লরেন্টজ রূপান্তর

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(লরেঞ্জ রূপান্তর থেকে পুনর্নির্দেশিত)
x-অক্ষ বরাবর ঘূর্ণন-মুক্ত লরেন্টজ রূপান্তর বা লরেন্টজ বুস্ট যেখানে কাঠামোদ্বয়ের আপেক্ষিক বেগ v

পদার্থবিজ্ঞানে স্থান-কাল ব্যবস্থায় লরেন্টজ বা লরেঞ্জ রূপান্তর হল পরস্পরের সাপেক্ষে ধ্রুব বেগে গতিশীল দুটি স্থানাঙ্ক কাঠামো তথা জড় প্রসঙ্গ কাঠামোর একটি থেকে অন্যটিতে ছয় পরামিতিযুক্ত এক প্রকার রৈখিক রূপান্তর। উক্ত বেগের স্থলে এর ঋণাত্মক বেগ বসিয়ে বিপরীত লরেন্টজ রূপান্তরকে পরামিতিকরণ করা যায়। ডাচ পদার্থবিদ হেন্ড্রিক লরেন্টজের নাম অনুসারে এ নামকরণ করা হয়েছে।

বাস্তব ধ্রুবকটি দিয়ে পরামিতিকৃত x-অক্ষ বরাবর সীমাবদ্ধ বেগের লরেন্টজ রূপান্তরটি নিম্নরূপভাবে প্রকাশ করা হয় (এটি এই রূপান্তরের সর্বাধিক প্রচলিত সাধারণ রূপ)[১][২]

এখানে (t, x, y, z) এবং (t′, x′, y′, z′) হচ্ছে একই ঘটনা দুটি ভিন্ন জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে পৃথক পৃথকভাবে পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত স্থানাঙ্ক; যখন প্রাইম() চিহ্নযুক্ত কাঠামোটি অপর কাঠামোর দিকে x-অক্ষ বরাবর v বেগে গতিশীল, c হল আলোর বেগ আর হল লরেন্টজ গুণকc এর তুলনায় v খুবই ক্ষুদ্র হলে প্রাপ্ত লরেন্টজ গুণক ও 1 এর পার্থক্য অতি সামান্যই হয় যা উপেক্ষণীয়। কিন্তু যখন v এর মান c এর কাছাকাছি পৌঁছে তখন ফ্যাক্টরটি সীমাহীন ভাবে বৃদ্ধি পায়। রূপান্তরটিকে অর্থপূর্ণ হতে হলে v এর মান অবশ্যই c এর মান থেকে ছোট হতে হবে।

বেগকে আকারে প্রকাশ করলে রূপান্তর হবে[৩]

প্রসঙ্গ কাঠামোকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: জড় প্রসঙ্গ কাঠামো এবং অজড় প্রসঙ্গ কাঠামো। জড় প্রসঙ্গ কাঠামোগুলো পরস্পরের সাপেক্ষে ধ্রুব বেগে গতিশীল হবে। অজড় প্রসঙ্গ কাঠামোগুলোর আপেক্ষিক গতি অধ্রুব অর্থাৎ ত্বরণ, ঘূর্ণন, বক্র ইত্যাকার হবে এমনকি ধ্রুব কৌণিক বেগে গতিশীল থাকলে সেটাও অজড় প্রসঙ্গ কাঠামোরূপে পরিগণিত হবে। লরেন্টজ রূপান্তর শুধু জড় কাঠামোর রূপান্তরের ক্ষেত্রে, সাধারণত বিশেষ আপেক্ষিকতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

যেকোন প্রসঙ্গ কাঠামোতে একজন পর্যবেক্ষক দৈর্ঘ্য পরিমাপে স্থানীয় স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা (এ ক্ষেত্রে সাধারণত কার্তেসীয় ব্যবস্থা) এবং সময় ব্যবধান নির্ণয়ে একটি ঘড়ি ব্যবহার করতে পারেন। ঘটনা হল এমনই কিছু একটা যা কোন স্থানে একটি বিন্দুতে একটি যুগপৎ মুহূর্তে ঘটে। আরও নিয়মতান্ত্রিকভাবে বলা যায়, ঘটনা ঘটে স্থান-কালের একটি বিন্দুতে। লরেন্টজ রূপান্তর যেকোন কাঠামোয় একজন পর্যবেক্ষকের পরিমাপকৃত একটি ঘটনার কাল ও অবস্থান স্থানাঙ্কের (space and time coordinates) মধ্য সম্পর্ক স্থাপন করে।

