পতিত হয়েছিল। এ প্রতিষ্ঠান তার নেক দু'আয় ধন্য হয়। এর ফলে দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার শুধু ফায়েদাই হয়নি, বরং দারুল উলৃমের মধ্যে এক নতুন জাগরণের সৃষ্টি হয়, এক নতুন অধ্যায়ের সুত্রপাত হয়। মাওলানা আলী মিয়া তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “একবার আমি হযরতজীর কাছে আরজ করেছিলাম যে, আমরা নদওয়ার পক্ষ থেকে উলামা ও মাশায়েখের কাছে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলাম, কিন্তু উল্লেখযোগ্য সাড়া পাওয়া যায়নি। আপনিই সর্বপ্রথম আমাদের উপর শফকতের হাত রেখেছেন। হযরতজী এ কথা শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন এবং বলেছিলেন, আপনি এটা কি বলছেন! আপনিতো মাশাআল্লাহ দ্বীনদার পরিবারের মানুষ। আমিতো মনে করি আলীগড়ের লোকদেরকেও দূরে রাখা উচিত হবে না। প্রকৃতপক্ষে রাসূলের সত্যিকার নায়েব এবং হকের দায়ীদের মেজায যেমনটি হওয়া উচিত সে অনুযায়ী মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর মধ্যেও শোকর, স্বীকারোক্তি, শফকত ও মহববতের জযবা পরিপূর্ণ মাত্রায় ছিল?

তাবলীগী মেহনতের মাধ্যমে ছাত্রদের চরিত্রগঠন[সম্পাদনা]

দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে মাওলানা মুহাম্মাদ নাযেম সাহেব নদভী লাখনৌর এই তাবলীগী কাজে ধ্রাণখোলা সহযোগিতা করেছিলেন। হযরত আলী মিয়া বৃহস্পতিবার লাখনৌ থেকে ৮ মাইল দূরবর্তী মালহর এলাকায় ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে চলে যেতেন। জুমআর দিন জামআত তৈরী হত। তারা আশপাশের এলাকায় কাজ করতেন। এই মেহনতে দ্বীনী ও ইসলাহী ফায়েদা, নামাযের একাগ্রতায় উন্নতি, যিকির ও রাত্রি জাগরণের ফায়েদা ছাড়াও ছাত্রদের কুরআন-হাদীছের ভাষায় বুৎপত্তি লাভে অদম্য স্পৃহা সৃষ্টি হত।

এ ছাড়া সরলতা, মেহনত, ওস্তাদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিজের আত্মশুদ্ধির দুর্বলতার ইলম, সাধারণ মানুষের বেছ্বীনী হালাত প্রভৃতি বিষয়ে দায়িত্ববোধের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে এই মেহনতে জড়িয়ে হযরত মাওলানার সাথে কিছু ছাত্রের এমন গভীর সম্পর্কের সৃষ্টি হয় যে, তারা পরবর্তী সময়ে দারুল উলুমের উন্নতিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল । হযরতজী (রহ.) দ্বীনী মাদ্রাসার ছাত্রদের এ মেহনতের কথা শুনে খুবই খুবই খুশী প্রকাশ করতেন, দু'আ দিতেন এবং চিঠি পত্রের মাধ্যমে হযরত আলী মিয়াকে মোবারক বাদ দিতেন ও সাহস জোগাতেন।

সন্তাহে বা মাসে নওজোয়ান ছাত্ররা যখন জামাতে বের হত তখন তারা বিভিন্ন ধরণের গল্প গুজবের সুযোগ ৫পত। অথচ একাজের একাজের একটি বিশেষ আদব ছিল বেহুদা বিষয় থেকে বেঁচে থাকা । তাই হযরত আলী মিয়া ছাত্রদেরকে জামাতে বের হওয়ার সময় শুধু মাত্র আরবীতে কথা বলার হুকুম দিতেন। এর দ্বারা দু টো ফায়দা হত। কম কথা বলা এবং কুরআন হাদীসৈর ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করা।

এক চিঠিতে হযরতজীকে এ ব্যাপারে জানান হলে হযরতজী রহ.) মাওলানা আলী মিয়াকে এক চিঠিতে লিখেন যে, “আরবী ভাষার সুন্নাতকে জিন্দা করার খবরে খুশী হয়েছি। অন্যান্য মাদরাসাকেও এ মেহনতের দিকে আকৃষ্ট করার কাজে আপনাকে আল্লাহ পাক মাধ্যম বানান, এই দু'আ করি।” হযরতজী সব সময় মাওলানা আলী মিয়া ও তীর চিঠির অপেক্ষায় থাকতেন এবং তার খেদমতে হাজির হলে তিনি খুবই খুশী হতেন। এক চিঠিতে তিনি ইরশাদ করেন, আপনার আগমনের সংবাদে অন্তর ভরে যায়। হুক তা'আলা আমাদেরকে আপনার ব্যক্তিত্ব থেকে ফায়েদা নেয়ার তাওফীক দান করুন। অন্য চিঠিতে লেখেন যে, আপনার পত্রাবলী আমাদের হৃদয়ের তালা খোলার চাবিস্বরূপ।

হযরত আলী মিয়ার অবস্থাও ছিল এই যে, তিনি এক-দুই মাস পর পর হযরতজীর খেদমতে হাজিরা দেয়ার চেষ্টা করতেন এবং মেওয়াতের বিভিন্ন এজতেমায় শরিক হতেন। এসব সফরে অধিকাংশ সময় মাওলানা হাফেয ইমরান খান সাহেব নদভী (মুহতামিম দারুল উলুম) শরীক থাকতেন। ফলে জনাব খান সাহেব হযরতজীর নেক নজরে গড়েন এবং পরবর্তী সময়ে ভূপালে এই মেহনতের সুচনা তার দ্বারাই সম্ভব হয়।

লাখনৌ শহরে তাবলীগের কাজ ও হযরতজীর আগমন[সম্পাদনা]

কিছুকাল পর্যন্ত এই দাওয়াতের মেহনত নদওয়ার উলামা, তালাবা ও শহরের আশপাশের এলাকায় জীমাবদ্ধ থাকার পর হযরত আলী মিয়া এই শহরের ধর্মপ্রাণ লোকদের মধ্যে এই কাজের পরিচয় করান। ফলে লাখনৌ থেকে বড় বড় জামাআত নিবামুদ্দীন ও মেওয়াত যাওয়া ওরু করে এবং এই কাজে অংশগ্রহণকারীদের জীবনে অভাবনীয় পরিবর্তন ও উন্নতি পরিলক্ষিত হতে থাকে । এমনকি লাখনৌ শহরের অবস্থা এতই উন্নত হয়ে যায় যে, হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর পদধূলিতে ধন হওয়ার উপযুক্ত হয়ে যায়। সেমতে ১৯৪৩ সালে জুলাই মাসে তিনি লাখনৌ আসার দাওয়াত কবুল করেন। ১৮ই জুলাই তিনি জনাব হাফেয ফখরগন্দীন সাহেব, মাওলানা এহতেশামুল হাসান কান্দলভী, মুহাম্মাদ শফী সাহেব কুরায়শী ও হাজী নাসীম সাহেবসহ লাখনৌ তাশরীফ নিয়ে আসেন। নদওয়ার অদূরে মতিমহলের পুলের পূর্বে এক সবুজ ময়দানে হযরতজী ও তাঁর সাথীরা নফল নামায পড়ে দীর্ঘক্ষণ দু'আয় মশগুল হন। হযরত আল্লামা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী একদিন পূর্বেই এসে ছিলেন এবং ৮/৯ দিন হযরতজীর সাথে ছিলেন। দ্বিতীয় দিন হযরত শায়খুল হাদীছ সাহেব এবং মাদরাসা মাজাহিরে উলুমের শিক্ষক হযরত মাওলানা আবৃদুল হক মাদানী ও হযরত মাওলানা মনযুর নোমানী তাশ্রীফ নিয়ে আসেন। আফসোসের বিষয় এই যে, এ সময় (১৯৪৩ সালে) ছাত্রদের এক স্ট্রাইকের কারণে দারুল উলৃম নদওয়াতুল উলামা বন্ধ ছিল এবং পরিবেশ ছিল ভিন্নরূপ। ফলে ছাত্র বেশ কম ছিল। কিন্তু হযরতজীর আসার কারণে দারুল উলৃমের নতুন যাত্রা শুরু হয় এবং নূরানী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দারুল উলৃমের যিম্মাদার ব্যক্তিদের সাথে বিশেষ করে নাযেমে নদওয়াতুল উলামা, মাওলানা আলী মিয়ার বড় ভাই ডাক্তার সাইয়েদ আবৃদুল আলী সাহেব এবং মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী (রহ.)-এর সাথে হযরতজীর গভীর সম্পর্ক কায়েম হয় । মাওলানা আলী মিয়া বলেন, একদিন হযরতজী আমাকে বললেন, আমাকে এমন স্থানে নিয়ে চলো যেখান থেকে পুরো দারুল উলৃম দেখা যায়। তখন আমি তাকে মাদরাসার ছাদের উপর নিয়ে গেলাম যেখান থেকে পার্শ্ববর্তী নদীর দৃশ্য এবং দারুল উলুমের মসজিদ, শিবলী দারুল ইকামাহ ও অন্যান্য বিজ্ডিং নজরে আসে ।

এ সময় হযরতজী ও আলী মিরী ব্যতীত আর কেউ সেখানে ছিলেন না। হঠাৎ হযরতজী তীকে বললেন, আমি দারুল উল্মের কিছু খেদমত করতে চাই, বলুন কি খেদমত করতে পারি? মাওলানা আলী মিয়ী তখন হ্যরতজীকে বলেছিলেন, শুধু এতটুকু চাই যে, আপনি মাদরাসা মাজাহিরে উলৃম যেভাবে দেখাশুনা করেন নদওয়াকেও সেই একই নজরে দেখবেন। হযরতজী নদওয়ার জন্য দু'আ করেন এবং নীচে নেমে আসেন।

রায়বেরেলী আগমন[সম্পাদনা]

লাখনৌ আগমনের শেষ দিন রাতের গাড়িতে হযরতজী (রহ.) হযরত শায়খুল হাদীছ, হাফেষ ফখরুদ্দীন সাহেব এবং আরো কিছু সাথী শুভাকাজক্কীসহ রায়বেরেলী তাশরীফ নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছে দায়েরায়ে শাহ আলামুন্লায় রাতের বাকী অংশ এবং পরবর্তী আধাদিন অতিবাহিত করেন। হযরত সাইয়েদ আহমাদ শহীদ বেরেলভী (রহ.)-এর মস্জিদে হাজির হয়ে তিনি খুবই খুশী হন এবং তেলাওয়াতে মশগুল হয়ে যান। হযরত শায়খুল হাদীছের দিকে ফিরে এই বস্তির প্রতিষ্ঠাতা এবং এই খান্দানের বড় বুযুর্গ হযরত শাহ আলামুল্লাহ সম্পর্কে উচু মন্তব্য করেন এবং নিজের প্রতিক্রিয়ার কথা জানান। দুপুরের গাড়ীতেই তিনি লাখনৌ হয়ে কানপুরের পথে দিল্লী ফিরে যান।

হ্যরতজীর মুখপাত্র রূপে[সম্পাদনা]

হযরতজী (রহ.) মাওলানা আলী মিয়াকে তাঁর তরজুমান বা মুখপাত্র করেছিলেন। লাখনৌতে এক বিশেষ মজলিসে হ্যরতজীর তাকরীর হয়। সেখানে শহরের উচ্চ শিক্ষিত লোকজন এবং কয়েকজন উকিল উপস্থিত ছিলেন। এ সময় হযরত আলী মিয়া বুঝতে পারছিলেন যে, মেহমানরা হযরতজীর কথা ভাল করে বুঝতে পারছেন না; তাই তিনি দীড়িয়ে যান এবং হযরতজীর কথার সারাংশ ভালো করে বুঝিয়ে দেন। এতে হযরতজী ও উপস্থিত ব্যক্তিগণ খুবই খুশী হন। হযরতজী এই বয়ান ছাপিয়ে প্রকাশ করারও আগ্রহ প্রকাশ করেন।

একবার হযরত আলী মিয়ী রাতে সফর করে ভোরের দিকে নিযামুদ্দীন পৌছেন। হযরতজী মাওলানাকে ফজরের নামায পড়াবার হুকুম করেন। সালাম ফিরাবার সাথে সাথে বয়ান করার হুকুম দেন। এ সময় মজলিসে ডাঃ যাকির হোসাইন খান, কুরাইশী সাহেব, মালিক দ্বীন মুহাম্মাদ (বড় ব্যবসায়ী) উপস্থিত ছিলেন। মাওলানা আলী মিয়া বললেন, হযরত আমার মাথায় কিছুই নেই, আমি কি বয়ান করব? হযরতজী বলেছিলেন, শুরুতো করুন। তারপর তিনি বয়ান করেন এবং হযরতজী আলী মিয়ার বয়ানের দিকে মুতাওয়াজ্জোহ হয়ে বসে থাকেন।

হযরত আলী মিয়া হযরতজীর সোহবত, তাঁর চিঠি ও ইরশাদাতসমূহের জালোকে এই দাওয়াতী মেহনতের উপর 'এক আহাম হ্বীনী দাওয়াত' নামে একখানি ছোট পুস্তিকা রচনা করেন। হযরতজী রেসালাখানা শব্দে শব্দে শোনেন। তিনি দু' একটি শব্দের সামান্য পরিবর্তন করেন এবং খুব দু'আ করেন। এ জন্যই হযরতজী (রহ.) আলী মিয়াকে সবসময় কাছে কাছে রাখতেন। একবার যিম্মাদাররা হযরত আলী মিয়াকে নিযামুদ্দীনের আশপাশে কোথাও গাশতে পাঠিয়ে দেন। হযরতজী এ খবর পেয়ে বলে উঠেছিলেন, এক ব্যক্তিই আমার কথাবার্তা কিছু বুঝে, তোমরা তাকেও বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছো, এখন আমি কার সাথে কথা বলব? ভাবলীগে আত্মনিয়োগ এবং দারুল উলূম থেকে দীর্ঘ ছুটি গ্রহণ

দাওয়াতী প্রোথাম ও বারবার নিযায়ুদ্দীন যাতায়াতের ফলে দারুল উল্মের অধ্যাপনার কাজে বেশ অসুবিধা দেখা দিতে লাগল। তাছাড়া

মাদরাসার চার দেয়ালের মধ্যে ধরাবীধা নিয়মের গণ্তীতে নিজেকে সম্পূর্ণ আবদ্ধ রাখার মনোবৃত্তিও তার শেষ হয়ে আসছিল । তাই মাওলানা অলী মিয়ী ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাদরাসার চাকুরী ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তার রূহানী মুরববী হযরত মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন উপলব্ধি করে তিনি নিষামুদ্দীন হাজির হন এবং হযরতজীর নিকট স্বাধীনভাবে দ্বীনের খেদমত করার বিষয়ে পরামর্শ চান। একই সাথে নিজের মনোভাবের কথা জানান। হযরতজী ইরশাদ করেছিলেন, আমাদের বুযু্ণরা পূর্বের চাকুরীর চেয়ে ভালো চাকুরী না পাওয়া পর্যন্ত চাকুরী ছাড়ার অনুমতি দেন না। দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে হযরতজী একই জবাব দিতে থাকেন। সম্ভবত তিনি আলী মিয়ার উদ্দেশ্যকে পরীক্ষা করছিলেন যে, এ ব্যাপারে তিনি দৃট়পদ কি-না।

ফজরের নামাযান্তে বয়ানের পর হযরতজী মাওলানাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি নদওয়া থেকে কত টাকা পান? মাওলানা জবাবে বলেছিলেন, মাসিক পঞ্চাশ টাকা পাই। এ কথা শুনে হযরতজী বড় দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, এ রকম হাজার পঞ্চাশ টাকা আপনার গোলামদের পায়ের উপর কুরবানী হবে। এই কথা বলে তিনি অনুমতি দিয়ে দেন। অবশ্য পরে তিনি ১৯৪৩ ইং সালের ১ লা ডিসেম্বর থেকে পুনরায় দারুল উলুমে ছবক পড়ানো শুরু করেন। ১৯৪৫ সালের ৫ই নভেম্বর থেকে স্থায়ীভাবে দারুল উলৃমের চাকুরী ছেড়ে দেন এবং দাওয়াতী মেহনতের সাথে বিভিন্ন সামাজিক ও অন্যান্য কাজ করতে থাকেন।

হ্যরতজীর ইন্তেকালের দিন[সম্পাদনা]

হ্যরতজীর (রহ.) হুকুমে মাওলানা আলী মিয়া করাচী ও হায়দ্রাবাদের সফর থেকে ফিরে দিল্লী উপস্থিত হন। কিন্তু দওয়া থেকে প্রায় দেড় মাস অনুপস্থিত থাকার কারণে তিনি সোজা লাখনৌ চলে আসেন। এ দিকে হযরতজী (রহ.) এঁ সময় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল । সম্ভবত তিনি ১৯৪৪ ইং সনের জুনের প্রথম দিকে দীর্ঘ অবস্থানের নিয়তে হযরতজীর খেদমতে হাজির হন। এ সময় হযরত মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানীও নিযামুদ্দীনে অবস্থান করছিলেন। ২১ শে" জুন শায়খুল হাদীছ হযরত মাওলানা যাকারিয়া সাহেব তাশরীফ নিয়ে আসেন। এ মাসেই মেওয়াতের নূহে 'মুয়িনূল ইসলাম মাদরাসার' জলসায় আলী মিয়া শরীক হন। হযরতজী কয়েকবার আলী মিয়াকে ডেকে বলেন যে, আমার জীবনের আর কোন আশা নেই। একদিন বাদ মাগরিব আলী মিয়ার ডাক পড়ে। অত্যন্ত শ্নেহ ও মমতার সাথে মাথায় হাত রাখেন এবং চুলের

আল্লামা সাইয়েদ আবুঙ্গ হাসান আলী দৃর্ভী রহ. - ১১১

মধ্যে হাত ঘোরাতে থাকেন। তারপর এঁ দুর্বল অবস্থায় উঠে বসে হযরত আলী মিয়ার কপালে চুমু দেন এবং বলেন, তুষি ক্লান্ত হয়ে পড়েছো, তোমার সাহায্যকারী কেউই নেই। এভাবে তাকে সান্তনা দেন।

একদিন হঠাৎ আলী মিয়াকে ডেকে হ্যরতজী বলেন, আপনার কান আমার ঠোটের কাছে নিয়ে আসুন। এরপর বলেন যে, মানুষদেরকে যিকিরের তাকীদ করুন এবং মাওলান! আবৃদুল কাদের রায়পুরী (রহ.)-এর মজলিসে বসার জন্য বলুন। এটা ১৯৪৪ সালের ৮ই জুলাইর ঘটনা। ১২ ও ১৩ই জুলাই-এর মাঝ রাতে হ্যরতজীর জীবনের শেব সময় এসে যায় এবং ফজরের আধানের পূর্বেই হযরতজী ইন্তেকাল করেন। জীবনের ক্লান্ত মুজাহিদ সম্ভবত আরামের ঘুম কোন সময় ঘুমাতে পারেননি । তাই নিজের মনযিলে মাকছুদে গিয়ে প্রশান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। হযরত আলী মিয়ার উপর এই ঘটনার দারুন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কাফন-দাফনের পর তিনি নিজেকে সামলাতে না পেরে বাদশাহ হুমায়ূনের মাকবারার দিকে চলে যান এবং সেখান থেকে ইশার পর ফিরে আসেন। .

হযরতজী (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আলী মিয়াসহ অন্যান্য আকাবিরের সামনেই সাহেবজাদা হযরত মাওলানা ইউসুফ সাহেবকে জামাআতের আমীর বানানো হয়। হযরত আলী মিষ্ দ্বিতীয় হযরতজীর পরামর্শ অনুযায়ী দাওয়াতের কাজে ব্যস্ত থাকেন এবং নিযামুদ্দীনের সাথে তার এই সম্পর্ক বরাবর কায়েম থাকে।

লাখনৌর দ্বীনী পরিসরে তাবলীগের মাকবুলিয়াত[সম্পাদনা]

১৯৪৪ থেকে ৫২-৫৩ পর্যন্ত লাখনৌর সাধারণ শিক্ষিত শ্রেণী, আইনজীবী শ্রেণী, পেশাদার গোষ্ঠী, আলেম সম্প্রদায় ও ইউনিভার্সিটির শিক্ষিত শ্রেণীর দৃষ্টি এ কাজের দিকে দ্রন্ত গতিতে বাড়ছিল। তখন লাখনৌ থেকে বিহারের পূর্বসীমান্ত কাটিহার ও পূর্ণিয়া জেলা পর্যন্ত এবং পাঞ্জাব ও কাশ্মীর পর্যন্ত হযরত মাওলানা মনযুর নোমানী (রহ.)-এর সাথে হযরত আলী মিয়া বু দাওয়াতী সফর করেন।

এসব সফরের মধ্যে ১৯৪৫ সালের সীমান্ত প্রদেশ সফর, '৪৬ সালের হাজারা জেলার মারি সফর, পুনছ ও কাশ্ীরের সফর এবং সুবাদাবাদের সফর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ১৯৪৫ সালের জানুয়ারী মাসে মেওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ জলসায় যোগদান ছিল তার দাওয়াতী সফরের বিশেষ অংশ। এ ছাড়া ভূপাল, লাখনৌ, কানপুর বসতি, সিতাপুর প্রভৃতি তাবলীগী এজতেমায়

হযরত আলী মিয়া শরীক থাকেন এবং বয়ানও করেন। ১৯৪৬ সালের - ফেব্রুয়ারী মাসে হযরতজী মাওলানা ইউসুফ সাহেব এক বড় জামাআতসহ উপস্থিত হন। একদিন পূর্বে হযরত মাওলানা আবৃদুল কাদের রায়পুরী 'ও " শায়খুল হাদীছ হযরত মাওলানা যাকারিয়া সাহেব লাখনৌ তাশরীফ এনেছিলেন। পরদিন এসব মেহমান একটি বাসে করে রায়বেরেলী পৌছেন। এছাড়া হযরত মাওলানা মনযুর নোমানী, মাওলানা আবৃদুল বারী নদভী, সুহাম্মাদ শফী সাহেব কুরায়শীও উপস্থিত ছিলেন। একদিন একরাত মেহমানগণ উপস্থিত ছিলেন। তখন বৃহস্পতিবারের এজতেমা নদওয়ার মসজিদে হত। বাদ মাগরিব বেশির ভাগ বয়ান মাওলানা মনযুর নোমানী ও মাওলানা আলী মিয়া করতেন। সীরাতের কোন একখানি কিতাবের দরসও হত। তাছাড়া জামাআতের তাশকীল ও অন্যান্য প্রোথ্াম চলতো । শেষ রাত্রে - মসজিদে নফল নামা ও মিকিরের ফলে এক আশ্চর্য রকমের নূরানী অবস্থা সৃষ্টি হত।

১৯৫১ সালে তিনি দীর্ঘ এক বছর ভারতের বাইরে মধ্যপ্াচে দাওয়াতের কাজ করে লাখনৌ ফিরে এসে জামাআতের অবস্থা আরো সুসংহত পেয়ে খুশী হন। তখন জামাআতের ভাইদের মধ্যে স্বার্থত্যাগ, নম্রতা ও এবে অপরের খেদমত করার জযবা সৃষ্টি হচ্ছিল। শহরের সকল শ্রেণীর লোকজন এই মেহনতের সাথে যুক্ত হচ্ছিল। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকগণও এতে অংশ গ্রহণ করতেন। ফজরের পর তরবিয়ত্তী তাকরীর হত। এই তাকরীর সাধারণতঃ আলী মিয়াই করতেন। যেসকল ছাত্র বছরের পর বছর এসব সাপ্তাহিক এজতেমায় শরীক হতো তারা ফারেগ হওয়ার পর নিজের এলাকায় এবং বিদেশী ছেলেরা দেশে গিয়ে দাওয়াতী কাজ শুরু করতো । তারাও নদওয়ার ছাত্র জীবনের এই মেহনতের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে চিঠিপত্র দিত। ১৯৪৫ সাল থেকে এই এজতেমা কাছারী রোডের বর্তমান মারকাযে স্থানাত্তরিত হয়।

হিজাযে দাওয়াতী কাজের জন্য আলী মিয়ীর নির্বাচন[সম্পাদনা]

সৌদী আরবে হযরতজী (রহ.)-এর দাওয়াতী কাজের পরিচয় তার ১৯৩৮ সালের সৌদী সফরের সময় হয়ে গিয়েছিল। তার অন্তরের একান্ত কামনা ছিল যে, ভারতে কাজ কিছু এগিয়ে চললে সৌদী আরবে গিয়ে এই কাজের বুনিয়াদ পত্তন করবেন। হযরতজী (রহ.)-এর মত তাঁর সাহেবজাদা

মাওলানা ইউসুফ সাহেবের মধ্যেও এ জবা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। তিনি ১৯৪৬ সালেই জামাআতের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সৌদী আরব পাঠিয়ে দেন, যাদের মধ্যে হযরত মাওলানা উবায়দুল্লাহ সাহেব বলিয়াভী উল্লেখযোগ্য ছিলেন। তিনি বড় হযরতজীর বিশেষ তরবিয়ত পেয়েছিলেন। হযরত মাওলানা উবায়দুল্রাহ সাহেব অনেক ধৈর্যের সাথে দাওয়াতের কাজ করে এক বছরের মধ্যে শুধুমাত্র মুহাজির ও প্রবাসী লোকদের মধ্যে এবং ভারতীয় হাজীদের মধ্যে এ কাজের পরিচয় করাতে সক্ষম হন। কিন্তু সৌদী আরবের আলেম-উলামা ও শিক্ষিত শ্রেণীর কাছে এ দাওয়াত পেশ করার জন্য আরবী ভাষায় দক্ষ ও দাওয়াতী কাজের সাথে মনে-প্রাণে সম্পৃক্ত, খালেছ দায়ী আলেমের প্রয়োজন ছিল। কেননা প্রত্যেক কাজের একটা ভিন্ন ধারা রয়েছে।

উচ্চ শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে ও ইলমী হালকায় কাজ করার জন্য সেই ধারারই লোকের প্রয়োজন ছিল। হযরত মাওলানা উবায়দুল্লাহ সাহেব এ ব্যাপারটি বুঝতে পেরে মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহ.)-এর নিকট বার বার চিঠি লিখে জানাতে থাকেন যে, এখানে এমন কোন ব্যক্তিত্বকে পাঠান যিনি শিক্ষিত মহলে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দীওয়াতের পরিচয় করাতে পারেন এবং যার প্রতিক্রিয়া এখানকার শিক্ষিত যুবক, আহলে ইলম তথা সমগ্র শ্রেণীর উপর পড়ে। এ কাজের জন্য স্বয়ং মাওলানা উবায়দুল্লাহ সাহেব সম্ভবত নিযামুদ্দীনে মাওলানা আলী মিরার নাম প্রস্তাব করেছিলেন। কেননা তিনি আলী মিয়ার আরবী সাহিত্যে বৃৎ্পত্তি সম্পর্কে পূর্বেই অবগত ছিলেন। ফলে হযরত মাওলানাকেই এ কাজের সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করে হযরত শায়খুল হাদীছ সাহেবের পরামর্শে ছয় মাসের জন্য সৌদী আরবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

হযরত আলী মিয়া তাঁর আম্মা, স্ত্রী, এক বোন .ও ভাগ্পে মাওলানা মুহাম্মাদ সানী হাসানীকে নিয়ে ১৯৪৭ সালের ৯ জুলাই করাটী থেকে জাহাজে রওয়ানা হয়ে ১৯শে জুলাই (২৯শে শাবান) জেন্দা পৌঁছেন। হজ্জের বেশ দেরী থাকায় তিনি প্রথম মদীনা শরীফে উপস্থিত হন। মাওলানা মুহাম্মাদ সানি সাহেব সাথে থাকার কারণে তিনি সকল সাংসারিক ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে পুরো সময় দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে ব্যয় করতে থাকেন।

কোন দায়ী ঘিনি নতুন কোন দেশে দাওয়াতের কাজ শুরু করবেন, তার জন্য দু'টি বিষয়ের একটি অত্যন্ত জরুরী । প্রথমত খান্দানী পরিচিতি, দ্বিতীয়ত ব্যক্তিত্ব । এদু'য়ের একটি হলেও তার কথা শোনা হয়। প্রথম বিষয়

তো ভারতে আলী মিয়ার জন্য সহজ ছিল । বিরাট খান্দানী পরিচিতি বিদ্যমান ছিল। কিন্তু সৌদী আরবে তিনি নতুন ছিলেন, তখনও পর্যন্ত তার কোন পরিচিতি গড়ে ওঠেনি। এজন্য এ সফরের পূর্বেই হযরত আলী মিয়া তার লিখিত এবং দিশ্লীতে এশিয়ান কন্ফারেন্সে পঠিত একখানি আরবী পুস্তিকা (0০৬ ১১৩ ৮৬৫ 4) সাথে নিয়েছিলেন। পুস্তিকাখানির সাহিত্যমান খুবই উন্নত ছিল এবং দাওয়াতের তরীকাও ছিল উন্নত মানের। সৌদী আরবে তখনও পর্যন্ত দাওয়াতী ও ইসলাহী রসে আরবী পত্রপত্রিকা কমই পাওয়া যেত। মিসর থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাতেও ছিল শুধু সাহিত্য ও আধুনিকতা । আরবরা তখন তাদের নিজস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে ব্যস্ত । তিনি যে সমাজের মধ্যে দ্বীনী দাওয়াতের কাজ চালাবেন, সে সমাজের সামনে তার ইমেজ যথার্থভাবেই গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং বড় বড় জ্ঞানী ও শিক্ষিত মানুষের সাথে ওঠাবসা করার সুযোগ পেয়েছিলেন । তাঁর আরবী ভাবা ও সাহিত্যের পাভ্ভিত্যের মাধ্যমে আরবের সে সময়ের সূধী সমাজে এই নবাগত ভারতীয় ইসলাম প্রচারক এবং আরবী সাহিত্যিক সবার নিকট সমভাবে সমাদৃত হয়েছিলেন। ফলে উচু শ্রেণীতেও দাওয়াতের কাজ করা তার জন্য খুবই সহজ হয়ে পড়ে। ূ

হযরত মাওলানা ৩রা রমযান থেকে ২০শে জিলকৃদ প্রায় ৩ মাস মদীনা - শরীফে ছিলেন। মসজিদে নববীতে তারাবীহ নামাযের পর উলামা সমাবেশে, জুমআর নামাযের পর “মাদরাসা শরীয়াহ'-এর একটি হলে এবং শহরের বিভিন্ন এলাকার সমাবেশে বক্তব্য পেশ করেন। তাছাড়া গাশ্ত বা ঘুনে-ফিরে স্বীনী কাজের জন্য সদস্য সংগ্রহসহ তাবলীগের সমস্ত কর্মসূচীকে দ্রুত এগিয়ে নিতে সক্ষম হন।

জিলকদের শেষের দিকে তিনি মা শরীফে উপস্থিত হন। সেখানকার বড় বড় আলেমের সাথে হযরতের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। যাদের মধ্যে আল্লামা শায়খ ইবনে আরাবী, শায়খ মাহমুদ শাওবিল এবং শায়খ আবদুর রাজ্জাক হামযা বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। সে সময় আরবের যুব সম্প্রদায়, সাহিত্যিক, লেখক ও সাংবাদিকরা আলেমদের গন্ডি থেকে দূরে থাকতো এবং সঠিক দ্বীনী আন্দোলন সম্পর্কে তারা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতো ।

মন্ধা শরীফে দীর্ঘ অবস্থানের একটা বড় ফায়েদা ছিল শায়খ উমর ইবনুল হাসান আল শায়খ এর সাথে মাওলানা আলী মিয়ার পরিচয়। এই পরিচয় দাওয়াতের কাজে ও জামাআতের পক্ষে খুবই সহায়ক হয়েছিল৷ তিনি শায়খ মুহাম্মাদ আবৃদুল ওহাব (রহ.)-এর বংশধর ছিলেন। সৌদী সরকারের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় কাধীউল কুযাত ও শায়খুল ইসলাম শায়খ আবদুল্লাহ বিন হাসানের আপন ভাই রিয়াদের “হাইয়াতে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনিল -মুনকার”-এর প্রধান" ছিলেন। আল্লাহু পাকের মেহেরবানীতে তার সাথে হযরত আলী মিয়ীর গভীর সম্পর্ক হয়ে যায়। তিনি আলী মিয়ার আরবী পুস্তিকা মনোযোগ সহকারে পড়েন। তাঁর সাথে এ সম্পর্ক এসব লোকের ষড়যন্ত্র ধুলিস্যাৎ করে দিত যারা এই দাওয়াতী কাজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকমের কুৎসা রটাবার প্রয়াস পেত। শায়খ নিজেই ভাদের বিরুদ্ধে লড়তেন। শায়খ উমর এ কাজের ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিন্ত হয়ে যান যে, তিনি নিজেই জামাআতের সাহায্য করতেন। তার এই সাহায্য তার ইন্তেকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

সৌদী আরবে অবস্থান কালেই হযরত মাওলানা উপলব্ধি করেছিলেন যে, আরবদের অবস্থা খুবই করুণ। তারা তাদের আসল অবস্থান থেকে দ্রুত গতিতে পাশ্চাত্যের দিকে ছুটে চলেছে। তিনি ব্যথিত চিত্তে ধ্বংসের হাত থেকে তাদের বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন সমাবেশে দাওয়াতী কার্যক্রম জোরদার করেন এবং এ বিষয়ে তীর স্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরেন। তার এ আবেগপূর্ণ আবেদন আরবের শিক্ষিত ও সুধী সমাজের মনোজগতে এক বিরাট বিপ্লুব এনে দেয়। তারা সম্িত ফিরে পায় এবং নিজেদের ভুল বুঝতে পারে।

হযরত আলী মিয়া এ ব্যাপারে এতটাই পেরেশান হয়ে পড়েন যে, হকের আওয়াজকে কি করে সৌদির আমীর-উমারাদের কাছে পৌঁছাবেন তার উপায় সন্ধান করতে থাকেন। তীর সফর শেষ পর্যায়ে এসে গিয়েছিল । তিনি অনেক চিন্তা-ভাবনার পর সৌদী বাদশাহর নিকট অত্যন্ত আবেগের সাথে একখানি পত্র লেখেন। উক্ত পাত্রে তিনি আরবদের তৎকালীন অবস্থার কথা উল্লেখ করে আর কিভাবে এই কওমকে ইসলামের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা যায় তার বিস্তারিত আলোচনা করেন। পত্রে তিনি হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের রাজত্বকালের খায়ের-বরকতের কথা উল্লেখ করেন। সবেপিরি সারা দুনিয়ার মুসলমান সৌদী আরবের কাছে কি চায়, কি আশা করে ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। তিনি বাদশাহদের দায়-দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেন। এ চিঠি তিনি মাওলানা উবায়দুল্লাহ সাহেবের মাধ্যমে শায়খ উমর বিন হাসানের কাছে পৌঁছে দেন। শায়খ উমর এই চিঠি সৌদী বাদশাহকে পড়ে শোনান ।

আরব বিশ্বে দীর্ঘ দাওয়াতী সফর[সম্পাদনা]

এ সফর শুরু হয় ১৯৫০ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বরে হযরত রায়পুরীর সঙ্গে হজ্জের সফরের সময়। হজ্জের সফর শেষ হলে হযরত রায়পুরীকে বিদায় দিয়ে তিনি তাঁর কয়েকজন সাথী নিয়ে মক্কা মোকাররমায় অবস্থান করতে থাকেন এবং দাওয়াতী প্রোগ্রাম চালাতে থাকেন।

সে সময় তিনি দাওয়াতী কাজ নিয়ে আরব বিশ্বের প্রাচীন কেন্দ্রীয় মারকায মিসর সফর করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি সকল রকমের প্রস্ততি নিয়ে ১৯৫১ সালের ২০ জানুয়ারী ইসলাহী ও দাওয়াতী ছোট কাফেলা নিয়ে জেদ্দা থেকে ইটালীর ওনভা জাহাজে সুয়েজ অভিমুখে রওয়ানা হন এবং মিসর উপস্থিত হন। মিসরে তিনি প্রায় ছয়মাসব্যাপী তাঁর দাওয়াতী মিশনকে খুব কাজে লাগিয়ে তৎকালীন মিসরের সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এক নতুন জীবনের প্রেরণা জাগাতে সক্ষম হন। মিসরের পর তিনি সুদান ও দামেশূক সফর করেন। এ সকল স্থানে তিনি তার খোদাপ্দত্ত যোগ্যতা দিয়ে আহলে আরবদের আধুনিক শিক্ষিত, ছাত্র, শিক্ষক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের মাঝে ব্যাপক ধর্মীয় আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এ সফরেও মাওলানা মুয়িনুল্লাহ নদভী ও মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে সাহেব এবং মাওলানা - উবায়দুল্লাহ্‌ বলিয়াভী তার সাথে ছিলেন। মোটকথা তিনি সমাজের উচু শ্রেণীর মধ্যে দাওয়াতী ও ইসলাহী মিশনের আকর্ষণ সৃষ্টি করতে সমর্থ হন।

১৯৫১ সালের আগস্ট মাসে তিনি দামেশ্ক পৌঁছেন। সেখান থেকে মদীনা ও মন্কায় আসেন এবং পাঁচমাস অবস্থান করেন। অবশেষে এ দীর্ঘ এক বছরের সফর শেষ করে ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে ভারতে ফিরে আসেন।

ধর্মীয় সংগঠন[সম্পাদনা]

[সম্পাদনা]

