যৌক্তিক ইতিবাদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মরিস শ্লিক (১৮৮২ -১৯৩৬), যৌক্তিক ইতিবাদের জনক

যৌক্তিক ইতিবাদ (ইংরেজি: Logical Positivism) মূলত ভিয়েনা চক্র প্রদত্ত কতগুলো দার্শনিক চিন্তার সামগ্রিক রূপ।[১] ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও বিজ্ঞানের কয়েকজন শিক্ষক এ-চিন্তাধারার বাহক ও ধারক। এ-দর্শন একদিকে যুক্তিধর্মী, অন্যদিকে বিজ্ঞানভাবাপন্ন। এ-দর্শনের দার্শনিকরা ভাষার যৌক্তিক বিশ্লেষণ ও অর্থ পরিষ্করণে আগ্রহী। তারা বিজ্ঞানের বাক্যগুলোকে বিশ্লেষণ, শ্রেণিকরণ এবং সম্পর্ক নির্ণয়নের ব্যবস্থা করেন এবং এজন্য তারা দর্শনকে বিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত করেন।

যৌক্তিক ইতিবাদী দার্শনিক[সম্পাদনা]

যৌক্তিক ইতিবাদ ভিয়েনা চক্রীয় দার্শনিক আন্দোলন হিসেবেও খ্যাত। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষদিক থেকে বিংশ শতাব্দি পর্যন্ত এ-আন্দোলনের ব্যাপ্তিকাল। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন ও বিজ্ঞানে নিয়োজিত কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী যৌক্তিক ইতিবাদী চিন্তার অগ্রনায়ক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরোহী বিজ্ঞানের দর্শনের অধ্যাপক মরিস শ্লিককেই এ-দর্শনের উদ্গাতা বলে অভিহিত করা হয়।[১] তিনি ছাড়া আর যাদের নাম যৌক্তিক ইতিবাদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়: রুডলফ কারণাপ, নিউরাথ, ফাইগল, ভাইজম্যান। এ. জে. এয়ার দর্শনের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ১৯৩৩ সালে এ-চক্রের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন।

যৌক্তিক ইতিবাদের লক্ষ্য[সম্পাদনা]

যৌক্তিক ইতিবাদের প্রধান লক্ষ্য দুটো : ১)তত্ত্ববিদ্যার অসারতা প্রতিপন্ন করা এবং ২) বিজ্ঞানকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করা।[২] এ-দুই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য যে পন্থা অবলম্বন করা হয়, তা হচ্ছে ভাষার যৌক্তিক বিশ্লেষণ। ভাষা বিশ্লেষণের মাধ্যমে অধিবিদ্যা তথা তত্ত্ববিদ্যার অসারতা প্রতিপন্ন করার প্রয়াসকেই নব্য ইতিবাদীবা মৌলিকত্ব বলে দাবি করেন। দর্শনের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে উৎকর্ষ ও ধ্বংসের পর্যায় পরিলক্ষিত হয়। হেগেলীয় ও নব্য হেগেলীয় দর্শনে চরম উৎকর্ষের একটা অশনিসংকেত লক্ষ করা যায় যৌক্তিক ইতিবাদীদের তত্ত্ববিদ্যার অসারতা প্রমাণের প্রয়াসের মধ্যে।

অধিবিদ্যা অসার[সম্পাদনা]

যৌক্তিক বিশ্লেষন হলো সেই পদ্ধতি যেখানে সম্পূর্ণ বাক্যকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করে তাদের সত্যতা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এমতানুযায়ী কোনো বাক্য তখনই সত্য হবে যখন তাকে কীভাবে যাচাই করতে হবে তা জানা থাকবে।

এখন অধিবিদ্যার বাক্যগুলির চরিত্রই এমন যে তাদের অভিজ্ঞতা বা অন্য কোনো উপায়ে যাচাই বা পরীক্ষা করা যায় না। তাই অধিবিদ্যার বাক্যে কোনো অর্থ প্রকাশিত হয় না, তা অর্থহীন, অসার।

যাচাইকরণ নীতি[সম্পাদনা]

