শয়তানের বাণী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

শয়তানের বাণী হলো "শয়তান কর্তৃক প্ররোচিত" সেই সমস্ত আয়াত বা বাক্য যা ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদ ভুলবশত আল্লাহ কর্তৃক স্বর্গীয় বাণী মনে করেছিলেন বলে দাবী করা হয়।[১] কথিত এই আয়াতগুলোতে তিনজন প্রাক-ইসলামি আরবীয় দেবী লাত, উজ্জামানাতের প্রশংসা করা হয়েছে। আল-ওয়াকিদী, ইবনে সা'দ, ও ইবনে ইসহাক রচিত সীরাতে এবং আল-তাবারির তাফসীরে এই আয়াতগুলির বর্ণনা পাওয়া যায়।[২] "শয়তানের বাণী" (ইংরেজি: Satanic Verses স্যাটানিক ভার্সেস) অভিব্যক্তিটি ১৮৫৮ সালে স্যার উইলিয়াম মুয়ার প্রথম ব্যবহার করেন।[৩]

ইসলামি অধ্যয়নের আধুনিক পণ্ডিতরা এই বিবেচনায় শয়তানের আয়াত প্রবর্তন ঘটনা স্বীকার করেন যে মুসলমান জীবনীরচয়িতারা নিজেদের নবী নিয়ে মিথ্যা কুৎসা রটাবে না।[৪][৫] ইসলামি ইতিহাসের প্রথম দুই শতকের ধর্মীয় পণ্ডিতরা এই ঘটনাকে স্বীকার করে নিলেও বর্তমানের অনেক মুসলমান পণ্ডিতরা (উলামা) মুহাম্মাদের দৈব বিশুদ্ধতার (ইসমাহ) ভিত্তিতে এই ঘটনার ঐতিহাসিকতা অস্বীকার করেন। কেননা উল্লেখ্য ঘটনাটি "মুহম্মদ কখনোই শয়তানের ধোঁকায় প্ররোচিত হননি" এরূপ মতবাদের বিরূদ্ধে যায়।[১][৬][৭]

সাধারণ আখ্যান[সম্পাদনা]

আরবীয় দেবী লাত এবং তাঁকে ঘিরে থাকা উজ্জা ও মানাত

এই ঘটনার একাধিক বর্ণনা একাধিক মাধ্যম থেকে এসেছে। প্রতিটি ঘটনা বর্ণনার মাঝে পার্থক্য থাকলে, এর সাধারণ আখ্যান মূলত একই বার্তা প্রদান করে। সবগুলো বর্ণনাই অবশ্য একজন বর্ণনাকারী মুহাম্মদ ইবনে কাব পর্যন্ত যায়। মুহাম্মদ ইবনে কাব ছিলেন মুহাম্মদের জীবনীলেখক ইবনে ইসহাকের দুই প্রজন্ম পরের বর্ণনাকারী।[২] ঘটনাটির বর্ণনাতে বলা হয় যে, মুহাম্মদ তাঁর মক্কার প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। এজন্যই তিনি ফেরেশতা জিব্রাইল কর্তৃক নিয়ে আসা সুরা আন-নাজমের দুটি আয়াত[৮] পাঠ করেন।

"আপনি কি ভেবেছেন লাত ও উজ্জা সম্পর্কে? এবং তৃতীয় আরেকটি [দেবী] মানাত সম্পর্কে?"

কুরআন ৫৩:১৯–২০

শয়তান তাঁকে নিম্নলিখিত বাক্যটি উচ্চারণ করতে প্ররোচিত করেছিল:

تلك الغرانيق العلى وإن شفاعتهن لترتجى অর্থ: "এঁরা হলেন উচ্চমানের গারানিক, যাঁদের সুপারিশ প্রত্যাশিত।"

