বিষয়বস্তুতে চলুন

কাজী আনোয়ার হোসেন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(শামসুদ্দীন নওয়াব থেকে পুনর্নির্দেশিত)
কাজী আনোয়ার হোসেন
জন্ম(১৯৩৬-০৭-১৯)১৯ জুলাই ১৯৩৬
ব্রিটিশ ভারত ঢাকা, ব্রিটিশ ভারত
মৃত্যু১৯ জানুয়ারি ২০২২(2022-01-19) (বয়স ৮৫)
ছদ্মনামবিদ্যুৎ মিত্র, শামসুদ্দীন নওয়াব
পেশালেখক, প্রকাশক, অনুবাদক
জাতীয়তাবাংলাদেশী
নাগরিকত্ববাংলাদেশ
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি[কুয়াশা]]
উল্লেখযোগ্য পুরস্কারবাচসাস পুরস্কার, জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার
দাম্পত্যসঙ্গীফরিদা ইয়াসমিন (১৯৬২-২০১৫, মৃত্যু পর্যন্ত)
সন্তানকাজী শাহনূর হোসেন
কাজী মায়মুর হোসেন
শাহরীন সোনিয়া

কাজী আনোয়ার হোসেন (১৯ জুলাই ১৯৩৬-১৯ জানুয়ারি ২০২২) ছিলেন একজন বাংলাদেশি লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক, এবং জনপ্রিয় [মাসুদ রানা ধারাবাহিকের প্রকাশক]] সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার হিসাবে তিনি ষাটের দশকের মধ্যভাগে মাসুদ রানা নামক গুপ্তচর চরিত্রকে প্রকাশ করেন।[] এর কিছু আগে কুয়াশা নামক আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র তার হাতেই জন্ম নিয়েছিলো। কাজী আনোয়ার হোসেন ছদ্মনাম হিসেবে বিদ্যুৎ মিত্রশামসুদ্দীন নওয়াব নাম ব্যবহার করতেন।

জন্ম ও শৈশব

[সম্পাদনা]

কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম 'নবাব'। তার পৈত্রিক নিবাস রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলায়। তার পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১) , মাতা সাজেদা খাতুন ( ১৯০৫-১৯৭৫)। তারা ছিলেন ৪ ভাই, ৭ বোন।[] ঢাকা মেডিকেল কলেজের পূর্ব সীমানায় উত্তর ও দক্ষিণ কোণে যে দুটি দোতলা গেস্ট হাউজ আজও দেখা যায়, সেখানেই উত্তরের দালানটিতে আনোয়ার হোসেনের ছেলেবেলা কেটেছে। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় বাড়ি বদল করে তারা দক্ষিণ দিকের গেস্ট হাউসে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের কিছু অংশ দক্ষিণ দিকে ছিল। অধ্যাপক ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।[] পরে অবশ্য তারা বাসা বদল করে সেগুনবাগিচায় নিজেদের বাসায় চলে আসেন।

শিক্ষাজীবন

[সম্পাদনা]

তিনি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন।[] এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন।

কর্মজীবন

[সম্পাদনা]

পড়াশুনা শেষ হওয়ার পর রেডিওতে তিনি নিয়মিত গান গাইতে শুরু করেন। নিয়মমাফিক কোনো প্রশিক্ষণ না নিলেও বাড়িতে গানের চর্চা সবসময় ছিলো। তার তিন বোন সানজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুনমাহমুদা খাতুন এখনও রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকা বেতারের সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। কিন্তু রেডিও কিংবা টিভিতে গান গাওয়া এবং সিনেমার প্লে-ব্যাক কাজী আনোয়ার হোসেন ছেড়ে দেন ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে।[]

১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে বাবার দেয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগিচায় প্রেসের যাত্রা শুরু করেন। আট হাজার টাকা দিয়ে কেনেন একটি ট্রেডল মেশিন আর বাকিটাকা দিয়ে টাইপপত্র।[] দুজন কর্মচারী নিয়ে সেগুনবাগান প্রেসের শুরু, যা পরবর্তীকালে নাম পাল্টে হয় সেবা প্রকাশনী[] পরবর্তীতে তার প্রকাশনা সংস্থা বাংলাদেশে পেপারব্যাক গ্রন্থ প্রকাশ, বিশ্ব সাহিত্যের প্রখ্যাত উপন্যাসের অনুবাদ এবং কিশোর সাহিত্যের ধারাকে অগ্রসর করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে প্রকাশিত হল কুয়াশা-১, যার মাধ্যমে সেগুনবাগান প্রকাশনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে।[][]

ব্যক্তিগত জীবন

[সম্পাদনা]

১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনকে (১৯৪০-২০১৫ ) বিয়ে করেন।[] কাজী আনোয়ার হোসেনের এক মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে। তার মেয়ে শাহরীন সোনিয়া (১৯৬৪-২০১৪) একজন কন্ঠশিল্পী। বড় ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন এবং ছোট ছেলে মায়মুর হোসেন লেখালেখির এবং সেবা প্রকাশনীর সাথে জড়িত।[]

লেখালেখি

[সম্পাদনা]