মরিস শ্লিক-এর মতবাদ

মরিস শ্লিক বাক্যের অর্থ নিরূপণের উপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করেন, বাক্যের অর্থ তার যাচাই বা পরখ করার পদ্ধতিতেই নিহিত আছে বলে তিনি মনে করেন। যাচাই করার অর্থ হচ্ছে যাচাই করার সম্ভাব্যতা। কোন বাক্য যদি নীতিগতভাবে অপরখযোগ্য হয়, তবে তা অর্থহীন হয়ে পড়ে। তিনি উল্লেখ করেন, অধিবিদ্যক বাক্যগুলো অর্থহীন, কারণ এইসব বাক্য প্রচলিত ভাষা প্রয়োগের নিয়ম ও যৌক্তিক নিয়মাবলি খণ্ডন করে। এইসব বাক্যের অর্থ প্রতিপাদন করা কোনোভাবেই যাচাই করার সম্ভাব্যতার আওতায় পড়ে না। যাচাইকরণ নীতি সংকীর্ণ ও ব্যাপক অথবা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ- এই দু’অর্থে ব্যবহৃত হয়। সংকীর্ণ অর্থে অর্থপূর্ণ উক্তিকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সত্য বা মিথ্যা বলে প্রতিপাদনযোগ্য হতে হবে। শ্লিক প্রথমে অর্থপূর্ণ উক্তির এই "সংকীর্ণ অর্থের" উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু এটি কঠোরভাবে সমালোচিত হওয়ায় "ব্যাপক অর্থে" যাচাইকরণ নীতি অবলম্বন করেন। এই নীতি অবলম্বনকে "সংকীর্ণ অর্থের" সংশোধনও বলা হয়ে থাকে। "ব্যাপক অর্থে" তিনি বলেন, বাক্যশব্দ বাস্তবে (in practical) যাচাইযোগ্য না হলেও চলবে। তবে তিনি পাশাপাশি এও বলে রেখেছেন, বাস্তবে না হলেও এগুলোকে অবশ্যই নীতিগতভাবে (in theory of principle) প্রতিপাদনযোগ্য হতে হবে।

রুডলফ কারনাপ-এর মতবাদ

রুডলফ কারনাপ অন্যান্য যৌক্তিক ইতিবাদীর মতোই উল্লেখ করেন, কোনো বাক্য অর্থপূর্ণ হতে হলে তার যাচাইযোগ্যতা (verifiability) থাকতে হবে। তিনি দু’ধরনের যাচাইয়ের কথা উল্লেখ করেন: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। প্রটোকল (protocol) উক্তি বা বাক্যকেই সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায়। কারণ এগলো অভিজ্ঞতার আওতায় রয়েছে। পক্ষান্তরে, অন্যান্য বাক্য, যেমন- একক বা বিশিষ্ট (singular proposition) ও সঠিক জাতীয় বাক্য কেবল পরোক্ষভাবে যাচাই করা যায়। পরোক্ষ যাচাই বলতে কারণাপ বুঝিয়েছেন যে, যাচাইযোগ্য কোনো বাক্যকে অন্যান্য পূর্ব-যাচাইকৃত বাক্যের সাথে এমনভাবে নেওয়া যায়, যার ফলে এগুলোকেও প্রত্যক্ষভাবে যাচাইযোগ্য করা যায়। ‘পরম সত্তা অস্তিত্বশীল’ জাতীয় তত্ত্ববিদ্যক বা অধিবিদ্যক বাক্যকে কোনোভাবেই যাচাই করা যায় না। সুতরাং এ-জাতীয় বাক্য সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়, বরং অর্থহীন।

কারণাপ পরবর্তীতে ‘যাচাইযোগ্য’ (verifiable) শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পরীক্ষাযোগ্য’ (testable) ও ‘নিশ্চয়যোগ্য’ (confirmable) শব্দের পেছনে ধাবিত হন। যে বাক্যের অভিজ্ঞতাভিত্তিক বা প্রায়োগিক মূল্য নেই সেই বাক্য অর্থহীন বলে তিনি মত দেন। অধিবিদ্যা ও নীতিবিদ্যার বাক্যগুলো অভিজ্ঞতাভিত্তিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না বলে এগুলো অর্থহীন।

