বিষয়বস্তুতে চলুন

বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্ম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(বাংলাদেশে খ্রিষ্টধর্ম থেকে পুনর্নির্দেশিত)
গারো ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশন, বিরিশিরি, দুর্গাপুর, নেত্রকোনা

বাংলাদেশে মোট খ্রিস্টান জনসংখ্যা ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পাঁচ লাখ (০.০৩%)।[] এর মধ্যে ক্যাথলিক খ্রিস্টানের সংখ্যা ৩,৫০,৬৬৯ জনের বেশি। ব্যাপ্টিস্ট এক লাখ ৩৪ হাজার। তবে, বাংলাদেশে রোমান ক্যাথলিকদের সংখ্যাই বেশি।

ধর্মপ্রদেশ

[সম্পাদনা]

বর্তমানে বাংলাদেশে সর্বমোট ৭টি ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশ আছে- ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশ, চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশ, খুলনা ধর্মপ্রদেশ, ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশ, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ ও দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশ। পূর্ববঙ্গে প্রথম বিশপ নিযুক্ত হন টমাস অলিফ ১৮৪৬ সালে। এসময়ে এই প্রৈরিতিক এলাকার অধীনে ছিল বর্তমান ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশ, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশ, খুলনা ধর্মপ্রদেশের অংশবিশেষ এবং উত্তর মায়ানমার ও আসামের কিছু অংশ। ঢাকা ধর্মপ্রদেশ স্থাপিত হয় ১৮৮৬ সালে। ফাদার আগস্টিন লুয়াজকে ১৮৯০ সালে ঢাকা ধর্মপ্রদেশের প্রথম বিশপ নিযুক্ত করা হয়। চট্টগ্রামকে ১৯২৭ সালে ঢাকা ধর্মপ্রদেশ হতে আলাদা করে নতুন ধর্মপ্রদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই বছর দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা ধর্মপ্রদেশকে ১৯৫০ সালে মহাধর্মপ্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কলকাতা মহাধর্মপ্রদেশের কিছু অংশ ও কৃষ্ণনগর ধর্মপ্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে প্রথমে ১৯৫২ সালে যশোর ধর্মপ্রদেশ নামে এবং ১৯৫৬ সালে খুলনা শহরে স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমান খুলনা ধর্মপ্রদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। হলিক্রস ফাদার থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী প্রথম বাঙ্গালী বিশপ নিযুক্ত হন ১৯৬০ সালে। তার পরে ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের আর্চবিশপ মনোনীত হন মাইকেল রোজারিও। পৌলিনুস কস্তা ২০০৫ সালে ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের আর্চবিশপ মনোনীত হন। ঢাকার উত্তরসূরী আর্চবিশপ হিসেবে মনোনীত হন ২০১০ সালে প্যাট্রিক ডি'রোজারিও, সিএসসি। খুলনা ধর্মপ্রদেশের বিশপ মাইকেল রোজারিও অবসর নেওয়ার পর ২০০৫ সালে বিশপ বিজয় এন ডি’ক্রজ খুলনা ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল নিযুক্ত হন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকাকে ১৯৮৭ সালে ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশ হতে আলাদা করে ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশপ ফ্রান্সিস এ গমেজ ছিলেন ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের প্রথম বিশপ। তার অবসর গ্রহণের পর ২০০৬ সালে ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের বিশপ হিসেবে মনোনীত হন বিশপ পল পনেন কুবি, সিএসসি। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম আদিবাসী বিশপ। বিশপ জের্ভাস রোজারিওকে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল নিযুক্ত করা হয় ২০০৭ সালে। দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশকে ভাগ করে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে। বিশপ মজেস এম কস্তা, সিএসসি ১৯৯৬ সালে দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের ধর্মপাল নিযুক্ত হন। ধর্মপ্রদেশের আওতায় রয়েছে ধর্মপল্লী। প্রতিটি ধর্মপল্লী পরিচালিত হয় একজন পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে। তিনি খ্রিস্টভক্তদের আধ্যাত্মিক সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। প্রতিটি ধর্মপল্লীতেই রয়েছে গির্জা। প্রতি রবিবার খ্রিস্টভক্তরা প্রার্থনায় যোগ দেন। আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, সিএসসি ক্যাথলিক মণ্ডলীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বাংলা ভূখণ্ডে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ইতিহাস