মুফাক্কিরে ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী ( রহ . ) ছিলেন মুসলিম উম্মার একজন সত্যিকারের অভিভাবক । তাঁর সাধনা ও আত্মত্যাগ এ উম্মাহকে দিয়েছে নবজাগরণের এক অমিয় সূধা । তিনি ছিলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী । জীবনে তিনি বহু কাজ করেছেন । বহু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের তিনি সভাপতি বা রােকন ছিলেন । তিনি জড়িত ছিলেন এমন কয়েকটি দ্বীনী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত আলােচনা করা হল । এখানে প্রতিষ্ঠানের বিশদ আলােচনা করা মুখ্য উদ্দেশ্য নয় , বরং হযরত মাওলানার সাথে এসকল প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক কেমন ছিল এবং তিনি এ সকল প্রতিষ্ঠানের কি ধরনের সহযােগিতা করেছিলেন তারই সংক্ষিপ্ত আলােচনা করা হয়েছে । দ্বীনী মাদরাসা হযরত মাওলানা আলী মিয়া নদভী দ্বীনী মাদরাসাসমূহকে নিজের আশা আকার কেন্দ্র মনে করতেন । তাঁর দৃষ্টিতে মাদরাসা ছিল মুসলমানদের টিকে থাকবার প্রধান অবলম্বন ও ইসলামের দূর্গ । দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা , দারুল উলুম দেওবন্দ , জামেয়া মিল্লিয়া ও মাদরাসা মাজাহিরে উলুম সাহারানপুরসহ বিভিন্ন মাদরাসার ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা করার সময় তিনি অন্তরের যে গভীরতা দিয়ে মাদরাসার বড়ত্ব প্রকাশ এবং মাদরাসা ফারেগ ছাত্রদের যেভাবে উৎসাহিত করতেন তাতে বুঝা যায় যে , তার নিকট মাদরাসার গুরুত্ব কত ছিল । মাদরাসা বলতে তিনি শুধু নদওয়াকে বুঝতেন না বরং তার মহানুভব অন্তর গােটা ভারতের মাদরাসাগুলিকে একটি সুতায় গ্রথিত মাল্য মনে করত । তিনি প্রতিটি মাদরাসাকে নিজের মাদরাসা মনে করতেন । তিনি বিভিন্ন মাদরাসায় হাযির হওয়ার জন্য দূর - দূরান্তে সফর করতেন । মাদরাসাগুলিকে আর্থিক সহযােগিতার ব্যবস্থা করতেন তার ব্যথিত অন্তর মাদরাসাগুলিকে একটি জীবন্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবং ইসলামের পাওয়ার হাউজ হিসেবে দেখার জন্য চাতকের মত চেয়ে থাকতাে। হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী ( রহ . ) দ্বীনী মাদরাসার পরিচয় দিতে গিয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের উলামা ও ভােলাবা সম্মেলনে বলেছিলেন , “ মাদরাসা হলাে এক মহান কর্মশালা , যেখানে মানুষ গড়ার সাধনা হয় । যেখানে দ্বীনের দায়ী ও ইসলামের সিপাহী তৈরী হয় । মাদরাসা হলাে ইসলামী বিশ্বের বিদ্যুৎকেন্দ্র , যেখান থেকে ইসলামী জনপদে , বরং সমগ্র মানব বসতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় । মাদরাসা হলাে মন ও মস্তিষ্ক এবং অন্তর ও অন্তদৃষ্টি তৈরীর কারখানা । মাদরাসা হলাে গােটা বিশ্বের গতি - প্রকৃতি নির্ধারণ এবং সমগ্র মানব জীবনের কার্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের মহান কেন্দ্র । সমগ্র বিশ্বের উপর তার সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় , বিশ্বের কোন সিদ্ধান্ত তার উপর কার্যকর হয় না । মাদরাসার সম্পর্ক বিশেষ কোন যুগ , সমাজ এবং বিশেষ কোন ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে নয় , নয় বিশেষ কোন কৃষ্টি ও সভ্যতার সঙ্গে । সুতরাং যুগ ও সমাজের পরিবর্তন , ভাষা ও সংস্কৃতির বিলুপ্তি , কিংবা সভ্যতার প্রাচীনতা মাদরাসার গতি ও ব্যাপ্তিকে কখনাে প্রভাবিত করতে পারে না । আমরা যাকে মাদরাসা বলি , একদিকে তার সম্পর্ক হলাে সরাসরি মুহাম্মাদী নবুয়তের সঙ্গে যা বিশ্বজনীন , সার্বজনীন ও সর্বকালীন । অন্যদিকে তার সম্পর্ক হলাে মানুষ ও মানবতার সাথে এবং সেই গতিশীল জীবনের সাথে যা সাগরমুখী নদীর মতই চিরপ্রবাহমান । মাদরাসা হলাে নবুয়তে মুহাম্মাদীর চিরন্তনতা ও মানবজীবনের গতিশীলতার মিলন মােহনা । সুতরাং আধুনিক ও প্রাচীনের বিতর্ক এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশের সীমাবদ্ধতা এখানে কল্পনা করাও সম্ভব নয় । বন্ধুগণ ! মাদরাসার পরিচয় প্রসঙ্গে যদি বলা হয় যে , তা বিগত যুগের স্মারক কিংবা ইতিহাসের ধারক তাহলে এর চেয়ে আপত্তিকর ও অপমানজনক বিষয় আর কিছু হতে পারে না । আমি তাে এটাকে মাদরাসার স্বভাব সত্তার আমূল বিকৃতি মনে করি । মাদরাসাকে আমি মনে করি সবচে ' সুরক্ষিত ও শক্তিশালী কেন্দ্র এবং গতি ও প্রগতির উচ্ছলতায় এবং উদ্যম ও প্রাণচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান । এর এক প্রান্তের সংযােগ হলাে নবুয়তে মুহাম্মাদীর সঙ্গে , অন্য প্রান্তের সংযােগ হলাে জীবন ও জগতের সাথে । মাদরাসা একদিকে নবুয়তে মুহাম্মাদীর চিরন্তন ঝরণাধারা থেকে পানি সঞ্চয় করে , অন্যদিকে জীবনের ফসলভূমিতে পানি সিঞ্চন করে । এটা দ্বীনী মাদরাসার সর্বক্ষণের দায় ও দায়িত্ব । মুহূর্তের জন্য যদি সে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলা করে তাহলে জীবনের ফসলভূমি শুকিয়ে যাবে , মানুষ ও মানবতা নির্জীব হয়ে পড়বে এবং জীবন ও জগতের সব কিছুতে স্থবিরতা দেখা দেবে । নবুয়তে মুহাম্মাদীর ঝরণাধারা যেমন কখনাে শুকোবে না , তেমনি মানবতার পিপাসাও কখনাে দূর হবে না । নবুয়তে মুহাম্মাদীর কল্যাণ ও বদান্যতায় যেমন কৃপণতা ও দানবিমুখতা নেই , তেমনি মানবতার প্রয়ােজন ও প্রার্থনারও বিরাম নেই । এদিক থেকে বারবার ধ্বনিত হয় আল্লাহ দেন , আমি বিতরণ করি'- এই আশ্বাস বাণী , ওদিক থেকে উচ্চারিত হয় ' দাও , আরাে দাও'- চাহিদার কাতর ধ্বনি । দুনিয়াতে মাদরাসার চেয়ে কর্মচঞ্চল ও ব্যস্ত সচল প্রতিষ্ঠান আর কী হতে পারে ! জীবনের সমস্যা ও প্রয়ােজন অসংখ্য , জীবনের চাহিদা ও পরিবর্তন অসংখ্য , জীবনের বিচ্যুতি ও পদস্খলন অসংখ্য , জীবনের আশা ও উচ্চাকাঙ্খ অসংখ্য এবং জীবনের প্রতারণা ও প্রতারক অসংখ্য । মাদরাসা যখন এমন সমস্যাসংকুল ও প্রয়ােজনবহুল জীবনের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেছে যাপনের অবকাশ কোথায় ? দুনিয়াতে যে কোন মানুষ কাজ ছেড়ে আরাম করতে পারে । যে কোন প্রতিষ্ঠান অবসর যাপন করতে পারে । পৃথিবীতে সবার ছুটি ভােগ করার অধিকার আছে , কিন্তু মাদরাসার নেই কোন ছুটি । প্রতিদিন তার কর্মদিন , প্রতি মুহূর্ত তার ব্যস্ততার মুহূর্ত । দুনিয়ার যে কোন মুসাফির চাইতে পারে একটু আরাম , একটু বিশ্রাম , কিন্তু জীবনের সদা চলমান কাফেলায় মাদরাসা নামের যে মুসাফির , তার কপালে নেই কোন আরাম , তাকে চলতে হবে অবিরাম । জীবনের গতি কখনাে যদি মুহূর্তের জন্য থৈমে যেতত , চাহিদা ও প্রয়ােজনের সাময়িক অবসান হতাে , তাহলে মাদরাসারও সুযােগ ছিলাে চলার পথে একটু দম ফেলার , একটু জিরিয়ে নেয়ার । কিন্তু জীবন যেখানে সদা গতিশীল , জীবনের চাহিদা ও প্রয়ােজন যেখানে পরিবর্তনশীল সেখানে মাদরাসার কর্মচঞ্চলতায় স্থিরতা ও স্থবিরতার অবকাশ কোথায়? তাকে তাে তখন অবসর পদে পদে জীবনকে শাসন করতে হবে , জীবনের ভুল - বিচ্যুতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । নতুন নতুন সমস্যা ও জিজ্ঞাসার সমাধান দিতে হবে । পরিবর্তিত পরিস্থিতির সামনে স্থির হয়ে দাঁড়াতে হবে এবং নতুন নতুন ফেতনার সফল মােকাবেলা করতে হবে । মাদরাসা যদি জীবন - কাফেলা থেকে পিছিয়ে পড়ে , কিংবা কোন মঞ্জিলে এসে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে এবং তন্দ্রায় ঢলে পড়ে তাহলে জীবনকে সঙ্গ দেবে কে ? মানবতাকে পথ দেখাবে কে ? ঝড় - তুফানের অন্ধকারে নবুয়তের আলাে দেখাবে কে ? হতাশা ও নিরাশার মুখে পয়গামে মােহাম্মদীর চিরন্তন সান্ত্বনা বাণী শােনাবে কে ? মাদরাসা যদি কর্মে অবহেলা ও দায়িত্বে শিথিলতা করে , মাদরাসা যদি জীবনের নেতৃত্ব ত্যাগ করে এবং গতিহীন ও স্থবির হয়ে পড়ে তাহলে তা হবে জীবন ও জগতের সাথে এবং মানুষ ও মানবতার সাথে বিশ্বাস ভঙ্গের শামিল , যা দায়িত্বশীল ও কর্তব্য সচেতন কোন মাদরাসা কল্পনাও করতে পারে না । ” পরিবর্তিত সময়ে সমাজকে সঠিক নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনা দিতে হলে দ্বীনী মাদরাসার তােলাবার কি ধরণের যােগ্যতা অর্জন করতে হবে সে সম্পর্কে এক দিক নির্দেশনামূলক ভাষণে হযরত মাওলানা ( রহ . ) বলেন , “ আমার প্রিয় বন্ধুগণ ! এত দিনে সময় ও সমাজ এবং পরিবেশ - পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে । এখন যদি আমাদের আল - ইছলাহ আমানের উদ্দেশ্য হয় শুধু মাঝারি মানের কিছু লেখক - গবেষক ‘ উৎপাদন ' , যারা সময়ের পরিবর্তন ও প্রবণতা অনুসরণ করে এবং সমকালীন বুদ্ধিজীবীদের কলমের লেখা ও চিন্তার রেখা অনুধাবন করে তার মােকাবেলায় কিছু বলতে বা লিখতে পারে , তাহলে আমার কাছে শুনুন , চলমান সময়ের জন্য তা মােটেই পর্যাপ্ত নয় । সময়ের দাবী ও চাহিদা এখন অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত । সময়ের দাবী ও চাহিদা সর্বদা একই মান ও পরিমাণে স্থির থাকে না । বরং পরিবেশ - পরিস্থিতি , মানুষের যােগ্যতা ও সামর্থ এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের বিচারে চাহিদার মান ও পরিমাণ নির্ধারিত হয়ে থাকে এবং সে অনুযায়ী উলামায়ে উম্মতের কাছে পথের দিশা ও দিক নির্দেশনা । দাবী করে থাকে । সময় এখন কোন দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শুধু এজন্য ছাড়পত্র দিতে প্রস্তুত নয় যে , এখানে উর্দু ভাষার কিছু ভালাে লেখক বা বক্তা তৈরী হচ্ছে এবং মাঝারি মানের সাহিত্যিক , চিন্তাবিদ ও আলেম তৈরী হচ্ছে।

[সম্পাদনা]

শুনুন ভাইসব ! মুসলিম সমাজের চিন্তা - জগতে আজ এক ব্যাপক নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য ছড়িয়ে পড়েছে । এই উম্মাহ এবং এই দ্বীনের মাঝে যে চিরন্তন যােগ্যতা গচ্ছিত রাখা হয়েছে সেই যােগ্যতা ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে যুবসমাজ এবং আধুনিক শিক্ষিত মহলে ভয়ানক অনাস্থা - অনিশ্চয়তা দানা বেঁধে উঠেছে । সর্বোপরি দ্বীনের ধারক - বাহক আলেমদের নতুন প্রজন্মে মারাত্মক হতাশা ও হীনম্মন্যতা শিকড় গেড়ে বসেছে । এগুলাে দূর করে যুগ ও সমাজের লাগাম টেনে ধরার জন্য , দ্বীন ও শরীয়তকে নয়া যামানার নয়া তুফান থেকে রক্ষা করার জন্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়ােজন । অনেক বড় ইলমী জিহাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয় অর্জনের প্রয়ােজন । এখন প্রয়ােজন আরাে বেশী আত্মনিবেদনের , আত্মবিসর্জনের এবং আরাে উর্ধ্বাকাশে উড্ডয়নের । এতে কোন সন্দেহ নেই যে , আমাদের পূর্বসূরীগণ অনেক কালজয়ী কীর্তি ও অবদান রেখে গেছেন , বিশেষত আমাদের নদওয়াতুল উলামার প্রথম কাতারের লেখক - গবেষক ও চিন্তাবিদগণ তাদের সময় ও সমাজকে অনেক কিছু দিয়েছেন এবং নতুন প্রজন্মকে ইসলাম ও ইসলামী উম্মাহর ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে যথেষ্ট আশ্বস্ত করতে পেরেছেন । যে সব সমস্যা ও জিজ্ঞাসা তখন জ্বলন্ত ছিলাে সেগুলাের উপর চিন্তা গবেষণার যে ফসল এবং যে বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান তারা রেখে গেছেন , তা সে যুগের জন্য খুবই কার্যকর ও যুগান্তকারী ছিলাে । কিন্তু সেগুলাের চর্বিত চর্বন এখন বিশেষ কোন কৃতিত্ব বলে গণ্য হবে না এবং তাতে যুগ ও সমাজের হতাশা দূর হবে না । জ্ঞান ও গবেষণার ক্ষেত্র এখন অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়ে পড়েছে । ইলমের যে প্রাচীন ভান্ডার ও গুপ্ত সম্পদ পূর্ববর্তী আলেমদের কল্পনায়ও ছিলাে , আধুনিক প্রকাশনা বিপ্লবের এবং বৃহৎ প্রকাশনা সংস্থাগুলাের নিরলস প্রচেষ্টায় তা এখন দিনের আলােতে চলে এসেছে । আগে যে সব কিতাবের শুধু নাম শুনেছি এখন তা গ্রন্থাগারের তাকে তাকে শােভা পায় । তাছাড়া চিন্তার পথ ও পন্থা এবং অস্থির চিত্তকে আশ্বস্ত করার উপায় - উপকরণের এত পরিবর্তন ঘটেছে যে , পুরােনাে পথ ও পন্থার অনুকরণ করা এখন কিছুতেই সম্ভব নয় । পুরােনাে বহু আলােচনা এখন তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে । একটা সময় ছিলাে যখন মাওলানা শিবলী নােমানীর ‘ আল - জিয়া ফিল ইসলাম'কে মনে করা হতাে মহা আলােড়ন সৃষ্টিকারী কিতাব । এক নজরে আওরঙ্গজেব ' তাে ছিল রীতিমত এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয় । একইভাবে ‘ আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ' ছিল ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে । দাঁতভাঙ্গা জবাব । কিন্তু এসব এখন এতই গুরুত্বহীন যে , এ সম্পর্কে বলার বা লেখার নতুন কিছু নেই এবং যুগ ও সমাজের তাতে তেমন কোন আগ্রহ নেই । এ যুগে কোন কীর্তি ও কর্ম রেখে যেতে হলে এবং প্রতিভা ও যােগ্যতার স্বীকৃতি পেতে হলে আরাে ব্যাপক ও বিস্তৃত জ্ঞান - গবেষণা ও ইলমী সাধনার প্রয়ােজন । কেননা সময়ের কাফেলা অনেক পথ পাড়ি দিয়ে চলে গেছে অনেক সামনে । এটা ঠিক যে , পূর্ববর্তীদের রেখে যাওয়া এই জ্ঞানসম্পদও অবশ্যই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণযােগ্য । এর সাথে জড়িয়ে আছে স্মৃতি এবং ইতিহাস - ঐতিহ্য । এগুলাে এখন আমাদের অস্তিত্বেরই অংশ । কিন্তু সময় বড় নির্দয় । যামানা বড় বে - রহম । ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যত বিশাল হােক , প্রতিভার প্রভা যত সমুজ্জ্বল হােক এবং জামাত ও সম্প্রদায় যত ঐতিহ্যবাহী হােক , সময় কারাে সামনেই মাথা নােয়াতে রাজী নয় । যুগের স্বভাবধর্ম এই যে , যদি যােগ্যতা বলে তার স্বীকৃতি আদায় না করা হয় , আগে বেড়ে সে কাউকে স্বীকার করে না । কোন কিছুর ধারাবাহিকতা বা প্রাচীনতা সময়ের শ্রদ্ধা লাভের জন্য যথেষ্ট নয় । সময় এমনই বাস্তববাদী , এমনই শীতল ও নিরপেক্ষ যে , তার হাতে নতুন কিছু তুলে না দিলে এবং তার ঘাড়ে ভারী কোন বােঝা চাপিয়ে না দি সে মাথা নােয়াতে চায় না । সময়ের স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি লাভ করা এতসহজ নয় এবং শুধু ঐতিহ্যের দোহাই যথেষ্ট নয় । সুতরাং সময়ের স্বীকৃতি পেতে হলে , ব্যক্তিত্বের প্রভাব বিস্তার করতে হলে এবং আত্মগবী সমাজের মন - মগজে যথাযােগ্য স্থান পেতে হলে প্রতিভা ও যােগ্যতার আরাে বড় প্রমাণ দিতে হবে এবং ব্যক্তিত্বের উচ্চতা আরো বাড়াতে হবে , যে উচ্চতা ছাড়িয়ে যাবে হিমালয়ের শৃঙ্গকে । ” আরেক ভাষণে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে হযরত মাওলানা ( রহ . ) বলেন , “ এখন সমস্ত মাদরাসায় একটি শূন্যতা বিরাজ করছে । তা এই যে , আসাতিজা ও তালাবা- এই দুয়ের মাঝে কোন সম্পর্ক নেই , ন্যূনতম যােগাযােগ নেই । বরং উভয়ের মাঝে এক বিরাট ফারাক ও ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে । তারা এখন শুধু দরসের ছাত্র এবং দরসের আসাতেযা হয়ে পড়েছেন । এই সম্পর্কহীনতা ও ব্যবধান অবশ্যই দূর করতে হবে । উভয়ের মাঝে আত্মার সম্পর্ক এবং হৃদয়ের বাঁধন সৃষ্টি করতে হবে । মাদারিসের অস্তিত্ব , ইলমের অগ্রগতি এবং তালিবে ইলমের কামিয়াবি এখানেই রয়েছে নিহিত । ”

অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড[সম্পাদনা]

ভারত স্বাধীনের পর ভারতে বসবাসকারী সকল সম্প্রদায়ের জন্য একই ধরনের আইন চালু করার দাবী উঠতে থাকলে মুসলমানদের একটি অংশ এটিকে নিজেদের সংস্কৃতি ধ্বংস করার একটি ষড়যন্ত্র মনে করে। এসময় আমীরে শরীয়ত খ্যাত বিহারের মিন্নাতুল্লাহ রহমানি আবুল হাসান আলী নদভীর সাথে পরামর্শ করে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তােলার লক্ষ্যে দারুল উলুম দেওবন্দ, মুসলিম মজলিস মশওয়ারাত, জামাতে ইসলামী, নদওয়া প্রভৃতি ইসলামী ফোরামগুলির সাথে মতবিনিময় করে ১৯৭২ সালে বােম্বাইতে মুসলিম পার্সনাল ল কনভেনশন আহ্বান করেন। এতে নানা মুসলিম উপদলের দলের মুখপাত্ররাও অংশ গ্রহণ করেন। উক্ত কনভেনশনে নদভীর উপস্থিতিতে দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম ক্বারী তৈয়বকে সভাপতি এবং মিন্নাতুল্লাহ রহমানিকে সেক্রেটারী করে মুসলিম পার্সোনাল ল বাের্ড নামে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। নদভী এ সংগঠনের আলীগড়ের দ্বিতীয় কনভেনশন উদ্বোধন করেন এবং জোরালাে ভাষায় ভারত সরকারকে এ ধরনের ষড়যন্ত্র হতে দূরে থাকার আহ্বান জানান। ১৯৮৩ সালে বাের্ডের সভাপতি তৈয়ব মৃত্যুবরণ করলে সর্বসম্মতভাবে তাকে এ আন্দোলনের সভাপতি করা হয়। তিনি ১৯৮৩ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় ১৭ বছর ধরে এ বাের্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাের্ডের এই আন্দোলনকে ভারতের ইতিহাসে মুসলমানদের সব চেয়ে বড় এবং সুসংহত আন্দোলন মনে করা হয়। সভাপতি হিসেবে তিনি মিন্নাতুল্লাহ রাহমানিকে সাথে নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীবগান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং মুসলমানদের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক পারিবারিক আইনের প্রয়ােজনীয়তার গুরুত্ব বােঝাতে সক্ষম হন। রাজীব গান্ধী পার্লামেন্টে বিল মঞ্জুরীর ব্যবস্থা করেন। এটিকে ভারতীয় পার্লামেন্টে সংখ্যালঘু মুসলমানদের সমস্যার ব্যাপারে তার একটি বড় বিজয় ধরা হয়। ঠিক এমনিভাবে ভারতের স্কুলগুলির সকল ছাত্রছাত্রীর জন্য হিন্দুদের প্রতিমা পুজার ধ্যান-ধারণা সম্বলিত জাতীয় সঙ্গীত বন্দে মাতরম পাঠ বাধ্যতামূলক করা হলে এবং শাহবানু মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট মুসলিম পারসােসল ল বাের্ডের বিরুদ্ধে যে রায় ঘােষণা করেছিল তার বিরুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

পয়ামে ইনসানিয়াত[সম্পাদনা]

ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিয়ে তার দর্শন ছিল, ভারতের বিশাল অমুসলিম জনগােষ্ঠীর সাথে দৈহিক এবং রাজনৈতিক শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়াটা মুসলমানদের জন্য আত্মঘাতি পদক্ষেপ এবং জান-মাল, মান-সম্মান তথা সমস্ত কিছুতে চরম নিরাপত্তাহীনতা ডেকে আনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তিনি ভারতীয় মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায় হিসাবে প্রতিবেশী অমুসলিমদের মানবতা ও সহমর্মিতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করার এবং নিজেদের নৈতিক চরিত্রের শ্রেষ্ঠতার মাধ্যমে তাদের উপর প্রভাব ফেলার কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। ১৯৫১ সালে লখনউয়ের আমীনুদ্দৌলা পার্কে একটি হিন্দু-মুসলিম জনসভার আয়োজন করে ‘খােদা পুরস্তি আওর নফস পুরন্তি’ নামে একটি বক্তৃতা করার তার এ দাওয়াতি কার্যক্রমের সূচনা হয়। এরপর তিনি তার এ বার্তা নিয়ে ভারতজুড়ে সফর করেন। ১৯৫৪ সালে লখনউয়ের গঙ্গা প্রসাদ মেমােরিয়াল হলে পয়ামে ইনসানিয়াতের সভা হয়। ১৯৭৪ সালে এ আন্দোলন পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়। কিন্তু বিশেষ কারণে তিনি পয়ামে ইনসানিয়াতকে সাংগঠনিকরূপ দেননি। এর জন্য কোন কমিটিও ছিল না, কোন ফান্ডও ছিল না। তিনি নিজেই এ আন্দোলনের ভিত্তি ছিলেন।

রাবেতায়ে আদবে ইসলামী[সম্পাদনা]

তিনি ভাষা ও সাহিত্যকে দাওয়াতের অন্যতম বাহন বা মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে এর উন্নতি ও প্রসারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ১৯৮৫ সালের জানুয়ারী মাসে রাবেতায়ে আদবে ইসলামী নামে একটি আন্দোলনের সূচনা করেন। ইমাম মুহাম্মাদ বিন সউদ ইউনিভার্সিটির আরবি সাহিত্য বিভাগের প্রধান ড. আবদুর রহমান রাফাত পাশা এবং সেখানকার কয়েকজন অধ্যাপক এ আন্দোলনের মূল স্থপতি ছিলেন। পাশা নদভীর লিখিত আরবি সাহিত্যের পাঠ্যবই মুখতারাতের ভূমিকা পড়ে এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ফলে তিনি এবং তার কয়েকজন বন্ধু নিয়ে মক্কায় নদভীর সাক্ষাতে এ আন্দোলনের উপর ব্যাপক আলােচনা করেন। আলােচনা সভায় তাকে এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি এবং রাবে হাসানী নদভীকে সাধারণ সম্পাদক মনােনীত করা হয় এবং এর সদরদপ্তর লখনউ রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এক বছর পর ১৯৮৬ সালের জানুয়ারী মাসে লখনউতে এর প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে ইসলামী সাহিত্যের ভিত্তি মজবুত করা, ইসলামী সাহিত্যের সমালােচনা বিভাগের নিয়মকানুন তৈরী করা, নতুন গল্প সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগ, জীবনী সাহিত্যের ইসলামী নিয়ম নীতি প্রণয়ন করা, ইসলামী সাহিত্যের ইতিহাস নতুনভাবে প্রণয়ন করা, ইসলামী সাহিত্যিকদের আদর্শ জমা করা, শিশু সাহিত্যের দিকে মনােযােগ দেয়া, ইসলামী সাহিত্যের মর্যাদা মেনে নেয়ার এবং সারা পৃথিবীর মুসলিম সাহিত্যিকদের সাথে সুসম্পর্ক কায়েম করা ইত্যাদি বিষয়ে আলােচনা হয়। এ আন্দোলনের দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ইস্তাম্বুলে। এরপর থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বের করা এবং বার্ষিক সম্মেলনের ধারা অব্যাহত আছে।

শিবলী একাডেমী[সম্পাদনা]

শিবলী নোমানীর প্রতিষ্ঠিত দারুল মুসান্নিফীন বা শিবলী একাডেমীর সাথে তিনি গভীর সম্পর্ক রেখেছিলেন। তিনি এবং তার বড় ভাই এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন মজলিসের সদস্য ছিলেন। আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদীর পর তাকে মজলিসে আমেলার সভাপতি বানানো হয়। ডাঃ সাইয়েদ মাহমুদ এবং মাওলানা শাহ মঈনুদ্দীন আহমদ নদভীর মৃত্যুর পর তিনিই ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ। তিনি নিয়মিত দারুল মুসান্নিফীনের সম্মেলনে উপস্থিত হতেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি তার আব্বার রচিত গ্রন্থ গুলে রাআনাআস-সিফাতুল ইসলামিয়া ফিল হিন্দ এখান থেকে প্রকাশ করেন। তার নিজের রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম ২ খণ্ড এখান থেকেই প্রকাশিত হয়। এ প্রতিষ্ঠান হতে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা মাআরিফের তিনি নিয়মিত পাঠক ছিলেন। মৃত্যুবরণের কিছুদিন পূর্বে তাকে তার সবচাইতে প্রিয় মাসিক পত্রিকার নাম জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাবে মাআরিফের নাম বলেছিলেন।

উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বহগুণার নদওয়াকে দেয়া এক লাখ রুপীর বাজেট তিনি দারুল মুসান্নিফীনকে দিয়ে দেন। তিনি সীরাতুন নবীর সপ্তম খন্ডের ভূমিকা লিখেছিলেন। পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ গ্রন্থ পড়ে খুশী হয়ে তাকে ১ লাখ রূপি পুরস্কার দেওয়ার উদ্যোগ নিলে তিনি বলেছিলেন এ পুরস্কারের প্রকৃত প্রাপক হচ্ছে দারুল মুসান্নিফীন এবং সুলাইমান নদভীর স্ত্রী। উক্ত পুরস্কার অর্ধেক অর্ধেক করে উভয়কে দেয়া হয়। এছাড়া দুবাই এবং সুলতান ব্রুনাই আন্তর্জাতিক পুরস্কারের কিছু অর্থ তিনি দারুল মুসান্নিফিনকেও দিয়ে দেন। রাবেতা আলমে ইসলামী হতেও তিনি কিছু আর্থিক সহযোগিতা দারুল মুসান্নিফীনের জন্য করিয়ে দিয়েছিলেন।

দ্বীনী তালীমী কাউন্সিল[সম্পাদনা]

ভারত স্বাধীনের পর মুসলমানদের শিক্ষায় হিন্দুত্ববাদের প্রভাবমুক্ত রাখতে বস্তি জেলার কাজী আদিল আব্বাসী মুষ্টি চাঁদার ভিত্তিতে মসজিদ ভিত্তিক সকাল সন্ধ্যা ধর্মীয় শিক্ষার একটা সীমিত উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যা বেশ উপযোগী প্রমাণিত হয়। নদভী আব্বাসীর এই সীমিত আন্দোলনকে প্রথমে প্রদেশব্যাপী, পরবর্তীতে সারা ভারতে ছড়িয়ে দেন। ১৯৫৯ সালের ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর এবং ১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি আব্বাসির আহবানে বস্তিতে তিনদিন ব্যাপী এক প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে দ্বীনী তালীমী কাউন্সিল নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়, সর্বসম্মতিক্রমে নদভীকে তার সভাপতি মনোনীত হন।

রাবেতায়ে আলমে ইসলামী[সম্পাদনা]

১৯৬০ সালের দিকে আরব বিশ্বের উপর কম্ধিং বিমান হামলা শুরু হয়। এ সময় সৌদী আরব সম্নয় উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং একটি আন্তর্জাতিক মানের সংস্থা গঠন করে। যার নাম রাখা হয় রাবেতায়ে আলমে ইসলামী (ইসলামী বিশ্বের মৈত্রী সংঘ)। এ সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল সারা বিশ্বের মুসলমানদের স্বীনী এবং আর্থ সামাজিক কাজে সহযোগিতা করা। সাহায্য সহযোগিতার নামে খৃষ্টান এনজিওরা যেভাবে মুসলমানদের মুরতাদ করে ফেলছে এবং সেবা ও সহযোগিতার নামে মুসলমান যুবক-যুবতীদের ঈমান হরন করে চলছে তারই মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে এ সংস্থা তার কাজ শুরু করে। ১৩৮১ হিজরীর ১৮ জিলহজ্জ মরহুম শাহ সৌদ বিন আবদুল আযীযের বা লা নার এ সময় মাওলানা আলী মিয়া মক্কা শরীফে অবস্থান করছিলেন। এ অনুষ্ঠানে হযরতকে দাওয়াত দেয়া হয়- এবং তাঁকে রাবেতার মেম্বার, . মনোনীত করা হয়। � আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. - ১৭০

ভারত থেকে আরো একজন রাবেতার সদস্য নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে হযরত মাওলানা আলী মিয়া, বিখ্যাত আলেমেছীন হযরত মাওলানা মনযুর নোমানী সাহেবের নাম পেশ করেন এবং হযরত নো'মানী রাবেতার সদস্য নির্বাচিত হন। রাবেতার সদস্যদের উপর হযরতের বিশেষ প্রভাব ছিল। রাবেতার সভাপতি শায়খ ইবরাহীম অনুপস্থিত থাকলে মাওলানা আলী মিয়াকেই সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হত। এক বছর তিনি রাবেতার মিটিং এ উপস্থিত হতে পারেননি । এ সময়ের রাবেতা প্রধান শেখ ছালেহ বলেছিলেন, খোদার কসম, শায়খ আবুল হাসান না থাকায় রাবেতার মিটিং ফিকে হয়ে গিয়েছে। তিনি থাকলে জলসার মধ্যে আযমত এবং নুরানিয়াত অনুভূত হত। আরেক বহর জলসার পূর্বে শেখ নাসের আবদী বলেছিলেন_ কোনই অসুবিধা নেই, শায়খ আবুল "হাসান প্রথম বৈঠকে উপস্থিত না হতে পারলে তৃতীয় দিনের বৈঠকে হাযির হতে পারেন। নিসন্দেহে তার এক ঘন্টার উপস্থিতি রাবেতার জলসাকে ভারী করে দেয়। রাবেতার জন্য এটা বিরাট সৌভাগ্য হবে'যে শায়খ অল্প সময়ের জন্য হলেও মিটিং এ উপস্থিত হয়েছেন।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ[সম্পাদনা]

বৃটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি পৃথিবী বিখ্যাত। এঁ ইউনিভার্সিটিতে একটি ইসলামিক সেন্টার কায়েম করার জন্য সেখানকার মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বহুদিন হতে চেষ্টা করে আসছিলেন। ইউনিভার্সিটির সাতশত বছরের ইতিহাসে এ বিভাগ বাস্তবায়ন করার প্রথমবারের মত যখন সুযোগ আসে তখন লন্ডনে অবস্থানরত বিখ্যাত এতিহাসিক জনাব প্রফেসর খালীক আহমাদ নেযামী ১৯৮৩ সালে হযরত আলী মিয়াকে এ সেন্টারের উদ্বোধন করার দাওয়াত দেন। 7

ইসলামী বিষয়ে অধ্যয়ন, গবেষণা এবং পশ্চিমা বুদ্ধিজীবি ও সত্য 'সন্ধানীদেরকে ইসলামের সাথে পরিচিত করার লক্ষ্যে ঈসায়ী শিক্ষা কেন্দ্রে এ ধরণের একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রচেষ্টায় সেন্ট ক্রস কলেজের শিক্ষক ও ভাইস প্রিঙ্সিপাল ডঃ ডিজি ব্রাউনিং ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। তাঁর ইচ্ছা ছিল যে, মাওলানা আলী মিয়ার মত ব্যক্তিত্ব এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত থাকবেন, এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গঠনতন্ত্র প্রণয়নে সাহায্য করবেন এবং ইসলাম ও পাশ্চাত্য বিষয়ে প্রবন্ধ পড়বেন।


�আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাঁসান আলী নদী রহ. - ১৭১

বহু বছর হতে হযরত আলী মিয়া (রহ.) তাঁর চিন্তাধারাকে পাশ্চাত্য সমাজের সামনে পেশ করার সুযোগ খুঁজছিলেন এবং রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করছিলেন। এ দাওয়াতনামা পাওয়ার পর তাঁর অন্তরের সে আকাঙ্ষা পুরো হওয়ার সুযোগ হয়। তিনি এ সুযোগ কাজে লাগান এবং সেখানকার উন্নতির জন্য তার সকল প্রচেষ্টা জারী রাখেন।

তিনি ১৯৮৩ সালের ২০ ও ২১শে জুলাই লন্ডন রওয়ানা হন, হিথরো এয়ার পোর্টে ডঃ ব্রাউনিং এবং ফারহান নেযামী তাকে অভ্যর্থনা জানান। ২২শে জুলাই সকাল দশটায় জলসা শুরু হয়। তিনি প্রথমে আরবীতে সংক্ষিপ্ত বতুতা করেন এবং ফারহান নেযামী তাঁর মূল প্রবন্ধ ইংরেজীতে ভাষান্তর করে শুনান।

২৩ ও ২৪ জুলাই এই ইসলামিক সেন্টারের আসল বিষয়গুলি চূড়ান্ত করা হয়। ভাঃ ফারহান নেজামীকে ডাইরেক্টর এবং ডঃ ব্রাউনিংকে রেজিস্ট্রার করা হয়। অস্থায়ী গঠনতন্ত্র তৈরী করা হয় এবং এর ইসলামী চরিত্র বহাল রাখার জন্য এ নিয়ম করা হয় যে কমিটির রোকনদের মধ্যে আধিক্য থাকবে মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের । এ সিদ্ধান্ত এ জন্য নেয়া হয় যে, এ প্রতিষ্ঠান যেন অন্য কোন উদ্দেশ্যে এবং কোন বিশেষ দলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে না পারে।

সাহিত্যকর্ম[সম্পাদনা]

উলুমে শরীয়া'র বিভিন্ন শাখায় শায়খ নদতী'র অংশখহণ,

ব্যুৎপত্তি ও অবদান

উলুমে শরীয়া'র কোন্‌ কোন্‌ শাখায় শায়খ নদভী'র সাবলীল বিচরণ ছিলো? কোন্‌ কোন্‌ বিষয়ে তার লেখালেখি কেন্দ্রিভূত ছিলো? যা যা পড়েছেন, জেনেছেন, তার সব নিয়েই কি তিনি কলম ধরেছেন না-কি নির্দিষ্ট কিছু বিষয়েই তা কেন্দ্রিভূত ছিলো?...... এ প্রশ্নের উত্তর জানতেই এখানে আমাদেরকে একটু থামতে হবে।

আবুল হাসান আলী নদভী দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা ও দারুল উলুম দেওবন্দের উলামা-মাশায়েখের গভীর সান্নিধ্য ও শিষ্যত্বে উলুছে শরীয়া'র বিভিন্ন শাখায় ইলম হাসিল করেছেন।


�না, সব বিষয় নিয়ে তিনি লিখেন নি।

তার লেখক-সত্ত্বা আবর্তিত হয়েছে দাওয়াত এবং ইসলামী চিন্তা-দর্শনকে কেন্দ্র করে।

ইসলামী চিন্তা-দর্শনের গুঢ় রহস্য ও তাৎপর্যকে কেন্দ্র করে।

বিভিন্ন বাতিল ফেরকা ও শয়তানি মতবাদের অসারতা ও মুখোশ উলন্মোচনকে কেন্দ্র করে।

ইসলামী ইতিহাস-এতিহ্যের হত-গৌরব পুনরুদ্ধারে কেন্দ্র করে।

ইসলাম ও রিসালাতে মুহাম্মদীকে ঘিরে দানা-বেঁধে-ওঠা সংশয়-সন্দেহের অপনোদনকে কেন্দ্র করে।

শায়খ নদভী ও কুরআনে কারীম[সম্পাদনা]

কুরআন গবেষণায় তার অন্যতম দ্যুতিত অবদান হলো- ও ০১ ০ 3১১ (সূরায়ে কাহফঃ চিন্তার আলোকমালা) গ্রন্থটি। পরবর্তীতে এটি ৯১১ ১এ)। ৬৪ (1০40 ( ঈমান ও বন্তবাদের লড়াই) নামে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া এ-বিষয়ে তিনি আরো লিখেছেন- এ) ৯৬ 3 ৮০১1) 5 (কুরআনের আলোকে নবুয়ত ও নবী) | কুরআনের টুকরো কথা নিয়ে কিংবা নির্দিষ্ট কোনো আয়াতকে কেন্দ্র করে রয়েছে তার অসংখ্য পুস্তিকা। (সম্প্রতি এ বিষয়ে ০ম 1 নামে উ্দূতে একটি গুরুতপূর্ণ কিতাব প্রকাশিত হয়েছে।)

