বিষয়বস্তুতে চলুন

লিসা দেল জোকোন্দো

এটি একটি ভালো নিবন্ধ। আরও তথ্যের জন্য এখানে ক্লিক করুন।
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
লিসা দেল জোকোন্দো
বিশদে লিসার মুখ দেখানো চিত্রকর্ম
মোনা লিসা (১৫০৩–১৫০৬) চিত্রকর্ম
লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা ছবিটি বর্তমান লুভ্‌র জাদুঘরে রয়েছে।
জন্ম
লিসা দি আন্তনমারিয়া গেরার্দিনি

১৫ জুন, ১৪৭৯
মৃত্যু১৫ জুলাই, ১৫৪২ (৬৩ বছর)
সেন্ট ওরসোলার কনভেন্ট, ফ্লোরেন্সের ডাচি
পরিচিতির কারণমোনা লিসা চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু
দাম্পত্য সঙ্গীফ্রান্সেসকো দি বার্তোলোমিও দি জানোবি দেল জোকোন্দো (বি. ১৪৯৫)
সন্তান
পিতা-মাতা
  • আন্তনমারিয়া দি নলদো গেরার্দিনি (পিতা)
  • লুক্রেজিয়া দেল কাচ্চা (মাতা)

লিসা দেল জোকোন্দো (ইতালীয় উচ্চারণ: [ˈliːza del dʒoˈkondo]; বংশনাম: গেরার্দিনি [ɡerarˈdiːni]; ১৫ জুন ১৪৭৯ – ১৫ জুলাই ১৫৪২) ছিলেন একজন ইতালীয় সম্ভ্রান্ত নারী। তিনি ফ্লোরেন্সতোসকানার গেরার্দিনি পরিবারের সদস্য ছিলেন। ইতালীয় রেনেসাঁর সময়ে তার স্বামী ফ্রান্সেসকোর উদ্যোগে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তার প্রতিকৃতি হিসেবে জগদ্‌বিখ্যাত মোনা লিসা চিত্রকর্মটি এঁকেছিলেন বলে বিবেচনা করা হয়।

লিসার জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তিনি ফ্লোরেন্সে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কৈশোরে একজন কাপড় ও রেশম ব্যবসায়ী এবং জুতা প্রস্তুতকারক ফ্রান্সেসকো দেল জোকোন্দোর সাথে তার বিয়ে হয়। পরবর্তীতে তার স্বামী স্থানীয় কর্মকর্তা হয়েছিলেন। লিসা পাঁচ সন্তানের জননী ছিলেন। তার পারিবারিক জীবন সুখী-সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবন ছিল বলে মনে করা হয়। লিসা তার স্বামীর চেয়ে বেশিদিন বেঁচে ছিলেন।

লিসার মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পরেও তার প্রতিকৃতি হিসেবে আঁকা মোনা লিসা বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্ম।[] ২০০৫ সালে লিসা দেল জোকোন্দো নিশ্চিতভাবে মোনা লিসার মডেল হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিলেন।[]

প্রারম্ভিক জীবন এবং পরিবার

[সম্পাদনা]

লিসার ফ্লোরেন্সীয় পরিবার বেশ পুরানো ও অভিজাত ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারা তাদের প্রভাব হারায়।[] সেসময় তারা অভিজাত হলেও খুব বেশি ধনী ছিল না। ফ্লোরেন্স ছিল তৎকালীন ইউরোপের বৃহত্তম শহরগুলোরর মধ্যে একটি। এই পরিবার সেখানে খামারের আয়ের উপর নির্ভর করে বসবাস করত। ফ্লোরেন্স তখন অর্থনৈতিকভাবে বেশ সফল হলেও, ফ্লোরেন্সের বাসিন্দাদের মধ্যে সেসময় সম্পদের বৈষম্য ছিল যথেষ্ট বেশি।[]

লিসার বাবা আন্তনমারিয়া দি নলদো গেরার্দিনি এমন একটি পরিবার থেকে এসেছেন, যারা পূর্বে পোজ্জোর সান দোনাতোর কাছে থাকা ভূ-সম্পত্তিতে বসবাস করলেও পরবর্তীতে শহরে চলে এসেছিল।[]