[সম্পাদনা]

বাংলা ভূখণ্ডে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ইতিহাস ৫শ বছরের বেশি পুরোন। আজ থেকে পাঁচ থেকে ছয়শ বছর আগে, অর্থাৎ ১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীতে, খ্রিস্টান মিশনারিরা বাংলায় আসেন। প্রথমে পর্তুগিজরা তাদের সঙ্গে করে খ্রিস্টান মিশনারিদের এখানে নিয়ে আসেন এবং যীশুর কথা প্রচার করতে শুরু করেন।

বাংলা ভূখণ্ডে ১৫১০ সালে পর্তুগিজদের সঙ্গে আলফোনসো ডি আলবুকার্ক  ও পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারকদের আগমনের আগপর্যন্ত খ্রিস্টধর্মের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায় না। আলবুকার্ক স্থানীয় বাঙালি নারীদের সাথে আন্তঃবিবাহকে উৎসাহিত করে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের চেষ্টা করেছিলেন। তাই তাদের বংশধররা ছিল খ্রিস্টানদের প্রথম প্রজন্ম। ক্যাথলিক পোপ ও পর্তুগালের রাজার মধ্যে চুক্তির সুবাদে ১৫১৪ সালের মধ্যে পর্তুগিজরা বাংলায় খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অধিকার লাভ করে।

বাংলাদেশে প্রথম খ্রিস্টান গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নে। এর আগে ১৫৪০ সালে ইগ্নেসিয়াস লয়োলা নামক একজন স্পেনবাসীর নেতৃত্বে জেসুইট বা যীশু সম্প্রদায় গঠিত হওয়ার পর খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য মিশনারিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন। সেই আমলে এই অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম প্রচার সম্পর্কিত তথ্যাদি পাওয়া যায় পিয়ারে ডুজারিক নামক একজন ফরাসী ঐতিহাসিকের লেখা থেকে। ডুজারিকের তথ্যানুযায়ী সেসময় বাকলা, শ্রীপুর ও যশোহর নামে তিনটি হিন্দু রাজ্য ছিল। ফনসেকা নামে একজন খ্রিস্টান পাদ্রী নদীপথে ১৫৯৯ সালের ২০ নভেম্বর যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ঈশ্বরীপুরে পৌঁছান। সেখানে তিনি অন্য একজন খ্রিস্টান পাদ্রী ফাদার সোসার দেখা পান।

ফাদার সোসা ও ফাদার ফনসেকা, মতান্তরে ফাদার ফ্রান্সিসকো ফার্নান্দেজ ও ফাদার দোমিঙ্গো দ্যা সুজা, পরদিন ২১ নভেম্বর বারো ভুঁইয়ার অনত্যম প্রতাপাদিত্যের দরবারকক্ষ বারদুয়ারীতে উপস্থিত হন। সঙ্গে ছিল বেরিঙ্গান নামের এক ধরনের সুস্বাদু কমলালেবু। এসময় দুই ফাদার বারদুয়ারী ভবনের উত্তর-পূর্ব কোণে, যেখানে আজকের খ্রিস্টান পল্লী অবস্থিত সেখানে, একটি গির্জা নির্মাণের প্রস্তাব দেন। এই দুই ফাদার ছিলেন রোমান ক্যাথলিক মণ্ডলীর সদস্য। প্রতাপাদিত্য আনন্দের সঙ্গে এ প্রস্তাবে রাজি হন। তিনি গির্জা তৈরিতে কেবল অনুমতিই দেন নি, আর্থিক সহায়তা ও জমিও দিয়েছিলেন।

প্রতাপাদিত্যের ফরমান পাওয়ার পরই গির্জা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ঐসময় তার সৈন্যবাহিনীতে বহু পর্তুগীজ কর্মরত ছিলেন। গির্জা নির্মাণের জন্য তারা সাধ্যমত অর্থ সাহায্য করেন। জেসুইটদের এই গির্জার নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৫৯৯ সালের ডিসেম্বরে। উদ্বোধন করা হয় ১ জানুয়ারি ১৬০০ সালে। নাম দেওয়া হয় ‘দ্য চার্চ অফ দ্য হোলি নেম অফ জেসুস’। নির্মাণকাল বিচারে বাংলা ভূখণ্ডের এই অঞ্চলে নির্মিত এটাই প্রথম রোমান ক্যাথলিক গির্জা। কালের বিবর্তনে এই গির্জার অস্ত্বিত্ব বিলীন হয়েছে। সেখানে এখন কৃষিজমি আর বসতভিটা। তবে, কাছেই গড়ে উঠেছে যিশুর গির্জা নামে খ্রিস্টান মিশনের তিন তলা ভবন।

