আব্বাসউদ্দীন আহমদ
আব্বাসউদ্দীন আহমদ | |
---|---|
জন্ম | ২৭ অক্টোবর ১৯০১ |
মৃত্যু | ৩০ ডিসেম্বর ১৯৫৯ | (বয়স ৫৮)
পেশা | লোকসঙ্গীত শিল্পী, সরকারী কর্মকর্তা |
পরিচিতির কারণ | লোকসঙ্গীত সুরকার, গায়ক, পল্লীগীতি শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক |
পুরস্কার | স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮১) |
আব্বাসউদ্দীন আহমদ (২৭ অক্টোবর ১৯০১ – ৩০ ডিসেম্বর ১৯৫৯) ছিলেন একজন বাঙালি লোক সঙ্গীতশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক, ও সুরকার। সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর প্রাইড অফ পারফরম্যান্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন।[১]
পরিবারও শিক্ষা
[সম্পাদনা]আব্বাসউদ্দীন আহমদ ১৯০১ সালের ২৭শে অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[১] আব্বাস উদ্দীন আহমদের পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন তুফানগঞ্জ মহকুমার আদালতের উকিল। মাতা হিরামন নেসা।[২] শৈশবে বলরামপুর স্কুলে আব্বাসউদ্দীনের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা এবং ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে আই. এ পাস করেন। এখান থেকে বি.এ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে তিনি সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন।[৩] তার বড় ছেলে ড. মোস্তফা কামাল বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতি ছিলেন। মেজো ছেলে মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও একমাত্র মেয়ে ফেরদৌসী রহমান কণ্ঠশিল্পী।[৪]
সঙ্গীত জীবন
[সম্পাদনা]একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আব্বাস উদ্দীনের পরিচিতি দেশজোড়া। আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, উর্দুগান সবই তিনি গেয়েছেন। তবে পল্লীগীতিতে তার মৌলিকতা ও সাফল্য সবচেয়ে বেশি। গানের জগতে তার ছিল না কোনো ওস্তাদের তালিম। আপন প্রতিভাবলে নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরেন। তিনি প্রথমে ছিলেন পল্লীগায়ের একজন গায়ক। যাত্রা, থিয়েটার ও স্কুল-কলেজের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান শুনে তিনি গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং নিজ চেষ্টায় গান গাওয়া রপ্ত করেন। এরপর কিছু সময়ের জন্য তিনি ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর নিকট উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখেছিলেন।[৫] রংপুর ও কোচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া, ক্ষীরোল, চটকা গেয়ে আব্বাস উদ্দীন প্রথমে সুনাম অর্জন করেন। তারপর জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালা গান ইত্যাদি গান গেয়ে জনপ্রিয় হন। তিনি তার দরদভরা সুরেলা কণ্ঠে পল্লি গানের সুর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা আজও অদ্বিতীয়। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের ইসলামি ভাবধারায় রচিত গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের সহায়তায় কলকাতায় এসে গ্রামোফোন রেকর্ডে গান রেকর্ড করেন। তার প্রথম রেকর্ড 'কোন বিরহীর নয়নজলে বাদল ঝরে গো' এবং রেকর্ড করা গানের সংখ্যা কমপক্ষে সাত-শো। শহুরে জীবনে লোকগীতিকে জনপ্রিয় করার কৃতিত্ব আব্বাসউদ্দিনের। আবার বাংলার মুসলমান সমাজকে উদীপ্ত করেছিলেন ইসলামি গান গেয়ে। পল্লীগীতির সংগ্রাহক কানাইলাল শীলের কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন। ক্ল্যাসিক্যাল গান শিখেছিলেন ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁর কাছে।[২] আব্বাস উদ্দিন ছিলেন প্রথম মুসলমান গায়ক যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচ এম ভি থেকে গানের রেকর্ড বের করতেন। রেকর্ডগুলো ছিল বাণিজ্যিকভাবে সফল ছিল। তাই অন্যান্য হিন্দু ধর্মের গায়করা মুসলমান ছদ্মনাম ধারণ করে গান করতে থাকে।[৬] আব্বাস উদ্দীন ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বসবাস করেন। প্রথমে তিনি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী পদে এবং পরে কৃষি দপ্তরে স্থায়ী পদে কেরানির চাকরি করেন।[১] এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রীত্বের সময় তিনি রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। চল্লিশের দশকে আব্বাস উদ্দিনের গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশ বিভাগের পর (১৯৪৭ সালে) ঢাকায় এসে তিনি সরকারের প্রচার দপ্তরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন।পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৫ সালে ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সঙ্গীত সম্মেলন, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলন এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন।
আব্বাসউদ্দিন সম্পর্কে ফরহাদ মজহার বলেন, "আব্বাসউদ্দিন কেবল গায়ক ছিলেন না, এই প্রজন্মের গায়করা যদি ভাবেন আব্বাসউদ্দিন শুধু গান গেয়ে এদেশের মানুষের মন জয় করেছেন তাহলে তা মস্ত বড় ভুল হবে। আব্বাস তার সময়কালের আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামকে ধারণ করেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং আরো অনেকে।"[৬] তার সন্তান ফেরদৌসী রহমান এবং মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও গান গেয়ে খ্যাতি লাভ করেছেন।