তার কিতাব ও প্রবন্ধ-নিবন্ধের পাঠক খুব সহজেই অনুভব করতে পারবেন যে, তিনি কুরআনে কারীমের কতো বড় স্বাদগ্থহণকারী ও বোদ্ধা ছিলেন। কুরআনে কারীমের. আয়াত দ্বারা প্রামাণ্য উদ্ধৃতি পেশ-_ তীর লেখা ও বলার বৈশিষ্ট্য ছিলো। বিশেষত ঈমানী এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণকে প্রতিফলিত করে। এর উদাহরণ প্রচুর, অসংখ্য ।

শায়খ নদভী ও ইলমে হাদীস[সম্পাদনা]

অনুরূপভাবে হাদীস শান্ত্েও শায়খ নদী পূর্ণতা অর্জন করেন এবং শীর্ষ অবস্থানে উপনীত হন। সমকালীন হাদীসতত্ববিদগণের কিতাবের জন্যে তিনি যে মহামূল্যবান ভূমিকা লিখে দিয়েছেন, তা তার প্রকৃষ্ট গ্রমাণ। � তীর এ-সব ভূমিকা আলাদা গ্রস্থাকারেও প্রকাশিত হয়েছে তার গুরুত্‌ বিবেচনা করে । শিরোনাম : ১. ০১. 4 ৬১০১১ (হাদীসে নববী গবেষণা)। এতে মোট আটটি ভূমিকা রয়েছে :

১. আন্মামা শায়খুল হাদীস মুহাম্মদ যাকারিয়া রহ. রচিত 1৯ ০০০ ৯৯০)-এর ভূমিকা ।

২. শায়খ আল্লামা তাকী উসমানী লিখিত ০৮১ ও ৪ তে থ- ৮ শ*৮ -এর ভূমিকা।

৩. ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আন্ামা রশিদ আহমদ গাঙ্গৃহী রহ. লিখিত ৬-০,। ₹»১ ৮ 5১-৫। -৫/। -এর ভুমিকা ।

৪, বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আল্লামা খলিল আহমদ সাহারানপুরী রহ. লিখিত ১3১ 0০৮ ৬৮ ১১৩ 4৬ -এর ভূমিকা।

৫. আল্লামা শায়খুল হাদীস মুহাম্মদ যাকারিয়া রহ. লিখিত ঠা ৬৮ 0০) ৬৮০ এ! -এর ভূমিকা।

৬. আল্লামা শায়খুল হাদীস মুহাম্মদ যাকারিয়া রহ. লিখিত ০ ৬০৭০৬ এ ৪১ -এর ভুমিকা।

৭. বিশিষ্ট এতিহাসিক (শায়খ নদভী'র পিতা) আল্লামা আবদুল হাই আল-হাসানী রহ. লিখিত এ১--৬। -:-এর ভূমিকা ।

৮. মাওলানা আবু সাহবান রুহুল কুদস লিখিত ১০-১। ৩১) -এর

এই আটটি ভূমিকা ছাড়াও উক্ত পুস্তিকাটিতে আরো দু'টি গুরুত্ৃপূর্ণ লেখা স্থান পরেয়েছে। প্রথমটি ইমাম মালিক ও তীর মুয়াত্তা সম্পর্কে আর দ্বিতীয়টি ৷ 3 ৩৩১1) -+--। ৯০১৬ ৬ 5৭4 সম্পর্কে। শেষোক্ত লেখাটিতে তিনি মুসলিম হিন্দুস্তানের চিত্র তুলে ধরেছেন এবং ইসলামের বিজয়াভিযানের পর সেখানে লেখক, মুসান্নিফ, মুহাদ্দিসগণের আগমনের ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করেছেন। যাদের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন হিন্দুস্তানের শ্রেষ্ঠ হাদীসবেস্তা শাহ ওয়ালী উল্লাহ ইবনে আবদুর রহিম দেহলভী রহ. | সে সময় শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রহ. এবং তার বংশধর ও শাগরিদদের মেহনতের বদৌলতে সারা হিন্দুস্তান জুড়ে সৃষ্টি হয় এক মহান ইলমী জাগরণ । বিশেষত ইলমে হাদীসকে কেন্দ্র করে। ইলমে

হাদীসের আলোয় দেদীপ্যমান যে-সব শহর তখন সবচে' বেশি আলোচিত ছিলো তা হলো-_ দিল্লী, লখনৌ, পানিপথ, দেওবন্দ, মুরাদাবাদ, গাঙ্গৃহ ও অন্যান্য শহর ও এলাকা।

এ ছাড়া “হাদীস তত্তে' শায়খ নদভী'র আরো দু'টি গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে। একটি হলো- ৮৫ 5১:। ৬৯-এ। ₹১।১১ এ ১১০ আর অপরটি হলো- ০৩০১ ৬৯০০) তআ| 5৩ ৩৪১৩৭ ১৪১ ।॥ শেষোক্ত গবেষণাটি মূলত একটি বক্তৃতা, যা তিনি “রাবেতায়ে আলমে ইসলামী'র সেমিনারে পেশ করেছিলেন।

শায়খ নদভী রহ. এর জীবনীকাররা “হাদীস তন্ত'-এ তার অংশগ্রহণের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। এ-সব লেখা নদওয়াতুল উলামা'র গবেষণা মুখপত্র ১. ০. তে ছাপা হয়েছে।

শায়খ নদতী ও ইতিহাস[সম্পাদনা]

যে ক্ষেত্রে শায়খ নদভী অত্যন্ত দাপট ও প্রাধান্যের সাথে এবং অতি স্বাচ্ছন্দ ও সাবলীলতার সাথে বিচরণ করেছেন, তা হলো-_ ইসলামের ইতিহাস ও এ্রতিহ্য। এ-ইতিহাস লেখার সূচনা করেছেন তিনি 'সীরাতে নববী" রচনার মাধ্যমে। “সীরাতে নববী'ই তো আসলে ইসলামের ইতিহাসের মূল উৎস! মূল সূচনা!!

ইসলামের ইতিহাস রচনায় শায়খ নদভী যে এতিহাসিক অবদান রেখেছেন, এ-সংক্ষিপ্ত শব্দচিত্রে তার মূল্যায়ন ও চিত্রায়ন অসম্ভব। শিরোনামের মতো করে শুধু বলা যায়__

ইতিহাসের মহা সমুদ্রে ডুব দিয়েছেন যে সকল মনীষী-__

তিনি তাদের একজন।

যারা জানেন ইতিহাসের রহস্য ও তাৎপর্য এবং ভিতর ও বাহির-_

তাদেরও তিনি একজন।

যাদের কাছে ইতিহাসের দূর-দিগন্তও,

রাঙা প্রভাতের মতো আলোকোজ্বল ও স্পষ্ট__

তাদেরও তিনি একজন.।

যারা জানেন ইতিহাসের শক্তি ও ক্ষমতা এবং দৈন্য ও দুর্বলতা__

তাদের নামের পাশেও তার নাম তারার মতো জুলজবল করে।

এই উম্মতকে গাফলতের নিদ থেকে জাগাতে..

অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠির মধ্যে এ-উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে..

বিশ্বময় ইসলাম ছড়িয়ে দিতে উম্মতকে উদ্দুদ্ধ ও সতর্ক করতে-_

তিনি ইতিহাসকে সুসংহত ও সুবিন্যস্ত করেছেন।

আবেগময় ভাষায় তা লিপিবদ্ধ করেছেন।

ইতিহাসকে কেন্দ্র করে তার এ-অমর জ্ঞান-গবেষণা উদ্ভাসিত হয়েছে তার সর্বাধিক আলোচিত গ্রন্থ ০০4-এ। ৮৬৬ 1. ,-০. ১০ -এর পাতায়- পাতায় এবং ১০1 ও 3১৮১ ০ ৩৬১ ( ইসলামের চিন্তানায়ক ও দাঈগণ) ন্থের ছত্রে-ছত্রে। (১০১3 3 ৪১১১ ১এ। 0০) গ্রন্থে ইসলামের প্রাময়তায়_ গ্রন্থিত করেছেন। এশ্রন্থে (যা মুলত দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তার একটি অমর বক্তৃতামালার সংকলন) তিনি তুলে ধরেছেন যে, উম্মতের ঈমানী শূন্যতা ও ক্ষতিপূরণ করার জন্যে যুগে-যুগে মুজাদ্দিদ পাঠানো-_ আল্লাহ্‌র বিধান। এ-শূন্যতা ও ক্ষতি উক্ত মুজাদ্দিদ ছাড়া আর কেউ পূরণ করতে পারেন না। যুগ ৪ বা শতাব্দীর ব্যবধানে একেকজন মুজাদ্দিদ এসে-এসে উম্মতের ঈমানের বিরান বাগিচাকে বসন্তময় করে দিয়ে যান। ফুলে-ফলে-সৌরভে আমোদিত করে দিয়ে যান। ঠিক এমন দৃষ্টিকোণ্‌ থেকেই তিনি আলোচনা করেছেন উমর

এখানে আমি আরেকটি কথা উল্লেখ করতে চাই। শায়খ নদভী এ-ইতিহাস লিখেছেন এমন সব বরাতণ্রস্থের সাহায্য নিয়ে, যেগুলোকে সচরাচর কেউ কোনো বরাতগরন্থই মনে করে না।

পরবর্তীতে এ-সিরিজে যুক্ত হয়েছেন ইমাম সারহান্দি, যিনি মুজাদ্দিদে আলফে সানী হিসাবে অধিক পরিচিত, হাকীমুল ইসলাম মহান সংস্কারক আহমদ ইবনে আবদুর রহিম, যিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহ নামে অধিক প্রসিদ্ধ এবং সবশেষে যুক্ত হয়েছেন আল্লাহর পথের মহান বীর ও মুজাহিদ শহীদ আহমদ ইবনে ইরফান, যিনি সায়্যিদ আহমদ শহীদ নামে বেশী প্রসিদ্ধ। শায়খ নদভী রহ. এর গর্বিত পূর্ব পুরুষ তিনি। যে খান্দানের পূর্ব পুরুষেরা হিন্দুস্তানের আকাশে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে জুলছে।

শেষ দিকে ০০, (চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রা. এর জীবনেতিহাস) গ্রন্থটি লিখে ইসলামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং অনেক অজানা প্রশ্নের সৃক্ষ ও সুন্দর জবাব দিয়েছেন।

পাঠক! মোদ্বাকথা হলো; ইসলামের ইতিহাস ছিলো শায়খ নদভী'র বড়ো প্রিয় বিষয়। এ জন্যেই লক্ষ্য করবেন যে, ইসলামের ইতিহাসের বর্ণোজ্বল আকাশে দেদীপ্যমান 'রবি-শশী-গ্রহ-তারা'দের নিয়ে লিখেছেন__ তীর একান্ত নিজস্ব বর্ণময় উপস্থাপনায় । যাদের কেউ ছিলেন ইলম ও তত্ব দর্শন এবং ফিকির ও চিন্তা-দর্শনের দিকগাল। যেমন ইমাম গাযালী ও ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. আর কেউ ছিলেন ইসলাহ ও সংস্কার আন্দোলনের এবং আত্মার জগতের রাহবার ও দিক দিশারী। যেমন মুজাদ্দিদে আলফে সানী ও শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী রহ. । কেউবা ছিলেন জিহাদ ও রাজনীতির ময়দানে সিপাহসালার ও দিক দিশারী । যেমন উমর ইবনে আবদুল আযিয ও সালাহুদ্দীন আইয়ূবী রহ. ৷

শায়খ নদভী ও ফিক্হ[সম্পাদনা]

কিন্তু ফিক্হ নিয়ে শায়খ নদভী লিখেন নি। যদিও এ বিষয়েও তিনি যথেষ্ট পড়াশুনা করেছিলেন। তার কালজয়ী গ্রন্থ ৬4)৬। ১4। (আরকানে আরবাআ বা চার স্তস্ত) সালাত, সিয়াম, যাকাত ও হজ্-এর হাকিকত ও তাৎপর্য এবং মানুষের মনে-সমাজে-জীবনে তার প্রভাব সম্পর্কে তিনি এই গ্রন্থে অনবদ্য আলোচনা করেছেন। এখানেও তিনি ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো আলোচনা করেন নি। অর্থাৎ এ-কিতাবের ভাষা ও উপস্থাপনা _ “দাঈ ও মুরুববী'র ভাষা ও উপস্থাপনা, মোটেই নয়__ কোনো “ফকীহ'-এর ভাষা ও উপস্থাপনা ।

এমনটা কেনো হলো? কী এর রহস্য? ... আমার কাছে মনে হয় এর কারণ হলো-_ গভীরে প্রবেশ করেন নি।

দুই, তার লেখক-সন্তার বিশেষ অনুরাগ মিশেছিলো ফিকহের আনুষঙ্গিকতা ও টুকরো কথার তুলনায় দাওয়াত ও চিন্তা-দর্শনের সাথে।

তিন, তীর প্রচণ্ড আল্লাহভীতি ও তাকওয়াবোধও এ ক্ষেত্রে একটি অন্যতম কারণ । অর্থাৎ হালাল-হারামের ব্যাপারে ফতওয়া দেয়ার মতো

কঠিন দায়িত্ব ও ঝুঁকি তিনি নিতে চান নি। তাই এ থেকে তিনি নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখেছিলেন। এ জনেই আমরা লক্ষ্য করেছি যে, 'রাবেতায়ে আলমে ইসলামী" -এর “ফিকাহ একাডেমী এর তিনি একজন গুরুতৃপূর্ণ সদস্য হওয়া সত্তেও ফিকাহ নিয়ে সেখানে তিনি কোনো আলোচনার অবতারণা করেন নি এবং কোনো কিছুই লিখেন নি। তাই আমার মনে হয় _-লেখালেখির ক্ষেত্রে তার চিন্তাধারাটা সম্ভবত ছিলো এই-_ ইচ্ছে করেই তিনি ফিকহী গবেষণায় মনোযোগ দেন নি। এ-বিষয়টি বরং তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন ফিকাহ শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ও পারদরশী-_ এ-ময়দানের যাবতীয় শর্ত পূরণকারী কোনো মুফতি'র দায়িত্বে

কিন্তু এ ক্ষেত্রে মুহাম্মদ আল-গাযালী ছিলেন তার চেয়ে ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন প্রথম সারির একজন দাঈ। দাওয়াত মিশেছিলো তীর রক্তে-মাংসে। চিন্তায়-চেতনায়। অনুভব-অনুভূতিতে। তবুও ফিকাহ শাস্ত্রে প্রবেশ করতে মোটেই তিনি কুপ্ঠিত হন নি। এমন কি অনেক ফিকহী মাসআলায় তিনি বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছেন। এ জন্যে অনেকেই তার উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং তার অনেক মতামতকেই মেনে নিতে পারেন নি। আর তাদের সংখ্যাটাও বেশ ভাবিয়ে তোলার মতো। তার যে সব বিষয় ও বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক ও মতভেদের সূচনা হয়েছে তার কিছু ছিলো এই-

১. হা, ১

ই ৬১৯ টা ৬০৩১ ১৯ ৩৯ আচ

৩, সি

8. ৬৯১১০

ই পার এত নেন নি। বিশেষত তার ৬4 ১ 4 ৭ ০৪ ১৮। ০4 খরস্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর। অপরদিকে শায়খ নদভী এ-ধরনের যুদ্ধে অবতীর্ণ হন নি। ফলে তার মতাদর্শ নিয়ে কোনো বিভাজনও তৈরী হয় নি। তিনি বরং মনে-প্রাণে চাইতেন বন্ধন__ হৃদয়ে-হৃদয়ে। যা গড়ে উঠবে প্রধানত ঈমানী ভ্রাতৃত্বের উপর । ইবাদতের নিষ্ঠার উপর। সুকুমারবৃত্তির অবিচলতার উপর । আল্লাহ্‌র কাছে জীবনে-মরণে দায়বদ্ধ থাকার দৃঢ়তার উপর ।

এখানে এসেই দু'টি নদীর প্রবাহ একটিমাত্র মোহনায় মিশে যায়; অর্থাৎ শায়খ নদভী এবং শায়খ হাসানুল বান্না ছিলেন এ ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। হাসানুল বান্নাও শায়খের মতো চাইতেন ভাঙার বদলে শুধু গড়তে এবং বিচ্ছিন্নতার বদলে শুধু এক্যবদ্ধ করতে । হাসানুল বান্না'র প্রসিদ্ধ নীতির একটি নীতি ছিলো-_ মা ৩ ৩০ হজ আস ফল (সি ও ০৮] ২৯০১ ইল 0৮ এ? ১৮ 0৪ 98 ১১ দল ৩ এক এস ৬ ২১০০ আত ভিত ৬৮ এ এপি ও প্ড৯০ ৩০ ৩১৮ ৯৬৬ তৈত উত এ্রএত ১ ১00 ৮৮০১ ৪৬ উস সা এ ০ ও ও ভা “শরীয়তের হুকুম-আহকাম ও বিধি-বিধানে পূর্ণতা অর্জন না-করা পর্যন্ত এবং সঠিক পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা হাসিল না-করা পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলমানের উচিত যে কোনো একজন ইমামের অনুসরণ করা। আর উক্ত ইমামের দলিল প্রমাণ সম্পর্কে সাধ্য অনুযায়ী অবহিত হওয়াটা একান্ত বাঞ্চনীয়। শরীয়তের মানদণ্ডে উক্ত ইমাম যদি “অনুসরণীয়' হওয়ার যোগ্য হন, তাহলে তার সকল দিক নির্দেশনাই মেনে চলতে হবে। কেউ যদি 'আহলে ইলম" হন, তাহলে ইলমের ক্ষেত্রে তার সকল শূন্যতা দূর করে পূর্ণতা অর্জনে অবশ্যই তাকে সচেষ্ট হতে হবে। ধাপে ধাপে শরীয়তের হুকুম-আহকাম ও বিধি-বিধান সম্পর্কে পূর্ণতা অর্জন করতে হবে এবং সঠিক পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও অর্জন করতে হবে।" �

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পুরস্কার[সম্পাদনা]

[সম্পাদনা]

মাওলানা আলী মিয়া ও , দেশী-বিদেশী পুরক্ষারসমূহ

হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী জীবদ্দশায় বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও দেশী পুরস্কীর ও সম্মাননা লাভ করেন। ভারত সরকারের দেয়া একটি পুরস্কার তিনি গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ২০০০ সালে দিল্লী 'হতে হযরত মাওলানা আলী মিয়াকে মরনোত্তর শাহ ওয়ালী উল্লাহ এওয়ার্ড দেওয়া হয়। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হল -

বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার[সম্পাদনা]

স্ববথম ও সবচেরে উল্লেখযোগ্য ছিল শাহ ফয়সল পুরক্কার। মুসলিম বিশ্বে ফয়সল পুরস্কারের মর্যাদা সাধারণভাবে নোবেল প্রাইজের মত। নিয়ম অনুায়ী পুরস্কার কমিটির পক্ষ থেকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিত্ব ও সংস্থার নিকট এমর্মে মতামত চাওয়া হয় যে, আপনার/ আপনাদের মতে এ পুরস্কার লাভের যোগ্য কে? যার পক্ষে অধিক মতামত পাওয়া যায়, তার নামেই সিদ্ধান্ত হয়। পুরস্কারের পরিমাণ নগদ দুই লাখ রিয়াল, একটি পদক ও সনদপত্র । সনদপত্রে পুরস্কার প্রাপকের অসাধারণ কর্মকান্ড ও অবদানের স্বীকৃতি থাকে । একটি অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। সৌদী বাদশাহ, যুবরাজ, মন্ত্রীবর্গ এবং বিশিষ্ট আলেম ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এতে অংশথহণ করেন।

২৪শে সফর ১৪০০হিজরী, মোতাবেক ১৪ই জানুয়ারী ১৯৮০ খৃঃ থেকে ২৬ই সফর ১৪০০ হিঃ, মোতাবেক ১৬ই জানুয়ারী ১৯৮০ খুঃ পর্যন্ত নির্বাচন কমিটির মিটিং হয় এবং পুরস্কার প্রাপকদের নামের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। পুরস্কার কমিটির সভাপতি আমীর খালেদ ফয়সল ইবনে আবদুল আবীযের পক্ষ থেকে টেলিথ্াম আসে দারুল উলূম নদওয়াতুল_উলামা লাখনৌতে। এতে হযরত মাওলানাকে রিয়াদে এসে উক্ত পুরস্কার গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়। একই সাথে সৌদী আরব থেকে বেশ কয়েকটি অভিনন্দন বার্তাও আসে । সর্বপ্রথম অভিনন্দনের টেলিগ্রাম আসে শায়খুল হাদীছ হযরত মাওলানা যাকারিয়া রেহ.)-এর পক্ষ থেকে। সৌদী রেডিও মারফত অবগত হয়ে জনৈক ভক্ত তা হযরত শায়খুল হাদীছকে অবহিত করলে তিনি তৎক্ষণাৎ তার পক্ষ থেকে হযরত মাওলানা নদতীকে মোবারকবাদ জানিয়ে টেলিগ্রাম করার নির্দেশ দেন। কেননা তিনি আশংকা করেছিলেন যে, মাওলানা আলী মিয়া নদভী এ পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। তাই টেলিগ্রামের মাধ্যমে হযরত শায়খুল হাদীছের মনোভাবের প্রতি মাওলানা. আলী মিয়া নদভীকে ইজিত দেওয়া হয়।

সৌদী আরব সরকারের শিক্ষামন্ত্রী শায়খ হাসান আবদুল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত মাওলানা আলী মিয়ার নিকট এক বিশেষ টেলিথাম আসে। তাতে তিনি হযরত মাওলানাকে এমর্মে অনুরোধ করেন যে, আপনি আমার খাতিরে পুরস্কার গ্রহণ করবেন। কিন্তু এতসব সত্তেও হযরত মাওলানা আলী মিয়া মনস্থির করেন যে, ডক্টর আবদুল্লাহ আব্বাস নদভীকে তীর প্রতিনিধি নিযুক্ত করবেন। ডক্টর নদতীই তার পক্ষ থেকে পদক ও পুরস্কার গ্রহণ করবেন।

এতদুপলক্ষে পুরক্কার কমিটির সভাপতির নামে হযরত মাওলানা আলী মিয়া নদভী এক পত্র প্রেরণ করেন। এতে তিনি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পর লেখেন-উত্তম হত দ্বীনের সেবকদের পুরস্কার তাদের দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পরে পাওয়া । কিন্তু আমার অজ্ঞাতসারে এ ঘোষণা হয়েছে। এখন আমার পক্ষে মরহুম বাদশাহ ফয়সল (যার সাথে এ. পুরস্কার সম্পৃক্ত) এর ইসলামের মহান খেদমতসমূহের স্বীকৃতি ও সম্মানের খাতিরে এ পুরস্কার গ্রহণ না করে এবং এমর্মে দু'আ না করে উপায় নেই যে, পুরস্কার যেসব ইঙ্গিত ও তাৎপর্য বহন করে তা যেন সম্পন্ন হয়। আমি স্বয়ং উপস্থিত হতে পারছি না । আমার দ্বীনী ভাই ডক্টর আবদুল্লাহ আব্বাস নদ্ভীকে আমি আমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করছি। তিনি তা গ্রহণ করবেন এবং আমার পক্ষ থেকে সালাম ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবেন।

তিনি আরো লিখলেন- এ পুরস্কারের দু'টি দিক রয়েছে। একটি হল অন্ত নিহিত তাৎপর্য। অর্থাৎ সম্মান ও শ্বীকৃতি। আমি তা শরম ও লজ্জার সাথে গ্রহণ করছি। আরেকটি. হল আর্থিক দিক। অর্থাৎ এর সাথে যে নগদ অর্থ পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে আমি আপনাদের অনুমতি প্রার্থনা করছি যে, আমি উক্ত অর্থ নিজের বিবেচনা অনুযায়ী ইসলামের স্থার্থে ও দ্বীনী খেদমতের খাতে ব্যয় করব। ডক্টর আবদুল্লাহ আব্বাস নদভী উক্ত খাতসমূহের ঘোষণা দেবেন।

পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান হয় ১২ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮০ রিয়াদের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ফয়সল হলে রাত আটটায়। বাদশাহ খালেদ ইবনে আবদুল আধীষের ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে যুবরাজ ফাহাদ ইবনে আবদুল আযীয বের্তমান বাদশাহ) অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। কয়েকজন যুবরাজ, মন্ত্রীর্গ ও রিয়াদের গভর্ণর এতে অংশ গ্রহণ করেন। ফাহাদ ইবনে আবদুল আযীয পুরস্কার প্রদান করেন। পুরস্কার প্রাপকদের জীবনালেখ্যও পাঠ করা হয়। অনুষ্ঠানে ঘোষণা করা হয় যে, সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী তীর প্রতিনিধি হিসেবে ন্টর আবদুল্লাহ আব্বাস নদভীকে নিযুক্ত করেছেন। তিনি হযরত নদভীর পক্ষে পদক, সনদ ও পুরস্কার গ্রহণ করবেন। ,সেমতে ডঃ আব্দুল্লাহ নদী তা গ্রহণ করেন। তিনি হযরত মাওলানার পত্র পাঠ করে শোনালেন এবং ঘোষণা করলেন যে, পুরস্কারের অর্থের অর্ধেক আফগান শরণাী্দের জন্য, এক চতুর্থাংশ জামায়াতে তাহফীজুল কুরআনিল কারীমের জন্য, যার তন্বাবধায়ক শায়খ সালেহ কাষযায (সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল, রাবেতা আলমে ইসলামী) এবং অপর এক চতুর্থাংশ মন্কার মাদরাসায়ে সৌলতিয়ার জন্য ব্যয় করা হবে।

একই অনুষ্ঠানে আরো একজনকে সাহিত্য ও গবেষণা কর্মের জন্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। তিনি ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও রাবেতার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ডক্টর মুহাম্মাদ নাসের । তিনি স্বয়ং উপস্থিত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন।

এ উপলক্ষে হযরত মাওলানার অজ্ঞাতসারেই দারুল মুসান্নিফীনের নাজেম সাইয়েদ সাবাহুদ্দীন আব্দুর রহমান এক সর্ধনা সভার আয়োজন করেন। সম্বর্ঘনার জবাবে হযরত মাওলানা তাঁর প্রথম জীবনের ঘটনা স্মরণ করেন, যখন ১৯৩১ সালে তিনি নিজ উত্তাদ আল্লামা তাকিউদ্দীন হেলালীর সাথে দারুল মুসান্নিফীনে আগমন করেছিলেন এবং যংসামান্য সম্মানীর বিনিময়ে এখানে কাজ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু তখন তাঁকে উপযুক্ত বিবেচনা করা হয়নিঃ অথচ এখন ত্বাকে সে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই স্ব্ধনা দেওয়া হচ্ছে। তেমনি দ্রারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার পক্ষ থেকেও একটি সব্ঘ্ঘনা সভার আয়োজন করা হয়। ূ

কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির সম্মানজনক ডিশ্নী (১৯৮১)[সম্পাদনা]

১৯৮১ সালে কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদীকে ডক্টর অব লিটারেচারের সম্মানজনক ডিম্রী প্রদান করা হয়। ১৬ই অক্টোবর ১৯৮১ হযরত মাওলানা যখন হজ্জ ও রাবেতার সভা

থেকে দেশে ফিরে আসেন তখন তিনি এ সংবাদ পান। ডিগ্রি প্রদানের তারিখ ছিল ২৯শে অক্টোবর ১৯৮১। এ ব্যাপারে জন্মু কাশ্নীরের গভর্ণর বি.কে.নেহেরু কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর অহীদুদ্দীন মালিক ও প্রফেসর আলী আহমাদ সরওয়ারের পক্ষ থেকে হযরত মাওলানার নিকট পত্র ও টেলিফোন আসে এবং অবিলম্বে সম্মতি জ্ঞাপনের অনুরোধ জানানো হয়। হযরত মাওলানা বলেন আমার জন্য এ আকস্মিক সংবাদ ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তাই তিনি দ্িধাদ্ন্দে পড়ে যান। অতঃপর নিজের ঘনিষ্ঠজনদের সাথে পরামর্শের পর এ শর্তে সম্মত হন যে, অনুষ্ঠানটি হতে হবে নিছক একাডেমিক ও সাহিত্যকেন্দ্িক। কোন প্রকারের. রাজনীতির সাথে দূরতম সম্পর্কও থাকতে পারবে না। ইতিপূর্বে সাইয়েদ সুলায়মান নদভী, নওয়াব সদর ইয়ার জঙ্গ, মাওলানা হাবিবুর রহমান খান শিরওয়ানী ও আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদীকে আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে এবূপ ডিশ্রী দেওয়া হয়েছিল। তীরা তা গ্রহণ করেছিলেন । হযরত মাওলানা এসব নজীর স্মরণ করেই সম্মত হয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি চিন্তা করলেন, এই সুযোগে তিনি আধুনিক শিক্ষাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বুদ্ধিজিবী এবং দেশের কর্মকর্তাদের সামনে জ্ঞানী ও বিদ্বানদের সম্পর্কে নিজের মনোভাব ও পরামর্শ পেশ করতে পারবেন। একজন দায়ী হিসাবে এ সুযোগ হাতছাড়া করা তিনি সমীচীন মনে করলেন না।

২৯শে অক্টোবর ১৯৮১ কনভোকেশন হুল সভাপতি ছিলেন গভর্ণর বি.কে. নেহেরু এবং .বিশেষ অতিথি ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী শেখ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ অনুষ্ঠানে ইউনিভার্সিটি গ্ান্টস কমিশনের চেয়ারম্যান ডক্টর মাধুরী আরশগও উপস্থিত ছিলেন তাকেও ডক্টরেট দেওয়া হয়েছিল ।

এতদুপলক্ষে হযরত মাওলানা যে বক্তৃতা পেশ করেন তার শিরোনাম ছিল “ইলম কা মাকাম আওর আহলে ইলম কি জিম্মাদারিয়া'। যেহেতু এটি ছিল বিদ্যায়তনিক অনুষ্ঠান তাই তিনি সুযোগের সদ্যবহার করেন এভাবে যে, বক্তৃতার শুরুতে তিনি প্রথমে ওহীর আলোচনা করলেন, যাতে একজন উদ্ধী বা নিরক্ষর ব্যক্তির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাষায় একটি নিরক্ষর জাতির সামনে' এ সত্য ঘোষণা'করা হল যে, জ্ঞানের যাত্রা শুরু করা উচিত সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময় ত্রষ্টার নির্দেশনা মোতাবেক । কেননা এ অভিযাত্রা অতি দীর্ঘ পথের জটিল ও দুর্গম। অতঃপর এ ওয়াহীতে কলমের কথাও ভুলে যাওয়া হয়নি। অথচ গোটা মক্কায় তা পাওয়া যেত না । ঘোষণা করা হল যে, জ্ঞান ও বিদ্যার সম্পর্ক কলমের সাথে এবং এই উন্মী নবীর (সা.) নবুওয়াত প্রাপ্তির


ফলে যে জাতির উন্মেষ ঘটবে তা কলম ঘারা পূর্ণ “সহযোগিতা নেবে। অতঃপর এ.বিপ্রবী ও অবিনশ্বর সত্যও বর্ণনা করা হয়েছে যে, জ্ঞানের কোন শেষ নেই। অতঃপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের দায়িত্বের উপর আলোকপাত "করেন এবং বলেন-বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রথম কাজ চরিত্র গঠন। তিনি আরো বলেন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উচিত নিজ শিক্ষার্থী ও ন্নাতকদের এমন চরিত্র গঠন করা যে, তারা নিজেদের বিবেককে ইকবালের ভাষায়, এক মুষ্টি গমের বিনিময়ে বিক্রি করতে সম্মত হবে না। বৃর্তমান কালের দর্শন ব্যবস্থার মতে বাজারে প্রত্যেকটি বস্তুর নির্ধারিত মূল্য রয়েছে। কোন বন্ত যদি স্বল্পমূল্যে খরিদ করা না যায় তাহলে অধিক মূল্যে খরিদ করা যাবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত সাফল্য হল, ভা চরিত্র গঠনের কাজ করবে। তা এমন বিছবান ব্যক্তি সৃষ্টি করবে যারা নিজেদের বিবেককে বিকিয়ে দেবে না- যাদেরকে বিশ্বের কোন শক্তি, কোন ধ্বংসাত্মক দর্শন, কোন অসার আন্দোলন কোন মূল্যেই খরিদ করতে পারবে না।

দ্বিতীয় কর্তব্য হলো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ থেকে এমন যুবকরা বের হবে, যারা নিজেদের জীবনকে ন্যায়, সততা, জ্ঞান ও সৎপথের জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকবে। যারা অন্যের জন্য উপোস থাকতে তেমনই আনন্দ অনুভব করবে, কেউ কেউ উদরপূর্তিতে যেমনটি অনুভব করে থাকে। যারা তাদের যৌবনের শ্রেষ্ঠ সামর্থ্য মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ যোগ্যতা ও নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবেত্তিম দান (যা তাদের ঝুলিতে তরে দেওয়া হয়েছে) মানবতাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাচানোর জন্য ব্যয় করবে।

উন্নত মানবীয় জীবনযাপনের মৌলিক উপায়হল খোদাভীতি, মানবপ্রেম, আত্মসংবরণের সাহস ও যোগ্যতা, ব্যক্তিস্বার্থের উপর সামষ্টিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া অভ্যাস, মানবতার সম্মান, মানবীয় জীবন, সম্পদ, সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার উদ্যম, প্রাপ্ত দাবীর চেয়ে দায়িত্ব পালনকে অগ্রাধিকার নিপীড়িত ও দুর্বলদের সাহায্য-সহযোগিতা, অত্যাচারী ও শক্তিমানদের বিরদদ্ধে লড়াইয়ের সাহস, যেসব মানুষের সম্পদ ও পদবী ছাড়া কোন পুঁজি নেই তাদের প্রতি নির্ভয়, সর্বক্ষেত্রে এবং নিজ সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সত্য কথা বলার সাহস, নিজের ও অপরের সাথে আচরণে সমতা ও ন্যায় বিচার কোন সর্বজ্ঞ .ও সব্রষ্টা শক্তির .তন্ত্বাবধানের বিশ্বাস এবং তার নিকট জবাদিহিতা ও হিসাবের আশংকা এই হল বিশুদ্ধ সুস্থ, নিরাপদ ও সফল জীবন যাপনের মৌলিক শর্ত এবং একটি সুখী সুন্দর সমাজ ও একটি শক্তিশালী সার্বভৌম সম্মানিত রাষ্ট্রের প্রকৃত চাহিদা এবং তা রক্ষার গ্যারান্টি।

আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাঁসান আলী নদর্ভী রহ. - ২৩০

এসবের শিক্ষা এবং এজন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি ক্রা বিদ্যায়তনগুলোর প্রাথমিক দায়িত্ব । এরাপ উপলক্ষসমূহে আমাদের দেখতে হবে এ দায়িত্ব সম্পাদনে আমাদের বিদ্যায়তনগুলো কতটুকু সফল এবং তা থেকে সফলতা অর্জনে আমরা কি কি পরিকল্পনা নিয়েছি, কি কি ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছি।

হযরত মাওলানার বৃতার পর যখন গভর্ণর বি.কে. নেহরু বক্তৃতার জন্য . দীড়ালেন, তখন তিনি বললেন আমি অনেক সনদ বিতরণ সভায় অংশগ্রহণ করেছি, কিন্তু এমন প্রেরণাদায়ক ভাষণ শুনিনি। এ ভাষণ উদ্দুতে ছেপে কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী শেখ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহর নিকট পাঠানো হলে তিনি এক জবাবী পত্র লেখেন। তাতে তিনি বলেন, উক্ত সভায় আপনার আগমন ও সুচিন্তিত উপায়ে সমকালীন সমস্যাবলীর সত্যাশ্রয়ী পর্যালোচনার প্রতিধ্বনি এখনো শোনা যাচ্ছে। ইসলামী শিক্ষার আলোকে সমকালীন জীবনের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জটিলতার চিত্রায়ন আপনি যেভাবে করেন, তা একমাত্র আপনারই কীর্তি” ইত্যাদি।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের পুরস্কার (১৯৮৬)[সম্পাদনা]

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক হযরত মাওলানা নদভী (রহ.)-কে অত্যন্ত ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। হযরত মাওলানা তাঁর 'পুরানে চেরাগ" গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, বাদশাহ ফয়সল ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের মত অন্য কোন রাষ্ট্প্রধানের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। হযরত মাওলানা পাকিস্তান সফরে গেলে প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক তাঁর সাথে সাক্ষাৎ লাভে নিজেকে ধন্য মনে করতেন। এমনকি কোন কারণে হযরত মাওলানা যদি ইসলামাবাদে না যেতে পারতেন, তাহলে প্রেসিডেন্ট নিজেই এগিয়ে এসে সাক্ষাৎ করতেন।

হযরত আল্লামা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী (রহ.)-এর বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ সীরাতুন্নবী (সা.)-এর সপ্তম খণ্ডের ভূমিকা লিখেছেন হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)। প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এ ভূমিকা পাঠ করে খুবই অভিভূত হন এবং হযরত মাওলানার, জন্য পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে এক লাখ রূপিয়া পুরক্ষারের ঘোষণা দেন। কিন্ত হযরত মাওলানা তার চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে পত্র লিখে জানান যে, মেহেরবানী করে -এ অর্থের অর্ধেক এ গ্রন্থের প্রকাশক দারুল সুসান্নিফীন আজমগড়কে এবং অবশিষ্ট অর্ধেক করাচীতে অবস্থানরত আল্লামা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী রেহ.)-এর পরিবারের সদস্যদের দিয়ে দিন।


অতঃপর ১৯৮৬ সালের জুন মাসে করাচীতে হযরত মাওলানার সাথে প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সাক্ষাৎ হলে তিনি হযরত মাওলানাকে বলেন- আপনি যদি পুরস্কারের অর্থ গ্রহণ করতেন, তাহলে আমি খুব আনন্দিত হতাম। হযরত মাওলানা পুনরায় তা অস্বীকার করেন।

দুবাই আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব পুরস্কার (১৯৯৯)[সম্পাদনা]

সংযুক্ত আরব. আমিরাতের রাজধানী দুবাইতে প্রতি বছর রমযানুল ২১শে রমযান তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। যারা বিজয়ী হন, তাদেরকে বিরাট বিরাট পুরক্ষারে ভূষিত করা হয়। তাছাড়া বাইরে থেকে যারা এতে অংশগ্রহণ করে তাদেরও সম্মান জানানো হয়। এ উপলক্ষে ইসলামী বিশ্বের কোন ব্যক্তিত্বকে নির্বাচন করে আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এ পুরস্কার নিজ হাতে প্রদান করেন দুবাইয়ের যুবরাজ ও আরব আমিরাতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে রাশেদ ।

এজন্য শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে রাশেদ দুবাইতে একটি কমিটি মনোনীত করেছেন। উক্ত কমিটির দায়িত্ব হলো আল-আজহার ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে আল-আইন ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত আরবের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে তাদের মতামত নেয়া। সেমতে ১৯৯৯ খৃষ্টাব্দে সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানের মতামত চাওয়া হলে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, বর্তমানে ইসলামী বিশ্বের ইলমী ও দ্বীনী ব্যক্তিত্ব শায়খ আবুল হাসান আলী নদভীই এ পুরক্কারের যোগ্য । লাখনৌতে যখন এ সংবাদ পৌঁছে তখন হযরত মাওলানার শরীর খুব খারাপ । তাছাড়া রমযান মাসের কারণে তিনি সফর করতে অস্বীকৃতি, জানালেন । মাওলানা তাকিউদ্দীন নদভী তখন দুবাইয়ের আল-আইন ইউনিভার্সিটির হাদীসের অধ্যাপক ছিলেন। পুরস্কার কমিটির সভাপতি ও অন্যান্য সদস্য মাওলানা তাকিউদ্দীন সাহেবকে অনুরোধ করেন যে। তিনি যেন যে কোন প্রকারে হযরত মাওলানাকে সফরে রাজী করান। সে মতে তিনি টেলিফোনে প্রথমে মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে নদভী ও মাওলানা সায়ীদুর রহমান আজমীর সাথে এবং পরে সরাসরি হযরত মাওলানার সাথে আলাপ করে তাকে রাজী করান। কিন্তু ১০ই রমযানের পর হযরত মাওলানার শরীর আবার খারাপ হয়ে যায়। এমনকি রোযা রাখাও দুষ্কর হয়ে পড়ে।


হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে সাহেব পুনরায় 'জানিয়ে দেন যে, হযরতের পক্ষে সফর করা সম্ভব হবে না। কিন্তু পুরস্কার কমিটি মনে করল, হযরতের অনুপস্থিতির কারণে-অনুষ্ঠানের শোভা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই দুবাই সরকার বিশেষ বিমান পাঠিয়ে হলেও হযরত মাওলানাকে দুবাই: নেওয়ার পরিকল্পনা করে। সেমতে ২০শে রমযান বুধবার লাখনৌ এয়ারপোর্টে বিমান এসে পৌঁছে এবং হযরত মাওলানা ও তীর সাঘীবর্গ সেদিনই দুবাই পৌঁছেন। পরের দিন এশার নামাযের পর দুবাইয়ের এক বিশেষ হলে অনুষ্ঠান শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, উলামায়ে কেরাম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এতে অংশগ্রহণ করেন । যুবরাজ নিজেও উপস্থিত ছিলেন । প্রথমে হযরত মাওলানার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে কয়েকজন বক্তা দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। অতঃপর যথাসময়ে হযরত মাওলানা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন এবং দুবাইয়ের যুবরাজ পুরস্কার ঘোষণা করেন।

হযরত মাওলানা এতদুপলক্ষে খুব সংক্ষিপ্ত অথচ এতিহাসিক বক্তব্য রাখেন। তিনি এ সম্মাননার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার পর .ঘোষণা করেন যে, পুরস্কারের অর্থ দ্বীনী প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য বরাদ্দ করা হবে। এতে শ্রোতারা করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। আরবদের উদ্দেশ্য করে হযরত মাওলানা বলেন আমার জন্ম ভারতের ছোট্ট একটি পল্লীতে । আমার মাতাপিতার চেষ্টায় আল্লাহ তাআলা আমাকে এমন অবস্থানে এনেছেন যে, আপনারা আমাকে সম্মাননা প্রদান করছেন। এজন্য আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি আপনাদের জন্য একটি বার্তা নিয়ে এসেছি যা আল্লামা ইকবালের ভাষায় - .