আন্তনমারিয়ার দুই স্ত্রী সন্তান প্রসবের সময় মারা যান।[] তাদের মধ্যে লিসা দি জোভান্নি ফিলিপ্পো দে'কার্দুচ্চিকে ১৪৬৫ সালে এবং কাতেরিনা দি মারিওত্তো রুসেল্লাইকে তিনি ১৪৭৩ সালে বিয়ে করেছিলেন। অন্যদিকে লিসার মা ছিলেন পিরা স্পিনেল্লির কন্যা এবং আন্তনমারিয়া গেরার্দিনির তৃতীয় স্ত্রী লুক্রেজিয়া দেল কাচ্চা।[] ১৪৭৬ সালে তাদের বিয়ে হয়। লিসার বাবা আন্তনমারিয়া একসময় কিয়ান্তিতে কয়েকটি খামারের মালিক ছিলেন। পাশাপাশি তিনি আরও কয়েকটি খামার ভাড়া নিয়েছিলেন। মোট ছয়টি খামারে তিনি গম, মদ ও জলপাই তেল উৎপাদন এবং গবাদি পশু লালনপালন করতেন।[]

লিসা ১৪৭৯ সালের ১৫ জুনে ফ্লোরেন্সের ভিয়া মাজ্জোতে জন্মগ্রহণ করেন।[] যদিও বহু বছর ধরে মনে করা হতো, তিনি গ্রেভের বাইরে ভিল্লা ভিনিয়ামাজ্জোতে তার জন্ম হয়েছিল। ভিল্লা ভিনিয়ামাজ্জো ছিল তার পরিবারের বেশকয়েকটি গ্রামীণ ভূ-সম্পত্তির মধ্যে একটি।[] তার দাদীর নামানুসারে তার নাম লিসা রাখা হয়েছিল।[] পিতামাতার সাত সন্তানের মধ্যে লিসা ছিল সবার বড়। তার তিন বোনের একজনের নাম ছিল জিনেভরা এবং তিন ভাই জোভান গুয়ালবের্তো, ফ্রান্সেসকো ও নলদো।[১০]

তার পরিবারের সকলেই ফ্লোরেন্সে বসবাস করত। প্রথমদিকে তারা মূলত সান্তা ত্রিনিতার কাছে নিজস্ব বাড়িতে বসবাস করলেও পরবর্তীতে সম্ভবত বাড়িটি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হওয়ার পর তা মেরামত করতে না পারায় সান্তো স্পিরিতোর কাছে ভাড়া করা বাড়িতে থাকতে শুরু করে। তারপর লিসার পরিবার প্রথমে বর্তমানের ভায়া দে পেপি এবং পরে সান্তা ক্রোচের কাছে বসবাস শুরু করে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির পিতা সের পিয়েরো দা ভিঞ্চির তাদের কাছাকাছিই থাকতেন।[১১] শহর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার (২০ মা) দক্ষিণে পোজ্জো গ্রামের সান্তা দোনাতোতে লিসার পরিবারের একটি বাড়ি ছিল।[১২] লিসার দাদা নলদো কিয়ান্তিতে সান্তা মারিয়া নুওভা হাসপাতালে একটি খামার উইল করেছিলেন। গেরার্দিনি হাসপাতালের অন্য একটি খামারের ইজারা পান এবং তাতে তিনি গম কাটার তত্ত্বাবধান করতেন। সেখানে তার পরিবার কা'দি পেসা নামক বাড়িতে গ্রীষ্মকাল কাটাত।[১৩]

বিয়ে এবং পরবর্তী জীবন

[সম্পাদনা]

