জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা
২০১০ জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুতি | |
---|---|
স্থান | পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ |
তারিখ | ২৮ মে, ২০১০ ০১:৩০ ভারতীয় সময় (UTC+05:30) |
হামলার ধরন | অন্তর্ঘাত অথবা বোমা বিস্ফোরণ |
নিহত | ১৪৮[১] |
আহত | ২০০+[২] |
হামলাকারী | পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি[৩][৪] |
সন্দেহভাজন হামলাকারী | (মাওবাদী) |
২০১০ সালের ২৮ মে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছিল।[৫] এই দুর্ঘটনায় জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত বগিতে একটি চলন্ত মালগাড়ির ধাক্কা লাগায় মোট ১৪১ জন যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। অন্তর্ঘাত না বোমা বিস্ফোরণের ফলে লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।[৬]
প্রেক্ষাপট
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) এই অঞ্চলে চার দিনের বনধ ঘোষণা করা ৯০ মিনিট পরেই এই দুর্ঘটনা ঘটে।[৭] এই সপ্তাহটিকে "কালা সপ্তাহ" ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সতর্কতাও জারি ছিল।[৮]
এই ট্রেন দুর্ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে নকশাল হানার ফলে ভারতীয় রেল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে: "নকশাল বনধ ও অবরোধের কারণে আমাদের ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। যেসব জায়গায় ট্রেন চালানো ঝুঁকিপূর্ণ সেই সব অঞ্চলে বনধ ডাকা ও অন্যান্য আতঙ্কের কারণে রেলের কাজ, পণ্য ও যাত্রী পরিবহন বিঘ্নিত হচ্ছে এবং তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে জনজীবনে।"[৯]
লাইনচ্যুতি
রাজ্য পুলিশ প্রধান দাবি করেন যে, নকশালপন্থী মাওবাদীরা রেলওয়ে ট্র্যাক থেকে ৪৬ সেন্টিমিটার অংশ সরিয়ে নেয়।[১০] স্থানীয় সময় রাত দেড়টা নাগাদ ১৩টি কোচবিশিষ্ট একটি দুরপাল্লার যাত্রীবাহী ট্রেন এই কেটে নেওয়া ট্র্যাকে লাইনচ্যুত হয়। "হাওড়া-কুরলা লোকমান্য তিলক জ্ঞানেশ্বরী সুপার ডিলাক্স এক্সপ্রেস" (সংক্ষেপে "জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস") নামে এই ট্রেনটি হাওড়া থেকে মুম্বই যাচ্ছিল।[৫] এরপরই উল্টোদিক থেকে আসা একটি মালগাড়ি লাইনচ্যুত ট্রেনটিতে ধাক্কা মারে।[৫] এই দুর্ঘটনায় ১৪১ জনের মৃত্যু হয় এবং ১৮০ জনেরও বেশি আহত হন।[৬] খেমাশোলি ও সরডিয়া স্টেশনের মধ্যবর্তী অংশে এই দুর্ঘটনা ঘটে।[৫] দেখা যায় যে, রেল ট্র্যাকের একটি অংশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এবং ফিসপ্লেটগুলি ঢিলে হয়ে গেছে। তা থেকেই অনুমিত হয় যে, অন্তর্ঘাতের ফলে এই দুর্ঘটনা ঘটে থাকবে।[১০][১১]
বোমা বিস্ফোরণ না লাইনচ্যুতি – ঠিক কি কারণে এই রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে প্রথম দিকে ধোঁয়াশা ছিল। রেলমন্ত্রীর বক্তব্য, বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে "পরিকল্পিত হামলা" চালানো হয়, যার ফলে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়।[১২] তিনি বলেন, "ট্রেনের ড্রাইভার একটি বিস্ফোরণ আওয়াজ শুনেছেন। তাই আমরা সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখছি। আমরা জানি যে, নকশালদের হাতে উন্নতমানের বোমা ও বিস্ফোরণ ঘটানোর অত্যাধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে।"[৯]
উদ্ধারকার্য
সরকারিভাবে, একটি উদ্ধারকারী দলের সাহায্যে ২৬টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনাস্থলে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একাধিক হেলিকপ্টার উপস্থিত ছিল। এই হেলিকপ্টারগুলির সাহায্যেও একাধিক আহত ব্যক্তিতে তুলে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হয়।[১০] দুর্ঘটনাস্থলে একটি মেডিক্যাল ট্রেনও পাঠানো হয়।[১৩] দুটি ট্রেনের মাঝে আটকা পড়া একজন মাত্র ব্যক্তিই প্রাণে বেঁচে যান।[১৪]
তদন্ত