একইসময়ে এই অঞ্চলে পরপর আরও দু’টো গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম তখন আরাকান রাজ্যের অধীনে ছিল। দ্বিতীয় গির্জাটি নির্মাণ করেছিলেন আন্দ্রে বোভস চট্টগ্রামে আরাকান রাজার আর্থিক সাহায্যে। এর উদ্বোধন হয় ২৪ জুন ১৬০০ সালে। এটি ‘সেন্ট জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট চার্চ’ নামে পরিচিত ছিল।

মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় একদল ক্যাথলিক মিশনারি ঢাকায় আসেন। ঢাকা তখন বাংলার রাজধানী। মিশনারিরা নারিন্দায় একটি গির্জাঘর স্থাপন করেন। এরপর তেজগাঁওয়ে জপমালার রাণীর গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৭৭ সালে। সেন্ট নিকোলাস গির্জা নির্মিত হয় ১৬৯৫ সালে গাজীপুরের নাগরীতে। বরিশালের পাদ্রিশিবপুরের গির্জা নির্মিত হয় ১৭৬৪ সালে। ঢাকা-নবাবগঞ্জের অদূরে হাসনাবাদের গির্জা ১৭৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইতিহাসমতে ১৬৬৩ সালে মগ ও আরাকান দস্যুরা ভূষণা বা ফরিদপুর বিধ্বস্ত করে সেখানকার এক রাজপুত্রকে অপহরণ করে। এই রাজপুত্র ছিলেন ভূষণার রাজার বংশধর। অপহৃত রাজপুত্রকে খ্রিস্টান মিশনারিরা দস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার করেন। রাজপুত্র নাকি স্বপ্নে সাধু আন্তনীর দর্শন লাভ করেন এবং তার নির্দেশে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে দোম আন্তোনিও নাম গ্রহণ করেন। নবদীক্ষিত আন্তোনিও প্রচার কাজে খুব সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং তার প্রচারের ফলে কয়েক বছরের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ২০ হাজার নিম্নবর্ণের হিন্দুও ছিলেন।

জেসুইস ও অগস্টেইনিয়া নামে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের দু’টো দল পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০ বছর ধরে বাংলায় খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন। মোগল সম্রাট আকবর তৎকালীন ভারতের বাঙালা প্রদেশের ও বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে পর্তুগিজদের বসতি স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন। মিশনারিরা এসে সেখানে গির্জা, স্কুল ও হাসপাতাল চালু করেন। হুগলিকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে তারা ঢাকাতেও কাজ শুরু করেন।

এভাবে এই অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারিদের তৎপরতা পূর্ণোদ্যমে শুরু হয় ১৬২১ সালে। ১৬৩৩ সালে সম্রাট শাহজাহান ৭৭৭ বিঘা জমি বিনা খাজনায় (লা-খেরাজ) খ্রিস্টান মিশনারিদের দান করেন। ফলে মিশনারিরা আরও উৎসাহ নিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার কাজ শুরু করেন। এই মোঘল আমলেই মিশনারিরা অগস্টেইনিয়া গির্জা গড়ে তোলেন। এবং, ১৬৩৩ সালের পর ১৩টি অগস্টেইনিয়া গির্জা গড়ে ওঠে।

প্রথম প্রোটেস্ট্যান্ট রেভারেন্ড জন জাকারিয়া কিয়ারনন্ডার বাংলাদেশে আসেন ১৭৪০ সালে। তিনি ১৭৭০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ‘মিশন চার্চ’ নামে একটি প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জার অর্থায়ন ও নির্মাণ করেন।

এরপর ১৭শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর মধ্যে পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারকরা বাংলা ভাষায় ধর্মপ্রচার ও ধর্মান্তকরণ (ইভাঞ্জেলাইজিং) করেন। এইসময় বাংলা ভাষায় ইভাঞ্জেলিক্যাল বই ও খৃস্টান ধর্মতত্ত্ব লেখা হতে থাকে।