"আরব বিশ্বের প্রাণশক্তি হলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম” । একথা শুনেই পুরো অনুষ্ঠানে পিনপতন নিস্তদ্ধতা নেমে আসে। শ্রোতাদের চোখে পানি এসে যায়। অনুষ্ঠান শেষ হলে পরের দিন গরীব মসজিদে তিনি জুমআর নামায আদায় করেন। নামাের আগে বিশ মিনিটের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও রাখেন। রাতে সুলতান ইবনে যায়দ আল-নাহিয়ান দেখা করতে আসেন এবং নিজ পিতা যায়দ আল-নাহিয়ানের সালাম পৌঁছে দেন। পরের দিন ২২শে রমযান হযরত মাওলানা তাঁর সাথীবর্গসহ লাখনৌ. ফিরে আসেন!

কাবা শরীফের চাবি (১৯৯৬)[সম্পাদনা]

মহান আল্লাহ রাবুল জালামীনের পক্ষ থেকে যখন কাউকে সম্মান ও মর্ধাদায় ভূষিত করা হয় তখন তা এত বিপুল ও বিশীল হয় যে, স্বয়ং নভোমন্ডলও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়; ফেরেশতারাও উক্ত 'মাটির মানুষ . আদম সন্তানকে ঈর্ধার চোখে দেখতে থাকে । ইতিহাসের পাতায় উক্ত ঘটনার

সুহূত্গুলো স্ব্ণাক্ষরে অংকিত থাকে ৷ এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল ৮ই শাবান ১৪১৭ হিজরী, মোতাবেক ১৮ই ডিসেম্বর ১৯৯৬ বুধবার তোরে বায়তুল্লাহ শরীফের দরজার নিকট। হযরত-

মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী সৌদী আরব সরকারের দাওয়াতে রাবেতা আলমে ইসলামীর মন্কা শাখা এবং রাবেতা মসজিদ বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিটির মিটিং-এ যোগদানের জন্য ১লা শাবান ১৪১৭ হিজরী, মোতাবেক ১২ই ডিসেম্বর ১৯৯৬ মক্কা মুকাররমায় গমন -করেন। সেখানে রাবেতার মিটিংয়ে যোগদানের পর ৮ই শাবান বায়তুল্লাহ শরীফে প্রবেশ করার জন্য উক্ত কমিটির সদস্যদের অনুমতি প্রদান করা হয়। হযরত মাওলানা এ সৌভাগ্য ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার লাভ করেছিলেন। তাই এবার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কেননা তখন তার শারীরিক দুর্বলতা বেড়ে গিয়েছে; তাছাড়া অনেক ভীড় হবে, এবং ভোর সাড়ে ছয়টায় তাকে ওষুধ সেবন করতে হয়। তাই সে সময়ে তার পক্ষে ভীড়ের মধ্যে যাওয়া কষ্টকর । তথাপি তিনি চিন্তা করলেন, এ সুযোগ বার বার আসে না। বয়সের ভারে তার , শরীরের যে অবস্থা তাতে আর কয়বারই বা মন্কী শরীফে আসতে পারবেন তা বলা যায় না। সুতরাং তিনি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সঙ্গে ছিলেন উদ্মান সাহেব, হাজী আবদুর রাজ্জাক ও মাওলানা বেলাল হাসানী। প্রথমে তিনি অত্যন্ত ভীড়ের কারণে কাবা শরীফ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। অতঃপর কাবা শরীফের দরজার সাথে লাগানো সিঁড়িতে গিয়ে বসলেন। : কেননা কাবার চাবিবাহক শায়বি সাহেব তখনো আসেননি। শারবী, সাহেব , হলেন হযরত উছমান ইবনে তালহা (রা.)-এর বংশধর। হযরত উছমান ইবনে তালহা শায়বী (রা.)-কে স্বয়ং মহানবী (সা.) কাবা শরীফের চাবি অর্পন করেছিলেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত তার সন্তানেরা উক্ত চাবি বহন করবে বলে ঘোষণা করেছিলেন। সেমতে আজ পর্যন্ত এ পবিভ্র ও সম্মানিত আমানত ও সম্মান পর্যায়ক্রমে তারই বংশধরেরা বহন করে এসেছেন। মহা পরাক্রমশালী সম্রাট হোক কিংবা সাধারণ বিয়ারতকারী হোক কাবা শরীফে

ব্রুনাই এওয়ার্ড (১৯৯৬)[সম্পাদনা]

১৯৯৬ সাল থেকে ইসলামী শান্ত্রসমূহের কোন একটি শীখায় বিশেষ অবদানের জন্য অক্সফোর্ড সেন্টার অফ ইসলামিক স্টাডিজ এর মাধ্যমে কোন ব্যক্তিত্বকে ক্লুনাই সুলতান আলহাজ্জ হাঁসান বলবিয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। ইসলামী ফেকাহের খেদমতের জন্য আল্লামা ইউসুফ কারজাতী, হাদীছ শরীফের খেদমতের জন্য আল্লামা আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) ও তাফসীরের খেদমতের জন্য মিসরের একজন প্রখ্যাত আলেমকে এক এক বছর এ পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। ১৯৯৯ খৃষ্টাব্দ মোতাবেক ১৪২০ হিজরীতে ইসলামী ব্যক্তিত্বসমূহের ইতিহাস রচনা ও বিশ্লেষণে বিশেষ অবদান ও ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীকে এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়। মার্চ মাসের দিকে তাঁর নাম নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয় এবং অক্সফোর্ড সেন্টার অব ইসলামিক স্টাডিজের সহসভাপতি ডক্টর আবুল্লাহ উমর নাসীফ ও ডক্টর ফারহান নেযামী টেলিফোনে হযরত মাওলানাকে সংবাদ ও অভিনন্দন জানান। পুরস্কার প্রদানের তারিখ নির্ধারিত হয় ২০শে জুলাই । কুনাই গিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করাই নিয়ম। কিন্তু অক্সফোর্ড সেন্টারের দায়িতৃশীলগণ হযরত মাওলানার অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে অনুষ্ঠানের স্থান নির্ধারণ করেননি । তারিখ নিকটবর্তী হয়ে গেলে স্বয়ং হযরত মাওলানার অবস্থানস্থল নদওয়াতুল উলামা লাখনৌকে নির্ধারণ করা হয়। এজন্য ব্রুনাইয়ের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ব্রুনাই সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী জনাব পায়হান আব্দুল আধীযকে সুলতান আলহাজ্জ হাসান বলখিয়ার প্রতিনিধি মনোনীত করা হয়। তিনি নদওয়ায় উপস্থিত হবেন বলে হযরত মাওলানাকে জানান হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, তিনি ২০শে জুলাই সকাল ১০টায় লাখনৌ পৌছুবেন। ১২টায় পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠান হবে। তারপর তিনি হযরত মাওলানার সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে আসরের সময় দিস্লী ফিরে যাবেন।

সেমতে লাখনৌতে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ জানা যায় যে, ভারত সরকার তার নিরাপত্তার অজুহাত তুলে তাকে লাখনৌ যেতে আপত্তি জানায়। হযরত মাওলানার সাথে সাক্ষাত করতে কিংবা কোন সম্মানজনক অনুষ্ঠানে কোন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কোন ব্যক্তির আগমনে বাঁধা সৃষ্টির ঘটনা এ ছিল প্রথম। অথচ ক্রনাইয়ের সাথে ভারত সরকারের সুসম্পর্ক ছিল। কিছুদিন যাবত সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ মনোভাবের লোকেরা হযরত “মাওলানার নামে নানা দুর্নাম ছড়াতে থাকে । বিশেষ করে তখন কেন্দ্র ও প্রদেশ উভয় স্থানে এমন ব্যক্তিরাই ক্ষমতাসীন ছিল। এজন্য তাদের নিকট এটি মোটেই পছন্দ হয়নি যে, হযরত মাওলানাকে এভাবে এ ধরণের সম্মান জানান হোক।

. অথচ লাখনৌর পরিস্থিতি তখন মোটেই এরূপ ছিল না যে, 'একজন বিদেশী মেহমান একজন ভারতীয় মণীধীকে সম্মান জানাতে আসবেন আর তার নিরাপত্তা বিশ্লিত হবে।.কেননা এ সম্মান শুধু হযরত মাওলানার ছিল না, বরং তা ভারতেরও সম্মান ছিল। এজন্য ভারত সরকারের উচিত ছিল রাষ্রীয় পর্ষায়ে ব্রুনাই সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা।

যাই হোক ক্রুনাই হাই কমিশন শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত করে যে হযরত মাওলানা দিল্লী গিয়ে এ পুরস্কার গ্রহণ করবেন কিন্তু- হযরত মাওলানার স্বাস্থ্য এতই খারাপ ছিল যে, তার পক্ষে দিল্লী পর্যন্ত সফর করাও সম্ভব ছিল না। তাই তিনি অপারগতা - প্রকাশ করেন। ক্রুনাই হাই কমিশন তখন হযরত মাওলানার কোন নিকটাত্রীয়কে প্রতিনিধি মনোনীত করার প্রস্তাব দেন। সেমতে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে' হাঁসানীর নেতৃত্বে ছয়জনের একটি প্রতিনিধি দল ১৯শে জুলাই দিল্লী পৌছে। ২০শে জুলাই দিল্লীর রিজেন্সি হোটেলের হল রুমে এ অনুষ্ঠান হয়। অক্সফোর্ড ইসলামিক সেন্টারের ডাইরেক্টর ডক্টর ফরহান নেষামী, ক্রুনাই ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর পায়হান আবু বকর, শায়খে আজহারী আর রহমান প্রমুখ এতে অংশ গ্রহণ করেন। ডক্টর ফরহান নেযামী উদ্বোধনী ভাষণ দেন। .

অতঃপর পায়হান আবদুল আজীজ ভাষণ দেন। এতে তিনি পুরস্কারের তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। তিনি নদওয়ায় উপস্থিত হতে না পারার জন্য - ছুঃখ প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে সুযোগমত নদওয়ায় উপস্থিত হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। অতঃপর. একটি একটি করে দু'টি পদক ও পুরস্কারের নগদ অর্থের খাম মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে' হাসানীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। পদকে হযরত মাওলানার নাম, সুলতান বলখিয়ার নাম ও অক্সফোর্ড সেন্টারের নাম খোদাই করা ছিল। মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে' তখন মনত মহোৌদয়কে হযরত মাওলানার পত্র হস্তান্তর করেন।

সেদিনই ভারতীয় পত্র পত্রিকায় পুরস্কারের সংবাদ ছাপা হয় এবং ভারত সরকারের আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এ পুরস্কারের মূল্যমান ছিল ভারতীয় মুদ্রায় ২০ লাখ রূপী। এ অর্থ তিনি শুভানুধ্যায়ী ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠান সমূহের জন্য দান করে যান।

বহির্বিশ্বে নদভী[সম্পাদনা]

[সম্পাদনা]

বহির্বিশ্বে হবরত মাওলানা আলী মিয়া হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদী (রহ.)-এর পুরো জীবনটাই ছিল সফর। দ্বীনী দাওয়াত ও পয়গাম নিয়ে উম্মতের দরদে তিনি ভারতের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতেন। কোন স্থান হতে ডাক এলে তিনি আর বসে থাকতে পারতেন-না। দ্বীনের উপর কোন স্থানে হামলা হলে তিনি ছুটে যেতেন সে এলাকায় । তার এই দ্বীনী ও দাওয়াতী সফর শুধু ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তিনি সারা পৃথিবীতে তাঁর এই সফর জারী

রেখেছিলেন আলোচ্য অধ্যায়ে বহির্বিশ্বে হযরত মাওলানার প্রধান দাওয়াতী কার্যক্রমগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল।

সৌদী আরব (১৯৪৭)[সম্পাদনা]

হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর আরব বিশ্বের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী এবং সাহিত্যিক মহলের মধ্যে দাওয়াতের কাজ পরিচিত করার উদ্দেশ্যে নিযামুদ্দীন মারকায হতে হযরত মাওলানাকে সৌদী আরবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ইতিপূর্বে অবশ্য হ্যরত . মাওলানা উবায়দুল্লাহ বলিয়াভী সাহেব (রহ.) এ কাজেই সৌদী আরবে অবস্থান করছিলেন। অবশ্য কাজ তখন শুধুমাত্র ভারত ও পাকিস্তান প্রবাসী মুসলমানদের মধ্যে এবং সাধারণ আরবদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আরবী ভাষা ও সাহিত্যের ময়দানে হযরত মাওলানার পদচারণার জন্য এ নির্বাচন খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল ।

. হযরত মাওলানা (রহ.) ১৯৪৭ সালের ১৯শে জুলাই, ১৩৬৬ হিজরী ২৯শে শারান এ উদ্দেশ্যে জেদ্দা পৌঁছেন। রমযান শুরু হয়ে যায়। হযরত ' মাওলানা প্রথমে তিনমাস মদীনায় অবস্থান করেন এবং মদীনার উচ্চ শিক্ষিত সমাজে দাওয়াতের কাজের পরিচয় তুলে ধরেন। ২০শে জিলকদ তিনি হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ রওয়ানা হন; হজ্জের পর মক্কা শরীফেও তিলমাস অবস্থান করে দাওয়াতের কাজকে সুধী সমাজের সামনে তুলে ধরেন। হযরত মাওলানা সেখানকার আরবী সাহিত্যের বড় ঝড় আলেম এবং জ্ঞানী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি তার ব্যক্তিত্বকে তাদের সামনে তুলে ধরতে সমর্থ হন।

১৯৫০ সালের ঠা সেপ্টেম্বর তিনি ২য় বার হজ্জের জন্য তার পীর ও মুর্শেদের সাথে সৌদি আরব রওয়ানা হন। হজ্জের পর তিনি বেশ কয়েক মাস মদীনা ও মক্কা শরীফে অবস্থান করেন। এ সময় তিনি সৌদী আরবে পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাবের উপস্থিতি উপলব্ধি করেন। ফলে তিনি তার সকল মজলিসে মুসলমানদের জন্য পশ্চিমা জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করাটা আত্মঘাতী কাজ হবে বলে আরব দুনিয়াকে সতর্ক করেন। তিনি সৌদি সাহিত্যিক ও কলমিষ্টদের বিভিন্ন সেমিনারেও ভাষণ দেন। সৌদি রেডিওতেও হযরত মাওলানা প্রাণ খুলে আরব দুনিয়ার সামনে তাঁর চিন্তাধারা পেশ করতে সমর্থ হন।

মিসর (১৯৫১)[সম্পাদনা]

মাওলানা আলী মিয়া সৌদি সফরে এ বিষয় ভালভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, সৌদি আরবের শিক্ষিত শ্রেণী ও বুদ্ধিজীবীরা মিশরের সাহিত্যকে নিজেদের আইডিয়াল হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাই তিনি তাঁর সৌদি আরবের দ্বিতীয় সফরের চারমাস পর ১৯৫১ সালের ২০শে জানুয়ারী মিশর রওয়ানা হন। তিনি মিশরে প্রায় ছয়মাস অবস্থান করেন। মিশরে, অবস্থানকালে তিনি সেখানকার সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে মত বিনিময় করেন। তাঁর এই সফর ছিল দাওয়াতী ও ইলমী। তিনি সেখানকার নামকরা আলেম, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এবং লেখকদের সাথে পরিচিত হন। এসকল মনীষীর মধ্যে ডঃ আহমাদ আমীন, ডঃ তৃহা হুসাইন, আব্বাস মাহমুদ, ডঃ মুহাম্মাদ হুসাইন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

বিখ্যাত আলেমদের মধ্যে ছিলেন শায়খুল আজহার, শায়খ আবদুল মজীদ প্রমুখ । বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও দায়ীদের মধ্যে উস্তাদ মুহ্ববুদ্দিন খতীব, সাইয়েদ কুতুব, আহমাদ শেরবাসী, মুহাম্মাদ গাজ্জালী, সাইদ রামাযান প্রমুখের সাথেও তিনি মত বিনিময় করেন।

বিখ্যাত সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে ইখওয়ানুল মুসলিমীন, জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীন প্রভৃতি সংগঠনের নেতৃবৃন্দের. সাথেও তিনি মত বিনিময় করেন। তাঁর এ সফরের ডায়েরী আরবী ও উর্দুতে প্রকাশিত হয়। এসময় তিনি আল্লামা ইকবালের চিন্তাধারাকে আরব বিশ্বে তুলে ধরেন। এ ছাড়া ০০ ৪ জগ নামক প্রবন্ধ সেখানকার আরবী পত্রিকায় প্রকাশ করেন।

ইখওয়ানুল মুসলিমীন[সম্পাদনা]

. মিশর সফরের সময় তার বিশেষ আবেগ এই ছিল যে, তিনি মিশরের বিখ্যাত ইসলামী ও দাওয়াতী সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমীনকে কাছে থেকে ' দেখবেন, এর সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন ও শায়খ হাসানুল বান্নার পুরনো সাথীদের ও তাঁর দীক্ষাপ্রাপ্ত অনুসারী ও ছাত্রদের সাথেও মত বিনিময় করবেন এবং এ সংগঠনের নিয়মনীতি সম্পর্কে জানবেন।

শায়খ হাসানুল বান্না ১৯৪৯ সালে শাহাদাতবরণ করেন। তাঁর সংগী- সাথীরা প্রায় সবাই জীবিত ছিলেন। এী সময় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ মা-যা খাসিরাল আলামু বি ইনহিতাতিল মুসলিমীন” প্রকাশিত হয়েছিল । এ গ্রন্থের কারণে তিনি তাঁর পরিচয় ও অবস্থান আরব বিশ্বের শিক্ষিত সমাজে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। ইখওয়ানের কাছে এ গ্রন্থ খানা ছিল খুবই থিয় এবং

তারা তাদের তরবিয়তী কোর্সে এ গ্রন্থখানিকে স্থান দিয়েছিল। তিনি তাদের

বিভিন্ন মজলিসে বক্তৃতা করেন এবং ইখওয়ানের বিশিষ্ট সাহিত্যিক শায়খ ! গাজ্জালীর সাথে মিশরের প্রত্যন্ত এলাকা সফর করেন।

তিনি ইখওয়ানের কর্মীদের সহজ জীবন যাপন, বাস্তব কর্মজীবন ও পাশ্চাত্যের বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত সমাজে দ্বীনের আলো জ্বালিয়ে রাখার জযবাকে মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেন এবং তাদেরকে মোবারকবাদ জানান।

সুদান[সম্পাদনা]

১৯৫১ সালের ২৩ শে জুন তিনি কায়রো থেকে সুদান রওয়ানা হন। ৭ই জুন খুরতুম উপস্থিত হন। সেখানে তিনি সুদানের বিখ্যাত দ্বীনী ও রাহানী ব্যক্তিত্ব সাইয়েদ মীর গনি পাশার বিশ্বাসভাজন শায়খ তৈয়ব আব্দুল মাকসুদের নিকট অবস্থান করেন এবং দাওয়াতী প্রোগথামসমূহ চালু করেন। উল্লেখ্য, এ সফরে তাঁর সাথে নিযামুদ্দীন মারকাযের হযরত “মাওলানা উবায়দুল্লাহ বলিয়াভীও ছিলেন।

তিনি খুরতুমের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব উস্তাদ ইসমাইল ও সাইয়েদ' আলী মীর গনি পাশাসহ উলামা ও শিক্ষিত সমাজের সবন্তরের লোকদের সাথে মত বিনিময় করেন। তিনি এসব অনুষ্ঠানে সুদানী ভাইদেরকে আফ্রিকায় ইসলাম প্রচারের এবং ইসলাম ও মুসলমানদের ভবিষ্যত নির্ধারণে ব্যাপক ভূমিকা রাখার দাওয়াত দিয়ে দিক নির্দেশনা মূলক পরামর্শ দেন। তিনি সুদানে ১০ দিন অবস্থান করেছিলেন।

দামেশুক পর[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা আলী মিয়া ১৯৫১ সালের সুদানে ১০ দিন অবস্থান করে দামেশ্ক আগমন করেন। দামেশূক ছিল সাহাবায়ে কেরামের মাজার এবং বড় বড় উলামা-মাশায়েখের জন্মভূমি । হযরত মাওলানা সিরিয়াতে প্রায়. দেড়মাস অবস্থান করেছিলেন। এর মধ্যে শুধু দামেক্কেই ২৪ দিন ছিলেন। খুব বেশিদিন সিরিয়াতে অবস্থান না করলেও হযরতের এ সফর ছিল খুবই গুরুতৃপূর্ণ। এ অল্প সময়ে তা: কর্মব্যস্ততা ছিল খুবই । বিশেষ করে দ্রামেক্কের উলামা-মাশায়খ এবং সুধী সমাজের সামনে তিনি তাঁর আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের যথাযোগ্য প্রয়োগ করতে এবং তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। তিনি সিরিয়ার ইলমী প্রতিষ্ঠান, সাহিত্য কেন্দ্রসমুহ,কেন্দ্রীয় একাডেমী “আল মাজমাউল ইলমী' এঁতিহাসিক মাদরাসা 'দারুল হাদীছ' (যেখানে ইমাম নববী (রহ.) দরস দিতেন) প্রত্যক্ষ করেন। তিনি সিরিয়ার পার্লামেন্টের এক অধিবেশনেও বিশেষ মেহমান হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এ সফরে তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসও পরিদর্শন করেন এবং এটি সে সফরের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল। দামেস্কের সুধী সমাজের সামনে ফিলিস্তিন ট্রাজেডি শীর্ষক একটি প্রবন্ধও পাঠ করেন।

এছাড়া তিনি দামেশৃক ইউনিভার্সিটির ডঃ মোস্তফা সুবারীর দাওয়াতে ১৯৫৬ সালে সেখানকার ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন এবং সেখানে তিনমাস অবস্থান করেন। এ সময় দামেশ্ক রেডিও তাঁর দুইটি ভাষণ প্রচার করে।

মন্কা শরীফ[সম্পাদনা]

দামেশ্ক থেকে ১৯৫১ সালের ১২ই আগষ্ট তিনি বিমান যোগে মদীনা শরীফ ফিরে আসেন এবং কয়েকদিন পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করে মক্কা মোকাররমা চলে আসেন। এখানে তিনি আরও ৫ মাস অবস্থান করে দ্বিতীয় হ্জ্ঞ সম্পাদন করেন। .

হজ্জের পর তার পুরনো বন্ধু-বাহ্ধবদের সাথে পূর্বের সফরে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ভা নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে উঠে। বুস্তানে বুখারীতে এজতেমার সময় যাদের সাথে হযরতের পরিচয় হয়েছিল, এ সফরে সে পরিচয়ে নতুন মাত্রা যোগ হয়। এ সফরে সৌদি রেডিও তার দুইটি বক্তব্য প্রচার করে। এর মধ্যে একটি ছিল “মিন গারে হেরা” । এ বক্তব্যে তিনি ইসলামের সুবহে সাদেক শুরু হলে দুনিয়াব্যাপী কিভাবে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে ছিল, বিক্ষিপ্ত মানবতা কিভাবে সুশৃংখলভাবে সংঘবদ্ধ হয়েছিল এবং সে যুগের সমস্যাক্লিষ্ট মানবতার সুষ্ঠু সমাধানের মূল চাবিকাঠি কি ছিল তার উপর বিশদভাবে আলোকপাত করেন ।

দরসগাহে নবুওয়ত বিভিন্ন প্রয়োজনে কি ধরনের মডেল মানুষ তৈরী করেছে, তাদেরকে জীবনের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কিভাবে ফিট করেছে এবং তারা দুনিয়াতে কি ধরনের বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল সৌদি রেডিওতে প্রথম ভাষণে তিনি সে প্রসঙ্গেও আলোচনা করেন।

সৌদি রেডিও প্রচারিত তীর দ্বিতীয় ভাষণের বিবয়ববস্ত ছিল, “আল্লামা ইকবালের জীবন-কর্ম ও বিপ্ুবী আহ্বান” এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি আল্লামা ইকবালকে আরব বিশ্বের সর্বসাধারণের নিকট পরিচিত করে তোলেন।

এই সফরে তিনি তায়েফ ও ওয়াদিয়ে ফাতেমা সফর করেন এবং হ্ীনী, দাওয়াতী ও ইলমী প্রোগ্রাম সফল করেন। এই সহাশ সফর শেষ করে ১৯৫১ তিনি দেশে ফিরে আসেন।

লেবানন[সম্পাদনা]

দামেক্কের এই সফরেই তিনি সুযোগ করে লেবানন সফর করেন। মাত্র কয়েক ঘন্টার দূরত্ব দামেশৃক থেকে লেবানন। এ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেননি। ইখওয়ান সংগঠনের এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি লেবানন হাজির হন। এখানে তিনি চারদিন অবস্থান করেন এবং এ্রতিহাসিক স্থাপনা ও স্থানগুলো পরিদর্শন করেন। ইমাম আওযায়ী (রহ.)-এর মাযার যিয়ারত করেন। এছাড়াও এ সফরে তিনি দ্বীনী প্রতিষ্ঠান, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্ন দায়িত্বশীলের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এসময় তিনি বিখ্যাত নওমুসলিম দার্শনিক 7২০৪৫ 10 75০০৪. এর লেখক মুহাম্মাদ আসাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

তুরস্ক ১৯৫৬)[সম্পাদনা]

দামেশ্ক ইউনিভার্সিটির প্রবন্ধ পাঠ থেকে অবসর হয়ে তিনি ১৯৫৬ সালের ১২ই জুন দু'সপ্তাহের জন্য তুরক্ক সফরে রওয়ানা হন। তিনি হালাব শহরে এক রাত অবস্থান করেন এবং সেখানের ইখওয়ানুল মুসলিখীনের এক সমাবেশে অংশগ্রহণ করে বক্তব্য পেশ করেন। বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল 1০৮ এ এ এ এ। এ বক্তৃতায় তিনি আরব জাতীয়তাবাদের ব্যাপক সমালোচনা করেন । শ্রোতাদের মধ্যে এ বক্তব্য বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করে।

হালা থেকে তিনি তুরস্কের সীমান্ত অঞ্চল হায়দার পাশা দিয়ে তুরস্কে প্রবেশ করেন। এ দুই সপ্তাহে তিনি তুরস্কের এতিহাসিক স্থান ইস্তাম্ুল সফর করেন। এছাড়া আংগুরা, কওনিয়া (মাওলানা রুমীর জম্মস্থান) প্রভৃতি স্থানও সফর করেন।

বাগদাদ[সম্পাদনা]

জুলাই মাসের কোন এক তারিখে তিনি বাগদাদ এবং করাচী হয়ে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। বাগদাদে এসময় হযরতের শ্রদ্ধেয় উত্তাদ ড. তকীউদ্দিন হেলালী অবস্থান করছিলেন। দীর্ঘ ২৩ বছর পর প্রাণপ্রিয় এই উত্তাদের সাক্ষাতে তিনি যারপরনাই আনন্দিত হন। হযরত হেলালীর দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ায় তিনি আলী মিয়াকে না দেখতে পারলেও তাঁর কণ্ঠ শুনে তিনি যেন পরম তৃপ্তি লাত করেন। প্রিয় শাগরেদকে তিনি দাওয়াত দেন এবং আপ্যায়ন করেন।

এ সফরে তিনি জমিয়াতু ইনফাষে ফিলিস্তীনের দফতরে অবস্থান করেন এবং সেখানকার সুধী সমাজের সামনে বক্তব্য রাখেন। মাওলানা আলী মিয়া তার খান্দানের উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ হযরত শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) সহ অন্যান্য বুযুগানে দ্বীনের মাযার যিয়ারত করেন।

পাকিস্তান (১৯৫৩)[সম্পাদনা]

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথমবার ১৯৫৩ সালে মাওলানা আলী মিয়া পাকিস্তান যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে দিল্লী থেকে ফিরে আসেন। খতমে নবুওয়ত আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানের পরিস্থিতি সেসময় ভাল ছিল না। এরপর ১৯৫৪ সালের মে মাসে তিনি তাঁর পীর ও মোর্শেদ হযরত মাওলানা রায়পুরীর সাথে রমযান অতিবাহিত করেন।

এ সফরে মাওলানা আলী মিয়া তাঁর প্রিয় দোস্ত মাওলানা মাসউদ আলম নদভীর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। মাওলানা মাসউদ আলম নদর্ভী €রহ.) তাঁর লাহোরে উপস্থিত হওয়ার দুইমাস পূর্বে ইন্তেকাল করেন। অবশ্য তাঁর অপর দোস্ত, বহু বছরের সাথী মাওলানা মুহাম্মাদ নায়েম সাহেব নদভী উপস্থিত ছিলেন। তিনি কোন সময় লাহোর উপস্থিত হলে জনাব নাযেম নদভী সুদূর ভাওয়ালপুর হতে কয়েকদিনের জন্য মাওলানা আলী মিয়ীর সাথে সময় কাটাতেন। লাখনৌ ও রায়বেরেলীর পর লাহোর ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় শহর। এ শহরেই তিনি তীর ছাত্রজীবনের একটি সুন্দর অধ্যায় অতিবাহিত করেন। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এখানে তিনি কয়েক মাস করে সময় কাটিয়েছিলেন। তার শৈশব, যৌবন, ইলমী ইস্তেফাদা এবং রূহানী পিপাসা

মিটাবার অনেক স্মৃতি এ শহরটির সাথে জড়িত। ১৯৫৫ সালে তিনি দ্বিতীয়বার লাহোর সফর করেন।

রেগুন (১৯৬০)[সম্পাদনা]

তিনি ১৯৬০ সালের ১৮ই ডিসেম্বর রেঙ্গুন সফর করেন। ভারতের

গুজরাট, সুরাট প্রভৃতি স্থানের মুসলমান ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত সফলতার সাথে রেঙ্গুনে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। শুধু তাই নয়, তারা ভারতের দ্বীনী ইদারাগুলিতে দান করতেও ভুলতেন না। এঁ সময় রেঙ্গুনে অবস্থানরত দেওবন্দের একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ক্বারী আব্দুর রহমান সাহেব মাওলানা আলী মিয়াকে রেঙ্গুন সফরের জন্য দাওয়াত দেন। রেঙ্গুনের মুসলমানদের মধ্য এক নতুন দ্বীনী দাওয়াতী চেতনা সৃষ্টি করা এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল। তিনি রেঙ্গুন উপস্থিত হলে তাকে জীকজমকের সাথে অভ্যর্থনা জানানো হয়। স্বাধীন বার্মায় ইতিপূর্বে কোন আলেমের জন্য এমন ধরনের অভ্যর্থনা জানানোর নজীর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কীরী আবদুর রহমান কাসেমী, মাওলানা ইবরাহীম সাহেব মাজাহেরী এবং মুফতী মাহুদ দাউদ সাহেব মাজাহেরী তাকে অভ্যর্থনা জানান।

রেঙ্গুনে তিনি প্রায় একমাস অবস্থান করেন। তিনি বার্মার মুসলমানদের ইসলামের হেফাজত ও প্রচারের বিরাট দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বার্মী ভাষার উপর যোগ্যতা সৃষ্টি করার পরামর্শ দেন এবং তিনি বার্মার মুসলমানদের সাবধান করে দেন যে, যদি তীরা এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেন তবে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

তার এ কথাগুলি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। তীর বার্মা হতে ফিরে আসার কিছুদিন পরই সামরিক শক্তি বার্মা দখল করে কম্যুনিজম চালু করে এবং বার্মার মুসলমানদের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে দেয়।

কুয়েত (১৯৬২)[সম্পাদনা]

মাওলানা আলী মিয়া নদভী ১৯৬২ সালের ২৪শে জানুয়ারী কয়েকজন মুখলেস বন্ধুর দাওয়াতে কুয়েত উপস্থিত হন। তিনি সেখানে তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন। এ সফরে তিনি কুয়েতের বড় বড় মসজিদে জুমআর খুতবা . প্রদান করেন এবং আরব সুখীসমাজের সামনে কুয়েতের মত তেল সমৃদ্ধ দেশের মানুষদের দায়িত্ব কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি কুয়েত রেডিওতে “ইসমায়ী ইয়া জাহরাতুস সাহরা' নামে বক্তৃতা করেন। এ বক্তৃতায় তিনি বর্তমান সভ্যতায় কুয়েত কি দায়িত্ব পালন করতে পারে এবং পৃথিবীকে কি উপহার দিতে পারে তার প্রতি কুয়েতবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ সফরে তিনি কুয়েতের আমীর শায়খ আবদুল্লাহ সালেম অসাবাহ এর নিকট একটি গুরুত্পূর্ণ চিঠি পেশ করেন! হযরত মাওলানার পরিচয় আরব জাহানে পূর্বেই খুবই সম্মান করেন এবং এ সম্মানিত মেহমান থেকে তীরা লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেন।

আফগানিস্তান, ইরান, লেবানন, সিরিয়া ও জর্দান সফর[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রঃ) রাবেতা আলমে ইসলামীর প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে ১৯৭৩ সালে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ যেমন-আফগানিস্তান, ইরান, লেবানন, সিরিয়া ও ইরাক সফর করেন। এ সফরের সময়সীমা ছিল ৪ ঠা জুন থেকে ২০ শে আগষ্ট । উদ্দেশ্য ছিল সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের মুসলমানদের সাধারণ অবস্থা, তাদের সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা এবং তাদের সামনে রাবেতার পরিচিতি তুলে ধরা। এ সফরের শেষে তিনি “দরিয়ায়ে কাবুল ছে দরিয়ায়ে ইয়ারমুক" নামে একটি ভ্রমণ কাহিনীমূলক বইও লেখেন । বহি বালো জয়া কাবুল থেকে আনান ঘকাশিত হয়েছে।

শ্রীলংকা (১৯৮২)[সম্পাদনা]

১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে রাবেতা আল-আলমে ইসলামীর

সেক্রেটারী জেনারেল শায়খ মুহাম্মাদ আলী আল-হারাকানের অনুরোধে এবং শ্রীলংকার নাধিমিয়া ইউনিভার্সিটির দাওয়াতে তিনি প্রথমবার ১৯৮২ সালের ৯ই মে, সুইস এয়ার যোগে বোষে থেকে কলম্বো হাজির হন। কলম্বো এয়ারপোর্টে ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা, শ্রীলংকার মুসলমানদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব আলহাজ মুহাম্মাদ নাধিম সাহেবসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। "