১৪৯৫ সালের ৫ই মার্চে ১৬ বছর বয়সী লিসা ফ্লোরেন্সেরই কাপড়রেশম ব্যবসায়ী ফ্রান্সেসকো দেল জোকোন্দোর তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। লিসার বিয়ের যৌতুক ছিল ১৭০ ফ্লোরিন (তৎকালীন ফ্লোরেন্স প্রজাতন্ত্রের মুদ্রা) ও তার পারিবারিক বাড়ির নিকটের সান সিলভেস্ত্রো খামার।[১৪] খামারটি পোজ্জোর কাস্তেল্লিনা ও সান দোনাতোর মধ্যে অবস্থিত ছিল। এর নিকটবর্তী দুটি খামার পরে মাইকেলেঞ্জেলোর মালিকানাধীন হয়।[১১] তৎকালীন প্রেক্ষাপটে যৌতুকের এই পরিমাণ থেকে ধারণা করা হয়, গেরার্দিনি পরিবার সেসময়ে ধনী ছিল না এবং লিসা ও তার স্বামী একে অপরকে ভালবাসতেন। এই দম্পতি মধ্যবিত্ত-জীবনযাপন করেছিলেন। লিসার বিয়ে সম্ভবত তার সামাজিক মর্যাদা বাড়িয়ে তুলেছিল, কারণ তার স্বামীর পরিবার তার পরিবারের চেয়ে ধনী ছিল বলে ধারণা করা হয়।[১৪] অন্যদিকে এই বিয়ের মাধ্যমে ফ্রান্সেসকোও লাভবান হয়েছে বলে মনে করা হয়। কারণ, গেরার্দিনি একটি পুরানো ও অভিজাত পরিবার।[১৫] ১৫০৩ সালের ৫ মার্চের আগ পর্যন্ত তারা অন্যের সাথে ভাগাভাগি করা বাড়িতে বসবাস করত। এরপর ফ্রান্সেসকো ভায়া ডেলা স্তুফায় তার পরিবারের পুরানো বাড়ির পাশে একটি বাড়ি কিনতে সক্ষম হয়। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি সেবছরই লিসার প্রতিকৃতি আঁকা শুরু করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।[১৬][১৭]

লিসা-ফ্রান্সেস্কো দম্পতির পাঁচজন সন্তান ছিল। তারা হলো: পিয়েরো, পিয়েরা, কামিল্লা, মারিয়েত্তা ও আন্দ্রেয়া। তারা সবাই ১৪৯৬ থেকে ১৫০২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে।[১৮] ১৪৯৯ সালে লিসার আরেকটি একটি শিশু-কন্যা মারা যায়।[১২] এছাড়াও লিসা ফ্রান্সেস্কো ও তার প্রথম স্ত্রী কামিল্লা দি মারিওত্তো রুসেল্লাইয়ের ছেলে বার্তোলোমিওকেও বড় করেছিলেন। বার্তোলোমির জন্মের কিছুক্ষণ পরেই কামিল্লা মারা গিয়েছিলেন। কামিল্লা দি মারিওত্তো রুসেল্লাই ছিলেন লিসার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী কাতেরিনা দি মারিওত্তো রুসেল্লাইয়ের আপন বোন।[১৭] এই কামিল্লার নামানুসারেই লিসা ও ফ্রান্সেস্কো তাদের একটি মেয়ের নাম কামিল্লা রেখেছিলেন।

লিসার দুই মেয়ে কামিল্লা ও মারিয়েত্তা ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী হয়েছিলেন। সুওর বেয়াত্রিচে নাম গ্রহণ করে কামিল্লা সান ডোমেনিকো দি কাফাজ্জোর কনভেন্টে প্রবেশ করেছিলেন। সেখানে তাকে আন্তোনমারিয়ার বোন সুওর আলিবিয়েরা, লিসার বোন সুওর কামিল্লা এবং সুওর আলেসান্দ্রার তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত করা হয়। কনভেন্টে সুওর কামিল্লা চারজন পুরুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি, তাদের সাথে দেখা করা এবং চার্চের দৃষ্টিকোণে কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়ার কারণে তাকে কনভেন্ট থেকে খালাস দেওয়া হয়েছিল।[১৯] কামিল্লা তথা বেয়াত্রিচে ১৮ বছর বয়সে মারা যান।[১৯] তাকে বাসিলিকা দি সান্তা মারিয়া নভেল্লাতে সমাহিত করা হয়।[২০] লিসা ফ্লোরেন্সে উচ্চ-সম্মানে অধিষ্ঠিত একটি কনভেন্ট সান্ত'ওরসোলার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৫২১ সালে সেখানে তিনি মারিয়েত্তাকে রাখতে করতে সক্ষম হন। মারিয়েত্তা সেখানে সুওর লুদোভিকা নাম গ্রহণ করে কিছু দায়িত্বপূর্ণ পদাধিকারী হিসেবে কনভেন্টের সম্মানিত সদস্য হয়েছিলেন।[২১]