উইলিয়াম কেরি ও খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক

ধর্মীয় অধ্যয়ন বিষয়ে স্কলার সুফিয়া এম. উদ্দিনের মতে, উইলিয়াম কেরিকে ‘প্রথমদিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ব্যক্তিত্বদের একজন’ হিসেবে দেখা যেতে পারে। কেরি ১৭৭৩ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং তাকে মিশনারি কাজ চালানোর জন্য ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি আর্থিকভাবে সহায়তা করেছিল। কেরি বিশ্বাস করতেন একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবে তার সাফল্যের কারণ তার বাংলা ভাষা শেখা ও সুসমাচার (গসপেল) অনুবাদ করা।

উইলিয়াম কেরির মতো ব্রিটিশ মিশনারিরা ১৮ শতকের মধ্যে আরও গির্জা তৈরি করেছিলেন, বাইবেল ও খ্রিস্টধর্ম-সম্পর্কিত অন্যান্য বই অনুবাদ করেছিলেন এবং ধর্মীয় বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ব্রিটিশ মিশনারিরাও সুসমাচার প্রচারের প্রয়াসে খ্রিস্টান সংবাদপত্র (যেমন ‘দিগদর্শন’, ‘দ্য গসপেল ম্যাগাজিন’ ও ‘দ্য ক্রিশ্চিয়ান মহিলা’) চালু করেছিলেন।

কেরি ১৮০১ সালে দ্য নিউ টেস্টামেন্টের একটি অনুবাদ প্রকাশ করেন, যা ছিল দক্ষিণ এশীয় কোনো ভাষায় বাইবেলের প্রথম অনুবাদ। সেবছরই তিনি বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশ করেন এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ডের সহায়তায় শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮১৮ সালে।

কেরির সহকর্মী ও মিশনারি দল গরিব খ্রিস্টান বালকদের জন্য একটি বাংলা ভাষাভিত্তিক স্কুল স্থাপন করেন। তারা ১৮১৭ সাল নাগাদ এরকম ৪৫টি বালক বিদ্যালয় পরিচালনা করতেন। মেয়েদের জন্য তারা ১৮১৮ সালে প্রথম বাংলা ভাষাভিত্তিক বালিকা বিদ্যালয় খোলে এবং ১৮২৪ সালের মধ্যে ৬টি বালিকা বিদ্যালয় চালু করেন।  মিশন-চালিত এই স্কুলগুলো সাধারণত বৃত্তি ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতো।

কেরি ৩৪টিরও বেশি ভারতীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করার কাজের তদারকির দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ওদিকে, মিশনারিরা খ্রিস্টান জীবনধারার পক্ষে বই ও পুস্তিকা লিখছিলেন। এই বই ও পুস্তিকাগুলো (যেমন ‘প্রফেটস টেস্টিমনি অফ খ্রাইস্ট’, ‘গডস পানিশমেন্ট অফ সিন’ ও ‘কৃষ্ণ এন্ড খ্রাইস্ট কমপেয়ারড’) কেবল খ্রিস্টান জীবনের সুবিধার ওপরই জোর দেয় নি, হিন্দু ও মুসলিমদের বিশ্বাসেরও নিন্দা করেছে।

ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায় ব্যাপ্টিস্টরা এসে ১৯০৮ সালে লিপ্রসি বা কুষ্ঠনিরাময় কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরো ভারতের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই খ্রিস্টান মিশনারিদের তৎপরতা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। পর্যায়ক্রমে পাকিস্তান আমলে ও পরে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের তৎপরতা অব্যাহত থাকে।

নারী ধর্মপ্রচারক

প্রথম ইংরেজ নারী মিশনারিদের একজন ছিলেন মিস মেরি অ্যান কুক। মিশনারি উইলিয়াম ওয়ার্ড বাঙালি নারীদের সঙ্গে আরও সংযোগ স্থাপনের জন্য ১৮২০ সাল থেকে ইংরেজ নারীদের খ্রিস্টধর্ম প্রচারে উৎসাহিত করেছিলেন। খ্রিস্টান মিশনারী সোসাইটির সহায়তায় মিস কুক কলকাতা এলাকায় প্রায় ৩০০ ছাত্রী নিয়ে ১৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

