বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস
পদ্মাসনে আসীন বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেব
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়

(১৯৫৩-০৩-১৪)১৪ মার্চ ১৯৫৩
মৃত্যু১৪ জুলাই ১৯৩৭(1937-07-14) (বয়স ৮৪)
ধর্মহিন্দুধর্ম
জাতীয়তাভারতীয়
দাম্পত্য সঙ্গীকৃষ্ণভামিনী দেবী
সন্তানদুর্গাপদ, বিষ্ণুপদ ও বিশ্বেশ্বরী
পিতামাতাঅখিলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (পিতা)
রাজরাজেশ্বরী দেবী (মাতা)
দর্শন
ধর্মীয় জীবন
গুরুমহর্ষি মহাতপা
শিষ্য
সম্মানযোগিরাজধিরাজ, পরমহংস, গন্ধ বাবা

বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস (১৪ মার্চ ১৮৫৩ - ১৪ জুলাই ১৯৩৭) ছিলেন একজন ভারতীয় আদর্শ যোগী, জ্ঞানী এবং আধ্যাত্মিক গুরু। আধ্যাত্মিক পরম পথের এই প্রদর্শক যোগবিজ্ঞান উভয় বিষয়েই সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তিনি গন্ধ বাবা তথা সুগন্ধি সাধক নামে তার শিষ্য তথা বিশ্বের ভক্তদের কাছে পরিচিত ছিলেন।

জীবনী[সম্পাদনা]

পূর্বাশ্রমে পিতৃদত্ত নাম ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মার্চ ব্রিটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার বণ্ডুল গ্রামে।[২] তার পিতা অখিলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা নাম রাজরাজেশ্বরী দেবী।[৩][৪]জন্মের মুহূর্ত হতে তার মুখের মনোমুগ্ধকর হাসি আর অন্যান্য অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই তার মাতাপিতা ভোলানাথ নাম রাখেন। অল্প বয়স থেকেই, ভোলানাথের অসাধারণ আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক আচরণের প্রভাব দেখা দিয়েছিল। তার সমবয়সীরা যখন সাধারণ খেলাধূলা করত, ভোলানাথ তখন নির্জনে স্বস্তি খুঁজে পেতেন, কাদামাটি নিয়ে দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করে ফুল নিবেদন করে পূজা করতেন, স্তোত্র পাঠ করতেন।[৫] পরবর্তীকালে আধ্যাত্মিক জীবনে নিরন্তর মন্ত্রজপ তথা ধ্যান, তপস্যা এবং সমাধি তথা অতি-চেতনা অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি অনেক অতি-প্রাকৃতিক আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় তার শিষ্য ও ভক্তরা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ও পরিবেশে তার অনেক অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। সূর্যবিজ্ঞানের এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় ভগবান কৃষ্ণের সৌরভ ছড়াতে সমর্থ হন।[৬]

আধ্যাত্মিক জীবন[সম্পাদনা]

নয় বছর বয়সে তাঁর যজ্ঞোপবীত সংস্কার করার তথা উপনয়নের সময় বাণ্ডুল গ্রামের শিবলিঙ্গে এক অলৌকিক দৃশ্য প্রতিভাত হয়েছিল।[৭] পরে চৌদ্দ বৎসর বয়সে স্বামী অভয়ানন্দের সংস্পর্শে এসে বিন্ধ্যপর্বতের এক গোপন গুহায় ( পরবরতীতে জ্ঞানগজ্ঞে) সাধনভজন করেন। মহান সিদ্ধ যোগী পরমহংস নিমানানন্দ স্বামীর সঙ্গ লাভ করেন, যোগ আসন, বীজ মন্ত্রাদি শেখেন। পরমহংস তাকে কয়েক বছর পর তার গুরু মহর্ষি মহাতপের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।[৮] তিনি যোগতন্ত্রাদি ধর্মসাধনার প্রক্রিয়াতে দীক্ষা দেন।[২]

দীক্ষা গ্রহণের পর তিনি বারো বছর ব্রহ্মচর্য পালন করেন তিব্বতের জ্ঞানগঞ্জ যোগাশ্রমে এবং কঠোর পরিশ্রমের সাথে আধ্যাত্মিক সাধনা করেন। আয়ত্ত করেন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ( যেমন, বায়ু বিজ্ঞান, চন্দ্র বিজ্ঞান, সূর্যবিজ্ঞান ইত্যাদির) ব্যবহার। শক্তির রূপান্তর একজন সিদ্ধ যোগীর বিশুদ্ধ ইচ্ছা শক্তির অনুশীলনে সম্ভব।[৬] দীর্ঘকাল হিমালয় এবং অন্যান্য অনেক স্থানে ভ্রমণ ও অনুশীলন করেছেন।ব্রহ্মচর্যের পর্যায় পেরিয়ে তিনি মঠের নিয়মানুযায়ী চার বৎসরের 'দণ্ডি' গ্রহণ করেন। এরপর চার বৎসরের সন্ন্যাস জীবন যাপন করেন। এই সময়ে তার নাম হয় বিশুদ্ধানন্দ। সন্ন্যাস অবস্থা অতিক্রমের পর আট বৎসরের তীর্থস্বামী পর্যায়ের সাধনার পর তার গুরুদেব মহর্ষি মহাতপা মহারাজ পরমহংস উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তাকে উপদেশ দেন, আত্মোন্নয়নের চেয়ে সমাজের উন্নতি করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই সমাজ জীবনে বিবাহ করে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে, মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করার আদেশ দেন।[৯] তীর্থস্বামী থাকাকালীন সময়ে গুরুর নির্দেশ অনুসারে কৃষ্ণভামিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রথমে তিনি বর্ধমান জেলার গুসকরা গ্রামে মানুষের চিকিৎসার লিপ্ত হন। তিরিশ বছর তিনি জ্যোতিষশাস্ত্র এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেন।