লাত, উজ্জা ও মানাত হচ্ছে মক্কাবাসী উপাসনা করতো এরকম তিন দেবী। "গারানিক" এর অর্থ নির্ণয় করা কঠিন, কেননা এটি শুধুমাত্র একবারই এই বাক্যে ব্যবহৃত হয়েছে। অনেকের মতে এর অর্থ "সারস"। আরবিতে সাধারণত "সারস" পাখি বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার হয়। যার একবাচক শব্দ গিরনিক, গুরনুক, গিরনাউকগুরনাইক। শব্দটি "কাক", "দাঁড়কাক" ও "ঈগল" পাখিবিশেষ বোঝাতেও প্রচলিত।[৯] "উচ্চমানের গারানিক" কথাটিকে একটি বিচ্ছিন্ন বাক্যাংশ হিসেবে নিয়ে প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম মুয়ার একে "উচ্চমানের নারী" অর্থে অনুবাদ করেছেন, যেখাবে সমসাময়িক শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ মানাজির আহসান একই বাক্যাংশকে "সুউচ্চ (দেবতা)" হিসেবে অনুবাদ করেছেন। সুতরাং এই বাক্যাংশটিতে তিনটি "মূর্তি"-কে ঐশ্বরিক মাহাত্ম্য আরোপ করতে বলা হয়েছিল কিনা তা বিতর্কের বিষয়।[১০] উভয় ক্ষেত্রেই পন্ডিতরা সাধারণত বাক্যটির দ্বিতীয়ার্ধ "যাঁদের সুপারিশ প্রত্যাশিত"-এর অর্থের বিষয়ে একমত হন এবং বাক্যাংশটি নিজেই একটি গোঁড়াপন্থী ইসলামি মূলনীতির বিরোধিতা করে, অর্থাৎ কোনো সাধু বা দেবতা মুসলমানদের জন্য সুপারিশ করতে পারে না।

মুসলিম সমাজে ব্যাখ্যা[সম্পাদনা]

আদি ইসলাম[সম্পাদনা]

শয়তানের বাণীর ঘটনাটি ইসলামের প্রথম দুই শতাব্দীতে তাফসীর ও সীরা-মাগহাজী সাহিত্যে বর্ণিত আছে[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

ইবনে তাইমিয়াহর মতে: "প্রাথমিক ইসলামী পণ্ডিতগণ (সালাফ) সম্মিলিতভাবে সারসের আয়াতগুলোতে কোরআনের সাথে সম্পৃক্ত হিসেবে মেনে নিতেন। পরবর্তী আগত আলেমদের (খালাফ) থেকে যারা প্রথম পণ্ডিতদের মতামত অনুসরণ করেছিল, তারা বলে যে এই ঐতিহ্যগুলোকে খাঁটি বর্ণনার সাথে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং এগুলি অস্বীকার করা অসম্ভব এবং কোরআন নিজেই এর সাক্ষ্য দিচ্ছে। " [১১]

মুহাম্মদের সবচেয়ে প্রথম জীবনী, ইবনে ইসহাক (– ৭৬১-৭৬৭) হারিয়ে গেলেও তার সংগ্রহকৃত তথ্যাবলি মূলতঃ দুই উৎসে টিকে আছে। ইবনে হিশাম (৮৩৩) এবং আল-তাবারি (৯১৫)। শয়তানের বাণী প্রবর্তনের এই ঘটনাটি আল-তাবারিতে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ইবনে ইসহাক থেকে এই তথ্য সঙ্গিগ্রহ করেন। তবে ইবনে হিশামে এই ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয় না। অবশ্য তিনি স্বীকার করেন, এই ঘটনা "কিছু মানুষকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলতে পারে" বলেই এরূপ করা হয়েছে। [১২] মুহাম্মদের প্রথম দিককার জীবনী রচয়িতা ইবনে সাদআল-ওয়াকিদীও ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। [১৩] উরি রুবিন, শাহাব আহমেদ এবং গিলিয়ামের মতো পণ্ডিতদের ধারণা ছিল যে এই প্রতিবেদনটি ইবনে ইসহাক থেকেই এসেছে। যদিও আলফোর্ড টি। ওয়েলশ এর ধারণা খব সম্ভবত ইবনে ইসহাকে এই রকম কিছুর বর্ণনা ছিলো না। [১৪]