মিশনারী প্রচারে সাহায্য করার জন্য ইতালি থেকে সিস্টার আর্গেরিটা বেলাসিনি, সিস্টার ব্রিগিডা জেনেলা ও সিস্টার অ্যাগোস্টিনা বিগো ১৮৬৮ সালের ১৭ মে ফাদার মারিত্তির সঙ্গে দেখা করেন। এদের উদ্দেশ্য ছিল ঘরে ঘরে বিশেষ করে দরিদ্র ও বিপদাপন্ন বিধবাদের কাছে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করবেন। অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপ্টিস্ট মিশনের মিস আর্নল্ড ও ১৮৮৬ সালে নিউজিল্যান্ডের ব্যাপ্টিস্ট মিশনের মিস ম্যাকজর্জ ১৮৮২ সালে বাংলাদেশে আসেন।

প্রথম খ্রিস্টান মিশনারীর আত্মত্যাগ

বাংলা ভূখণ্ডে কর্মরত খ্রিস্টান মিশনারীদের মধ্যে প্রথম নিহত হন ফাদার ফ্রান্সিসকো ফার্নান্দেজ। আরাকানিদের হাত থেকে খ্রিস্টান নারী ও শিশুদের বাঁচাতে গিয়ে তিনি মারা যান ছিলেন ১৬০২ সালের ১৪ নভেম্বর। এই খ্রিস্টান নারী ও শিশুদেরকে আরাকানে দাস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ফাদার ফ্রান্সিসকো তাদের হাতে আটক হন। তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম

[সম্পাদনা]

বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যেও খ্রিস্ট মণ্ডলী বিস্তার লাভ করেছে। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা-টাঙ্গাইল-শেরপুর জেলায় গারো; দিনাজপুর-রাজশাহী-নাটোর-সিরাজগঞ্জ-চাপাই নবাবগঞ্জ-নীলফামারী-লালমনিরহাট-নওগাঁও-রংপুরে সাঁওতাল ও ওঁরাও; সিলেট অঞ্চলে খাসিয়া, রাঙ্গামাটি-বান্দরবান এলাকায় বম, খিয়াং, খুমী, ম্রো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি আদিবাসীদের মধ্যে অনেকেই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন। ইংল্যান্ডের প্রেসবাইটেরিয়ান চার্চ রাজশাহী জেলার রামপুরের বোয়ালিয়ায় ১৮৬২ সালে একটি মিশন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। রেভারেন্ড বিহারী লাল সিংহ এর কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি ফ্রি চার্চ অফ স্কটল্যান্ডের মিশন ইন কলকাতার একজন এজেন্ট ছিলেন। ফ্রি চার্চ অফ স্কটল্যান্ড ১৮৭০ সালে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের সাঁওতাল এবং উড়িষ্যার খোন্ড ও প্যানোদের মধ্যে কাজ শুরু করে। দিনাজপুর ও রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের অধিকাংশ খ্রিস্টভক্তই আদিবাসী। এখানে দিনাজপুর ও রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজ শুরু হয় ১৯ শতকের শেষের দিকে। নীলফামারীর সৈয়দপুরে ১৮৯৩ সালে যে গির্জাটি নির্মিত হয়, সেটাই উত্তরবঙ্গের প্রথম ক্যাথলিক গির্জাঘর। এই গির্জা তৈরি হয়েছিল রেলওয়ে কর্মীদের জন্য। এরপর স্থানীয়দের নিয়ে প্রথম মণ্ডলী শুরু হয় ১৯০৩ সালে বর্তমান বেনীদুয়ার ধর্মপল্লীর অন্তর্গত বেগুনবাড়ী গ্রামের মুণ্ডা আদিবাসীদের নিয়ে। ইতালি থেকে আসা পিমে ফাদাররা এই এলাকায় মিশনারি কাজ শুরু করেন এবং এখনও তারা এখানে কাজ করছেন। বগুড়াতে ১৯০৬ সালে চার্চেস অফ গড মিশন শুরু করেন বাওয়ার্স দম্পতি। দক্ষিণ দিনাজপুরে আদিবাসী মুণ্ডাদের মধ্যে ক্ষুদ্র গির্জা স্থাপন করা হয়। গারো পাহাড়ের আদিবাসীদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার কাজ শুরু হয় ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায়। নেত্রকোনার বিরিশিরিতে গারো ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশন (জিবিসি) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮১ সালে। পুনর্নিমাণ করা হয় ১৯১১-তে। তবে এর কাজ শুরু হয় আরও আগে ১৮৭৪ সালে। ওদিকে ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশ খ্রিস্টধর্ম প্রচারের শতবর্ষপূর্তি পালন করেছে ২০০৯ সালে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে গারোদের মধ্যে প্রথম খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন রাধানাথ ভৌমিক।