জনাব সুহাম্মাদ নাযিম সাহেব মাওলানা আলী মিয়ীর একটি পুস্তিকা 'রিদ্দাতুন ওয়ালা আবা বাকরিন লাহা" পড়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য অনুপ্রাণিত হন। ফলে এ প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রম এবং চিন্তাধারা হযরত মাওলানার চিন্তাধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল। আলমে ইসলামের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হল শিক্ষিত শ্রেণীর চিন্তা ও আদর্শের পরিবর্তন । তাই শ্রীলংকার মুসলমান ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বীন ও ঈমানের হেফাযতের উদ্দেশ্যে এ প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করা হয়। এ সফরে হযরত আলী গিয়া এ ভার্সিটির লাইবেরী বিল্ডিংয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। হাজী সাহেব এ প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ অর্থ নিজেই দান করেছেন। এ প্রতিষ্ঠান শুরু করার প্রায় আট বছর পরে প্রথম সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে তাকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। এ কনভেনশনে শ্রীলংকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী, কুটনীতিকবৃন্দ, রাষ্্রদূতগণ উপস্থিত ছিলেন। তিনি আরবীতে ভাষণ দেন। এ ছাড়া ছাত্র-শিক্ষদের উদ্দেশ্যে তিনি বক্তৃতা করেন। সেখানকার তাবলীগী মারকাযে হযরতের বয়ান হয় এবং জমিয়াতুল উলামায়ে আরকানের সামনেও তিনি বক্তব্য রাখেন।

তখন শ্রীলংকার মুসলমানদের অবস্থা খুবই ভালো ছিল। মুসলমানদের সংখ্যা তখন ছিল প্রায় ১২ লাখ। শ্রীলংকার মোট লোক সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ । শতকরা প্রায় ৯ ভাগ মুসলমান। শ্রীলংকার বাসিন্দারা চেহারা রঙ ইত্যাদিতে ভারতের কেরালা, মাদ্রাজ এলাকার সাথে মিশে যায়। আবাদীও একই ধরনের, কয়েক মাইল পর্যন্ত শুধু নারিকেলের সারি । জুমআর দিন এক ঘন্টার জন্য সবকিছু বন্ধ থাকতো । দেড়ঘন্টা ব্যাপী রেডিওতে মুসলমানদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রোথাম চালু ছিল।

বাংলাদেশ (১৯৮৪)[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা আলী মিয়া নদভী প্রথমবার ১৯৮৪ সালের ৯ ই মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসেন। হযরতের কয়েকখানা কিতাবের অনুবাদ ইতিমধ্যেই ইসলামিক ফাউণ্ডেশন থেকে বের হয়েছিল। ফলে এ দেশের আলেম সমাজ ও শিক্ষিত শ্রেণীর কাছে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। হযরত আল্লামা সাইয়েদ মাওলানা সুলতান জওক, মাওলানা আবু সাইদ মুহাম্মাদ ওমর আলী, মাওলানা মুহীউদ্দীন খান প্রমুখের দাওয়াতে তিনি এ সফর করেন। ১৯ শে মার্চ পর্যন্ত তার এ দশদিনব্যাপী সফরেই তিনি ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, চট্রগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট প্রভৃতি এলাকা সফর করেন। ঢাকার সফরে তিনি সোনারগীয়ে উপস্থিত হন এবং হযরত শায়খ আবু তাওয়ামার মাজারে ফাতেহা পাঠ করেন। ১৬ ই মার্চ বায়তুল মোকাররমে জুম'আর খোতবা দেন এবং নামাযের পূর্বে বয়ান করেন।

এ সফরে তিনি বিভিন্ন মাদরাসা ও ইসলামী সংগঠন এবং বিশেষ করে ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের পক্ষ থেকে হোটেল পূর্বাণীতে দেয়া অভ্যর্থনা জল্সায় গুরুতুপূর্ণ বক্তৃতা করেন। এসব বক্তৃতায় তার মর্সবাণী ছিল নিন্নরূগঃ

১. আপনাদেরকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নিয়ন্ত্রণভার হাতে নিতে হবে । ২. উলামা ও বুদ্ধিজীবী সমাজকে সজাগ ও ভুশিয়ার থাকতে হবে। ৩. আপনাদের নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার, নিজেদের কবি-সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীদেরকে জনগণের সামনে বিশেষ করে নুতন প্রজন্মের সামনে দুলে ধরতে হবে । এ প্রসঙ্গে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কথা তিনি তুলে ধরেন। রবি ঠাকুরের পরিবর্তে কবি নজরুলকে সারা দুনিয়াতে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব এ দেশের মুসলমানদের উপর রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করে বলেন, আপনাদেরকেই এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় এ জাতি সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়বে। ঢাকায় অবস্থান করেন। ২০শে মার্চ তিনি ঢাকা থেকে কলকাতা রওয়ানা হন। এ ভাষণসমূহ তোহফায়ে মাশরেক নামক গ্রন্থে সংকলন করা হয়েছে, যা ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রাচ্যের উপহার নামে অনুদিত হয়েছে।

১৯৯৪ সালে তিনি তার বাংলাদেশী গুণগ্রাহী বিশেষ করে রাবেতায়ে আদবে ইসলামীর (আন্তজাতিক ইসলামী সাহিত্য) বাংলাদেশ ব্যুরোর চেয়ারম্যান মাওলানা সুলতান যওক সাহেবের দাওয়াতে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ সফরে আসেন।

মালয়েশিয়া (১৯৮৭)[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রঃ) ১৯৮৭ সালের ২রা এপ্রিল মালায়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর উপস্থিত হন। মালয়েশিয়ার কিছু ছাত্র ইতিপূর্বে নদওয়ায় পড়াশোনা করে দেশে ফিরে গিয়ে তার চিন্তা-চেতনা ও পয়গাম ছড়িয়ে দিয়েছিল। সেখানকার উলামা ও শিক্ষিত সমাজ হযরতের রচনাবলী পড়ে তাঁকে নিজেদের কাছে পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে" সেখানকার ইসলামী সংগঠন %, ৪, [1 এবং নদভী ছাত্রদের পক্ষ থেকে দাওয়াতনামা আসে এবং তিনি তা কবুল করেন।

ওরা এপ্রিল মালয়েশিয়ার একটি প্রদেশ তেরেঙ্গানুতে প্রথম প্রোগ্রাম রাখা হয়। তেরেঙ্গানুর রাজধানী কুয়ালা তেরেঙ্গানুতে হযরতের মজলিস রাখা হয়। সেখানকার বিশিষ্ট দায়ী শায়খ আব্দুল হাদীর তত্ত্বাবধানে জল্সা অনুষ্ঠিত হয়। জুম'আর নামাধের পূর্বে তিনি আরবীতে বয়ান করেন। আলোচ্য বিষয় ছিল "লাল ইসলামে মিন জাদীদ' আলোচনায় তিনি মালায়ী মুসলমানদের সাবধান করে দেন যে, মালায়েশিয়ার এ উন্নতি ও তরক্কি সব বিফল হয়ে যাবে যদি তাঁরা ইসলাম থেকে দূরে সরে যান।

৪ঠা এপ্রিল জাতীয় ইউনিভার্সিটির শরীয়ত ফ্যাকাল্টির উদ্যোগে ভার্সিটির অডিটরিয়ামে শিক্ষক, গবেষক এবং ছাত্রদের সামনে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যের আসল বিষয় ছিল, মুসলিম দেশগুলির শাসক শ্রেণী এবং সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে যে দ্বন্ধ চলছে তার কারণ হল, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, সভ্যতা, সংস্কৃতি মুসলমানদের আব্মি্দা এবং বিশ্বাসের খেলাপ হওয়া । আপনারা এদেশের শিক্ষিত সমাজের মাঝে দ্বীনের জাগরণ আনুন ।

৬ই এপ্রিল তিনি কাদাহ এলাকা সফর করেন। মা'হাদুত তারবিয়াতিল ইসলামিয়া যেখানে নদভী ছাত্রদের বিরাট সমাগম ছিল, সেখানে বক্তৃতা করেন। দ্বিতীয় দিন শুধু ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে গুরুত্পূর্ণ বক্তব্য রাখেন এবং আল্‌ মা'হাদুল আলী লিদ্দাওয়ার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।

৭ই এপ্রিল যোহরের পূর্বে মালয়েশিয়া ইউনিভার্সিটিতে প্রোথাম রাখা হয়। আছর বাদ তিনি তাবলীগী মারকাজে এবং এবি,আই, এম ছছোত্র সংগঠন)-এর সম্মেলনে বয়ান করেন।


আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. _ ১৮৪

৮ই এপ্রিল মাওলানা আলী মিয়া মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইউনিভার্সিটি পরিদর্শন করেন এবং ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। সিটির ভাইস চ্যা্সেশর বচ্ঞাত আরব গ্িত ই জাদুর রউফ মিসরী তাঁকে অভ্ঞর্থনা জানান।

আছর বাদ তিনি হিজবুল ইসলামীর মারকাজে এক বিরাট সমাবেশে স্বীনী দাওয়াতী কাজের জন্য মহব্বতের পদ্ধতিগুলি গ্রহণ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ৯ই এপ্রিল তিনি ভারতে ফিরে আসেন।

উযবেকিস্তান-১৯৯৩[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ-) প্রায় সারা পৃথিবী দেখার পরও এশিয়ার দ্বীনী ও ইলমী প্রাণকেন্দ্র রাশিয়ার বুখারা, সমরখন্দ, তাশখন্দ ইত্যাদি এতিহাসিক স্থানসমূহ দেখার সুযোগ না পাওয়ায় মনে মনে খুবই আক্ষেপ করতেন। আল্লাহপাক তার জন্য এ সফরের এক কুদরতী ব্যবস্থা করেন ।

লন্ডনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইসলামিক সেন্টারের পক্ষ হতে হযরত ইমাম বুখারীর মাযারের পাশে একটি ইসলামী গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেন্টারের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৯৩ সালের ২৩শে অক্টোবর সমরখন্দে এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। এ মোবারক কনফারেনে সেন্টারের পক্ষ হতে হযরত মাওলানাকে দাওয়াত দেয়া হয়। তিনি মাওলানা রাবে নদভী ও মাওলানা উসমান সাহেবকে নিয়ে ২২শে অট্টোবর দিল্লী হতে উবেক এয়ার যোগে তাশখন্দে পৌছে যান। সেখান হতে বিমানে চল্লিশ মিনিটে সমরখন্দ পৌঁছে যান এবং ২৩শে অক্টোবরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশঘহণ করেন। এঁ সময় ডাঃ আবুন্লাহ উমর নাসীফ অক্সফোর্ড ইসলামিক সেন্টারের ডাঃ ফারহান নেযামী মো'তামার ইসলামীর জেনারেল সেক্রেটারী এবং শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহসহ সারা পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্রা উপস্থিত ছিলেন। হযরত মাওলানা সেখানে হযরত ইমাম বুখারী এবং তার এতিহাসিক হাদীছ গ্রন্থের উপর আরবীতে প্রবন্ধ পাঠ করেন।

২৪শে অক্টোবর তিনি. সমরখন্দ হতে ১৫ কিলোমিটার দুরে ইমাম বুখারীর মাযার ঘিয়ারত করেন। ২৫শে অক্টোবর তিনি মাইক্রোবাস যোগে সমরখন্দ হতে ৩০০ কিমি. দূরে ইমাম বুখারীর কর্মস্থল বুখারায় উপস্থিত হন। এ সময় তার সাথে শায়খ আবদুল ফাল্তাহ্‌ আবু গুদ্দাহসহ অরো অনেক আলেম উলামা ছিলেন। বুখারার সুলতান এবং সেখানকার কিছু কুচত্রী আলেম উলামার চক্রান্তের কারণে মহামান্য ইমামকে নিজ এলাকা ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল ফলে ভিনি বুখারার পরিবর্তে সমরখন্দের কাছে খরতঙ নামক এলাকায় মাদফুন হন।

হযরত মাওলানা ও তার সাথী সংগীর। সিলসিলায়ে নকশবন্দিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দী (রহ.)-এর মাদরাসা ও বুখারার এ্রতিহাসিক স্থানসমূহ পরিদর্শন করেন। ২৬শে অক্টোবর তিনি সমরধন্দ হতে লাখনৌ ফিরে আসেন।

ইউরোপ (১৯৬৩)[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রঃ) ১৯৬৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর হতে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ইউরোপের প্রথম সফর শেষ করেন। এ সফরে ডাঃ মুহাম্মাদ ইশতিয়াক হুসাইন কুরাইশীকে হযরতের অবস্থান করেছিলেন। এ সফরের আসল উদ্যোস্তা ছিলেন বিখ্যাত দায়ী ডাঃ সাঈদ রমযান। তিনি তার জেনেভার ইসলামিক সেন্টারে ইউরোপের আরব এবং মুসলমান ছাত্রদের একটি শিক্ষা শিবিরে হযরত মাওলানাকে 'দাওয়াত দিয়েছিলেন। হযরত মাওলানা এ প্রতিষ্ঠানের রোকন ছিলেন। এ সফরে জেনেভা. লুজান, বার্লিন, প্যারিস, লগ্ন, ক্যামরিজ, অন্ধুফোর্, গ্রাসকো, এডিনবরা, এবং স্পেনের গ্রানাডা, টলেডো ও কর্ডোভা যান।

এডিনবরা ইউনিভার্সিটির ইসলামী মজলিসে, লগুন ইউনিভার্সিটির ইউনিয়ন হলে হযরত মাওলানার বক্তৃতা হয়। বিবিসি হতে হযরত মাওলানার দু'টি বক্তৃতা প্রচারিত হয়। লগুন ভ্রমণের প্রতিক্রিয়া এবং “আরবী ভাষার 'উন্নতি, সম্ভবনা ও মুসলিম দেশসমূহের সাথে এর সম্পর্ক” নামে লগ্ন ইউনিভার্সিটি হলের বক্তৃতা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । বক্তব্যটি আরবীতে 'বাইনাল মাশারিকি ওয়াল মাগারিব' নামে এবং তার ইংরেজী তরজমা 990461 639€ 2110 455 নামে তৈরী করা হয়। একজন নওমুসলিম ছাত্র মুস্তফা ইয়ানূস ইংরেজী তরজমাটি খুবই বলিষ্ঠতার সাথে পাঠ করেন। এ সময় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আরবী বিভাগের প্রধান, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির ডঃ আরবেরী প্রশুখ পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের সাথে হযরত মাওলানা মতবিনিময় করেন।

লগ্ডনে অবস্থানকালে তিনি বৃটিশ মিউজিয়াম লাইবেরী এবং ইপ্ডিয়া অফিস লাইব্রেরী হতে উপকৃত হওয়ার সুযোগ পান। “মুসলিম মামালেক মে ইসলামিয়াত ওয়া মাগারিবিয়াত কা কাশমাকাশ" গ্রন্থের ভূমিকা তিনি লগ্ুনের এ সফরেই লিপিবদ্ধ করেন।

স্পেন[সম্পাদনা]

এ সফরেই তিনি স্পেন সফর করেন। মুসলমানদের কয়েকশ বছর রাজত্রে গৌরবময় ইতিহাসের কথা স্মরণ করে তিনি শোকে অভিভূত হয়ে পড়েন। কর্ডোভা 'মসজিদে হাজির হয়ে তিনি আল্লামা ইকবালের কবিতা আওড়াতে থাকেন। তিনি মসজিদে প্রবেশ করে “কুল জাআল হান্কু" এই আয়াত লিখিতভাবে দেখতে পান। তিনি গাইডকে ফাঁকি দিয়ে সেখানে দু'রাকাত নামায পড়েন। অতঃপর মসজিদ হতে বের হয়ে আজান দিয়ে আসরের নামায আদায় করেন।

গ্রানাডা সফরে জুম'আর নামাষের সময় হয়ে গেলে তিনি কিছু আরব ছাত্রদের জুম'আর নামাষের দাওয়াত দেন এবং একজন আরব নওজোয়ানের কামরায় জুম'আর নামায আদায় করেন। তিনি অনেক দুঃখের সাথে আরব মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আফসোস! স্পেনের মানুষদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌছানোর সুযোগ আমাদের হলো না; প্রয়োজন ছিল স্পেনিক ভাষা শিখে স্পেনবাসীদের বলে দেওয়া যে, তোমরা মুসলমান- দেরকে দেশ থেকে বের করে কি সর্বনাশ করেছ, তোমরা অবনতির কোন স্ত রে পৌছে গিয়েছো। মুসলমানরা স্পেনে থাকলে আজ স্পেনের অবস্থা কি হত। ১৯৬৩ সালে হযরত মাওলানা (রঃ) ইউরোপে অবস্থানকালে তাঁর ভাতিজা মুহাম্মাদুল হাসানীর নিকট, সেখানকার অবস্থা জানিয়ে বেশ কয়েকটি চিঠি দিয়েছিলেন। সে চিঠিগুলো মাকাতিবে ইউরোপ নামে উর্দুতে ছাপা হয়েছে। চিঠিগুলি পড়লে ইউরোপ সম্পর্কে হযরত মাওলানার মনোভাবের একটা সুস্পষ্ট ধারণা করা যায়।

ইউরোপ (দ্বিতীয় সফর ১৯৬৪)[সম্পাদনা]

১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে দ্বিতীয়বার তিনি জনাব ডাঃ সাঈদ রমধানের জেনেভার ইসলামী সেন্টারের দাওয়াতে জেনেভা হাজির হন। পরে লগ্ন সফর করেন। এ সফরে তিনি জার্মানের বার্লিন,আখুন, মিউনিখ প্রভৃতি স্থান সফর করেন। এ সফরে লগ্তনের বেকার স্ট্রীটের ইসলামী সেন্টারে মুসলিম ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশে গুরুতপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। ২৭ শে অক্টোবর বার্লিনের ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সমাবেশে আরবীতে বতুতা করেন। জার্মান ভাষায় এ বক্তৃতার তরজমা করা হয়। ইউরোপ (ত্তীয় সফর ১৯৮৩)

১৯৮৩ সালের ২১ শে জুলাই তিনি তৃতীয়বার লগ্ন সফর করেন। এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইসলামিক সেন্টারের শুভ উদ্বোধন করা। বিখ্যাত এতিহাসিক প্রফেসর খালেক নেজামী সাহেবের হাওয়াতে তিনি এ সফর করেন । সেন্টারের উদ্বোধন করার পর এ প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্র, উদ্দেশ্য ইত্যাদি মৌলিক বিষয়ে তিনি গুরুত্পূর্ণ দিক নির্দেশনা দেন এবং এ প্রতিষ্ঠানের সঠিক উন্নয়নে সহযোগিতা করেন। তিনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইসলাম ওয়াল মাগরিব নামে একটি প্রবন্ধ পড়েন। রর পর তিনি এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বৈঠকে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে ১৯৮৬ ও ১৯৮৭, সালেও লপ্তন সফর করেন।

আমেরিকা (১৯৯৭)[সম্পাদনা]

হযতর মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রঃ) ১৯৯৭ সালের মে মাসে আমেরিকার মুসলিম ছাত্রদের বিখ্যাত সংগঠন এম,এস,এ 1৬003]. 909090705 89$00141107. 06 /070708 ৪170 0৪809 এর বার্ষিক সম্মেলনে এর দাওয়াতে প্রথমবার আমেরিকা ও কানাডা সফর করেন। তাঁর এ সফর ছিল সম্পূর্ণ দাওয়াতী । পাশ্চাত্য সভ্যতার পাদপীঠ আমেরিকাবাসীদের কাছে বিশেষ করে সেখানকার প্রবাসী ভাইদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌছে দেয়ার এবং তাদের দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য তিনি এ দাওয়াত কবুল করেন।

২৮ শে মে তিনি বোম্ছে হতে নিউইয়র্কের কেনেডী এয়ার পোর্টে উপস্থিত হন। নিউইয়র্কে কয়েকঘন্টা অবস্থান করে “ইগ্ডিয়ানা পোলিশ" এর মেলবোর্ন-এ উপস্থিত হন। সেখানেই উক্ত সংগঠনের চৌদ্দতম বার্ষিক কনভেনশন শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২৮শে মে সন্ধ্যা ৭টায় তিনি উক্ত সম্মেলনে ইসলামী সংগঠনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করেন। আরবদের সমাবেশেও তিনি বক্তৃতা করেন।

এ জরুরী প্রোগ্রাম থেকে অবসর হওয়ার পরে এম,এস,এ-এর তত্ত্বাবধানে আমেরিকা ও কানাডার বিভিন্ন অংগরাজ্যে ৩ সপ্তাহব্যাপী তার সফরের প্রোগ্রাম তৈরী হয়। এ উপলক্ষে তিনি নিউইয়র্ক সিটি, জারসি সিটি, ফ্লাডেলফিয়া, বাল্টিমোর, ওয়াশিংটন, বোষ্টন, শিকাগো, সানফ্রানসিসকো, লসএঞ্জেলস এবং কানাডার টরেন্টো এবং মন্রিল প্রভৃতি প্রসিদ্ধ স্থান সফর করেন। এসব স্থানে তিনি প্রবাসী হিন্দুস্তানী, পাকিস্তানি এবং আরব মুসলমানদের সামনে অত্যন্ত হৃদয়গাহী বক্তব্য পেশ করেন। এ সফরে তিনি হারভার্ড ইউনিভার্সিটি, ডেদ্রয়েট ইউনিভার্সিটি, উত্তর কালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, (লস. এনজেলস) এর উটা ইউনিভার্সিটি (সালটালেক সিটি) তে বক্তৃতা করার সুযোগ পান। এ ছাড়া জাতিসংঘের নামায হলে, টরেন্টো ও ডেট্রয়েটের জামে মসজিদে জুম'আর খুতবা প্রদান করেন।

এ সকল বক্তৃতা তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্তঃসারশৃণ্য ধৌকাবাজীর খপ্পরে পড়ে নিজের মহামূল্যবান ঈমান ও আমলকে না হারাবার উদাত্ত আহবান জানান। হযরত মাওলানা তাঁর এ সকল বয়ানে নিজের জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা এবং ইসলামী শ্পিরিটকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকায় অবস্থানরত মুসলমানদের সামনে নতুন পৃথিবী আমেরিকার রঙ করা আধুনিক সভ্যতার পোষ্টমর্টেম করেন। হযরত আলী মিয়ার এসব বক্তৃতা আরবী, ইংরেজী এবং উদ্দূতে সংকলিত হয়েছে। এসব বক্তৃতায় তিনি দু'টি বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।

একঃ পশ্চিমা সভ্যতার সমালোচনা, তার অসারতা ও এর সৃষ্ট সমস্যাবলীর ব্যাখ্যা । .

দুইঃ আমেরিকায় অবস্থানকারী মুসলমানদের নিজেদের মর্যাদা ও পয়গাম' এবং ব্যক্তিত্বের হেফাযতের তাকিদ করেন।

তিনি আমেরিকাবাসীদের উদ্দেশে; বলেন, “আমেরিকায় মেশিনের বাহার, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি খুবই হচ্ছে, কিন্তু মানবতার অপমৃত্যু ঘটছে।

এ মাটি যদি দ্বীনে ফিতরতের নেয়ামত পেত তাহলে দুনিয়ার ইতিহাস অন্যরকম হত। আমেরিকা একই সাথে সৌভাগ্যশালীও আবার দুর্ভাগ্যশালীও ৷ সৌভাগ্যশালী এ জন্য যে, আল্লাহ পাক এ দেশকে অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন। বিশাল সামরিক শক্তি ও সরঞ্জামাদি এ দেশের রয়েছে। এ দিক দিয়ে এ দেশ সৌভাগ্যশালী। অপর পক্ষে হতভাগ্য দেশ এজন্য যে, এ দেশের ভাগ্যে দ্বীন ইসলামের নেয়ামত জোটেনি। এ দেশ বস্তবাদের দিকে যেভাবে ঝুঁকে পড়েছে, চারিত্রিক উৎকর্ষতার দিকে সেরূপ প্রচেষ্টা চালায়নি।

প্রবাসী মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা সকল বন্তবাদের মোকাবেলায় ঈমানের হেফাযত এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের ঈমানী নেয়ামতকে প্রাধান্য দিন। এ দায়িত্ব পালন করতে না পারলে আপনাদের এখানে একদিনের জন্যও থাকা ঠিক হবে না। আর যদি আপনারা নিশ্চিন্ত হন যে, আপনারা এখানে আল্লাহ পাকের রেজা অনুযারী জীবনযাপন করছেন, আপনাদের দিল যদি সাক্ষ্য দেয় যে, আপনারা এখানে আপনাদের ঈমান বাঁচাতে পারছেন এবং বাচ্চাদের ভবিষ্যৎও হেফাযত করতে পারছেন, তাহলে আপনাদের এদেশে থাকা শুধু জায়েয নয়; বরং উপকারী এবং মোবারকও হতে পারে।

এসব মজলিসে মহিলাদের বসার জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকতো । মহিলাদের লক্ষ্য করে তিনি বলেছিলেন,“মা ও বোনেরা! ইসলাম পারিবারিক এবং দাম্পত্য জীবনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে, আপনারা সেই জীবনের ভিত্তি স্বরূপ। আপনাদের ইসলামের উপর পুরোপুরী চলার উপরই নির্ভর করছে এদেশের লাখো-কোটি মানুষের ইসলাম গ্রহণ করার সৌভাগ্য। পশ্চিমা সভ্যতায় পরিবারকে ধ্বংস করা হয়েছে। দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনের মধুময় সম্পর্ক চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। আপনারা এ দেশের বুকে পারিবারিক জীবনের মডেল স্থাপন করুন। আপনাদের পারিবারিক জীবনের নমুনা দেখে এদেশের বোনেরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে অনুপ্রাণিত হবে বলে আমি আশা করি।

চোখের অপারেশন

হযরত মাওলানা বহুদিন থেকে চোখের অসুখে ভুগছিলেন । ডাক্তারদের পরামর্শে ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে বোষ্েতে তার বাম চোখে প্রথম অপারেশন হয়। কিন্ত্ত সে অপারেশন সফল হয়নি। অপারেশনের পরে যে ধরনের বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজন ছিল এবং যে সতর্কতা অবলম্বনের দরকার ছিল বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে তাও সম্ভব হয়ে উঠেনি। ফলে চোখের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যেতে থাকে ।

১৯৬৫ সালের ২২শে জুন হযরত মাওলানা এ অবস্থায় "দ্বীনী তা'লীম কাউন্সিলের প্রোথামে মিরাঠ সফরের সময় একদিন সকালে অনুভব করেন যে, বাম চোখের জ্যোতি একেবারেই শেষ । লাখনৌ ফিরে এসে ২৬ শে জুন তিনি সীতাপুরের বিখ্যাত চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসার পর একটু ভালো লাগলে তিনি লাখনৌ ফিরে আসেন এবং লেখাপড়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৬৫ সালের ৫ ই ডিসেম্বর চোখের অবস্থা মারাত্রক হয়ে পড়লে তিনি পুনরায় ৭ই ডিসেম্বর সিতাপুর হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময় হযরতের বাম চোখে €েটি অপারেশন হয়। প্রচণ্ড ব্যথায় এ সময় হযরত মাওলানা ছটফট করতেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের একটি করুণ অধ্যায়। হযরতের বৃদ্ধা আম্মা ও অন্যান্য আত্রীয়স্বজন অস্থির হয়ে পড়েন। ২/৩ মাস থাকার পর তিনি হাসপাতাল ত্যাগ করেন। পরে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করানোর ফলে ব্যাথা কিছুটা উপশম হয়। হযরতের ডান চোখের অবস্থাও ভালো ছিল না। তিনি এ সময় হতে নিজে লিখতে এবং পড়তে পারতেন না। খুবই কষ্ট করে তার সফর এবং অন্যের সাহায্যে লেখাপড়ার কাজ চালু ছিল। এ অবস্থা প্রায় ১৩/১৪ বছর জারী ছিল।

১৯৭৭ সালে আমেরিকা সফরের সময় হযরত মাওলানার ডান চোখ অপারেশনের ব্যাপারে বনু এন্ডেখারা, দু'আ এবং পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। & সময় আমেরিকার ফ্লাডিলফিয়ার বিখ্যাত চক্ষু বিশারদ ডাঃ শায় খুবই নামকরা বাক্তিত্ব ছিলেন। তার কাছে হযরতের বড় ধরনের পরিচিতি তুলে ধরা হয়ে ছিল। ডাঃ শায় নিজেও খুবই আথহের সাথে একাজে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭৭ সালে অনেক চিন্তা-ভাবনা পর তিনি ২৯ শে জুন ডাঃ শায় এর আই ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার.পর পহেলা জুলাই অপারেশন হয়। আল্লাহ পাকের অসীম রহমতে এ অপারেশন কামিয়ীব হয়। তিনি দীর্ঘ ১৩/১৪ বছর পর নতুন জীবন লাভ করেন। এ অপারেশনের সময় হযরতের ভাগিনা নদওয়ার বর্তমান নাষেম হযরত মাওলানা রাবে সাহেব উপস্থিত ছিলেন। আমেরিকায় হযরতের গুণগ্রাহীরা তাদের অন্তর হযরতের সেবায় উজাড় করে দেন। ঠিক অপারেশনের সময় শায়খুল হাদীছ হযরত মাওলানা যাকারিয়া (রহ.)-এর মাধ্যমে বায়তুন্রাহ শরীফে দোয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ১২ দিন পর তিনি হাসপাতাল ত্যাগ করেন। এক সপ্তাহ পরে ডাক্তার শায়-এর কাছে চক্ষু পরীক্ষার পর কিছুটা আরামের জন্য তিনি তৃতীয় বার শিকাগো যান। ২ রা আগষ্ট শিকাগো থেকে চোখ দেখানোর জন্য পুনরায় ফিলাডিলফিয়া আসেন এবং ডাক্তার শায়-এর সাথে দেখা করেন। ডাক্তার শায় বাকি সেলাইশুলো কেটে দেন।

অপারেশন সম্পূর্ণ কামিয়াৰ হওয়ায় হযরত মাওলানা তাকে ধন্যবাদ জানান। উন্লেখ্য ডাক্তার শায় এ অপারেশনের কোন ফিস গ্রহণ করেননি এবং অন্যান্য খরচপত্র খুবই কম নিয়েছিলেন । প্রায় সোয়া ২মাস সফর শেষে ১৯৭৭ সালে ৯ আগষ্ট তিনি আল্লাহ পাকের রহমতে নিরাপদে লাখনৌ' ফিরে আসেন। �

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নদভী[সম্পাদনা]

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব জাতির ইহ ও পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণের একমাত্র নিয়ামক হিসেবে যে বিধিনিষেধ আম্মিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে দান করেছেন তার সর্বশেষ ও চূড়ান্ত রূপ আল-কুরআন নাযিল হয়েছে সাইয়েদুল মুরসালীন খাতামুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ।

কুরআন মজীদের বিধান ও মহানবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে মুসলিম জাতি গোটা বিশ্বে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল । বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠতু প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত হয়েছিল ।

মরু আরবের এক নিভৃত কুটিরে জন্ম নেওয়া মুহাম্মাদ (সা.) ইবনে আবুল্লাহকে সারা বিশ্ব মেনে নিয়েছিল মানবজাতির সবাঁধিক কল্যাণকামী ও হিতাকাজক্ী মহান পুরুষ হিসেবে । কিন্তু কালক্রমে মুসলিম জাতির অগ্রযাত্রা স্থগিত হয়ে যায়। আদর্শবিচ্ুতি ও কর্মস্থবিরতার কারণে তাদের নিম্গামিতা শুরু হয়। বিশ্বনেতৃত্ব ও মানবপরিচালনার জন্য সৃষ্ট মুসলিম মিল্লাত এখন সকল ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ।

এমত পরিস্থিতি থেকে ইসলামী উম্মাহকে পুনরায় বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে ফিরিয়ে আনার উপায় সম্পর্কে, হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) তীর কালজয়ী রচনা “মা যা খাছিরাল আলামু বি ইনহিতাতিল মুসলিমীন' গ্রন্থে ষে রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন এখানে তার সার সংক্ষেপ তুলে ধরা হল।

মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ প্রতিষ্ঠা[সম্পাদনা]

বিশ্ব মান্বতার সকল অশান্তি ও অকল্যাণের মাত্র একটিই সমাধান রয়েছে। তাহল বিশ্ব নেতৃতু ও পরিচালনা সেই পাপিষ্ঠ ও মানবতার রক্তে রঞ্জিত হাত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, যা মানব জাতিকে চিরতরে নিমজ্জিত করার অঙ্গীকার করে রেখেছে। আমানতদার, দায়িত্বশীল, খোদাভীরু অভিজ্ঞদের হাতে এ নেতৃত্ব আসতে হবে, যাদেরকে মানবুজাতির পরিচালনার জন্য আদিকাল থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলপ্রসূ ও কার্যকর বিগ্নুব শুধুমাত্র এই যে, বৃটেন, আমেরিকা, রাশিয়া ও তাদের দোসর প্রাচ্য ও এশিয়ার জাতিসমূহ তথা জাহেলিয়াতের বলয় থেকে বিশ্ব নেতৃত্ব ও মানবজাতির কর্তৃত্ব চলে আসতে হবে সেই জাতির হাতে, যার নেতৃত্ রয়েছে মানবজাতির মহান নেতা বনিআদমের শ্রেষ্ট ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়াসাল্লামের হাতে। তার কাছেই রয়েছে বিশ্বকে পুনঃনির্মাণ ও মানবতার পুনর্জাগরণের নীতিমালা ও শিক্ষা। যার ঈমান বিশ্বকে বর্তমানের জাহেলিয়াত থেকে ঠিক তেমনি উদ্ধার করতে সক্ষম, যেমনটি সক্ষম ছিল চৌদ্দশত বছর পূর্বে ।

ঈমানের নবায়ন[সম্পাদনা]

কিন্তু এই মহান কাজের জন্য ইসলামী জাহানকে আত্মপ্রসতি ও আত্ম পরিবর্তন সাধন করতে হবে। এজন্য প্রথম প্রসতি এই যে, ইসলামী জাহানকে ইসলামের প্রতি নতুন ও টাটকা ঈমান আনতে হবে। ইসলামী জাহানের জন্য নতুন' ধর্ম, নতুন পয়গম্বর, নতুন শরীয়ত ও নতুন শিক্ষার মোটেই প্রয়োজন নেই। সূর্যের মত ইসলাম কখনও পুরাতন ছিল না, পুরাতন নয়ও। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুয়ত স্থায়ী ও চূড়ান্ত। তার আনীত ধর্ম সংরক্ষিত রয়েছে, তীর শিক্ষা সদা সজীব । কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইসলামী জাহানকে নতুন করে ঈমান আনতে হবে। নতুন ফিতনা, নতুন শক্তি, নতুন প্রচারণা ও নতুন আহকামসমূহের মোকাবেলা দুর্বল ঈমান ও নিছক আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা সম্ভব নয়। ড্যাম হয়ে যাওয়া কোন ভবন নতুন প্রাবন ও নতুন ঢেউ সহ্য করতে পারে নাঁ। তাছাড়া কোন মতবাদের প্রবক্তার জন্য জরুরী হল নিজের মতবাদের প্রতি তার অটল বিশ্বাস থাকতে হবে। তার মধ্যে এমন একজন ব্যক্তির মত আনন্দ ও ফুর্তি থাকতে হবে, যে কোন নতুন ভান্ডার লাভ করেছে। ইসলামী জাহান যদি বিশ্ব মানবতার মধ্যে নতুন প্রাণ ও নতুন জীবন সৃষ্টি করতে চায় এবং বিশ্বকে বর্তমানের বন্তুপুজা ও সংশয় সন্দেহ থেকে উদ্ধার করতে চায়, তাহলে প্রথমে নিজেদের মধ্যে ঈমানের নবায়ন ঘটাতে হবে।

অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি[সম্পাদনা]

ইসলামী জাহান যদি এ মহান দায়িত্ব পালন করতে চায়,তাহলে মুসলমানদের আভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি এবং নিজেদের ভিতরকার অবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। ধর্মবিবর্জিত পাশ্চাত্যের মোকাবেলা করতে হলে তা' শুধুমাত্র অন্তঃসারশূন্য সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডদ্বারা সম্ভব নয়। তেমনি পাশ্চাত্য ভাষায় পারদর্শিতা ও পশ্চিমা জীবনধারা আয়ত্ত করার মাধ্যমেও তা সম্ভব হবে না। কেননা জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির সাথে এসবের কোন সম্পর্ক নেই। বরং পাশ্চাত্যে নৈতিকতা, ধর্মপরায়ণতা ও অরষ্টাযুখীতার যে তীব অভাব বিরাজ করছে, মুসলমানদেরকে সেই অভাব পূরণ করতে হবে। ইসলামের প্রাণশক্তি, মুসলমানদের নৈতিক দৃঢ়তা ও ধর্মবিশ্বাসের অবিচলতাই এক্ষেত্রে প্রধান সহায়ক হবে। তাই মুসলমানদের ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। পার্থিব জীবনের মোহ পরিত্যাগ করতে হবে। প্রবৃত্তির তাড়না নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে । মুসলমানদের মধ্যে শাহাদাতের আগ্রহ এবং জান্নাতের আশা তীব্র করতে হবে। পার্থিব সম্পদের ক্ষণস্থায়িত্ব ও তুচ্ছতা তাদের মনে বদ্ধমূল করতে হবে। আল্লাহর পথে তারা সকল বিপদ-মুসিবত আনন্দের সাথে বরণ করে নিতে প্রস্তত থাকবে। প্রকৃতপক্ষে একজন বিধর্মীর সাথে মুসলমানের পার্থক্য থাকবে এখানেই। এমন মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।

ইসলামী জাহানে এমন দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গেছে যখন মুসলমানদের এই রূহানী শক্তির কোন মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে মুসলমানদের মধ্যে এ শক্তি স্তিমিত হতে হতে এক পর্যায়ে তার অস্তিত্ব সন্দেহজনক হয়ে গেছে।

সুতরাং বর্তমানে ইসলামী জাহানের নেতৃবৃন্দ, চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনসমূহের জন্য জরুরী হল, মুসলমানদের অন্তরে ঈমানের বীজ পুনরায় বপনের চেষ্টা করা, দ্বীনী চেতনা উজ্জীবিত করা। নবী করীম (সা.) প্রথমেই যে নীতিমালা অনুযায়ী মানুষদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন, সেই নীতিমালা ও দৃষ্টিতঙ্গি নিয়ে মুসলমানদেরকে ঈমানের পথে আহবান জানাতে হবে। আল্লাহ, রাসূল ও পরকালের বিশ্বাসের মাত্রা প্রবলতর করার �

আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদী রহ. - ১৯৬

জন্য শিক্ষা "ও দীক্ষা দিতে হবে। এজন্য ইসলামের প্রাথমিক যুগে যেসব পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল, এখনও তা-ই অবলম্বন করতে হবে। একই সাথে আধুনিক যুগে যেসব উপকরণ ও মাধ্যম সৃষ্টি হয়েছে, তা-ও ব্যবহার করতে হবে । া

চেতনার দীক্ষা[সম্পাদনা]

