নাগরিক শক্তি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নাগরিক শক্তি
প্রতিষ্ঠাতামুহাম্মদ ইউনূস
প্রতিষ্ঠা১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ (2007-02-17)
ভাঙ্গন৩ মে ২০০৭ (2007-05-03)
ভাবাদর্শধর্মনিরপেক্ষতা
সামাজিক উদারনীতি
স্লোগানবাংলাদেশ এগিয়ে চলো[১]
নোবেল বিজয়ী, নাগরিক শক্তির প্রবক্তা মুহাম্মদ ইউনূস

নাগরিক শক্তি ছিল বাংলাদেশের একটি প্রস্তাবিত রাজনৈতিক দল। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৭ সালে ওয়ান ইলিভেন সরকারের আমলে এই দলটির পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি সেসময় দেশের জনগণের কাছে তার ধারণাগুলি জানিয়ে বিশিষ্ট ইংরেজি জাতীয় পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টারে নাগরিকদের উদ্দেশ্যে মোট তিনটি চিঠি লিখে মতামত চেয়েছিলেন। আগ্রহী যোগ্য প্রার্থীর অভাবের কারণে তিনি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার উদ্যোগ বাতিল করে দেন।

প্রেক্ষাপট[সম্পাদনা]

২০০৬-০৮ সালে চলমান অস্থিতিশীল বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের অংশ হিসবে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনা-হস্তক্ষেপের পর বাংলাদেশের রাজনীতি চলতায় জর্জরিত ছিল, বিশেষ করে ২০০৬-০৮ সালের অস্থিরতার সময়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াশেখ হাসিনাসহ বেশিরভাগ শীর্ষ রাজনীতিবিদ দুর্নীতির অভিযোগে কারাবন্দী ছিলেন[২][৩] এবং সেসময় দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। সুতরাং, রাজনীতিতে ব্যাপক দুর্নীতিমোকাবেলায় ইউনূস পরিচ্ছন্ন সৎ ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত একটি রাজনৈতিক দলের প্রস্তাব করেছিলেন।[৪]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

২০০৬ সালের প্রথম দিকে ইউনূস, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, আইনবিদ কামাল হোসেন, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এবং অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সহ সুশীল সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে একটি প্রচারণায় অংশ নেন। জাতীয় নির্বাচনে সৎ ও পরিচ্ছন্ন প্রার্থীদের জন্য[৪] সে বছরের শেষের দিকে রাজনীতিতে প্রবেশের কথা ভেবেছিলেন।[৫]

প্রথম চিঠি[সম্পাদনা]

২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে ইউনূস বাংলাদেশি ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি খোলা চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সঠিক নেতৃত্ব এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের তার পরিকল্পনার বিষয়ে নাগরিকদের মতামত জানতে চান। চিঠিতে তিনি সবাইকে সংক্ষেপে এই কাজটি কীভাবে করা উচিত এবং কীভাবে তারা এতে অবদান রাখতে পারেন তার রূপরেখা তুলে ধরার আহ্বান জানান।[৬]

উন্মোচন[সম্পাদনা]

অবশেষে ইউনূস ২০০৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নাগরিক শক্তি নামে একটি নতুন দল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।[৭][৮][৯] জল্পনা ছিল যে, সেসময়কার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক সেনাবাহিনী ইউনূসের রাজনীতিতে আসার পদক্ষেপ সমর্থন করেছিল।[১০]

দ্বিতীয় চিঠি[সম্পাদনা]

নাগরিকদের উদ্দেশ্যে লেখা দ্বিতীয় চিঠিতে রাজনীতিতে তার যোগদানের আগ্রহের কথা উল্লেখ করা হয়। চিঠিতে দলের ভিত্তি ও মূলনীতি, দলের তৃণমূল পর্যায়ের জন্য একটি বিস্তারিত সাংগঠনিক কাঠামো উপস্থাপনের পাশাপাশি নারী, তরুণ ও প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে সম্বোধন করা হয়।

নীতিবাক্য এবং নীতি[সম্পাদনা]

"বাংলাদেশ এগিয়ে চলো" ছিল আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য। জনগণের উদ্দেশে লেখা দ্বিতীয় চিঠিতে এই স্লোগান ঘোষণা করা হয়।[১] দলটির অন্যতম লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফলাফল অর্জন করা। চিঠিতে দলটি সৎ প্রশাসন এবং জবাবদিহিতার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যোগ্য নেতাদের নিয়োগের চেষ্টার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।[৪] ড. ইউনূস বাংলাদেশ সমুদ্রবন্দরগুলো উন্মুক্ত করে দিয়ে এবং বৈশ্বিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অর্থনৈতিক চেক-পয়েন্টে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।[১]

সংগঠন[সম্পাদনা]