মুক্তিযুদ্ধে খ্রিস্টানদের অবদান

[সম্পাদনা]

মহান মুক্তিযুদ্ধে খ্রিস্টানদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। অনেক খ্রিস্টান নর-নারী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন অনেকে।

আওয়ামী লীগ সকারের সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট প্রমোদ মানকিন[][], মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট সাংবাদিক চিত্ত ফ্রান্সিস রিবেরূ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর তৎকালীন আর্চবিশপ টি এ গাঙ্গুলী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের সঙ্গে দেখা করে নিজের গলার স্বর্ণের চেইন ও ক্রশ দান করেছিলেন দেশের পুনর্বাসনের জন্য।

দেশ গঠনে খ্রিস্টানদের অবদান

[সম্পাদনা]

খ্রিস্টানরা সংখ্যায় মোট জনসংখ্যার ০.০৩% হলেও দেশ গঠনে তাদের অনেক অবদান রয়েছে। নটরডেম কলেজ, হলিক্রস স্কুল, সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল এর মত সুনামধন্য স্কুল পরিচালনা করছে বাংলাদেশ ক্যাথলিক মণ্ডলী। এছাড়া গ্রামে-গঞ্জে রয়েছে মানসম্পন্ন স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্য কেন্দ্র।

মিশনারিরা যেখানেই গেছেন সেখানেই সাধারণত পিছিয়ে পড়া সমাজের শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এছাড়াও, হাসপাতাল স্থাপন, ঋণ সুবিধা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং দারিদ্র বিমোচনে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। এদেশে জটিল রোগের চিকিৎসার জন্যে তারা ডাক্তার, সার্জনদের ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসেন এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের মালুমঘাট, ময়মনসিংহ, রংপুর, রাজশাহীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাসপাতাল তৈরি করে প্রথমে বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেন।

খ্রিস্টধর্ম প্রচারাভিযান নিয়ে সমালোচনা

[সম্পাদনা]

সাম্প্রতিক বাংলাদেশে খ্রিস্টান ধর্মের উত্থানের কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে পশ্চিমা এনজিও ও খ্রিস্টান দাতব্য সংস্থাকে, যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর মানবিক সহায়তা দিয়েছিলেন।

তারপর থেকে এই এনজিও ও দাতব্য সংস্থাগুলো বাংলাদেশে কেবল জরুরি ত্রাণ, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার জন্য সহায়তা করে নি, তারা বাইবেল পড়ার অনুশীলনকেও উৎসাহিত করেছে। বাংলাদেশে ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৯১ হাজার মুসলমান খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন।[১]

খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের বিরুদ্ধে উত্থিত অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে তারা আদিবাসীদের পশ্চিমাকরণের মাধ্যমে স্বকীয় সংস্কৃতি ও ভাষা বিলুপ্তকরণে ভূমিকা রাখছে।[২] সারা বিশ্বে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ বিকাশে ১৫শ শতক থেকেই খ্রিস্টধর্ম প্রচারাভিযানগুলো সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।[৩]

পরিসংখ্যান

[সম্পাদনা]

ধর্মপল্লী: ৯৭, উপ-ধর্মপল্লী: ৪৮, বিশপ: ৯,পুরোহিত :৩৬৭, সন্ন্যাসিনী: ১,০৫১, ধর্মসংঘ: ৩৪।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "বাংলাদেশের জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২"উইকিপিডিয়া। ২০২৪-১২-১৩। 
  2. "প্রমোদ মানকিন"উইকিপিডিয়া। ২০২৪-১২-১৩। 
  3. "মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের অবদান"www.jumjournal.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৫ 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]