কোন জাতির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর হল, তাদের মধ্যে সঠিক চেতনার অভাব। যে জাতি সকল প্রকারের যোগ্যতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ভালমন্দের পার্থক্য করতে পারে না, শক্র-মিত্র চিনতে পারে না, অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে না, পরিচালক ও নেতৃবৃন্দের কার্যকলাপের জবাবদিহিতা আদায় করতে পারে না, দুষ্টদের দমন করতে পারে না, স্বার্থপর নেতাদের বাগাড়ম্বরে মুগ্ধ হয়ে যায় এবং বারবার প্রতারিত হয়, সে জাতি কখনই উন্নতি লাভ করতে সক্ষম হয় না।

পশ্চিমা জাতিগুলোর মধ্যে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের দারুণ শূন্যতা বিরাজ করলেও তাদের মধ্যে নাগরিক চেতনা ও রাজনৈতিক সচেতনতা পূর্ণরূপে বিদ্যমান। তারা তাদের নেতৃত্বের আসনে এমন ব্যক্তিদের অধিষ্ঠিত হতে দেয় না, যারা অযোগ্য কিংবা জাতীয় স্বার্থে আপোষকামী।

সুতরাং ইসলামী জাহানের জন্য নেহায়েত প্রয়োজন হলো, মুসলিম মিল্লাতের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে ইসলামী চেতনা সৃষ্টি করা এবং দ্বীনী মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা । শিক্ষার প্রসার ও শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বৃদ্ধির দ্বারা চেতনার উপস্থিতি প্রমাণিত হয় না। যদিও শিক্ষার ব্যাপকতা ও শিক্ষার প্রসার চেতনা জাগ্রত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, কিন্তু ব্যাপকভাবে চেতনা সৃষ্টির জন্য সুশৃংখল ও ব্যাপক নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

ইসলাম একটি আসমানী ধর্ম। অহী ও নবুওয়াতই ইসলামের ভিত্তি। ইসলাম তার অনুসারীদের মধ্যে এক বিশেষ চেতনা সৃষ্টি করেছে, যা সবচেয়ে পরিপূর্ণ, প্রশস্ত ও গভীর চেতনা । ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য এক বিশেষ চিন্তা পদ্ধতি সৃষ্টি করেছে, যা জাহেলী চিন্তাধারা থেকে ভিন্নতর ৷ ইসলাম তার অনুসারীদের মধ্যে এমন এক চেতনা ও আত্মপোলন্ি দান করেছে, যা ব্যাপক ও সম্প্রসারণশীল হওয়া সত্তেও সাংঘর্ষিক ও নীতিবিরুদ্ধ চিন্তাধারা এবং যুক্তিপদ্ধতির সাথে আপোষ করে না।ইসলামী চেতনার দীক্ষা লাভের কারণে সাহাবায়ে কেরাম কোন অন্যায়ও ভুল সিদ্ধান্তকে প্রশ্রয় দিতেন না। এমনকি স্বয়ং খলীফার কাজেও তারা আপত্তি তুলতে দ্বিধাবোধ করতেন না। এ কারণে বনু উমাইয়। শাসকগণকে পদে পদে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে.হত সাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে। যতদিন সাহাবায়ে কেরামের কেউ জীবিত ছিলেন, ততদিন বনু উমাইয়া শাসকদের পক্ষে নির্বিঘ্নে ক্ষমতা চালানো সম্ভব হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে যে কোন বিপ্লুব সফল হওয়ার জন্য জনগণের মধ্যে চেতনার অনুভূতি একান্ত প্রয়োজন। যখন কোন সমাজ বা দেশের চেতনা জাগ্রত হয় এবং মানুষের মন কোনদিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন সে জনতার, যে প্রীবন সৃষ্টি হয় তা রোধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দা বিপ্লব সম্ভব করে তুলেছিলেন বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। তারা জনমত গড়ে তুলেছিলেন বিরাট পরিবর্তনের পক্ষে । একারণেই সেখানে বিপ্ুব সংঘটিত হয়েছিল ।

পশ্চিমা বিশ্বে শত অধঃপতন ও অনৈতিকতা সত্ত্বেও যে কারণে বিশ্বব্যাপী তাদের প্রাধান্য বিস্তার অব্যাহত রয়েছে, তা হলো নাগরিক জীবনের দায়িতৃশীলদের সচেতনতা ও রাজনৈতিক অনুভূতি । এখন পর্যন্ত ইংরেজ ও আমেরিকানদের মধ্যে এমন ব্যক্তি খুজেও পাওয়া মুশকিল, যে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্তলি দেয়, কিংবা রাষ্ত্রীয় তথ্য ফাঁস করে দেয় অথবা অকেজো যুদ্ধান্ত্ খরিদ করে। পশ্চিমাদের অনৈতিকতা তাদের ব্যক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত সীমিত। সেখানকার নেতৃবৃন্দ মিথ্যাচার করেন, প্রতারণা করেন, অন্য কোন জাতিকে - বশীভূত করতে কৌশল অবলম্বন করেন। কিন্ত এসবই তাদের জাতীয় স্বার্থে, ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়। অবশ্য ইসলামে এসব অপকর্মের কোন অবকাশ নেই। ব্যক্তি কিংবা সমষ্টি কারো সাথেই, কারো স্বার্থেই অনৈতিক আচরণ ইসলামে সমর্থিত নয়। কিন্তু পশ্চিমা কোন ব্যক্তি যা কিছুই করে তা সচেতনতা ও এক বিশেষ নৈতিক দর্শনের অধীনে । পক্ষান্তরে প্রাচ্যের কোন ব্যক্তি যা করে তা অবচেতন ও ব্যক্তিগত স্বার্থের অধীনে করে।

মুসলিম দেশগুলোর শাসক ও নেতৃবৃন্দের জন্য অসম্ভব নয় ব্যক্তিগত স্বার্থ কিংবা আরাম-আয়েশের জন্য নিজের দেশকে বন্ধক রাখা, কিংবা কারো কাছে দাসখত দেওয়া, কিংবা নিজের দেশের জনগণকে ছাগল-গরুর মত বিক্রি করে দেওয়া, কিংবা দেশকে এমন যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলা যাতে দেশের কিংবা জনগণের কোন স্বার্থ নেই, বরং ক্ষতি রয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এতদসত্তেও তাদের ক্ষমতা কিংবা নেতৃত্ব বহাল থাকে। জনগণ এমন নেতাদেরই জয়গান করে, তাদের নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি তোলে। নেহায়েত অসচেতন ফিংবা আন্বীতোলা না হলে কোন জাতির পক্ষে এমনটি সম্ভব হয় কি?

এমন অনেক মুসলিম দেশ রয়েছে, যেখানে মানবাধিকার বলতে কিছুই নেই। জনগণের সাথে জন্ত-জানোয়ারের মত আচরণ করা হয়। জনগণ শুধু ক্লেশ করার জন্য আর শাসক ও অভিজাত শ্রেণী শুধু ভোগবিলাসের জন্য৷ ' সেখানে প্রকাশ্যে আল্লাহর নাফরমানী করা হয়, মানবতার মর্যাদা ভুলুষ্ঠিত করা হয়, শরীয়তের বিধান পদানত করা হয়। কিন্তু জনগণের মধ্যে কোন ক্ষোভ নেই, দুঃখ নেই, কারো অন্তরে ব্যথা অনুভূত হয় না। প্রকৃতপক্ষে মানবীয় চেতনা ও ইসলামী মূল্যবোধের অভাবেই এমন ভয়ানক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

তাই ইসলামী জাহানের জন্য বিরাট খেদমত হবে এই যে, মুসলমানদের মধ্যে সঠিক চেতনা সৃষ্টি করতে হবে। যে চেতনা কোন অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করবে না, ধর্ম ও নৈতিকতায় কোন বিচ্যুতি মেনে নেবে না, ভুল-শুদ্ধ, নিষ্ঠা-শঠতা, শক্র-মিত্র ও কল্যাণ-অকল্যাণের মধ্যে অনায়াসে পার্থক্য করতে সক্ষম হবে। কোন অপরাধী ক্ষোভ ও ভর্থসনা থেকে রেহাই পাবে না। নিষ্ঠাবান পাবে স্বীকৃতি ও প্রশংসা। জনগণ তাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়াদিতে সঙ্ঞানতা ও পরিপকৃতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম ও যোগ্য হবে। যতদিন পর্যন্ত এরূপ চেতনা সৃষ্টি না হবে, কোন ইসলামী দেশ ও জাতির কর্মদ্যোম, যোগ্যতা, স্বীনী জাগরণ এবং ধর্মীয় জীবনের দৃশ্য ও আচার-অনুষ্ঠান কোনই কার্যকর ভূমিকা রাখবে না।

ব্যক্তি ও গোস্ঠীস্বার্থ বিসর্জন[সম্পাদনা]

ইসলামে ব্যক্তিস্বার্থের কোন অবকাশ নেই। এতে ব্যক্তিগত প্রাধান্য বা গোষ্ঠীগত প্রাধান্য ও ব্যক্তি স্বার্থের কোন স্থান নেই। তেমনি ইউরোপ- আমেরিকায় সংগঠন বা দলের স্থার্থরক্ষার যে ব্যবস্থা চালু রয়েছে তারও কোন অনুমোদন ইসলামে নেই। নতুন ইসলামী নেতৃত্বের জন্য তাই সকল প্রকার ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ ও আঞ্চলিক স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে। সকল প্রকার সংকীর্ণতার উর্ধে স্থান দিতে হবে মুসলিম মিল্লাতের সামষ্টিক স্বার্থকে।

প্রযুক্তিগত ও সামরিক প্রস্তুতি[সম্পাদনা]

ইসলামী জাহানের দায়িত্ব এখানেই শেষ নয়। যদি ইসলামের বাণী প্রচার করতে হয় এবং বিশ্বের নেতৃত্ব ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে হয়, তাহলে বিশেষ শক্তি, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান এবং বাণিজ্য ও সমরবিদ্যায় পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। ইসলামী জাহানকে সকল ক্ষেত্র ও প্রয়োজনে পশ্চিমাদের প্রতি মুখাপেক্ষিতা থেকে যুক্ত হয়ে স্বনির্ভর হতে হবে। খাদ্য ও বন শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে, যুদ্ধান্ত্ও নিজেদেরই নির্মাণ করতে হবে। খনিজ সম্পদ আহরণে অন্যের সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। নিজেদের প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানসমূহ নিজেদেরই সম্পদ ও লোক দিয়ে চালাতে হবে। মুসলিম দেশগুলোর সমুদ্রসীমায় মুসলমানদের নৌবহর থাকতে হবে। শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে নিজেদেরই নির্মিত জাহাজ, গোলাবারুদ ও অস্ত্র দিয়ে। আমদানীর চেয়ে রপ্তানি হতে হবে বেশি। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে খণ গ্রহণের প্রয়োজন যেন না পড়ে। কারো পতাকাতলে আশ্রয় গ্রহণের কিংবা কোন বলয়ে অন্ত্ভুক্তিতে যেন বাধ্য হতে নাহয়।

ইসলামী জাহান যতদিন প্রর্বস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যে পাশ্চাত্যের প্রতি মুখাপেক্ষী থাকবে, পাশ্চাত্য ততদিন ইসলামী দেশগুলোর রক্ত চুষতে থাকবে। মুসলিম বিশ্বেরই উৎপাদিত ফসলাদি পশ্চিমাদের কারখানার কীচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকবে, মুসলিম বিশ্বের বাজার ছেয়ে যাবে পশ্চিমাদের উৎপাদিত পণ্যে । ইসলামী দেশগুলো যতদিন পর্যন্ত পশ্চিমাদের নিকট থেকে ধণ নিতে থাকবে, নিজেদের প্রশীসন পরিচালনায়, গুরুত্ব পূর্ণ ও কীপোস্টগুলো পূরণে, নিজেদের সৈন্যদের ট্রেনিং দিতে পশ্চিমাদের লোকদের অনুগ্ধহের দাস থাকবে, সেখানকার বাণিজ্য ও শিল্পপণ্য আমদানী, তাদেরকে বুদ্ধিজীবী, মুরববী ও পৃষ্ঠপোষক মনে করবে; “ততদিন পর্যন্ত ইসলামী 'জাহানের পক্ষে পাশ্চাত্যের মোকাবেলা করা তো দূরের কথা, তাদের প্রতি চোখ তুলে তাকানোও সম্ভব নয়।

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইসলামী বিশ্ব নিকট অতীতে খুবই উদাসীনতা ও অবহেলার পরিচয় দিয়েছে। যার ফলে দীর্ঘকাল যাবত ইসলামী বিশ্বকে হেয়তার জীবন যাপন করতে হয়েছে। অতঃপর এতে আধিপত্য ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পশ্চিমাদের । পশ্চিমারা এ সুযোগে বিশ্বব্যাপী ধ্বংসলীলা ও খুনখারাবী ছড়িয়েছে। যদি এখনও ইসলামী দেশগুলো বিজ্ঞান- প্রযুক্তিতে অগ্রসর না হয় এবং নিজেদের ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে ভুল করে, তাহলে তাদের ভাগ্যে থাকবে বঞ্চনা ও নিগ্রহ এবং বিশ্ব মানবতার দুর্ভোগের মেয়াদ আরো বৃদ্ধি পাবে।

নতুন শিক্ষাব্যবস্থা[সম্পাদনা]

ইসলামী জাহানের জন্য প্রয়োজন এমনভাবে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা যা হবে ইসলামের প্রাণশক্তি ও পয়গামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ । ইসলামী বিশ্ব প্রাচীন বিশে নিজেদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কুষ্টি কালচারের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয়েছিল। পৃথিবীর সাহিত্য ও দর্শনের গভীরে ইসলামই মজরুত অবস্থান নিয়েছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সভ্য দুনিয়া ইসলামী দর্শনের আঙ্গিকে চিন্তা করতো, ইসলামী ধারায় সাহিত্য রচনা করতো, ইসলামের ভাষায়ই গ্রন্থ সংকলন করতো । ইরান, তুর্কিস্তান, আফ্গানিস্তান ও ভারতের লেখক, সাহিত্যিকগণ কোন গুরুতৃপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করতে চাইলে আরবিতে লিখতেন। অনেকে মূলগ্রসথ আরবিতে লিখে তার সার সংক্ষেপ ফার্সিতে প্রস্তুত করতেন। যেমন ইমাম গাধ্যালী কিমিয়ায়ে সাআদাতে করেছেন। যদিও আব্বাসী যুগে প্রবর্তিত এই শিক্ষা আন্দোলন গ্রীক ও অনারব প্রভাবিত ছিল এবং ইসলামী স্পিরিট ও ইসলামী চিন্তাধারার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তাছাড়া শিক্ষা ও ধর্মীয় দিক দিয়ে তাতে বেশ কিছু দূর্বলতা ছিল, তথাপি শক্তি ও সজীবতার কারণে তা সারা দুনিয়াতে স্রোতের মত ছড়িয়ে পড়েছিল এবং প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থা তার সামনে থমকে দীঁড়িয়ে ছিল।

অতঃপর ইউরোপের অগ্রগতি ও উন্নতির যুগ এল। ইউরোপ নিজন্ব অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা এই প্রাচীন ব্যবস্থাকে যাদুঘরে স্থানান্তরিত করে এবং তার পরিবর্তে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করে। ইউরোপীয় দর্শন, চিন্তাধারা ও মনোবিজ্ঞানের সাথে পুরোগুরি সামঞ্জস্য রক্ষা করে এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রণীত হয়েছিল। এই শিক্ষা পরিবেশ থেকে যেসব শিক্ষার্থী বের হত তাদের শিরায়-উপশিরায় এক বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হত। বিশ্ব দ্বিতীয়বারের মত এ. শিক্ষাব্যবস্থার নিকট আত্মসমর্পন করে। ইসলামী বিশ্বকেও স্বাভাবিক নিয়মেই এ শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য স্বীকার কুরতে হল। কেননা দীর্ঘকাল ধরে এখানে জ্ঞানের নি্লগামিতা ও চিস্তার জড়তায় রুগ্ন অবস্থা বিরাজ করছিল । মুসলমানদের পেয়ে বসেছিল হীনম্মন্যতায় তারা নিজেদের পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ইউরোপের অনুকরণেই নিহিত বলে মনে করত। তাই সকল দুর্বলতা ও ক্রুটি-বিচ্যুতি সর্বেও মুসলিম বিশ্ব এ শিক্ষাব্যবস্থাই হণ করল যা অদ্যাবধি ইসলামী জাহানের সর্ব ঢালু রয়েছে।

স্বাভাবিক নিয়মেই ইসলামী ভাবধারা ও নতুন ভাবধারার মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হল। ইসলামী নৈতিকতা ও পাশ্চাত্য নৈতিক ধারার মধ্যে রশি টানাটানি হতে লাগল। বস্তুরাজির মূল্য ও মর্যাদা নির্ধারণে নতুন মাপকাঠি ও পুরাতন মাপকাঠির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হল। এ শিক্ষা ব্যবস্থার ফল দাঁড়াল এই যে, শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে সংশয়বাদিতা, শঠতা, অস্থিরতা, জীবনের প্রতি মায়া, প্রবৃত্তি পূজা ও বিলম্বিত উপকারের চেয়ে তাৎক্ষণিক উপকারকে প্রাধান্য দেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হল। পশ্চিমা দাতার, অনিবার্ অনুলদ রগ আরা রেস সু দিক নুরোছে তা সবই সৃষ্টি হল।

ইসলামী বিশ্ব যদি নতুন করে জীবন শুরু করতে চায় তাহলে শুধুমাত্র শিক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা নয়; বরং শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব, অর্জন করতে হবে। এটি কোন সহজ কাজ নয়। এর জন্য গভীর চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। এজন্য ব্যাপকভাবে রচনা সংকলন এবং বিভিন্ন শাস্ত্র নতুনভাবে বিন্যস্ত করার কাজ শুরু করা প্রয়োজন। এ কাজের যিনি নেতৃত্ব দেবেন তিনি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে এ পরিমাণ অবগতি ও গভীর দৃষ্টি রাখবেন যা যীচাই ও সমালোচনার পর্যায়ে পৌছে। একই সাথে ইসলামের আসল উৎস থেকে পূর্ণরূপে জ্ঞান আহরণ করে থাকবেন এবং ইসলামী প্রাণশক্তি ও চেতনায় উজ্জীবিত হবেন। একাজ এতই কঠিন ও শ্রমসাপেক্ষ যে, কোন সংগঠন বা সংস্থার পক্ষেও তা সম্পন্ন করা দুরূহ ব্যাপার। এটি ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের কাজ। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রথম নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সেটআপের প্রয়োজন হবে।

এমন বিশেষজ্ঞদের নির্বাচন করতে হবে, যারা প্রতিটি বিষয়ে পান্ডিত্য রাখেন। তীরা এমন শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করবেন, যাতে একদিকে থাকবে কিতাব ও সুন্নাহর অপরিহার্য ও দ্বীনের অপরিবর্তনীয় বিষয়াদি; অন্যদিকে প্রয়োজনীয় আধুনিক বিদ্যাসমূহ। তীরা মুসলমানদের নতুন প্রজম্মের জন্য আধুনিক বিদ্যাসমূহ নতুনভাবে বিন্যস্ত করবেন যা ইসলামের মূলনীতি ও ইসলামের মৌলিক চেতনার ভিত্তিতে হবে। তাতে এমন প্রতিটি বিষয় থাকবে, যা নতুন প্রজন্মের জন্য প্রয়োজনীয় যা দ্বারা তারা নিজেদের জীবনকে সাজাতে পারবে 'এবং নিজেদের প্রয়োজনাদি মেটাতে, স্বাধীনতা- সর্বভৌমত্ রক্ষা করতে ও নিজেদের সম্পদ কাজে লাগাতে পাশ্চাত্যের মুখাপেক্ষী হবে না। তারা নিজেদের অর্থব্যবস্থা নতুন করে সাজাবে এবং ইসলামী ভাবধারার আলোকে এমনভাবে পরিচালনা করবে যে, প্রশাসন ব্যবস্থা ও অর্থব্যবস্থায় ইসলামী ব্যবস্থাপনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় এবং অর্থসংক্রান্ত যেসব সমস্যার সমাধানে পশ্চিমা বিশ্ব হার মেনেছে ও অসহায়ত্ব স্বীকার করেছে, সেগুলোর সমাধান করবে। এই আধ্যাত্মিক কারিগরি ও সামরিক প্রস্তুতি এবং শিক্ষায় ম্বয়ংসম্পূর্ণতার মাধ্যমেই মুসলিম বিশ্ব উন্নতি ও অগ্চগতি অর্জন করতে পারবে, বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের বার্তা পৌছাতে পারবে এবং ধ্বংসোনুখ পৃথিবীকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। অতএব বিশ্বব্যাপী ইসলামী জাহানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আরব জাহানের গুরুতু ও দায়িত্ব অনেক বেশি।

কেননা খাতামুন্নাবিয়টান মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাছ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরব ভূমিতে আগমন করার কারণে বিশ্ব মুসলিমের কাছে আরবদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমীহ অপরিসীম । মহানবী (সা.) ঘোষণা করে গিয়েছেন যে, কুরাইশ বংশ থেকেই ইমামগণ হবেন। তাই আরবদেরই এগিয়ে আসতে হবে । আরবদেরই প্রস্তুত হতে হবে। মনে রাখতে হবে আরব জাহানের প্রধান শক্তি হল ঈমান। তাই ইসলামের প্রতি তাদের ঈমান ও নিষ্ঠা জোরদার ও নবায়ন করতে হবে। একই সাথে সামরিক, প্রযুক্তিগত ও আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ভুলে যেতে হবে। তবেই কল্যাণ, তবেই মুসলিম জাহান পুনরায় বিশ্বব্যাপী নিজেদের প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্িত করতে সক্ষম হবে । আর এতে করে বিশ্বমানবতার সার্বিক কল্যাণ সাধিত হবে।,

নতুন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা[সম্পাদনা]

সাথে সাথে আজ ইসলামী দুনিয়ার জন্য এমন গবেষণ] প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন যা নতুন ইসলামী সভ্যতার জন্ম দেবে, যে সভ্যতা আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীকে ইউরোপীয় জীবনধারার নাগপাশ থেকে ছিনিয়ে পুনরায় ইসলামের 'দিকে, : সার্বজনীন ইসলামী আদর্শের দিকে ফিরিয়ে আনবে। তাদের কেউ তো বুঝে শুনে আসবে, কিন্তু অনেকেই সময়ের আবহাওয়ায় প্রভাবিত হয়ে আসবে। যে সত্যতা যুবকদের চেতনায় নতুনভাবে ইসলামের বুনিয়াদকে প্রতিষ্ঠিত করবে, তাদের হৃদয় ও আত্মার খোরাক হবে। এ কাজের জন্য ইসলামী দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে এমন দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন যারা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এ লড়াইয়ের ময়দান থেকে পিছু হটবে না।

আমি আমার ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, আমি কশ্মিনকালেও এ সকল লোকদের দলভুক্ত নই যারা দ্বীন ও রাজনীতির মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করে। আমি না তাদের দলভুক্ত যারা পূর্বেকার সমস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্রেষণ থেকে হটে গিয়ে ইসলামের এমন ব্যাখ্যা-বিশ্রেষণ করে, যার দ্বারা ইসলাম যে কোন সমাজ ব্যবস্থা এবং যে কোন অবস্থার সাথে (চাই তা ইসলাম থেকে যতদুরে সরে গিয়ে হোক না কেন) ফিট হয়ে যায় এবং সব ধরনের সোসাইটিতে খাপ খায়। আমার তাদের সাথেও কোন সম্পর্ক নেই যারা রাজনীতিকে কুরআনে উল্লিখিত অভিশপ্ত বৃক্ষ .১0) 201 4 2548) 2১৮-2315 এর মতলব মনে করে। আমি এ সমস্ত লোকদের প্রথম সারিতে যারা মুসলিম জাতির মাঝে বিশুদ্ধ রাজনৈতিক চেতনা উজ্জীবিত করার প্রত্যাশী এবং প্রতিটি রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় যোগ্য নেতৃত্ব দেখার অভিলাধী। আমি তাদের দলভুক্ত যাদের বিশ্বাস, ইসলামী সমাজ ততক্ষণ পর্যন্ত কায়েম হতে পারে না, যে পর্যন্ত না ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় এবং ইসলামী আইনই রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার বুনিয়াদ হয়। আমি এর একজন একনিষ্ঠ দা'ঈ এবং যিন্দেগীর আখেরী নিশ্বাস পর্যন্ত এর উপর অবিচল থাকব।

মৃত্যুবরণ[সম্পাদনা]

জীবনের শেষ দিনগুলো[সম্পাদনা]

১৪১৯ হিজরী, মোতাবেক ১৯৯৯ইং সালের মার্চ মাসে কোরবানীর সময়ে হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তখন তা সামাল দিয়ে উঠলেও নিকটজনেরা ভাবতে লাগলেন যে, এ হলো সাময়িক সেরে ওঠা । যে কোন মুহূর্তে এ অমূল্য সম্পদ আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যেতে পারে। স্বয়ং হযরতও অনেক সময় ব্যথা ও দরদভরা কণ্ঠে বলে উঠতেন- “হে আল্লাহ তোমার সাক্ষাৎ চাই।” কখনো বলতেন- “এবার আমিও চলি।" “হে খোদা! খাতেমা বিল খাইর কর।” কখনো বলতেন- “হে আল্লাহ! আমাকে তোমার সান্নিধ্যে তুলে নাও- এভাবে অসহায়ত্ব সাথে আর কতদিন।” জনৈক খাদেমকে বিভিন্ন সময়ে বলতেন- “তোমাদের উপর অনেক বোবা চাপিয়েছি- আর মাত্র কয়েকটি দিন!” কখনো বলতেন- “এবার আমি চলি- আর মাত্র ক'টা দিন, আর মাত্র ক'্টা দিন।”

শাবানের শুরুতে হযরত মাওলানার খাদেম ও চিকিৎসকদের মনে যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছিল তা হল- হযরত এবার রমযান মাস কোথায় কাটাবেন? ভক্তদের পীড়াপীড়ি ছিল- হযরত এবার নদওয়ায় রমযান মাসটি কাটান। অবশেষে হযরতের ইচ্ছা ও মনোভাবের উপর ছেড়ে দেয়া হয়।

তিনি বললেন- রমযানের পূর্বে রায়বেরেলী যেতে হবে। সেমতে ২৭শে শাবান তাকিয়া গেলেন। ২৮ তারিখ সেখানে অবস্থান করে তিনি অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মাওলানা সাইয়েদ বেলাল হাসালীকে বললেন- আমাকে মসজিদে নিয়ে যাও। মসজিদের আঙিনায় জায়নামাব বিছিয়ে দেওয়া হল। তিনি দু'রাকাআাত নামায আদায় করলেন। অতঃপর মসজিদের ভিতরে গেলেন। সেখানেও দু'রাকআত নামায আদায় করলেন। অতঃপর বললেন- নদীর দিকে নিয়ে চল। সেখানে নবনির্মিত সিঁড়ি ঘাটের উপর দীড়িয়ে একবার চারিদিকে নজর বুলিয়ে বললেন- মাশাআল্লাহ্‌! মাশাআল্লাহ্‌!

এরপর মসজিদের পিছনের দিকে নিতে বললেন। যেখানে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহ.)-এর সময় থেকে একটি পাথর বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু ক্লান্ত হয়ে যাবার চিন্তায় আর সে ইচ্ছা পূরণ হল না। মসজিদ থেকে বের হতেই হযরত শাহ আলামুন্লাহ (রহ.)-এর রওযা। সেখানেই হযরতের ' পিতামাতা, ভাই-বোনসহ আরো অনেক বুযুর্গ চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন। সিঁড়ির পাশে হেলান দিয়ে দীড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে মরহুমদের উদ্দেশ্যে সওয়াব রেসানী করলেন। এরপর সেখান থেকে ফিরে ক্লান্তি সত্তেও বাড়ীর ভিতরে গেলেন। সেখানে বাড়ীর মহিলারা সকলেই সমবেত ছিলেন। সাথে হযরতের ভাগ্নে হযরত মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ রাবে হাসানী সাহেবও ছিলেন। পনের মিনিট পর বাড়ী থেকে বের হয়ে বাংলোয় আসলেন। যোহর নামাযের পর একটু বিশ্রাম নিয়ে আসরের নামায সময়ের শুরুতেই আদায় করলেন। অতঃপর বাড়ীর ভিতরে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তারপর লাক্ষৌ রওয়ানা হলেন।

প্রথম রমযান শুরু হলে তিনি বললেন- জানি না পুরো রমযান পাই কিনা। “হে আল্লাহ্‌! তুমি পুরো রমযানের বরকত দিয়ে ধন্য কর।' তারপর তিনি বললেন- ওষুধে যা করতে পারে না, রমধানে তা সিদ্ধ হয়।

রমযানের শেষ দশক রায়বেরেলিতে কাটাবার ব্যাপারে তিনি চিকিৎসকদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রেখেঙ্ি্লিন। ডাক্তার নজর, ডাক্তার আব্দুল মাবুদ, ডাক্তার সাইয়েদ কমরদ্দীন ও ডাক্তার কর্নেল শামছী এ পরামর্শে শরীক ছিলেন।

২০শে রমযান ১৪২০, মোতাবেক ২৯শে ডিসেম্বর ১৯৯৯ইং বিরাট এক বহর নিয়ে রায়বেরেলী রওয়ানা হলেন। এখানে ই'তেকাফকারী লোকজনে মসজিদ ভরে গেল। প্রথমদিন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- মসজিদে কতজন লোক? মৌলবী সাইয়েদ বেলাল হাসানী বললেন- মসজিদ ভরে গেছে। হযরত বললেন- প্রতিষ্ঠাতার ইখলাস! শেষদিনের রাতে তারাবীহের পরে যথারীতি মজলিসে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলেন। হযরতের যেসব গ্রন্থ দামেশুক থেকে ছেপে এসেছিল, তা দেখে তিনি বললেন- এসব আল্লাহ তা'আলাই লিখিয়েছেন। হযরতের এক খাদেম বাইরের দেশ সফর করে এসেছিলেন। তিনি জানালেন যে, জনৈক বিত্তশালী ব্যক্তি তুরস্কের এক প্রকাশক ও অনুবাদককে সাতাইশ হাজার ডলার দিয়েছেন হযরতের সকল রচনা প্রকাশ করে তুর্কিদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য। হযরত খুব আনন্দ প্রকাশ করলেন। মজলিসে ০:০০ 7৪৬ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন- পরিণাম শুভও হয়, অশুভও হয়। শেষে প্রশ্ন করলেন- কাল কি জুম'আতুল বিদা? :

অনন্ত জীবনের উদ্দেশ্যে[সম্পাদনা]

২২ শে রমযান ১৪২০ হিজরী, মোতাবেক ৩১শে ডিসেম্বর ১৯৯৯ শুক্রবার তিনি নিত্যদিনের মত সকল কর্মকান্ড পালন করেন। সাড়ে নয়টায় ঘুম থেকে জেগে ইন্তেঞ্া করেন। অযু করে নফল নামায আদায় করেন। অতঃপর কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করেন। তেলাওয়াতের সেজদাও করেন।

লাক্ষৌতে কুরআন মজীদ খতম করেছিলেন। শেষদিনে তেরতম পারা পাঠ করেন। মৌলবী সাইয়েদ জা'ফর মাসউদ হাসানী উপস্থিত হয়ে, হযরত মাওলানা তাকিয়ায় আগমন করায়, তাকিয়ার লোকজনের আনন্দের কথা তাঁকে জানান এবং বলেন, আপনি আগমন করলে এখানে বসন্তের আগমন হয়। হযরত বললেন- এ হলো তাকিয়ার বিশেষত্ব, যা ইনশাআল্লাহ অব্যাহত থাকবে। কিছুক্ষণ পর লাক্ষৌ থেকে ডাক্তার আব্দুল মাবুদ খানও উপস্থিত হন। হযরত বললেন- এত প্রকট শীতের মধ্যেও আপনি এসে গেলেন। তিনি বললেন- আমিতো হযরতের সাথে ওয়াদা করেছিলাম? তিনি এ-ও বললেন, আমি সাথে করে অক্সিজেন ও মনিটরও নিয়ে এসেছি, যাতে হযরতের কোন কষ্ট না হয়। একথা শুনে হযরত মুচকি হাসলেন।

অনেক বছর ধরে হযরতের চুল ছাটতেন সাবের । তিনি এসে হযরতের চুল ছেঁটে দিলেন। অতঃপর গোসলের প্রস্তুতি নিলেন। হযরতের খাদেম যাকাউল্লাহ খান বলেনঃ গোসলখানায় যাওয়ার পূর্বে হযরত প্রশ্ন করলেন- আজ কি ২২শে রমযান? আবার বললেন- জুম'আর নামায কি পনের মিনিট দেরী করে পড়া যায়? হযরতের খাদেম আলহাজ্জ আব্দুর রাষ্যাক বললেন- হযরত বললে দেরী করা যাবে। সাড়ে এগারটায় গোসল খানায় গেলেন। পনের মিনিটে গোসল সেরে কাপড় পরলেন। শেরওয়ানীর বোতাম লাগিয়ে দিলেন সাইয়েদ বেলাল হাসানী। অতঃপর তিনি বললেন- তোমরা প্রস্তুত হয়ে যাও। নামায পনের মিনিট দেরী করাবে। আমি এখন সূরা কাহাফ তেলাওয়াত করব। এ সূরা তেলাওয়াতের অভ্যাস তার আট বছর বয়স থেকে। একথা বলে তিনি বিছানায় বসলেন। কিন্তু সূরা কাহাফের পরিবর্তে সূরা ইয়াসীন পাঠ করতে লাগলেন। দশ-বারো আয়াত হয়ে থাকবে। হঠাৎ করে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। আয়াতটি ছিল ৫১৮ ৮13 2১84 ০১: । যেভাবে বসেছিলেন তা থেকে একটু পিছন দিকে হেলে পড়লেন। মৌলবী বেলাল হাসানী মাথা এবং খাস খাদেম হাজী আব্দুর রায্যাক পা ধরে খাটে শুইয়ে দিলেন । ডাক্তার সাইয়েদ কমরুদ্দীন ও ডাক্তার আবুল মা'বুদ খান নিকটেই ছিলেন। তারা অক্সিজেন লাগালেন । শিরায় ইনজেকশন দেয়া গেল না; তাই কোমরে দেয়া হল। ডাক্তার সাইয়েদ কমরুদ্দীন বুকে একটি ইন্জেকশন দিলেন। হাত দিয়ে বুকে মালিশ করলেন এবং মুখ দিয়ে বাতাস দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আল্লাহর পথের মুসাফির এসকল মেডিক্যাল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নিজ প্রভুর সান্নিধ্যে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন) '. তখন বারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকী। এ শোক সংবাদ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল এবং ভক্ত-অনুরক্ত, শুভানুধ্যারী ও স্বজনরা দলে দলে উন্মাদ হয়ে রায়বেরেলী পৌছাতে লাগল । মৌলবী সাইয়েদ হামযা হাসানী নদভী এই নাধুক ক্ষেত্রে গোসল, কাফন, জানাযা ও দাফনের সকল কাজ সম্পন্ন করেন।

গোসল দেওয়ার কাজে নিনোক্ত ব্যক্তিবর্গ অংশখহণ করেন। মৌলবী সাইদ বানু নদী যিনি (দক্ষিণ আফ্রিকা) রমযান মাস হযরতের সাহচর্ষে কাটাবার জন্য এসেছিলেন । তিনি হযরতের একজন খলীফাও। খাস খাদেম (মেদীনা), মৌলবী সাইয়েদ বেলাল হাসানী নদভী, হযরতের বিশিষ্ট অনুলেখক মৌলবী নেসারম্ল হক নদভী, যৌলবী নেয়া আহমাদ নদভী প্রমুখ । এ ক্ষেত্রে মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ রাবে হাসানী নদভী, মৌলবী সাইয়েদ -সালমান_ হুসায়নী নদভী ও মৌলবী আব্দুল্লাহ হাসানী নদভীও উপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া খাদেম আবুল সুইদ প্রতাপগড়ী, মাহমুদ হাসানী, মুহাম্মাদ মুয়াষ কান্ধলবী, সাইয়েদ শারেক ও খাদেম মেসবাহুদ্দীন সিদ্দীকী উপস্থিত থেকে সহযোগিতা করতে থাকেন। তাছাড়া মৌলবী সাইয়েদ হামযা হাসানী, সাইয়েদ জাফর মাসউদ হাসানী, সাইয়েদ আম্মার হাসানী এবং পরিবারের আরো অনেক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। মাগরিবের পরে সাতটা থেকে পৌনে দশটা পর্যন্ত শেষবারের মত দেখার জন্য লোকদের ভিড় লেগে থাকে। সময়' যতই এগিয়ে চলল, ততই ভিড় বাড়তে লাগল। জানাযার নামায দশটায় হবে বলে পূর্বেই ঘোষণা করা হয়েছিল। সেমতে ঠিক পৌনে দশটায় জানাযা উঠানো হয়। দু'মিনিটের পথ অতিক্রম করতে পঁচিশ মিনিট লেগে যায় । মসজিদের ভিতরে মিম্বরের পাশেই জানাযা রাখা হয়। মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ রাবে হাসানী জানাযার নামাষে ইমামতি করেন ।

সাড়ে দশটায় হযরতের লাশ মোবারক কবরে নামানো হয়। তাকে সমাহিত করা হয় শাহ আলামুল্লাহ কবরস্তানে। এখানে সর্বশেষ কবরের জায়গাটি তার জন্যই নির্ধারিত ছিল।


ইন্তেকালের পর বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও পত্র-পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদর্ভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির ইন্তেকাল হয় ২২শে রমযান ১৪২১ হিজরী, মোতাবেক ৩১শে ডিসেম্বর ১৯৯৯ইং শুক্রবার। প্রচন্ড শীত ও আবহাওয়ার তীব্র প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে প্রায় দুই লাখ মানুষ তার নামাযে জানাযায় অংশখহণ করে। মন্ধা মুকাররমা, মদীনা মুনাওয়ারা, দুবাই, শারজা, আম্মানসহ আরও অনেক জায়গায় তার গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। সৌদী আরবে সরকারীভাবে গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।

এ ছাড়াও রাবাত, আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, লিবিয়া, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, (মালয়েশিয়া) কাদাহ (মালয়েশিয়া) জাকার্তা (ইন্দোনেশিয়া) অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর বহু জায়গায় শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। যার বিস্তারিত বিবরণ এখানে উদ্ধৃত করা কঠিন। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় যেসমস্ত খবর বিশেষভাবে পরিবেশন করা হয়েছে শুধু তা-ই সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নে উল্লেখ করা হচ্ছে৷

লাখনৌতে অনুষ্ঠিত শোকসভা[সম্পাদনা]