ইউনূস জনগণের কাছে তার দ্বিতীয় চিঠির মাধ্যমে দলের সাংগঠনিক কাঠামোর রূপরেখা তুলে ধরেন।[১]

নাগরিক শক্তির সংগঠন মূলত বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল অর্থাৎ গ্রামভিত্তিক হওয়ার কথা ছিল।[১] ধারণা করা হয়েছিল, সেখানে ২০ জন শ্রমজীবী লোক থাকবে, এবং আশা করা হয়েছিল যে দলগুলি জনসভার মতো আনুষ্ঠানিক শোডাউন এড়িয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকে আরও উচ্ছৃঙ্খল পথে যাওয়া এড়াব। এরপরিবর্তে সত্য ঘোষণা করে ভোটারদের সন্তুষ্ট করতে পছন্দ করবে। প্রতিটি ইউনিটে ৫০ শতাংশ নারী কর্মী-সমর্থক থাকা উচি, তবে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ থাকতেই হবে। আদর্শভাবে, মহিলা এবং তরুণদের দলের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে উচিত। প্রতিটি সংগঠন বা গোষ্ঠীকে অবশ্যই উচ্চতর পদে অন্যদের মনোনীত করতে সক্ষম হতে হবে এবং এই অনুশীলনটি নির্বাচনী এলাকা স্তর পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া উচিত। দলীয় খরচ তার সদস্যদের দ্বারা বহন করা হবে।

ইউনূস ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তার দল ৩০০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছা করেছিলেন।[৭]

গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে স্বার্থের সংঘাত[সম্পাদনা]

ইউনূস নাগরিক শক্তির সঙ্গে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণদাতা গ্রামীণ ব্যাংকের স্বার্থের সংঘাতের অভিযোগ এড়াতে চান। তিনি বলেছেন, ব্যাংকের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা কমানো হবে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের কোনো নির্বাহী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন না।[১১]

রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া[সম্পাদনা]

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোড়ন তুলে দলটি। প্রথম দিকে অনেক রাজনৈতিক নেতা মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও কেউ কেউ দল নিয়ে তিক্ততা প্রকাশ করেছেন।

এরপর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনূসের রাজনীতিতে যোগ দেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, রাজনীতিতে নবাগতরা ব্যক্তিরা বিপজ্জনক উপাদান এবং তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তারা অনেক সময় ভালোর চেয়ে জাতির ক্ষতি বেশি করে।[১২]

ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা ফজলুল হক আমিনী অধ্যাপক সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে আরও কঠোর সমালোচক ছিলেন। তিনি বলেন, "ড. ইউনূস দেশ, জাতি ও ইসলামের শত্রু।"[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

তৃতীয় চিঠি[সম্পাদনা]

তবে ৩ মে ইউনূস তৎকালীন তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদের সাথে বৈঠকের পর ঘোষণা করেন, তিনি তার রাজনৈতিক পরিকল্পনা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।[১৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ইউনূস, মুহাম্মদ (২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৭)। "Yunus' second letter"দ্য ডেইলি স্টার। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১১ 
  2. PTI (৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭)। "Khaleda Zia and Sheikh Hasina become neighbours...in prison"Rediff। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১১ 
  3. "The coup that dare not speak its name. The army, not the politicians, now runs Bangladesh"দ্য ইকোনোমিস্ট। ১৮ জানুয়ারি ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১১ 
  4. "Parliament with honest, efficient must for development"দ্য নিউ ন্যাশন। ২১ মার্চ ২০০৬। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগস্ট ২০০৭ 
  5. "Yunus not willing to be caretaker chief"|দ্য ডেইলি স্টার। ১৮ অক্টোবর ২০০৬। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০০৭ 
  6. "Yunus seeks people's views on floating political party"|দ্য ডেইলি স্টার। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০০৭ 
  7. "Yunus names his political party Nagorik Shakti"Bdnews24.com। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭। ২০১২-০৩-১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১১ 
  8. Siddique, Islam (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭)। "Bangladesh Nobel Laureate Announces His Political Party's Name"AHN। ২০০৭-০২-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০০৭ 
  9. "Nobel laureate Yunus to contest Bangladesh's next parliamentary polls"হিন্দুস্তান টাইমস। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জানুয়ারি ২০১৬HighBeam Research-এর মাধ্যমে। 
  10. Mustafa, Sabir (৫ এপ্রিল ২০০৭)। "Bangladesh at a crossroads"বিবিসি নিউজ। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০০৭At first glance, the current state of Bangladesh appears to be a paradox : a country under a state of emergency, but where the general public seem quite content. 
  11. "Yunus floats party styled Nagorik Shakti"দ্য ডেইলি স্টার। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬। সংগ্রহের তারিখ ৯ মে ২০০৭ 
  12. "Nobel winner enters Bangladesh poll"আল জাজিরা। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭। 
  13. "Yunus drops plans to enter politics"আল জাজিরা। ৩ মে ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০০৭