মধ্যযুগীয় সময়কাল[সম্পাদনা]

প্রকৃত সূত্রের উপস্থিতির অভাবে শয়তানের বাণীর ঘটনাটি কোন হাদীসে সংকলিত হয় নি। (যদিও ঘটনার সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত সংস্করণগুলো উপলব্ধ্য) এই শয়তানের বাণী সম্পর্কিত তথ্যসূত্র ও সমালোচনা সম্পর্কে প্রাথমিক ইতিহাসে প্রদর্শিত হয়েছে। [১৫][১৬][১৭] তাবারির তাফসীর ছাড়াও, মুকাতিলে তাফসীর, আব্দুর র-রাজ্জাক ও ইবনে কাসীর সেইসাথে আবু জাফরের নাসখে এই বাণী সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। ওয়াহিদির asbāb এমনকি মধ্য যুগের শেষের দিকে সুউতির সংকলন আল দুর আল মান্থুর ফিল তাফসীর বিল মাথুর এপ্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

ঐতিহাসিকতার বিতর্ক[সম্পাদনা]

উইলিয়াম ম্যুরের পর প্রাচ্যের বিশেষজ্ঞরা এই ঘটনার ঐতিহাসিকতা মেনে নিয়েছিলেন। [৫] যদিও কিছু প্রাচ্যের বিশেষজ্ঞ অবশ্য বিভিন্ন ভিত্তিতে এই বাণীগুলির ঐতিহাসিক সত্যতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করেছিলেন। [১৮]

উইলিয়াম মন্টগোমেরি ওয়াট এবং আলফ্রেড গিলোয়াম দাবি করেছেন যে মুসলমানরা তাদের নবীর ব্যাপারে ঋণাত্মক বার্তা ছড়ায় এমন এক গল্প বর্ণনা করছে যেহেতু, নিঃসন্দেহে ঘটনাটি সত্য ছিল: "মুহাম্মদ অবশ্যই কুরআনের অংশ হিসাবে প্রকাশ্যে শয়তানী আয়াত তেলাওয়াত করেছেন; এটি কল্পনাও করা যায় না কাহিনীটি মুসলমানরা বানিয়ে বানিয়ে বলছে, বা অমুসলিমরা এরকম কোনো মিথ্যে গল্প মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে।" [৪] ট্রুড এহলার্ট, ইসলামের এনসাইক্লোপিডিয়াতে ওয়াটের কারণকে অপর্যাপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন "কাহিনীটির বর্তমান রূপে (আল-আবারা, আল-ওয়াইদা ও ইবনে সাদ বর্ণিত) বিভিন্ন কারণে ঐতিহাসিক হিসাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না "। [১৯]

ফ্রেড হলিডের মতে, এই ঘটনা ধর্মীয়ভাবে ক্ষতিকারক নয় বরং একটি সাবধানতার দীক্ষা দেয়। "এর মাধ্যমে ঈশ্বরকে অবজ্ঞা করা নয়, মানুষের মনুষ্যত্বকে চিহ্নিত করা যায়, "এবং এমনকি একজন নবীও শয়তান দ্বারা বিভ্রান্ত হতে পারে - যদিও শেষ পর্যন্ত এখানে শয়তান ব্যর্থ হয়েছে। [২০]

আরো দেখুন[সম্পাদনা]

পাদটীকা[সম্পাদনা]