লিসার স্বামী ফ্রান্সেসকো একসময় ফ্লোরেন্সে একজন কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ১৪৯৯ সালে দোদিসি বুওনোমিনি এবং ১৫১২ সালে সিনোরিয়া নির্বাচিত হন। পরবর্তিতে ১৫২৪ সালে তিনি প্রিওরি হিসাবে নিশ্চিত হন। মেদিচি পরিবারের রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক স্বার্থের সাথে তার সম্পর্ক থাকতে পারে। ১৫১২ সালে ফ্লোরেন্স সরকার নির্বাসন থেকে মেদিচিদের প্রত্যাবর্তনের আশঙ্কা করার সময়ে ফ্রান্সেস্কোকে বন্দি করার পাশাপাশি ১,০০০ ফ্লোরিন জরিমানা করা হয়েছিল। মেদিচিরা ফিরে এলে সেপ্টেম্বরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।[২০][২২]

১৫৩৭ সালের জুন মাসে ফ্রান্সেসকো অনেক বন্দোবস্তের মধ্যে তার উইলে লিসার কাছ থেকে নেওয়া যৌতুক তাকে ফিরিয়ে দেয়। এছাড়াও উইলে তাকে ভবিষ্যতের জন্য ব্যক্তিগত পোশাক ও গহনা সরবরাহ করার অঙ্গিকার করা হয়। উইলে তাদের মেয়ে লুদোভিকার কাছে লিসার দেখভালের দ্বায়িত্ব অর্পণ করা হয়। তবে কোনও কারণে সে অক্ষম হলে এই দ্বায়িত্ব তার পুত্র বার্তোলোমিও উপর বর্তানো হয়। ফ্রান্সেসকো লিখেছিলেন, "প্রিয়তমা স্ত্রী মোনা লিসার প্রতি উইলকারীর স্নেহ ও ভালবাসার প্রেক্ষিতে; লিসা সর্বদা একটি মহৎ আত্মা এবং একজন বিশ্বস্ত স্ত্রী হিসাবে কাজ করেছেন বিবেচনা করে; আশা করি, তার যা যা প্রয়োজন তার সবই সে পাবে..."।[২৩]

মৃত্যু

[সম্পাদনা]

একটি বিবরণ অনুযায়ী লিসার স্বামী ফ্রান্সেসকো ১৫৩৮ সালের প্লেগে মারা যান। সেসময়র লিসাও অসুস্থ হয়ে পড়লে তার মেয়ে লুদোভিকা তাকে সান্ট'ওরসোলার কনভেন্টে নিয়ে যান। সেখানে তিনি ১৫৪২ সালের ১৫ জুলাইয়ে ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[২৪][২৫][২৬] ফ্রান্সেসকো ও লিসার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে পণ্ডিতদের অপর একটি বিবরণে, মৃত্যুর সময় ফ্রান্সেসকো প্রায় ৮০ বছর বয়সী ছিলেন। অন্যদিকে লিসা কমপক্ষে ১৫৫১ সাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেন। সেই হিসেবে তখন তার বয়স ছিল ৭১ বা ৭২।[১২]

মোনা লিসা

[সম্পাদনা]
সম্পূর্ণ মোনা লিসা চিত্রকর্ম (ইংরেজি: Mona Lisa, ইতালীয়: La Gioconda, লা জোকোন্দা; ফরাসি: La Joconde)। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা ছবিটি এখন লুভ্‌র জাদুঘরে রয়েছে।

তাদের আর্থিক অবস্থার কারণে ফ্লোরেন্সের অন্যান্য অধিবাসীদের মতোই ফ্রান্সেসকোর পরিবারের সদস্যরা শিল্প-প্রেমী এবং শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার ছেলে বার্তোলোমিও আন্তোনিও দি দন্নিনো মাৎসিয়েরিকে ফ্লোরেন্সের সান্তিসিমা আনুনসিয়াতার ব্যাসিলিকায় থাকা পারিবারিক সমাধিস্থলে একটি ফ্রেস্কো আঁকতে বলেছিলেন। আন্দ্রেয়া দেল সার্তো তার পরিবারের অন্য একজন সদস্যের জন্য একটি ম্যাডোনা এঁকেছিলেন।[২০] ফ্রান্সিসকো লিওনার্দোকে তার স্ত্রীর প্রতিকৃতির জন্য এবং আরেক শিল্পী ডোমেনিকো পুলিগোকে আসিসির সন্ত ফ্রান্সিসের একটি চিত্রকর্ম আঁকার জন্য ফরমাশ দিয়েছিলেন। তিনি আন্দ্রেয়ার জন্ম এবং পরিবারের বাড়ি কেনা, উভয় উদ্‌যাপনের উপলক্ষ্যে লিসার প্রতিকৃতিটি আঁকানোর ফরমায়েশ করেছিলেন বলে মনে করা হয়।[১৭]