দুর্ঘটনার তদন্তে নেমে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রামের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির শাখা সিধু কানু গণ মিলিশিয়া-র সদস্য সমীর মাহাতোকে গ্রেফতার করে। তার আগেই অবশ্য সিআইডি মূল অভিযুক্ত খগেন মাহাতোকে গ্রেফতার করেছিল।[১৫]
দায়
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাকে "সম্ভবত মাওবাদীদের কাজ" বলে উল্লেখ করার পর[১০] পিসিপিএ এই ঘটনার দায় স্বীকার করে।[৪]
পুলিশ দুর্ঘটনাস্থল থেকে মাওবাদী-অনুমোদিত পিসিপিএ-এর একটি পোস্টার উদ্ধার করে। এই পোস্টারে দুর্ঘটনার দায় স্বীকার করা হয়েছিল।[১৬] যদিও একজন পিসিপিএ মুখপাত্র এই মর্মে এই অভিযোগ অস্বীকার করেন যে, রেলমন্ত্রীর চরিত্রহনন ও পিসিপিএ-এর সঙ্গে মানুষের দূরত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) (সিপিআই(এম))-এর "চক্রান্তে" এইরকম করা হয়েছে।[১৭]
প্রতিক্রিয়া
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ দুর্ঘটনায় জীবনহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেন।[১৮] ভারত সরকার দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারবর্গকে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের চাকরির আশ্বাস দেন।[১৩] পশ্চিমবঙ্গ সরকার আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের অঙ্গীকার করেন।[১০]
রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি জানান যে, মাওবাদীদের কালা দিবস কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন এবং এই উপলক্ষে রেলের নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়েছিল।[১৯] অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও এই ঘটনার নিন্দা করেন।[১৪] তবে তিনি মাওবাদীদের দোষারোপের ক্ষেত্রে আশ্চর্যরকম সংযমও রক্ষা করেন। বিস্ফোরণের তত্ত্বের ব্যাপারে তিনি তার সহকর্মী রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমত ছিলেন না। তিনি বলেন, "এই দুর্ঘটনায় আমি গভীর শোকাহত। ট্র্যাকের একটি অংশ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে দেখে এটিকে অন্তর্ঘাত বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।"[২০]
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই ঘটনার নিন্দা করেন। তিনি বলেন, "এই ধরনের বদমায়েশির বিরুদ্ধে আমাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে, ভাবতে হবে কীভাবে রাজ্য ও দেশ এ থেকে মুক্ত হতে পারে... আমাদের বাহিনীকে সজাগ করে মাওবাদীদের মোকাবিলা করতে হবে। আমরা জানি যে এই সপ্তাহে তারা উৎসব পালন করছে, কিন্তু তারা এই রকম ভয়ংকর কাপুরুষোচিত অপরাধ কি করে সংঘটিত করল তা আমাদের জানা নেই।"[২১] তিনি সাবধান করেন এই বলে, "তারা সব দিক থেকে আসছে।"[৯]
রাজনৈতিক দোষারোপ
এই ঘটনার এক দিন পরেই রাজ্যে পুরনির্বাচন উপলক্ষে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল পরস্পরবিরোধী দোষারোপ শুরু করে দেয়।[২২] সিপিআই(এম) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে পিসিপিএ সহ মাওবাদীদের মদত দেওয়ার অভিযোগ আনে। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস এই অভিযোগ খণ্ডন করে।[২৩]
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরে এই ঘটনাকে রাজনৈতিক চক্রান্ত বলে মন্তব্য করলে, তার মাধ্যমে থেকে ক্ষমতাসীন সিপিআই(এম)-কে দোষারোপ করা হচ্ছে বলে মনে করা হতে থাকে।[২৪]
নকশালদের প্রতিক্রিয়া
নকশাল মুখপাত্র "কমরেড আকাশ" বিবিসি-র সঙ্গে যোগাযোগ করে জানান যে নকশালদের কোনো দলছুট বিদ্রোহী এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হবে। যেহেতু রেল মন্ত্রক নকশাল অধ্যুষিত অঞ্চলের রাতে ট্রেন না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই কারণে এই সব অঞ্চলে নকশালরা রেল যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত করবে।[২৫]
আরও দেখুন
- ভারতে রেল দুর্ঘটনার তালিকা
- নকশাল-মাওবাদী সন্ত্রাসবাদের কালপঞ্জি
- রেল ব্যবস্থায় সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ
- রফিগঞ্জ ট্রেন দুর্ঘটনা
বহিঃসংযোগ
পাদটীকা