তার অধিকাংশ উপন্যাসগল্প বিদেশী কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে রচিত।[] কুয়াশা সিরিজের কুয়াশা-১-এর মাধ্যমে লেখালেখির জগতে বিচরণ ঘটে তার।[] তার ভাষাশৈলী অসাধারণ রকমে স্বাদু। মৌলিক রচনাগুলোও চমকপ্রদ। বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন তিনি প্রধানত সম্পাদকের কাজ করেন, যদিও প্রকাশের ক্ষেত্রে বইগুলো তার নামেই প্রকাশিত হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

মাসুদ রানা

[সম্পাদনা]

মাসুদ রানা তার প্রকাশ করা একটি কাল্পনিক চরিত্র। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ধ্বংস পাহাড় প্রচ্ছদনামের প্রথম গ্রন্থটি থেকে শুরু করে সেবা প্রকাশনীহতে মাসুদ রানা সিরিজে এই চরিত্রকে নিয়ে চার শতাধিক গুপ্তচর কাহিনীর বই প্রকাশিত হয়েছে।[] সিরিজের প্রথম দুইটি বই "ধ্বংস পাহাড়", "ভারতনাট্যম" এবং "হ্যাকার" ছাড়া বাকিগুলো ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ বা ছায়া অবলম্বনে রচিত। মাসুদ রানার চরিত্রটিকে মূলত ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সৃষ্ট জেমস বন্ড চরিত্রটির বাঙালি সংস্করণ হিসেবে গণ্য করা হয়।

রহস্যপত্রিকা

[সম্পাদনা]

মাঝে ১৯৬৯-৭০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সাংবাদিক রাহাত খানের অনুপ্রেরণায় রহস্যপত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এবং পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে। চারটি সংখ্যা বের হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের সময় পত্রিকাটির প্রকাশনা স্থগিত রাখা হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে পত্রিকাটি প্রকাশ সম্ভব হচ্ছিলো না। এরপর ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রহস্যপত্রিকা আবার প্রকাশিত হয়। আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে।[]

চলচ্চিত্রায়ন

[সম্পাদনা]

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে মাসুদ রানা'র কাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় (মূল ভুমিকায় ছিলেন সোহেল রানা)।[] বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে প্রথম প্যাকেজ নাটক প্রাচীর পেরিয়ে 'র কাহিনী রচনা করা হয় শেখ আবদুল হাকিম রচিত মাসুদ রানা সিরিজের পিশাচ দ্বীপ নামক বই থেকে। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রচারিত নাটক প্রাচীর পেরিয়ের নির্দেশক আতিকুল হক চৌধুরী। ঐ নাটকের প্রধান দুটি চরিত্রে ছিলেন বিপাশা হায়াতনোবেল[]

সমালোচনা

[সম্পাদনা]

কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রথম সমালোচনা ছিলো তিনি মাসুদ রানা সিরিজে যৌনতার বেসাতি পেতেছেন। এই হাওয়ায় পাল এতোটাই উঠেছিলো যে, 'প্রজাপতি' মার্কাওয়ালা বই পড়াই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো বাঙালি ঘরে।[] যারা এসব বই পড়তো তাদেরকে দেখা হতো অন্য নজরে। এছাড়া তিনি সমালোচিত হয়েছেন, প্রায় ঢালাওভাবে বিদেশী কাহিনী ধার করে মাসুদ রানাকে সচল রাখার জন্য।

পুরস্কার ও সম্মাননা

[সম্পাদনা]

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন।[] এছাড়া পেয়েছেন সিনেমা পত্রিকা ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার।

মৃত্যু

[সম্পাদনা]

২০২১ সালের অক্টোবর মাসের ৩১ তারিখ তাঁর প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর একবার ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্ট এটাক হয়। এরপর ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তিনি ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।[১০]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "পঞ্চাশে মাসুদ রানা: 'এক দুর্দান্ত, দু:সাহসী স্পাই'"বিবিসি বাংলা। ১৩ মে ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০ জানুয়ারি ২০২২ 
  2. "乌海鹊钨电子技术有限公司"www.sonalisakal.com [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. "সময়ের তারকা"দৈনিক প্রথম আলো। ২৩ জানুয়ারি ২০১০। ২৩ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুন ২০১৯ 
  4. "কাজী আনোয়ার হোসেনের ভুবনে"দৈনিক প্রথম আলো। ৯ জানুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুন ২০১৯ 
  5. "'মাসুদ রানা'র স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন আর নেই"প্রথম আলো 
  6. "The spy who turns 73" (ওয়েব)দৈনিক নিউ এজ (ইংরেজি ভাষায়)। ঢাকা। ১৭ জুন ২০০৮। সংগ্রহের তারিখ জুন ২, ২০১০ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  7. "লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন আর নেই"banglanews24.com। ১৯ জানুয়ারি ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ২০ জানুয়ারি ২০২২ 
  8. "The Daily Star Web Edition Vol. 5 Num 987"archive.thedailystar.net। ২৯ নভেম্বর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জানুয়ারি ২০২২ 
  9. "'মাসুদ রানা' বাছাই করবেন ফেরদৌস ও পূর্ণিমা"দৈনিক প্রথম আলো। ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুন ২০১৯ 
  10. "চলে গেলেন 'মাসুদ রানা'র স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন"দ্য ডেইলি স্টার। ১৯ জানুয়ারি ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জানুয়ারি ২০২২ 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]