  1. Ahmed, Shahab (১৯৯৮)। "Ibn Taymiyyah and the Satanic Verses"। Maisonneuve & Larose: 67–124। জেস্টোর 1595926ডিওআই:10.2307/1595926 
  2. Ibn Ishaq, Muhammad (১৯৫৫)। Ibn Ishaq's Sirat Rasul Allah - The Life of Muhammad Translated by A. Guillaume.। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 165। আইএসবিএন 9780196360331। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  3. John L. Esposito (২০০৩)। The Oxford dictionary of Islam। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 563। আইএসবিএন 978-0-19-512558-0। ১১ জুন ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  4. Watt, Muhammad at Mecca
  5. EoQ, Satanic Verses. For scholars that accept the historicity, see
  6. Shirazi, Naser Makarem (৪ নভেম্বর ২০১৩)। "180 Questions Enquiries About Islam Volume Two: Various issues"Al-Islam (ইংরেজি ভাষায়)। Compiled by Sayyid Husain Husaini। The Islamic Education Board of the World Federation of Khoja Shia Ithna-Asheri Muslim Communities। 43. What is the Myth of Gharaniq or ‘The Satanic Verses’?। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ 
  7. Saalih al-Munajjid, Muhammad (৩১ মে ২০০০)। "4135: "Satanic verses""Islam Question and Answer। সংগ্রহের তারিখ ৯ জুলাই ২০১৮ 
  8. (Q.53)
  9. Militarev, Alexander; Kogan, Leonid (২০০৫), Semitic Etymological Dictionary 2: Animal Names, Alter Orient und Altes Testament, 278/2, Münster: Ugarit-Verlag, পৃষ্ঠা 131–132, আইএসবিএন 3-934628-57-5 
  10. "The "Satanic Verses" | Common Errors in English Usage and More | Washington State University" 
  11. Ibn Taymiyyah। Majmu' al-Fatawa। ১৩ জুন ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ জুলাই ২০২০ 
  12. Holland, Tom (২০১২)। In the Shadow of the Sword। Doubleday। পৃষ্ঠা 42। আইএসবিএন 9780385531368 
  13. Tabari's works are often filled with weak and fabricated narrations as he stated in his introduction to his tareekh that he had collected every account that he came across without considering any verification. Most of the later narrations of the 'satanic verses' incident stem from the works of Tabari.↵↵Rubin, Uri (১৪ আগস্ট ২০০৮), "Muḥammad", Dammen McAuliffe, Jane, Encyclopaedia of the Qurʾān, Georgetown University, Washington DC: Brill [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  14. Rubin, Uri (1997), The eye of the beholder: the life of Muḥammad as viewed by the early Muslims: a textual analysis, Princeton, NJ: Darwin Press (published 1995), p. 161, ISBN 0-87850-110-X
  15. ibn Isḥāq ibn Yasār, Muḥammad; Ibn Hishām, ʻAbd al-Malik, Sīrat Rasūl Allāh
  16. Ṭabarī, Ṭabarī, Tārīkh ar-Rusul wal-Mulūk 
  17. Ṭabarānī, Sulaymān ibn Aḥmad, al-Mu'jam al-Kabīr
  18. EoQ, Satanic Verses. For scholars that do not accept the historicity, see
  19. "Muḥammad." Encyclopaedia of Islam, Second Edition. Edited by: P. Bearman, Th. Bianquis, C.E. Bosworth, E. van Donzel, W.P. Heinrichs. Brill Online, 2014. Reference.
  20. Halliday, Fred, 100 Myths about the Middle East,

উৎস[সম্পাদনা]

  • Fazlur Rahman (1994), Major Themes in the Qur'an, Biblioteca Islamica, ISBN 0-88297-051-8
  • John Burton (1970), "Those Are the High-Flying Cranes", Journal of Semitic Studies, 15 (2): 246–264, doi:10.1093/jss/15.2.246.
  • Uri Rubin (1995), The Eye of the Beholder: The Life of Muhammad as Viewed by the Early Muslims: A Textual Analysis, The Darwin Press, Inc., ISBN 0-87850-110-X
  • G. R. Hawting (1999), The Idea of Idolatry and the Emergence of Islam: From Polemic to History, Cambridge University Press, ISBN 0-521-65165-4
  • Nāsir al-Dīn al-Albānī (1952), Nasb al-majānīq li-nasfi qissat al-gharānīq (The Erection of Catapults for the Destruction of the Story of the Gharānīq)
  • Shahab Ahmed (2018), Before Orthodoxy: The Satanic Verses in early Islam, Harvard University Press, ISBN 978-0-674-04742-6

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

মন্তব্যকারীদের[সম্পাদনা]