এ. জে. এয়ার-এর মতবাদ

এয়ার মনে করেন, কোনো বাক্যের অর্থ সেই বাক্যের যাচাইকরণ নীতির উপর নির্ভরশীল। তিনি ব্যবহারিক যাচাইকরণ ও নীতিগত যাচাইকরণের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন। ব্যবহারিক যাচাইকরণ নীতি হলো কোনো বাক্যকে সরাসরি যাচাই করা। কিন্তু এমন অনেক তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য রয়েছে, যাদের সরাসরি যাচাই করা যায় না। সেগুলোকে নীতিগতভাবে যাচাই করতে হয়। যেমন: ‘চাঁদে সাপ আছে’- এ-বাক্যকে ব্যবহারিক বা সরাসরিভাবে যাচাই করা যায় না, নীতিগতভাবে যাচাই করতে পারি। কারণ চাঁদে গিয়ে এ-বাক্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করা যাবে। ফলে এ-বাক্যের ব্যবহারিক যাচাইযোগ্যতা না থাকলেও নীতিগত যাচাইযোগ্যতা রয়েছে এবং এ-কারণেই এটি অর্থপূর্ণ। কিন্তু অধিবিদ্যক বাক্য, যেমন, ‘পরমসত্তা অস্তিত্বশীল’-এধরনের বাক্য নীতিগত দিক থেকেও যাচাই করা যায় না। কীভাবে এগুলো যাচাই করা সম্ভবপর হবে, আমরা তাও জানি না। ফলে, অধিবিদ্যক বাক্যগুলো অর্থহীন। এয়ার সবলদুর্বল অর্থেও যাচাইকরণ নীতির পার্থক্য নির্দেশ করেন। যে যাচাইয়ের সাহায্যে কোনো বাক্যকে নিশ্চিতরূপে প্রতিপাদন করা যায়, এয়ার তাকে সবল যাচাইকরণ নীতি বলেছেন। এই নীতি অত্যন্ত কঠোর, কারণ এটি মেনে নিলে অণেক সার্বিক বাক্যকে অর্থপূর্ণ বলে গ্রহণ করা যায় না। যেমন: ‘সকল মানুষ মরণশীল’- এ-জাতীয় সার্বিক বচন সবল অর্থে যাচাইযোগ্য নয়। এ-অসুবিধে দূর করার জন্য এয়ার দুর্বল যাচাইকরণ নীতির আশ্রয় নেন। যে যাচাইকরণ নীতির মাধ্যমে কোনো বাক্যের অর্থ নিশ্চিতরূপে যাচাই করা না গেলেও সম্ভাব্যভাবে তার অর্থ প্রতিপাদন করা যায় তাকে তিনি দুর্বল যাচাইকরণ নীতি বলেছেন। তার দুর্বল যাচাইকরণ নীতি অনুসারে তথ্যসম্পর্কিত বাক্য ব্যতিরেকেও সাধারণ বাক্য এবং অতীত বা ঐতিহাসিক ঘটনাবলি সম্পর্কিত বাক্যের অর্থ ও তাৎপর্য নির্ধারণ করা যায়।

হেমপেল-এর মতবাদ

হেমপেল প্রদত্ত যৌক্তিক ইতিবাদ অনেকটা উদার। তিনি অর্থের যাচাইকরণ নীতি সম্পর্কীয় বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যের বিচারমূলক আলোচনা করেন এবং অনুবাদযোগ্যতা মানদণ্ডের সুপারিশ করেন। এই মানদণ্ড অনুযায়ী একটা বচন তখনই অর্থপূর্ণ হবে যখন তা একটা অভিজ্ঞতাভিত্তিক বচনের অনুবাদযোগ্য হবে। তিনি উল্লেখ করেন যে, জ্ঞানজ অর্থপূর্ণতা এবং অর্থহীনতার মধ্যকার তীব্র দ্বি-কোটিক বিভাগকে ক্রমাগত পার্থকরণ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে হবে এবং ঐ-ধরনের বচনমণ্ডলিকে অর্থপূর্ণতার চরম একক বলে গ্রহণ করতে হবে।

প্রভাব[সম্পাদনা]

যৌক্তিক ইতিবাদী চিন্তাধারা ক্রমে-ক্রমে ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। বার্লিনে হ্যামস রিকেনব্যাক, সি হেম্পেল, কে গ্রেলিং এবং আর ভন মিসেস এ-চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হন। আমেরিকার অনেক চিন্তাবিদের হৃদয়ও ছুঁয়েছিলো এ-আন্দোলন। যেমন- ই নোগল, সি ডব্লিও মরিস, জন ডিউক এবং টারস্কি। এরা পরে সবাই ভিয়েনা চক্রের সদস্য হন। এ-সদস্যেদের অনেকেই ছিলেন বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, ইতিহাস ও আইনের শিক্ষক। এ-মতবাদ ভিটগেনস্টাইনের ভাষা সম্পর্কীয় বিশ্লেষণ (Linguistic Analysis) মতবাদকে প্রভাবান্বিত করে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে গড়ে-ওঠা দৃষ্টান্তবাদও এ-মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত।

সমালোচনা[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. মো. আবদুল হালিম (মে ২০০৩)। দার্শনিক প্রবন্ধাবলি : তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ। ঢাকা: বাংলা একাডেমি  অজানা প্যারামিটার |1= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  2. মো. বজলুর করিম। হেগেলোত্তর দর্শন। পৃষ্ঠা ১৭৫।  অজানা প্যারামিটার |1= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)