উজবেকিস্তানের ইতিহাস
খৃষ্টের জন্মের এক হাজার বছর আগের সময়ের মধ্যে ইরানীয় যাযাবররা মধ্য এশিয়ার নদীগুলোর আশেপাশে সেচ ব্যবস্থা চালু করে।[১] গড়ে তোলে বোখারা ও সমরকন্দ শহর। এ স্থানগুলো চীন ও ইউরোপকে সংযোগকারী ও পরে সিল্ক রোড নামে পরিচিত পথের বহুল-ব্যবহৃত ট্রানজিট বিন্দুতে পরিণত হয়। দৃশ্যত, এই ব্যবসা থেকে সোগদীয় ইরানীয়রা সবচেয়ে বেশি লাভবান হত। সপ্তম শতকে তারা লক্ষ করল, তাদের ট্রান্সঅক্সিয়ানা (মাওয়ারাননহর) প্রদেশে আরবদের আধিপত্য বেড়ে যাচ্ছে, যারা পুরো অঞ্চলে ইসলাম ধর্মকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। আব্বাসীয় খিলাফতের অধীনে অষ্টম ও নবম শতক ছিল ট্রান্সঅক্সিয়ানার শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম সোনালী যুগ। উত্তর দিক থেকে অঞ্চলটিতে তুর্ক জাতির লোকেরা এসে নতুন অনেকগুলো রাজ্য তৈরি করে। এগুলোর বেশির ভাগই পারস্য সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবান্বিত ছিল। একেক সময় একেকটি রাজ্য অঞ্চলটি শাসন করেছিল। অবশেষে দ্বাদশ শতকে ইরান ও খোয়ারিজম অঞ্চলের সাথে একীভূত হয়ে ট্রান্সঅক্সিয়ানা একটি একক রাজ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়। জায়গাটি ছিল আরাল সাগরের দক্ষিণে। ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে অঞ্চলটি চেঙ্গিজ খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলদের আক্রমণের শিকার হয়। তার উত্তরসূরীদের অধীনে মধ্য এশিয়ার কিছু অংশ থেকে ইরানীয় ভাষায় কথা বলা সম্প্রদায়গুলো বিতাড়িত হয়। তৈমুর লং এর সময়ে সমরকন্দকে কেন্দ্র করে ট্রান্সঅক্সিয়ানায় সর্বশেষ সাংস্কৃতিক পরিস্ফুটন শুরু হয়। তৈমুর লং এর পরে রাজ্যটি ভাঙতে শুরু করে। ১৫১০ সালের মধ্যে উজবেক গোত্রগুলো মধ্য এশিয়ার সমগ্র অঞ্চল জয় করে নেয়।
ষোড়শ শতাব্দীতে উজবেকরা বোখারা ও খোয়ারিজম নামে দুটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খানাত প্রতিষ্ঠা করে। এই সময়কালে সমুদ্র পথে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার ঘটলে সিল্ক রোডের ব্যবহার কমতে থাকে। ইরানের সাথে যুদ্ধের কারণে খানাতগুলো ছিল বিভক্ত। উত্তরের যাযাবরদের আক্রমণের কারণেও এগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ১৭২৯ থেকে ১৭৪১ সালের মধ্যে পারস্যের নাদের শাহ খানাতগুলোকে নিজের জায়গির বানিয়ে নেন। ঊনবিংশ শতকের শুরুতে বোখারা, খিভা ও কুকোন (কোকান্দ) খানাত তিনটি স্বল্পকালের জন্যে মুক্ত হয়। তবে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়া অঞ্চলটির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ও বিশেষ করে এর কার্পাস তুলার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মধ্যে এশিয়ায় পূর্ণাঙ্গ সামরিক বিজয় শুরু করে। ১৮৭৬ সালের মধ্যে রাশিয়া তিনটি খানাতকেই (অর্থাৎ বর্তমান উজবেকিস্তানের সমগ্র অঞ্চল) এর সাম্রাজ্যের অংশ বানিয়ে নেয়। খানাতগুলো সীমিত আকারে স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে উজবেকিস্তানে রুশ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে যায়। শিল্পায়নও হয় কিছুটা।
