প্রবোধচন্দ্র সেন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
প্রবোধচন্দ্র সেন
জন্ম(১৮৯৭-০৪-২৭)২৭ এপ্রিল ১৮৯৭
মৃত্যু২০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬(1986-09-20) (বয়স ৮৯)
জাতীয়তাভারতীয়
নাগরিকত্বভারতীয় ভারত
পেশাছন্দ বিশেষজ্ঞ, রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদ
পিতা-মাতাহরদাস সেন (পিতা)
স্বর্ণময়ী সেন (মাতা)
পুরস্কারবঙ্কিম পুরস্কার (১৯৭৫)
দেশিকোত্তম (১৯৮০)

প্রবোধচন্দ্র সেন (ইংরেজি: Prabodhchandra Sen) ( ২৭ এপ্রিল, ১৮৯৭ - ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬), প্রখ্যাত বাঙালি ছান্দসিক, রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক ।[১] ঊনিশ শতকের যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং সাংস্কৃতিক চেতনার ধারক ছিলেন তিনি।

জন্ম ও শিক্ষা জীবন[সম্পাদনা]

প্রবোধচন্দ্র সেনের জন্ম ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে এপ্রিল অবিভক্ত বাংলার বর্তমানে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার চুন্টা গ্রামে। পিতার নাম হরদাস সেন ও মাতার নাম স্বর্ণময়ী সেন। তার প্রাথমিক পড়াশোনা গ্রামের পাঠশালা ও স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর তার স্কুল ও কলেজ জীবন অতিবাহিত হয় কুমিল্লা শহরে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্সে নিয়ে বি.এ পাশ করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। এম.এ পাশের পর তিনি রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর ও পরে হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন। তার ইতিহাস প্রীতির মূলে ছিল স্বদেশপ্রেম। ছাত্রাবস্থায় তিনি অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। রাজদ্রোহী সন্দেহে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে অন্যান্য কারাবন্দীদের সাথে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পান।

কর্ম জীবন[সম্পাদনা]

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রবোধচন্দ্র সেন কর্মজীবন শুরু করেন খুলনার হিন্দু একাডেমী (বর্তমানে দৌলতপুর কলেজে) ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা দিয়ে। দীর্ঘ দশ বৎসর অধ্যাপনার শেষে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে বিশ্বভারতী বিদ্যাভবনে রবীন্দ্র-অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হলে তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান হন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিক উৎসবকালে রবীন্দ্রভবনের প্রথম রবীন্দ্র-অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ হন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে অবসরগ্রহণ করার পর বিশ্বভারতীর সম্মানসূচক এমেরিটাস অধ্যাপক হন।

বাংলা সাহিত্যে অবদান[সম্পাদনা]

প্রবোধচন্দ্র কলেজে পড়ার সময় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে "বাংলাছন্দ" নামে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন এবং সেটি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায়, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ বাংলার কবিগণের প্রশংসা অর্জন করেন। ধারাবাহিক ভাবে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত সে প্রবন্ধে বাংলা ছন্দের আলোচনা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনিও ভূয়সী প্রশংসা করে তাঁকে "ছান্দসিক" অভিধায় ভূষিত করেন। তারপর তিনি দীর্ঘ ষাট বৎসরের অধিককাল বাংলা ছন্দের উপর বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা ও পরিভাষা রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার বাংলা ছন্দ সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল -

  • 'ছন্দোগুরু রবীন্দ্রনাথ'(১৯৪৫)
  • 'ছন্দপরিক্রমা'(১৯৬৫)
  • 'ছন্দজিজ্ঞাসা'(১৯৭৪)
  • 'বাংলাছন্দ চিন্তার ক্রমবিকাশ'(১৯৭৮)
  • 'ছন্দ সোপান'(১৯৮০)
  • 'বাংলা ছন্দে রূপকার রবীন্দ্রনাথ'(১৯৮১)
  • 'নতুন ছন্দ পরিক্রমা'(১৯৮১) প্রভৃতি।

সুগভীর ইতিহাসবোধ[সম্পাদনা]

বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রবোধচন্দ্রের আগ্রহের মূলে ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঅক্ষয়কুমার মৈত্রেয় প্রমুখের স্বদেশপ্রীতি ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী 'স্বদেশী আন্দোলন'। এর সূত্র ধরে তিনি আকৃষ্ট হন বাংলার ভৌগোলিক ইতিহাসের প্রতি। তার রচিত "বাংলার জনপদ" এরই একটি উদাহরণ। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত "বাংলার ইতিহাস সাধনা" বাংলার এক মূল্যবান হিস্টরিয়োগ্রফি হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। ভারত-ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে তার সুগভীর ইতিহাসবোধের পরিচয় বহন করে নিম্নোক্ত বই তিনটি -

  • 'বাংলায় হিন্দু রাজত্বের শেষ যুগ' (১৯৩০)
  • 'রামায়ণ ও ভারত-সংস্কৃতি' (১৯৬২)
  • 'ভারতাত্মা কবি কালিদাস' প্রভৃতি গ্রন্থ এবং অনুরূপ বহু প্রবন্ধ। শেষোক্ত বইতে তার প্রাচীন সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। [২]

অন্যদিকে ইতিহাসের পটভূমিতে রবীন্দ্র সাহিত্যের আলোচনা করে এক নতুন দৃষ্টি ভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। বইগুলি হল -

  • 'ভারতপথিক রবীন্দ্রনাথ'(১৯৬২)
  • 'রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা'
  • 'ইচ্ছামন্ত্রের শিক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথ' (১৯৭৮)
  • 'ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত' (১৯৪৯)

শেষোক্ত বই ও :"India's National Anthem" বইটিতে তার ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধানের ফলেই ভারতের জাতীয় সঙ্গীত "জনগণমন" গানটি নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রচলিত ভ্রান্তির নিরসন সম্ভব হয়েছে।

ছাত্রজীবনে প্রবোধচন্দ্র প্রসিদ্ধ বৌদ্ধশাস্ত্রবিদ ড. বেণীমাধব বড়ুয়ার সান্নিধ্যে আসেন। তার ফলে গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রতি তার গভীর অনুরাগ ও শ্রদ্ধা জন্মেছিল। তার প্রকাশ নিম্নোক্ত বইদুটিতে পাওয়া যায়-

  • 'ধর্মজয়ী অশোক' (১৯৪৭)
  • 'ধম্মপদ-পরিচয়'

সম্মাননা[সম্পাদনা]

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য প্রবোধচন্দ্র সেন বিভিন্ন সময়ে অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে আছে প্রফুল্ল-স্মৃতি পুরস্কার (১৯৬৯), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'বঙ্কিম পুরস্কার' (১৯৭৫) 'ভারতাত্মা কবি কালিদাস' গ্রন্থের জন্য, কেশবচন্দ্র গুপ্ত স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৮), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের 'দেশিকোত্তম উপাধি (১৯৮০), কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডিলিট (১৯৮৩), উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডিলিট (১৯৮৩)। এশিয়াটিক সোসাইটি ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে মরণোত্তর "রবীন্দ্রশতবার্ষিকী স্মারক পদক প্রদান করে।

জীবনাবসান[সম্পাদনা]

প্রবোধচন্দ্র সেন ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ শে সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনে প্রয়াত হন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ২৩০, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  2. শিশিরকুমার দাশ সংকলিত ও সম্পাদিত, সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৯, পৃষ্ঠা ১২৯ আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-০০৭-৯ {{আইএসবিএন}} এ প্যারামিটার ত্রুটি: চেকসাম