মোনা লিসা চিত্রকর্মটি ১৫ শতক ও ১৬ শতকের প্রথম দিকের একজন গুণী নারীর চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করেছিল। লিসাকে তার অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে একজন বিশ্বস্ত স্ত্রী হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। কারণ, ছবিটিতে তার তার ডান হাতটি বাম হাতের উপরে রাখা অবস্থায় আঁকা হয়েছে। লিওনার্দো লিসাকে সম্ভবত তার বাস্তব অবস্থার চেয়ে বেশি সচ্ছল দেখিয়ে ফ্যাশনেবল ও সফল হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন। তার গাঢ় রঙের পোশাক ও কালো ওড়না ছিল স্প্যানিশ-প্রভাবিত উচ্চ ফ্যাশন। এগুলি তার প্রথম কন্যার জন্য শোকের চিত্র হতে পারে না, যেমনটি কিছু পণ্ডিত ধারণা করেছেন। তার এই প্রতিকৃতি আকর্ষণীয়ভাবে বড়। এর আকার সেই সময়ের ধনী শিল্প পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা অর্জিত কমিশনের সমান। এই বাড়াবাড়িকে ফ্রান্সেস্কো ও লিসার সামাজিক আকাঙ্ক্ষার চিহ্ন হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।[২৭]

১৫০৩ সালের বসন্তের সময়, লিওনার্দোর কোনও আয়ের উৎস ছিল না। এই তথ্যটি একটি ব্যক্তিগত প্রতিকৃতি তৈরিতে তার আগ্রহের কারণকে আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।[২২][২৮] কিন্তু সেই বছরের পরে তাকে সম্ভবত মোনা লিসা-র কাজ বিলম্বিত করতে হয়েছিল। কারণ, তখন তিনি বাত্তালিয়া দি আঙ্গিয়ারি (আঙ্গিয়ারির যুদ্ধ) নামক চিত্রকর্মটি শুরু করার জন্য অর্থ গ্রহণ করেছিলেন। সেটি ছিল আরও মূল্যবান কমিশন। তিনি ১৫০৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই চিত্রকর্মটি সম্পন্ন করার জন্য ফরমায়েশদাতার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন।[২৯] ১৫০৬ সালে লিওনার্দো লিসার প্রতিকৃতিটিকে অসমাপ্ত বলে মনে করেছিলেন।[৩০] তাই সেসময় তাকে এই কাজের জন্য অর্থ প্রদান করা হয়নি এবং তিনিও ফরমায়েশদাতার কাছে চিত্রকর্মটি পৌঁছে দেননি।[৩১] ধারণা করা হয়, অনেক বছর পর ফ্রান্সে[১৫] তিনি ১৫১৬ সালের মধ্যে মোনা লিসা-কাজ সম্পন্ন করতে পারেন।[৩২]

চিত্রকর্মটির নাম ১৫৫০ সালে নির্ধারণ করা হয়। ফ্রান্সেস্কোর পরিবারের অন্তত কয়েকজনের পরিচিত একজন[১২] জর্জো ভাসারি লিখেছেন, "লিওনার্দো ফ্রান্সিসকো দেল জোকোন্দোর জন্য তার স্ত্রী মোনা লিসার প্রতিকৃতি আঁকার কাজ হাতে নিয়েছিলেন"[৩০] (ইতালীয়: Prese Lionardo a fare per Francesco del Giocondo il ritratto di mona Lisa sua moglie.)[৩৩] প্রতিকৃতিটির ইতালীয় নাম লা জোকোন্দা তার বৈবাহিক নামের মেয়েলি রূপ। ফরাসি ভাষায় এটি লা জোকোন্দের বৈকল্পিক দ্বারা পরিচিত। এটি লিসার বিবাহিত নাম থেকে আসলেও এর একটি অতিরিক্ত তাৎপর্য রয়েছে। নামটি লাতিন ও ইতালীয় jocund (অর্থ: খুশি, আনন্দিত বা সুখি কেউ) শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।[১৫]