বিংশ শতকের শুরুতে জাদিদীয় আন্দোলন রুশ শাসনকে উৎখাত করার পক্ষে অবস্থান নিতে শুরু করে। শিক্ষিত মধ্য এশিয়দের এ আন্দোলন বর্তমান উজবেকিস্তানকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া রুশ সেনাবাহিনীতে মধ্য এশিয়দের জোর করে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ১৯১৬ সালে উজবেকিস্তান ও অন্যান্য স্থানে প্রচণ্ড বিরোধীতা দানা বাঁধে। ১৯১৭ সালে জার ক্ষমতাচ্যুত হলে জাদিদীয়রা কুকোনে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তবে এটি অল্প সময় স্থায়ী হয়। মস্কোয় বলশেভিক দল ক্ষমতা গ্রহণ করলে জাদিদীয়রা দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি পক্ষ রুশ কমিউনিজমকে সমর্থন দান করে। আরেকটি পক্ষ সমর্থন দেয় প্রায় পুরো অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিদ্রোহকে, যা পরে বাসমাখি বিদ্রোহ নামে পরিচিতি পায়। ১৯২০ এর দশকে এই বিদ্রোহ তীব্র দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছিল। এ সময় ফয়জুল্লাহ খোদাজায়েভদের মতো স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতারা উজবেকিস্তানে ক্ষমতা অর্জন করতে থাকে। ১৯২৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে উজবেক সোভিয়েত স্যোশালিস্ট রিপাব্লিক, যাতে বর্তমান তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯২৯ সালে তাজিকিস্তানকে আলাদা করে তাজিক সোভিয়েত স্যোশালিস্ট রিপাব্লিক তৈরি করা হয়। ১৯২০ এর দশকের শেষ ও ১৯৩০ এর দশকের শুরুর দিকে বড় আকারের সামষ্টিকিকীকরণের ফলে মধ্য এশিয়ার বড় অঞ্চলজুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯৩০ এর দশকের শেষের দিকে জোসেফ স্ট্যালিন (শাসনকাল: ১৯২৭-৫৩) খোদাজায়েভসহ উজবেক প্রজাতন্ত্রের সকল নেতাকে অপসারণ করেন ও মৃত্যুদণ্ড দেন। পদগুলোতে বসানো হয় রুশ কর্মকর্তাদের। ১৯৩০ এর দশকে শুরু হওয়া এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রুশকরণ ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত চলতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্ট্যালিন জাতীয় গোষ্ঠীগুলোকে ককেসাস ও ক্রিমিয়া থেকে উজবেকিস্তানে নির্বাসন দেয়, যাতে তারা যুদ্ধ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে "নাশকতামূলক" কর্মকাণ্ড করতে না পারে।
১৯৭০-এর দশকে উজবেক দলের নেতা শরফ রশিদভ নিজের বন্ধু ও আত্মীয়দের বিভিন্ন প্রভাবশালী পদে নিয়োজিত করলে উজবেকিস্তানের ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে আসে। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে উজবেক নেতৃত্বকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে মস্কো নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এর ফলে উজবেক জাতীয়তাবাদ আরও আরও প্রবল হয়ে ওঠে। এমনিতেই বিভিন্ন এলাকায় এককভাবে কার্পাস তুলা চাষে বাধ্য করা ও ইসলামী ঐতিহ্য দমনের কারণে সোভিয়েত নীতির প্রতি উজবেকদের অসন্তোষ কাজ করছিল। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে মিখাইল গর্ভাচেভের (ক্ষমতায়: ১৯৮৫-৯১) অধীনে সোভিয়েত ইউনিয়নের উদারনীতিকৃত পরিবেশে বিরোধী রাজনৈতিকি গোষ্ঠীগুলো সুবিধা পেতে থাকে। এ সময় উজবেকিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রকাশ্য বিরোধীতা (সীমিত আকারে হলেও) দেখা যায়। ১৯৮৯ সালে উজবেকদের অংশগ্রহণে একের পর এক অনেকগুলো জাতিগত সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। এর জের ধরে বহিরাগত উজবেক নেতা ইসলাম করিমভকে কমিউনিস্ট দলের প্রধান করা হয়। ১৯৯১ সালে সুপ্রিম সোভিয়েত ইউনিয়ন অনিচ্ছা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উজবেকিস্তানের স্বাধীনতা অনুমোদন করে। করিমভ হন উজবেকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি।