নিউটনীয় তথা চিরায়ত বলবিদ্যার গ্যালিলীয় রূপান্তরে স্থান ও কালকে পরম ধরে নেওয়া হয়। লরেন্টজ রূপান্তর গ্যালিলীয় রূপান্তরকে অকার্যকর করে দেয়। যখন আপেক্ষিক বেগ আলোর বেগের তুলনায় অনেক কম থাকে গ্যালিলীয় রূপান্তর শুধু তখনই প্রায় সঠিক হিসাবই প্রদান করে। সাধরণ অনুমান বা স্বতঃলব্ধ জ্ঞানের দ্বারা সহজে উপলব্ধি করা যায় না লরেন্টজ রূপান্তরের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা গ্যালিলীয় রূপান্তরের নেই। যেমন:– লরেন্টজ রূপান্তর এই সত্যের প্রতিফলন ঘটায় যে, পরস্পর থেকে পৃথক পৃথক বেগে গতিশীল একদল পর্যবেক্ষক একটি ঘটনার দূরত্বসময় ব্যবধান ভিন্ন ভিন্ন দেখলেও সকল জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে তারা আলোর বেগ সর্বদা একই পাবে। আলোর বেগের অপ্রভাবিত বা ধ্রুব থাকার এই বৈশিষ্ট্য বিশেষ আপেক্ষিকতার স্বীকার্যগুলোর মধ্য একটি।

ঐতিহাসিকভাবে, প্রসঙ্গ কাঠামো থেকে আলোর বেগ কীভাবে স্বতন্ত্র থাকে লরেন্টজ ও অন্যান্যদের এই পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করার এবং তড়িচ্চুম্বকত্বের সূত্রগুলোর প্রতিসাম্য বোঝার যে প্রচেষ্টা তারই ফল হল এই রূপান্তর। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার সাথে লরেন্টজ রূপান্তরের সাদৃশ্য থাকলেও লরেন্টজ রূপান্তর প্রথমে প্রতিপাদন করা হয়েছিল।

লরেন্টজ রূপান্তর একটি রৈখিক রূপান্তর। লরেন্টজ রূপান্তরে স্থানের ঘূর্ণন অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে; ঘূর্ণন-মুক্ত লরেন্টজ রূপান্তরকে লরেন্টজ বুস্ট বলা হয়। বিশেষ আপেক্ষিকতায় মিনকভস্কি স্থান হল স্থান-কালের একটি গাণিতিক মডেল। লরেন্টজ রূপান্তর মিনকভস্কি স্থানে যেকোন দুটি ঘটনার স্থান-কাল ব্যবধান সংরক্ষণ করে যা লরেন্টজ রূপান্তরের সংজ্ঞা প্রদানকারী ধর্ম। স্থানকালিক ঘটনা তার উৎপত্তি স্থলে যে রূপান্তরের ফলে ঠিক থাকে লরেন্টজ রূপান্তরসমূহ কেবল সেই রূপান্তরগুলোই বর্ণনা করে। এদেরকে মিনকোভস্কি স্থানের অধিবৃত্তিক ঘূর্ণন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। রূপান্তরগুলোর অতি সাধারণ যে সেট সেটিও অনুবাদকে অন্তর্ভুক্ত করে যা পোঁয়াকারে গ্রুপ নামে পরিচিত।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

ওল্ডমার ফুগত, জর্জ ফিটজজেরাল্ড, জোসেফ লার্মার এবং স্বয়ং হেন্ড্রিক লরেন্টজসহ[৪] অনেক পদার্থবিদ ১৮৮৭ সাল থেকেই এই সমীকরণগুলোর মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানকে আলোচনা করে আসছিলেন।[৫] ১৮৮৯ এর শুরুতে অলিভার হেভিসাইড ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো থেকে দেখালেন যে, কোন গোলীয় পৃষ্ঠে একটি আধানের বণ্টিত এবং আলোকবাহী ইথারের সাপেক্ষে ঐ আধানের গতিশীল থাকা অবস্থায় গোলীয় প্রতিসাম্য অর্জন করতে হলে গোলীয় পৃষ্ঠে বণ্টিত থাকা আধানকে ঘিরে যে তড়িৎ ক্ষেত্র তাকে বাতিল করা উচিৎ। ফিটজজেরাল্ড তখন অনুমান করলেন যে, হেভিসাইডের এই বিকৃতির ফল হয়ত আন্তঃআণবিক বলের কোন এক তত্ত্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এর কয়েক মাস পরই, ১৮৮৭ সালে চালানো মাইকেলসন-মর্লির ইথার-বায়ু পরীক্ষণে প্রাপ্ত বিভ্রান্তিকর ফলাফল (ইথারের অনুপস্থিতি ও অন্যান্য) ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গতিশীল থাকা বস্তুসমূহ যে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে ফিটজজেরাল্ড তার এই অনুমান ঘোষণা করলেন। ১৮৯২ সালে, লরেন্টজ এ বিষয়ে তার একই ধারণা আরও বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করলেন যাকে পরবর্তীকালে ফিটজজেরাল্ড-লরেন্টজের সংকোচন অনুকল্প বলা হত।[৬] ১৯০৫ সালের পূর্বে তাদের এই ব্যাখ্যা ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়েছিল।[৭]