কমপক্ষে চারটি ভিন্ন চিত্রকর্ম ও দশজন ভিন্ন ব্যক্তির কাছে লিসার পরিচয় যুক্ত করার বিষয়টি অনুমান করা হয়।[৩৪][৩৫] ২০ শতকের শেষের দিকে চিত্রকর্মটি একটি বিশ্বব্যাপী আইকনে পরিণত হয়। সেসময় ৩০০ টিরও বেশি অন্যান্য চিত্রকর্ম ও ২,০০০ টির বেশি বিজ্ঞাপনচিত্রে এটি ব্যবহৃত হয়েছিল। প্রতি সপ্তাহে গড়ে একটি করে মোনা লিসা সংবলিত নতুন বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হতো।[৩৬]

Vespucci's notation on an old manuscript
আগোস্তিনো ভেসপুচ্চির মার্জিন নোট

২০০৫ সালে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারের একজন বিশেষজ্ঞ পাঠাগারের সংগ্রহে থাকা একটি মার্জিন নোট খুঁজে পান। এটি নিশ্চিতভাবে মোনা লিসার মডেল লিসা হওয়ার ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করে। ১৫০৩ সালে আগোস্তিনো ভেসপুচ্চি রচিত এই নোটে বলা হয়েছে, লিওনার্দো লিসা দেল জোকোন্দোর একটি প্রতিকৃতিতে কাজ করছিলেন।[] ষোড়শ শতাব্দীতে মোনা লিসা চিত্রকর্মটিকে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস অধিগ্রহণ করার পর থেকে এটি ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে এটি ফ্রান্স প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তি।[৩৭] বর্তমানে এটি একটি ফরাসি জাতীয় সংগ্রহের অংশ। প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্যারিসের ল্যুভর জাদুঘরে এই চিত্রকর্মটি দেখতে যায়।[৩৮]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. রাইডিং, অ্যালান (৬ এপ্রিল ২০০৫)। "In Louvre, New Room With View of 'Mona Lisa'"দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০০৭ 
  2. "Mona Lisa – Heidelberg discovery confirms identity)"। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার। ৮ মে ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০০৮ 
  3. পাল্লান্তি ২০০৬, পৃষ্ঠা: ৫৮
  4. পাল্লান্তি ২০০৬, পৃষ্ঠা: ১৭, ২৩, ২৪
  5. Kemp, Martin (২০১৭)। Mona Lisa: The People and the Painting। পৃষ্ঠা 10 
  6. পাল্লান্তি ২০০৬, পৃষ্ঠা: ৩৭
  7. পাল্লান্তি ২০০৬, পৃষ্ঠা: ৪১–৪৪
  8. "History of Vignamaggio"। Villa Vignamaggio। ১২ মে ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ এপ্রিল ২০০৮ 
  9. পাল্লান্তি ২০০৬, পৃষ্ঠা: ৪০
  10. পাল্লান্তি ২০০৬, পৃষ্ঠা: ৪৪
  11. পাল্লান্তি ২০০৬, পৃষ্ঠা: ৪৫–৪৬
  12. সোলনার ১৯৯৩, পৃষ্ঠা: ৪
  13. পাল্লান্তি ২০০৬, পৃষ্ঠা: ৪১–৪৪
  14. সোলনার ১৯৯৩, পৃষ্ঠা: ৫
  15. Kemp, Martin (২০০৬)। Leonardo Da Vinci: The Marvellous Works of Nature And Man। পৃষ্ঠা 261–262। আইএসবিএন 0-19-280725-0। সংগ্রহের তারিখ ৫ অক্টোবর ২০০৭ 
  16. "Portrait of Lisa Gherardini, wife of Francesco del Giocondo"। সংগ্রহের তারিখ ৪ অক্টোবর ২০০৭ 
  17. সোলনার ১৯৯৩, পৃষ্ঠা: ৯
  18. জনস্টন ব্রুস (১ জানুয়ারি ২০০৪)। "Riddle of Mona Lisa is finally solved: she was the mother of five"Telegraph.co.ukটেলিগ্রাফ মিডিয়া গ্রুপ। এপ্রিল ২৭, ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ অক্টোবর ২০০৭ 
  19. পাল্লান্তি ২০০৬, পৃষ্ঠা: ৬১–৬২
  20. মুন্টজ ১৮৯৮, পৃষ্ঠা: ১৫৪
  21. পাল্লান্তি ২০০৬, পৃষ্ঠা: ৬৩
  22. Masters, Roger D. (জুন ১৫, ১৯৯৮)। Fortune is a River: Leonardo da Vinci and Niccolò Machiavelli's Magnificent Dream of Changing the Course of Florentine History (online notes for Chapter 6)। Free Press via Dartmouth College (dartmouth.edu)। আইএসবিএন 0-684-84452-4। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  23. পাল্লান্তি ২০০৬, পৃষ্ঠা: ১০৫