আল্লামা নদীর ইন্তেকালে গোটা লাখনৌতে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। লাখনৌর মানুষ তাদের প্রিয় মানুষকে হারিয়ে যে নিদারুণ দহনে দগ্ধ হয় তার অভিব্যক্তি ঘটায় বিভিন্ন স্মরণসভার মধা দিয়ে।

“ইদারায়ে দারুল মুবাল্লিগীন লাখনৌর” আহ্বানে ৯ ফেব্রুয়ারী ২০০০ ইং তারিখে একটি বড় ধরনের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার আলোচ্য বিষয় ছিল “সত্য ও ন্যায়ের দূত” । এ সভায় মাওলানা আবুল্াহ আব্বাস নদভী, মাওলানা সাইয়েদ রাবে হাসানী নদভী, মাওলানা আব্দুল আলীম ফারুকী, ডক্টর মাসউদুল হাসান উসমানী প্রমুখ বিদগ্ধ ব্যক্তিগণ অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষায় মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদ্ভীর জীবনের বিভিন্ন দিক আলোচনা করেন। বিশেষভাবে আল্লামা নদভী (রহ')-এর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ইসলামের পথে মানুষকে দাওয়াত ও আহরান এবং আত্মশুদ্ধির প্রসঙ্গসমূহ আলোচিত হয়। এ ছাড়াও বক্তারা আরব ও বহির্বিশ্বের রীষ্টরপ্রধান ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সাথে মাওলানার নিঃস্বার্থ সম্পর্কের উপর বিশেষভাবে আলোকপাত করেন।

'আঙ্জুমানে যুহাম্মাদীয়া ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি' নাজিরাবাদ লাখনৌর আয়োজনে এক বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত স্মরণসভায় মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ রাবে হাসানী নদভী, মাওলানা সাঈদুর রহমান আজমী নদভী, মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া নদভী এবং ডক্টর কলবে সাদেক প্রমুখ মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীর আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব, তাঁর দাওয়াতী কাজসহ জীবনের প্রতিটি দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

লাখনৌতে আরো যেসব সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে তারমধ্যে মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী স্মরণ কমিটির উদ্যোগে বিজনৌর এলাকায়, গোলাগপ্রের ক্রিশ্চান কলেজ মাঠে এবং ইসলামী যুব সংঘের উদ্যোগে আহমাদাবাদের জামেয়া সাইয়েদ আহমাদ শহীদ-এ ও মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহর ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব আলোচনা সভায় “মাওলানা নদভী ও দেশ প্রেম”, শিরোনামে তাত্বিক ও সারগর্ভ আলোচনা হয়। � আলিগড়ের আলোচনা সভা আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির আরবী বিভাগ ২৩ এবং ২৪ শে ফেব্রুয়ারী ২০০০ ইং দুই দিনব্যাপী “মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী

নদভী (রহ.) হিন্দুস্তানের আরবী ও ইসলামী সাহিত্যের অগ্রনায়ক” শিরোনামে এক বিরাট আলোচনা সভার আয়োজন করে ।

উত্ত আলোচনা সভায় দেশবরেণ্য আলেম, পভিত, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক-সাংবাদিকসহ বিদগ্ধজন উপস্থিত হয়ে আল্লামা নদভী স্মরণে প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও আবেগাকুল কবিতা পাঠ করেন। এ আলোচনায় বারা অংশ নেন তাদের মধ্যে মাওলানা সাঈদুর রহমান আজমী নদভী বর্তমান নদওয়াতুল উলামার পরিচালক, ডঃ মাহমুদুর রহমান সাহেব ভাইস চ্যান্সেলর আলিগড় মুঙ্গলিম ইউনিভার্সিটি, প্রফেসর কাফীল আহমাদ, ডঃ. মুহাম্মাদ সালাহউদ্দিন উমরী, প্রফেসর মুহাম্মাদ রাশেদ নদভী ও প্রফেসর মুহাম্মাদ সালেম কুদওয়ায়ী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের আলোচনা সভা

আলিগড় ইউনিভার্সিটির আরবী বিভাগের উক্ত আলোচনা সভার কিছুদিন পর ৯ই আগষ্ট ২০০০ ইং তারিখে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ আরও একটা আলোচনা সভার আয়োজন করে। দুই দিনব্যাপী এ আলোচনা সভায় হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদতীর ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়।

এ আলোচনা সন্ভায় উপস্থিত ছিলেন মাওলানা নিযাম়ুদ্দীন সাহেব জেনারেল সেক্রেটারী “ইভিয়ান মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ড', মাওলানা মাসউদ আলম কাসেমী, প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়, মুফতী যফীর উদ্দিন সাহেব দারুল উলুম দেওবন্দ, ডক্টর ইশতিয়াক হোসাইন কোরাইশী লাখনৌ, মাওলানা সাইয়েদ সালমান আল- রূহুল কুদ্‌স নদভীসহ অনেক যুগশেষ্ট জ্ঞানী-গুণী-বুদ্ধিজীবী। শোকের ছারা দিল্লীতে _

মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর ইন্তেকালের পরই দিল্লীতে পয়ামে ইনসানিয়াতের উদ্দ্যোগে এক বিরাট শোকসভার আয়োজন করা হয়। ভারতের উপরাষ্ট্রপতি শ্রী কৃষাণ কান্তের সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

মাননীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছাড়াও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভি.পি. সিং. বর্তমান প্রধান মন্ত্রী সটলবিহারী বাজপেয়ী এক জরুরী সফরে দিল্লীর বাইরে যাওয়ার কারণে তার স্থলাভিষিক্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাননীয় রাজনাথ সিং এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। নদওয়ার বর্তমান নাজেম মাওলানা রাবে হাসানী নদভী, মাওলানা আব্দুল্লাহ আব্বাস নদী, মাওলানা আব্দুল করীম প্রমুখ বিশেষ ব্যক্তিগণ উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন।

এ ছাড়াও দিল্লী ইউনিভার্সিট, জওহর লাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি, শোকসভায় প্রফেসর-ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ জনতার ঢল নেমেছিল ।

দিল্লীর ঘিতীয় সেমিনার

রাবেতা আদবে ইসলামিয়ার দিশ্লীস্থ আঞ্চলিক শাখার উদ্যোগে আরও এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। উক্ত সেমিনারে আলোচনা করেন দিল্লীস্থ রাবেতার চেয়ারম্যান প্রফেসর মুহাম্মাদ ইজতেবা নদভী, সহকারী . চেয়ারম্যান প্রফেসর সাইয়েদ জিয়াউল হাসান নদভী, প্রফেসর শফীক আহমাদ খান নদভী । বক্তাগণ মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রেহ.)-কে এক আদর্শ পুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

এ ক্ষেত্রে জামেয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়ার কনফারেন্স হলে আয়োজিত মিল্লিয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের আলোচনাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এখানে বক্তব্য রাখেন খাজা হাসান সানী নেষামী, প্রফেসর নেসার আহমাদ ফারুকী, প্রফেসর জাফর আহমাদ নিষামী প্রমুখ মনীষী । বোন্ছে .

২৮ শে'মার্চ ২০০০ ইং তারিখে আঞ্জুমানে ইসলাম বোম্বের উদ্যোগে “মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) জীবন ও কর্ম” শীর্ষক এক মনোজ্ঞ আলোচনা 'সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায়. অংশ নেন মাওলানা মুহাম্মাদ সালেম কাসেমী, মাওলানা জিয়াউদ্দীন এসলাহী, মাওলানা তকীউদ্দীন নদভী মাজাহেরী, ডঃ মুহাম্মাদ ইসহাক, মাওলানা শামীম তারেক প্রমুখ মনীষী।

আওরঙ্গাবাদ

জামেয়া কাশেফুল উলুম আওরঙগবাদে ২৯ শে এপিল ২০০০ ইং এক . সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে মাওলানা রাবে হাসানী নদভী, মাওলানা ইজতিবা নদী, মাওলানা মুহাম্মাদ সালেম কাসেমীসহ আরও অনেক আলেম ও বুদ্ধিজীবী উপস্থিত ছিলেন। রায়বেরেলি

রায়বেরেলির ন্যাশনাল ইন্টার কলেজে মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে হাসানী নদভী, মাওলানা আব্দুল করীম, মাওলানা কলবে সাদেক, মাওলানা আব্দুল্লাহ মুগিসীসহ অনেকে বক্তৃতা করেন। কলকাতা

কলকাতায় মাদরাসা দারুল উলুমের উদ্যোগে মাওলানা আলী মিয়া নদভীর ইন্তেকালের পর বিশেষ সিস্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয় কলকাতা মুসলিম ইনৃষ্টিটিউট হলে । এতে মাওলানা সাঈদুর রহমান আজমী নদভী, মাওলানা আবু মাহফুযুল করীম মা'সুমী বলেন- "আল্লামা নদ্ভীর গোটা জীবন ও জীবনের প্রতিটি দিক ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যে ভরপুর । তীর প্রতিটি কাজে মুসলিম উম্মাহর প্রতি এক নীরব আহ্বান আর বার্তা নিহিত। আজ জাতির এই ক্রান্তি কালে আল্লামা নদভীর আদর্শ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজন ।” অনুষ্ঠানে আরও অনেকে বক্তুতা করেন।

কাশ্মীর

কাশ্মীরের শ্রীনগরে আঞ্জুমানে নসরতে ইসলামের উদ্যোগে মওলভী মুহাম্মাদ উমর ফারুকের তত্্ীবধানে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। দেরাদুন , , দেরাদুন শহরের ইসলামী যুব সংঘের উদ্যোগে মাওলানা আলী মিয়া অনুষ্ঠিত হয়।


আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শোকের প্রকাশ[সম্পাদনা]

নেপাল

নেপালের জামেয়া নূরুল ইসলাম জলপাপুরে এবং জামেয়া নূরুল উলৃমে পৃথক দুটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে মাওলানা আবুল হাসান আলী

নদভীর ইসলামী চেতনা সম্পর্কে আলোচনা হয়। আমিরাত ৮ই জুন ২০০০ ইং তারিখে 'আবনায়ে নদওয়া ফাউন্ডেশন দুবাইয়ে

“হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী জীবন ও কর্ম” শীর্ষক আলোচনা সভা সাইয়েদ খলীলুর রহমানের সভাপতিতে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে দুবাইয়ের উলামা, শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ সর্বমহলের নদভী ভক্তদের এক বিরাট দল উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ

বাংলাদেশে মাওলানা আলী মিয়ার ইন্তেকালের খবর পৌঁছানোর পর কয়েক জায়গায় গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশস্থ “মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদতী একাডেমীর" উদ্যোগে মাওলানা সুলতান যওক নদভী, মাওলানা সালমান ও মাওলানা আবু সাঈদ মুহাম্মাদ ওমর আলীর ব্যবস্থাপনায় এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় প্রেস ক্লাবের এ অনুষ্ঠানে দেশবরেণ্য ব্যক্তিগণ বক্তব্য রাখেন।

জাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশের উদ্যোগে কমিটির চেয়ারম্যান মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ও খন্দকার রঈস উদ্দিনের প্রচেষ্টায় এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় এবং আল্লামা নদভী (রহ.) স্মারক নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এছাড়াও বাংলাদেশস্থ রাবেতা আল-আদাবিল ইসলামীর উদ্যোগে “আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) জীবন ও অবদান” শীর্ষক এক মনোজ্ঞ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা সুলতান যওক নদী ।

মালয়েশিয়া মালয়েশিয়ায় হযরত আল্লামা নদভীর ইন্তেকালের খবর পৌছার সাথে

সাথে রাজধানী কুয়ালালামপুরসহ বিভিন্ন শহরে শোকের ছায়া নেমে আসে । কুয়ালালামপুর, তরঙ্গানো, কাদাহ, ক্রিন্টন, জাযিরাসহ বেশ কয়টি শহরে গায়েবানা জানাযা এবং বিভিন্ন শহর-বন্দরে স্বীনী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা আবুল হাসান আলী নদীর উপর এ স্মরণসভার ধারাবাহিকতা অনেক দিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বিভিন্ন শহরে একাধিক স্থানে বিভিন্ন শিরোনামে মাওলানা আলী মিয়া নদভী (রহ.) স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। তারমধ্যে ২৭ শে রমযান, ১৪২১ হিজরীতে মা'হাদুত্‌ 'তারবিয়াতিল ইসলামিয়া কাদাহ, কুয়ালালামপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির হায়ার স্টাডিজ এবং মালয়েশিয়ান যুবকদের বিখ্যাত সংগঠন ইসলামী যুব আন্দোলনের ঠেযাগ) উদ্যোগে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের আলোচনা সভা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব অনুষ্ঠানে আন্ত ্জাতিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হয়ে বক্তব্য পেশ করেন। একটি স্মারক খরন্থও প্রকাশ করা হয়।

ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তাসহ বিভিন্ন শহরে হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর গায়েবানা জানাযা এবং স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। থাইল্যান্ড

থাইল্যান্ডেও বড় বড় মসজিদে আল্লামা নদীর গায়েবানা জানাযা ও স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান

পাকিস্ত।নের করাচি, দাহোর, ফয়সলা বাদ, 'গুজরাণওয়ালা, ইসলামাবাদ, আকুড়াখটক, কোয়েটা, গেশওয়ার, হায়দারাবাদসহ বিভিন্ন শহর-বন্দরে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। যার বিস্তারিত রিপোর্ট বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। রাবেতা আলমে ইসলামীর পাকিস্তান দফতরের উদ্যোগে ইসলামাবাদ ও লাহোরে বিশেষ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

ইসলামাবাদে জাতীয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগেও আর একটি গুরুত্পূর্ণ সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করা হয়। এতে পাকিস্তানের: প্রেসিডেন্ট রফীক তারারসহ সেদেশের লেখক-গবেষক, সাহিত্যিক সাংবাদিকগণ অনেক মূল্যবান বক্তব্য পেশ করেন।

মিশর 8 .

রাবেতা আদবে ইসলামীর মিশর শাখা “ইসলামী সাহিত্যে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী” শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে। এতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, “হ্যরত মাওলানা নদভী (রহ.) পভিত, আলেমে দ্বীন, উচ্চতর গবেষক, প্রজ্ঞাবান চিন্তাবিদ-বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক এবং উঁচুমানের একজন লেখক ছিলেন।

মিশরস্থ নদওয়ার ছাত্রদের উদ্যোগে পৃথক আরও দুইটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও মিশরের বিভিন্ন শহরে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয় । দক্ষিণ আফ্রিকা

দক্ষিণ আফ্রিকায় শায়খুল হাদীছ হযরত মাওলানা যাকারিয়া (রহ.)-এর নামে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলৃম যাকারিয়ায় হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীর. উপর এক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত করেন মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে হাসানী নদ্ভী। আল্লামা নদভী স্মরণে আয়োজিত এই সম্মেলনে দারুল উলুমের মুফতী জনাব জিয়াউল হক সাহেবের রচিত একটি কবিতা এ মাদরাসার ছাত্ররা অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ও সুললিত কষ্ঠে পাঠ করে হযরত নদভী (রহ.)-কে শ্রোতাদের হৃদয়ে পৌছে দেয়

যুক্তরাজ্য

যুক্তরাজ্য মুসলিম কমিউনিটি ফোরাম ৩০ শে জুলাই ২০০০ ইং তারিখে হযরত মাওলানা নদ্ভীর উপর এক স্মরণসভার আয়োজন করে। এতে আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ ক'টি দেশের জ্ঞানী-গুণী, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক-সাংবাদিক-কলামিস্টসহ বহু ভক্ত জমায়েত হন এবং মাওলানা নদীর উপর বিসশ্ট্েষণমূলক আলোচনা পেশ করেন।

উত্তর ইংল্যান্ডের বাটলে (98115) শহরে ২৪ শে জানুয়ারী ২০০০ইং তারিখে একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয় । এতে মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব কাসেমী আল্লামা নদভী (রহ.)-এর জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, হযরত নদভী (রহ.)-কে আল্লাহ তা'আলা অসাধারণ যোগ্যতার জনি ফরেজিরেন। উর রতি উরি ছার একনিষ্ঠতা

বং দ্বীনের স্বার্থে সমস্ত কিছু বিসর্জন দেয়ার মত মন-মানসিকতা তার মধ্যে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল? এ সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে হযরত মাওলানা আতিকুর রহমান সম্ভলী: বলেন- মরহুম মাওলানা এমন এক বক্তিত্থের অধিকারী ছিলেন যে, যে ব্যক্তিই তীর সান্নিধ্য ও আকীদা-বিশ্বাসের পরশ পেয়েছে সে বহু মুল্যবান বস্ত পেয়েছে । এ ছাড়াও দেশে-বিদেশে তীর স্মরণে বহু সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

বিশেষ সংখ্যা[সম্পাদনা]

হ্যরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) ইন্তেকাল করলে অত্যন্ত বেদনা বিধুর ভাষায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। ইন্ডিয়ান রেডিও, টিভিতে বিশেষ গুরুত্বের সাথে এ সংবাদ প্রচার করা হয়। তীর বর্ণাঢ্য জীবন এবং কর্মের উপর যেসকল পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যা এবং স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করা হয় তারমধ্যে ভারতসহ পার্শব্তী দেশের কয়েকটা পত্রিকার কথা নিন উল্লেখ করা হচ্ছেঃ.

নদওয়াতুল উলামা থেকে আরবী পত্রিকা আল-বা'ছুল ইসলামী এবং আর-রায়েদ, উর্দু পত্রিকা তা'মীরে হায়াত ও ইংরেজী পত্রিকা টোন 0৮1৮৫ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে।

আঞ্জুমানে শাবাবে ইসলাম লাখনৌর মাওলানা সাইয়েদ সালমান আল হাসানী নদীর তত্ত্বাবধানে “বাঙ্গেদারা”, লাখনৌ থেকে “আল ফুরকান”, মাসিক “রিজওয়ান”(উদ্দু) হায়দারাবাদ থেকে প্রকাশিত আরবী পত্রিকা “আস্-সাহওয়াতুল ইসলামিয়া,” দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত “আদ-দারী” আরবী) পাক্ষিক “আশ্শারেক” (আজমগড় থেকে প্রকাশিত), “নাওয়ায়ে আদব বোষে”, কাশ্মীরের মাসিক “নুসরাতুল ইসলাম”, দিল্লী ইত্তেহাদ" এবং জয়পুর থেকে প্রকাশিত “হেদায়াত”, গাজীপুরের “তাযকীর" ইভিয়ান পত্রিকা হযরত মাওলানা মরহুম নদভী (রহ.) স্মরণে বিশেষ স্খ্যা প্রকাশ করে।

এ ছাড়াও পার্শবর্তী দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বিশেষ পাতা প্রকাশ, প্রবন্ধ, জীবন চরিত নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করে। পাকিস্তানের “আল- ফারুক”, “আল-বালাগ”, “তামীরে আফকার”, “খতমে নবুওয়াত” “তাকবীয়”, “ইয়ানাত”, “আনওয়ারে মদীনা”, “হক চার ইয়ার”, “আল- হুক”, “আন্-নসীহাহ”, “আস-সিয়ানাহ”, “তরজমানুল কুরআন” ইত্যাদি পত্রিকা বিশেষ প্রবন্ধ, জীবনী ও অন্যান্য বিষয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে।

এমনিভাবে বাংলাদেশে দৈনিক “ইনকিলাব”, “দৈনিক সংগা” ও “মাসিক মদীনা" এ উদ্দেশ্যে বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এ ছাড়াও হিন্দুস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় দেশগুলোর পত্রপত্রিকা হযরত আল্লামা নদভী (রহ.) স্মরণে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করে। আল্লাহ তাদের শ্রম স্বার্থক করুন এবং আল্লামা নদীর ব্যক্তিত্ব ও চিস্তা-চেতনায় জীবন গড়ার তাওফীক দান করুন।

মূল্যায়ন[সম্পাদনা]

মুফাক্কিরে ইসলাম হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ, প্রখ্যাত দায়ী এবং একজন বিখ্যাত লেখক। তার জীবনের সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি সমগ্র বিশ্বের উলামা-মাশায়খ, দ্বীনদার বুদ্ধিজীবী এবং সুসাহিত্যিক ও দার্শনিকদের নিকট ছিলেন সুপ্রিয় ব্যক্তিত্ব । হযরত মাওলানার জ্ঞান গভীরতা, ও যুসলিম মিল্লাতের প্রতি সীমাহীন দরদ ও বিশ্বমানবতার জন্য তার ব্যথাতুর হৃদয়ের আকুল আকুতির কারণে তাঁর অসাধারণ মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা পরিধি শুধু এ উপমহাদেশেই নয়; বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিস্তৃতি লাত করেছিল । এখানে হযরত মাওলানা আলী মিয়া (রহ.) সমসাময়িক খ্যাতনামা উলামা মাশায়খ ও ইসলামী চিন্তাবিদগণের নজরে কত প্রিয় এবং মর্যাদার অধিকারী ছিলেন তার কিছু নমুনা পেশ করা হচ্ছে।

আশরাফ আলী থানভী[সম্পাদনা]

১৯৩৪ সালে গরমের সময় হযরত আলী মিয়া লাহোরে তার শায়খ হযরত মাওলানা আহনদ আলী লাহোরী (রহ.)-এর নিকট অবস্থান করছিলেন। এ সময় তার বড় ভাই এক চিঠিতে লাহোর থেকে ফিরে আসার পথে থানাভবনে হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর সোহবতে কয়েকদিন কাটিয়ে আসার হুকুম দেন; সাথে সাথে থানাভবনে হাজিরা দেয়ার নিয়ম-কানুন ইত্যাদি সর্ম্পকে হুঁশিয়ার করে দেন। সেমতে হযরত আলী মিয়া লাহোর থেকে পত্র মারফত হযরত থানভী (রহ.)-এর নিকট তার নিজের পরিচয় দিয়ে থানা ভবনে হাজির হওয়ার অনুমতি চান। তখন তার বয়স ছিল ১৯ বছর। হ্যরত থানভী তীর পত্রের জবাবে তাঁকে থানা ভবনে হাজির হওয়ার অনুমতি দেন। ইতিমধ্যে হযরত থানভী (রহ.)-এর চিকিৎসার উদ্দেশ্যে লাখনৌ তাশরীফ নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ায় তিনি অন্য এক চিঠিতে আলী মিয়াকে লাখনৌর ঠিকানা দেন। কিন্তু এরপর নানান কারণে তীর থানা ভবনে ' হাজির হওয়ার সুযোগ হয়নি । অবশেষে ১৯৩৮ সালে হযরত থানভী (রহ.) . চিকিৎসার উদ্দেশে লাখনৌ এলে মাওলানা আলী মিয়ী তাঁর বড় ভাই- ডাঃ সাইয়েদ আব্দুল আলী সাহেবের সাথে হযরত থানভীর সোহবতে যাওয়া আসার সুযোগ লাভ করেন। তারপর থেকে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান চলতে থাকে । অবশেষে তিনি ১৯৪২ সালের মে অথবা জুন মাসে হযরত মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের সাথে কান্দালা এলাকা সফর করার সময় হযরতজীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ২৪ ঘন্টার জন্য থানা ভবনে হাজিরা দেন। হযরত থানভী তাঁকে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হন। ন্নেহ-ভালবাসা ও আদরের সাথে মেহমানদারী করেন। তিনি দুপুরের সময় পৌছেছিলেন। এ সময় তার লিখিত গ্রন্থ “সিরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ' হযরত থানত্রীর ডেস্কের উপর শোভা পাচ্ছিল।

যোহরের পর মজলিস শুরু হলে হযরত থানভী তীর বিশিষ্ট খলীফা হযরত খাজা আজিজুল হাসানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ডাঃ আব্দুল আলী সাহেবের ভাই এসেছে কিনা। তখন আলী মিয়া বললেন, হ্যা আমি এসেছি। হযরত থানভী বললেন, আপনি আমাকে অবগত করেননি । আমিতো আপনার সাথে নিরিবিলি কথা বলার জন্য চিঠিপত্র লেখার কাজ অনেকটা আগেই সেরে নিয়েছি।

একজন-নতুন কম বয়সী মেহমানের জন্য এ ছিল হযরত থানভীর ভীষণ রকমের রেয়ায়েত, যার ধারণাও তিনি করেননি। হযরত থানভী (রহ.) জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আর কোন সাথীতো নেই? খানার কোন নির্ধারিত নিয়ম আছে কিনা, কোন বিধি-নিষেধ বা বাছবিচার আছে কিনা? এরপর তিনি বলে দিলেন যে, আমার অসুস্থতার কারণে খানা আপনার সাথে খেতে পারবো না। অবশ্য আপনি আমার মেহমান। এর পর মজলিস শুরু হয়ে যায়। পরের দিন সকালে খাজা সাহেব হযরত থানভীর পয়গাম নিয়ে আসেন যে, অমুক সময় আমার বিশেষ মজলিস হবে, আপনি সে মজলিসে শরীক হতে পারেন অথবা পৃথক সময় চাইলে তা দেয়া যাবে। হযরত আলী মিয়া পৃথক সময় নেননি। শী বাছ মজলিসেই হযরতের সোহবত থেকে ফায়েদা নেন। এরপর দুপুরের দিকে তিনি থানা ভবন থেকে বিদায় নেন।

হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রেহ.)-এর কাছে আলী মিয়া যখন লাহোর থেকে প্রথম চিঠি লিখেছিলেন, সেই চিঠির জবাবে হযরত - থানভী শুরুতে যে সম্বোধন লিখে দেন তা ছিল “মুজাম্মাউল কামালাত” অর্থাৎ বিভিন্ন গুণের আধার। হাকীমুল উম্মতের মত যুগশ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদের কলম থেকে একজন নওজোয়ান আলেমের উদ্দেশ্যে এ ধরনের শব্দাবলী ব্যবহার করা হযরত আলী মিয়ার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বাক্ষর বহন করে। সাথে সাথে হযরত থানভীর অন্তরে হযরত আলী মিয়ার ইজ্জত এবং মাকাম কোন ধরনের ছিল তা প্রতিভাত হয়।

আব্দুল কাদের রায়পুরী[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা আব্দুল কাদের রায়পুরী (রহ.) তখন উপমহাদেশের খ্যাতনামা মাশায়েখের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। আলী মিয়ী হযরত রায়পুরীর হাতে রায়াত হয়েছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি হযরত রায়পুরীর নূরে নযর (নয়নমণি) হয়ে যান। মাওলানা মনযুর নো'মানী (রহ.) লেখেন যে, হযরত রায়পুরীর নিকট আলী মিয়ার যে মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা আমাদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায় । লাহোরের এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে

কাদীয়ানীদের উপর একখানা আরবী গ্রন্থ লেখার আলোচনা হলে হযরত

রায়পুরী বড় নির্ভরতার সাথে বলে ওঠেন যে, আলী মিয়া এলে আমি এ কাজ তার দ্বারাই করিয়ে নেব। আলী মিয়ার উপর তার অগাধ বিশ্বাস ছিল । আলী মিয়াকে নিয়ে তিনি গৌরব করতেন।

হষরত রায়পুরীর এক খাদেম বলেন যে, একবার ১৩৮০ হিজরীর রমযান মাসে রায়পুরে উলামা-মাশায়েখের ভীড় জমে যায়। এ সময় হযরতের জন্য, শায়খুল হাদীছ সাহেবের জন্য এবং হযরত আলী মিয়ার জন্য পৃথক পৃথক তিনটি সুন্দর খাট পাতা হয়। এটি সম্ভবত ১৪ই রমযানের ঘটনা। উক্ত খাদেম যার সাথে হযরতের বংশগত সম্পর্ক ছিল তিনি হযরত রায়পুরীর শরীর ম্যাসেজ করছিলেন। এক ফাঁকে তিনি রায়পুরী সাহেবের নিকট জিজ্ঞেস করলেন, হযরত! আপনার এবং শায়খের জন্য বিছানা পাতা আমাদের বুঝে আসে, কিন্তু আলী মিয়াকে এত সম্মান দেখানোর কারণ আমাদের বুঝে আসে না। হযরত তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছিলেন, “তোমরা জান না, আলী মিয়ী মুজাদ্দিদে আলফে ছানীর হক কথা, শাহ ওয়ালী উল্লাহর চিন্তা-চেতনা এবং সাইয়েদ আহমাদ শহীদের জযবায়ে জিহাদের ফটোকপি । হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মন্ধী, মাওলানা রহমাতুন্লাহ কিরানভী, মাওলানা রশীদ আহমাদ গৎগুহী এবং মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.) এর জিহাদে হেকমতে আমলীর উজ্জ্বল নমুনা এবং সাইয়েদ সুলায়মান নদভী, মাওলানা শিবলী নো'মানীর চিন্তাধারার বাস্তব চিত্র। মাওলানা ইলিয়াস, শায়খুল ইসলাম মাওলানা মাদানী এবং শায়খুল হাদীছ হযরত মাওলানা যাকারিয়া (রহ.) এর দু'আর ফসল। মনে রেখ, তিনি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) হাতে সকল আকাবিরীনের আওয়াজের মুখপাত্র এবং আমার চোখের মণি।

হযরত রায়পুরী রেহ.) নিজ মজলিসে প্রায় সময় আলী মিয়ার কিতাব- পত্র পড়ে শুনানোর নিয়ম চালু করে ছিলেন। তিনি আলী মিয়া ও তার নতুন গ্রন্থাবলীর অপেক্ষায় প্রহর গুণতেন। হযরত রায়পুরী আলী মিয়ার চিঠির জবাবে নিজের এই সাগরেদকে "সাইয়েদী ওয়া মাওলায়ী” বলে সম্বোধন করতেন। উপরের ঘটনাগুলোর দ্বারা হযরত রায়পুরীর অন্তরে মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদতীর কি ধরনের মর্যাদা ছিল তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

আয়ামা ইকবাল[সম্পাদনা]

১৯২৯ সালের জুল মাসে হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী €রেহ.) তার ফুফা মাওলানা মুহাম্মাদ তালহা এবং পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আবদুল্লাহ চাগতাই এর সাথে কবি ইকবালের বাসায় গিয়ে তার সাথে দেখা করেন। তখন হযরতের পরিচয়ের জন্য একথাগুলি বলা হয়েছিল।

(১) এ ছেলেটি “গুলে রায়ানা'র লেখকের ছেলে।

(২) এ ছেলেটি আপনার কয়েকটি কবিতার আরবী অনুবাদ. করেছে।

হযরত আলী মিয়া কবি সাহেবের “চান্দ' কবিতার আরবী অনুবাদ সাথে

নিয়ে গিয়েছিলেন । আল্লামাকে এ অনুবাদ দেখালে তিনি আশ্চর্য হয়ে ভাবতে থাকেন যে, এই বয়সে এ কি করে সম্ভব! বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য তিনি




আল্লামা সাইরেদ আবুল হাসান আলী নদর্ভী রহ, - ২৮৭

আলী মিয়াকে প্রাচীন আরব কবিদের সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। হযরত আলী মিয়া সে সকল প্রশ্নের এমন সুন্দর জবাব দেন যে, কবি ইকবাল খুশী হয়ে যান এবং বলে ওঠেন, “আপনি আরবী তাা ও সাহিত্যকে আপনার কর্মক্ষেত্র বানাবেন ।”

১৯৩৭ সালের ২২শে নভেম্বর তিনি তার ফুফা- লাহোর অরিয়েন্টাল কলেজের সাবেক প্রফেসরের সাথে গিয়ে ডক্টর ইকবালের সাথে দেখা করেন এবং ইসলামের গুরুতৃপূর্ণ বিষয়ে মত বিনিময় করেন।

আল্লামা ইকবালকে আরব দেশে পরিচিত করেন[সম্পাদনা]

হযরত আলী মিয়া যখন মিশর ও সিরিয়ার আরবী পত্র-পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও উপমহাদেশীয় অন্য কবিদের প্রশংসা এবং আলোচনা দেখতেন তখন তিনি জুলে উঠতেন। তিনি তখন আল্লামা ইকবালের কবিতা . ও চিন্তাধারা আরবী ভাষার মাধ্যমে আরবদের কাছে তুলে ধরে কবি ইকবালকে সরাসরি পরিচয় করিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সৃতরাং তিনি দ্বিতীয় বার সাক্ষাতের সময় তার কবিতা অনুবাদ করার অনুমতি লাভ করেন এবং ডক্টর ইকবাল হযরত আলী মিয়ার উপর ভীষণ খুশী হন এবং দু'আ করেন।

হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদী অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রাচ্যের এই দার্শনিক কবির মর্মবাণীকে 'রাওয়ায়ে ইকবাল' নামক গ্রন্থের মাধ্যমে আরবদের কাছে পৌঁছে দেন। এভাবে তিনি ইকবালের চিন্তা-চেতনাকে রাসুল (সো.)-এর দেশে পৌঁছে দিয়ে এক এঁতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। এই গ্রন্থের উর্দু অনুবাদ 'নুকুশে ইকবাল' প্রকাশিত হলে আল্লামা ইকবালের সাহেবযাদা- জাস্টিস জাভেদ ইকবাল এবং বিখ্যাত লেখক মাওলানা মাহেরুল কাদেরী হযরত আলী মিয়ার শুকরিয়া আদায় করেন এবং ভূয়সী প্রশংসা করেন।

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া[সম্পাদনা]

উপমহাদেশের স্বনামধন্য শায়খুল হাদীছ হযরত মাওলানা যাকারিয়ার (রহ.)-এর সাথে হযরত আলী মিয়ার গভীর সম্্পক ছিল । তিনি তার বিখ্যাত আরবী গ্রন্থাবলীর ভূমিকাগ্ডুলো আলী মিয়াকে দিয়ে লেখাতেন। অথচ এ সময় ভারতে বড়-বড় উলামা-মাশায়েখ ছিলেন। এক চিঠিতে হযরত শায়খ আলী মিয়াকে লেখেন যে, “বিনা দ্বিধা-সংকোচে বলছি- আপনার সাথে এই সম্্পককে নিজের জন্য নাজাতের ওসীলা মনে করি।" হযরত শায়খ, আলী “মিয়ার চিঠিপত্র ও তাঁর আগমনের অপেক্ষায় থাকতেন। আলী মিয়ার হযরত রায়পুরীর হাতে বায়আত হওয়ার মূলে হযরত শায়খুল হাদীছ সাহেবের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল। শায়খ রায়পুরীর সাথে আলী মিম্নীর হজ্জে যাওয়ার সময় তিনিই নিজের মেয়ের পক্ষ থেকে আলী মিয়াকে বদলী হজ্জের ব্যবস্থা করে দেন।

পবিত্র মদিনায় অবস্থানের সময় জিকিরের মজলিসে হাজির হলে হযরত শায়খ হযরত আলী মিয়াকে প্রতিদিন ডিম এবং খমিরা শেক্তিবর্ধক হালুয়া) খাওয়াতেন। আলী মিষ্ন কোন সময় মদীনা হতে অন্য শহরে গেলে খাদেমদের ইশারা করতেন যে, যতদিন তিনি বাইরে থাকবেন ততো দিনের খোরাক সাথে দিয়ে দাও । মদিনায় উপস্থিতির দিনগুলোয় তার কাছে গাড়ী না থাকলে তাকে নিজের গাড়ীতে করে বাসায় না পাঠানো পর্যন্ত তিনি স্বস্তি পেতেন না। হযরত আলী মিয়ার চোখের অপারেশনের ব্যাপারে তার চেয়ে শায়থই বেশী চিন্তান্িত থাকতেন। অবশেষে শায়খের হুকুমেই আমেরিকায় আলী মিয়ার চোখের সফল অপারেশন হয়। হযরত শায়খ এঁ সম্ম দু'আর খুব এহতেমাম করেন এবং খাদেমদেরকে দু'আর জন্য হারাম শরীফ পাঠিয়ে দেন। উপরের ঘটনাবলীতে আমরা বুঝতে গারি হযরত আলী মিযী হযরত শায়খের কত প্রিয়পাত্র ছিলেন।

হোসাইন আহমাদ মাদানী[সম্পাদনা]

নদওয়া থেকে ফারেগ হওয়ার পর হযরত আলী মিয়ার বড় ভাই যিনি হযরত মাদানীর মুরীদ ছিলেন, তাকে দেওবন্দে হযরত মাদানীর খেদমতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনি কয়েক মাস হযরত মাদানীর হাদীসের দরসে এবং সোহবতে থেকে ফায়েদা হাসিল করেন। হযরত মাদানী তাঁকে খুবই শফ্কত ও মহব্বতের চোখে দেখতেন । কুরআন পাকের বিভিন্ন আয়াতের তাফসীর জানার জন্য হযরত মাদানী তার এই প্রিয় শাগরেদকে কিছু পৃথক সময়ও দিতেন। ১৯৫০-৫১ সালে দীর্ঘ তাবলীগী সফরে মাওলানা আলী মিয়া সৌদি আরব, মিশর, সুদান ও সিরিয়া যান। উক্ত সফরের কিছু বর্ণনা তাঁর ভাই মাওলানা আবদুল আলী সাহেব হযরত মাদানীকে জানালে হযরত মাদানী তাঁর জবাবে লিখেন, “মৌলভী আলী' মিয়ার খবর আমি তাবলীগ জামাতের আমীর মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ ও অন্যান্যদের থেকে পাই। আপনার লেখায় আরো বিস্তারিত জেনে খুশী হলাম। দু'আ করি আল্লাহ পাক আলী মিয়াকে খায়ের বরকতের চাবী ও সকল অনিষ্টের প্রতিরোধক বানিয়ে দেন এবং হযরত সাইয়েদ আহমাদ শহীদের 'মিল্লাতে ইসলামিয়া'র সংস্কারিক কার্যক্রমের নিশানবাহী বানিয়ে, স্বীয় নেয়ামত দিয়ে ভরপুর করে দিন।

সাইয়েদ সুলায়মান নদভী[সম্পাদনা]

তাযকিরায়ে সুলায়মান গ্রন্থের লেখক জনাব গোলাম মোহাম্মাদ সাহেব বলেন যে, ১৯৫০ সালের ১৯শে নভেম্বর মাগরিব বাদ হযরত সুলায়মান নদভী নিজের মা'মুলাত পুরো করার পর আমাদের দিকে ফিরে .কথাবার্তা বলছিলেন। হঠাৎ করে সিরিয়ার রাষ্ট্রদূত হযরতের সাথে দেখা করতে আসেন। সালাম-কালামের পর তিনি জামায়াতে ইসলামী এবং তাবলীগ জামাত সম্পর্কে মাওলানার ব্যক্তিগত অভিমত জিজ্ঞাসা করেন। জবাবে হযরত আল্লামা বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী দ্বীনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পেশ করে, আর তাবলীগ জামাত দ্বীনে খালেসের দায়ী । রাষ্ট্রদূত দ্বিতীয় প্রশ্ন করেন যে, মাওলানা মওদুদী এবং মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর মধ্যে কে বড় আলেম? জবাবে তিনি বলেন, “মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী তো একজন বড় আলেম” । অন্যত্র আল্লামা সুলামান নদভী লেখেন যে, আজ আলী মিয়া সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী নামে পৃথিবী বিখ্যাত। তাবলীগে দ্বীনের কাজে মশগুল। হেজাজ এবং মিশরের আকাশ বাতাস তাঁর দাওয়াতী মিশনে গুপ্তরিত হচ্ছে। আল্লাহ পাক তাকে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের নেয়ামত দান করেছেন যা তিনি আজ দাওয়াতী কাজে লাগাচ্ছেন। ' .