লরেন্টজ এবং লার্মার উভয়েই আলোকবাহী ইথারের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোকে ইথার থেকে কোন চলমান কাঠামোয় রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে এগুলো যাতে অপরিবর্তিত (invariant) থেকে যায় এমন এক রূপান্তরের সন্ধানে তারাও চেষ্টা চালাচ্ছিলেন (লরেন্টজ ১৮৯২-১৯০৪ এবং লার্মার ১৮৯৭-১৯০০ সাল পর্যন্ত)। তারা ফিটজজেরাল্ড-লরেন্টজের সংকোচন অনুকল্পের সম্প্রসারণ ঘটালেন এবং লক্ষ্য করলেন যে, সময় স্থানাঙ্কেরও সংশোধন (modify) করতে হচ্ছে ("স্থানীয় সময়" হিসেবে)। চলমান প্রসঙ্গ কাঠামোয় আলোর বেগ ধ্রুব থাকে এটা ধরে নিয়ে অউনরি পোয়াঁকারে স্থানীয় সময়কে ঘড়ির যুগপৎ-ঘটনের (synchronization) ফলাফল হিসেবে একটি ভৌত ব্যাখ্যা দাড় করালেন (আলোর বেগের সাথে সাধারণীকৃত দুটি প্রসঙ্গ কাঠামোর আপেক্ষিক বেগ v/c এর প্রথম ক্রমে)।[৮] তার সমীকরণসমূহের অন্তর্নিহিত কাল দীর্ঘায়ন বিষয়ক অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য প্রথম যিনি অনুধাবণ করেছিলেন সে কৃতিত্ব লার্মারের।[৯]

রূপান্তরটির যে গাণিতিক গ্রুপ ধর্ম রয়েছে সেটা সর্বপ্রথম অউনরি পোয়াঁকারে ১৯০৫ সালে বুঝতে পারেন এবং লরেন্টজের নামানুসারে এর নামকরণ করেন।[১০] পরে একই বছর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাত্ত্বিক ইথারকে নিষ্প্রয়োজনীয় হিসেবে পরিহার করে এবং আপেক্ষিকতার মূলনীতি ও যেকোন জড় প্রসঙ্গ কাঠামোয় আলোর বেগের অপরিবর্তনশীলতার ধারণার ভিত্তিতে লরেন্টজ রূপান্তরকে প্রতিপাদনপূর্বক প্রকাশ করেন যাকে এখন বিশেষ আপেক্ষিকতা বলা হয়।[১১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Srinivasa Rao, K. N. Rao, Rao Srinivasa K N, Srinivasa Rao Koneru, K. N. (১৯৮৮)। The Rotation and Lorentz Groups and Their Representations for Physicists (illustrated সংস্করণ)। John Wiley & Sons। পৃষ্ঠা 213। আইএসবিএন 978-0-470-21044-4  Equation 6-3.24, page 210
  2. Forshaw ও Smith 2009
  3. Cottingham ও Greenwood 2007, পৃ. 21
  4. Lorentz 1904
  5. O'Connor ও Robertson 1996
  6. Brown 2003
  7. Rothman 2006, পৃ. 112f.
  8. Darrigol 2005, পৃ. 1–22
  9. Macrossan 1986, পৃ. 232–34
  10. The reference is within the following paper:Poincaré 1905, পৃ. 1504–1508
  11. Einstein 1905, পৃ. 891–921

ওয়েবসাইট[সম্পাদনা]

  • O'Connor, John J.; Robertson, Edmund F. (১৯৯৬), A History of Special Relativity, ৯ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ২৫ জুলাই ২০২১ 
  • Brown, Harvey R. (২০০৩), Michelson, FitzGerald and Lorentz: the Origins of Relativity Revisited 

পত্রিকা[সম্পাদনা]

গ্রন্থ[সম্পাদনা]