  24. Lorenzi, Rossella (১৯ জানুয়ারি ২০০৭)। "Mona Lisa Grave Found, Claims Scholar"ডিসকভারি চ্যানেল সংবাদ। ডিসকভারি কমিউনিকেশনস। ২৬ নভেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ অক্টোবর ২০০৭ 
  25. Lorenzi, Rossella (২ মে ২০০৭)। "Mona Lisa's Identity Revealed?"ডিসকভারি চ্যানেল সংবাদ। ডিসকভারি কমিউনিকেশনস। ৮ অক্টোবর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ অক্টোবর ২০০৭ 
  26. Squires, Nick (২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। "Who was Mona Lisa? Burial breakthrough may solve identity mystery behind Da Vinci masterpiece"দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ। জানুয়ারি ১২, ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  27. সোলনার ১৯৯৩, পৃষ্ঠা: ১২
  28. সোলনার ১৯৯৩, পৃষ্ঠা: ৭
  29. মুন্টজ ১৮৯৮, পৃষ্ঠা: ১৩৬
  30. Clark, Kenneth (মার্চ ১৯৭৩)। "Mona Lisa": 144–151। আইএসএসএন 0007-6287জেস্টোর 877242 , quoting a translation of Vasari
  31. সোলনার ১৯৯৩, পৃষ্ঠা: ৬
  32. "Mona Lisa 1503–16"। ইউনিভার্সিটি অফ দ্য আর্টস, লন্ডন। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০০৭ 
  33. Vasari, Giorgio (১৮৭৯)। Le vite de' più eccellenti pittori, scultori ed architettori। গাইতানো মিলানেসি। জি.সি. সানসোনি। পৃষ্ঠা 39। সংগ্রহের তারিখ ৫ অক্টোবর ২০০৭ 
  34. Stites, Raymond S. (জানুয়ারি ১৯৩৬)। "Mona Lisa--Monna Bella"। College Art Association via JSTOR: 7–10+22–23। জেস্টোর 771197ডিওআই:10.2307/771197  and Littlefield, Walter (১৯১৪)। The Two "Mona Lisas"। পৃষ্ঠা 525। সংগ্রহের তারিখ ৯ অক্টোবর ২০০৭  and Wilson, Colin (২০০০)। The Mammoth Encyclopedia of the Unsolved। পৃষ্ঠা 364–366। আইএসবিএন 0-7867-0793-3 
  35. Debelle, Penelope (২৫ জুন ২০০৪)। "Behind that secret smile"দি এইজ। দি এইজ কোম্পানি। সংগ্রহের তারিখ ৬ অক্টোবর ২০০৭  and জনস্টন ব্রুস (৮ জানুয়ারি ২০০৪)। "Riddle of Mona Lisa is finally solved: she was the mother of five"Telegraph.co.ukটেলিগ্রাফ মিডিয়া গ্রুপ। সংগ্রহের তারিখ ৬ অক্টোবর ২০০৭ , and Nicholl, Charles (review of Mona Lisa: The History of the World's Most Famous Painting by Donald স্যাসুন) (২৮ মার্চ ২০০২)। "The myth of the Mona Lisa"গার্ডিয়ান আনলিমিটেড। London Review of Books via Guardian News and Media। সংগ্রহের তারিখ ৬ অক্টোবর ২০০৭  এবং Chaundy, Bob (২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৬)। "Faces of the Week"বিবিসি নিউজব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন। সংগ্রহের তারিখ ৫ অক্টোবর ২০০৭ 
  36. স্যাসুন ২০০১, সারাংশ এবং পৃষ্ঠা: ১৬
  37. স্যাসুন ২০০১, পৃষ্ঠা: ৮
  38. Chaundy, Bob (সেপ্টেম্বর ২৯, ২০০৬)। "Faces of the Week"বিবিসি নিউজব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ৫, ২০০৭  and Canetti, Claudine (n.d.)। "The world's most famous painting has the Louvre all aflutter"Actualité en France via French Ministry of Foreign and European Affairs (diplomatie.gouv.fr)। জুন ২৯, ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ৮, ২০০৭ 

গ্রন্থপঞ্জি

[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]