মুফতী মুহাম্মাদ শফী[সম্পাদনা]

মুফতী মুহাম্মাদ শফী (রহ.) এর সাহেববাদা, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন

করাচীর মাওলানা তাকী উসমানী সাহেব বিভিন্ন মজলিসে বার বার উল্লেখ করেছেন যে, তীর পিতা হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী সাহেব বলতেন যে, হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) 40 ০০3১৯ আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে তাওফীক প্রাণ্। হযরত মাওলানা .আলী মিয়ার ফয়েজ ও বরকতে দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা যে আন্ত জ্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে তা ইসলামী দুনিয়ার এক উজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু এর সাথে সাথে নদওয়াকে তিনি আরো একটি তোহফা দিয়েছেন যার

ফলে তার আযমত, মকবুলিয়াত, বিশ্বাস এবং সম্মানের ক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্চগতি হয়েছে।

মানাষের আহসান গিলানী[সম্পাদনা]

বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক আলেম হযরত মাওলানা মানাযের আহসান গিলানী (রহ.) এর অন্তরে হযরত আলী মিয়ীর স্থান ছিল অনেক উচ্চে। দামেশ্ক ইউনিভার্সিটিতে মাওলানা আলী মিয়া ভিজিটিং প্রফেসরের দাওয়াত পেলে হযরত গিলানী আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন এবং হযরত মাওলানা আলী মিয়ার এই মর্যাদা লাভে তিনি গৌরব অনুভব করতে থাকেন। মাওলানা গিলানী এক চিঠিতে মাওলানা আলী মিয়াকে মোবারকবাদ পেশ করেন। চিঠির এক স্থানে তিনি লেখেন যে, সত্যই আপনার উজ্জ্বল অস্তিত্ব আমার জন্য ঈর্ধার বিষয় ।

অন্য এক চিঠিতে হযরত গিলানী লিখেছেন, “আল জমিয়ত ও মদীনার পত্রিকায় এই এঁতিহাসিক সম্মানের কথা পড়েছি, যা শতাব্দীর পর এ উপমহাদেশ অর্জন করেছে। আল্লামা সফিউদ্দীন বাদায়ুনীর পর সম্ভবত আপনিই দ্বিতীয় ব্যক্তিতূ, যিনি সিরিয়াবাসীদের শিক্ষাদানে এবং নিজের এলম ও প্রজ্ঞা দিয়ে সিরীয়দের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করার সুযোগ পেলেন। মাওলানা সফিউদ্দীন হিন্দী তো নিজ ইচ্ছায় গিয়েছিলেন আর আপনাকে সেখানকার ইউনিভার্সিটি এবং সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

এ সম্মান শুধু আপনার ব্যক্তিত্ব পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এ সম্মান কল ভারতীয় উলামাদের জন্য বয়ে এনেছে এক গৌরবোজ্জবল' অধ্যায় । ডাক্তার সাহেব (বড় ভাই) এবং আপনার সকল খানদানের খেদমতে মোবারকবাদ পেশ করতে গিয়ে যে খুশী আমি অনুভব করছি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।”

হযরত গিলানীর মহব্বত

হযরত মাওলানা আলী মিয্নার বিখ্যাত গ্রস্থ “তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমাত” এর প্রথম খণ্ড হযরত গিলানীর খেদমতে পৌঁছালে তিনি নিমললিখিত বাক্যের. মাধমে মাওলানা আলী মিয়ীকে নিজের" হৃদয়ের আবেগের অভিব্যক্তি করেছিলেন- “দাওয়াত ওয়া আযিমাতের ইতিহাস মিলেছে, নিজের হারানো সম্পদ হাতে এসেছে। আল্লাহ পাকই জানেন কতবার এই গ্রন্থ পড়ে ফায়েদা লাভ করতে থাকবো। পড়েছি, অন্তর ভরে না, তৃপ্তি মিটেনা। আল্লাহ পাকই জানেন, আমার অন্তরের কত আশা-আকাঙ্খা আপনার ছারা পুর্ণ হবে।

মনযূর নো"মানী[সম্পাদনা]

আল ফুরকান পত্রিকার সম্পাদক হযরত মাওলানা মনযুর নো'মানী (রহ.) মাওলানা আলী মিয়ার চিরজীবনের সাথী ছিলেন। তীরই চেষ্টায় হযরত মাওলানা আলী মিয্নী কিছু ভালো দ্বীনী চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে অথ্রসর হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। বিশেষ করে দাওয়াত ও তাবলীগ এবং হযরত রায়পুরীর সাথে সম্পর্ক কায়েমের ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। তিনি সব সময় আলী মিয়াকে রফিকে মোহতারাম (সম্মানিত বন্ধু) বলে সম্বোধন করতেন। বহু বছর ধরে মাওলানা নো'মানী ও আলী মিয়া একই সাথে উঠাবসা করতেন।

হযরত মাওলানা নো'মানী সাহেব হযরত আলী মিয়াকে কত ভালবাসতেন এবং মর্যাদার চোখে দেখতেন নিম্নের ঘটনাবলীর দ্বারা তা স্পষ্ট হয়ে যায়। হযরত নো'মানী বর্ণনা করেন যে, ১৯৫৪ ইং সালে রফিকে মোহতারাম আলী মিয়ী দারুল উলুম দেওবন্দের বিহারী ছাত্রদের সংগঠন 'সাঙ্জাদ লাইবেরী' এর এক জলসায় প্রধান অতিথির ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হন।

হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহ.) উক্ত দাওয়াত নামার সাথে সাথে সুপারিশ সম্বলিত একখানা পত্রও দেন। এঁ সময় হযরত আলী মিয়া খুবই অসুস্থ ছিলেন। তারপরও তিনি দাওয়াত করুল করেন। তিনি দেওবন্দে তাশরীফ নিয়ে যান ও ছাত্র সমাবেশে ভাষণ দেন। তার আলোচনার বিষয় ছিল “তালেবানে উলৃমে নবুয়ত কা মাকাম আওর উনকি যিম্মাদারীয়া" নেববী জ্ঞানের শিক্ষার্থীদের মর্যাদা এবং দায়িত্) প্রবন্ধটি তার ফিরে আসার ২ সপ্তাহ পরে আমার দৃষ্টি গোচর হয়। এ সময় আমি অনুভব করি যে, প্রবন্ধটি তিনি লেখেননি, বরং তার দ্বারা লেখানো হয়েছে। আমি প্রবন্ধটি পড়ার পূর্বে প্রবন্ধকারের কিছু পরিচয় আপনাদের কাছে (আল ফুরকান পাঠকের কাছে) এ জন্য তুলে ধরছি যে, তাতে প্রবন্ধের কদর এবং মূল্যায়ন করা আপনাদের জন্য খুবই সহজ হবে বলে আমি মনে করি।

প্রথমকথা এই যে, এটা শুধু প্রবন্গকারের কথাই নয় বরং এটা তার অন্তরের দরদ, এটাই তার অবস্থা এবং যে সব বিষয়ের দিকে দ্বীনী মাদাসার ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, আল্লাহ পাকের খাস ইনায়েত এবং তাওফীকে প্রবন্ধকার নিজেই তার জীবন্ত নয়ুনা।

দ্বিতীয় কথা এই যে, আমার ৫০ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, এ পৃথিবীতে এ ধরনের লোক খুবই কম পয়দা হয়েছেন, যাদেরকে আল্লাহ্‌ পাক তীক্ষ জেহেন (স্মৃতিশক্তি) দিয়েছেন এবং সাথে সাথে আলোকময় অন্তরও দিয়েছেন। যারা পরিবর্তিত দুনিয়ার অবস্থা ও চাহিদা সম্পর্কে জ্ঞাত এবং নবীগণের উত্তরাধিকার হিসেবে মজবুত ঈমানের অধিকারীও বটে। অবশ্যই দুনিয়াতে এ ধরনের ব্যক্তিত্ব একেবারেই কম। একেবারে হাতে গোনা ক'জন। আল্লাহ পাকের এ রকম বান্দা যারা এ দুই গুণে গুণান্বিত, এ অধমের এক হাতে যে কয়টি আঙ্গুল আছে তার সমসংখ্যকও দেখেনি। দু'চারজন যাদের দেখেছি তার মধ্যে মাওলানা আলী মিয়া অন্যতম। আল্লাহপাক তাঁকে একদিকে চিন্তা ও চেতনার সঠিক মুখপাত্র বানিয়েছেন, সাথে সাথে সাহেবকে কলবও । তিনি নিজের ইলম ও প্রজ্ঞার দিক দিয়ে আধুনিক, কিন্তু ্বীন, ইয়াকীন, দ্বীনের গভীরতা এবং জীবনযাত্রার দিক দিয়ে পুরাতনও । তিনি জীবন্ত মাদরাসাও _ খানকাহও।


আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা, আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী (রহ.) তার সমসাময়িক উলামা মাশায়েখ ও মণীষীদের সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তির গ্রন্থ "যু'আসিরীন” এ মাওলানা আলী মিরা প্রসঙ্গে লিখেছেন-.

আলী মিয়ী মরহুম নন, জীবিত। আল্লাহ্‌র রহমতে দ্বীন ও মিল্লাতের জন্য যুগ যুগ ধরে তাঁর কীর্তি এই ধরা পৃষ্ঠকে সজীব রাখবে । তিনি বয়সে আমার চেয়ে কিছুটা ছোট হলেও জ্ঞান ও পাপ্তিত্যে পরিপূর্ণত, সাধাসিধে চালচলন, চিন্তা-চেতনা, স্বভাব-চরিত্র, ইখলাসের দিক থেকে, শিষ্টাচার আর খোদাভীতির ব্যাপারে, এবাদত-বন্দেগীতে এবং চেষ্টা-সাধনায় আমাদের চেয়ে অনেক বড়দের সমমর্যাদায় প্রতিষ্িত। রায়েবেরেলীর সাইয়েদ বংশের অন্যদের সম্পর্কেও জানি। এরপরও তার বাবা, মা, ভাই-বোনদের কথা বলার দরকার নেই। সব মিলে 'নূরুন আ'লা নূর' আলোর উপর আলো।

পাক-পবিত্র মাটির যো তায়াম্মুম করার যোগ্য) ছারা তৈরী অনান্য আত্রীয়-স্বজনও নিজ স্থানে প্রশংসা এবং গৌরবের অধিকারী। তারা প্রত্যেকেই তারকাতুল্য। এই তারকারাজির মধ্যে মাওলানা আলী মিয়া জুলত্ত এক সূর্য্য।

নদওয়া এবং দেওবন্দ উর বিদ্যাগীঠের আকাবির থেকে মাশাআল্লাহ তিনি জ্ঞান আহরণ করেছেন। এছাড়াও নিজ বংশীয় বুযুর্গদের নিকট থেকেও ইখলাস আর আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তীক্ষ্ম মেধা আর বৃদ্ধি শুরু থেকেই তার ছিল। চাঁদ, সূর্ঘ তিনি আজন্মই। ইংরেজীও প্রয়োজন পরিমাণ শিখেছেন। আরবী সাহিত্যে তো হিন্দুস্তানসহ সারাবিশ্বে খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছেন। উর্দূ পদ্য ও গদ্য সাহিত্যে পা্ডিত্য অর্জন করেছেন। সিরীয় ও মিশরীদের নিকটও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। বক্তৃতা আর গল্লেও অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। আমার মত তিনি রোগা ও দুর্বল নন। দারুল উলুম নদওয়ার মত বিশাল প্রতিষ্ঠান তিনি পরিচালনা করছেন। বিভিন্ন আমন্ত্রণে গোটা হিন্দুস্তান চষে ফিরছেন। এখন এখানে, তখন সেখানে । প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখালেখির ব্যাপারে এই ভাবলেন আর সাথে সাথেই লিখে ফেললেন। .

উর্দু-আরবী ছাড়াও ইংরেজীতে এমনকি তুকীতেও বেশ কিছু লিখেছেন। তার জীবন গর্বেরও, ঈর্ষারও। স্বয়ং আমার ব্যাপারে তার কৃপণতা আর আত্মাভিমানের অভিযোগ অবশ্যই আছে। একবার নয়, হয়তো দুইবার । আর এটা কোন ইশারা-ইজ্গিতে নয়, বরং মুখে মুখে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম, “হযরত! উঁচুমানের আধ্যাত্মিকতার রহস্য আমাদের কিছু শেখান, চেহারা থেকে নিজকে গোপন করার পর্দা একটু সরান। আপনার পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করে আমাদেরকে একটু উষ্ণতা দিন। তিনি শুধু চুপ থাকলেন, এসব আব্দারের কোন জবাব পেলাম .না। এমন অজ্ঞতার ভাব দেখালেন যেন জ্ঞানী হয়েও অজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছেন আলী মিয়ী প্রতিটি দিকে এত বিপুল পরিমাণের কাজ আল্াম দিয়েছেন যে, কেউ যদি তার কাজগুলোর বিস্তারিত অনুসরণ নয়, শুধু তার একটি সূচী তৈরী করে, তাহলেই সে এক বিরাট পন্তিত হিসেবে খ্যাতি অর্জন করবে। এবং শরীয়তের দার্শনিক তত্বের উপর ব্যাপক কাজ করেছেন।

আমি আমার ওসীয়তনামায় ভেন্তিম ইচ্ছার তালিকায়) লিখে যাচ্ছি যে, আমার শেষ নিঃশ্বাস চলে যাওয়ার পর সর্বপ্রথম যেন তাকেই আবুল হাসান আলী নদভী) খোঁজা হয়। যদি তাকে পাওয়া যায়, তাহলে জানাযার নামায পড়ানোর প্রথম নম্বরের অধিকার তাঁরই।

সমগ্র দুনিয়ায় তাকে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী বলে' সম্বোধন করে, আর আমাদের মুখে শুধু আলী মিয়াটাই প্রিয় থেকে শ্রিয়তর।

শাহ ওছিউল্লাহ ইলাহাবাদী[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা আলী মিয়া হযরত হাকীমুল উম্মতের বিশিষ্ট খলীফা হবরত মাওলানা শাহ ওছিউল্লাহ সাহেবের সোহবতে কয়েকবার উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, একবার আমি ফতেহপুরে দুপুরের সময় হযরতের খেদমতে পৌঁছি। তখন খাওয়া-দাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সংবাদ পেয়েই হযরত উপর থেকে নিচে নেমে আসেন এবং অত্যত্ত মহব্বত ও শফকতের সাথে উপরে নিয়ে যান। দীর্ঘক্ষণ আমার হাত ধরে রাখেন। খানা গরম করা হয়। তিনি আমাকে. মাঝে মাঝে খানা. লোকমা বানিয়ে মুখে তুলে দিচ্ছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি আশ্চর্য হচ্ছিলাম যে, আমার মধ্যে কোন যোগ্যতা না থাকা সত্বেও, আর হযরত এত উচু মাকামে থাকার পরও এ অধমের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই এ ধরনের ব্যবহার করছেন কেন?

একবার ১৯৬৪ সালের জুন মাসে হযরত শাহ সাহেব ইলাহাবাদে ছিলেন। মাওলানা আলী মিয়া এলাহাবাদে হযরতের খেদমতে হাজির হওয়ার সংবাদ পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু গাড়ী দেরীতে পৌঁছে। হযরত মাওলানা শাহ ওছিউল্লাহ্‌ সাহেব সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দেখা হতেই বলে উঠেছিলেন, মাওলানা! নাস্তার সময় মনে করে আমি আপনার জন্য নাস্তা নিয়ে হাজির হয়েছিলাম, কিন্তু এখনতো দুপুর হয়ে গেছে। তাই ঘরেই নাস্তা হবে। হযরত আলী মিয়া হযরত শাহ সাহেবের এই ব্যবহারে লজ্জায়, আবেগে আড়ষ্ট হয়ে যান এই ভেবে যে, উপস্থিত হওয়ার সংবাদ কেন দিলাম।

হ্যরত শাহ সাহেব্‌ মাঝে মাঝে অস্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং কারো চুলে হাত দিয়ে কিছু কথা বলতেন। এ ধরনের এক ঘটনায় নিজের এক খাস শাগরেদ সুফী আব্দুর রব সাহেবকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন, “সকলের অন্তর দেখেছি (িস্ত আলী মিয়ার মত অন্তর কারো পাইনি।” অন্য এক চিঠিতে মাওলানা আলী মিয়াকে তিনি লিখেছিলেন, যে সকল আলেম-উলামা আমার নিকট আসেন তাদের মধ্যে অন্তরের গতি আপনার দিকেই সবচেয়ে বেশী ধাবিত হয়।

ইয়াকুব সাহেব মুজান্দেদী (ভূপালী)[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা আলী মিয়া হযরত শাহ সাহেবের সোহবতে যাতায়াত করতেন। তিনি “সোহবতে বাআহলেদেল' নামে হযরত শাহ সাহেবের মজলিসের মালফুজাত জমা করে একখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন। এত বড় বুযুর্গ হওয়া সত্তেও শাহ সাহেব আলী মিয়াকে খুবই সম্মান করতেন। ভূপালের সফরের সময় আলী মিশ্নীকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তিনি নিজেই সেখানে হাজির হতেন। একবার তিনি স্টেশনে হাজির হতে পারেননি । হযরত আলী মিয়া তার খানকায় পৌঁছে গেলে তিনি বার বার তার অপারগতার কথা আলী মিয়াকে জানিয়ে আফসোস করতে থাকেন এবং বলতে থাকেন, হযরত! বেল্সাদবী হয়ে গিয়েছে, মাফ করে দিবেন।

একবার হযরত আলী মিয়া হায়দ্রাবাদ থেকে ফিরছিলেন। ভূপালের মাওলানা ইমরান খানকে অল্প সময়ের জন্য ভূপালে অবস্থানের টেলিঘ্বাম করেছিলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে গাড়ী ৪/৫ ঘন্টা বিলম্বিত হওয়ায় সব প্রোগ্রাম উলটপালট হয়ে যায়। ডিসেম্বর মাসে প্রচণ্ড শীত ছিল । গাড়ী ভূপাল পৌঁছালে মাওলানা ইমরান খান সাহেবের পাঠানো লোক ছুটে এসে সংরাদ দেয় যে হযরত! শাহ সাহেব আপনার জন্য স্টেশনে এসেছেন এবং সারারাত শীতে কষ্ট করেছেন। ইতিমধ্যে শাহ সাহেব আলী মিয়ার সাথে দেখা করেছিলেন। হযরত আলী মিয়া মাথা নত করে টেলিথাম দেয়ার জন্য আফসোস করছিলেন। অপরদিকে হযরত শাহ সাহেব বলে চলছিলেন, এমন সুন্দর রাত জীবনে আর কোন দিন পাইনি।

মুহাম্মাদ আহমাদ ফুলপুরী[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা আলী মিয়ী, যামানার কুতুব এবং বিশিষ্ট বুমুর্গ হযরত মাওলানা আহমাদ ফুলপুরী (রহ.) এর খেদমতে মাঝে মাঝে হাজির হতেন। হযরত ফুলপুরীও তাকে খুবই মর্যাদা দিতেন। তিনি বলতেন, “যেহেতু আলী মিয়া আল্লাহপাকের মাহবুব তাই আল্লাহ পাক তাঁকে ইলমের পর্দার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন। তিনি ঘদি নিজকে জাহের করে দেন তবে অন্য পীরদের মুরীদ মিলবে না।”

অন্য এক চিঠিতে তিনি আলী মিয়াকে লিখেছিলেন যে, হযরতের ফিরে যাওয়ার পর একটি হাত চিঠি দিয়েছিলাম, এরপর একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছি। এরপর একখানা জবাবী খাম পাঠিয়েছি, জবাবের অপেক্ষায় আছি। এখনও হযরতের খায়রিয়াত শুনতে পাইনি বলে বড় পেরেশান আছি। আমার দ্বারা কোন ভুল-ক্রটি হলে মাফ করে দিবেন। সম্ভবতঃ আমার পত্র পাননি। অন্তর পেরেশান, তাই আপনার খোঁজখবর নেয়ার জন্য সুলতানুল হুদাকে আপনার খেদমতে পাঠালাম। এই পবিত্র মাসে (রমযান) আপনার জন্য দু'আ করে চলেছি এবং আমি নিজেও আপনার দু“আর মুখাপেক্ষী । আপনি সফরে থাকা অবস্থাতেও দু'আ জারী ছিল। আপনার সাথে আমার যে কি সম্পর্ক তা আপনি ভালো করেই জানেন। মনে-প্রাণে আপনার জন্য দু'আ করি।

সিদ্দীক আহমাদ বান্দবী[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা কারী সিদ্দীক সাহেব বান্দবী (রহ.) হযরত মাওলানা আলী মিয়ীকে খুবই সম্মান ও মহব্বত করতেন। নিম্নের একটি ঘটনায় কারী সাহেবের নম্রতা ও ইখলাস এবং হযরত আলী মিয়ার বড়ত্ব ও মহত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।

একবার হযরত বান্দবী (রহ.) লাখনৌ আসেন এবং হযরত আলী মিয়াকে বলতে থাকেন, হযরত! আমার কিছু সাথী আমার মালফুজাত জমা করছে এবং তীরা ছাপাতে চাচ্ছে। আমি তাদের বলেছি যে, আমি প্রথমে গিয়ে হযরতের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নেই, তারপর ছাপা হবে । আজ শুধু এ নিয়তেই খেদমতে হাজির হয়েছি, অন্যকোন উদ্দেশ্য নেই। এ আলোচনা সাধারণ মজলিসে চলছিল।

হযরত আলী মিয়ী বলে উঠেছিলেন যে, আমার পক্ষ থেকে শুধু অনুমতিই নয়, বরং দরখাস্ত এই যে,. আপনি এই মালফুযাত অবশ্যই ছাপুন। ইনশাআল্লাহ বহুত ফায়েদা হবে।

অন্য এক চিঠিতে হযরত .বান্দবী (রহ.) আলী মিয়াকে লিখেছিলেন, আহকার নিজের আকাবিরের সাথে মহব্বত এবং আকীদাত কায়েম রেখেছে আলহামদুলিল্লাহ । এ সময়ে হযরত ওয়ালার যে মহব্বত ও সম্মান আমার অন্তরে আছে তার স্থান সকলের উপরে । এটাই আমার জীবনের পুঁজি, আল্লাহ পাক শেষ সময় পর্যস্ত এটাকে অক্ষুণ্ন রাখুন ।

ডাক্তার আব্দুল হাই[সম্পাদনা]

হযরত ডাক্তার আবদুল হাই সাহেব হাকীমুল উম্মতের বিশিষ্ট খলীফা ছিলেন। তিনি তীর বিখ্যাত গ্রন্থ “উসওয়ায়ে রাসুলে আকরাম (সা.)'-এর আরবী এডিশনের ভূমিকা লেখার জন্য হযরতের কাছে যে চিঠি দিয়েছিলেন, তাতে তার অন্তরে মাওলানা আলী মিয়ার কি মাকাম ছিল তা পরিস্কার হয়ে যায়।

তিনি লিখেন, “আল্লাহ পাক নিজের ফযল ও করমে বর্তমান যুগে , আপনার হৃদয়, যবান এবং কলমে এমন এক বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা নিজের শানে পরিস্ফুটিত। (এটা আল্লাহর অপার দান) &॥ 1০১ 5১- মা-শা আল্লাহ। আপনি সারাক্ষণ দাওয়াত ও ইশাআতের কাজেই লিপ্ত আছেন। আল্লাহ পাক কবুল করুন। ৯১৪ ৯) [-8)- আরব দেশে বিশেষ করে সৌদী আরবে আপনার তাবলীগী খেদমত্ের যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া আছে। এ আশায় যদি এই গ্রন্থের ভূমিকা আপনি লেখেন তাহলে এই কিতাবের প্রচার এসব দেশে সম্ভব হবে।”

ইউসুফ বিন্নুরী[সম্পাদনা]

হযরত মাওলানা ইউসুফ বিনৃনুরী (রহ.) পাকিস্তানের বহুত বড় আলেম ছিলেন। তিনি তীর বিখ্যাত গ্রন্থ মাআরিফুস সুনান গ্রন্থ প্রকাশিত হলে হযরত আলী মিয়ার নিকট পাঠিয়ে দেন। হযরত বিন্নুরী আলী মিয়ার নামের সাথে এ ছা ০ পা “আল্লাহ পাকের নিশানসমূহের মধ্যে একটি' নিশান” এই বাক্য ব্যবহার করেছিলেন। উক্ত ঘটনার দ্বারা হযরত বিন্নুরীর অন্তরে আলী মিয়া কত বড় স্থান দখল করেছিলেন তা সহজেই অনুমেয় ।


তাকী উসমানী[সম্পাদনা]

. পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা তাকী উসমানী (দাঃ বাঃ) বলেন- আল্লাহ পাক এ যামানায় হযরত আলী মিয়ার দ্বারা যে আযিমুশ্বান ' খেদমত নিয়েছেন, তা সত্যই আশ্চর্যের ব্যাপার এবং তীর ' প্রতিক্রিয়া উপমহাদেশ পেরিয়ে আরব দুনিয়া এমনকি পাশ্চাত্য সমাজ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। এ ধরনের সৌভাগ্য খুব কম লোকেরই হয়ে থাকে। আল্লাহপাক তাকে যে ধরনের চিন্তাধারার শুজ্রতা ও উম্মতে ইসলামিয়ার জন্য যে ধরনের ব্যথা ও দরদ দান করেছেন এবং তার ছারা তিনি যে কাজ নিয়েছেন তা শুধুমাত্র ভাষা ও সাহিত্যের পণ্ডিতদের দ্বারা সম্ভব নয়।

আরব উলামাগণের নজরে[সম্পাদনা]

১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসে সৌদী আরবে দাওয়াতী সফরের সময হযরত মাওলানার জীবন এবং কর্মের উপর সৌদী “বতার থেকে একটি প্রবন্ধ প্রচার করা হয়। উক্ত প্রবন্ধে হযরত মাওলানা আলী মিয়াকে তৎকালীন বিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ এবং আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাঁকে একজন আদর্শ পুরুষ হিসেবে পেশ করে রেডিওতে উল্লেখ করা হয় যে, মাওলানার মধ্যে আমরা দ্বীনদারী, তাকওয়া, পবিত্রতা, সাধারণ জীবন যাত্রা, নিলেভি প্রভৃতি এমন কিছু গুণের সমারোহ দেখেছি যাতে করে তাঁকে আমাদের আসলাফগণের সঠিক নমুনা হিসেবে পেশ করা যায়। জাহানের দ্বীনী এবং আখলাকী হালাতকে জাগরুক রাখার জন্য কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। তার দাওয়াত, তার সাহিত্য সাধনা, তার ব্যথিত হৃদয় মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছে। রেডিওতে প্রচারিত এই প্রবন্ধের মাধ্যমে গোটা মুসলিম জাহানে আলী মিয়ার ব্যাপক পরিচিতি গড়ে ওঠে । নিম্নের কয়েকজন খ্যাতনামা আরবী শায়খ এবং সাহিত্যিকের বক্তব্য থেরে হযরত মাওলানা আলী মিয়ার আরব জাহানে ব্যাপক পরিচিতি ও সমাদৃতির বিষয়টি আন্দাব করা যায়।

ইউসুফ আল কারযাভী[সম্পাদনা]

. . ফযিলাতুশ শায়খ ইউসুফ আল কারযাতী বর্তমান আরব বিশ্বের একজন খ্যাতনামা মুসলিম চিন্তাবিদ, লেখক ও দায়ী হিসেবে ভূয়সী প্রশংসা ' কুড়িয়েছেন। তিনি বর্তমানে কাতার ইউনিভার্সিটির ইসলামী শরীয়া বিভাগের ভীন হিসেবে কর্মরত। তিনি মিসরে জন্গ্রহণ করেন। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন এবং সেখান থেকেই ডক্টরেট ডিথ্ী অর্জন করেন। তিনি একজন বিখ্যাত খতীব । মাওলানা আলী মিয়ীর মিশর সফরের সময় প্রথম পরিচয় হয়। তিনি তার কাছে সেখানে কিছু দিন পড়াশুনাও করেছিলেন এবং তার সোহবতে অবস্থান করেছিলেন।

সৌদী ফয়সাল পুরস্কার পাওয়ার পর শায়খ কারযাভী এক চিঠিতে হযরত মাওলানাকে মোবারক বাদ দিতে গিয়ে বলেন, “সালাম বাদ ফয়সাল পুরস্কার পাওয়ার জন্য আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী শরীয়া বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা আমাদের হৃদয় নিড়ানো মোবারক বাদ পেশ করছি। আমার কাছে মনে হয় আপনার মত ব্যক্তিত্ব এ পুরস্কার লাভ করায় স্বয়ং পুরস্কারের দামই বেড়ে গেছে। আমি আপনাকে একজন খালেস দ্বীনী দায়ী হিসেবে তিরিশ বছর ধরে জীনি। আপনার সাথে সাক্ষাতের পূর্বে আপনার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ “মা-যা খাসিরাল আলাম বিইনহিতাতিল মুসলিমীন” পড়েছিলাম । পড়ার পর ১৯৫১ সালে মিশরে আপনার সাথে পরিচয় হয়।

তখন আমি জামিয়া আযহারের ছাত্র ছিলাম। এ সময় আমার অন্তরে আপনার মত একজন মুখলেস দাঈ মুয়ালিমের আদর্শ নমুনা বসে যায়। আপনি এ সময় আমাদের নওজোয়ানদের তরবিয়ত করতেন। নিজের ঈমানী শক্তি দিয়ে আমাদের অন্তর গরম করতেন। নিজের চিন্তা ও চেতনা দিয়ে আপনি আমাদের মন জয় করেছিলেন। এরপর হযরত মাওলানা আওকাফ বিভাগের আমন্ত্রণে কাতার সফর করেন ১৯৯৫ সালে । শেখ কারযাভী হযরত আলী মিয়ার এক বয়ানের পর আবেগাপ্ুত হয়ে দীড়িয়ে যান এবং হযরতের উপর পারিচিতিমূলক কিছু কথাবার্তা বলেন- “শায়খ আবুল হাসান আলী আমার প্রিয়। নিঃসন্দেহে তার সাথে আমার মহব্বত আছে। আল্লাহপাকের কাছে দু'আ করি এ মহব্বত যেন শুধু আল্লাহর জন্য হয়। শায়খ নিজের তাকওয়া, পরহেজগারী, ইখলাস ও বুযুগ্গীর কারণে আমার প্রিয় ।”

আবৃদুল ফাতাহ আবু গুদ্দা[সম্পাদনা]

মুহাদ্দিসে জলীল, শায়খ আবদুল ফাস্তাহ আবু গুদ্দা রিয়াদের মুহাম্মাদ বিন সৌদ ইউনিভার্সিটির হাদীছের উস্তাদ ছিলেন। তিনি মূলতঃ সিরিয়ার অধিবাসী ও জামেয়ার ছাত্র 'ছিলেন। তাঁর নিকট হযরত আলী মিয়া খুবই প্রিয় ছিলেন। শায়খ আবুল ফাল্তাহ যে চারজন বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য দু'আ করতেন তীর মধ্যে মাওলানা আলী মিয়া অন্যতম। তিনি দেওবন্দ ও নদওয়া কয়েকবার এসেছিলেন ।

এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, "আল্লাহ পাক আপনার ব্যক্তিত্বের মধ্যে আমাদের অতীত ইতিহাসের গৌরবান্বিত উজ্জল অধ্যায়গুলি দেখিয়েছেন। উলামায়ে সালাফের স্মরণ পুনরুজ্জীবিত হয়েছে । আপনি নিঃসন্দেহে এ আসলাফের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার উত্তম দৃষ্টান্ত বটে; যাদের অন্তরে আল্লাহ পাক নিজের এবং তার রাসুলের মহব্বত সৃষ্টি করেছেন । আল্লাহপাক আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন।

অন্য এক চিঠিতে লিখেছিলেন যে, আল্লাহপাক আপনাকে কলমের শক্তি এবং ইখলাসের দৌলত দান করেছেন। আপনার চিন্তা চেতনা মিল্লাতে ইসলামিয়ার নওজোয়ানদের অন্তরের চাবি এবং তাঁদের হিম্মতকে বৃদ্ধি করার এ মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, যার ছারা উম্মতে যুসলিমার প্রথম যুগের কাফেলাসমূহ পরিচালিত হতো।

শায়খ আলী তানতাবী (মক্কা মোকাররমা)[সম্পাদনা]

দামেক্ষে জন্গ্রহণ করেন। তিনি সিরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ল' পাস করেন এবং হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। পরে সৌদী আগমন করেন । তিনি অনেক গ্রন্থের লেখক বর্তমানে ম্কাশরীফে অবস্থান করছেন।

তিনি হযরত আলী মিয়ার রচনা এবং ফিকরী কার্যক্রমের খুবই প্রশংসা করতেন এবং তাকে ভালবাসতেন। এক চিঠিতে তিনি জালী মিয়াকে লিখেছিলেন “আমার বক্তব্য ব্রডকাস্ট করছিলাম । হঠাৎ এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো পৃথিবীতে আপনার কোন শহরটি সবচেয়ে প্রিয় এবং কোন শহরের সাথে আপনার স্মৃতি বিজড়িত? এ ব্যক্তির বিশ্বীস ছিল যে, আমি জবাবে দামেক্কের নাম নেব। কিন্তু আমি যখন লাখনৌ শহরের নদওয়াতুল উলামার নাম নিলাম তখন তাঁর আশ্চর্যের সীমা থাকলো না। এ ব্যক্তি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, লাখনৌ কোথায়? আমি বললাম, এটা আরুল হাসান আলী নদভীর শহর।” এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আরব বিশ্বে আপনি লাখনৌর চেয়ে অনেক বেশী গ্রসিদ্ধ। লাখনৌর পরিচয় তো আপনার সম্ভার মাধ্যমে হয়ে থাকে।

সাইয়েদ কুতুব শহীদ[সম্পাদনা]

আরব বিশ্বের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ এবং প্রখ্যাত লেখক সাইয়েদ কুতুব শহীদ (রহ.) হযরত মাওলানাকে উচ্চ মর্যাদার চোখে দেখতেন। হযরতের কিতাব "মাযা খাছিরাল আলাম” প্রকাশিত হলে তিনি এ গ্রন্থ সম্পর্কে তার মতামত ব্যক্ত করতে যেয়ে উল্লেখ করেন, বর্তমান যুগের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হল মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। তাঁদের মধ্যে অতীতের উপর নির্ভরতা এবং ভবিষ্যতের উপর আশা-ভরসা করার মনোবৃত্তি সৃষ্টি করা। এই দ্বীন মুসলমানদের খুবই কম বুঝে এসেছে।

এ বিষয়ে নতুন ও পুরাতন যে কয়েকখানি গ্রন্থ আমার নজরে এসেছে তাঁর মধ্যে হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীর নতুন লেখা ১.১ উপ ৬৩৪৪ [| ৮৮ - আমার কাছে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।

খানায়ে কা'বায় প্রবেশের বিরল সম্মানঃ

১৯৯৬ সালে মুসলিম বিশ্বের গৌরব হযরত মাওলানা আলী মিয়াকে কাবা শরীফে প্রবেশ করার জন্য বায়তুল্লাহর দরজার চাবি পেশ করা হয়। রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর সদস্যবৃন্দ সমভিব্যহারে হযরত মাওলানা খানায়ে কাবায় প্রবেশ করেন। এ বিরল সম্মানের কথা পত্র-পত্রিকা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গড়ে। এঘটনার দ্বারা আরব জাহানে হযরত মাওলানার কি ধরনের মকবুলিয়াত ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ।

বায়তুল্লাহর্‌ ইমাম মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ সুবাইল[সম্পাদনা]

শায়খ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ্‌ কাবা শরীফের সব চাইতে প্রবীণ ইমাম। বহু বছর ধরে তিনি মসজিদে হারামে ফজর এবং এশার নামাযে ইমামতি করে আসছেন। তিনি মক্কা-মদীনা উভয় হেরেমের সকল প্রশাসনিক কাজের জিম্মাদার। ১৯৯৭ সালের ১২/১৩ই নভেম্বর কাদীয়ানীদের উপর এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে শায়খ সুবাইল, মসজিদে আকসার ইমাম.সহ উলামায়ে কেরামের এক বড় জামাত নিয়ে নিজের বিশেষ প্রেনে করে লাখনৌ উপস্থিত হন। কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সভাপতি হিসেবে শায়েখের নাম ঘোষণা করার ইশারা করা হলে শায়খ সুবাইল বিস্কিত হয়ে বলে ওঠেন, সেমাহাতুশ শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী উপস্থিত থাকতে আমি সভাপতিত্ব. করব! আল্লাহু আকবার! আল্লাহ পাক হযরত আলী মিয়াকে আরব উলামা এবং মাশায়েখের নজরে কত বড করেছিলেন, এ ঘটনা তার জলত্ত প্রমাণ।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. এস্পোসিতো, জন এল. (২০০৩)। দ্য অক্সফোর্ড ডিকশনারি অফ ইসলাম (ইংরেজি ভাষায়)। অক্সফোর্ড, ইংল্যান্ড: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। আইএসবিএন 978-0-19-512558-0ডিওআই:10.1093/acref/9780195125580.001.0001/acref-9780195125580-e-1686 
  2. "শায়খ সৈয়দ আবুল হাসান আলী আল-হাসানী আন-নদভী"কিং ফয়সাল প্রাইজ.অর্গ। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুলাই ২০২১ 
  3. আখতার, জামিল (১৯ জুলাই ১৯৯৯)। "ইসলামিক স্টাডিজে অবদানের জন্য ব্রুনাইয়ের সুলতানের কাছ থেকে পুরষ্কার জিতেছেন আলী মিঁয়া"রেডিফ.কম। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুলাই ২০২১ 
  4. "নদভী, আবুল হাসান আলী"অক্সফোর্ড ইসলামিক স্টাডিজ.কম। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুলাই ২০২১ 

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

অভিসন্দর্ভ[সম্পাদনা]

জীবনীগ্রন্থ[সম্পাদনা]

পত্রিকা[সম্পাদনা]

বই[সম্পাদনা]

সাময়িকী[সম্পাদনা]