১৯৯২ সালে উজবেকিস্তানে নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। তবে প্রধান বিরোধী দল বিরলিককে নিষিদ্ধ কর হয়। গণমাধ্যমের ওপর শুরু হয় দমন-পীড়নের রীতি। ১৯৯৫ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে করিমিভের মেয়াদকাল ১৯৯৭ থেকে বৃদ্ধি করে ২০০০ সাল পর্যন্ত করা হয়। ১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সময়ের মধ্যে পূর্ব-উজবেকিস্তানে অনেকগুলো সহিংস ঘটনা ঘটলে সরকার ইসলামী চরমপন্থী গোষ্ঠী, অন্যান্য বিরোধীপক্ষ ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কঠোর হয়। ২০০০ সালে করিমভ বিপুল ভোটে পুননির্বাচিত হন। আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। ঐ বছরের শেষের দিকে তাজিকিস্তান সীমান্তে বিস্ফোরক পাতা শুরু হয়। এর ফলে নতুন করে মারাত্মক একটি আঞ্চলিক সমস্যা তৈরি হয়। উজবেকিস্তানের আঞ্চলিক আধিপত্যও আরও শক্তিশালী হয়। ২০০০ সালের পরপর পার্শ্ববর্তী দেশ কির্গিজস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের সাথেও উত্তেজনা তৈরি হয়। একবিংশ শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়া ও উজবেকিস্তানের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য আকারে শক্তিশালী হয়। ২০০৬ সালে একটি দাঙ্গার পরে শত শত শরণার্থী উজবেকিস্তানের আন্দিজন অঞ্চল থেকে কির্গিজস্তানে পালিয়ে গেলে উজবেকিস্তান তাদের প্রত্যর্পণ দাবি করায় কির্গিজস্তানের সাথে উত্তেজনা বেড়ে যায়। সীমান্তে অনেকগুলোকে ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাজিকিস্তানের সাথেও নতুন উত্তেজনার সূত্রপাত ঘটে। ২০০৬ সালেও করিমভ অধস্তন সরকারি কর্মকর্তাদের যথেচ্ছা বরখাস্ত ও বদলি করতে থাকেন। এর মধ্যে আছে একজন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীও।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ
[সম্পাদনা]১৯৩৮ সালে ওকলাদনিকভ উজবেকিস্তানে ৭০,০০০ বছর আগের ৮ থেকে ১১ বছর বয়সী একটি নিয়ানডার্থাল শিশুর খুলি আবিষ্কার করেন।
প্রাথমিক ইতিহাস
[সম্পাদনা]জানা তথ্য অনুসারে ইরানীয় যাযাবররা মধ্য এশিয়ায় সর্বপ্রথম বসতিস্থাপন করে। এরা খ্রিস্টের জন্মের আগের সহস্রাব্দে উত্তরের বর্তমানে কাজাখস্তান নামে পরিচিত তৃণভূমি থেকে এসেছিল। এই যাযাবররা ইরানের বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলত। মধ্য এশিয়ায় বসতি গড়ে এরা এই অঞ্চলের নদীগুলোর আশেপাশে ব্যাপকভাবে সেচ প্রকল্প গড়তে শুরু করে। এই সময়েই শাসন ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে বুখোরো (বোখারা) ও সমরকন্দের মতো শহরগুলোর আবির্ভাব ঘটতে শুরু করে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের মধ্যে বাকট্রিয়, সোগদীয় ও তোখরীয়দের রাজ্যগুলো আধিপত্য লাভ করে। পাশ্চাত্যের সাথে বাণিজ্যের সমৃদ্ধির জন্যে চীন সিল্ক রোডের নির্মাণ শুরু করলে ইরানীয় শহরগুলো ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং সুবিধা পেতে থাকে। উজবেকিস্তানের ট্রান্সঅক্সিয়ানা (অঞ্চলটির নাম মাওয়ারাননহর দেওয়া হয় ইসলামের বিজয়ের পরে) প্রদেশ ও আরও পূর্বের বর্তমান চীনের জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলের শহর ও বসতিগুলোর বিশাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সোগদীয় মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা ইরানি বণিকদের মধ্যে সবচেয়ে ধনবান হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে সিল্ক রোড নাম খ্যাত এই বাণিজ্যপথের ব্যবসার ফলে বুখোরো ও সমরকন্দের অর্থনীতি খুব সমৃদ্ধি লাভ করে। মাঝেমাঝেই ট্রান্সঅক্সিয়ানা প্রাচীনকালের অন্যতম প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী ইরানীয় প্রদেশ হয়ে উঠত।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৮ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট অঞ্চলটি জয় করেন। এর মাধ্যমে অঞ্চলটি অল্প সময়ের জন্যে মেসিডোনীয় সাম্রাজ্যের অধীনে থাকে।
ট্রান্সঅক্সিয়ানায় সম্পদের প্রাচুর্যের আকর্ষণে অঞ্চলটি উত্তরের তৃণভূমি ও চীন থেকে নিয়মিত আক্রমণের শিকার হত। সোগোদীয় রাজ্য ও ট্রান্সঅক্সিয়ানার অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইরানীয় ও চীনারাও অঞ্চলটি নিয়ে চিরন্তন দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। এ অঞ্চলের ফরগানা ঘোড়ার প্রতি চীনাদের দুর্বলতা ছিল। ঘোড়াগুলো পাওয়ার জন্য তারা খ্রিষ্টপূর্ব ১০৪ সালে ফরগানা উপত্যকার নগরায়িত সভ্যতা দায়ুন অবরোধ পর্যন্ত করে।
একই সময়ে আবার অঞ্চলটি বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ও ধর্মেরও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। প্রথম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রধান ধর্ম ছিল জরাথুস্ট্রবাদ। তবে বৌদ্ধ ধর্ম, মানি ধর্ম ও খ্রিস্টান ধর্মেরও বহুসংখ্যক অনুসারী ছিল।
প্রাথমিক ইসলামী যুগ
[সম্পাদনা]অষ্টম শতকে সমাপ্ত আরব মুসলমানদের মধ্য এশিয়া বিজয় অঞ্চলটিতে নতুন একটি ধর্মের সূচনা ঘটায়, যা আজ অবধি এখানে সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্ম। আরবরা সর্বপ্রথম মধ্য এশিয়া আক্রমণ করে সপ্তম শতকের মধ্যভাগে। তবে ইরান বিজয়ের সময়ে করা এ আক্রমণগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন। আরবদের বিজয়ের বিদ্যমান সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, মধ্য এশিয়ার সোগদীয় ও অন্যান্য ইরানীয় জনগণ নিজদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও নিজস্ব শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাবে আরবদের কাছ থেকে নিজেদের ভূমি রক্ষা করতে পারেনি। অন্য দিকে আরবদের নেতৃত্বে ছিলেন প্রতিভাবান জেনারেল কুতায়বা ইবনে মুসলিম। এছাড়াও তাদের মধ্যে ছিল নতুন বিশ্বাসকে (আনুষ্ঠানিকভাবে যার সূচনা ঘটে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে) ছড়িয়ে দেওয়ার প্রেষণা। এসব কারণে ট্রান্সঅক্সিয়ানার মানুষ সহজেই নতি স্বীকার করে। ক্রমেই আরবদের নিয়ে আসা নতুন ধর্ম বিস্তার লাভ করে। আরবদের আসার আগেই ইরানীয়দের প্রভাবে আঞ্চলিক ধর্মীয় পরিচয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিলুপ্তির পথে ছিল। আরবদের প্রভাবে আগের পরিচয় আরও বেশি করে বিলুপ্ত হয়। তবে মধ্য এশিয়া শক্তিশালী ইসলামী অঞ্চল হয়ে ওঠে ৭৫০ সালে তলাস নদীর তীরে চীনা বাহিনীর সাথে সংঘটিত একটি যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে।
সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আরবদের শাসনে থাকলেও মধ্য এশিয়া এর বেশিরভাগ ইরানীয় বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখে। নতুন ধর্ম গ্রহণের বহু শতাব্দী পরেও এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন ইরানীয় রাজার শাসনকালের মতোই আঞ্চলিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ট্রান্সঅক্সিয়ানার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অব্যাহত থাকে। বস্তুত, ৭৫০ সাল থেকে শুরু করে ৫০০ বছর আরব বিশ্বের ক্ষমতায় থাকা আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতিষ্ঠার পেছনেও মধ্য এশীয় সমর্থকদের সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এর আগে তৎকালীন ক্ষমতাশালী উমাইয়া খিলাফতের সাথে আব্বাসীয় খিলাফতের দ্বন্দ্ব চলছিল।
অষ্টম ও নবম শতকে আব্বাসীয় খিলাফতের সুসময়ে মধ্য এশিয়া ও ট্রান্সঅক্সিয়ানা সত্যিকার অর্থেই সোনালী যুগ অতিহাবিত করছিল। বুখোরো মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিল্পের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডোভার মতো সমসাময়িক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোর সাথে পাল্লা দিচ্ছিল এর মহিমা। ইতিহাসের বেশ কিছু সেরা ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী ও ভূগোলবিদ এ অঞ্চলের স্থানীয় মানুষ ছিলেন।
আব্বাসীয় খিলাফত দুর্বল হতে শুরু করলে স্থানীয় ইরানীয় ইসলামী রাজ্যগুলো ইরান ও ট্রান্সঅক্সিয়ানা শাসন করা শুরু করে। এ সময় উক্ত অঞ্চলটির সাহিত্য ও সরকারের ভাষা হিসেবে ফার্সি ভাষার গুরুত্ব অব্যাহত থাকে। ইরানের পূর্ব অংশ ও ট্রান্সঅক্সিয়ানার শাসকরা ছিল ইরানীয়। সামানি ও বুয়ি সাম্রাজ্যের অধীনে ট্রান্সঅক্সিয়ানার ইরানীয়-ইসলামী সংস্কৃতির সমৃদ্ধি অব্যাহত থাকে।
ট্রান্সঅক্সিয়ানায় তুর্ক প্রভাব
[সম্পাদনা]নবম শতকেও উত্তরের তৃণভূমি থেকে যাযাবরদের আসা অব্যাহত থাকলে মধ্য এশিয়ায় নতুন একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়। এরা ছিল তুর্ক জাতির মানুষ, যারা মঙ্গোলিয়া থেকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত তৃণভূমিতে বসবাস করত। সামানি সাম্রাজ্যে মূলত দাস হিসেবে নিয়ে আসা এই তুর্ক জাতির মানুষগুলো অঞ্চলটির সবগুলো রাজ্যের সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিল। আব্বাসীয় সেনাবাহিনীতেও এরা ছিল। দশম শতকের শেষ দিকে সামানিরা ট্রান্সঅক্সিয়ানা ও উত্তর-পূর্ব ইরানের নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকলে এই সৈন্যদের কেউ কেউ অঞ্চলটির সরকারের প্রভাবশালী পদ গ্রহণ করে। শেষ পর্যন্ত এরা নিজেদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। অবশ্য রাজ্যগুলোতে ইরানিদের প্রবল প্রভাব ছিল। অঞ্চলটিতে একটি তুর্ক শাসক গোষ্ঠীর আবির্ভাবের ফলে অন্যান্য তুর্ক গোত্রগুলো ট্রান্সঅক্সিয়ানায় স্থানান্তরিত হতে শুরু করে।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ This section incorporates text from the following source, which is in the public domain: Lubin, Nancy (1997). "Uzbekistan", chapter 5 in Glenn E. Curtis (Ed.), Kazakhstan, Kyrgyzstan, Tajikistan, Turkmenistan, and Uzbekistan: Country Studies. Washington, DC: Federal Research Division, Library of Congress. আইএসবিএন ০৮৪৪৪০৯৩৮৩. pp. 375–468: Early History, pp. 385–386.