বিখ্যাত কিছু গান
[সম্পাদনা]তার কিছু অবিস্মরণীয় গান হল:
- ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষ
- আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান
- ওকি গাড়িয়াল ভাই
- আমার গলার হার খুলে নে
- আমায় এত রাতে কেন ডাক দিলি
- আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
- মাঝি বাইয়া যাও রে
- ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে
- থাকতে পার ঘাটাতে তুমি
- নদীর কুল নাই
- বাউকুমটা বাতাসে
- আগে জানলে তোর ভাংগা নৌকায়
- আমায় ভাসাইলি রে
- আমার হাড় কালা করলাম রে
- রোজ হাশরে আল্লাহ আমার
- শোন শোন ইয়া ইলাহী
- খাদা এই গারীবের শোন মোনাজাত
- তুমি অনেক দিলে খোদা
- তাওফিক দাও খোদা ইসলামে
- দে যাকাত দে যাকাত
- হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড়
- শোন মোমিন মোসলমানও
- ইসলামের ঐ সওদা লয়ে
- তাওহীদেরই মুরশিদ আমার
- ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ
- মোহাম্মাদ এর নাম জপে ছিলি
- ধর্মের পথে শহীদ যাহারা
- দিকে দিকে পূর্ণ
- আমি ভাবি যারে পাই না গো তারে
- নাও ছাড়িয়া দে
- দিন গেল মোর মায়ায় ভুলে
- উঠুক তুফান পাপ দরিয়ায়
- গুরুর পদে প্রেম ভক্তি
- তোরষা নদী উথাল পাতাল
- প্রেম জানে না রসিক কালাচান
- নদী না যাইও রে
- ধিক ধিক মইশাল রে
চলচ্চিত্রে অভিনয়
[সম্পাদনা]আব্বাসউদ্দিন আহমেদ মোট ৪টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই ৪টি সিনেমা হল বিষ্ণুমায়া (১৯৩২), মহানিশা (১৯৩৬), একটি কথা ও ঠিকাদার (১৯৪০)। ঠিকাদার সিনেমাতে আব্বাস উদ্দিন একজন কুলির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ধারণা করা হয় যে তিনি এর চেয়ে বেশি সংখ্যক চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও তা উল্লেখ করেননি। কারণ সেই চরিত্রগুলো তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। এসব সিনেমাতে তিনি গানও করেছিলেন।[৬] তখনকার দিনে মুসলমান ব্যক্তির সিনেমা করা ছিল একটা ব্যতিক্রম ঘটনা।তাই হয়ত ‘বিষ্ণুমায়া’ ছবিতে অভিনয়ের পরও এর ভূমিকা লিপিতে আব্বাস উদ্দিনের নাম ছিল না যার তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল কানন দেবীর কাছ থেকে।[৬]
গ্রন্থ ও পুরস্কার
[সম্পাদনা]আমার শিল্পীজীবনের কথা (১৯৬০) আব্বাস উদ্দীনের রচিত একমাত্র গ্রন্থ। সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর
বছর | পুরস্কার | বিভাগ | ফলাফল | সূত্র |
---|---|---|---|---|
১৯৬০ | প্রাইড অফ পারফরম্যান্স | বিজয়ী | ||
১৯৭৯ | শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার | বিজয়ী | ||
১৯৮১ | স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার | শিল্পকলা (মরণোত্তর) | বিজয়ী | [১] |
২০১৩ | আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ডস | পরম্পরা পরিবার পদক (মরণোত্তর) | বিজয়ী | [৭] |
মৃত্যু
[সম্পাদনা]তিনি ১৯৫৯ সালের ৩০শে ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।[৮]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ ঘ রহমান, ইমরান (২৭ অক্টোবর ২০১০)। "আব্বাস উদ্দিন"। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১১।
- ↑ ক খ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ৭৬, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
- ↑ সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা- ৬৫।
- ↑ গানের সাম্রাজে আব্বাসউদ্দীন পরিবার, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪ জুলাই ২০২০
- ↑ "পল্লীগীতির যুগস্রষ্টা শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ"। দৈনিক আজাদী। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ২৭ অক্টোবর ২০১৯।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ ক খ গ ঘ মোরশেদ, হেদায়েত হোসেন (২০০১)। "চলচ্চিত্রে আব্বাস উদ্দিন এবং..."। সাপ্তাহিক ২০০০, ঈদ সংখ্যা। শাহাদত চৌধুরী। ৪ (২৮): ৩৫৯।
- ↑ শাওন, রাশেদ (২৭ জানুয়ারি ২০১৩)। "আরটিভির সেরা সজল ও মৌসুমী"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ১৫ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জুন ২০২০।
- ↑ "লোকশিল্পী নয় অনন্য মনীষা"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-২৮।
- ১৯০১-এ জন্ম
- ১৯৫৯-এ মৃত্যু
- কোচবিহার জেলার ব্যক্তি
- বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী
- বাঙালি সঙ্গীত পরিচালক
- বাঙালি সুরকার
- বাঙালি চলচ্চিত্র অভিনেতা
- সংস্কৃতিতে স্বাধীনতা পুরস্কার বিজয়ী
- প্রাইড অব পারফরম্যান্স প্রাপক
- বাঙালি গীতিকার
- স্বাধীনতা পুরস্কার বিজয়ী
- ২০শ শতাব্দীর ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞ
- ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাংলাদেশী ব্যক্তি
- পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গীতজ্ঞ