পরে জ্ঞানগঞ্জ থেকে প্রাপ্ত নির্দেশ অনুসারে বণ্ডুল গ্রামে বর্ধমান আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। পরে একে একে পুরী, কলকাতা[৪]এবং বারণসীতে বিশুদ্ধানন্দের শিষ্যরা 'অখণ্ড মহাযোগ সঙ্ঘ' আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।[২] ঝালদার রাজা উদ্ধব চন্দ্র সিং দেও ছিলেন তার শিষ্যদের একজন। তিনিও ঝালদায় একটি আশ্রম নির্মাণ করে গুরুদেবকে উৎসর্গ করেন। স্বামীজির দুই পুত্র সন্তান ও এক কন্যা সন্তান ছিল। তারা হলেন দুর্গাপদ, বিষ্ণুপদ এবং বিশ্বেশ্বরী। বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেবের শিষ্যদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেন গোপীনাথ কবিরাজ তিনি বেশ কয়েকটি খণ্ডে এই মহাপুরুষের জীবন ও সাধনার পরিচয় রেখে গেছেন। 'অখণ্ড মহাযোগ' সম্পর্কে বাংলা ও হিন্দিতে গ্রন্থ রচনা করেছেন।[২]

যোগিরাজাধিরাজ স্বামী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেবের যে দুটি বিশেষতা উল্লেখনীয় ছিল তা হল-

  1. স্বামী বিশুদ্ধানন্দ অতিপ্রাকৃত যোগ শক্তি লাভ করেছিলেন। তার যোগব্যক্তিত্বের অন্ত ছিল না। পতঞ্জলি যোগদর্শনের 'বিভূতিপাদ'-এ বর্ণিত উপাদানের চেয়ে বেশি শক্তির স্ফুরণ (বিশেষ করে ইচ্ছা, জ্ঞান এবং কর্মের শক্তি) তার মধ্যে প্রত্যক্ষ করা গেছে।
  2. স্বামীজি যোগের ঐতিহ্যের প্রতিটি ধাপের কথা ব্যাখ্যাসহ বর্ণনা করেছেন-

"কর্ম হল মন্থন, তা থেকে জ্ঞান আসে। সচেতন জ্ঞান থেকে আসে ভক্তি , ভক্তি থেকে প্রেম এবং প্রেম থেকে আসে উপলব্ধি।"

"সংসারে একমাত্র যোগীই প্রকৃত প্রেমিক। যোগীরাই কঠোর আধ্যাত্মিক অনুশীলনে লিপ্ত থাকেন। তবে সবকিছুর মূলে রয়েছে কর্ম - এটি প্রথম পদক্ষেপ এবং যোগ অনুশীলনের ভিত্তি। প্রেম কেবল যোগের পথেই অর্জন করা যায়। সাধারণ প্রেম কেবল একটি মানসিক ব্যাধি। শুধুমাত্র একজন যোগীই প্রকৃত প্রেমিক।"

তিরোধান[সম্পাদনা]

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই কলকাতায় যোগিরাজাধিরাজ স্বামী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেবের প্রয়াণ ঘটে।[৬]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Akshay Kumar Dutta Gupta Yogi Rajadhiraj Sri Sri Vishddhananda Paramahansa Vishwavidyalay Publications Pvt Ltd.
  2. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৪৮৯, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  3. म. म. पं. गोपीनाथ, कविराज (২০০০)। योगिराज विशुद्धानन्द प्रसंग तथा तत्त्वकथा (प्रथम সংস্করণ)। वाराणसी: विश्वविद्यालय प्रकाशन। পৃষ্ঠা ১। আইএসবিএন 978-93-5146-197-5 
  4. "Baba Vishuddhananda (ইংরাজীতে)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-১৪ 
  5. "Vishuddhananda Paramahamsa (ইংরাজীতে)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-১৩ 
  6. "Paramahansa Visshuddhanandji's Siddhis - Shivayoga"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-১৪ 
  7. म. म. पं. गोपीनाथ, कविराज (২০০০)। योगिराज विशुद्धानन्द प्रसंग तथा तत्त्वकथा (प्रथम সংস্করণ)। वाराणसी: विश्वविद्यालय प्रकाशन। পৃষ্ঠা ৮। আইএসবিএন 978-93-5146-197-5 
  8. म. म. पं. गोपीनाथ, कविराज (২০০০)। योगिराज विशुद्धानन्द प्रसंग तथा तत्त्वकथा (प्रथम সংস্করণ)। वाराणसी: विश्वविद्यालय प्रकाशन। পৃষ্ঠা ৯,১১,১৬,১৯। আইএসবিএন 978-93-5146-197-5 
  9. म. म. पं. गोपीनाथ, कविराज (২০০০)। योगिराज विशुद्धानन्द प्रसंग तथा तत्त्वकथा (प्रथम সংস্করণ)। वाराणसी: विश्वविद्यालय प्रकाशन। পৃষ্ঠা ২১,২৪,৩০,৫১। আইএসবিএন 978-93-5146-197-5