- ↑ PTI, May 31, 2010, 05.40pm IST। "No CBI probe into Jnaneswari express derailment: WB govt - India - The Times of India"। Timesofindia.indiatimes.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৫-৩১।
- ↑ "India train attack death toll rises - CENTRAL/S. ASIA"। Al Jazeera English। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৫-৩১।
- ↑ "We're sorry... Target was goods train"। Indian Express। ৩১ মে ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মে ২০১০।
- ↑ ক খ "Times of India Publications"। Lite.epaper.timesofindia.com। ২০১১-১০-০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৫-৩১।
- ↑ ক খ গ ঘ "15 dead, Gyaneshwari Express derail after blast"। Indian Express। ২৮ মে ২০১০। ১ জুন ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ মে ২০১০।
- ↑ ক খ "15 dead, Gyaneshwari Express derail after blast"। Indian Express। ২৮ মে ২০১০। ৩১ মে ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ মে ২০১০।
- ↑ "'Sabotage' behind India train crash"। Al-Jazeera। ২৮ মে ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০১০।
- ↑ Magnier, Mark (২৮ মে ২০১০)। "India train crash leaves 65 dead in West Bengal state"। Los Angeles Times। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০১০।
- ↑ ক খ গ "Naxals menace stalks Railways"। Business-standard.com। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মে ২০১০।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "At least 25 dead in India train blast and collision"। BBC News। ২৭ মে ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ২৭ মে ২০১০।
- ↑ "Gyaneshwari Express accident One foot section of track missing"। ১২ জুন ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০১০।
- ↑ "Bomb blast caused train derailment: Mamata Banerjee"। Ndtv.com। ২০ জানুয়ারি ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০১০।
- ↑ ক খ NDTV. 28 May 2010. 7:30.
- ↑ ক খ NDTV. 28 May 2010, 16:45 IST.
- ↑ "PCPA leader Samir Mahato arrested"। ১১ জুন ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০১০।
- ↑ "List of the injured persons who are admitted KGP Rly. Hospital due to incident on Howrah–Mumbai Gyaneswari Super deluxe Exp." (পিডিএফ)। www.CIDWestBengal.gov.in। ২৯ মে ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মে ২০১০।
- ↑ "PCPA denies involvement and accuses CPI(M)"। ২ জুন ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০১০।
- ↑ "PM expresses grief over loss of lives in mishap involving Gyaneshwari Express"। ৩ জুন ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০১০।
- ↑ "Mamata rushes to mishap spot, says Railways aware of Maoist Black Day – Oneindia News"। News.oneindia.in। ৩০ অক্টোবর ২০০৭। ২ জুন ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০১০।
- ↑ Nishit Dholabhai (১৯৯৯-০৩-০১)। "The Telegraph - Calcutta (Kolkata) | Nation | PC cautious on rebel role"। Telegraphindia.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৫-৩১।
- ↑ "The Hindu : News / National : Buddhadeb vows to fight Maoists"। Beta.thehindu.com। ২০ আগস্ট ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মে ২০১০।
- ↑ "Front Page : Train disaster a political conspiracy, says Mamata"। The Hindu। ২০১২-০৫-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৫-৩১।
- ↑ "Maoists gain from CPM-TMC spat in West Bengal - Politics - Political News - ibnlive"। Ibnlive.in.com। ২০১০-০২-০৩। ২০১০-০৬-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৫-৩১।
- ↑ "Mamata hints at political conspiracy"। ২ জুন ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০১০।
- ↑ [১]